#পরীজান
#পর্ব ৪৮
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
‘আপনার বাবা বেছে বেছে তাদেরই নিজের দলে টানে যাদের পরিবারে খুবই অভাব। খেয়ে পড়ে বাচাঁ মুশকিল। কেননা একমাত্র তারাই বোঝে টাকার কতটা মূল্য! তারা পরিবারের সবাইকে সুখি রাখতে সবকিছু করতে রাজি থাকে। সম্পান, সিরাজ আর আমি!! এই তিনজনই আপনার বাবার শিকার মাত্র। কিন্ত আমার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আপনার বাবার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। নিজেকে অনেক চতুর মনে করে আপনার বাবা। কিন্ত শেষে সে নিজের জালে নিজেই ফেসেছে। যারা যারা আপনার বাবার কর্মচারী ছিলো তাদের কোন না কোনভাবে হ*ত্যা করেছেন আপনার বাবা। কারণ আপনার বাবার সব অ*প*কর্মের স্বাক্ষী ছিল তারা। আমাকেও এতদিনে মে*রে ফেলতেন কিন্ত পারেনি। কেন জানেন? কারণ আপনার বাবার কু*কৃ*র্তির সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি যদি মা*রা যাই তাহলে সব প্রমাণ পুলিশের হাতে চলে যাবে এজন্যই আপনার বাবা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আর সম্পান কে মে*রে ফেলেছেন। সিরাজ কে বাঁচিয়ে রেখেছেন কারণ ও আপনার বাবার মতোই নির্দয়। টাকার বিনিময়ে ও সব করতে পারে। এজন্য আপনার বোনকেও ফা*সিয়েছে। শুধুমাত্র টাকার জন্য মানুষ ভুলে যায় সে একজন মানুষ।’
শায়ের দম ফেলে পরীর দিকে তাকাল। পরী এখনও শায়েরের বুকে মাথা রেখে আছে। শায়ের বলল, ‘আপনি কি শুনছেন পরীজান?’
‘হুম শুনছি। আপনিও তো টাকার জন্য খু*ন করেছেন।’
‘ভুল পরীজান। টাকার জন্য আমি সব করলেও খু*ন করিনি। আমি প্রথম খু*ন করি পালককে।’
পরী মাথা তুলে শায়েরের দিকে তাকালো,’কেন খু*ন করলেন তা সম্পূর্ণটা এখনও আপনি আমাকে বললেন না। আজ অন্তত বলুন!!’
পরী অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। শায়ের আবার বলতে শুরু করে,’পালকের কোন দো*ষ নেই অন্তত আপনার দৃষ্টি থেকে। পালকের ধর্ম ভিন্ন তা কি আপনি জানেন? তবুও সে আমাকে পেতে চেয়েছিল। এতে আমি ওর কোন দো*ষ দেখি না। মানুষ জাতি বড়ই অদ্ভুত পরীজান। কখন কার দৃষ্টিতে কে আটকে যায় তা বলা মুশকিল। সেজন্যই পালক আমাতে আটকে ছিল। আমি পালককে হ*ত্যা করতাম না। কিন্ত শেষে সে সবকিছু জেনে গেল। শুধু তাই নয় সে আমাকে হু*মকি দিল যে সে আপনাকে সব বলে দিবে। যদি আমি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে চুপ থাকবে। সুযোগের সদ্যব্যবহার,তবে তার দো*ষ আমি দেখি না। ভালোবাসা পেতে আমি নিজেই খু*ন করেছি আর সে তো হু*মকি দিয়েছে মাত্র। তখন কানাইকে নিয়ে ঝা*মেলা চলছিল তার মধ্যে পালক চলে আসে। মাথা কাজ করছিল না তাই ওর মুখ বন্ধ করার জন্য মে*রে দিয়েছি।
তারপর আরো পাঁচজন কে মে*রেছি আমি। চারজন ছিল বিন্দুর ধ*র্ষ*ণ*কা*রী। মেয়েদের সম্মান না করলেও অসম্মান করি না আমি। সম্পান ও। ওইদিন বিন্দুকে মা*রা*র কোন পরিকল্পনা ছিল না। সম্পান কে প্রথমে আপনার বি*রুদ্ধে নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত সে আপনার আর বিন্দুর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ। এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম নারীর ভালোবাসা হিং*স্র মানবকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
সম্পান নিজে থেকে আপনার বাবার কাজ ছাড়তে চেয়েছিল কিন্ত আপনার বাবা আপনাকে মা*রার পর তাকে যেতে বলেছিল। কিন্ত সম্পান তা নাকচ করে দেয়। তারপর বিন্দুকে মা*রার হুমকি দেন আপনার বাবা। নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে সম্পান আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইল। কিন্ত সে জানতো আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে পরিকল্পনা করেই যাত্রা দেখতে পাঠানো হয় যাতে আমি কিছু জানতে না পারি। তবে সেদিন সম্পান ওখানে গিয়ে আমাকে খবরটা দেয়। আমাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে সব শেষ। সম্পান নিজের ভালোবাসাকে ওইভাবে দেখতে পারেনি তাই ছয় জনের মধ্যে দুজনকে ওখানেই মে*রে দেয়। আর বাকি চারজনকে আমি মা*রি। বিন্দু যদি বেঁচে থাকতো তাহলে সম্পানের বধূ হয়ে আজ ওর ঘরে থাকতো। কিন্ত বিধাতার কি লিখন। দুজনকেই তিনি টেনে নিয়েছেন। আমি আর সম্পান হিং*স্র*তাকে জিততে দেইনি পরীজান। ভালোবাসাকে জয়ী করেছি। ভালোবেসে ওরা দুজন প্রা*ণ দিয়েছে আর আমরা দুজন একসাথে রয়েছি।’
-‘আর নাঈমকে কেন মিথ্যা আ*সামী বানালেন?’
-‘মিথ্যা আ*সামী তাকে বানিয়েছে নওশাদ। আপনার বিয়ে ভাঙার সব পরিকল্পনা নওশাদের ছিল। আমি জানতাম আপনাকে আমি শেখরের মতো করে সুখি রাখতে পারব না। তাই আপনার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্ত মাঝপথে জানতে পারলাম যে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আপনার বাবা পরিকল্পনা করে আপনাকে মে*রে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেবে আর গ্রামের লোকেরা ভাববে বিয়ে ভাঙার কষ্টে আপনি আ*ত্ম*হ*ত্যা করেছেন। আমি তা হতে দেইনি। আপনার বাবাকে বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করব এবং আমার গ্রামে নিয়ে গিয়ে হ*ত্যা করব। কিন্ত বিশ্বাস করুন পরীজান আমি আপনার সাথে সুখে থাকতে চেয়েছি শুধু। কিন্ত সেই সুখটাও ওরা কেড়ে নিল। আমি মানছি আমি পাপ করেছি।’
কথাগুলো শেষ করে পরীর দিকে তাকালো শায়ের। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে পরীর। সে মুচকি হেসে বলে,’আমি জীবনে অনেক পা*প করেছি কিন্ত পূণ্য করেছি আপনাকে ভালোবেসে। এর চেয়ে পবিত্রতা বুঝি দুনিয়াতে নেই।’
-‘এজন্যই তো এতো ভালোবাসা আমার কপালে সইলো না মালি সাহেব। যু*দ্ধে নামতে হয়েছে আমাদের। সেখানে আপনি আমার শ*ত্রু*পক্ষ।’
-‘শত্রুপক্ষ যে আপনাকে ভিশন ভালোবাসে। ত*লো*য়া*রের আঘাতে নয় শ*ত্রু*র ভালোবাসায় আপনার দম বন্ধ হয়ে আসবে পরীজান।’
-‘আমি যে এই যুদ্ধে প্রাণ হারাব মালি সাহেব। তখন আপনি কি করবেন?’
-‘আপনাকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব।’
-‘আমি মারা গেলে আমার কবরের পাশে একটা বেলি ফুল গাছ লাগাবেন মালি সাহেব!! আমার দেহটা পঁচে সার হয়ে মিশে যাবে ওই গাছে। আর প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণে আপনি আমাকে পাবেন।’
এই প্রথম শায়ের পরীর কথার জবাব দিতে পারল না। সে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল পরীজানের পানে। পরী দেখতে পেল ক্ষত বিক্ষত চোখদুটো। ওই চোখে কত ভালোবাসা দেখেছে সে। আর আজ ওই চোখজোড়া সে নিমিষেই রক্তাক্ত করে দিয়েছে। আচমকা পরীকে শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে শায়ের। বলে ওঠে,’আপনাকে এভাবেই ধরে রাখব আমি পরীজান। আপনি আর কোথাও যেতে পারবেন না। আচ্ছা,চলুন না আমরা ফিরে যাই আমাদের গ্রামে? আমরা ভাল থাকব।’
-‘কিন্তু আমার মা বোন ভাল থাকবে না। ওদের শেষ করে দেবে ওই জঘন্য লোকগুলো।’
-‘সবাইকে নিয়ে যাব আমরা। তাহলেই তো হবে।’
-‘এসব বাদ দিন। আমি আপনাকে একটু কাছে পেতে চাই। এই মুহূর্তটা স্মরণীয় করে রাখতে চাই।’
পরী আঁকড়ে ধরে স্বামীকে। শায়ের আজ নিজে থেকে সব সত্য স্বীকার করেছে অথচ পরীর রাগ হচ্ছে না। কারণ সে নওশাদের বিনাশ করতে পেরেছে তাই আজকে সে খুশি থাকবে। এই মধুরতম রাতটা শায়ের কে দিবে। ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ এঁকে দিবে। তাইতো সে এতো রাতে স্বামীকে তলব করে এনেছে।
সকাল হতেই ঘুম ভাঙে শায়েরের কিন্ত তার এই মুহূর্তে উঠতে একদম ইচ্ছে করছে না। পরীর উষ্ণ আলিঙ্গনে তার আরো থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্ত সে ইচ্ছা ভঙ্গ করে পরীই উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে কলপাড়ের দিকে এগোলো। কিছুক্ষণ বাদে শায়ের নিজেও গেল কিন্ত উঠোনে আসতেই সে দেখতে পেল শেফালি আর কুসুম গোবর দিয়ে উঠোন লেপছে। বিষয়টা শায়েরের সন্দেহজনক মনে হল কিন্ত সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কারণ আর কিছুক্ষণ বাদে তাকে অন্দর ত্যাগ করতে হবে। এটা পরীর হুকুম। তাই সে বিনা বাক্যে প্রস্থান করে।
বেলা দশটা বাজতেই ডাক পড়ল নওশাদের। তাকে বৈঠক ঘরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্দরে নওশাদ যাবে না এটা সবাই শতভাগ নিশ্চিত। তবে গেল কোথায়। সবাইকে খুঁজতে পাঠালো আফতাব। কিন্ত নওশাদের হদিস পাওয়া গেল না। আখির তাতে ক্ষেপে গিয়ে বলে,’নিশ্চয়ই পরী কিছু করেছে ভাই। সে’ই নওশাদ কে গুম করেছে। নাহলে রাতারাতি ছেলেটা উধাও হয় কীভাবে?’
-‘সত্যিই যদি পরী কিছু করে থাকে তাহলে ওর আজকেই শেষ দিন। শায়েরের কোন কথাই আমি শুনব না। এতে যা হয় হোক।’
আফতাব তার দলবল নিয়ে অন্দরের দিকে পা বাড়ায়। কিন্ত দরজা পর্যন্ত যেতেই শায়ের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আফতাব বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,’সামনে থেকে সরে যাও শায়ের। আজ পরী বাঁচবে না। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।’
-‘পরীজান কিছু করেনি। সে জানে না নওশাদ কোথায়!’
-‘তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কীভাবে?’
-‘কাল সারাদিন নওশাদ আমাদের চোখের সামনেই ছিল। এমনকি রাতে আমার সামনে দিয়েই নিজের ঘরে গেল।’
-‘ঘুমানোর পর হয়তো পরী ওকে ধরে নিয়ে গেছে।’
-‘নাহ! কারণ কাল রাতে আমি পরীজানের সাথে ছিলাম।’
-‘তুমি ছিলে পরীর কাছে! কেন গিয়েছিলে?’
সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে শায়ের। রাগন্বিত হয়ে বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। শায়ের আবারও সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলে,’আপনি বড়ই নির্লজ্জ। একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কেন যায় সেটা কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে জমিদার মশাই? আচ্ছা বাদ দিলাম আমার কথা। আপনি নিজ স্ত্রীকে ফেলে পর নারীর কাছে কেন যেতেন? সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি?’
শায়েরের কথা পুরোপুরি না শুনে রক্ষিরা সব চলে গেছে। এই মুহূর্তে শুধু আখির আর আফতাব দাঁড়িয়ে। শায়েরের কথা শুনে বিড়ম্বনায় পড়ল আফতাব। ভাইকে কিছু বলতে না দেখে আখির বলে উঠল,’তুমি মুখে মুখে তর্ক করো খুব। তুমি জানো কাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি?’
-‘হুম! আমি মস্তিষ্কহীনদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কেন একথা বলছি জানেন? কারণ আপনাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। যারা আপনাদের সাহায্য করে তাদের কেই মে*রে ফেলেন আপনারা। তাহলে আপনাদের তো মস্তিষ্কহীন বলা উচিত তাই না?’
বিপরীতে আখির পাল্টা জবাব দিলো না। শায়ের আবার বলল,’পরীজানের দিকে নজর বুলাবেন না বলে দিলাম। নাহলে ফল খারাপ হবে।’
চলে গেল শায়ের। ক্ষোভে ফেটে পড়ে দুই ভাই। তাদের সমস্ত পরিকল্পনা সব শায়ের নষ্ট করে দিচ্ছে বারবার। আফতাব নিচুস্বরে বলে,’সিরাজ কে খবর দে। শায়ের কে আগে সরাতে হবে তারপর পরীকে সরাব। পুলিশ কে হাতের মুঠোয় নিতে আমার সময় লাগবে না। আগে একটা আপদ সরাই তারপর আরেকটাকে সরাব।’
কথাটা শেফালির কর্ণগোচর হয়ে গেল। সে দৌড়ে পরীকে গিয়ে খবর দিল। ওর বাবার সব পরিকল্পনা জানিয়ে দিলো। পরী চুপ থেকে সব শুনল। তারপর বেশ শান্ত ভাবেই নিজ ঘরে চলে গেল। শেফালি বুঝল যে ঝড় আসতে চলেছে। পরীর চুপ থাকা মানেই ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছুক্ষণ বাদে পরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। শেফালিকে বলে,’তোরা তৈরি থাক পরবর্তী শিকার সিরাজ।’
#চলবে,,,#পরীজান
#পর্ব ৪৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সময়কাল ২০০৮,
সিমেন্টের মলাটে আবৃত খাতাটা বন্ধ করে মুসকান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখের চশমাটা খুলে খাতাটা আগের জায়গায় রেখে কক্ষ ত্যাগ করে রান্নাঘরে আসে। শোভন এসে মায়ের কাছে আবদার করে সে নুডুলস খাবে। তাই সে চুলায় গরম পানি করতে দিল। অপর চুলাতে চা বসিয়ে দিল। আগে নুডুলস রান্না করে তারপর চা বানিয়ে ছেলের কাছে নিয়ে এল। একটু ফুসরত পেল না সে। কলিং বেলের শব্দে সে আবার সেদিকে গেল। দরজা খুলে দেখতে পেল ঘর্মাক্ত ক্লান্ত পুরুষটিকে। হাতের এপ্রোন টা মুসকানের হাতে দিয়ে পুরুষটি ঘরে ঢোকে। বাথরুম থেকে পরিপাটি হয়ে বের হতেই মুসকান প্রশ্ন ছোঁড়ে,’নূরনগর গ্রামটিকে তুমি চেনো নাঈম?’
সচকিতে তাকালো নাঈম,’কেন বলতো?’
‘গত সপ্তাহে আমি একটা ইন্টারভিউ নিতে জমিদার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা ঘরে একটা খাতা পেলাম। সেটাই আজ সময় করে পড়েছিলাম।’
ঘাবড়ালো নাঈম। চোখ লুকানোর চেষ্টা করল মুসকানের থেকে। সেটা বুঝতে পেরে মুসকান নাঈমের হাত ধরে টেনে তার পাশে বসলো,’ক্লান্ত তুমি,এই বাহানা দিও না। আমাকে বলো জমিদার কন্যা পরী এখন কোথায়? আর তার স্বামী সেহরান শায়ের ই বা কোথায়? কি হয়েছিল তার পরিবারের?’
-‘আমি জানি না মুসকান।’
-‘জানতাম মিথ্যা তুমি বলবে। নাঈম তুমি সব জানো। ওই খাতায় সর্বশেষ পরী তোমার নাম লিখেছে। তুমি কি সব বলবে নাকি কাল আমার নিউজ পেপারে আমি পরীর লেখা খাতাটা পাবলিশ করব?’
-‘এটা করো না মুসকান। পরীর নিষেধাজ্ঞা আছে।’
-‘তাহলে সব বলো আমাকে?’
-‘তোমাকে সব শায়ের বলতে পারবে। পরী একমাত্র শায়ের কেই সব সত্য বলার অনুমতি দিয়েছে।’
-‘সে এখন কোথায়? তার সাথে দেখা করব কীভাবে?’
নাঈম চুপ রইল কিছুক্ষণ। দেখে মনে হল সে অনিচ্ছুক কথাটা বলতে। অতঃপর নিরবতা ভেঙে সে বলে,’আর তিনদিন পর তার ফাঁ*সি হবে।’
নির্বাক হয়ে গেল মুসকান। সে কি সত্যি শুনছে? নাকি তার শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে?তিনদিন পর শায়েরের ফাঁ*সি!! এতকিছু কীভাবে হল? এর মধ্যে হয়তো কোন সত্য লুকানো আছে। সে জিজ্ঞেস করে,’কি বলছো তুমি নাঈম? সত্যি তার ফাঁ*সি? কিন্ত কেন?’
-‘তুমি সব প্রশ্ন তাকে করলেই পাবে। আমি সব জানলেও আমার হাত পা বাঁধা।’
-‘সেহরান ভালোবাসে পরীকে!! আর সেই সেহরানের ফাঁ*সি হবে? কোথাও ভুল হচ্ছে নাঈম। তুমি তো সব জানতে তাহলে তুমি কেন কিছু করলে না?’
-‘আমার জানা নেই সেহরান কেমন ভালোবাসে পরীকে।’
কথাটাতে মিশে আছে হিং*সা। তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না মুসকানের। তবে এই হিং*সার কারণটা কি?
নাঈমের পুরুষালী মনে কেন এই হিংসার সৃষ্টি?
-‘তুমি না জানলেও আমি বুঝতে পারছি। নাঈম মেয়েটার চেহারা ঝলসে গিয়েছিল আগুনে!! তারপরও সেহরানের ভালোবাসা একটুও কমেনি। সৌন্দর্য তার কাছে কোন কিছু না। মানুষ টাই সব। আমি যেটুকু জানতে পেরেছি এতে বেশ বুঝতে পারছি পরী আর সেহরানের সাথে অতীতে ভাল কিছু হয়নি। আমাকে তিনদিনের মধ্যে সব সত্য জানতে হবে। আমি সেহরান কে বাঁচাব এবং তার পরীর কাছে ফিরিয়ে দেব।’
নাঈম এবার রেগে গেল ভিশন। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’সেহরান সেহরান সেহরান,মাথা খারাপ করো না। যা বলার সেই বলবে তোমাকে। সাভার থানায় গিয়ে দেখা করে নিও। ওর হাতে বেশি সময় নেই।’
মুসকানের হাত পা কাঁপতে লাগল। না জানি শায়ের এখন কোন পরিস্থিতিতে আছে। পেশায় মুসকান একজন সাংবাদিক। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে
যায় তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। যা পরবর্তীতে ওদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নূরনগরের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করতে সে গত সপ্তাহে গিয়েছিল। মুসকান জানতে পারে নাঈম প্রায় দশ বছর আগে সেখানে গিয়েছিল। এজন্য মুসকানের আগ্রহ বেশি ছিল। তাই নিজের দলের সাথে অভিযানে নেমে পড়ে সে। সেখানে পরীর ঘরে একটা খাতা তার চোখে পড়ে। খাতাটা খুলে সে সোনালীর লেখা গুলোর কিছুটা পড়েছিল তবে সম্পূর্ণ পড়তে পারেনি। তাই খাতাটা লুকিয়ে সে নিয়ে এসেছে। শুধু সোনালী নয়,রুপালি এবং পরীর লেখাও আছে। যা সম্পূর্ণ পড়তে গিয়ে অসংখ্যবার চোখ মুছেছে সে। সে ভেবেছিল নাঈম এই ঘটনার আংশিক জানে কিন্ত সে ভুল। নাঈমের কথা শুনে এখন সে বুঝতে পারছে নাঈম নিজেও এই বিষয়ে জড়িত। ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য শায়েরের সাথে তার দেখা করা জরুরি। শায়ের ঠিক কতটা দো*ষী তা সে জানতে চায়।
শোভন মুসকানের কাছে এসে বলে,’আম্মু আমার ঘুম পেয়েছে।’
মুসকান শোভন কে নিয়ে তার ঘরে গেল। খুব যত্নে শোভন কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সে নিজ ঘরে ফিরে এলো। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নাঈম। ঘুমায়নি সে। মুসকান তার পাশে গিয়ে বসে,’শোভন কে নাঈম?’
হঠাৎই কারো গলার স্বর শুনে চমকে তাকায় নাঈম। মুসকানের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। মুসকান আবার বলে,’পিকুলই কি আমাদের শোভন?’
নাঈম মাথা নাড়ল। শান্ত দৃষ্টি মুসকানের,’একটা মানুষ এতো ভালোবাসতে পারে তা আমার ভাবনায় কখনও আসেনি নাঈম!!! সোনালীর জীবন দূর্বিষহ ভাবে কেটেছে। রুপালির ও তাই কিন্ত পরী তার জীবনে সবচেয়ে সেরা মানুষ টাকে পেয়েছে। এতো নিখুঁত ভালোবাসা আমি এই প্রথম দেখেছি।’
নাঈমের রাগ যেন কমে এলো,’শায়েরের কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে তো?’
-‘এই সেই পুরুষ যে কথা দ্বারা নারীর মন ভাঙতে সক্ষম কিন্ত পরীর মন সে শুধু গড়েছে নতুন ভাবে। আমার দেখা করা উচিত তার সাথে।’
নাঈম বিপরীতে কথা বাড়ায় না। মুসকান সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। কখন সে শায়েরের সাথে দেখা করতে যাবে সেই আশায়। রাতটা যেন কয়েক যুগ মনে হচ্ছে তার কাছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে সূর্যের আগমন ঘটলো ধরণীতে। তৈরি হয়ে সে শোভন কে সাথে নিয়ে বের হলো। পথে শোভনকে স্কুলে দিয়ে আসবে।তারপর সাভার যাবে। নাঈম নিজেও চেম্বারে যাওয়ার জন্য বের হলো। মুসকান কে দেখে সে বলল,’সেহরান কে তোমার পরিচয় দিও। নাহলে কিন্ত তোমাকে সে কিছুই বলবে না।’
কথা শেষ করে নাঈম চলে গেল। মুসকান শোভন কে স্কুলে দিয়ে সাভারের উদ্দেশ্য রওনা হলো। এই সকালেও রাস্তায় জ্যাম। কর্মজীবিরা নিজ নিজ কর্মে বেরিয়ে পড়েছে। রোদের তাপে ঘেমে একাকার হয়ে সাভার থানায় পৌঁছালো সে। একজন কনস্টেবল কে ডেকে জিজ্ঞেস করল শায়েরের কথা। অপেক্ষা করতে বলে কনস্টেবল চলে গেল ভেতরে। মুসকান বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর তার ডাক পড়ল। নিঃশব্দে সে অফিসারের কেবিনে প্রবেশ করল। মুসকান বুঝতে পারে অফিসারের নাম নুরুজ্জামান শেখ। নেইমপ্লেট দেখে বুঝল সে। অফিসার হাতের ফাইল টেবিলে রেখে মুসকানের দিকে তাকাল, ‘আপনি কেন একজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সাথে দেখা করতে চান? কি হয় সে আপনার?’
-‘আসলে আমি একটা আর্টিকেল লিখতে চাইছি যেটা নূরনগরের জমিদার বাড়ি নিয়ে। তো সেই বাড়ির সাথে সেহরানের সম্পর্ক আছে তাই আমি তার সাথে দেখা করতে চাইছি।’
-‘কিন্তু আমাদের তো অনুমতি নেই তার সাথে কারো দেখা করতে দেওয়ার।’
-‘আমি একজন সাংবাদিক তাই আপনাদের উচিত আমাকে আমার কাজটা করতে দেওয়া। নাহলে জানেনই তো নিউজ পেপারে ভুলভাল তথ্য ছাপাতে আমরা একদমই সময় নেই না। হতে পারে কালকের ব্রেকিং নিউজ আপনাকে ঘিরেই হতে পারে।’
অফিসার হাসে। সত্যিই এই সাংবাদিকদের কোন তুলনা হয় না। বাড়িতে যদি চুলায় ভাত বসানো হয় তাহলে তারা সেটা খবরের কাগজে ফুটিয়ে প্লেটে পরিবেশন করে দেবে। তবে মুসকান তার পূর্ব পরিচিত। কোন এক ইন্টারভিউ তে দেখা হয়েছিল তার। তাই তিনি বেশি কিছু বললেন না। মুসকান কে নিয়ে চলল যে সেলে শায়ের কে রাখা হয়েছে। চোখের চশমাটা ঠিক করে চারিদিক দেখতে দেখতে সে নুরুজ্জামানের পিছন পিছন গেল। চলতে চলতে সে জিজ্ঞেস করে,’ঠিক কি কারণে সেহরানের ফাঁ*সি হচ্ছে?’
-‘জমিদার আফতাব তার ভাই আখির,তাদের কয়েক জন কর্মচারী এবং আফতাবের কন্যা রুপালিকে হ*ত্যা*র দায়ে তার ফাঁ*সি হচ্ছে।’
পা দুটো আপনা আপনিই থেমে যায় মুসকানের
মুসকান আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। মনের সব প্রশ্ন সে শায়েরের জন্য সাজাতে লাগল। সে আবার হাটতে লাগল। কয়েকটি গলি পেরিয়ে নুরুজ্জামান একটি সেলের সামনে এসে দাঁড়াল। যেখানে আলো বাতাস কিছুই প্রবেশ করতে পারে না। ভেপসা গন্ধ আসছে সেখানে। মুসকান ও সেখানেই দাঁড়াল। নুরুজ্জামান লোহার শিকে হাত রেখে শায়ের কে ডাকে,’সেহরান তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।’
কিন্ত সে কোন প্রকার সাড়া দিল না। নুরুজ্জামান কয়েক বার ডাকল কিন্ত শায়ের আসল না। দরজার তালা খোলা নিষিদ্ধ। তাই মুসকানকে সে বলে উঠল, ‘এর বেশি আমি কিছু করতে পারব না। শায়ের ইচ্ছা হলে আসবে নাহলে নাই।’
-‘তাহলে আপনি চলে যান আমি সব সামলে নেব।’
নুরুজ্জামান থাকতে চাইলেন কিন্ত মুসকান তাতে বাঁধা দিল। অতঃপর তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিল। মুসকান অন্ধকারে শুধু শায়েরের অবয়ব দেখতে পাচ্ছে। সে নিম্নস্বরে বলল,’দেখুন আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি মুসকান,নাঈমের স্ত্রী। আমি পরীর ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই। দয়া করে সামনে আসুন। আপনার সাথে জরুরী কথা আছে।’
এবার ও আশানুরূপ কোন জবাব সে পেল না। হতাশ হয়ে মুসকান দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর লোহার শিকল টানার শব্দ পেল সে। দেখার চেষ্টা করলো ভেতরের দৃশ্য। শায়ের এগিয়ে এসে শিকে হাত রাখে। মুসকান অবাক চোখে শায়ের কে দেখে। এটা সেই প্রেমিক পুরুষ যে তার ভালোবাসার জন্য পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। পুরো পৃথিবীকে পায়ে ঠেলে সে পরীর সামনে হাজির থাকে। যার কাছে পরীর সৌন্দর্যের থেকে পরীই ঊর্ধ্বে। মুসকান ভাবতেও পারেনি সে এই পুরুষ টির সামনে আসবে তাও এত তাড়াতাড়ি!! পরীর খাতায় লেখা তার মালি সাহেবের বর্ণনা মনে পড়ল মুসকানের। সেই মায়াময় চেহারা। সুদীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট আঁখি যুগল যা সুরমা দ্বারা এখনও বেষ্টিত। মুসকান কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগে শায়ের কে। লোহার শিকল দিয়ে আবৃত দেহখানা ধুলো বালিতে পরিবেষ্টিত। চুলগুলো উসকো খুসকো। মুখ ভর্তি দাড়ি। অদ্ভুত প্রাণীর মত দেখাচ্ছে তাকে। শায়ের মুসকান কে বলে,’ডাক্তার বাবুর স্ত্রী বলেই আপনাকে একটুখানি দর্শন দিলাম। তবে এখন আপনি আসতে পারেন।’
মুসকান বাঁধা দিয়ে বলে,’দয়া করে যাবেন না। আমি পরীর খাতায় ওর লেখা পড়েছি। সবকিছু সেখানে লেখা নেই। সম্পূর্ণটা আপনিই ভাল বলতে পারবেন। আমি জানতে চাই মুখ আগুনে ঝলসানোর পর কি হয়েছিল পরীর সাথে!’
-‘পরীজানের খাতা আপনার কাছে?’
মুসকান শায়েরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে, ‘সেহরান শায়ের!! পরীর মালি সাহেব!! কিন্ত সেহরানের পরীজান! সে কোথায় এখন? তার মালি সাহেবের এই অবস্থায় সে আসবে না।’
মৃদু হাসে শায়ের। মুসকান সেই হাসির মর্মতা বুঝতে পারে না। এতক্ষণ চুপ থেকে শায়ের মুখ খোলে,’পরীজানের ব্যাপারে কতটুকু জানেন আপনি?’
-‘তাহলে সে কেন আপনার কাছে আসল না?’
-‘সে তো আমার কাছেই আছে। আমার অস্তিত্বে মিশে আছে সে। স্বয়ং আল্লাহ ও চায় না আমাকে পরীজানের থেকে আলাদা করতে।’
-‘দুনিয়াতেই তো আপনারা আলাদা রয়েছেন। এখন তো আপনার কাছে পরী নেই।’
আবারও হাসে শায়ের। তবে তার এবারের হাসির প্রগাঢ়তা অনেক। সে বলে,’হাসছেন যে?’
-‘আমরা দুনিয়াতে আলাদা নই,আমাদের দুনিয়াই আলাদা।’
নড়ে দাঁড়ায় মুসকান। পরী ঠিকই বলেছে, এই পুরুষটির সাথে কথায় হার মানতে হবে। মানুষ কে কথার জালে আটকাতে পারে সে।
-‘কেমন দুনিয়াতে আছেন আপনারা?’
-‘একটা ছোট্ট দুনিয়া। যেখানে নেই কোন বিশাল সাম্রাজ্য নেই কোন হিং*স্র*তা। যেখানে হবে না কোন যু*দ্ধ র*ক্তা*র*ক্তি। থাকবে শুধু সেহরান আর পরীজানের ভালোবাসার সংসার। ছোট্ট একটা কুটির থাকবে যেখানে দিন শেষে ফিরে পরীজানের দর্শন পাব আমি। একটা পবিত্র মুখের দর্শনের আশায় আমি যে সবসময় ছটফট করি। আমরা এখন যে দুনিয়ায় বসবাস করছি তা এখন বারবার অপবিত্র হচ্ছে। সামনে আরও হবে। শুধু আমার পরীজানের দুনিয়া পবিত্র। তাহলে বুঝুন আমাদের দুনিয়া কেমন আলাদা?’
#পরীজান
#পর্ব ৫০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
অন্ধকার কুঠুরির সামনে মেঝেতে বসে আছে মুসকান। তার দৃষ্টি শেকলে বন্দি পুরুষটির দিকে। ধুলো বালি ওর গায়ে মাখছে তবুও তার হুস নেই। সে শায়েরের দিকে বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে। শায়েরের মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না আদৌ সে সব বলবে কি না? মুসকান নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি পরীকে খুব ভালোবাসেন তাই না? সেই ভালোবাসার সাথে কি এমন হয়েছিল? আপনি কি খু*ন গুলো সত্যিই করেছেন?’
-‘একটা আওয়াজ,যা আমার কানে সবসময় বাজে। একটা চেহারা যা আমার চোখে সবসময় ভাসে। একটা সময় ছিল যখন সেই মানুষ টা আমার খুব কাছে ছিল। এখনও আছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই তাকে দেখতে পাই।’
-‘দয়া করে বলুন না অতীতের সেই ঘটনা? আমি আপনাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী হিসেবে থাকতে চাই।’
-‘আমি আপনাকে বলব সব। কিন্ত একটা কথা আপনাকে দিতে হবে। কাউকে কোনদিন সত্যিটা বলতে পারবেন না আপনি।’
-‘কথা দিলাম আমি কাউকে কিছু বলব না। আপনি বলুন।’
শায়ের দৃষ্টি মেলে সামনের রঙ ওঠা কালচে দেয়ালের দিকে। কত যত্নহীনে এই দেয়াল টা এরকম হয়েছে তা বেশ বুঝেছে সে। তার অতীতের মতো এই দেয়ালের অতীত ও যে ভাল কাটেনি। সে তার রঙহীন অতীতে ডুব দিল,
বৈঠকে হন্তদন্ত হয়ে আসল সিরাজ। আফতাবের জরুরি তলবে তার আসতে হলো। জমিদার বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ মনে করে না সে। এখানে থাকলে নওশাদের মতো সেও গায়েব হয়ে যেতে পারে। কেননা এখন পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি নওশাদের। প্রথমত সবাই ভেবেছিল পরীর ভয়ে সে জমিদার বাড়ি ত্যাগ করেছে। কিন্ত যখন সবাই জানতে পারে যে নওশাদ নিজ বাড়িতেও যায়নি তখন সবার সন্দেহ বাড়ে। কাজটা কি পরী করেছে? তার যথাযথ কোন প্রমাণ পায়নি কেউই। শায়ের যেহেতু রাতে পরীর সাথেই ছিল সেহেতু পরীর দিকে আঙুল তোলা অসম্ভব। শায়ের বাদেই ওরা গুরুত্বপূর্ণ সভা বসিয়েছে। শায়ের কে কিভাবে হ*ত্যা করা যায় সেই পরিকল্পনার করছে সবাই। সিরাজ গম্ভীর গলায় আফতাব কে বলে,’এই মুহূর্তে শায়ের কে মা*রা কি ঠিক হবে? আমাদের মুখোশ খোলার হা*তিয়ার কিন্ত একমাত্র শায়েরের কাছে আছে। ও ম*রে গেলেও কিন্ত আমাদের জেলে যেতে হবে! সেই ব্যবস্থা কিন্ত শায়ের করেই রেখেছে।’
আফতাব জবাব দিলো না বিধায় আখির বলে উঠল, ‘পরের টা পরে দেখা যাবে। শায়ের বেঁচে থাকলে আমরা পরীর হাতে ম*র*ব। ভাই কথা বলেন আপনি।’
-‘তা ঠিক। পরী এখন হিং*স্র হয়ে উঠেছে। যাকে সামনে পাবে তাকেই থাবা মা*রবে।’
সিরাজ বলে উঠল,’আর রুপালি?’
-‘রুপালি আবার কি? সে পরীর মতো আমাদের মা*রতে আসবে না। মায়েদের সাথে ও বেঁচে থাকুক। কিন্ত যেদিন দেখব রুপালিও পরীর মতো সেদিন সেও শেষ হবে। ওরা মেয়ে হয়ে যদি বাপকে মা*রতে চায় তাহলে আমিও ওদের অস্তিত্ব রাখব না।’
-‘জুম্মানকে কি করবেন ভাই?’
-‘ও থাকুক বাগান বাড়িতে। যেদিন ও পুরোপুরি সব কাজ শিখে যাবে তখন নাহয় আসবে।’
-‘তাহলে আজকে শায়ের কে বাগান বাড়িতে নিয়ে যাই? তারপর নাহয় মে*রে ফেললাম।’
-‘সিরাজ,তুমি শায়ের কে নিয়ে আজ রাতেই বাগান বাড়িতে যাবে। তারপর আমরা যাব।’
সভা ওখানেই শেষ হলো। তবে শায়ের জানতেই পারল না যে ওর বিরুদ্ধে কত বড় ষ*ড়*য*ন্ত্র করা হয়েছে। তবে সব কথা শেফালির কানে চলে গেছে।
পরীর আদেশে শেফালি সর্বদা বৈঠকে নজর রাখে। তাই সে খবরটা পরীকে জানিয়ে দিল। খা*রা*প স্বামীকে বাঁচানোর জন্য পরী মরিয়া হয়ে উঠল। শেফালি তা বুঝতে পেরে বলল,’আপনি শায়ের ভাইরে অনেক ভালোবাসেন তাই না আপা? হেয় খা*রাপ কাম করলেও কিন্ত আপনেরে অনেক ভালোবাসে। হের লাইগাই আপনের এতো টান।’
-‘খু*ন করে সে পাপ করেছে শেফালি কিন্ত এই পাপের ক্ষমা আল্লাহ করবেন যদি সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। আল্লাহ বলেছেন তুমি যদি বিচার করো তাহলে আল্লাহ তার বিচার করবে না। এজন্য আমি তাকে শা*স্তি দেব না। আমি চাই তার বিচার আল্লাহ করুক। আমি শুধু তাকে ভালোবাসব। সেই ভালোবাসায় সে নিজেকে সুধরাবে।’
চলে যাওয়ার আগে পরী আবারও পেছন ফিরে বলে,’আজকেও তোকে সব কাজ করতে হবে। পারবি তো?’
শেফালি মাথা নাড়ল। সে বুঝলো আজকে ভ*য়ানক কিছু হতে চলেছে। পরী শায়ের কে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা তো করবেই। কিন্ত তারপর পরীর কি হবে তা ভেবে ভয়ে আছে শেফালি।
পরী রুপালি ঘরে গেল। পিকুল কে নিয়ে বসে আছে সে। কালবিলম্ব না করেই পরী বলে,’সিরাজ কে মা*রবে না আপা? আজকে সে সময় এসে গেছে।’
রুপালির চেহারায় ভয় দেখতে পেল পরী। নওশাদ কে মা*রা*র সময় ভয় পেয়েছিল। এখনও সেই ভয়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। পরী রুপালির মনে রাগ জন্মানোর জন্য বলে,’এতো সহজে তাকে ছেড়ে দেবে? যে তোমাকে মিথ্যা ভালোবাসার জালে আটকিয়েছিল! যে তোমাকে শশীলের হাতে তুলে দিয়েছিল। ভাবতে পারো সেদিন আমি না থাকলে তোমার কি হতো? কবিরকে তো আমি শেষ করেই দিয়েছি। এখন সিরাজ কে তুমি ছেড়ে দিবে?’
রুপালির মনে পড়ে গেল জঘন্য অতীতের কথা। পরী না থাকলে সেদিন শশীল তার ই*জ্জ*ত হরন করতো। বেঁচে থাকতে পারত না সে। আর সিরাজ ওকে ধোঁকা দিয়েছে একথা মাথায় আসতেই রাগে জ্বলে ওঠে সে। র*ক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকে সারা শরীরে। এতো কিছুর পর সিরাজ কে ছাড়া যাবে না। কিছুতেই না। পরীর দিকে তাকিয়ে সে ইশারা করল। পরী মুচকি হেসে চলে গেল।
সূর্য ডুবতেই সকল দিক থেকে সবাই তৈরি হতে লাগল। ওদিকে আফতাব আখির আর সিরাজ পরিকল্পনা করছে আর এইদিকে পরী। পরী শায়ের কে তলব করে এবং শায়ের সাথে সাথেই চলে আসে।
তবে এবার পরী শায়ের কে সোনালীর ঘরে নিয়ে যায়। শায়ের পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। পরী কাঠের চেয়ার টেনে শায়ের কে বসতে দিলো। বসলো শায়ের।
-‘এই ঘরেই নওশাদ কে মেরেছি আমি!’
অবাক হলো না শায়ের,’আপনি নওশাদ কে মেরেছেন এটা আমি সেই রাতেই টের পেয়েছি।’
-‘কিভাবে টের পেলেন? আমি তো সাবধানে ঠান্ডা মাথায় ওকে মারলাম?’
-‘র*ক্তে*র গন্ধের সাথে যে আমি পরিচিত পরীজান।
তাছাড়া সকালে শেফালি আর কুসুম কে উঠোন লেপতে দেখেই আমার সন্দেহ সত্যি হয়। ওরা রক্তের দাগ ঢাকতেই এটা করেছে। আপনি আমার চোখে কিছুই ফাঁকি দিতে পারবেন না।’
পরী হেসে শায়েরের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে একটা দড়ি নিয়ে শায়েরের হাত চেয়ারের সাথে বাঁধতে বাঁধতে বলতে লাগল,’প্রথমে এইভাবেই নওশাদ কে চেয়ারের সাথে বেঁধেছিলাম। তারপর ওর মুখের ভেতর গামছা ঢুকিয়ে ছিলাম যাতে ও শব্দ না করতে পারে। তারপর ওর দুটো আঙুল কে*টে*ছিলাম।’
-‘তারপর কি করলেন?’
পরী এবার শায়েরের পা দুটো বাঁধতে লাগল,’তারপর
ওর বুকে ছু*রি চালিয়ে ছিলাম তারপর উঠোনের কোণে জীবিত পুঁতে দিয়েছি। আর তারপর আপনাকে অন্দরে ডেকেছি।’
-‘আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তা এখন আমাকেও সেভাবে মারবেন নাকি?’
শায়েরের কথা শুনে হাসল পরী। গামছা টা হাতে নিয়ে বলল,’নাহ,আপনি এখানে চুপটি করে বসে থাকবেন আর আমি বাগান বাড়িতে গিয়ে সিরাজ কে মে*রে চলে আসব।’
কথাটা শোনা মাত্রই শায়েরের চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে গেল। সে বিনয়ের স্বরে বলে,’ওখানে যাবেন না পরীজান। আপনার বিপদ হবে। আমার হাত খুলে দিন। দয়া করে যাবেন না।’
পরী শায়ের কে আর কথা বলতে দিলো না। গামছা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে দিলো। মাথা নেড়ে শায়ের পরীকে যেতে নিষেধ করে বারবার কিন্ত পরী সেসবে পাত্তা না দিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে চলে যায়। শায়ের ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্ত কোন লাভ হচ্ছে না। শক্ত করেই বেঁধেছে পরী। মুখ বাঁধা থাকায় কাউকে ডাকতেও পারছে না। নিজ কক্ষে গিয়ে পূর্বের ন্যায় পোশাক পড়ে নিল পরী। মুখটাও কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল। রুপালিও পরীর মতো পোশাকে নিজেকে তৈরি করেছে। পরী কুসুমের হাতে ওর ত*লো*য়া*র দিয়ে অন্দরে ঢোকার দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। যদি কেউ জবরদস্তি করে ভেতরে আসতে চায় তাকে যেন আঘাত করে। কুসুম জানে সে এটা করতে পারবে না তবুও সাহস করে দাঁড়িয়ে রইল। রিতিমত কাঁপতে লাগল সে।
রুপালি আর পরী ছাদে চলে গেল। আম গাছ বেয়ে দুজনেই মাটিতে নামল। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল বাগান বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাগান বাড়িতে চারজন রক্ষি আছে শুধু। আর সবগুলো জমিদার বাড়ি পাহারা দেয়। কারণটা অবশ্য পরী। কখন কি হয়ে যায় সেজন্য আফতাব এতো পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
অন্ধকারের পথ ধরে জমিদার বাড়ির দিকে আসছে সিরাজ। পথে হুট করেই শেফালি এসে দাঁড়াল। সিরাজ চমকে গেল শেফালিকে দেখে। সে বলে উঠল,’তুই এতো রাতে এখানে কি করস?’
-‘একখান কথার আপনেরে কইতে আইছি। নওশাদ রে পরী আপার খু*ন করছে। আমি নিজের চোখে দেখছি।’
-‘একথা আগে বললি না কেন? আর এখানে এসেছিস কেন তুই?’
-‘পরী আপার ডরে কই নাই। বড় কর্তা আপনারে বাগান বাড়ি যাইতে কইছে। শায়ের ভাইরে নিয়া হেরা বাগান বাড়িতে চইলা গেছে। তাই আমারে পাঠাইছে আপনেরে খবর দিতে। আপনে অহনই যান।’
সিরাজ কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে শেফালির দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল,’আমি জানি না আপনেরে ক্যান যাইতে কইছে। আমি গেলাম।’
দ্রুতপদে শেফালি প্রস্থান করল। সিরাজ ওখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল ওর আসতে দেরি বিধায় হয়তো শায়ের কে নিয়ে ওনারা চলে গেছে। তাই সিরাজ বাগান বাড়ির পথ ধরে। কিন্ত আফতাব আর আখির যে এখনও সিরাজের অপেক্ষা করছে তা সিরাজ জানতেই পারল না। বাগান বাড়ির বাইরে দুজন পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় দূরের ঝোপের ভেতর থেকে শব্দ ভেসে আসে। কিন্ত হচ্ছে তা দেখার জন্য একজন সেখানে যায়। সাথে সাথেই তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল পরী আর রুপালি। মাথায় আঘাত করে জ্ঞানহীন করে দেয়। এবং দাড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়। দ্বিতীয় জন প্রথম জনের খোঁজে যেতে তাকেও একই অবস্থা করে ফেলে রাখে। তারপর দুজনে একসাথে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। পরী সাবধানে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেই ঘরটাতে যায় যেখানে পরীকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্ত সেখানে গিয়ে পরী অবাক হয়। কেননা সেখানে জুম্মান বসা। মাথা নিচু করে জুম্মান বসে আছে। একজন রক্ষি ওকে খাবার খাওয়ার জন্য বলছে কিন্ত সে খাচ্ছে না। কাঁদছে আর বলছে সে মায়ের কাছে যাবে। বছর তেরোর ছেলেটা আর কি বুঝবে? পরী আর রাগ ধরে রাখতেই পারে না হনহন করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। পরীকে দেখে চমকে গেল লোকটা তবে চিনতে পারে না। তবে জুম্মান ঠিকই চিনে ফেলে পরীকে। সে বলে উঠল,’পরী আপা! আমারে এইহান থাইকা নিয়া যাও। আমি থাকমু না।’
লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো লোকটা পরীর নাম শুনে। কিন্ত পরী কায়দা করে তার লাঠি কেড়ে নিল এবং তাকেই আঘাত করে বসে। কিন্ত পরমুহূর্তে পেছন থেকে কেউ পরীকে লাঠি দ্বারা আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তাকিয়ে দেখে রক্ষি এসে পড়েছে। সে আবার পরীকে মারতে যাওয়ার আগেই তার রক্ত ছিটকে এসে পরীর মুখে পড়ে। কারণ রুপালি তাকে আঘাত করে বসেছে। বড় একটা ছুরি লোকটার পিঠে গেঁথে দিয়েছে। লোকটা সাথেই মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে। অন্যজন ভয়ে গুটিয়ে যায়। বুদ্ধি করে ওরা চারজন কে কাবু করে ফেলেছে। এখন শুধু সিরাজের আসার পালা।
#চলবে,,,,,
#চলবে,,,,