একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -৩৪

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩৪
#WriterঃMousumi_Akter.
ঘড়িতে সকাল নয়টা বেজে ১০ মিনিট।অনবরত ফোন বেজেই চলেছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল।চোখ পুরোপুরি খুলতে পারলাম না,ঘুমে চোখ এঁটে ধরছে।মাথাও কেমন যেন ভারী হয়ে আছে।ভোর রাতে রিসোর্ট থেকে ফিরে ঘুমিয়েছি।রিসোর্টের কথা মনে হতেই মনে পড়ে গেল কাল রাতের ঘটনা।কী সাংঘাতিক লজ্জাকর ছিল সেই মুহূর্ত! ভেবেই আবারও লজ্জা লাগছে আমার।মুহূর্তের মাঝেই ঠোঁটজুড়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসির ছড়াছড়ি বয়ে গেল আমার।পাশে তাকিয়ে দেখি ওনি উদাম শরীরে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছেন। একটা হাত আমার পেটের উপর দিয়ে আমাকে আবদ্ধ করে রাখা।এই মানুষটার মাঝে এত আবেগ,এত অনুভূতি, এত রোমান্স আছে বুঝতেই পারিনি!আচ্ছা! এসব না থাকার-ই বা কারণ কী?এসব থাকাই তো স্বাভাবিক।ওনার প্রফেশনের সাথে জুড়ে দেওয়া ট্যাগ অত্যন্ত সম্মানজক।ওনি একজন লেকচারার,মানে শিক্ষক।শিক্ষক বলেই যে তার মাঝে প্রেম ভালবাসা, রোমান্স এসব থাকবে না এমন তো কোনো নিয়ম নেই।ওনি কম বয়সে লেকচারার হয়েছেন।ওনাকে বুড়ো ভাবারও কারণ নেই।

ফোনের রিংটোন থামছেই না।কী অসহ্য!কে এত সকালে ফোন দিচ্ছে!ওনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন, ‘সারাহ!প্লিজ স্টপ দ্যা ফোন।’ বলেই বালিশ টেনে নিয়ে কানের উপর চেপে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করছেন।ওনার ঘুম ঘুম কণ্ঠেও যেন একটা নেশালো ভাব আছে।আমাকে কেমন নেশা ধরিয়ে দিল।কাউকে ভালো লাগলে বুঝি তার সব-ই ভালো লাগে!

ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে ছোঁয়ার নাম্বার।ফোন রিসিভ করে বললাম, ‘ডা -য় – নি মহিলা!এত ভোরে কী জন্য ফোন দিচ্ছিস?তোর জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল।’

‘এত ভোর! সিরিয়াসলি? তোর ওই হাড় কিপ্টা জামাই-এর কী একটা ঘড়িও নেই সারাহ?শোন,তোর জামাইরে রাস্তায় বসায় দেব। ফুটো প্লেট দিয়ে।মানুষ যে চারআনা করে দিবে তাই দিয়ে ঘড়ি কিনে দেবো।’

‘আবার জামাই নিয়া পড়লি ক্যান সাত সকালে?’

‘তোর কোনো টাইম সেন্স নেই এই জন্য বললাম।সাড়ে নয়টা বাজে।আর তুই বলছিস এত্ত ভোর?’

‘ওহ! বেজে গেছে না?’

‘ওয়েট,এত বেলা করে ঘুমোচ্ছিস কেন?নিশ্চয়ই সারারাত পড়ালেখা করেছিস?কী-রে সারাহ তুই তো বিশাল পড়ছিস!এত পরিমান বই পড়িস আর আমাদের এসে বলিস,” কিচ্ছু পড়িনিরে আমারে একটু দেখাস।”যাইহোক বেইবি এইবার কিন্তু তোর মারাত্মক ভালো রেজাল্ট হবে, দেখে নিস।’

‘আমি সারারাত বই পড়েছি?’

‘তা ছাড়া কী?’

‘একজন বিবাহিত মেয়ে কী করে বোঝো না?’
‘সমস্যা কী? তোর জামাই তো আনরোমান্টিক।তোকে তো আর ডিস্টার্ব করে না।একটা চুমু দিয়েছে এখনো?’

‘আল্লাহর ওয়াস্তে আর আনরোমান্টিক কইস না। আমি মাফ চাই।ফোন দিছিস ক্যান তাই বল।’

‘দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়।’

‘কাল পরীক্ষা! আজ কই যাব?’

‘পরীক্ষা তো কী!এত পড়ে কী হবে?’
‘যাবি কই?’

‘আমি আর তন্ময় ঘুরতে যাব।বাসায় বলেছি তোর সাথে ঘুরতে যাচ্ছি।এখন তুই না গেলে হবে?’

‘বাহ!আমার নাম ভাঙিয়ে আর কতকাল খাবি তুই?না জানি কবে তোর ফ্যামিলি থেকে আমারে জু ”তা মা” রে।’

‘তুই রেডি হয়ে নে আগে।’

‘না ছোঁয়া, প্লিজ রাগ করিস না।আমার শরীর ভালো লাগছে না।তাছাড়া আজ একটা বিশেষ দিন।আমি যেতে পারব না।’

‘বিশেষ দিন!কীসের?’

‘কিছু না! তুই যা ঘুরে আয়।’

‘শোন,বাই এনি চান্স আমার বাসা থেকে যদি তোকে ফোন দেয় তাহলে বলবি আমি তোর পাশে আছি।ওকে?’

‘ওকে।’

বিছানা ছেড়ে উঠতেই চোখ গেল তন্ময়ের দেওয়া ফটোফ্রেমের দিকে।দু’ঠোঁটে মৃদু হাসি চলে এলো।কাল যে ওনার বুকে মাথা রেখে দু’জনে জলাশয়ে পা ডুবিয়েছিলাম সেই ছবি।ওনি কি কাল রাতেই ওই রিসোর্ট থেকেই ছবি প্রিন্ট করিয়ে এনেছেন!কী দারুণ লাগছে দেখতে!বিশেষ করে ওনাকে বেশি সুন্দর লাগছে।ওনি অনিমেষ চেয়ে আছেন আমার মুখশ্রীতে।ছবিতে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম।ওনাকে এত কিউট লাগছে;একটা চুমু না দিলেই নয়।

ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেলাম।শাশুড়ির ভাতিজি জিনাত এসেছে।দু’জনে বসে কী সামালোচনা করছে জানি না।গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনাত।শাশুড়ি নিচে বসে বড়ো একটা গামলায় চাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।সাইডেই দাদু বসে আছেন।দাদুর খুব কাশি হয়েছে।তরী নেই যে ভোরে উঠেই আগে কার কী সমস্যা সেটা দেখবে।ইশ!উচিত ছিল দাদুর জন্য আদা চা বানানো।রোশান স্যারও আদা চা ছাড়া খান না।আজ থেকে ওনার খুব যত্ন নিতে হবে।সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় আসেন।নিজের চা নিজেই করে খাচ্ছেন।আমাকে কখনো বলেনও না।নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে নেন।আমারও উচিত ওনার সেবাযত্ন করা।শাশুড়ি ঠিকভাবে রান্না করেন না।ওনি বেশিরভাগ টাইম-ই বাইরে খাচ্ছেন আবার আমার জন্যও খাবার নিয়ে আসছেন।এতে ভালোর ভালো কিছুই হচ্ছে না।আজ থেকে রান্নার দিকে খেয়াল দিতে হবে।আমি কিচেনের দিকে গেলাম।গ্যাসে পানি গরম করতে দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।দাদু বারান্দায় বসে কাশছেন।কফ বাইরে ফেলতে গিয়ে বারান্দায় পড়ে গেল।

জিনাত নাক সিটকে বলল,

”ছিঃ!পরিবেশ-ই নষ্ট।এইভাবে কেউ ফ্লোরে কফ ফেলে?ফুপি এইসব সহ্য করো কীভাবে?চোখের সামনে এসব কিন্তু সহ্য করা যায় না।হাউ ডিসগাস্টিং!আমি কতদিন ভাত খেতে পারব না তার ঠিক নেই!দেখেই বমি পাচ্ছে আমার!”

শাশুড়ি দাদুর দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্তির সাথে বললেন,”আচ্ছা বাবা আপনার কি কোনো আক্কেল নেই?এত দামি ঘরবাড়িতে আপনি এসব কীভাবে ফেলেন?এটা কি আপনার আগের কালের মাটির ঘর?আপনার জন্য বাড়ির পরিবেশ-ই নষ্ট।দুনিয়ায় আরও বুড়ো মানুষ আছে কেউ আপনার মতো পি – শা – চ না।”

জিনাত আরও বেশি মুখ সিটকে বলল,

“ফুপি ওনার আয়ু আছে বলতে হয়।ওনার বয়সী কেউ বেঁচে নেই।দাদুর থেকে আরও অনেক কম বয়সী মানুষ কিন্তু মা** রা গেছে।আর কতদিন তোমাদের জ্বালাবে তার ঠিক নেই!”

দাদুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।কাতর কন্ঠে বলল,

“আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি বউমা।বুঝতে পারিনি।বাইরে ফেলতে গেছিলাম ভেতরে পড়ে গিয়েছে।”

‘আপনি তো আপনার মেয়ের বাড়ি গিয়েও কিছুদিন থেকে আসতে পারেন বাবা।না মানে আপনার প্রতি দায়িত্ব কি শুধু আপনার ছেলের একার-ই?জমি তো ভাগ করে ঠিকই মেয়ের অংশ মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।দু’দিন যান দেখবেন দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিবে।বেশিরভাগ মানুষ তো বৃদ্ধকালে মেয়ের বাড়ি গিয়েই থাকে।আপনার জন্য কি আপনার মেয়ের বাড়িতে একবেলা ভাতও জোটে না?’

জিনাত বলল, “ফুপি ওনাকে খেতে দেওয়ায় উচিত নয়।ওনি কিন্তু ইচ্ছা করে সারাহকে রোশান ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে এনেছেন।ওনি জানেন ফার্নিচার,গহনা,টাকা এসব দিবে বললেই তুমি রাজি হয়ে যাবা।ওনার প্লান-ই ছিল তোমাকে টাইট দেওয়া।এইজন্য সারাহ’র মতো উৎশৃংখল বেয়াদপ-বেপরোয়া একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।আর তরীরও ছেলে নিয়ে বাইরে থাকার মতো এত সাহস কিন্তু হতো না ।মেইন কালপ্রিট এই বুড়ো।আজকে আমার সাথে রোশান ভাইয়ার বিয়ে হলে কী তোমার কপালে এত দুঃখ হতো?”

‘বিয়ে হয়েছে তাতে কী?আমার ছেলে কি পঁচে গিয়েছে?তরীকে বিদায় করেছি সারাহকেও বিদায় করে দুই ছেলের আবার বিয়ে দেব।’

এক কাপ চা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলাম।দাদুর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললাম, ‘দাদু আদা চা।খেয়ে ফেলুন দেখবেন একদম সুস্থ হয়ে গিয়েছেন।’
দাদু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ‘তোর ফুফু শাশুড়িকে একটু ফোন কর তো।আমি একটু বেড়াতে যাব।’
‘কোথাও যাওয়া হবে না আপনার দাদু।আপনি ছাড়া আমার ভালো লাগবে না।’
‘শোন আসব।তোর পরীক্ষা শেষ হোক ততদিন একটু ঘুরে আসি।অনেক দিন মেয়েটাকে দেখি না।সেই তোর বিয়েতে এসছিল।আর আসেনি।’
‘দাদু আমারও মনে হচ্ছে আপনি কিছুদিন ফুপি বাড়ি গিয়ে থাকলে কিছু মানুষকে জব্দ করতে আমার সুবিধা হতো।’
এর-ই মাঝে ওশান বাইক নিয়ে বাইরে থেকে এসে বলল,
‘আম্মা চা দাও।’
জিনাত বলল, “ফুপি আমারও চা খেতে মন চাচ্ছে।”
শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সারাহ সবাইকে চা দাও।”

দিচ্ছি বলে গ্রিল দিয়ে বাইরে থু থু ফেলতে গিয়েই সেটা পড়ল জিনাতের মুখে।জিনাত কেমন রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!মুহূর্তের মাঝে চেঁচামেচি শুরু করে বলল, ”তুমি আমার মুখে থুথু ফেললে কেন?”
আমি ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,

“তুমি গ্রীল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছো কেন?আমি গ্রীল দিয়ে বাইরে ফেলতে গেছি তোমার মুখে পড়ছে।আমি কী করব?আমি ইনোসেন্ট আমার কোনো দোষ নেই।’
‘এক্ষুনি আমার মুখ থেকে থুথু পরিষ্কার করো।আজ কিন্তু বাড়াবাড়ি রকম কিছু একটা হয়ে যাবে।’
‘পারব না। কী করবে তুমি?’
‘পারবে না মানে? মগের মুলুক পেয়েছ?তুমি না তোমার ঘাড় পারবে!’
‘ততক্ষণে শুকিয়ে যাচ্ছে তোমার গালে।’.
‘আমি আবার বলছি পরিষ্কার করো।’
‘কেন পরিষ্কার করব?আমার পথের সামনে এসে তুমি দাঁড়িয়েছ?আমার পথে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমি তাকে ছাড় দিতে পারি না আপু।,’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’
‘এই যে গ্রিল আর আমার মধ্যে ছিলে।থু থু খেলে।’
‘তোমার মতো বেয়াদব আর ফালতু মেয়ে দুনিয়াতে নেই!’
‘বাই দ্যা রোড জিনাত আপু,ফ্লোরে কাশি পড়াতে তো তোমার দারুণ ঘৃনা লাগল।এখন মুখে থু থু লাগল।কী করবে?মুখ কে**টে ফেলবে?কে*টে* ফেলা-ই উচিত। কারণ অনেক ঘৃণা বলে কথা!’
‘তুমি ফ্লোরের সাথে আমার মুখের তুলনা করছো?’
‘নিজেই বুঝে নাও।এবার বলো কবে মরবে আপু তুমি?তোমার চল্লিশা খাব কবে?’
‘হোয়াট? এই মেন্টাল মেয়ে কী-সব বলছো?’
‘তোমার থেকে কম বয়সী অনেকে মারা গিয়েছে,সেই হিসাবে দীর্ঘায়ু তোমার।এতদিন কীভাবে বেঁচে আছো?বিশেষ কোনো শক্তি পেয়েছ?দৈব পাওয়ার?’
চলবে,,?
(কাশির ওষুধ খেয়েছি।তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আজকের পার্ট লিখেছি। এই জন্য ছোটো হয়েছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here