#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ১৫
#মাহিয়া_মুন
সকালের মিষ্টি রোদের সোনালী আলোয় পরিবেশ আলোকিত। জানালা ভেদ করে আসা রোদের আলো চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকে গেল নিহার। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই চমকে গেল সে। আদ্রিজ তার হাত ধরেই মেঝেতে শুয়ে আছে।
নিহা চারদিকে তাকিয়ে কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।
কারণ সে এই রুম আগে কখনো দেখে নি। সামনে দেওয়াল জুড়ে আদ্রিজের হাসি মাখা ছবি টাঙানো দেখে কিছুটা অনুমান করলো যে সে এখন কোথায় আছে।
চৌধুরী বাড়িতে সে এবং মেঘা অনেকবারই এসেছে তবে কখনো এই রুমে আসে নি। তাই সে চিনতে প্রথমেই পারে নি।
নিহা আদ্রিজের ধরে রাখা হাত টির দিকে তাঁকালো।
লোকটা কি শক্ত করেই না ধরে রেখেছে হাতটি ঘুমের মাঝেও। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। নিহা আনমনেই হেসে উঠলো।
হটাৎ ই হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। তার অনেকটাই মনে আছে সে গত বিকেলে ড্রয়িং রুমে কি করেছিল। এবং এটাও এখন বুঝতে পেরেছে যে সে কেন এমন করেছে। গতকাল ডক্টর এইখানে বসেই সবার কাছে তার মেন্টাল কন্ডিশনের কথা বলেছিলেন। তখন নিহার কিছুটা জ্ঞান ছিল। দুর্বলতার কারণেই হয়তো চোখ খুলতে পারছিল নাহ। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
নিহা মনে মনে বলে উঠলো,
“সব তো ভালই চলছিল। ভালোই তো ছিলাম। হটাৎ করে কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে। এমন একটা পরিস্থতিতে এসে দাঁড়িয়েছি, নিজেকে যে অল্প হলেও সুস্থ্য রাখতে হবে। অন্তত ওই সুদূর জার্মানে যাওয়া অবধি। পুরনো দিনে যখন ফিরেই গিয়েছি তখন এর শেষ অবদি তো আমাকে দেখতেই হবে। এখনো যে একটা হিসাব মিলানো বাকি আছে আমার। আইনের লোক বেআইনী কাজ করে পার পেয়ে যাবে তাইনা, আমার বাবাকে পিছ থেকে ছুরি মারবে আর কেউ বুঝতে পারবে না। খুব বড় ভুল করলে। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে আমাদের। আর…আর…সেই সাথে জানতে হবে কে….এই আদিত্য।”
আনমনেই হেসে উঠলো নিহা। এই হাসি যেন বলে দিচ্ছে কারো জীবনের শেষ সময় গনিয়ে আসার কথা।
আদ্রিজের সারপ্রাইজ এর কথা মনে হতেই তার মুখের হাসির চওড়া হলো। লোকটা নিশ্চই আজ তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে করতো। সেইরকম ই তো মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।
আদ্রিজের দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হল।
লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আদ্রিজ হেসে বললো,
“কি ব্যাপার মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী, আমার দিকে তাঁকিয়ে কোন ভাবনায় ডুবে ছিলেন শুনি। আমায় ও একটু বলুন।”
‘মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী’ ডাকটা শুনতেই যেন নিহার মন জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। না চাইতেও মুখ জুড়ে দেখা দিল এক চিলতে হাসির রেশ।
“কি হল হাসছো কেন হুমম। হাসির কথা বলেছি বুঝি। নাকি মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী ডাকটা শুনে হাসলে কোনটা বলোতো?”
নিহা নিজেকে সংযত করে হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কি…কিসব ফালতু কথা বলছেন। আর আমায় এসব অদ্ভুত নামে ডাকতে মানা করেছি না।”
“মিসেস আদ্রিজ চৌধুরীকে তো মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী ই ডাকবো তাইনা। এইখানে ফালতু কি বললাম শুনি।”
“দেখুন আমি মিসেস নই আর আপনার…….”
“হ্যা বলো কি আমার?”
“আব….আমি আমি মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী নয় তাহলে কেনো ডাকছেন? এইটা কি ফালতু কথা নয়।”
“যা সত্যি তাই। বলেছিলাম না আজকে সারপ্রাইজ দিব।”
মেঘার টনক নড়ল।
“কি সারপ্রাইজ?”
আদ্রিজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমের দরজা ধাক্কার আওয়াজ পেল।
দরজা খুলতেই দেখতে পেল প্রায় সবাই ওপাশে দাড়িয়ে আছে। আদ্রিজ সরে যেতেই এক এক করে করে সবাই ভিতরে ঢুকলো।
মেঘার মা নিহার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলেন,
“এখন কেমন লাগছে মা তোর?”
“মামনি আমি একদম ঠিক আছি। তোমরা এতো চিন্তা কোরো নাতো।”
“সেতো দেখতেই পাচ্ছি আমরা কতটা ঠিক আছিস। চল ফ্রেশ হবি। আমি তোকে হেল্প করছি।”
এই বলে মেঘা নিহাকে ধরে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেল।
সবাই কিছু একটা নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলো।হটাৎ আদ্রিজ তার মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, বাবা আর কাকাই কোথায়? তারা বললো না আজ সকালে কাজী নিয়ে আসবে।”
“হ্যা বাবা কথা তাই ছিলো। তবে আজ সকালে হটাৎ তোর নানু বাড়ি থেকে কল এসেছে। আদিত্যর কথা তোর মনে আছে না। আদিত্য আজ সকালে দেশে ব্যাক করেছে। তবে তোর আদিল আংকেলের নাকি পরশু রাত থেকে ফোন বন্ধ। তার সাথের কারো একজনের ফোনে নাকি মেসেজ করে বলেছিল কোনো একটা কাজে সে কোথাও যাচ্ছে। কিছুদিনের মাঝেই চলে আসবে। সে নেই , ভাবলাম আদিত্য কে এইখানে নিয়ে আসি। আর বিকালে ধর্মীয় ভাবে তোদের বিয়ের কাজ টা সেরে ফেলবো। আদিত্য ও এইখানে বিয়েতে থাকবে।”
“ভালো তো। তবে বেশীদিন যেন না থাকে। ওই ছেলে এবং তার বাবাকে আমার একদম সহ্য হয় না এইটা খুব ভাল করে জানো তুমি। অন্যের জিনিসে নজর দেওয়া এদের অভ্যাস।”
এই বলে আদ্রিজ রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
“এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি নাহ। কেন যে আদিল ভাই এর কথা শুনতে পারে না এই ছেলে, আপা চলেন নাস্তা করবেন। আরে ঐতো মেঘা আর নিহা এসে পড়েছে। মেঘা আমরা যাচ্ছি। তুমি নিহাকে সাথে করে নিয়ে এসো।”
এই বলে আশা চৌধুরী সহ সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
নিহা যেন স্তব্দ হয়ে গেছে। অপলক তাকিয়ে রইলো আশা চৌধুরীর চলে যাওয়ার দিকে। তার কানে এখনো আশা চৌধুরীর বলা কথাগুলো বাজছে।
তার মানে চৌধুরী পরিবারের সাথে আদিল এহসানের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। কি সেই সম্পর্ক?
*#ভালোবাসার_প্রজাপতি
#পর্বঃ১৬
#মাহিয়া_মুন
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আদ্রিজ এবং নিহা বসে আছে রুমে। নিহা একের পর এক চমক যেন আর নিতে পারছে নাহ্। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে মিসেস মারিয়াম হাওলাদার তাকে খাবার খাওয়ানোর সময় এমন কিছু বলেছিলেন যা শুনে সে অতিরিক্ত মাত্রায় শকড হয়ে গেছে।
মামনির বলা সেই কথার প্রভাবে যেন তার মাথা থেকে আদিত্য আসার কথাটাও চলে গেছে।
সে যা করতে চায় নি তার অজান্তেই তা হয়ে গেলো। সে আইনত মিসেস আদ্রিজ চৌধুরী হয়ে গেলো। তার অজান্তেই হয়ে গেল সব। নিহার এখন নিজেকেই নিজে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে এতটা বোকা কি করে হল। তাকে যখন হসপিটালে কাগজে সাইন করতে বলা হয়েছে , তখন কাগজটা পড়ে নিলেই এতো কিছু আর হতো না।এখন সে কি করবে। সব কিছু যতটা সহজে করতে চাচ্ছে ততটাই যেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আদ্রিজ অনেক্ষন ধরেই নীরবে লক্ষ্য করছিল নিহাকে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে নিহা কিছু একটা লুকোচ্ছে সবার কাছ থেকে। এই মুহুর্তে নিহাকে তার কাছে ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী নিয়ে মেয়েটা এত ভাবে। যার কারণে মেন্টালি এতো ডিপ্রেসড। নাকি তার করা কাজটা মেনে নেয় নি। খুব কি ভুল করে ফেললো সে।
“এলোকেশী।”
আদ্রিজের ডাকে নিহা নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। কিছুটা অদ্ভুত ভাবেই যেন তাকালো আদ্রিজের দিকে।
নিহার এইরকম তাকানোতে আদ্রিজ যেন কিছুটা ভরকে গেল। হালকা হেসে বললো,
“দেখো তোমার অজান্তেই হয়তো বিয়ের রেজিস্ট্রি করে ফেলেছি কাল সকালে হসপিটালে। তুমি ভীষন রেগে আছো বুঝতে পারছি। তবে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে আমি হারাতে চাই না। তাই তোমার অজান্তে কাজ টা করতে বাধ্য হলাম।তাই বলবো যেভাবেই হোক এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী। একটু পর বিকালে ধর্মীয় ভাবেও বিয়ে সম্পন্ন হবে। সম্পর্ক টাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। আর হ্যা আমি জানি তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো। জোর করবোনা তবে তোমার যদি ইচ্ছে হয় অন্তত আমাকে জানিয়ো। তোমার এই হাত দুটি যখন ধরেছি। সকল বিপদ আপদে আমায় পাশে পাবে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নেও।”
এই বলে আদ্রিজ নিহার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
আদ্রিজ বেড়িয়ে যেতেই নিহা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। কিছু একটা ভাবতেই মুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত হাসি। আদ্রিজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“অসংখ্য ধন্যবাদ আদ্রিজ বাবু। বিয়েটা যে হওয়ার ই ছিল। আদিত্য লোকটা কে, জানার জন্য হলেও যে বিয়েটা খুব জরুরী। ”
এই বলেই নিহা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে উঠলো।
ড্রয়িং রুমে সকলের সাথেই বসে আছে নিহা। আশা চৌধুরী ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে আদিল এহসানের সাথে তাদের সম্পর্কের কথাটা।
মিসেস আশা চৌধুরীর চাচাতো ভাই হলেন মিস্টার আদিল এহসান। আর তাঁর ছেলেই মিস্টার আদিত্য এহসান। আদিল এহসানের বউ নাকি আদিত্য হওয়ার পর হটাৎ করেই কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছেন। অনেক খোঁজার পরও তার খোঁজ কেউ পায় নি। যদিও নিহার কাছে মনে হচ্ছে তাঁর বউ এর এইভাবে নিখোঁজ হওয়ার পিছে অবশ্যই মিস্টার আদিল এহসান কোনো ভাবে জড়িত ছিল।
নিহা বুঝতে পারলো তার মাঝে হটাৎ ভীষণ এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে । নিশ্চয়ই এই আদিত্য এহসান কে দেখবে বলেই এরকম হচ্ছে। লোকটার সাথে যে দেখা হওয়াটা খুব জরুরী।
নিহার হটাৎ করেই চোখ পড়লো মেঘা এবং মেঘ ভাইয়ার দিকে। দুজন চোখের ইসারায় এখানে বসেও নিজেদের প্রণয় চালিয়ে যাচ্ছে। আনমনেই হেসে উঠলো নিহা।
তবে সে হয়তো বুঝতে পারছে না, কেউ একজন গভীর মায়াবী চোখে তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে।
আদ্রিজ অপলক তাকিয়ে আছে তাঁর সামনে বসে থাকা মায়াবিনীর দিকে। এই এলোকেশী মায়াবিনী যে শুধুই তার। ভাবতেই নিজেকে কেমন সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।
আদ্রিজের হটাৎ করেই একটা কথা মনে আসলো,
“ইসস যে যারে ভালোবাসে তারেই যদি পেত।”
#চলবে
*
*
#চলবে