জোয়ার ভাটা পর্ব -০৩

#জোয়ার-ভাটা
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৩।

চন্দ্র ও সূর্যের ভূপৃষ্ঠের জল স্থলভাগকে আকর্ষণ করে যার ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রত্যহ একস্থানে উঠে আর অন্যস্থানে নেমে যায়। যাকে বলা হয় জোয়ার-ভাটা।ঠিক যেন মার্জানের জীবনের মতো। মার্জান সপ্তপর্ণ দৃষ্টিতে পূর্ণিমার রাতের জ্বলজ্বল চাঁদ আর সমুদ্রের জোয়ার তরঙ্গ দেখে যাচ্ছে। জলের গতির মতো জীবনটা-ও কত গতিপথ ছুটছে। মার্জান সাদা রঙ্গের টপে রাতের পরি মনে হচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ের শীতল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কেশ। রাতের আঁধারে শান্ত পৃথিবীর বুকে স্পষ্ট শোনাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। মার্জান এবার সমুদ্রর খুব কাছে চলে গেলো। সমুদ্র-ও ওঁকে বিনা দ্বিধায় স্পর্শ করে গেলো পা জোড়ায়। মার্জানের এবার ভাড়ী বুক-টা হালকা হতে শুরু করেছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে নিশ্বাস ভড়ে নিচ্ছে ভুড়ি ভুড়ি। মার্জান বলল,

” সমুদ্রের বুক খুব বড়। কত কিছু লুকিয়ে আছে ওঁতে। কত রহস্য আছে, কত দুঃখ আছে, কত কষ্ট আছে, আছে গভীরতা। এই বুকের মাঝেই প্রাণ হারিয়ে ফেলার ক্ষমতা-ও আছে। আছে কত মানুষের করা স্বগতোক্তি। ”

তাহের শেখের বাড়িতে আয়োজন চলছে, মার্জানের আহুতির। ঘর ভর্তি মেহমান, আর গান বাজনায় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো যেন। সময় কতটা দ্রুত চলে যাচ্ছে যেন মার্জানের জীবন থেকে। দু’দিন পর মার্জানের জম্মদিন। ১৮ বছরে পা দিবে সে। আর সে’দিন নাকি বিয়ে নামক বাঁধনে বেঁধে দিবে তাকে? আচ্ছা! ওর দোষটা কথায়? এ-তো সব ঘটনার মাঝে সব দোষ কি মার্জানেরই ছিলো? মার্জান এবার তীরে বসে পড়লো। পূর্নিমার আলোয় ফকফক করছে চারপাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জলস্থলে যুগল। মার্জান একপলক চতুর্দিক দৃষ্টি দিয়ে মাথা নত করে ফেললো। পরক্ষণেই কিছুটা মনে পড়তেই চমকে তাকালো ওর ডান পাশটায়। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওর থেকে খানিকটা দূরে। মার্জানের খুব চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছে ভাবতেই মনে পড়লো ওই-দিনের হোটল রুমের ওই ছেলেটির কথা। ওঁর শরীরে কম্পন ধরে গেলো। কালো শার্ট প্যান্ট পড়া যুবকটি এক সাইট মার্জান দেখেছিলো সেদিন ঘুম ভাঙ্গার পর। যার সাথে একটি পুরো রাত কাটিয়েছে, তাকে দেখবার কোনো আকর্ষণ দেখা গেলো না ওঁর মাঝে। ঠিক তার উল্টো কাজ করে বসলো ওঁ, এক ছুটে ভয়ে দুরুদুরু বুকে পালিয়ে চলে গেলো। কেন সে পালিয়ে এলো? কি কারণ? লজ্জায় নাকি ভয়?সে’দিন রাতের কথা মনে পড়তেই মার্জানের হাড়গোড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসে, অসাড় লাগে শরীর। কিভাবে একটি ছেলেকে জোর করেছিলো নিজের কাছে আসতে? নিজের অসহায়ত্বের সময়টুকু সপে দিতে অপরিচিত একজনের কাছে। মার্জান আর কিছু ভাবতে পাড়লো না। মন শুধু বলে চলছে,

” পালা, পালা মার্জান, পালা!”

মার্জান হাঁপাতে লাগলো ওঁর গাড়ির সামনে এসে। কাঁপা-কাঁপা হাতে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই পেটে মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো ওঁ। গাড়ির ভিতর পেটে হাত দিয়ে ব্যথায় চিৎকার করতে লাগলো। এ নিয়ে ঠিক দুবার এমন পেট ব্যথায় ভুগছে। মার্জানের কেমন জানি লাগলো। ভেবেই নিলো সকাল সকাল অপরিচিত কোনো হসপিটালে গিয়ে চেকাপ করিয়ে আসবে ওঁ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরেরদিন সকালে সে হসপিটালে ফুল বডি চেকাপ করিয়ে আসে। ডাক্তার জানায় রিপোর্ট একদিন পরে দিবে। মার্জান চলে আসে। ও চাইলেই পাড়ত পারিবারিক ডাক্তারের কাছে যেতে। কিন্তু এতে করে টগর চিন্তায় পড়ে যাবে। আর এ’কদিন যাবত টগরের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ওঁর মা। টগরের মুখটি দেখেই তো বেঁচে আছে মার্জান। নয়তো কবেই নিজেকে শেষ করে দিতো হয়তো।

দেখতে দেখতে মার্জানের জম্মদিনটি চলে এলো। বাড়ি সবাই ব্যস্ত তখন। মার্জানকে ঘিড়ে ওঁর আত্মীয় স্বজনরা। কথা চলছে কি কি এসেছে ছেলের বাড়ি থেকে, তা নিয়ে চলছে কথা বার্তা। একজন-তো বলেই উঠলো,

” মার্জান কি ভাগ্য তোর, সোনার টুকরো ছেলে পেয়েছিস, আকাদে এত কিছু পাঠিয়েছে, বিয়ে হলো না জানি কি করে বল?”

মার্জানের এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। ওঁর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। এই একটা মাসে একটি বাড়ে-ও ভাদ্রের সাথে ওঁর দেখা হয়-নি। কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই মার্জানের। এসব ভেবেই প্রশ্ন করলো মার্জান ওঁর বোনকে,

” ভাদ্র এসেছে কি?”

” হ্যাঁ আপু, ভাইয়াতো সকালেই চলে এসেছেন। নিজ হাতে সব করছেন।”

মার্জানের ভয় ভয় করছে। যত সময় ঘনিয়ে আসচ্ছে ততই ধুকপুক করছে বুক। মার্জান একটি পিংক গাউন পড়েছিলো। বার্বি ডলের মতো লাগছে ওকে। নিজ রুম থেকে গাউনটি হালাকা উপরে উঠিয়ে বেড়িয়ে এলো। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, এখন বিকেল। তবে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। মার্জান এদিক-ওদিক খুঁজে চলছে ভাদ্রকে। ঠিক তখন স্টোর রুম দিয়ে যেতেই কিছু আপত্তিকর শব্দ দাঁড়িয়ে পড়লো মার্জান। কিন্তু সে-দিকে খুব একটা খেয়াল করলো না। মানুষের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে বরাবরই ওঁর মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু,, নিজের নাম শুনে পা থেমে গেলো। কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মার্জান এবার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। জানালার ধারে একটু ফাঁক করা। উঁকি দিতে চক্ষু ছানাবড়া ।

মার্জানের বিশ্বাস হচ্ছে না যেন, এসব কি দেখছে? রিয়ানা ভাদ্রের একদম কাছাকাছি। খুব চক্ষুকটু দৃশ্য। ছিঃ। নিজের বোনের বাগদত্তার সাথে কি-না শেষ পর্যন্ত? কিন্তু রিয়ানার মাত্র ১৫ বছর বয়স। এ বয়সেই এসব কি? ঝটকা এবার খেলো মার্জান যখন শুনলো,

” ডার্লিং, কেন করছো বিয়ে তুমি ওই ফালতু মেয়ে মার্জানকে, যা চেয়েছিলে, তাতো পেয়েছোই। ওঁর বাবার হোটেলতো তুমি লিখিয়েই নিয়েছো। আর -কি চাই।”

ভাদ্র আরো আলিঙ্গন হলো রিয়ানার সাথে। বলল,

” মার্জাকেও চাই আমার!”

কপাট রাগ দেখিয়ে রিয়ানা দূরে সরে গিয়ে বলল,
” তাহলে আমি কে?”

ভাদ্র মুখে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। ওঁর হাত জোড়া খেলা করতে লাগলো রিয়ানার কচি শরীরটিতে। রিয়ানার রাগ যেন গলে গেলো। ভাদ্র রিয়ানার কানে ঠোঁট লাগতেই কেঁপে উঠলো। ভাদ্র বলল,

” তুমি আমার এক মাত্র ছোট বউ। তবে তোমার এখনো ১৮ বছর হতে অনেক সময়। এই তিনটে বছর না হয় মার্জান হোক তোমার রিপ্লেসমেন্ট। ”

মার্জান পা যেন এঁটে গেছে জায়গায়। জমে গেছে। এসব কি শুনছে সে? কক্সবাজারে মার্জান এর বাবা আরহাম মালিকের একটি হোটেল গড়েছিলো। এই হোটেলটি ওঁর বাবার স্বপ্ন ছিলো। বাবা মারা যাবার আগে এক মাত্র সন্তান হিসেবে মালিক হোটেলটি ওঁর নামে লিখে দিয়ে গেছিলো আরহাম মালিক। ভাদ্র ছিলো ওঁদের বংশের এক মাত্র ছেলে। মার্জানের হাসবেন্ড হিসেবে ওর নামেই চলে যেতো। কিন্তু তার আগেই এই হোটেলটি লিখিয়ে নিয়েছিলো ভাদ্র। মার্জানের মনে পড়লো। একবার ভাদ্রের একটি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কাজ করেছিলো মার্জান। কিছু ডকুমেন্টস এসাইন করেছিল সেদিন। হয়তো সে-দিন নিজের ভাগ্য নিজ হাতে আগ্নেয়গিরিতে দিয়েছে?বিশ্বাসঘাতক! মার্জান পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু পিছনের টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে ধেমে গেলো। শব্দ হতেই এলার্ট হলো ওঁরা। চটজলদি বের হতেই দেখতে পেলো মার্জান জল ভর্তি চোখে তাকিয়ে আছে ওঁদের দিক। মার্জানকে দেখেই ভাদ্র গম্ভীর হয়ে গেলো। রিয়ানা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। যেন যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। রিয়ানা বলল,

” দিদুভাই! তুমি সব শুনে আর দেখে ফেলেছো বুঝি?”

মার্জান জবাব দিলো না। ঘৃণায় তাকিয়ে রইলো শুধু। তা দেখে ভাদ্র বলল,

” ভালোই হয়েছে, সব জেনে গিয়েছো। ”

মার্জান ঘৃণিত নজরেই বলল,

” তোমার থেকে পোষা কুকুর অনেক ভালো। ”

“মার্জান!”

হাত তুলতে নিলো ভাদ্র। মার্জান তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,

” আমার সাথে বেইমানি করে ঠিক করনি তুমি। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। বুঝলে ঘৃণা। ”

রিয়ানা বলল,

” মার্জান… ও আমার দিদুভাই। সহজসরল দিদুভাই। তোমার ঘৃণা ওর না কিছু আসবে না আমার। ভাদ্র যা চেয়েছিলো, তা ও পেয়ে গেছে। তোমার চিন্তা করো এবার। ইফ ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, নানাজান উনার সম্পত্তি থেকেও তোমাকে বাদ দিয়েছে। কি করবে এখন তুমি বলো?”

মার্জান কখনোই টাকা-পয়সার লোভ করেনি। ওঁর বিশ্বাস কর্ম করলেই ফল। কিন্তু ওঁর দুঃখ ওঁর বাবার গড়া কষ্টের মালিক হোটেলটি নিয়ে। মার্জান এবার বলল,

” সম্পত্তি বা টাকা-পয়সার লোভ আমার নেই রিয়ানা। তবে বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে ভয়। এরা সুচ ফুঁটিয়ে দেয়।”

রিয়ানা বাহু চেপে ধরলো আলিঙ্গন ভাবে ভাদ্রর। বলল,

” হিংসে হচ্ছে বুঝি মার্জান? ভাদ্র তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে। তাই এসব বলছিস তো?”

মার্জান ফিকে হাসলো,

” একজন মা,দ,কদ্র,ব্য সেবনকারী ভালো হতে পারে, কিন্তু একজন চ,রি,এহীন ব্যক্তির চ,রি,ত্র কখনো ভালো হতে পারে না!”

এ পার্যায় থাপড় পড়র জোড়ে মার্জানের গালে। মার্জান ছিটকে পড়লো নিচে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। ভাদ্র রাগে গজগজ করছে,

” এই চরিত্রহীনকেই বিয়ে করতে হবে তোমার মার্জান!”

মার্জান চকিতে উত্তর দিলো,

” তার থেকে বরং মরাটাই আমার জন্য শ্রেয়!”

” এত ঘৃণা! ”

হাসলো ভাদ্র। হাটু ভেঙে বসে পড়লো মাটিতে। মার্জানের চুলের মুঠি টেনে ধরে মুখ হালকা উঁচু করলো,

” এই ঘৃণত ব্যক্তিটি কেই দিন রাত চোখে দেখতে হবে তোকে।”

একদলা থুতু ফেলে দিলো মুখে মার্জান। বলল,

” তোমার স্বপ্নে!”

ভাদ্র রাগ এবার তিড়তিড় করে বাড়লো। টেনে তুলে নিয়ে গেলো ওই স্টোর রুমটির ভিতরে। ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরে। মুখ থুবড়ে পড়লো মার্জান। বুঝে উঠার আগেই টান পড়লো গাউনে। চিৎকার করে উঠলো মার্জান,

” কি করোছো, ছাড়ো। যেতে দাও আমাকে!”

ভাদ্র শয়তানি হাসলো,

” আমি তো ভেবেছিলাম এক মাস আগেই ওই রাতে ত্যাজ কমে গেছিলো। কিন্তু না! ভুল ছিলাম। যাই হোক যা বিয়ে পর হতো, তা না হয় আজ হবে। যদি-ও সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস আমার পছন্দ না। কিন্তু আলাদা। তোর লতানো শরীর আমার মাথা পাগল করে দেয়। ”

বলেই এবার গাউনের নিচের ভাগ টেনে ছিঁড়ে ফেললো ভাদ্র। এদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করছে মার্জান। আরেকবার, আরো একবার কি মুখোমুখি হতে হবে এসব কিছুর? আরো একবার?

” হেল্প, রিয়ানা হেল্প, মা, নানাজান…!”

কেউ আসছে না। কেউ শুনছে না। গান বাজানার আওয়াজে কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না মার্জানের আর্তনাদ। ভাদ্র এবার মার্জানের উপর উঠতেই পিছন থেকে কেউ বাড়ি মারলো ভাদ্রের মাথায়। ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে পড়তে লাগলো রক্ত। ফ্লোর মেখে যেতে লাগলো রক্তে। ছিটেফোঁটা পড়লো এদিকে সেদিকে। পড়লো মার্জান মুখে। ভাদ্র মাথায় তীক্ষ্ণ ব্যাথা নিয়ে পিছনে ফিরলো। চোখ বড় বড় করে বলল,

” আ-প-নি..!

চলবে,

#ছবিয়াল মাকসুদা রান্তা আপুর ইডিটকৃত। ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here