প্রণয়ের সূচনা পর্ব -১৯

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৯
__________________________
ব্যস্ততার মোড়কে বন্দী শহুরে জনজীবন।সূর্যের উঁকি মারা/র সাথে সাথেই শুরু হয় মানুষের আনাগোনা।শরৎ এর ইতি ঘটিয়ে আগমন ঘটেছে হেমন্তের।হেমন্তেই শীতের ঘ্রাণ আসছে যেন।বিছানা থেকে মেঝেতে পা রাখতেই কিছু টা ঠান্ডা অনুভত হলো সূচনার।সূচনা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো চা হাতে।প্রণয় ওঠেনি এখনো।রাতে অনেকটা সময় বারান্দায় ছিল দু’জন। দেরি হয়েছে ঘুমোতে।তাই হয়তো ওঠেনি।আস্তে আস্তে তীব্র হচ্ছে আলো,মিলিয়ে যাচ্ছে শীতল, স্নিগ্ধ সকালের আবরণ।চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে সূচনা।বন্ধ আখিঁ জোড়া খোলার আগে কানে সেই রাতের কথোপকথন, চোখে ভেসে উঠল রাতের সেই দৃশ্য টুকুন।পাশাপাশি দাড়িয়ে ছিল দু’জন মানব-মানবি,নিশ্চুপ ছিল দু’জন।বাইরে হচ্ছিল হালকা বেগের বর্ষণ।বন্ধ ছিল সেই মানবির আঁখি জোড়া। হয়তো অনুভব করছিল বৃষ্টি কে।তখনই গ্রিলে রাখা তার বাম হাতে অনুভব হলো কারো ছোয়া,বন্দি হলো তার হাত সেই হাতে।চকিতে চোখ খুলে বন্দি করা হাতের মালিকের দিকে দৃষ্টি স্থির হলো।তার শান্ত,শীতল মুখে ঘোর লাগা চাহনি, অদ্ভুত,মাদকতা ভরা সেই চাহনি।জমে গেল সেই মানবির সমস্ত কায়া,হাত ছাড়ানোর জন্য বিন্দু মাত্র চেষ্টা ও করতে পারলনা।শুধু তাকিয়ে রইলো তার হাতের আঙুলের দিকে,অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে সাদা পাথরের একটা রিং।অপর হাত সামনে এনে ছোট নীল রঙের একটা বাক্স রাখল হাতে।কর্ণকুহর হলো মিহি স্বরে বলা বাক্য-

–‘বিয়ের রাতে নাকি স্বামী তার স্ত্রী কে কিছু উপহার দেয় কিন্তু তাড়াহুড়ায় আমি ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন।তারপরে তো ইরাদের এক্সিডেন্ট হলো।হসপিটাল,বাসা,অফিস করতে করতে আর সময় করতে পারিনি।আজকে নিয়ে এসেছি আসার সময়। বক্সের ভেতর ডায়মন্ডের নোজ পিন আছে একটা,যেটা পড়েছ সেটা কেমন যেন বুজে বুজে আছে মনে হয়। এটা পড়ে নিও।

কিছু না বলে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে ছিল সে।তার হাতটা তখনো মুঠোবন্দি। এক মুহূর্তের জন্য ও ছাড়াতে চেষ্টা করেনি। আবার কর্ণধার হলো তর কথা-

–‘আমি তো গিফ্ট দিলাম দু’টো।তুমি কিছু দিবেনা?

কিছুটা আড়ষ্টতা নিয়েই জবাব দিতে হলো-

–‘আমার কাছে তো এখন কিছু নেই।কি দিব?

বৃষ্টি থেমে গেছে। নিরব পরিস্থিতিতে যোগ হলো হাসির শব্দ।হাসি থামিয়ে বললো-

–‘আছে,যা চাইব সেটা তোমার কাছেই আছে আর সঠিক সময়ে ফিরিয়ে ও দিব।

প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী আছে?

সে সহসাই বলে দিল-

–‘যে হাতের আঙুলে আমার দেয়া উপহার জায়গা পেয়েছে সেখানে আমার ঠোঁটের স্পর্শ দিতে চাই।অনুমতি কী আছে? কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই তা ফেরত পাবে তুমি।

চমকিত,বিস্ময়াহত হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। সে আবারো হেসে বললো-

–‘ মৌনতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ।

দেরি করল না আর,অনামিকা আঙুলে থাকা রিং টার কিঞ্চিৎ ওপরে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিল সময় নিয়ে।আপনা আপনি বন্ধ হলো সেই মানবীর চোখ জোড়া,যেন অদ্ভুত, অজানা শিহরণে শিহরিত হলো সমস্ত শরীর।

হাতে টান পড়তেই ভাবনার সুতোয় টান পড়ল তীব্র ভাবে।সূচনার ডান হাতে থাকা চায়ের কাপটা এখন পাশে দাঁড়ানো প্রণয়ের হাতে। হুট করেই যেন লজ্জারা হানা দিল চারপাশ থেকে,লাল হলো কপোল।চোখ তুলে তাকাতেও পারলনা।প্রণয় যখন তার আধ খাওয়া চা খেতে ব্যস্ত তখন মাথা তুলে তাকালো সূচনা। ব্যস্ত গলায় বললো-

–‘আপনি আমার চা খাচ্ছেন কেন?দিন ওটা আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।

–‘তোমার নাম লেখা আছে চায়ে?

প্রণয়ের হাত থেকে কাপটা টান দিয়ে নিতে যেয়েও পারলনা।বললো –

–‘নাম লেখা নেই,ওটা আমি অর্ধেক খেয়েছি কেন খাবেন এটা,দিন আমি বানিয়ে দিচ্ছি আরেক কাপ।

কাপের অবশিষ্ট চা টুকু শেষ করে সূচনার হাতে কাপটা ধরিয়ে দিয়ে তারপর বললো-

–‘আমার লাগবে না আর, থ্যাঙ্কিউ ফর দা টি।বেস্ট ছিল, আর কিছু পারো আর না পারো চা ভালো বানাও,কিন্তু মিষ্টি টা অনেক বেশি।

সূচনা কিছু টা মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘আমি মিষ্টি কম খাই,ঠিকঠাক ই দিয়েছি বেশি কেন হবে?আর আমি জানি আমি চা ভালো বানাই তবে সেটাকে বেস্ট উপাধি দেয়াটা বাড়াবাড়ি।

প্রণয় যেতে নিলেও থেমে গেল সূচনার কথায়।তার দিকে ঘুরে মিহি স্বরে বললো-

–‘ তার মিষ্টতা ছিল চায়ে ভরপুর তাই মিষ্টি টাও বেশি লেগেছে।সে খারা/প বানালেও আমার কাছে তা বেস্টই হবে সবসময়।

প্রণয় দেরি করল না আর চলে গেল রুমে।সূচনা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ।
.
.
–‘আপনি কি আজকে অফিসে যাবেন না?

সকালে নাস্তা শেষে রেডি না হয় বিছানায় আরামসে ফোন নিয়ে বসে ছিল প্রণয়।তাই উক্ত প্রশ্নটা ছুড়ল সূচনা।প্রণয় হামি দিতে দিতে বললো-

–‘নাহ,,ইসহাক সাহেব এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দিয়েছেন,বলেছেন বউকে সময় দিতে বেশি করে।

সূচনা ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো-

–‘দিয়েছেন না আপনি নিয়েছেন?

প্রণয় মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘এহহ,,ঠে/কা পড়েছে আমার।যে একখান বউ পেয়েছি তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আবার অফিস থেকে ছুটি নিব।বাসায় থাকলে ভুল করেও তো রুমের দিক হও না আবার সে নাকি ঘুরতে যাবে আমার সাথে।তার চেয়ে বরং অফিসে থাকাই ভালো।অন্তত বোর হতে হয় না।

–‘হ্যা ঠিকই তো ধরেছেন কে যাবে আপনার সাথে ঘুরতে,খারু/স একটা।আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়ার থেকে তো ভালো বসে বসে ফিরোজা খালার সাথে স্টার জলসার সিরিয়াল দেখা।আমারই দোষ,কোন দুঃখে যে কথা বলতে এসেছিলাম আপনার সাথে।

প্রণয় লাফিয়ে উঠলো এক প্রকার বিছানা থেকে।
সূচনার সামনে দাঁড়িয়ে বললো-

–‘কী বললে?কী আমি?

–‘খারু/সসস।

প্রণয়কে রাগা/নোর জন্য সূচনা শেষে একটু টেনেই বললো।অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো।প্রণয় চোখমুখ একেবারে শক্ত করে সূচনার দিকে এগোতে লাগল।দাঁতে দাঁত চেপে বললো-

–‘আবার বলো তো পাখি,কী বললে।

সূচনা এবার ঘাবড়ে গেলে।ফাঁকা ঢোক গিলে কণ্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বললো-

–‘খারু/স বলেছি খারু/সস।

সামনে এগোচ্ছে প্রণয়,পিছু হাঁটছে সূচনা।যেতে যেতে কাবার্ডের সাথে ঠেকল তার পিঠ। থামল প্রণয়, সূচনার একেবারে নিকটে এসে।প্রণয়ের থুতনি বরাবর সূচনার কপাল পড়েছে।সূচনা নত মস্তকে, শ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন।প্রণয় বাকা হাসল,সূচনার বাম হাত উচু করে রাখল তার মাথার ওপরে কাবার্ডের সাথে চেপে ধরে অন্য হাত রাখল তার বাম পাশে। ফিচেল কণ্ঠে শোধালো-

–‘এবার কোথায় যাবে প্রণয়ী,এখন তো তুমি সম্পূর্ণ বন্দী আমার মধ্যে।এখন বলো কী বলছিলে?

সূচনার প্রায় জ্ঞান হারানোর জোগাড়।বন্ধ আখি জোড়া,কাপছে সে রীতিমতো।আনমনে মনের কথা মুখে এসে পড়ল।নিচু স্বরে নিঃসৃত হলো-

–‘আপনি এত কাছে আসবেন না আমার কেমন যেন লাগে,মনে হয় ম/রে যাব আমি।দূরে যান।

প্রণয় বা’কা হাসল।বললো-

–‘এতটুকু তো কিছু ই না,এখন ও তো ট্রেলার ই দেখালাম না তাতেই এ অবস্থা তাহলে পুরো মুভি কীভাবে দেখাব।

সূচনার হুঁশ হলো। যে হাত মুক্ত ছিল সে হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা দিল, প্রণয় সরে গেল,ছেড়ে দিল হাত। সূচনা আর তাকালো না সে দিকে। এক প্রকার দৌড়ে বের হলো রুম থেকে।শ্বাস নিল জোরে জোরে।
——————————————–
সকালের ঘটনার পর থেকে প্রণয়কে এড়িয়ে চলছে সূচনা।তাকে সামনে দেখলেই যেন হৃদ স্প্ন্দন অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! এমন হচ্ছে কেন?এমন হওয়ার কী আছে?প্রশ্ন টা মাথায় আসলেও উত্তর ছিল শূন্য। মনের প্রশ্নের উত্তর কি আর মস্তিষ্ক দিতে পারে?পারে না। কিন্তু সে সম্পর্কে তো সে অবগত না।তখন সেই যে রুমে গিয়েছিল তারপর আর যায়নি।কতক্ষণ মিসেস আফিয়া আর ফিরোজা খালার সাথে রান্নাঘরে ছিল।তারপর দিনা আর ইরার সাৎে কিছু কথা বলে সময় কাটিয়েছে।দিনার এখন ও মন খারা/প। কারণ কালকের পর জাওয়াদ আর কল করে নি, না দিনার কল উঠিয়েছে।আজকে সকালে দেখল তাকে সব জায়গা থেকে ব্ল/ক করে দিয়েছে। এবার ইরার কাছেও খট/কা লাগে কারণ এর আগে ছোট খাটো ঝগ/ড়া হলেও কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই সব ঠিক করে নিয়েছে, সে জায়গায় দুই দিন হয়ে গেল আবার ব্ল/ক ও করে দিয়েছে। সূচনা আর ইরা মিলে তাকে আশ্বাস দিয়েছে কোনোরকম যে সে হয়তো একটু বেশি ই রে/গে আছে,ঠিক হয়ে যাবে।দুপুরের দিকে রুমে এসে কাবার্ড থেকে শাড়ি নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকেছে, আশেপাশে কেউ আছে কি না তাও তাকিয়ে দেখেনি।প্রণয় তখন বেডেই বসে ছিল।সূচনা কান্ড কারখানা দেখে মুখ টিপে হাসছিল সে।দুপুরের পর রুমে না আসার সিদ্ধান্ত ই নিয়েছিল সূচনা।কিন্তু তার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই প্রণয় চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো-

–‘খেয়ে তাড়াতাড়ি একটু রুমে এসো তো কাজ আছে।

সূচনা জানে প্রণয় ইচ্ছে করে ই সবার সামনে কথাটা বলেছে।খাওয়া শেষে ডাইনিং এ ই ঘুরঘুর করছিল সূচনা। তা দেখে মিসেস আফিয়া বললেন-

–‘কি রে তোকে না প্রণয় রুমে ডাকলো,যাচ্ছিস না কেন?

সূচনা মেকি হেসে বললো-

–‘ভুলে গিয়েছিলাম মামী,এখন যাচ্ছি।

–‘হ্যা যা।

যতটুকু আস্তে আস্তে যাওয়া যায় সূচনা ঠিক ততটা আস্তে ই পা ফেলছে।রুমের সামনে এসে আর ঘাবড়ালো না। বু/কে ফু দিয়ে টু/স করে ঢুকে পড়ল রুমে।রুমে ঢুকতেই দুইশো ভোল্টের ঝাট/কা খেল যেন।সাথে হাত দিয়ে চেপে ধরল চোখ জোড়া।বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো —

–‘আপনার কী নূন্যতম সেন্সটুকু ও নেই যে চেঞ্জ করার আগে রুমের দরজাটা লক করে নিতে হয়।কেউ তো এসেও পড়তে পারে রুমে।

অর্ধেক টি-শার্ট পরিহিত ছিল প্রণয়,তখনই সূচনার আগমন ঘটেছে রুমে।প্রণয় গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললো –

–‘ অন্য কেউ তো আসেনি,আমার বিয়ে করা বউ ই দেখেছে, ইট’স নট আ বিগ ডিল।এমন ভাবে লজ্জা পাচ্ছ যেন কী দেখে ফেলেছ,অর্ধেক টি-শার্ট তো পড়া ই ছিল।

–‘আপনার ছি মার্কা কথা বার্তা শেষ হলে দয়া করে টি-শার্ট টা পড়ুন,উদ্ধার করুন।

–‘পড়েছি,খোলো চোখ।

চোখ খুলে আবার ও বন্ধ করে নিল সূচনা।দাত কিড়মিড় করে বললো-

–‘মিথ্যা বললেন কেন?হ্যা?আপনি এত বেশ/রম?ছি/হ!

সূচনার অবস্থা দেখে প্রণয় হাসতে হাসতে শেষ। হাসি থামিয়ে বললো-

–‘এবার খুলো।এবার সত্যি পড়েছি

আঙুলের ফাঁ/কে উঁকি মে/রে দেখে নিল।নাহ সত্যি ই এবার।

–‘শোনো কথা আছে একটা।

এক ভ্রু উঁচু করে সূচনা জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী?

প্রণয় ফিসফিসিয়ে বললো-

–‘সিক্রেট,কানে কানে বলতে হবে। কানটা সামনে আনো।

–‘কান টান সামনে আনতে পারবনা,এভাবেই বলেন।

প্রণয় মন খারাপে/র ভাব করে বললো-

–‘দিনার জন্য সারপ্রাইজ ছিল,তুমি শুনবে না,আমার আর কী করার।

সূচনা ভাবল কিছুক্ষণ,কানটা একটু সামনে এগিয়ে দিয়ে তারপর মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘বলেন

সূচনার কানের কাছে মুখ এনে প্রণয় ফিসফিস করে বললো কিছু। সূচনা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘সত্যি বলছেন আপনি?আগে বলেন নি কেন?আমি এখনি যেয়ে বলছি।

–‘আরে থামো,তোমাদের মেয়ে মানুষদের না একটাই সমস্যা, পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে ই প্যাচপ্যাচ করো।

প্রণয়ের কথায় ভে/ঙচি কাট/ল সূচনা।

–‘মুখ বা/কাও কেন আবার

–‘আমার মুখ আপনার কী?

–‘বউ আমার, সব আমার, তোমার কী?

–‘ঢং না করে বলেন।

–‘ঠিক আছে শোনো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here