একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -৩৯+৪০

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩৯+৪০
#WriterঃMousumi_Akter.
ফোন কেটে লজ্জায় মুখে হাত দিলাম।দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকলাম।ইশ!কী লজ্জা!এই গুরুগম্ভীর মানুষটা এত চেঞ্জ হয়ে গেল কীভাবে!ওনার সামনেই আর যাব না।এরই মাঝে হঠাৎ রাস্তার ঘটনাটা মনে পড়ল।নিমিষেই মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল আমার।মাথার মধ্যে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।কেমন অস্বস্তি ফিল হচ্ছে।কী বিশ্রী ছিল সেই স্পর্শ!ভেবেই শরীরের সমস্ত চামড়া শরীর থেকে আলাদা করে দিতে ইচ্ছে করছে।

এরই মাঝে তরীর ফোনের মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠল।পর পর তিনবার বাজল।মৃন্ময়ের নাম দেখে বেশ অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রীনে তাকালাম।শাটার টেনে দেখলাম প্রথম মেসেজ,
”আমার রিকুয়েষ্টটা কী রাখবেন মিস তরী?
জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের কাছে রিকুয়েষ্ট করেছি।আশা করি রিকুয়েষ্টটা ফেলবেন না।”

কীসের রিকুয়েষ্ট! কী রিকুয়েষ্ট!মনের মাঝে তুমুল কৌতুহল শুরু হলো।মৃন্ময় কী রিকুয়েষ্ট করতে পারে তরীর কাছে!ঠোঁট কামড়ে ধরে বিষয়টা ভাবতে শুরু করলাম।কী হতে পারে কাহিনি!আমি কি তরীর ইনবক্সে ঢুকব!ঢোকা কি ঠিক হবে!নাহ এটা লেইম ইস্যু হয়ে যাবে।কিন্তু কী রিকুয়েষ্ট সেটাও আমাকে জানতেই হবে।না হলে ঘুমই আসবে না।লেইম ফেইম যা ইস্যু হবে হোক।তরী তো আর কারো সাথে প্রেম ট্রেম করে না যে এমন পারসোনাল কোনো ইস্যু থাকতে পারে!
মেসেঞ্জারে আমি, রোশান স্যার,ফুফু শশুড়ির মেয়ে, পিহু আর মৃন্ময় ছাড়া আর কেউ নেই।ভাবতে ভাবতে প্রবেশ করলাম তরীর মেসেঞ্জারে।

মৃন্ময়ের ইনবক্সে ঢুকে সামান্য একটু উপরে গেলাম।তরীর নিক নেইমও দিয়ে ফেলেছে অলরেডি মৃন্ময়।’মায়াবিনী’।কাল রাতের মেসেজ থেকে পড়া শুরু করলাম,

‘ঘুমিয়ে গিয়েছেন?
‘না,বাবু জেগে আছে এখনও।’
‘ওহ!খেয়েছেন রাতে?’
‘হুম।’
‘সব সময় এমন মলীন মুখে থাকেন কেন মিজ তরী?’
‘হাসি-খুশি থাকার মতো কোনো কারণই তো আমার জীবনে নেই ভাইয়া!’
‘ভাইয়া?’
‘হুম।’
‘প্লিজ ডোন্ট কল মি ভাইয়া।’
‘কেন?’.
‘সোজা-সাপ্টা কথা বলি, আমি আপনাকে বোনের নজরে দেখি না।আর দেখাও পসিবল নয়।’
‘এসব কী বলছেন?’
‘যা সত্য তাই বলছি।’
‘এসব আর বলবেন না প্লিজ।’
‘আমি বড়ো বেপরোয়া ছেলে মিজ তরী।যা বলি তাই-ই করি।এখন বলুন,আপনি কেন হাসেন না?’
‘হাসতে ভালো লাগে না।’
‘কেন লাগে না?’
‘সবই তো জানেন।আমার মতো মেয়ের জীবনে কীভাবে হাসি আসবে?নিজের কোনো ঘর নেই,নিজের স্বামী যাকে অবলীলায় ছেড়ে গিয়েছে।দীর্ঘ দিনের সংসার থেকে বিতাড়িত। তার কাছে হাসি আশা করেন কীভাবে?এসব আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে।’
‘আপনিও একদিন হাসবেন,আপনার হাসি দেখে পুরো বিশ্ব মুগ্ধ হবে।আপনি একদিন নিজের জন্য হাসবেন,নিজের জন্য বাঁচবেন।’
‘এসব জটিল কথা তো বুঝি না।তবে এটুকু জানি আমার জীবনে হাসি আনন্দ কোনদিন ছিল না,আর আসবেও না।’
‘বাইরে চাঁদ দেখেছেন? দারুণ না চাঁদ টা? যেদিন জ্যোৎস্নাময় রাতে ওই আলোয় গা ভেজাবেন কারো সাথে,সেদিন বুঝবেন জীবন সত্যি সুন্দর! ভালবাসাও সুন্দর। তবে সেটা ওশানদের মতো লম্পট মানুষদের সাথে নয়।এই বেঈমানীর দুনিয়ায় এখনও শুদ্ধতম ভালবাসার মানুষ আছে।যাদের সঙ্গ পেলে জীবন সত্যি সুন্দর হয়।’
‘দেখুন আমি ডিভোর্সি, ছেলে আছে। এসব ভাবতেও চাই না।’
‘আপনিও একদিন ভাববেন।’

পরের দিন সকালের মেসেজ

‘শুভ সকাল মিস তরী।’
‘শুভ সকাল।’
‘ঘুম থেকে উঠলেন কখন?’
‘অনেক ভোরে’
এত ভোরে উঠে কী করেন?
নামাজ পড়ি,হাতের কাজ করি,আপনাদের ডেলিভারি দেওয়ার গহনার সেটিংস ঠিক করলাম।’
আপনার হাতের কাজ সত্যি নিখুঁত ,যে কোনো মানুষের নজর কাড়তে বাধ্য হবে।’
‘বেশি বলছেন না?’
‘বেশি কোথায়?বরং কমই বলছি।’
‘বুঝেছি সেটা আমি।’
‘আপনার সাথে আমাদের একটা ডিল শুরু হবে আজ থেকে।আর আমরা কিন্তু বিজনেস পার্টনারদের উপহার দিয়ে থাকি।’
‘আমার উপহার লাগবে না’
‘এখানে লাগা কিংবা না লাগা ফ্যাক্ট নয়।দিতে হয় এটাই নিয়ম।’
‘তাহলে তো আমাকেও দিতে হবে।কী দেব আপনাকে?’
‘বেশি কিছু না।এক প্যাকেট সিগারেট দিলেই হবে।’
‘আপনি সিগারেট খান নাকি?’
‘হুম’।
‘কেন?’
‘ছোটো বেলায় এক ললনা ছ্যাঁকা দিয়েছিল।মাঝে মাঝে মনে পড়লেই খাই।’
‘ছোটো বেলার ছ্যাঁকা মনে রেখেছেন?’
‘মনে রাখব না!মেয়েটা আমার হৃদয় দখল করে নিয়েছিল পুরোপুরিভাবে।’
ছ্যাঁকা দিল কেন?’
‘বিয়ে হয়ে গেল!’
‘আপনার সাথে পড়ত?’
‘নাহ!মেয়েটার বাড়ি আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশেই।গ্রামে যেতাম আর মেয়েটাকে দেখে দেখে মুগ্ধ হতাম।কী মুগ্ধ করা চাহনি ছিল!সরলতার উপমা ছিল। এমন অবুঝ চাহনি ছিল যাকে দেখে ভালো না বাসলেও অন্যায় হতো।’
‘তারপর?
‘আমি প্রপোজ করার আগেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেল।আর কোনদিন দেখাই পেলাম না।না চাইতেও দারুণ একটা ছ্যাঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেলাম।অনেক খুঁজেছি।তার দেখা আর মিললই না!সেই যে হারাল আর ফিরে এলো না!’
‘আর কোনদিন দেখা পাননি?’
‘পেয়েছি ৫ বছর পর।’
‘এখনও ভালোবাসেন তাকে?’
‘সিগারেটের ধোঁয়ারা জানে বাসি কি-না।’
‘এতদিন পরে দেখা হলো সে কিছু বলেনি আপনাকে দেখে?’
‘কী বলবে? সে মেয়ে জানেই না যে তাকে আমি লাইক করতাম।’
‘তাহলে বিয়ে করে নেননি কেন তাকে?তাহলে তো হারাত না।’
‘কীভাবে করব?আমার তখন কতটুকুই বা বয়স।ওই বয়সে বিয়ের কথা ভাবা যায়? বিয়ের কি কিছু বুঝতাম!’
‘তাহলে মেয়েটি আপনার না হওয়া প্রেমিকা ছিল?’
‘হুম।’
‘ভেবে আর কী হবে!’
‘এইজন্য খুব ইচ্ছে করে ভেঙে যাওয়া কোনো হৃদয়ে ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে।’
‘তাই?’
‘হুম।বাই দ্যা ওয়ে,আপনাকে কেউ প্রপোজ করেনি?’
‘ওই করত ক্লাসমেটরা।’
‘আর কেউ নেই যাকে চিনেন না, জানেন না।এমন কেউ ছিল না?’
‘এক বান্ধবী একটা চিঠি দিয়েছিল।ছেলেটা কে ছিল তা জানি না।জানার আগেই বিয়ে হয়ে গেল!’
‘আপনিও তাহলে কারো না হওয়া প্রেমিকা?’
‘সেরকমই’
‘আপনার হাতের রান্না খেতে চাই কিন্তু।শুনেছি দারুণ রান্না করতে পারেন আপনি!’
‘যতটা শুনেছেন ততটাও না’
‘এসব বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।খাওয়াবেন না তাইতো?
‘না খাওয়াব।’
‘আপনার গিফট এবং বাজার নিয়ে যাব।আশা করি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবেন।’
‘জি,চেষ্টা করব।’

সকাল ১০টার মেসেজ;
“প্লিজ শাড়িটা পড়বেন কিন্তু।আর শাড়ি চুড়ি পরেই আসবেন।”
‘দুঃখিত আমি পারব না।’
‘কেন?’
‘এগুলা উচিত নয়।আমার পক্ষে সম্ভবপর নয় কারো দেওয়া শাড়ি চুড়ি পরা।’
‘আমার রিকুয়েষ্ট আপনি পরবেন।’
‘আমাকে হাজারবার রিকুয়েষ্ট করলেও আমি পরব না।’

তরীর ফোনের মেসেজগুলো দেখে মনে হলো মৃন্ময়ের উইকনেস তৈরি হয়েছে তরীর প্রতি।হঠাৎ মনে হলো মন্দ হতো না মৃন্ময় আর তরীর মিল হলে।কিন্তু তরী কি আর এই মুহূর্তে মেনে নিবে এসব!বা কোনদিনই কি মেনে নিবে!সময় যাক, হয়ত সময়ের সাথে সাথেই আপনা আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে।তরী বুঝতে শিখবে ওর লাইফে বেটার কাউকে প্রয়োজন।
_____________________________
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো।তরীর বানানো গহনাগুলো নিয়ে রওনা হলাম মৃন্ময়দের দোকানের উদ্দেশ্যে। তরী মৃন্ময়ের দেওয়া শাড়িটা পরেনি।থ্রি পিছ-ই পরেছে।মেয়েটা বোধহয় এসব থেকে দূরে থাকতে চাইছে।আমিও আর এসব ব্যাপারে কিছুই বললাম না।কিছুক্ষণ পরেই মৃন্ময়দের দোকানে পৌঁছিয়ে গেলাম।মৃন্ময়দের দোকানে ঢুকতেই দেখলাম মৃন্ময় আড়চোখে তরীর দিকে তাকাল।তবে তরী তাকাল না।তরীর দৃষ্টি দোকানে রাখা বিভিন্ন ফুলের গহনার দিকে।মৃন্ময়ের বাবা আমাদের দেখে স্বভাব সুলভ হাসলেন।আমি আর তরী সালাম দিলাম,আঙ্কেল সালামের উত্তর দিয়ে কর্মচারী ডেকে গহনার বাক্সগুলো দোকানে নিতে বললেন।কর্মচারীরা গহনার বাক্সগুলো দোকানে তুলল।তারপর কর্মচারীদের বললেন,”যা খাবার নিয়ে আয়।”
খাবারের কথা শুনে বললাম, ”না না আঙ্কেল মাত্রই খেয়ে এসছি।আমরা খাব না।”
‘আরে মা আঙ্কেলের দোকানে এসেছ খালি মুখে কীভাবে যাবে শুনি?’
আঙ্কেল মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”ভেতর থেকে টুল আর চেয়ার দাও বাবা।”
মৃন্ময় টুল আর চেয়ার এগিয়ে দিল।আমরা তিনজনে দোকানের মাঝে বসলাম।আঙ্কেল আর মৃন্ময় দুজনে গহনাগুলো খুলল।
মৃন্ময় দেখেই বলল,
”বাহ!গহনাগুলো কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে।”
আঙ্কেল বললেন, ”বাহ!দারুণ হাতের কাজ!এত সুন্দর নিঁখুত কাজ কিন্তু আগে দেখিনি বললেই চলে।”
আমি আঙ্কেলকে বললাম, ”আপনাকে তো সব বলাই আছে আঙ্কেল।নতুন করে কিছুই আর বলার নেই।কোনো সমস্যা হলে বলবেন।”
‘আচ্ছা মা রেখে যাও,বিক্রি হলে আমি জানাব।’
‘ঠিক আছে আঙ্কেল।’
এরই মাঝে কর্মচারী কোল্ড ড্রিংক্স,আইসক্রিম,গরম সিঙ্গাড়া নিয়ে এলো।গরম সিঙাড়া আর আইসক্রিম খেতে খেতে যাবতীয় কথা শেষ করলাম।মৃন্ময় রোহানকে কোলে নিয়ে সামলাচ্ছে।পিহু টিফিনবক্সটি মৃন্ময়ের হাতে দিয়ে বলল, ”ভাইয়া তরী আপু রান্না করেছে।”
মৃন্ময় তরীর দিকে মৃদু হেসে টিফিন বক্সটা হাতে নিল।কথা শেষ করে বেরোতে বেরোতে পড়ন্ত বিকাল!সূর্যের তাপ মোলায়েম হয়ে এসেছে।উত্তপ্ততা কাটিয়ে মিষ্টতা ছড়াচ্ছে।মৃন্ময়কে বললাম,
”আমাদের একদিন সিনেমা দেখা না মৃন্ময়।”
‘টাকা নেই।’
‘দুইদিন রিক্সা চালা।টাকা হয়ে যাবে।’
‘কী বললি?তোরে সিনেমা দেখানোর জন্য রিক্সা চালাব আমি?’
‘তো! খারাপ প্রস্তাব না কি?তুই যদি সিনেমা না দেখাস মৃন্ময়, তুই যে সিগারেট খাস সেই পিকচার আছে আমার কাছে।সোজা তোর বাপরে দেখাই দিব।বুঝবি কেমন লাগে।’
‘বন্ধু জাতির কলঙ্ক তুই।ছবি ডিলিট দে কিন্তু সারাহ!’
‘জীবনে ডিলিট দিব না।তোকে জব্দ করতে সারাজীবন রেখে দিব এই ছবি।’
‘ডিলিট না দিলে তোর বর শালারে গাছের সাথে ব্যাঁন্ধে রাখব কড়া রোদে।’
আমি জোরে হেসে দিলাম।আমার হাসি দেখে মৃন্ময় বলল,
”হাসিস ক্যান?”
‘আমার জামাই যেদিন দেখবি রে মৃগে রোগী,সেদিন বুঝবি।’
‘হ শালারে দেখার অপেক্ষায় আছি আপা।’
‘আমারে পৌঁছে দিয়ে আয়।’
‘তোর জামাইরে বল আসতে,নিয়ে যাক।’
‘আমার জামাই আসলে স্ট্রোক করবি বুঝলি?তাই আপাতত না দেখাই ভালো হবে তোদের জন্য।’
‘ক্যান রে? ‘
‘আছে আছে।’

এরই মাঝে রোশান স্যারের মেসেজ এলো।”আমি মনিহারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তুমি এসো।”
ওদেরকে বিদায় জানিয়ে রিক্সা নিয়ে মণিহারের সামনে এসে থামলাম।মনিহারের সামনে আসতেই দেখি হাতের চাবির রিং ঘুরাচ্ছেন আর বার বার ঘড়ি দেখছেন ভদ্রলোকটি।পরনে সাদা গ্যাবাডিং, গায়ে কালো গেঞ্জি।অস্তমিত সূর্যের মৃদু আলো তার মুখে পড়েছে। শ্যামসুন্দর পুরুষটিকে দেখে ভীষণ আকারে ক্রাশ খেয়ে ফেললাম ।ওনাকে দেখেই মনে পড়ল দুপুরের সেই কুৎসিৎ ঘটনার কথা।চেহারায় কেমন মলিনতা চলে এলো আমার।আমি মলিন মুখে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম।
ওনি অভিজ্ঞ নয়নে তাকালেন আমার দিকে।আমার মলিন মুখ দেখে ওনি সন্দিহান ভাবে তাকালেন আমার দিকে।বেশ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ”কী হয়েছে তোমার?”
আমার হঠাৎ কেমন কাঁন্না পাচ্ছে।ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসছে।আগে কেউ কিছু বললে আহ্লাদে আম্মু আর বাবাকে কেঁদে কেঁদে সব বলে দিতাম।আজও আমার সেই অনুভূতি হচ্ছে।পৃথিবীর সব থেকে কাছের মানুষ-আপন মানুষের কাছে বোধহয় জীবনের সব খারাপ ঘটনা শেয়ার করা যায়।আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ”তোমার কী শরীর খারাপ? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমার চোখ মুখ?”
বলেই আমার কপালে হাত রাখলেন।সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কীভাবে তাকিয়ে আছে!যেন কোনো সিনেমার শুটিং দেখছে।ওনি আমার এক গাল থেকে আরেক গালে হাত ছুঁইয়ে বললেন,
”কেন এমন লাগছে তোমায়?”
আমি আশেপাশের মানুষের দিকে তাকালাম।আমাকে তাকাতে দেখে ওনিও তাকালেন।আমার কপাল আর গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললেন, ”কী হয়েছে?”
‘না,কিছু না।কেমন ক্লান্ত লাগছে।’
‘শুধুই ক্লান্তি?’
‘তাই ছাড়া কী হবে?’
কিন্তু আমার এমন মনে হচ্ছে কেন?তুমি কিছু লুকাচ্ছ?’
মানুষটা কেমন আমার চোখ-মুখ দেখেও সব বুঝতে পারে।এটাই বোধহয় সত্যিকারের ভালবাসা।কিছু না বললেও বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাটাই হলো ভালবাসা।
‘তাহলে বাইকে ওঠো।’
ওনি হেলমেট মাথায় দিয়ে,ফোন পকেটে গুঁজে, আমার মাথায় একটা হেলমেট পরিয়ে দিয়ে বাইকে বসে স্টার্ট দিলেন।আমি উঠে বসে বললাম,”
“চলুন।”
‘উঠেছ?’
‘হুম’
‘ওভাবে বসেছ কেন?’
‘কীভাবে?’
‘আমার কাঁধে হাত রেখে বসো।না হলে পড়ে যাবে।’
আমি ওনার কাঁধে হাত রেখে বসলাম।
সন্ধ্যার মৃদু আলোতে ধীর গতিতে বাইক চলছে।আমার মস্তিষ্কে সেই ঘটনা বারংবার পুররাবৃত্তি হচ্ছে।চুপচাপ বসে আছি।
ওনি বললেন, ”বাড়িতে মনে হয় কিছু একটা হচ্ছে!”
‘কী হচ্ছে?’
‘বুঝতে পারছি না।চারিদিক বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে।জিনাতকে দেখলাম আম্মার কাজে সহায়তা করছে।ওশান ওর ঘরের জন্য নতুন পর্দা কিনে এনেছে। নতুন বিছানার চাঁদর,নতুন বক্স খাট,নতুন একটা আলমারি।অবশ্য এসব টাকা আম্মাই দিচ্ছে।আম্মার একাউন্টে বাবার টাকা আছে।আম্মা সেসব টাকা দিচ্ছে।’
‘হঠাৎ সব নতুন কিনছে!কারণ কী?’
‘আমার বউ তো বিদুষী, তাই তার সাথে শেয়ার করছি।সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের না করে আমাকেই প্রশ্ন করছে!’
‘ওশান কী আবার বিয়ে করছে না কি?’
‘ভাব-লক্ষণ কিন্তু সেরকমই।কার কপাল পোড়াবে তাই ভাবছি।’
‘ওর মতো ছেলের সাথে বিয়ে করবে কে?’
‘কেন ওর তো রিলেশন আছে সেই মেয়েকে নিশ্চয়ই করবে।’
‘জিন্দেগীতেও সেই মেয়ে ওর সাথে আসবে না।’
‘আসবে আসবে।’
‘আসবে না।’
‘শোনো মেয়ে, আমার বয়স তোমার চেয়ে বেশি।তাই অনেক কিছুই বুঝি।ওশানের এত এক্সাইটেড ভাব কী জন্য?নিশ্চয়ই সেই মেয়ে আসবে সেই জন্য।এটা তো বোঝাই যায়।’
‘ওশান যাকে বিয়ে করুক আর যায় করুক সেই মেয়ে আসবে না দেখে নিয়েন।’
‘না এলেই ভালো।’
কিছুক্ষণ পরে ওনি আচমকা বাইক থামিয়ে বললেন,
”ফুচকা খাবে?”
‘না।’
‘কেন?’
‘ভালো লাগছে না।’
‘মন খারাপ?’
‘নাহ’
‘কেন মিথ্যা বলছ?তোমার এই মলিন চেহারার কারণ আমি বুঝেছি;কিন্তু কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
ফুচকাওয়ালাকে বললেন, “মামা এক প্লেট ফুচকা দিন।”
‘খাব না-তো! কেন দিতে বলছেন?’
‘খাবে না তাই না?আচ্ছা তোমার বন্ধুগুলো কোথায়?’
‘কেন?ওদের কি ফেইল করাবেন আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বলায়?’
‘ফেইল করালে আর কী কী বলবে তার ঠিক নেই।ট্রাস্ট মি তোমার বন্ধুজাতিকে আমি সব থেকে বেশি ভ**য় পায়।কখন কী বলে ইজ্জত খে* য়ে দেয়! ‘
‘শুনুন যতই হোক ওরা আপনার শা* লা /শা* লী কিন্তু।’
‘শা* লা /শা*লী?’
‘অবাক হওয়ার কী আছে? এটাই সত্য।’
এরই মাঝে ফুচকাওয়ালা ওনার দিকে প্লেট এগিয়ে দিল।ওনি একটা ফুচকা আমার মুখে পুরে দিয়ে বললেন, ”তোমাকে হাত লাগাতে হবে না।আমি খাইয়ে দিচ্ছি খাও।”
তার এত যত্নে দেওয়া ফুচকা কি না খেয়ে পারি!ফুচকা খেতে খেতে বললাম, ”আপনি খাবেন না?”
‘না এটা আমার প্রিয় খাবার না।’
‘তাহলে কী?’
‘দুপুরে দিয়েছিলাম ফোনে।ওটাই আমার প্রিয় খাবার।’
চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালাম ওনার দিকে।সাথে সাথে কাশি শুরু হলো আমার।ওনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ”কার এতো সাহস আমার বউকে স্মরণ করছে!”
কাশি শেষ হলে দোকান থেকে পানি খেয়ে বেরিয়ে বাইকে উঠলাম।ওনি আমাকে বাইকে করে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
”আমার কাজ আছে তুমি যাও।”
‘এখন কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কাজ আছে।’
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ”যাও,আসার সময় বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসব।গিয়ে পড়তে বোসো কিন্তু।”
আমি বাড়িতে ঢুকে দেখি সত্যি সব অন্য রকম লাগছে।জিনাত বেহায়ার মতো আবার এসেছে।আমাকে দেখে কী যেন ফিসফিস করে বলাবলি করছে।আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কাহিনি কী!এরা এত হাসি-খুশি কেন?এদের হাসি-খুশি মুখ মানে ভয়ংকর কোনো ঘটনার পূর্বাভাস।আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার রুমের তালা খুলে রুমে প্রবেশ করলাম।রুমে ঢুকে ভেবেই যাচ্ছি কী হতে চলেছে!আবারও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।উফফ!এত চিন্তা আর ভাল্লাগে না!
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এই অশান্তির মাঝ থেকে কোনো এক নির্জন-নিরালায়ে গিয়ে বসবাস করতে।পরনের জামা চেঞ্জ করে স্কার্ট আর গেঞ্জি পরে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ক্লান্তিতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।ঘুম ভাঙতেই দেখি রাত দশটা বেজে গিয়েছে।ওনি কি এসে গিয়েছেন?এত রাত হয়ে গিয়েছে।ওনি এলে কি আমাকে ডাকতেন না!দরজা তো লাগানোই আছে।ওনি কি আমাকে ডাকাডাকি করে না পেয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন!বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে দ্রুত দরজা খুললাম।চাতক পাখির মতো এদিক-ওদিক তাকালাম।কিন্তু বাইকও তো নেই।ওনি এখনও আসেননি!কেন আসেননি!ওনার নাম্বার ডায়াল করে ফোন দিলাম।টানা বিশবার ফোন দিলাম কিন্তু ফোনই তুললেন না।বুকের মাঝে অজানা এক ব্যাথায় চিনচিন করছে।অজানা এক ভ*য়ে অস্থির লাগছে।কী করব বুঝতে পারছি না।সাথে সাথে নেট অন করলাম।তিন ঘন্টা আগে এক্টিভ ছিলেন।এত টাইম অফ লাইনে কেন ওনি!ওনার তো নেট অন-ই থাকে।তাহলে অফ কেন?কিছু হয়নি তো!এসব কী ভাবছি আমি!কী হবে ওনার!ওনার কিছুই হবে না।মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া পড়ে প্রার্থনা করলাম।অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে আমার।কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।আমার বাবার নাম্বারে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
”বাবা তোমার জামাই-এর ফোন অফ! এত রাত হয়েছে এখনও বাসায় ফেরেনি।”
বাবা বললেন, ”আমার সাথে তো কথা হয়েছিল সন্ধ্যায়।আচ্ছা আমি দেখছি মা।তুমি চিন্তা কোরো না।”
বাবার ফোন কেটে ওনাকে মেসেজ করলাম,
“কোথায় আপনি?
অফ লাইনে কেন?
ফোন ধরছেন না কেন?
এত রাত!বাসায় আসেননি কেন?
আপনি ঠিক আছেন তো?
বলুন না প্লিজ!
এটা কিন্তু আমার জন্য ভয়নক একটা শাস্তি
দেখুন আমার কষ্ট হচ্ছে,
দম বন্ধ হয়ে আসছে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,
মিস ইউ,রিয়েলি মিস ইউ
প্লিজ রিপ্লাই দিন।
আই লাভ ইউ
আই রিয়েলি লাভ ইউ।”

মেসেজের কোনো উত্তর পেলাম না।চাতক পাখির মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছি।পাশের রুমে শাশুড়ি, জিনাত আর ওশান হাসাহাসি করছে।তার তো চিন্তাই নেই তার ছেলে বাসায় আসেনি।মা এমনও হয়!অন্য ছেলের অন্যায়ে কাজের সাথে যোগ দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে।
অপেক্ষা করতে করতে রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেল।এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করলাম।নামাজ শেষ করে জানালার গ্রিল ধরে একই ভাবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছি।চোখের কোয়া ফুলে গিয়েছে।রাত বারোটা পনের মিনিটে বাইকের শাব্দ কানে এলো।আমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালাম।ওনি বাইক স্ট্যান্ড করে রেখে ক্লান্ত শরীরে ঢুলতে ঢুলতে রুমে প্রবেশ করলেন।হাতে একটা প্যাকেট।ওনাকে দেখেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।বেসামাল ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।ওনি বেশ অবাক হয়ে হাতের প্যাকেট নিচে ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ”কী হয়েছে তোমার?এইভাবে কাঁদছ কেন?”
আমি আরও জোরে কেঁদে দিলাম।
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে আমার;কিছুই বলতে পারলাম না।ওনি আসার আগে কত কিছু ভেবে নিয়েছিলাম কিন্তু এখন কিছুই বলতে পারছি না।শুধুই কাঁদছি।
ওনি আমার দুই গালে ওনার দুই হাত দিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ”এইভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না।আমিও কেঁদে দেব।এমনিই আজ ভীষণ ক্লান্ত।বউ একটু আদর করবে সেবা যত্ন করবে।তা না করে কেঁদে আরও কষ্ট দিচ্ছে আমাকে।”
আমি বিছানায় গিয়ে বসে বললাম,”এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?আমার চিন্তা হচ্ছিল।”
ওনি হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললেন, দেখছিলাম আমার বউ আমাকে মিস করে কি না?”
‘এ কেমন দেখা বলে?আমার প্রা**ণ ই চলে যাচ্ছিল।’
ওনি ঘড়ি ড্রেসিং টেবিলের সামনে রেখে গায়ের গেঞ্জি খুলে আলনায় মেলে দিয়ে বললেন, ”টাওয়াল টা দিবে?ওয়াশ রুমে যাব।ফ্রেশ হতে হবে।”
আমি টাওয়ালটা ওনার হাতে দিয়ে অভিমান করে বিছানায় বসে রইলাম।ওনি কিছুক্ষণ পরে ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এলেন।গায়ে কিছুই নেই।ফ্লোর থেকে প্যাকেট তুলে একটা প্লেটে ভাত আর মাংস ঢেলে আমার মুখে দিয়ে বললেন, ”খাও।”
ভাত চিবাতে চিবাতে বললাম,
”আপনি কোথায় ছিলেন?”
‘আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।ভীষণ স্যরি তোমাকে জানায়নি।প্লিজ রা*গ কোরো না।’
‘আর ফোন তোলেননি কেন?’
‘ইশ!এত বিজি ছিলাম।এখনও ফোন চেক করিনি।’
‘আর খাব না।দুপুরে খেয়েছিলাম তো।আপনি খেয়ে নিন। ‘
‘খাচ্ছি।’
ওনি খাওয়া শেষ করে রুমের লাইট অফ করে আমার সামনে বসলেন।আমার ফোলা ফোলা চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী অবস্থা করেছ চোখের?”
‘কথা নেই আপনার সাথে।’.
‘তোমার অবুঝ অভিমান আর অবুঝ চাহনিতে আমি পা*গ*ল পরা প্রনোয়িনী’
‘আমি কোনো কথা বলব না।’
‘আমার বউ আমাকে এত ভালবাসে এত ভালবাসে?নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।আমার জন্য তোমার চোখের পানিও পড়েছে।’
‘আপনি জানেন চিন্তায় কেমন লাগছিল আমার?’
আমার সামনে একটা লাল গোলাপ ধরে বললেন, ”শত ব্যাস্ততার মাঝেও ভালবাসা কিনতে ভুলিনি আমি।ভালবাসি তোমাকে, নিজের থেকেও বেশি।হয়ত প্রকাশ করতে পারিনি।”
ওনার মুখে ভালবাসি কথাটা শুনে, আর ওনাকে দীর্ঘক্ষণ না দেখে সব লজ্জা ভুলে আবারও ওনার বুকে মাথা রেখে ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম।ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ওষ্ঠে চুমু দিয়ে বললেন, ”তখন আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিলে, একটা পুরুষকে ওইভাবে জড়িয়ে ধরে কেউ বোকা মেয়ে।এখন বোঝো সামলানো কী মুশকিল!পুরুষ সত্ত্বাকে এলোমেলো করে দেওয়ার শাস্তি তুমি পাবে এখন মেয়ে।”
এটুকু বলে ওনার আড়স্ট হাত আমার দুই গালে হাত দিয়ে ওষ্ঠে ওষ্ঠ ডুবিয়ে ডুব দিলেন গভীর ভালবাসাময় ছন্দে।আরও একটি রাত সাক্ষী হলো মধুচন্দ্রিমার।

চলবে?

বিঃদ্র –পর্যাপ্ত রেসপন্স না আসলে এত্ত বড়ো দিয়ে লাভ কী?সবাই রেসপন্স করবেন।অনুপ্রেরণায় পাঠকের শাক্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here