ঝিলের ওপারে পদ্মফুল পর্ব -০৭

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -০৭

“আজকের রাতটা অপেক্ষা কর পদ্মফুল, সকালেই তোরে এখান থেকে নিয়ে বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করতেছি আমি।
পদ্ম খানিক বিস্ময়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। আবছা আলোতে বুঝাই যাচ্ছে সে অনেক রেগে আছে৷ পদ্ম বুঝতে পারলো না এখন তার কি করা উচিৎ।

সারাটা রাত নির্ঘুম কাটালো শ্রাবণ। সারাক্ষণই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো কখন সে পদ্ম’কে নিয়ে এখান থেকে যাবে। পদ্ম’র সামনে আশিকের উপস্থিতি বড্ড জ্বালাচ্ছে তাকে। যদিও আশিক তেমন কিছুই করেনি, তবে যতটুকু করেছে সেটাও মানতে কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণের বেশ অস্বস্তি লাগছে। অনেক চেষ্টার পরেও তার ঘুম আসেনি। যখনই একটু চোখ লেগে এসেছে, তখনই আশিকের এমন ষাড়ের মতো নাক ডাকার কারণে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। দুর্ভাগ্যবশত আশিকের বিছানাতেই তার শোবার জায়গা হয়েছিলো কিনা।
শেষ রাতের দিকে ঘুমানোর কারণে সকাল সকাল উঠতে পারেনি শ্রাবণ। প্রায় ন’টার দিকে আসমার ডাকে ঘুম ভাংগে শ্রাবণের। চোখ ডলতে ডলতে সে উঠে বসে। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে টাইম দেখতেই চোখ কপালে উঠে যায় তার। রাতে পরিকল্পনা করেছিলো এই সময়ের আগেই সে পদ্ম’কে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এখন তো এই টাইমে সে ঘুমোতেই ব্যস্ত।

শ্রাবণ ঝটপট বিছানা ছেড়ে নামে। ব্যাগের পকেট থেকে ব্রাশ টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরে রুম থেকে। উঠোনে গিয়ে আরেক দফা মেজাজ বিগড়ে যায় তার। পদ্ম চেয়ারে বসে আছে, আর আশিক তার চারপাশে নানান বাহানায় ঘোরাঘুরি করছে। যদিও পদ্ম’কে দেখে মনে হলো না সে আশিককে তেমন পাত্তা দিচ্ছে। তবুও ব্যাপারটা হজম হচ্ছেনা শ্রাবণের। মনের মধ্যে প্রবল রাগ জমে থাকা স্বত্বেও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে সে পদ্ম’র কাছে গেলো। শ্রাবণকে দেখে আশিক দাঁত বের করে হেসে হেসে বললো
“ভাই ঘুম ভাংছে?
শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বললো
“হুম।
আশিক আবারও দাঁত কেলালো। বললো
“আমি কিন্তু অনেক ভোরে উঠছি। এতো বেলা অব্দি ঘুমানো কোনো ভালা মাইমষের কাম না। কি কও পদ্ম? পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে শেষের কথাটা বললো।আশিক।

এবার খানিক রেগে গিয়ে শ্রাবণ বলল
“তাহলে কি আমি ভালো মানুষ না?
আশিক জিভে কামড় বসালো। বললো
“কি কন ভাই। আমি হেই কথা কইছি নি। আপনি তো আমাগো বাড়ির অতিথি। অতিথিরা বেশি সময় ঘুমাইলেও দোষের কিছু না। কি কও পদ্ম?
আবারও পদ্মকে প্রশ্ন করে কথা বলায় মেজাজ মাথায় গিয়ে ঠেকলো শ্রাবণের। সে পদ্ম’র হাত টেনে বললো
“এখনো বসে আছিস কেন। তারাতারি গিয়ে রেডি হো। আমাদেরকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।
পদ্ম বিস্ময়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না। কারণ আশিক আছে এখানে, কিছু উল্টাপাল্টা বললে পরে হয়তো এটার কারণে শ্রাবণ ভাইয়ের কাছে বকা শুনতে হবে। পদ্ম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ ভাইয়ের পাশে। অন্যদিকে আশিক যেনো কিছুটা অবাকই হলো। সে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললো
“রেডি হইবো মানে! কই যাইবেন আপনেরা?
“বাড়ি যাবো। আবারও গম্ভীরমুখে বললো শ্রাবণ।

এবার আশিকের মুখটা চুপসে গেলো। সে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো
“হঠাৎ বাড়ি যাইবেন! তুমিও চইলা যাইবা পদ্ম?
“ওকে নিয়েই তো যাবো। যাবার দরকারটা ওর, আমার না।
“কি দরকার?
“এতোকিছু তোমাকে কেন বলতে যাবো?
শ্রাবণ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পদ্ম’কে টানতে টানতে সোজা ঘরের দিকে গেলো। সেলিম বসে আছে একা। আসমা বাকিদের সাথে রান্নাঘরে হাত লাগিয়েছে। শ্রাবণ সেলিমের কাছে গিয়ে ভারী গলায় বললো
“ভাবী’কে ডাক দে তো ভাই।
“কেন?
“পদ্ম’কে বাড়ি যেতে হবে। ও তো আর একা যেতে পারবে না, আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। ভাবিকে ডেকে বল আমরা এখনই বেরোবো।
সেলিম অবাক হলো। পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো
“হঠাৎ তোর কি এমন দরকার পরলো বাড়িতে?
পদ্ম অসহায় ভাবে তাকালো শ্রাবণের দিকে। পদ্ম কিছু উল্টাপাল্টা বলে দেয় কিনা সে ভয় থেকেই আগ বাড়িয়ে শ্রাবণ বললো
“ওর স্কুলে ডাক পরেছে। আজ যেতেই হবে, না গেলে ঝামেলা আছে।
পদ্ম শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে ওদের কথা, মুখে যেনো কুলুপ এঁটে আছে। কুলুপ খুলে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করলেই তো শ্রাবণ ভাইয়ের ঝাড়ি শুনতে হবে।
সেলিম আসমাকে আনলো। শ্রাবণ আর পদ্ম’র যাওয়ার কথাটা বলায় তিনিও বেশ অবাক হলেন। অনকে বার সাধলেন আজকের দিনটা থাকার জন্য। তবে শ্রাবণকে কোনোভাবের রাজি করানো গেলো না। শেষে অনুরোধ করলেন অন্তত নাস্তাটা যেনো করে যায়, কিন্তু তাও না। শ্রাবণের এক কথা, তাকে এই মুহুর্তেই পদ্ম’কে নিয়ে বেরোতে হবে।।

উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে সবাইকে রাজি হতে হলো। না খেয়েই বেরিয়ে পরলো তারা। বাড়ির দেউড়ি পার হতেই দেখা হলো একটা বড় পলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে আশিক। মুখটা তার চুপসে আছে, দেখে বুঝায় যাচ্ছে বেচারার মন খারাপ। শ্রাবণ তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হলো না। সে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো পদ্ম’র কাছে। মৃদু গলায় বললো
“পদ্ম।
পদ্ম আশিকের দিকে না তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণের দৃষ্টি সামনে, তবে চোখেমুখে তার আগুন স্পষ্ট। পদ্ম আশিকের দিকে তাকালো। আশিক মলিন গলায় বললো
“তুমি তো না খেয়েই চলে যাইতেছো পদ্ম, এই নাও… এতে কিছু চকোলেট, চিপস জাতীয় খাবার আছে। রাস্তায় খিদা লাগলে খেয়ে নিও।

পদ্ম শ্রাবণের দিকে তাকাতেই শ্রাবণ বিষাদ গলায় আবারও বললো
“আবারও এইসব?
আশিক হেসে বললো
“না খেয়ে বের হইছে, পদ্ম’র কষ্ট হইবো তো।।
শ্রাবণ আশিকের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো
“কষ্ট লাঘব করেছো তো, এবার আমাদের যেতে দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আশিক পথ ছেড়ে দিতেই ওরা চলে গেলো। রাস্তায় উঠতেই তারা সিএনজি পেয়ে গেলো। সিএনজি ছুটে চলেছে সরু রাস্তা বেয়ে। অনেকটা দুর এগিয়ে গেলে শ্রাবণ পদ্ম’র দিকে তাকায়। পদ্ম মুখভার করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অতিথি বাড়ি আশিকের যন্ত্রণায় পদ্ম’র সাথে শক্ত গলায় কথা বললেও এবার সে বেশ নরম হয়ে গেলো। মৃদু গলায় পদ্ম’কে ডেকে বললো
“পদ্মফুল, রেগে আছিস আমার উপর?
পদ্ম বেশ অভিমান নিয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো
“জীবনের প্রথম বার বেড়ানোর সুযোগ পাইছিলাম শ্রাবণ ভাই। মায়েরে অনেক কষ্টে রাজি করাইছে আপা। আর তুমি কিনা আমার সেই বেড়ানো থেকে বঞ্চিত করলা।।
“আশিক তোর সাথে ভাব জমানোর ট্রাই করছিলো পদ্ম’ফুল।।
“তাতে তোমার কি হইছে?
কথাটা বলেই জিভে কামড় দিলো পদ্ম। সে অবস্থাতেই শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণ কিঞ্চিৎ রাগীচোখে তাকিয়ে আছে পদ্ম’র দিকে। পদ্ম শুকনো ঢোক গিলে বললো
“না মানে, সে ভাব জমাইতে চাইলেও আমি তো আর ভাব জমাইতেছিলাম না।।
“তোর যা নরম মন, মনে হয় না ভাব জমাইতে বেশি সময় নিতিশ।

শ্রাবণের কথায় আবারও মুখ ভার করে তাকালো পদ্ম। শ্রাবণের বেশ হাসি পেলো এবার। তবে অনেক কষ্টে হাসিটাকে চেপে রাখলো সে। আরো কিছুটা সময় বাদে পদ্ম পলি থেকে একটা চিপ্সের প্যাকেট বের করলো খাওয়ার জন্য। শ্রাবণ আঁড়চোখে তাকালো পদ্ম’র দিকে। বিস্ময়ে বললো
“এটা বের করলি কেন?
“আমার খিদা লাগছে, ওইখানে তো খাইয়া আসার সময়টাও আমারে দেও নাই।
শ্রাবণ খপ করে পদ্ম’র হাত থেকে চিপ্সের প্যাকেট টা নিলো। পরক্ষণে প্যাকেটভর্তি পুরো পলিটাও নিলো। পদ্ম হা করে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। চিপ্সের প্যাকেট টা খুলে যখন একটা একটা করে চিপ্স শ্রাবণ মুখে দিতে লাগলো তখন পদ্ম খানিক রেগে বললো
“এইটা কি হইলো শ্রাবণ ভাই?
শ্রাবণ খেতে খেতে বললো
“কি হইছে?
“আমার চিপ্স তুমি খাও কেন?
“এইগুলার একটাও তোকে খেতে দিবো না পদ্মফুল। বলা তো যায় না, ঐ ছেলে কি জাদুমন্ত্র করে এগুলো তোরে দিছে। শেষে এগুলো খেয়ে তুই যদি ঐ ছেলের জন্য দিওয়ানা হয়ে যাস।।
“এবার কিন্তু তুমি বেশি বেশি করতাছো শ্রাবণ ভাই। আমার খিদা লাগছে কইলাম তো।

শ্রাবণ মৃদু হেসে বললো
“সামনে একটা বাজারে নেমে তোকে খাওয়াবো পদ্ম।
পদ্ম মুখ ভার করেই অন্যদিকে তাকালো। কিছুটা সামনে যেতেই একটা বাজারে গিয়ে ঢুকলো সিএনজি। শ্রাবণ ড্রাইভারকে বলে গাড়ি দাঁড় করালো। সেখানেই ভাড়া মিটিয়ে পদ্ম’কে নিয়ে নেমে পরলো সে। পদ্ম অবাক হয়ে বললো
“ভাড়া মিটাইলা কেন শ্রাবণ ভাই? আমরা কি বাড়ি যামু না?
শ্রাবণ পদ্ম’র মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো
“বাড়ি গেলে তো চাচীর জন্য তোর সাথে ভালো করে দু’টো কথাও বলতে পারিনা। আজ নাহয় মন ভরেই কিছু কথা বলে যাই। কাল তো আবার চলেই যাবো।
পদ্ম মুখ বাকিয়ে বললো
“তোমার তো আজকে যাওয়ার ডেট, তো কাল যাইবা কেন?
“আজ তো অতিথি বাড়ি ছিলাম।
“এখন তো সেইখান থেইকা আইসাই পরছো শ্রাবণ ভাই।
“এখন তো তোর সাথে আছি, তোর সাথে সময় কাটানোর সুযোগ টা মিস করবো নাকি পাগলী।

ভরা বাজারে পদ্ম’র হাতটা শক্ত করে ধরলো শ্রাবণ। সারা গায়ে শিহরণ বয়ে গেলো পদ্ম’র। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণের ঠোঁটের কোনে হাসি, দৃষ্টি সামনে। সে পদ্ম’র হাতটা ধরে সামনে এগিয়েই যাচ্ছে। পদ্ম একদৃষ্টিতে দেখছে তার শ্রাবণ ভাইকে। সামনে একটা বড় হোটেল। পদ্ম’কে নিয়ে সে হোটেলে ঢুকলো শ্রাবণ। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা বেরিয়ে পরলো বাজার থেকে। হেঁটেই যাচ্ছে তারা। গন্তব্য কোথায় তা পদ্ম’র অজানা। সে বিস্ময়ে শ্রাবণ কে পশ্ন করলো
“আমরা কই যাইতেছি শ্রাবণ ভাই?
“গেলেই দেখতে পাবি।
পদ্ম আর কোনো কথা বাড়ালো না। শ্রাবণের সাথেই হাঁটতে লাগলো। কিছুটা দূরে গিয়ে একটা জনমানবহীন যায়গায় চলে এলো তারা। শ্রাবণের ঠোঁটের কোনে এখনো সেই হাসি। জনমানবহীন সেই যায়গাটা অতিক্রম করতেই দূরে একটা বড় মাঠ দেখা গেলো। মাঠ পেরিয়ে একটা ছোট নদী। বাতাসের বেগে নদীর পানিতে ঢেউ খেলছে। দেখতে ভালোই লাগছে তার। পদ্ম সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটা দেখতে দেখতেই সামনে এগুচ্ছে।

নদীর একদম কাছাকাছি গিয়ে একটা শুকনো যায়গায় ঘাসের উপর গিয়ে বসলো তারা। বাতাসে পদ্ম’র মাথার চুলগুলো উড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ অপলক নয়নে তা দেখছে। পদ্ম’ও তাকালো শ্রাবণের দিকে। হেসে বললো
“এতো সুন্দর যায়গার খোঁজ কোথা থেকে পাইলা শ্রাবণ ভাই?
“এর আগে একবার বন্ধুদের নিয়ে আসছিলাম এখানে।
“ঘুরতে?
শ্রাবণ দুষ্ট হেসে বললো
“তা নয়তো কি প্রেম করতে?
পদ্ম হাসলো। দূরে একটা নৌকা বাধা দেখা যাচ্ছে, আশেপাশে কোনো মাঝি দেখতে পাচ্ছেনা সে। শ্রাবণকে উদ্দেশ্য করে পদ্ম বললো
“এই ঘাটে কোনো মাঝি নাই কেন শ্রাবণ ভাই?
“মাঝি দিয়ে কি করবি?
“নৌকায় উঠতে ইচ্ছা করতাছে। মাঝি থাকলে উঠতে পারতাম।
“আমি চালাবো নৌকা?
“নৌকা চালাইতে মাঝি লাগে শ্রাবণ ভাই। তুমি কি মাঝি নাকি?
শ্রাবণ হাসলো। আবেশে তাকালো পদ্ম’র দিকে। মৃদুস্বরে বললো
“আজ নাহয় তোর জন্য আমি মাঝিই হলাম। আল্লাহ সহায় হলে শুধু নৌকার মাঝি না, তোর জীবনের মাঝিও আমিই হবো।

চলবে…….

গ্রুপ লিংক : “তন্বী’র উপন্যাসমহল”- Tanni Islam✍️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here