#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৪।
পৃথিবীর বুকে হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছে। গর্জন করছে বিদ্যুৎ। ঝড়ের প্রকপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। মার্জানের জীবন-টাও যেন ঠিক এই ঝড়ের প্রকপে লন্ড-ভন্ড হচ্ছে। নিস্তব্ধ চতুর্দিকে শুধু আসমানী তান্ডবের আওয়াজ গুঞ্জন তুলছে। গুমোট পরিস্থিতিতে এবার একটি চিৎকার শোনা গেলো,
” ভা’দ্র”
গলাটা ছিলো রিয়ানার। মুহুর্তে তান্ডবে হতভম্ব হয়ে গেছিলো ওঁ। নিজেকে তটস্থ করে এক ছুটে গেলো ভাদ্রের কাছে। ভাদ্র ততক্ষনে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। ভাদ্র’র আধো খোলা চোখ আর কম্পিত গলায় বিড়বিড় করছে,
” মা’মী।”
টগরের রাগে গা কাঁপছে। নিজের মেয়েকে নরকের পশুর হাতে তুলে দিতে চাইছিলো? কত সর্বনাশ টা-ই করছিলো টগর। টগরে রাগ যেন কমছেই না। হাতে ফুলদানি দিয়ে আরো একটি বাড়ি বসাতে যেতেই নিজেও চিৎকার করে উঠে টগর। পিছন থেকে রিয়ানা একটি কাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। এ-সব কি হচ্ছে? নিজের ভাগ্নী যাকে মেয়ের থেকে কম দেখে-নি কখনো সে নাকি ওঁর গায়ে হাত তুলেছে? টগরের চোখ এবার ঘোলাটে হয়ে আসচ্ছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিয়ের ঘর বলেই নিচে নামছিলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের চিৎকারে ছুটে এসে এসব কিছু দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছিলো। তাই সামনে যা পেয়েছে তা দিয়েই বা’ড়ি মে’রে’ছে। কিন্তু রিয়ানা এমন কিভাবে করতে পারে? কিভাবে?
এত কিছু মধ্যে হতবুদ্ধি মার্জান ছুটে এলো মায়ের কাছে। চিৎকার করে ডাকছে,
” মা, মা ওঠো! মা কথা বলো, রিয়ানা এইটা কি করলে তুমি?”
রিয়ানার চোখে মুখে কোনো ভাব দেখা গেলো না। মুখ ফুঁটে বলল শুধু,
” আমি-তো কিছু করিনি, যা করেছো তুমি করেছো।”
বলেই হাতের কাঠটি মার্জানের পাশে ছুঁড়ে মারলো। মার্জান আকাশ থেকে পড়লো যেন। এসব কিছু বলছে ওঁ? মার্জান আবার কিছু বলবে এর আগেই ঢুকলো সুরভি! ঘটনা কি ঘটে গেছে বুঝতে পেরেই তিলকে তাল বানিয়ে ডাকলেন সবাইকে।ভাদ্র আর টগরকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। রিয়ানা মেকি কান্না করা শুরু করেছে কখন থেকে, এসব কিছু দেখে ভয় পেয়েছে যেন এমন ভাব। সুরভি মেয়েকে সান্তনা দিচ্ছে। তাহের শেখ নাতনিকে আদুরে কন্ঠে বলতে বললে, ঘটনার বর্ণনা করলো বিপরীত ভাবে,
” নানাজান… আ-মি আমি দেখেছি দিদুভাই ভাদ্র ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করছে, কথার মাঝেই আপু ভাইয়াকে বা-ড়ি মা-রে। খালাজান যখন ফিরাতে যায়, খালাজানের মাথাতেও আপু বা-ড়ি দেয়।”
বলেই মায়ের বুক জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো। হুহু করে কান্না করতে লাগলো।
সব কিছু শোনার পর, মার্জানকে নানাজান ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখলেন। বললেন,
” শেষ পর্যন্ত খাল কেঁটে কুমির এনেছি আমি! যদি টগরের কিছু হয়? আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
মার্জান নিরবে কাঁদছে। হাটু মুড়ে বসে আছে। মিন মিন করছে,
“আমি আমি কিছু করিনি নানাজান। আমি মা’রি ‘নি কাউকে!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা?
হসপিটালের করিডোর বসে আছে সবাই। চিন্তিত মুখ। ফিনাইলে গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডাক্তার এবার বের হলেন। জানালেন,
” মিসেস টগর কোমায় চলে গেছে। আর মিঃ ভাদ্র এখন ঠিক আছে।”
উপস্থিত সবাই এবার নড়েচড়ে উঠলো। টগরের কথা শোনে তাহের শেখ জমে গেছে। উনি তপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন মার্জানের দিকে। মার্জান উঠে এদিকেই আসছে মা’কে এক পলক দেখবে বলে। কিন্তু ওঁর পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লো তাহের শেখ। কঠোর গলায় বললেন,
” আজ এর এই মুহুর্তে থেকে তুমি আমার এবং টগরের কেউ না। এই খান থেকে চলে যাও। আমি চাইলে তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম মার্জান কিন্তু এতে করে আমার মান-সম্মানটায় দাগ পড়বে। ”
মার্জান কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
” নানাজান বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি। আমি মাকে দেখতে চাই, একটি বার দেখতে চাই। আমাকে যেতে দাও!”
নানাজান শুনলেন না। সুরভীকে ডেকে বলেন,
“আমার পরিবারে ত্রৃসীমানায় যেন না দেখি।”
সুরভী খুব খুশি হলো। মার্জানকে টেনে নিয়ে ফেললো হসপিটালের বাহিরে। ছিকটে পড়লো মাটিতে মার্জান। ঝড়-বৃষ্টির তান্ডবে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সুরভী হাসছে। বলল,
” আজ তোর বাপ থাকলে খুব ভালো হতোরে মার্জান, দেখতে পেতে নিজের মেয়ের কি ভিক্ষারীর মতো অবস্থা হয়েছে। ”
মার্জান এবার কাঁপা কন্ঠে চেঁচালো। ঠান্ডায় জড়িয়ে আসচ্ছে কথা,
” আমি তোমাদের কি করেছি, কেন করছো এমন আমার সাথে? কেন দেখা করতে দিচ্ছো না আমার মার সাথে?”
সুরভী হাসলো হো হো করে,
” তোর মা? সিরিয়ালি?হাসতে বাধ্য করলি। ওহো, হ্যাঁ ভুলেই গেছি, টগর তো তোকে সত্যিটি বলেই নি।”
মার্জান চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। এই কয়েকটি মাসে ওঁর সামনে কত কিঠু দেখবে?
” তুই তো তোর মায়ের আপন সন্তান-ই না।তুই তো তোর বাপের নাজায়েজ সন্তান। বেচারি টগরতো কখনো মা হতে পারেনি। ভালো মানুষ, আর ভালো মন বলেই তোকে পেলে বড় করেছে!”
মার্জান অবিশ্বাস্য চোখে চাইলো। মাটিতে থেকে উঠবার খুব চেষ্টা করেও পারলো না। সারা শরীর অসাড়তা ঝেঁকে বসেছে। চোখ জোড়াও বন্ধ হতে চাইছে।
” খালাজান তুমি… তুমি মিথ্যা বলছো, বুঝলে, মিথ্যা বলছো, মা আমাকে বলেছে আমি তাঁর রক্ত। ”
” ও-হো নাদান মার্জান, একবার তোমার খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়, রক্তের প্রয়োজন ছিলো।সেই মুহূর্তে টগর তোমাকে দয়া দেখিয়ে রক্ত দিয়েছিলো। তাই হয়তো বলেছে”
মার্জান এসব মানতে নারাজ। ওঁ ধীরে ধীরে উঠবার চেষ্টা করলো।
” মিথ্যা বলছো। মিথ্যা বলছো তুমি। আমি.. আমি মায়ের সাথে দেখা করবো।”
” সুরভী সত্যি বলছে, তুই টগরের মেয়ে না।”
তাহের শেখের কন্ঠে মার্জানের পা সেখানেই জমে গেলো। ধপাস করে বসে পড়লো আবার। টগরের হাসি হাসি মুখটি ভাসছে ওঁর চোখে। টগরের করা আদর, শাসন, ভালোবাসা গুলো অনুভব করছে। আবেগে আপ্লুত মার্জান হাত জোর করলো এবার,
” নানাজান, একটি বার একটি বার দেখতে দাও না মাকে, দূর থেকেই দেখবো শুধু!”
” নাহ্। কোন মুখে দেখতে চাস তুই? যে মা তোর জন্য এত লড়াই করেছে, সে-মাকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলি, হাত কাঁপলো না তোর? একটি বার? এখন কোন মুখে দেখা করতে চাইছিস?”
ধিক্কার জানালের এবার তাহের শেখ। মার্জান এসব কিছু আর সইতে পারছে না।
” আমি মাকে মা’রি’নি। মা’রি’নি। মাকে রিয়ানা মেরেছে। ”
বলেই ঢুকরে উঠলো মার্জান। সুরভী ঘাবড়ে গেলো তখন। দু’কদম এগিয়ে এসে চড় বসালো গালে। চুলের মুঠি টেনে বলল,
” আমার মেয়েকে এখন কালপ্রিট বানাতে চাইছিস? সাহস কত? আর একটি বার মিথ্যা বলে দেখ। মেরে এখানেই পুতে দিবো।”
এর ছেড়ে দিলো মার্জানকে। মার্জান সেখানেই লুটিয়ে পড়লো। হাড়গোড় ভেঙ্গে আসছে এবার। আধো খোলা চোখে শুধু দূরে যেতে দেখলেন তাহের শেখ আর সুরভীকে। মার্জান নিজেকে সঠিক প্রমান করার জন্য বার বার বলছে,
” আমি কিছু করিনি, মাকে মা-রি’নি। মা… মা গো… মা!”
মার্জানের পেটে মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব হতে গলা কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো শুধু। এর পর পুড়ো পৃথিবী অন্ধকার করে চোখ বুঝলো মার্জান।
সারা-রাতের ঝড়-বৃষ্টির পর সকালের মিষ্টি নরম সোনালী আলো কিশোরী হাসির মতো ঝলমল করছে। পাখিরা গাইছে গান। গতিশীল পৃথিবীর গতিপথের ধ্বনি। মার্জান পিট পিট করে চোখ খুললো এবার। হসপিটালের সাদা চাদর মুড়ি শুয়ে আছে মার্জান। মার্জানকে চোখ খুলতে দেখেই এক বৃদ্ধা বলে উঠলেন,
” মার্জান বেবি এখন কেমন লাগছে?”
মার্জান ওঁর সামনে ওঁর বাবার বাড়ি কাজের মহিলা মনোরমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ফুপিয়ে উঠে বলল,
” আন্টি, মা…”
“আমি জানি বেবি। তুমি কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে!”
মার্জান বলল,
” কিছু ঠিক নেই আন্টি। কিছুই না। সবাই আমাকে ভুল ভাবছে, কেউ আমাকে মায়ের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না!”
বলেই আবারো কাঁদতে লাগলো ওঁ। মনোরমা তখন বলে উঠলো,
” বেবি, সত্যি কখনো চাপা থাকে না। তুমি কেঁদো না। সত্যিকে লুকিয়ে রাখতে তো পারা যায় কিন্তু মুছে ফেলা যায় না। আর তোমার এই অবস্থা এতো টেনশন নিয়া ঠিক না বেবি। তোমার বাচ্চার উপর প্রভাব পড়বে!”
মার্জানের বাচ্চার কথা কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো,
” বাচ্চা…!”
মনোরমা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। মার্জান থম মেরে গেলো। নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি এর উপর এই বাচ্চা? কিভাবে পারবে মার্জান সামলাতে এইসব কিছু?
কিছুক্ষণ পর….
ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে মার্জান। এতক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বলল,
” মেম আমি এই বাচ্চা চাই না।”
ডাক্তার মার্জানকে আজব নজরে দেখলো। বলল,
” আজ-কালকের ইয়াং জেনারেশনদের কি যে হয়েছে? একে অপরের কাছে আসতে সময় লাগে না। কিন্তু বাচ্চা চলে এলেই মারতে চলে আসে।”
কথা গুলো গায়ে বিঁধলে চুপ রইলো মার্জান। ডাক্তার তখন এবসন পেপার এগিয়ে দিয়ে বললেন ফিলাপ করে জমা দিতে কাউন্টারে। মার্জান তাই করলো। কিন্তু সাহস এবার হারিয়ে গেলো ওটির ভিতরে এসে। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো একটি মেয়ে বাচ্চা এবোট করিয়েছে। ট্রের মাঝে একটি বাচ্চার সদ্য গড়ে ওঠা ছোট ছোট হাত-পা, মাথা, শরীর। কেঁটে কেঁটে বেড় করে রাখা। কি নির্মম দৃশ্য মার্জানের হাত পা শিউরে উঠলো। নিজের অজান্তেই পেটের মাঝে হাত চলে গেলো। চোখ দিয়ে পড়তে লাগলো জল গড়িয়ে। মার্জানের চোখে ভাসতে লাগলো বার বার ওই ছোট শরীরটা। একটি নার্স এসে নিয়ে গেলো সেই ট্রে টা। মার্জানের কি হলো সে নিজেও গেলো পিছুপিছু। নার্সটি ওই ট্রে টির বাচ্চাটাকে বাহিরের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। মুহূর্তেই দু’টো কুকুর এসে কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিলো বাচ্চার ছোট ছোট মাংসের পিন্ড গুলো। চোখের সামনে এসব দেখে গা গুলিয়ে এলো মার্জানের। বমি করে বসলো ওঁ। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই ওঁর বাচ্চার সাথে-ও এমনটি হবে? ফেলে দিয়া হবে কোনো ডাস্টবিন, ছিঁড়ে-বিড়ে খাবে এই কুকুর গুলো? বুকে মাঝে ভাড় ভাড় মনে হচ্ছে মার্জানের। নিঃস্বার্থ এই পৃথিবীর বুকে কেউ নেই এখন পাশে। এঁকা জীবন কিভাবে পাড় করবে ওঁ বা এই বাচ্চাটিরই বা কি হবে? কি নাম দিবে এই বাচ্চাটিকে? নাজায়েজ, নষ্ট রক্ত আরো কত কিছুই না শুনতে হবে? মার্জানের কাছে না-হয় বাবা ছিল টগরের মতো মা ছিলো, কিন্তু এই বাচ্চাটির তো কেউ থাকবে না! মার্জান যুদ্ধ করতে লাগলো এক প্রকার মনের সাথে।
” ম্যাম চলুন এবার আপনার পালা!”
একটি নার্সের গলা ভেসে এলো। ভেঁজা চোখে তাকালো মার্জান। পাশেই এসে দাঁড়ালো মনোরমা। বলল,
” মার্জান বেবি, মা হওয়া ভাগ্যের বিষয়। বাচ্চাটি কি দোষ করেছে বলো? বাকিটা তুমি যা ভালো বোঝো!”
মার্জান মনোরমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দূর থেকে একটি ছোট বাচ্চার হাসির খিলখিল শব্দ কানে বাঁজতেই তাকালো মার্জান। আহ্ কি সুন্দর হাসি, কি মায়াবী, কত মিষ্টি সেই অনুভূতি। মার্জানের ভাবনার আবার ফোঁড়ন কাঁটলো নার্সের কন্ঠে,
“ম্যাম চলেন জলদি!”
বলেই হাত টেনে তুলে নিয়ে যেতে লাগলো ওটির ভিতরে। হসপিটালের সাদা কাপড় পড়িয়ে শুয়ে দিলো বেডে। ওটির তীব্র আলোটি ধাম করে জ্বলে উঠলো। কি করবে মার্জান? নিজের মনের সাথে এখনো চলছে লড়াই… মন বলছে ছুটে পালিয়ে যেতে। ওইদিক মস্তিষ্ক বলছে…. নাহ্ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে।শেষ পর্যন্ত কি তাহলে এই নিষ্প্রাণ শিশুটি খবার হতে চলেছে ওই কুকুর গুলোর???
চলবে,