গল্পঃ মেরীর প্রতিজ্ঞা ( ৩য় পর্ব )
সুলতানের জন্য রাখা দুধে মেরী বিষ মিশিয়ে রেখেছে সেটা বুঝতে পেরে জেসিকা মেরীকে বললো– আপনি দেখতে যত সুন্দর আপনার মনটা ততই কুৎসিত রানী মেরী, আপনাকে এর শাস্তি পেতেই হবে। আমার কাছে মহারাজ সুলতান আগে, তারপর আপনি।
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মেরী বললো– জেসিকা, তোমার বাবাকে যদি কেউ হত্যা করতো তাহলে তুমি কি করতে? বাবার হত্যাকারীর সাথে হেসেখেলে সংসার করতে নাকি বদলা নিতে চাইতে? অবশ্যই বদলা নিতে কারণ বাবার রক্ত শরীরে প্রবাহমান সন্তান কখনোই বাবার হত্যাকারীকে ছেড়ে কথা বলবে না।
জেসিকা চুপচাপ।
মেরী আবার বলতে লাগলো– জেসিকা এই যে সুলতানের অত্যাচারে আসেপাশের রাজ্যের লোকজনের প্রাণ ওষ্ঠাগত, কত মেয়ে ধর্ষিত হলো তাদের জন্য তোমার মায়া হয়না? হাজার হাজার মানুষের দুঃস্বপ্নের কারণ যদি হয় এই একজন অত্যাচারী মানুষ সুলতান, তাহলে সুলতানের জন্য এতগুলো মানুষ তুমি মারবে নাকি এতগুলো মানুষের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিতে সুলতানকে প্রতিহত করবে বলো।
জেসিকা এগিয়ে গিয়ে একটা কাপড় এনে মেঝেতে পড়ে থাকা দুধ মুছে বেড়ালটি সেই কাপড়ে পেচিয়ে উঠে দাড়িয়ে মেরীকে বললো– আপনার সুনাম অনেক শুনেছি এবং আপনি রাজ্য ও প্রজাদের নিয়ে খুব ভাবেন, সুলতান আমার মায়ের পেটে লাথি মেরেছিল সেই কারনেই মায়ের মৃত্যু হয়। প্রতিশোধ আমারও নিতে ইচ্ছে হয় কিন্তু মহারাজ ভীষণ ভয়ঙ্কর। বেঁচে থেকে নাহয় মা বাবার জন্য দোয়া করি পরপারে যেন তারা ভালো থাকেন। আপনার যা করার বুঝেশুনে করবেন, মহারাজ যদি বুঝতে পারে তবে তার হাতে আপনার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কথা শেষে জেসিকা কাপড়ে মোড়ানো বিড়ালটি নিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
সুলতান যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন পুরুষ, তবে সুলতান সেগুলো খারাপ কাজে ব্যবহার করে বলেই চতুর্দিকে সুলতানের এত দুর্নাম। সুলতান তার বুদ্ধি বিচক্ষণতা সঠিক পথে প্রয়োগ করলে অন্যান্য রাজাদের চেয়ে বেশ ভালোই সুনাম অর্জন করতে পারতো তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
যেদিন মেরীর বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিনই মেরী আঁচ করতে পেরেছিল সুলতানের চাল। মেরীদের রাজ্যের মন্ত্রী সেদিন অসুস্থ ছিলনা, সুলতান কৌশলে তাকে বন্দী করে হত্যার হুমকি দিয়ে মন্ত্রীর মেয়ে এলিসাকে দিয়ে মেরীর কাছে খবর পাঠিয়েছিল রাজ্যের দক্ষিণাংশে হামলা করা হবে।
আসলে সুলতানের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন, সুলতান এলিসাকে দিয়ে ঐ খবর পাঠানোর কারণ মেরীর বাবা যখন জানতে পারবে তখন দক্ষিণের সীমান্তে অবশ্যই বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্যদের পাঠাবেন, তখন সবার চিন্তাভাবনায় রাজ্যের দক্ষিণাংশ থাকবে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুলতান তার উদ্দেশ্য হাসিল করবে।
রাজ্যের সবাই যখন দক্ষিণাংশ নিয়ে চিন্তিত তখন সুলতান তার সৈন্যদল দুই ভাগে বিভক্ত করে একদল পাঠায় মেরীর বাবার রাজ্যের দক্ষিণাংশে, আরেকদল নিয়ে নিজে গিয়ে হামলা করে রাজপ্রাসাদে, হত্যা করে মেরীর বাবাকে।
পরে এলিসা জানিয়েছিল তার বাবাকে বন্দি করার বিষয়টি।
সুলতানের পাপের বোঝা এতদিনে অনেক ভারী হয়ে গেছে, আশেপাশের কোনো রাজ্যের সাথে তার ভালো সম্পর্ক নেই। সুলতান নামটা সবার কাছে প্রচন্ড ঘৃনার।
যেকোনো মুহূর্তে হামলা হতে পারে সেই বিষয়ে সুলতান সদাসর্বদা সচেতন, তাই তার রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের বিশেষ গুরুত্ব দেয় সুলতান, এবং সুলতানের প্রাসাদের প্রহরীরা সব বাঘা-বাঘা নওজোয়ান একেকজন। তবুও ভুললে চলবে না বাপেরও বাপ আছে।
মেরীর আয়নার সামনে দাড়িয়ে খেয়াল করলো সেই বৃদ্ধ জ্বীনের দেয়া বেলীফুলটা খোঁপায় নেই। মেরী একটু হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো, ফুলটাও ছিল ভরসার, সেটাও হারিয়ে গেল অবশেষে!
বিষন্ন মনে মেরী খোঁপায় যেখানে ফুলটা ছিল সেখানে হাত বুলাতেই ফুলটা আবার দৃশ্যমান হলো। মেরী মনে আবার ভরসা ফিরে এলো।
মেরী বুঝতে পারলো একমাত্র সেই ছাড়া যেন কেউ ফুলটা না দেখতে পারে এর জন্যই ফুলটা অদৃশ্য হয়ে থাকে।
আয়নার সামনে এসে দাড়ালো মেরী, নিজের চেহারার অবস্থা দেখে নিজের জন্য নিজের আফসোস হচ্ছে। বাবার মৃত্যুর শোক, রাজ্যের এবং প্রজাদের চিন্তা, বাবার হত্যার বদলা নেবার প্রতিজ্ঞা, সব মিলিয়ে মেরীর চেহারার লাবন্যতা হারিয়ে গেছে বিষাদের ছায়ায়। একটা টিপ তুলে কপালে দিতে যাবে এমন সময় নিচ থেকে গন্ডগোলের শব্দ ভেসে এলো মেরীর কানে, টিপটা রেখে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করে হাঁপাতে হাঁপাতে জেসিকা বললো– রানী আপনি এখানেই দরজা বন্ধ করে কক্ষে বসে থাকুন চুপচাপ, পূর্বদেশের রাজা ইব্রাহীম তার লোকজন দিয়ে হামলা করিয়েছে, অন্যান্য উন্নত দেশের রাজাদের সাথে ইব্রাহীমের ভালো সম্পর্ক আছে বলে ইব্রাহীম অনেক শক্তিশালী।
মেরী অবাক হয়ে বললো– ইব্রাহীমের সাথে সুলতানের কিসের শত্রুতা?
জেসিকা বললো– ইব্রাহীমের বাবা তখনও জীবিত, ইব্রাহীম তখন সিংহাসন আরোহন করেনি। ইব্রাহীমের বোন আতিয়া ছিল আপনার মতোই সুন্দরী এবং গুণবতী। সুলতানের নজর পড়েছিল আতিয়ার ওপর– এই পর্যন্ত বলে জেসিকা থামলো।
ভীষণ কৌতুহলী হয়ে মেরী জিজ্ঞেস করলো– তারপর?
জেসিকা আবার বলতে শুরু করলো– আতিয়ার বিয়ের পরে ফুলশয্যা রাতে স্বামী স্ত্রী মিলনের পূর্বেই আতিয়ার স্বামীকে হত্যা করে সুলতান। আতিয়াকে তুলে নিয়ে আসার সময় সুলতানের হাতে নিজের ইজ্জত হারানোর ভয়ে একজন সৈন্যের কাছ থেকে তরবারী নিয়ে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আতিয়া। ইব্রাহীমের একমাত্র আদরের বোন আতিয়া, বোনকে হারিয়ে পাগল প্রায় ইব্রাহীম, এদিকে মেয়ের এমন মৃত্যুর খবর পেয়ে সইতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ইব্রাহীমের বাবা। এরপর ইব্রাহীম রাজা হয়। আপনার মতো ইব্রাহীমও হয়তো বোনের সাথে হওয়া অন্যায়ের বদলা নেবার পরিকল্পনা করে আসছিল এতদিন, আজ আক্রমণ করলো।
ইব্রাহীমের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় সামিল আরও কয়েকটি দেশ, তারা তাদের দেশের সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী সৈন্যদল পাঠায় ইব্রাহীমকে সহায়তা করার জন্য। তাদের নিয়েই ইব্রাহীম আজ আক্রমণ করলো।
ইব্রাহীমের শক্তিশালী সৈন্যদের কাছে ধরাশায়ী সুলতানের সৈন্যরা, ইতোমধ্যে ইব্রাহীমের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে সুলতানের বেশ কয়েকজন সৈন্য।
ইব্রাহীমের সৈন্যরা ধরে ফেলেছে সুলতানকে। কয়েকজন সৈন্য সুলতানকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আর একজন সৈন্য সামনে দাড়িয়ে সুলতানের গলায় তরবারীর কোপ মারবে এমন সময় সাৎ করে একটা তীর সুলতানের কানের পাশ দিয়ে গিয়ে সুলতানের সামনে দাড়ানো তরবারী হাতে সৈন্যর বক্ষ ভেদ করলো, সৈন্যটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেরী দাড়িয়ে আছে তীর ধনুক হাতে।
সুলতান ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেরীর দিকে, সুলতান মেরীর বাবার হত্যাকারী জেনেও আজ মেরী সুলতানকে প্রাণে বাঁচালো! এ তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য!
ইব্রাহীম এগিয়ে এসে বললো– রাজকুমারী মেরী, তোমার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? তুমি কি ভুলে গেছো সুলতান তোমার বাবার হত্যাকারী?
মেরী সামনে এগিয়ে এসে বললো,– না আমি কিছুই ভুলিনি, সে যেমন আমার বাবার হত্যাকারী, তেমনি আবার সে আমার স্বামী। আজ যদি আমি তোমার বোন হতাম তাহলে পারতে তুমি তোমার বোনকে বিধবা করতে ইব্রাহীম? তোমার বোনের যায়গায় দাড়িয়ে আজ তোমার কাছে আমি আমার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাই ইব্রাহীম।
ইব্রাহীম তার সৈন্যদের ইশারা করে ইব্রাহীমকে ছেড়ে দিতে বলে মেরীর বললো– এভাবে বলে কেন লজ্জা দিচ্ছো মেরী! তোমার প্রতি আমাদের অগাধ সম্মান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার খাতিরে, এবং তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সুলতানের প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে গেলাম।
কথা শেষে ইব্রাহীম তার সৈন্যদের নিয়ে চলে গেল।
সুলতান এটা নিশ্চিত হলো যে মেরী যদি বাবার হত্যার বদলা নিতে চাইতো তবে ইব্রাহীমের হাত থেকে বাঁচাতো না। মেরীকে ভীষণ সন্দেহ করলেও এখন মেরীর ওপর থেকে সুলতানের সন্দেহ কেটে গেছে।
দুদিন পরে রাত গভীরে মেরীর খুব কাছাকাছি আসলো সুলতান, মেরীকে একান্ত কাছে পেতে উতলা সুলতানের মন।
নিজ হাতে মেরীর কাপড় খুলে সারা শরীরে উন্মাদের মতো আদর করতে লাগলো সুলতান, মেরীও বাধা দিচ্ছে না।
সুলতান মেরীর শরীরের নেশায় পুরোপুরি মাতাল হয়ে মেরীর ওপর উঠতেই মেরী বিদ্যুৎ গতিতে বালিশের নিচের তরবারী টেনে বের করে সুলতানের বুকে চালাবে এমন সময় খপ করে মেরীর হাতটা ধরে ফেললো সুলতান…
চলবে…
লেখকঃ হৃদয় চৌধুরী।