বাসর ঘরে ঢুকতেই সদ্য বিবাহিত স্বামী বৃষ্টিকে বলল,
-“আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসি।আমি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেও কখনো ভালোবাসতে পারবো না।”
কথাটা শুনে বৃষ্টি আনন্দে নাচতে শুরু করল।বৃষ্টির স্বামী সূর্য তাকে এভাবে নাচতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।বৃষ্টিকে প্রশ্ন করল,
-“বৃষ্টি আপনি এভাবে নাচছেন কেন?”
বৃষ্টি নাচতে নাচতেই বল,
-“আরে ধুর এসব সংসার আমার ভালো লাগে না।ছোটবেলা থেকেই সিরিয়ালে দেখে এসেছি এরকম যৌথ পরিবারে মেয়েরা কত কষ্টে থাকে।আমি তো এই বিয়ে করতেই চাইনি।শুধুমাত্র বাবার কথাতেই বিয়েটা করেছি।আপনি একটা কাজ করুন আমাকে কাবিনের ২০ লক্ষ টাকাটা দিয়ে দিন।আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে বিদেশে ঘুরতে চলে যাব।আমার অনেক দিনের ইচ্ছা বিদেশ ঘুরতে যাওয়া।”
বৃষ্টির কথা শুনে যেন সূর্যের মাথায় আকাশ ভে*ঙে পড়ে।এখন কোথায় পাবে সে এত টাকা।তাই সে বৃষ্টিকে বলে,
-“আমার কাছে তো এখন এত টাকা নেই।আমাকে কিছুদিন সময় দিন।আপাতত ৫ লক্ষ টাকা দিতে পারব।”
কথাটা শুনে বৃষ্টি নাচ থামিয়ে সোফার উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে বলে,
-“যতদিন টাকাটা জোগাড় না হচ্ছে ততদিন আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না।”
সূর্য বৃষ্টির দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,
-“ঠিক আছে।আপনি থাকতে পারেন।কিন্তু মনে রাখবেন আমি কিন্তু আপনাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবোনা।”
-“আরে ভাই কে চেয়েছে আপনার স্ত্রীর মর্যাদা? আপনি নিজের স্ত্রীর মর্যাদা নিজের কাছেই রাখুন।”
-“আপনি এভাবে আমাকে ভাই বলছেন কেন? আমি কি আপনার ভাই?”
-“ভাই বলব না কি তো স্বামী বলব? এখন আর আপনার সাথে তর্ক করতে চাইনা।আমি এমনিতেই অনেক ক্লান্ত।একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।এখন তাড়াতাড়ি সোফায় ঘুমিয়ে পড়ুন।নিশ্চয়ই আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবেন না।নাহলে তো আপনার প্রেমিকা রাগ করবে।”
-“আমি সোফায় ঘুমাব?”
-“আপনি সোফায় ঘুমাবেন না তো কি আমি ঘুমাবো? এটা কি ইন্ডিয়ান সিরিয়াল পেয়েছেন যে আপনি আমায় রাগ দেখিয়ে বলবেন আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন না আর আমিও কেঁদে কেঁদে সোফায় গিয়ে ঘুমাবো? শুনুন সেটা কিন্তু হবে না।আমি বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারি না।সোফাতে ঘুমাতে হলে ঘুমান আর নাহলে আমার পাশে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।আমায় আর ডিস্টার্ব করবেন না।”
কথাটা বলে বৃষ্টি শুয়ে পড়ে।মুহুর্তেই যেন রাজ্যের ঘুম এসে তার চোখে ধরা দেয়।সূর্য অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।বিড়বিড় করে বলে,
-“জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু এরকম মেয়ে একটাও দেখিনি।বাবাকে কতবার বললাম প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ে দিতে।তা না কোথাকার কোন নিজের বন্ধুর মেয়েকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন।আল্লাহ আমায় বাচাও এই মেয়ের পাল্লা থেকে।”
_____________________
সকালে সূর্যর ডাকে ঘুম ভাঙে বৃষ্টির।ঘুম থেকে উঠেই সূর্যর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বৃষ্টি বলে,
-“আমার ঘুম আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিল শুনি? এইজন্যই বিয়ে করতে চাইনি।একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না।ধূর..”
-“আম্মু আপনাকে নিচে ডাকছেন।আমার কোন দো*ষ নেই।”
-“আপনার আবার দো*ষ থাকবে কেন? আপনি তো কচি খোকা।একটা মেয়েকে ভালোবেসে বাবা-মায়ের কথায় নাচতে নাচতে আমায় বিয়ে করলেন।আর এখন শুরু হলো নতুন নাটক।”
-“এই নাটক আর বেশিদিন করতে হবে না।আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২০ লক্ষ টাকা জোগাড় করে আপনাকে এই বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তি দেব।”
-“তারপর কি নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করবেন।”
-“হুম।”
-“তো সেটা আগে করলেই পারতেন।আপনার জন্য শুধু শুধু আমায় এত প্যা*রায় পড়তে হলো।নিন বিছানাটা গুছিয়ে নিন আমি নিচে যাচ্ছি।”
বৃষ্টির কথা শুনে সূর্য আরো একবার অবাক হয়।মেয়েটা সত্যিই অন্যরকম!
বৃষ্টি সুন্দর করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায়।একটু আগে যে এই মেয়ে কিরকম ব্যবহার করছিল তা কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না।
বৃষ্টি রান্নাঘরে গিয়ে তার শাশুড়ী সালমা আক্তারকে সালাম দিয়ে বলে,
-“আমায় মাফ করবেন।একটু দেরি হয়ে গেল।আসলে আপনার ছেলে কাল সারারাত আমায় ঘুমাতেই দেয়নি।তাই আজ সকালে উঠতে দেরি হয়েছে।নাহলে এমনি তো আমি সকালেই….”
বৃষ্টির কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে সালমা আক্তার কেশে ওঠেন।পাশে থাকা বৃষ্টির বড় যা আরশি সালমাকে পানি দিতে দিতে বলে,
-“এসব তুমি কি বলছ বৃষ্টি।মুরুব্বি মানুষদের সামনে কেউ আবার এমন কথা বলে।”
বৃষ্টি তো মনে মনে খুবই আনন্দ পায়।কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলে,
-“আমি কি ভুল বলেছি ভাবী।আমার আব্বু আমায় শিখিয়েছেন সবসময় সত্য কথা বলতে।আমি তো তাই বললাম।”
সালমা বেগম বলে ওঠেন,
-“থাক এসব কথা।বৃষ্টি তুমি একটু আরশিকে সাহায্য করো।বেচারি একা হাতে এতদিন সব সামলেছে।এখন তুমিও এই বাড়ির বউ।সংসারের হাল তো তোমাকেও ধরতে হবে।”
-“জ্বি, শাশুমা।আপনি কোন চিন্তা করবেন না।আমি খুব সুন্দরভাবে হাল ধরবো।”
সালমা আক্তার আরশির কানে ফিসফিস করে বলে,
-“এই মেয়েটার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব সহজ সরল সাদা মনের মেয়ে।এরকম মেয়েকেই তো আমি ছেলের বউ হিসেবে চেয়েছিলাম।তুমি একটা কাজ করবে মেয়েটাকে দিয়েই সব কাজ করাবে।তাহলে তোমার কষ্টটাও কমবে।”
আরশি সালমার কথা শুনে মুচকি হাসে।আসলে আরশি সালমার আপন বোনের মেয়ে।তাই আরশির প্রতি তার দরদ একটু বেশি।
সালমা চলে যেতেই আরশি বৃষ্টিকে ধমকানোর সুরে বলে,
-“আমার অনেক কাজ আছে।এতদিন আমি সব সামলেছি।এখন তুমি এসে গেছো তুমি সামলাও।সব রান্নাবান্না তুমি করো আমার অন্য কাজ আছে।”
বৃষ্টি অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখে মেকি হাসি এনে মাথা নাড়ায়।আরশি চলে যেতেই বৃষ্টি নিজের রান্নাঘর অগোছালো করে দেয় নিজের রাগ কমানোর জন্য।
সূর্য রান্নাঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল।বৃষ্টিকে এই অবস্থায় দেখে দৌড়ে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করে,
-“কি হয়েছে আপনার? এরকম পাগলামো করছেন কেন?”
বৃষ্টির সব রাগ এবার গিয়ে পড়ে সূর্যর উপর।বৃষ্টি সূর্যকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-“আপনার জন্য আজ আমায় এই দিন দেখতে হলো।আমি জীবনেও কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকিনি আর আজ কিনা আপনার পরিবারের এত মানুষের জন্য রান্না করবো! কখনো না।”
-“আমি কি করতে পারি?”
-“আজ সব রান্না আমার হয়ে আপনাকেই করতে হবে।ব্যাস আমি আর কোন কথা শুনব না।”
-“কি? আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আমি রান্না করবো।আমি তো একটা ছেলে।”
-“ছেলে হয়েছেন তো কি হয়েছে? ছেলেদের কি রান্না করা যায়না নাকি? শুনুন আমার মাথা ব্যাথা করছে আমি বেশি কথা বলতে পারবো না।ভালোয় ভালোয় রান্না করুন নাহলে আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেব যে আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নেননি তাই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আপনার গিএফকে বিয়ে করতে চাইছেন।”
বৃষ্টির কথা শুনে সূর্যর চক্ষু কপালে উঠে যায়।সূর্য এই একদিনেই বৃষ্টিকে যা চিনেছে এই মেয়ে সাংঘা*তিক।একবার যখন এমন কথা বলেছে তখন মেয়েটার কথা শোনার মঙ্গল।তাই সূর্য রান্নাঘরে ঢুকে যায়।তারপর ইউটিউব দেখে রান্নার প্রাকটিস করে।
বৃষ্টি নিশ্চিত হয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গিয়ে নিজের রুমে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকে।গান শুনতে শুনতেই বৃষ্টি বলে,
-“আমি বৃষ্টি।সিদরাতুল মুনতাহা বৃষ্টি।আমাকে জ*ব্দ করা এত সহজ নয়।সূর্য আর ওর পুরো পরিবারকে যদি ঘো*ল খাইয়ে না ছেড়েছি তাহলে আমার নামও বৃষ্টি নয়।কি ভেবেছে সবাই? আমার উপর যা খুশি হুকুম করবে আর আমিও বাধ্য মেয়ের মতো অক্ষরে অক্ষরে সবার হুকুম পালন করবো! না তা হবে না।এবার সবাইকে এমন টাই*ট দেব যে চিরকাল আমায় মনে রাখবে।আমি তো এমনিতেই এই বাড়িতে আর কয়দিনের অতিথি।”
হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় বৃষ্টি টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা তুলে হাতে নিয়ে দেখে, তার দাদি ফোন করেছে।ফোনটা রিসিভ করতেই বৃষ্টির দাদি মর্জিনা বেগম বলতে শুরু করেন,
-“তোর শ্বশুর বাড়িতে সবকিছু ঠিকভাবে চলছে তো?”
বৃষ্টি তার দাদিকে তো আর এখন সব সত্য বলতে পারবে না, যে তার স্বামী বাসর রাতে তাকে কি বলেছে।তাই কথা ঘুরিয়ে বলে,
-“তুমি ঠিক আছো তো দাদি? আমার কথা ভেবে একদম বেশি কান্নাকাটি করবে না।ঠিক সময়মতো ওষুধ খেয়ে নেবে।আর হ্যাঁ বাবার খেয়াল রাখবে।আমি চলে আসার পর বাবা যেন অনিয়ম না করে।মিষ্টি জিনিস যেন না খায়।আর নিয়মিত শরীরচর্চা যেন করে।”
-“তোর সবদিকেই নজর থাকে তাইনা বৃষ্টি?”
-“আমি নজর রাখবো না তো কে রাখবে? সেই ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি।তারপর তুমি আর বাবা মিলেই তো আমায় মানুষ করেছ।তোমরা ছাড়া আমার যে আর আপন বলতে কেউ নেই।এখন তোমাদের খবর আমি নেব নাতো কে নেবে শুনি?”
মর্জিনা বেগমের চোখে জল চলে আসে।তিনি আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বলেন,
-“আজ আমি আর তোর বাবা ঐবাড়িতে যাব।গিয়ে দেখবো তুই কেমন আছিস।কারণ তুই নিজের মুখে তো কিছু বলবি না।আর একটা কথা মনে রাখবি বিয়ে কিন্তু শুধু একটা শব্দ না বিয়ে হলো দুটি মন, দুটি আত্মার বন্ধন।যাকে বলা হয় বিবাহবন্ধন, যা একটি পবিত্র বন্ধন।এই বন্ধন টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু অনেক সং*গ্রাম করতে হয়।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।আমি এখন রাখছি।”
কলটা কে*টে দিতেই বৃষ্টির কানে সালমা আক্তারের চিৎকার ভেসে আসে।বিরক্তিকে তার ভ্রু কুচকে আসে।
রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সালমা আক্তার সূর্যর হাতে ব্যান্ডেজ করতে করতে বলছেন,
-“এ কেমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলাম।আমার ছেলেকেই রান্না করতে পাঠিয়ে দিচ্ছে।”
বৃষ্টি বুঝে যায় তাকে এখন কি করতে হবে।সে নিজের নাটক শুরু করার জন্য রেডি হয়ে যায় আর মনে মনে বলে,
-“তোমরা যতোই যাই করো এই বৃষ্টির কাছে সবাইকে হার মানতেই হবে।”
(চলবে)
#বিবাহ_বন্ধন
#সূচনা_পর্ব
#লেখক_দিগন্ত