#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৪০)
আঁখি জবাব দিয়ে উঠার আগেই আশরাফ খান জিজ্ঞেস করলেন।
″কি হয়েছে আরিয়ান?কি বলেছিস তুই এমন আঁখিকে যে এখন ক্ষমা চাইতে হচ্ছে?″
অতঃপর আরিয়ান মির্জা সবকিছু হুবহু বলে গেলেন,কথাগুলো শুনে মুহুর্তেই আশরাফ খানের চেহারায় যেন কালো মেঘ নামল,রাগে চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করে গেল।
″তোর সাহস হলো কি করে আরিয়ান আমার মেয়েকে এতো তুচ্ছ ভাবার!আর এখন নিজের ছেলের প্রাণ বাঁচাতে আমার মেয়ের কাছে এসে অনুতাপের জল ফেলছিস,দ্বিতীয়বার তুই আমার মেয়েকে অপদস্ত করবি না তার কি নিশ্চয়তা আছে,আমার মেয়ের খারাপ দিক খোঁজে তার ভালো দিক ঢেকে দেওয়া লোকগুলোকে কখনও ক্ষমা করব না আমি,চলে আয় আঁখি।পারলে নিজের ছেলেকে সামলাক।″
আঁখি মাথা নিচু করে বাবার পাশে চলে গেল,আদৃতকে এ অবস্থায় ছেড়ে যেতে বুক কাঁপছে,এদিকটায় আর কখনও মা বাবার অবাধ্য যাবে না পণ করে নিয়েছে।আশরাফ খান আঁখির হাত ধরে হাঁটা ধরবেন তখনই আরিয়ান মির্জা সামনে চলে এসে উনাদের আটকালেন।
″আশরাফ আমি নিজের ভুল বোঝতে পেরেছি,শিক্ষিত হয়েও অধমের কাজ করেছি,আমাকে ক্ষমা করে দে,আমি কথা দিলাম আঁখিকে মাথায় তুলে রাখব সারাজীবন, তোর মেয়ে আমায় ভিক্ষা স্বরূপ দিয়ে দে।″
″আঁখি,আজ আমি তোর উপর নিজের চাহিদা চাপিয়ে দিব না,তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি তার সমর্থন করব।তুই কি আরিয়ানকে একটা সুযোগ দিবি?″
″বাবা মানুষ মাত্রই তো ভুল,ভুল আমরা সবাই করতে পারি তবে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ক’জন? ডা.আদৃত সারাজীবন অনেক কষ্ট পেয়েছেন উনাকে আর কষ্ট দিতে পারব না আমি,একটা মানুষের প্রাণ থেকে বড় তো কিছু হতে পারে না।উনার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না,কখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারব না অনুশোচনায়।কিন্তু তুমি যদি না চাও বাবা তবে আমি তোমার অবাধ্যও যাব না।″
″পাগলি মেয়ে আমার এতো বোঝদার হয়েছে জানতাম না।তা আরিয়ান বিয়ের ডেট ফিক্স করবি না এখনও কিছু ইমোশনাল ড্রামা বাকি?″
আশরাফ খানের কথায় আরিয়ান মির্জা আলতো হেসে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,আঁখি লজ্জাময়ী হাসিতে স্থান ত্যাগ করল।
_____________
পরদিন সকালে,
রিদিকার অর্ধেক চুল পরে গেছে,চোখের তলটা অস্বাভাবিক ভাবে কালো হয়েছে,আরও তিনটে দাঁত উঠে গেছে আজ সকালেই,শরীরের চামড়ার যা তা অবস্থা। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠল,ভয় হচ্ছে নিজেকে দেখতেই অন্যরা কেমনে দেখবে তাকে,আদ্রিশ তো চোখ তুলেও তাকায় না এখন,রাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তিক্ত কথা শুনিয়ে যে চলে গিয়েছিল কোথাও এখনও ফিরে নি,পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও চোখ সরিয়ে রাখে এখন তার উপর থেকে,বাড়িতেও থাকে না তেমন,সকালে বেড়ুলে রাতে ফিরে।
হঠাৎ গাড়ি আসার শব্দে আদ্রিশ এসেছে বুঝতে পারল রিদিকা,তার সাথে শেষমেষ একটা কথা বলবে ভেবেছে, এদিকে আদ্রিশ ঘরে ঢুকতে নিলে দরজার পাশে একটা খাম পরে থাকতে দেখে, কৌতুহলবশত উঠায় সেটা,এভাবে কোনো খাম দরজার সামনে পরেই বা কেনো থাকবে!সেই চিন্তাতে খামটা উঠিয়ে ভেতরে দেখে,ভেতরে একটা রিপোর্ট দেখতে পায়,কিন্তু রিপোর্টটা পড়ার পর আদ্রিশের চোখ ছানাবানা হয়ে গেলে।চেঁচিয়ে উঠল রিদিকা বলে,ঘড়ের ভিতর তেড়ে গেল।
রিদিকা হুটহাট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল,আদ্রিশ তার মুখের সামনে রিপোর্টটা ধরে চেচিয়ে বলল।
″এসব কী রিদিকা?তুমি প্রেগন্যান্ট হতে পারো কি করে?″
″হোয়াট,আমি প্রেগন্যান্ট,আমি প্যাগন্যান্ট নই আদ্রিশ,এমন কোনো সিনড্রোম এখনও আমি পাই নি,এ ভুয়া রিপোর্ট কে দিয়েছে তোমায় যে জায়গাতে আমি এখনও কোনো টেস্ট করাই নি? আর যদি প্রেগন্যান্ট হই তবুও কি সমস্যা?তুমি তো বাচ্চার দোহাই দিয়েই বিয়ে করলে আমায়!″
কথাটা কানে যেতেই আদ্রিশ রিদিকার গাল বরাবর জোরালো একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল, অতঃপর গর্জে বলল।
″যে জায়গাতে আমি কখনও বাবা হতে পারব না সেখানে তুই মা কেমনে হবি!বল এই বাচ্চা তোর কোন নাগরের?বল কার বাচ্চা এটা?নইলে তোকে প্রাণে মেরে ফেলব আমি।
রিদিকার থুতনিতে সজোরো চেপে ধরে বলল আদ্রিশ, রিদিকা কান্নার সহিত জবাব দিলো।
″আমার বিরুদ্ধে ষরযন্ত্র করা হচ্ছে আদ্রিশ,আমি এসবের কিছুই জানি না,আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি,আর আমি প্রেগন্যান্ট নই।″
″চুপ কর,নষ্টামি করে এখন অবলা সাজার ডং করছিস,ছিঃ তোর এমন অবস্থা কোন পুরুষ তাকায় তোর দিকে কে জানে!রাস্তার নোংরা মাথায় তুলতে নেই মানুষ ঠিকই বলে,আমাকে পা*গ*লে কু*কু*র কামরেছিল যে তোর মতো নোংরাকে ঘরে তুলেছিলাম,তোর জন্য আমি আমার আঁখি আমার পরিবারকে হারিয়ে গেছি,কিন্তু আর না,তোকে এভাবে বার করব না,ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব ঘর থেকে অপেক্ষা করিস শুধু।″
আদ্রিশ এবার হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।রিদিকা অগ্নিদৃষ্টিতে আদ্রিশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বলল।
″তবে তোমারও সময় এসে গেছে আদ্রিশ,অপেক্ষা করো শুধু, রিদিকা তোমাকে তোমার ভাগের টা তোমায় এবার ঠিকই দিবে।″
_______________
আদৃত চোখ খোলে আঁখিকেই সামনে পেল নার্সদের সাথে কি জানি কথা বলছে দাঁড়িয়ে, আদৃতের উপর চোখ গেল আঁখির,চোখাচোখি হলো দু’জনের,আদৃত বেশ অভিমান নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।আঁখি মুচকি হাসল এতে।
নার্সদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বলল।অতঃপর আদৃতের পাশে বসে গলা খাঁকারি দিলো।
″এই যে চোখা নাকওয়ালা, ডাক্তারের সাথে কিন্তু রাগ অভিমান মানায় না।″
″কে বলেছে আপনাকে আমার চিকিৎসা করতে,চলে যান,আমাকে আমার হালে ছেড়ে দিন।″
″হুম, এসেছিলাম তো চিকিৎসা করতে,তবে এসে রোগীরই প্রেমে পরলাম,কিন্তু রোগী তো আমার দিকে তাকাচ্ছেই না।″
″দেখুন মশকরা করবেন না,এমনিতেই ভালো লাগছে না কিছু,চলে যান।″
″যাহ, রোগীর চোখা নাকের প্রেমে পরেছিলাম কিন্তু অভিমান হয়ত তার নাকের ডগায় চরে বসেছে,যাক আমার আর কি হেরে যাওয়া মন নিয়ে চলে যাই।″
কথাটা বলতেই আদৃত ফিরে তাকালো আঁখির দিকে।রসকষহীন স্বরে বলল।
″কোথায় যাবে?যেখানেই যাবে আমাকে পাবে।পিছু ছাড়ব না আমি তোমার।″
″বাহ,একটু আগেই তো শুনছিলাম কেউ আমাকে আপনি করে ডাকছিল,মুহুর্তেই দেখি হাবভাব চেঞ্জ,তা পিছু না ছাড়ার কথা বলে আপনি যেভাবে হারিয়ে যেতে নিচ্ছিলেন।হা হা হা হা।″
কথাটা বলে আঁখি অট্টাহাসিতে ফেটে পরল,আদৃত হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলল।
″হাসছ কেন?আমি মরে গেলে খুশি হতে বুঝি?″
″একদম চুপ,আবার যদি এমনটা বলেছেন তবে আর কখনও আপনার সামনে আসব না,এমন কোথাও চলে যাব যে আমাকে কখনও খোঁজে পাবেন না।″
হাসি থামিয়ে এবার ককর্শ ভাবে বলল কথাগুলো।আদৃত উঠে বসল এবার।
″আরে কি করছেন?আপনি দূর্বল উঠবেন না এখন।″
″আমি ঠিক আছি আঁখি,আগে বলো এই যে অধিকার,আমাকে হারিয়ে দেওয়ার ভয় যা আমি তোমার চোখে দেখছি তা মিথ্যে নয়,বলো তুমি কখনও আমায় ছেড়ে যাবে না,ভালোবাসো আমায়।বলো?″
আঁখি কিছু না বলে আদৃতকে জড়িয়ে ধরল,অতঃপর মৃদু স্বরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল।″
″ভালোবাসি আপনাকে।″
কথাটা আদৃতের কান বিশ্বাস করে উঠতে পারল না,আঁখিকে ছাড়িয়ে আশ্চর্যের সহিত জিজ্ঞেস করল।
″মিথ্যে বলছ না তো!″
″হতেও পারে,অসুস্থ মানুষকে শান্তনা প্রদান কিন্তু ডাক্তারের কর্তব্য।″
″ফাজলামো করো না আঁখি,সত্যিটা বলো।″
″আল্লাহ, পরলাম কোন চোখা নাকওয়ালার ধান্দায়,আরে আপনার বাবা আমার বাবা মিলে আমাদের বিয়ের ক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন,আমি রাজি না থাকলে কি করতেন তা?″
″কি!″
″হয়েছে আর অবাক হতে হবে না,যে কান্ড করেছিলেন আপনি।মজনু সাহেব বেঁচে থাকলে আজ আপনাকে দেখে হয়ত আফসোস করতেন।″
″আমি মজনু হতে চাই না আর না তো দেবদাস,আমি আঁখির আদৃত হয়েই থাকতে চাই,তার পাগল প্রেমিক রুপে।″
″জানেন আমার কি মনে হয় আপনার ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে লাভ গুরু হয়ে যাওয়া উচিত, যা শুরু করেছেন।″
আদৃত এবার অল্প টানে আঁখিকে নিজের বেশ কাছে নিয়ে গেল,আঁখির কপালের সামনা দিয়ে বেড়িয়ে আসা ছোট চুলগুলো কানের পিছন গুজে দিয়ে বলল।
″তোমার প্রেমে এই প্রেমিক যা তা হতে পারে।″
″হয়েছে এবার কথার ফুল না বেঁধে শুয়ে থাকুন,আমার আরও রোগী আছে।″
আঁখি আদৃতকে হালকা ধাক্কাতে ছাড়িয়ে ছোটে পালিয়ে আসতে লাগল।আদৃত পিছনে বলল।
″আমি ছাড়া কোনো পুরুষ রোগী দেখলে কিন্তু খবর আছে,কিন্তু তোমার না ওই পুরুষের।″
″পাগল একটা।″
আঁখি হাসতে হাসতে চলে গেল,আদৃতও জায়গায় বসে হাসছে।
চলবে…