জোয়ার ভাটা পর্ব -০২

#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২।

সকালের মিষ্টি রোদ এখন আর নেই। অভিমানী কিশোরীর মতো তপ্ত হয়েছে রোদের তেজ।হোটেল রুমটির বড় জানালার পর্দা গুলো ফরফর করে উড়ছে। সটান খুলে থাকা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে আলো-বাতাস। এই রুমটির বাহির থেকে দৃশমান সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসচ্ছে সাথে। বিছানায় শুয়ে থাকা দীর্ঘকায় যুবকটির ঘুম এবার ভেঙ্গে গেছে। মাথা তুলতেই কাল রাতের মেয়েটিকে আর দেখতে পেলো না ওঁ। কিন্তু মাথা কাছে মেয়েটি বেসলেট ফালিয়ে গেছে। মুখ বাকালো যুবক। এক পলক তাকিয়ে অন্য দিকে ফিরে আবার শুয়ে পড়লো যুবকটি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে।

বিকেল প্রায় শেষ ভাগ।সাঁঝ নামবে বলে। প্রভাতের সাথে সাথে ক্ষীপ্ত হতে থাকা সূর্যী মামার মেজাজ এবার কিছুটা শীতল। পুরো শহরে লালিমা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, তন্ময় হয়ে দেখছে ওঁর বিদায়। টগর মেয়েকে জড়িয়ে বসে আছে। চোখে এখন পানি। মেয়েটিকে ওঁর বাবা কুকুরের মতো মে,রে,ছে।যে কারো দেখলেই মায়া লাগবে। টগর মার্জানের মুখটি উপড়ে তুললো। মার্জানের চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে।নিজেকে মা ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে টগরের। আজ যদি ওঁর নিজের বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে কি এমন হতো? বাবা কি দিতো? এত এত সব অন্যায় হতে নিজের মেয়ের উপর? মার্জান এবার মুখ খুললো,

” মা তোমার-ও কি মনে হয়? আমি এমন কিছু করেছি?”

টগর মার্জানের চুল গুলো বিলি কেঁটে দিলো। কঁপালে চুমু খেয়ে বলল,

” আমার পুরো ভরসা আছে তোমার উপর! ”

মার্জান ফিকে হাসলো।ম্লান মুখটায় কতটা মায়ায় জড়িত। আবার বলল,

” মা? তোমার কাছে-ও কি আমাকে নষ্ট রক্তের মনে হয়?”

টগর হতবুদ্ধি। মেয়েকে কাছে টেনে শক্ত করে আবার জড়িয়ে ধরলো,

” নাহ্! তুমি আমার মেয়ে। আমার রক্ত! আমার রক্ত কখনো খারাপ হতে পারে না!”

মার্জান এ পর্যায় ফুপিয়ে উঠলো। মায়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সব কষ্টের বিসর্জন দিতে চায়।

কয়েকটি পায়ের শব্দে ভঙ্গ হয় মা-মেয়ে সুন্দর মুহূর্তটুকু। দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে আসে ২৩ বছরের সুদর্শন যুবক ভাদ্র। ভাদ্র হচ্ছে মুলত মার্জানের ফুপির ছেলে। পড়াশোনার পাশা-পাশি বাবার ব্যবায় ও চলচ্চিত্র জগৎ প্রডিউসার হিসেবে কাজ করে -ওঁ। মার্জানের সাথে বিয়ে দেয়ার খুব শখ ছিলো ওর ফুপির। দু’পরিবারের মানুষজন এতে রাজি। কথা ছিলো মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হলে আকাদ করে। কয়েকবার ডেটে-ও গেছিলো ওঁরা। কিন্তু মার্জান ভাদ্রকে তেমন একটা পছন্দ করে না। ওর থেকে এড়িয়ে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভাদ্রের পিছন পিছন চলে আসে মার্জানের খালাতো বোন রিয়ানা। ভাদ্রকে দেখে হেসে সমর্থন করে টগর,

” ভাদ্র এসে না। বসো!”

ভাদ্রকে চিন্তিত দেখালো মার্জানের এই অবস্থা দেখে। আজ সকালেই বিজনেস ট্যুর থেকে ফিরে এক পলক মার্জানকে দেখবে বলেই ছুটে এসেছিলো। ভাদ্র মার্জানের কাছে গেলো। মার্জানের সুন্দর গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ দেখে শিউরে উঠলো। চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

” আন্টি? ওঁর কি হয়েছে?”

টগর চুপ করে রইলো জবাব দিলো না। এদিকে মার্জান নিজের মুখটা ভাদ্রের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভাদ্র এই রিজেকশন দেখে বার বার অপমানিত মনে করে নিজেকে। যে মেয়েটিকে ওঁ ভালোবাসে, যে মেয়েটির সাথে সময় কাঁটাতে চায় সে মেয়েটি কি-না ওকে পাত্তা দেয় না? মুহূর্তে পরিবর্তন হয়ে গেলো মুখের রং। হাতের মুঠ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো মার্জানের নিচু করে রাখা মুখটির উপর।

” তোমরা বসো, আমি কিছু খাবার পাঠাচ্ছি।”

বলেই টগর বেড়িয়ে গেলো।

যাওয়ার আগে রিয়ানাকে ইশারা করে গেলো বাহিরে আসতে। কিছুটা সময় তাদের একা দিতে চায়। রিয়ানার এতে বেশি একটা খুশি বলে মনে হলো না। টগরের পিছন পিছন মুখ গোঁজা করে চলে গেলো।
ভাদ্র নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো। মুখের হাসির রেখা ফুটিয়ে, প্যাকেট থেকে একটা বক্স বের করলো।

” মার্জান দেখো আমি এবার ট্যুর থেকে ফিরবার সময় প্যারিস থেকে এই ডায়মন্ডের ন্যাকলেস নিয়ে এসেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?”

বক্সটি খুলে দেখালো ভাদ্র। কিন্তু মার্জানকে এ-দিকে খেয়েল করতে না দেখে রাগ এবার আর সামলাতে পাড়লো না।

” মার্জান তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেয়ে কি বোঝাতে চাইছো বলবে? ”

মার্জান কিছু বলছে না। আসলে ওঁর শরীরটাই ভালো লাগছে না। কাল থেকে নিজের উপর এত ধকল গেছে যে এখন আর এসবে এনার্জি পাচ্ছে না, না ইন্টারেস্ট। কিন্তু এই ছেলেটাকে ও কি করে বোঝাবে?

মার্জানকে এবারো কোনো কথা বলতে না দেখে দু বাহু চেপে ধরে বিছানা থেকে নামায় ভাদ্র। নিজ বরাবর দাঁড় করিয়ে চোখ রাঙ্গালো ওঁ।

” আনসার মি ডেম এইড।”

মার্জান কুকিয়ে উঠলো ব্যথায়। ওঁর সারা শরীরে মা’রের দাগ গুলো তাজা। তারউপর চাপ লাগতেই জীবন যেন বেড়িয়ে যেতে চাইছে। ভাদ্র বুঝতে পেরে ছেড়ে দিলো,

” সরি, সরি মার্জান। আ’ম সরি। রাগ উঠে গেছিলো খুব। বলো না প্লিজ এসব কে করেছে? কেন করেছে? আমার কি জানার অধিকার নেই বলো? আফটার ওল আমি তোমার উড বি।”

মার্জানের এবার চোখে জল ভরে উঠলো। বলতে চায় তো সব! কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে ওঁর কথা? কেউ কি বিশ্বাস করবে ওঁ নির্দোষ। নিজের বাগদত্তা হিসেবে ভাদ্র সত্যি মেনে নিবে ওঁর অন্য কারো সাথে রাত কাঁটানোর কথা? মার্জান এখন একটি শক্ত হাত চাইছে। যেটা ধরে সে নিজেকে সামলাতে পারবে। মার্জান বুকে সাহস যুগিয়ে বলল,

” খা’ লা জান, খালাজান আমাকে নেশার কোনো ঔষধ……”

” কাল দিদুভাই সারারাত বাড়ি ফিরেনি ভাদ্র ভাইয়া। তার উপর দিদুভাইয়ের গলায়, ঘারে লাল,লাল দাগ আর দিদুভাইয়ের কিছু অবাঞ্ছিত ছবি দেখে নানাজান মেরেছে দিদুভাইকে!”

গলাটা ছিলো রিয়ানার। হাতে খাবারের ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। রিয়ানা মুখ মিষ্টি-ধূর্ত মেয়ে। ঠিক মায়ের মতোই চালাকচতুর। ভাদ্রকে পছন্দ খুব এই ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর। মার্জানের মতো সুন্দরী না হলে-ও কম সুন্দর নয় ওঁ। তবে বয়সের তুলনায় দু’এক বড় মনে হয় ওঁকে। সুরভীর মুখে আদল খানি বসানো যেন। মায়ের মতোই মুখে মধু অন্তরে বিষ। মার্জান এবার চেঁচিয়ে উঠলো,

” আমি কিছু করি-নি। সব খালা’জান….!”

‘ঠাস’ করে একটি শব্দ হলো। মার্জান ছিটকে পড়লো বিছনায়। ভাদ্র চোখে জোড়া লাল হয়ে গেছে। মাথার রগ ফুলে গেছে। শক্ত হাতে টেনে তুললো ওঁকে। গগনবিদারী চিৎকার করে বলল,

” এই-এই জন্য-ই বুঝি আমাকে তোমার কাছে আসতে দাও নি? বলো! বলো মার্জান!”

মার্জানের গাল টন টন করছে ব্যথায়। হাতে কব্জিতে এভাবে ধরাতে ব্যথা করছে খুব। মার্জানের এবার সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করলো। এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা বুঝি খুব কষ্টের? মার্জান এবার মুখ ফুঁটে আর একটি শব্দ উচ্চারণ করতে চাইছে না। ভাদ্র আবারো গায়ে হাত তুলতে নিতেই মার্জান সরে এলো। নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলো,

” ব্রেকআপ!”

ভাদ্র চিৎকার করে উঠলো,

” মার্জান।”

মার্জান এবার আর কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। এদিকে রাগে গজগজ করতে করতে ভাদ্র বেড়িয়ে গেলো। এদিকে রিয়ানার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো।

সপ্তাহ পাড় হলো। মার্জান এখন সুস্থ হলেও। নিজ রুম থেকে বের হয় কম। কিভাবে বের হবে ওঁ? বের হলেই এই বাড়ির মানুষের ঘৃণিত নজরে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। নানাজানের তিক্ত কথায় গলা দড়ি দিতে ইচ্ছে করে। এদিকে ভাদ্র আজ ক’দিন যাবৎ কোনো খবর নেই। হয়তো মার্জানের দেহে পড়া অদৃশ্য দাগের জন্যই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে?

পাখি কিচিরমিচির করছে। কড়া রোদ করছে বেলকনির অপরাজিতা গাছটির উপর। থেকে নরছে মৃদুমন্দ হাওয়া গাছের পাতা আর মার্জানের খোলা কেশ। মার্জানের হাতে একটি বই। পড়ছে খুব মুগ্ধ হয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ি সামনে এসে দাঁড়ালো পর পর তিনটে গাড়ি। ভ্রুযুগল কুঁচকে চাইলো ওঁ। চোখ কঁপালে তুলে তাকিয়ে রইলো মার্জান,

“ফুপিজান!”

বড় বড় থালা হাতে ফুপিজান ঢুকলে বাড়িতে। মার্জান এর কৌতুহল বাড়লো। নিচে নেমে যেতেই মুন্তে পেলো,

” আঙ্কেল আমি ভাদ্রের জন্য মার্জানকে চাইতে এসেছি। ”

তাহের শেখের মুখ থেকে মেদুর ছায়া মিলিয়ে গেলো। খুশি খুশি রাজি হয়ে গেলেন তাহের শেখ। খুব চিন্তিত ছিল এই নষ্ট মেয়েটিকে নিয়ে। এবার ঘাড় থেকে নামবে। ভেবে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ঠিক হলো আজ থেকে এক মাস পড়েই মার্জানের বার্থডেতে আকাদ নয় সরাসরি বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। মার্জান এসব শুনে জামার কোনা শক্ত করে চেপে ধরলো। সত্যি কি ভাদ্র এসবের পর বিয়ে করতে চাইছে? নাকি এ-র পিছনে আছে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র। কেন করছে ভাদ্র এমন? আবারো কোনো ফাঁদে পড়ছে না_তো মার্জান?

চলবে,

পরবর্তী পর্ব কাল রাত ১০ টার পর…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here