#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৫১
#নিশাত_জাহান_নিশি
আর এক মুহূর্তও ব্যয় না করে অয়ন্তীকে চেপে ধরল রাফায়াত! ফ্রেশ হওয়ার একটুখানি সময়ও দিলোনা অয়ন্তীকে। অয়ন্তীর কোনো কথাই যেন সে কানে তুলছিলনা! নিমিষেই তার অপরিমেয় ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলল অয়ন্তীকে!
ফুলসজ্জার রাত পেরিয়ে অয়ন্তী এবং রাফায়াতের জীবনে নেমে এলো স্নিগ্ধ, সুন্দর এবং প্রশান্তিময় একটি নতুন সকাল। পবিত্র ভালোবাসায় দুজনই পূর্ণ আজ। শরীর-মন দুটিই যেন তৃপ্ত। কত শত অপেক্ষা-দূরত্ব-দুঃখ-কষ্ট ভোগ করার পর নতুন এই সুখকর জীবনটিতে পদার্পণ তাদের। নতুন জীবনের শুভ সূচনাটি অয়ন্তীর ফজরের নামাযের মাধ্যমেই শুরু হলো! শুধু সে নয়। রাফায়াতকেও জোর করে ধরে বেঁধে কাঁচা ঘুম থেকে টেনে উঠালো অয়ন্তী। অতঃপর দুজনই একসাথে ফরজ গোসল শেষ করে একই সাথে নামাজে দাঁড়ালো! পণ করে নিলো আজ থেকে তারা দুজনই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে। নামায নিয়ে আর কোনো হেলাফেলা চলবেনা। আল্লাহ’র প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা নিতান্তই আবশ্যক তাদের। উপর ওয়ালা চেয়েছে বিধায় এত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে তারা অবশেষে এক হতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে তারা কোনোভাবেই আল্লাহ’র মনে কষ্ট দিতে চায়না।
নামাজ শেষ হতেই রাফায়াত কোনোমতে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে যেন অয়ন্তীর থেকেও বেশী ক্লান্ত সে! শরীর একদমই নাড়াতে পারছেনা যেন! হেলেদুলে বেসামাল হয়ে পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অয়ন্তী কিছুক্ষণ তসবিহ্ পড়ে পরিশেষে আল্লাহ’র সান্নিধ্যে বড়ো একটি মোনাজাত ধরল। পুরো মোনাজাত জুড়ে অয়ন্তী চুপিসারে কেঁদে গেল! তার বোনের জন্য দো’য়া চাইল। তার গোটা পরিবারের জন্য দো’য়া চাইল৷ বাপের বাড়ি থেকে শুরু করে শ্বশুড় বাড়ি এক এক করে সবার জন্য। রাফায়াতের শরীর স্বাস্থ্য যেন আল্লাহ্ সবসময় ভালো রাখেন, তাকে যেন আল্লাহ্ নেক হায়াত দান করেন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেন সফলকাম হতে সাহায্য করেন, ভালো স্বামী এবং ভালো ছেলে হওয়ার তৌফিক দান করেন এসব চাইতে চাইতে-ই কখন যে তার নিঃশব্দ কান্নার মাত্রা বেড়ে হেঁচকি ওঠে গেল তা বুঝতেও পারলনা অয়ন্তী! অমনি রাফায়াত ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠল। ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ দুটো তার আ’ত’ঙ্কে জর্জরিত হয়ে উঠল। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে সে জায়নামাজে অয়ন্তীর ঠিক পাশাপাশি হয়ে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল কখন অয়ন্তীর মোনাজাত শেষ হবে। আর কখন সে অয়ন্তীর কান্নার কারণ জানতে চাইবে। মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হতেই অয়ন্তীর মোনাজাত শেষ হলো। অমনি রাফায়াত ব্যাকুল হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল অয়ন্তীকে। শুকনো ঢোঁক গিলে ভরাট গলায় বলল,,
“কী হইছে তোমার? এভাবে কাঁদছিলে কেন?”
কান্না জড়িত বিবর্ণ মুখেও অয়ন্তী ফিচেল হাসল। রাফায়াতকে দু’হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরল। কোমল স্বরে বলল,,
“অতি সুখে কাঁদছিলাম রাদিফ! না চাইতেও আল্লাহ্ আমাকে এত সুখ দিলেন। বিগত ছয় সাত মাস আগেও আমি ভাবিনি যাকে আমি প্রতিনিয়ত স্বপ্নে চাইতাম সে এভাবে স্বপ্ন ভেঙে আমার বাস্তবে চলে আসবে! তার ভালোবাসায় আমাকে এতটা সিক্ত করে তুলবে। পবিত্র বন্ধনে আমাকে আবদ্ধ করে নিবে। পৃথিবীর সব সুখ আমার ভাগ্যে তুলে দিবে। এভাবে আমাকে ষোল আনায় পরিপূর্ণ করে তুলবে। এত সুখ একসাথে আমার সহ্য হচ্ছিলনা রাদিফ। তাই না চাইতেও আল্লাহ্’র কাছে হাত তুলতেই চোখে জল চলে এলো!”
রুদ্ধশ্বাস ফেলল রাফায়াত। চিন্তিত স্বরে বলল,,
“ইশশশশ। এদিকে আমি ভয় পাচ্ছিলাম কী হলো তোমার। বুকটা এখনো কাঁপছে আমার। কান পেতে দেখো।”
অমনি রাফায়াতের বুকের ঠিক বাঁ পাশটিতে অয়ন্তী তার কান ঠেকাল। সত্যিই হৃদস্পন্দন কাঁপছে তার। দ্রুত বেগে কাঁপছে। ধড়ফড় ধড়ফড় করেই চলছে। কান দুটো যেন তার ঝালাফালা হয়ে যাচ্ছে। মিটিমিটি হাসল অয়ন্তী। মিচকে স্বরে বলল,,
“আমাকে ছুঁয়ে আছেন বলেই বুকটা ওভাবে কাঁপছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে। থোরাই না আপনি আমাকে নিয়ে ভয় পান! আল্লাহ্ না করুক আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় নাচতে নাচতে তো তখন দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাবেন!”
তাৎক্ষণিক অয়ন্তীকে ছেড়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। অয়ন্তীর মুখের দিকে আর একটিবারের জন্যও তাকালো না সে। রাগে মুখটা যেন লাভার রূপ ধারণ করল! পরিপূর্ণ বি’ধ্ব’স্ত দেখাচ্ছে তাকে। মাথার চুলগুলো অতি জোরালো ভাবে টেনে ধরে সে খাটের কার্ণিশে জোরে এক লা’থ মারল! রাগে-জেদে গোঙাতে গোঙাতে সে এই সাত সকালে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল! ভয় পেয়ে গেল অয়ন্তী। ভাবতে পারেনি তার কথায় রাফায়াত এতটা রিয়েক্ট করবে! কী অশান্তি লাগালো সে বিয়ের পরের দিনই!
অয়ন্তী বুঝতে পেরে গেল পেছন থেকে রাফায়াতকে ডেকে কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাবেনা। বরং তার চ্যাঁচামেচিতে বাড়ির সবাই ওঠে যাবে। তাই তড়িঘড়ি করে অয়ন্তী জায়নামাজ থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হন্ন হয়ে দৌঁড়ে রাফায়াতের পিছু নিলো। পেছন থেকে রাফায়াতকে ধাওয়া করতেই হঠাৎ শাড়ির কুঁচি প্যাঁচিয়ে অয়ন্তী ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন্তী ব্য’থা’য় মৃদু স্বরে চিৎকার করে উঠল। হাঁটা থামিয়ে দিলো রাফায়াত। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সে পিছু ফিরে তাকালো। অয়ন্তীকে ঐ অবস্থায় দেখামাত্রই রাফায়াতের রাগ হাওয়ায় উড়ে গেল। মরিয়া হয়ে দৌঁড়ে এলো সে অয়ন্তীর দিকে। কোমড়ে ব্য’থা পাওয়া অয়ন্তীকে সে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো। অমনি চোখের জল ফেলতে থাকা অয়ন্তীর দিকে সে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“ব্য’থা লেগেছে বেশী?”
ব্য’থায় চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল অয়ন্তী। প্রত্যত্তুরে আহাজারি গলায় বলল,,
“আমি সোজা হতে পারছিনা রাদিফ।”
“তো কে বলেছিল পাকামো করে আমার পিছু নেওয়ার?”
“আপনিই তো রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন।”
“তোমার কারণে রাগ করেছি। তোমার জন্যে রাগ করেছি। যে কথাগুলো আমি শুনতে চাইনা জানি না কেন তুমি সেই কথাগুলোই আমাকে বেশী বেশী করে বলো। মাথা গরম করে দাও আমার।”
“হইছে তো। এর শা’স্তি তো আমি পেয়ে-ই গেছি! বিয়ের পরের দিনই কোমড় ভেঙেছি!”
“ভাঙেনি কোমড়। স্প্রে করে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
অয়ন্তীকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় উবুড় করে শুইয়ে দিলো রাফায়াত। গাঁ থেকে প্যাঁচানো শাড়িটা একটানে খুলে ফেলল। তড়িঘড়ি করে ডেস্কের ড্রয়ার থেকে কোমড়ের ব্য’থা সারানোর স্প্রেটি বের করে বিছানায় কা’ত’রা’তে থাকা অয়ন্তীর পাশে এসে বসল। ব্য’থা’যুক্ত জায়গাটিতে সে ভীরু হাতে কয়েকবার স্প্রে করে দিলো। অতঃপর হালকা করে জায়গাটিতে মালিশ করে দিলো। অয়ন্তী তো রাফায়াতকে ঐ জায়গাটিতে হাত-ই ছোঁয়াতে দিচ্ছিল না! ব্য’থা’য় আ’র্ত’নাদ করে প্রতিবার রাফায়াতের হাতটি সরিয়ে দিচ্ছিল। নাছোড়বান্দা রাফায়াতও কিছুতেই হাল ছাড়ছিল না। জায়গাটি ভালোভাবে মালিশ করে পরেই সে অয়ন্তীকে ছাড়ল! পনেরো থেকে বিশ মিনিট অয়ন্তীকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলল। অতঃপর আস্তে ধীরে ব্য’থাটা কমেও গেল।
ব্য’থা হ্রাস পেতেই অয়ন্তী গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। রাফায়াত বুঝতে পারল অয়ন্তী এখন ঠিক আছে। সুস্থ্য আছে। অয়ন্তীর ঘুমন্ত মুখটির দিকে একটু ঝুঁকল রাফায়াত। তার উষ্ণ ঠোঁটজোড়া অয়ন্তীর কপালে ছুঁয়ে দিলো! চোখের শুকনো জলগুলোকে মুছে দিয়ে অয়ন্তীর পাশে শুয়ে পড়ল। কয়েকদফা প্রশান্তির শ্বাস ফেলে সে ঘুমন্ত অয়ন্তীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল! ভোর হয়ে আসতেই দুজন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
পরের দিন বড়ো করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হলো। বিয়েটা সাদামাটাভাবে সম্পন্ন হলেও বৌভাতটা হেলায় ফেলায় নষ্ট করলনা রাফায়াত। এলাকার সর্বস্তরের মানুষদের দাওয়াত করছিল সে তার বৌভাতে। এমনকি তাদের দূরবর্তী সমস্ত আত্নীয়স্বজনদেরও বৌভাতের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছিল। সবাই দলে দলে এসে রাফায়াত এবং অয়ন্তীর বৌভাতে এটেন্ড করে গেছে। এলাকার মানুষজনও এখন রাফায়াতকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। রাফায়াতের গোটা পরিবারের সাথে একাত্মভাবে মিশতে শুরু করেছে। তাদের সুশীল এবং আন্তরিক আচার-আচরণের জন্য সবাই তাদের অনেকটা কম সময়ের মধ্যেই আপন করে নিয়েছে। অয়ন্তীর বাবাও এখন সন্তুষ্ট রাফায়াতের প্রতি! রাফায়াতের নম্র এবং সহনশীল আচরণে তিনি দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছেন। রাফায়াতকে এখন মেয়ে জামাই হিসেবে পরিচয় দিতেও উনার কোনো দ্বিধাবোধ নেই!
বৌভাতের দিন রাতেই অয়ন্তী এবং রাফায়াতের মধ্যে তুখোড় ঝগড়া বেঁধে গেল! মূলত হানিমুনে যাওয়া নিয়েই তাদের ঝগড়া শুরু! অয়ন্তী বলছে হানিমুনে সাজেক যাবে আর অন্যদিকে রাফায়াত বলছে কক্সবাজার থেকে দুই-এক দিনের মধ্যেই ঘুরে টুরে চলে আসবে! কারণ, আগামী তিন দিনের মধ্যেই তার অফিসে জয়েন করতে হবে। নতুন চাকরী তাই বেশী ছুটি নেওয়া যাবেনা। এত কষ্টে অর্জিত চাকরী, তাই সে কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে চাইছেনা। কিন্তু অয়ন্তী তা মানতে নারাজ। সে জেদ ধরে বসে আছে সাজেক যাবে বলেছে মানে সে সাজেক-ই যাবে! রাফায়াতের কোনো কথাই শুনবেনা সে। প্রয়োজনে হানিমুন ক্যান্সেল করে দিবে! তবুও সাজেকের জায়গায় অন্য কোথাও যাবেনা। এই বারের সুযোগটিকে কাজে লাগাতে না পারলে অয়ন্তীর আর এই ইহজন্মে সাজেক যাওয়া হবেনা! অফিস খুইয়ে পরের বার রাফায়াত তাকে নিয়ে সাজেক যাবে বলেও কোনো নিশ্চয়তা নেই! কাজের প্রতি রাফায়াতের সিনিসিয়ারিটি দেখে সমস্ত আশা তার খুইয়ে গেছে! তাই এইবারের ছুটিটিকেই তার কাজে লাগাতে হবে।
জেদ ধরে রাতে না খেয়েদেয়েই অয়ন্তী শুয়ে পড়ল। এখন তারা দুজনই অয়ন্তীর বাপের বাড়িতে আছে। সন্ধ্যার দিকে রাফায়াত একটু বাইরে বের হয়েছিল। রাফায়াত তার বিয়েতে অয়ন্তীকে পার্সোনালি কিছু দিতে পারেনি। তাই সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে অয়ন্তীর জন্য সে ডায়মন্ডের একটি নাকফুল কিনে আনল শপিংমল থেকে! চাকরীর প্রথম অবস্থায় উপার্জন কম তার। তাই এরচেয়ে দামী কিছু গিফট হিসেবে অয়ন্তীকে আপাতত গিফট করতে পারল না সে। তবে পরবর্তীতে তার বেতন যখন বাড়বে তখন অয়ন্তীকে অনেক কিছুই গিফট করার আশা আছে তার!
রাত তখন পৌনে এগারোটার কাছাকাছি প্রায়। আরিফের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা সাড্ডা মেরে রাফায়াত বাড়ি ফিরে এলো। তার পকেটে রয়ে গেল অয়ন্তীর জন্য আনা ডায়মন্ডের ছোট্টো নাকফুলটি। রুমে প্রবেশ করে রাফায়াত প্রথমে বুঝতেই পারেনি অয়ন্তী তার সাথে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছে! ভেবেছে শরীর ক্লান্ত। তাই হয়ত খেয়েদেয়ে এত দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে। দোটানায় পড়ে গেল রাফায়াত। অয়ন্তীকে ঘুম থেকে জাগাবে কী জাগাবেনা! জাগালে যদি অয়ন্তী আবার বিরক্তবোধ করে? কিংবা রেগে যায়? এই করতে করতে তার চোখ পড়ল অয়ন্তীর পড়ার টেবিলের দিকে। রাতের খাবার সাজানো আছে বড়ো একটি প্লেটে। বুঝতে বেশী বেগ পেতে হলোনা খাবারটা তার জন্যই রাখা। এছাড়াও বাড়িতে প্রবেশের সময় তার শ্বাশুড়ী মা বলেছিল রুমে তার জন্য খাবার পাঠানো হয়েছে। ভালো করে খেয়েদেয়ে এরপর ঘুমাতে। যদিও রাফায়াত পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিল অয়ন্তী খেয়েছে কি-না? তখন তার শ্বাশুড়ী মায়ের স্পষ্ট জবাব ছিল, হ্যাঁ খেয়েছে! কারণ অয়ন্তী নিজেই তার মাকে মিথ্যে বলেছিল! তার মা ও সেই মিথ্যে কথাটিই বিশ্বাস করে নিয়েছিল।
খাবারটা না খেয়েই রাফায়াত ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে অয়ন্তীর পাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। নিষ্পলক দৃষ্টিতে অয়ন্তীকে দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে সেও ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝরাতের দিকে তার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল! তার অবশ্য একটা কারণও আছে। আর সেই কারণটি হলো অয়ন্তী! ঘুমালেও কান খাঁড়া থাকে রাফায়াতের! ঘুমের মধ্যেই সে অয়ন্তীর ফ্যাচ ফ্যাচ কান্নার আওয়াজ শুনছিল। তাই তড়িঘড়ি করে সে ঘুম ভেঙে উঠল। অমনি সে দেখতে পেল অয়ন্তী পাশ ফিরে পেটে হাত চেপে ধরে কাঁদছে। ভয় পেয়ে গেল রাফায়াত। হেঁচকা টানে সে ক্রন্দনরত অয়ন্তীকে তার দিকে ফিরিয়ে নিলো। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আ’হ’ত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী হয়েছে?”
পেটের ক্ষুধায় মোচড়ে ওঠে অয়ন্তী ফুপিয়ে কেঁদে বলল,,
“আপনি একটা পা’ষা’ণ মানুষ!”
অস্থির হয়ে উঠল রাফায়াত। ক্ষুধার্ত অয়ন্তীর দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী করেছি আমি? মানে ঘুমের মধ্যে তোমার পেটে আবার লা’থি টা’থি মে’রে বসিনি তো?”
“না।”
“তাহলে কী? কী হয়েছে বলো?”
“আমাকে রেখে একা একা খেয়ে ফেললেন?”
“কী খেলাম? কোথায় খেলাম? কী বলছ তুমি?”
“রাতের খাবার!”
“কেন? তুমি খাওনি?”
“কোথায় খেলাম?”
“তোমার মা তো বলেছিলেন তুমি খেয়েছ।”
“না খাইনি। আপনার সাথে রাগ করেই তো খাইনি।”
“মানে তুমি রাগ করেছিলে?”
“তো কী?”
“ওহ্ মাই গড! দেখি ওঠো ওঠো খেয়ে নাও।”
“না খাবনা! ভেবেছিলাম আপনি এসে জোর করে খাওয়াবেন। রাগ ভাঙাবেন আমার। কাজের কাজ তো কিছুই হলোনা। উল্টো আপনি নিজেই খেয়ে বসে আছেন।”
“আরেহ্ বাপ! আমি খাইনি। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি কী জানতাম? আমার স্টু’পি’ট বৌ টা সামান্য বিষয় নিয়ে রাগ থেকে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“ওহ্! আমি স্টু’পি’ট? পুরান হয়ে গেছি না?”
“হ্যাঁ শুরু হইছে! কথা এত প্যাঁচাও কেন হ্যাঁ?”
“এখন তো আমার সব কথাই প্যাঁচানো মনে হবে। কারণ এখন তো আমি….
অয়ন্তীকে থামিয়ে দিলো রাফায়াত। শরীরের শক্তি ছেড়ে দিয়ে অয়ন্তীকে ব্যঙ্গ করে বলল,,
“হ্যাঁ পুরাতন হয়ে গেছ!”
বলেই অয়ন্তীকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো রাফায়াত। বিছানার উপর তাকে সোজা করে বসিয়ে দিলো। গ্লাসভর্তি পানি এনে অয়ন্তীর মুখের কাছে ধরল। ভাবশূণ্য গলায় বলল,,
“নাও। কুলি করো।”
“রাখুন। ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল অয়ন্তী। টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটি হাতে নিয়ে রাফায়াত ভাত মাখাতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যে অয়ন্তী রুমে প্রবেশ করতেই রাফায়াত অয়ন্তীর মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। ব্যস্ত হয়ে রাফায়াত প্রথম লোকমাটি ক্ষুধার্ত অয়ন্তীর মুখের কাছে ধরতেই অয়ন্তী অভিমানে মুখটা অন্য পাশে ফিরিয়ে নিলো! নাটকীয় স্বরে বলল,,
“খাব না!”
“মানে? কেন?”
“আগে আমার শর্ত মানতে হবে।”
“কী শর্ত আবার?”
“আমরা কাল সাজেক যাচ্ছি!”
“বললাম তো কক্সবাজার!”
“আমি যাবনা কক্সবাজার।”
“আচ্ছা যাও। তাহলে হানিমুন ট্যুর ক্যান্সেল।”
“যাহ্। খাবারই খাবনা আমি! না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। তারপর ঘুমের মধ্যেই ম’রে থাকব। ভালো হবে এরপর। বৌ হারা হবেন!”
মাথার সেন্টিমিটার যদিও রাফায়াতের অত্যধিক গরম তবুও সে এই মুহূর্তে যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করল। ছিঁচকেঁদে অয়ন্তী বিছানার দিকে মোড় নিতেই রাফায়াত খপ করে অয়ন্তীর বাঁ হাতটি টেনে ধরল। বাধ্য গলায় বলল,,
“আচ্ছা যাও। সাজেক-ই যাব। তবুও না খেয়ে ঘুমুবেনা!”
খুশি হয়ে গেল অয়ন্তী! কারণ তার উদ্দেশ্য সফল। রাফায়াতের জেদকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পেরেছে সে। অতিশয় মুচকি হেসে অয়ন্তী বাধ্য রাফায়াতের দিকে নির্ভেজাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আনন্দঘন হয়ে সে মুহূর্তেই রাফায়াতকে জড়িয়ে ধরল। রাফায়াতের ঘাড়ে অসংখ্য চু’মু খেয়ে বলল,,
“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ বর। আমি জানতাম আপনি আমার কথা না রেখে থাকতে পারবেন না।”
“হইছে হইছে। ইমশোনাল ব্ল্যা’ক’মে’ইল!”
“থাক। বউ-ই তো! দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আপনার! কত আদুরে বলুন?”
“হুম। সেজন্যই তো মানতে বাধ্য হলাম।”
দেঁতো হেসে অয়ন্তী রাফায়াতকে ছাড়ল। এরপর দুজনই মিলেমিশে খাবারটা খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর্ব শেষে রাফায়াত কিছুক্ষণ আরিফের সাথে কথা বলে সাজেক যাওয়ার বিষয়টি কনফার্ম করে নিলো। আরিফই সব ব্যবস্থা করল তাদের সাজেক যাওয়ার। ভোর ছয়টার মধ্যে-ই তাদের ঢাকা থেকে রওনা হতে হবে। খবরটা অয়ন্তীর কানে পৌঁছাতেই অয়ন্তী যেন পাগল প্রায় হয়ে গেল! ঘুম নিদ্রা ভুলে সে ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দূর থেকে দাঁড়িয়ে রাফায়াত মৃদু হেসে অয়ন্তীর পাগলামো দেখছিল! আজ কতটা খুশি অয়ন্তী। শুধুমাত্র তার কথামত তার পছন্দের জায়গায় যাওয়া হচ্ছে তাই। হুট করেই রাফায়াত খেয়াল করল তার চোখ দুটো কেমন যেন জলে ভিজে উঠছে! টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে! এত খুশির মধ্যে হঠাৎ কেঁদে উঠার কারণটা রাফায়াত ঠিক বুঝতে পারলনা! তবে কী এ খুশির কান্না? অয়ন্তীকে এত হাসিখুশি দেখে তার চোখ দুটো আনন্দ অশ্রুতে ভরে উঠেছে?
অয়ন্তী দেখে ফেলার পূর্বেই রাফায়াত তার অশ্রুসজল চোখ দুটি ঝট করে মুছে নিলো। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে তুলল। ব্যাগ পত্র গোছাতে গিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলছে অয়ন্তী। বিয়ে উপলক্ষ্যে সে গিফটের যত শাড়ি পেয়েছে সব রাফায়াতদের বাড়িতে! তাই সে চেয়েও শাড়িগুলো প্যাক করতে পারলনা। মাথায় যেন হাত পড়ে গেল তার। এই মাঝরাতে সে কী সে ঐ বাড়িতে যাবে? সবার ঘুম ভাঙাবে? নাকি সকাল অবধি অপেক্ষা করবে? কিন্তু সকাল অবধি অপেক্ষা করতে গেলে যদি তাদের দেরী হয়ে যায়?
রাফায়াত বহুকষ্টে অয়ন্তীকে বুঝালো সকাল অবধি অপেক্ষা করতে। দু-এক ঘণ্টা দেরী হলেও বিরাট কোনো সমস্যা হবেনা। রাফায়াতের কথামত অয়ন্তী এই বাড়িতে রাখা তার সমস্ত সাজ সরঞ্জাম, আগের ব্লাউজ পেটিকোটগুলো গুছিয়ে নিলো। এরমধ্যেই রাফায়াতের মনে পড়ল নাক ফুলটির কথা! এত কিছুর মধ্যে রাফায়াত প্রায় ভুলেই গিয়েছিল অয়ন্তীর জন্য সে একটি সারপ্রাইজ গিফট এনেছে!
#চলবে…?
[চেয়েছিলাম আজকের পর্বেই গল্পটিকে শেষ করতে। তবে পরে ভাবলাম গল্পটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে আরও দু-এক পর্ব বাড়ালে মন্দ হয়না! কী বলেন আপনারা?]