পুনর্মিলন পর্ব -০৪+৫

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৪

ফাল্গুনী কথা শেষ করে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো অন্যমনস্ক হয়ে।
সোহাগ ফাল্গুনীর খাওয়া পাইপ দিয়েই অনায়াসে বাকি জলটুকু খেয়ে নিলো। ফাল্গুনীর সে খেয়াল নেই। সে মজে আছে অন্য চিন্তায়। ফেরি তো প্রায় পারে চলে এলো। এবার তো আবার সেই বাঘের সাথে বাঘের গুহায় ঢুকে হরিণের মতো বসে থাকতে হবে। না জানি কখন হামলা করে বসে। ফাল্গুনী মনে মনে পণ করে নিলো বাসে ওঠে আর ঘুমন্ত বাঘকে কোনভাবে জাগতে দেবে না। যতই বাঘ গর্জে উঠুক সে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে বসে রবে। তারপর আবার ভাবে, এখন তো এতো ভয় হচ্ছে জাগ্রত কে নিয়ে তাই তার সাথে কথা না বাড়ানোর চিন্তা আসছে মাথায়। বাসে উঠার পর মাথায় রাগ না চাপলেই হলো। নয়তো রাগের বসে যেচে পড়ে বাঘের থাবার শিকার হতে হবে। কপাল ভালো এখন আশেপাশে নেই নয়তো সোহাগের সাথে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখে নিলে না জানি কতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা শোনাতো আর দোষ ধরতো। কিন্তু ফাল্গুনী জানতে পারলো না বাঘ তো আরও আগেই ক্ষেপে গেছে। তার তো খোঁচা লেগেছে সোজা বুকের ভেতর। ক্ষত হয়েছে গভীর। এবার বাঘ কি করবে কে জানে!

ফেরি পৌঁছে গেছে তার গন্তব্যে। বাস, প্রাইভেট কার বা অন্যান্য যানবাহনের সকল যাত্রীরা যারা পুরো ফেরির এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো সবাই যার যার নিজের সিটে গিয়ে বসতে শুরু করে দিয়েছে। ফেরির কর্মচারীরা গাড়িগুলো বের হবার জন্যা রাস্তা করে দিলে সারি সারি সব গাড়ি গুলো নামতে শুরু করবে। ফাল্গুনী এবং সোহাগদের বাস একদম শেষ সারি তে। তাই তাদের বাস সবার শেষে বের হবে।

ফাল্গুনী এবং জাগ্রত নিরবে বসে আছে তাদের সিটে। বাসে উঠার পর দুজনের মধ্যে কথা তো দূর দৃষ্টি ও বিনিময় হয়নি। দুজন দু’দিকে ফিরে বসে আছে। তবে জাগ্রত এবার জানালার পাশে বসে নি। সে আগে থেকেই সামনের সিটে এসে বসেছিলো। ফাল্গুনী বাসে উঠলে সে দাঁড়িয়ে গিয়ে ফাল্গুনীকে ভেতরে বসার সুযোগ করে দিয়েছে। তবুও মুখে কোন কথা বলে নি। ফাল্গুনীও নিশ্চিন্তে আছে জাগ্রতকে নিশ্চুপ দেখে।

হটাৎ তড়িঘড়ি করে সোহাগ এসে দাঁড়ালো ফাল্গুনীর জানালার কাছে। সোহাগ কে এমন সময় দেখতে পেয়ে ফাল্গুনী ভীষণ চমকে উঠে। জাগ্রত অতি মাত্রায় আশ্চর্য হয় সোহাগকে এভাবে শেষ মুহুর্তে এখানে দেখে। বুঝতে পারে এ ছেলে সহজে পিছু ছাড়বে না। সোহাগ হুড়মুড় করে বলে উঠে,

‘ফাল্গুনী! ঝটপট ব্যাগ নিয়ে নেমে পরো তো। আমার দুই সিট সামনে একটি সিট খালি আছে। আমার পাশে বসা আংকেল কে বলে ওখানে পাঠিয়ে দেবো। তুমি বাকি পথ আমার সাথে করেই যেতে পারবে। জলদি করো গাড়ি গুলো বেড়িয়ে যেতে শুরু করবে এখন।’

‘আরে আপনি পাগল হয়ে গেছেন সোহাগ? বাস ছেড়ে দেবে এখন। আপনি নিজের বাসে গিয়ে বসুন যান। নয়তো বাস মিস করবেন। আর টিকিট ছাড়া এভাবে হুট করে অন্য বাসে যাওয়া যায় নাকি?’

‘তোমাকে এসব ভাবতে বলেছে কেউ? তুমি শুধু চলে এসো বাকিটা আমার দায়িত্ব। তুমি এই রাতে অচেনা একজন বাইরের পরপুরুষ এর সাথে বসে জার্নি করছো আমার সেটা একটুও ভালো লাগছে না ফাল্গুনী। আমার সাথে থাকলে তোমার সেইফটি নিয়ে অন্তত নিশ্চিন্ত হবো।’

সোহাগ তার শেষ কথাটা ধীর আওয়াজে বললেও জাগ্রতর তা শুনতে অসুবিধা হয় নি। ‘অচেনা বাইরের পুরুষ’ কথাটা বেশ গায়ে লাগলো জাগ্রতর। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে। অঙ্গের প্রতিটি শিরায় শিরায় আঘাত হানলো এ তিনটি শব্দ। মনে আশা জাগল ফাল্গুনী হয়তো তার দুঃসহ কন্ঠের কড়া শব্দের ধ্বনি তুলে বলে উঠবে, ‘উনি মোটেও আমার অপরিচিত কেউ নয়। আর না বাইরের কেউ। আপনি চলে যান সোহাগ। আমি এখানে যথেষ্ট কমফোর্টেবল এবং সেইফ ফিল করছি। এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবেন না।’

কিন্তু জাগ্রতর আকাঙ্ক্ষায় মাটি চাপা পরলো। ফাল্গুনী তেমন কিছুই বললো না। শুধু সোহাগ কে অনুরোধ করলো,

‘দেখুন আমার সাথে আমার কোন ব্যাগ নেই। ওগুলো বক্সে রাখা আছে। এখন রিসিট দেখিয়ে তারপর বক্স থেকে ওগুলো বের করার মতো এতো সময় নেই। বাস এক্ষুনি ছেড়ে দেবে।’

এর মধ্যেই ফেরিতে সারিবদ্ধ যানবাহনগুলো সব একে একে স্টার্ট দিয়ে দেয়। প্রথম লাইন থেকে শুরু করে বেরিয়ে যেতে থাকে একেকটা গাড়ি।

‘ওইতো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আপনি প্লিজ নিজের বাসে গিয়ে বসুন। নয়তো বাস মিস করবেন। এতো রাতে এমন বিপদ ডেকে আনবেন না। আপনার কাছে হাত জোর করে রিকোয়েস্ট করছি আমি প্লিজ।’

সোহাগ মন খারাপ করে দৌড়ে চলে যায় নিজের বাসে। বড্ড সম্মানে লেগেছে তার। মনে মনে পণ করলো ফিরে যাওয়ার পর কোন কথা বলবে না ফাল্গুনীর সাথে। মেয়েটা চাইলেই চলে আসতে পারতো। কিন্তু ইচ্ছে করেই এলো না। তারপর ভাবলো, পাশে বসা লোকটা কি ফাল্গুনীর চেনা কেউ? হাবভাবে তেমনই মনে হচ্ছিলো। তখন ফাল্গুনীর সাথে কথা বলার সময় কেমন করে এগিয়ে আসছিলো তাদের দিকে। দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিলো না। কিছু একটা ছিলো যেনো সেই দৃষ্টিতে।

এদিকে ফাল্গুনী ভেতর থেকে বড্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। জাগ্রত কিছু করবে বা বলবে সেই ভয়ে ভেতরটা খেয়ে যাচ্ছে। না জানি কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে মানুষটা। ভেতরের বিচ্ছিন্ন অবস্থা বাহ্যিক আচরণে স্পষ্ট রূপ না দেওয়ার অসীম প্রয়াস করে যাচ্ছে। তাই জানালার দিকে সম্পূর্ণ ফিরে বসে আছে আর ভাবছে হাজারও ভাবনা।

‘অচেনা বাইরের পরপুরুষ’ কথাটা তারও মনের গহীনে ঝড় তুলেছে। সেই চার বছর আগের পুরোনো ঝর। পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। বারবার নিজেই নিজেকে বোঝাচ্ছে তাদের সম্পর্কটা তো শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে গেছিলো। এখন আর একে অপরের উপর কোন অধিকার নেই। তাই সে কি বলবে বা কি করবে সেই ভয় পাওয়ার ও নিমিত্ত কোন কারণ নেই। তবু বুকের ভেতর যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের কোন থামাথামি নেই। মহাতান্ডব এ লুটিয়ে পড়ছে বুকের পাঁজর। পরমুহূর্তেই আবার মনকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা মানুষ টা এভাবে চুপ করে কেনো ছিলো? এখনও চুপ করে আছে। এতোকিছুর পরেও যে কিছুই বললো না তার কি একটুও খারাপ লাগেনি কথাটা শুনে। সে প্রতিবাদ কেনো করলো না।

ফাল্গুনীর অশান্ত মনে ক্ষনে ক্ষনে পাল্টাচ্ছে নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্খা, অনুভূতি। জাগ্রত কখন কি বলে ওঠে সেই ভয়ে ভেতর থেকে গুটিয়ে আছে, আবার চুপ করে কেনো আছে তা নিয়েও কষ্ট পাচ্ছে। নিজেই নিজেকে চিনে ওঠতে পারছে না আর না বুঝতে পারছে মন কি চায়। হতে পারে বুঝেও তা মেনে নিচ্ছে না। নয়তো এতো কিসের দোমনা, কেনো এতো সংশয় !

‘ছেলেটা কে?’

দীর্ঘ নিরবতার পর আচমকা জাগ্রতর প্রশ্নে ধক করে ওঠলো ফাল্গুনীর বুকের পাঁজর। তীব্র আন্দোলন শুরু হলো হৃদয়ের হৃৎস্পন্দনে। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর প্রয়াস করলো, কিন্তু হলো না। পাশ থেকে জলের বোতল তুলে নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো কয়েক ঢোক ঠান্ডা জল। ঘাড় ঘুড়িয়ে চাইলো জাগ্রতর দিকে। চোখে চোখ পড়লো না। তবে জাগ্রত কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। যেনো শত সহস্র অভিযোগ দায়ের করা আছে এই দৃষ্টিতে।

ফাল্গুনী চোখ নামিয়ে নিয়ে জবাব দিলো,

‘ওনার নাম সোহাগ। বরিশালে আমি যে বাসায় থাকি সেই বাসাটা ওনার মামার। সে থেকেই পরিচয়।’

‘ছেলেটা তোমায় ভালোবাসে তাই না?’

ফাল্গুনীর ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। কি জবাব দেবে সে। চোখ ভিজে আসতে চাইলো অকারণ আবেগের ঢলে। এতোক্ষণের এতো লুকোচুরি, এতো রাগ, এতো ভয় সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেনো দুজনের। আবেগ এবার পেয়ে বসেছে দুজনকে। জরিয়ে নিয়েছে আবেগের নরম চাদরে। তাইতো এতো শান্ত হয়ে আছে জাগ্রত, আর ফাল্গুনীও আবেগ অনূভুতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে চোখ ভিজিয়ে বসে আছে। তবে কেউ কারো মনে উঁকি দিতে রাজি নয়। যার যার নিজের মনগড়া যুক্তি আর সূত্র ধরে বসে আছে তারা।

‘কি হলো জবাব দিচ্ছ না যে? তার মানে কথাটা সত্যি?’

ফাল্গুনী আটকে আসা গলায় ধীর আওয়াজে বললো,

‘সামনে তার বিয়ে। বাড়ি থেকে মেয়ে দেখা হচ্ছে তার জন্য। খুব শীগ্রই বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হবে।’

‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। আগে কিন্তু এভাবে কথা ঘুরাতে না। এক সাময়িক প্রসঙ্গও নিয়েও মনমতো করে ইতি না টানা পর্যন্ত থামার নামই নিতে না। এতো বদলের কারণ-ও কি স…’

‘আমি ভালোবাসিনা ওনাকে। আর তেমন কোন সম্পর্কও নেই ওনার সাথে। ওনার সাথে আমার সম্পর্কের সীমা বন্ধুত্ব নাগাদ, তার বেশি না।’

জাগ্রত এতোক্ষণ সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে কথা বলছিলো। মাথা তুলে চোখ মেলে এবার ফাল্গুনীর দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো,

‘এটাও আমার প্রশ্নের জবাব ছিলো না।’

ফাল্গুনী বিব্রত হলো। বিহ্বলিত আঁখি জোড়া এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলো তার। কয়েক মূহুর্ত পর দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে শান্ত হলো। চলন্ত বাসে বসে জানালার বাইরে ফেলে রেখে যাওয়া মুহুর্ত পানে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। অকস্মাৎ বলে উঠলো,

‘ভালোবাসা বা না বাসার উপর আজকাল কিছু নির্ভর করে না। ভালোবাসা আজকাল চাকরির আবেদনপত্রের মতো। একবার চাকরিটা পেয়ে গেলে তারপর আর সেই আবেদনপত্র কোন কাজে আসে না। যত্ন করে তুলে রাখতে হয় মনের আলমারিতে। তখন প্রয়োজন পরে মানসিক ও শারীরিক প্রদত্ত শ্রম, বুঝদার ঠান্ডা মস্তিষ্ক আর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বলি দিয়ে উর্ধ্বতন মহলকে পরিতুষ্ট করার মতো ধৈর্যশক্তি। আর হ্যা, যেকোন দোষারোপ বন্ধ মুখে মাথা পেতে নেওয়ার মতো সহ্যশক্তিও কিন্তু চাই। তাহলেই চাকরি টিকবে। নয়তো উপরমহল থেকে ইস্তফাপত্র হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। অথবা নিজের ব্যার্থতা মেনে নিয়ে নিজে থেকেই পদত্যাগ করে নিতে হবে। যেমন আমাকে আপনি দিয়েছিলেন। ইস্তফাপত্র!’
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৫

ভালোবাসা বা না বাসার উপর আজকাল কিছু নির্ভর করে না। ভালোবাসা আজকাল চাকরির আ’বে’দ’ন’প’ত্রে’র মতো। একবার চাকরিটা পেয়ে গেলে তারপর আর সেই আ’বে’দ’ন’প’ত্র কোন কাজে আসে না। যত্ন করে তুলে রাখতে হয় মনের আলমারিতে। তখন প্রয়োজন পরে মা’ন’সিক ও শা’রী’রি’ক প্র’দ’ত্ত শ্র’ম, বুঝদার ঠান্ডা ম’স্তি’ষ্ক আর নিজের ইচ্ছা অ’নি’চ্ছা’র ব’লি দিয়ে উ’র্ধ্ব’ত’ন মহলকে পরি’তু’ষ্ট করার মতো ধৈ’র্য’শ’ক্তি। আর হ্যা, যেকোন দো’ষা’রো’প ব’ন্ধ মুখে মাথা পেতে নেওয়ার মতো সহ্য’শ’ক্তিও কিন্তু চাই। তাহলেই চাকরি টিকবে। নয়তো উপরমহল থেকে ই’স্ত’ফা’প’ত্র হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। অথবা নিজের ব্যা’র্থ’তা মেনে নিয়ে নিজে থেকেই পদ’ত্যা’গ করে নিতে হবে। যেমন আমাকে আপনি দিয়েছিলেন। ই’স্ত’ফা’প’ত্র!’

‘চাকরি করার ইচ্ছে ছিলো তোমার? ছিলো না। তাই ই’স্ত’ফা’প’ত্র পেয়েছিলে। এবং সেটা তোমার ইচ্ছেতেই। আর আ’ধ্যা’ত্মিক কথাবার্তা শিখেছো দেখছি। আগে তো ন’নী’র পু’তু’ল ছিলে। ধ’রা ছোঁ’য়া যেতো না তার আগেই গ’লে পড়তে। তা তোমার শি’ক্ষা’গু’রু কে? ওই সোহাগ নামের ছেলেটা?

‘না। আপনি, আপনার পরিবার আর আমার কিছু কাছের মানুষ। আপনারা শিখিয়েছেন আমায়। কেউ এক চু’ল ছা’ড় দেননি শি’ক্ষ’ক’তায়। শি’খি’য়ে গেছেন তো গেছেন-ই। আমিও ছিলাম আদ’র্শ প’ড়ু’য়া। সে সু’যো’গ লু’ফে নিয়েছি।’

জাগ্রত এতোখন ঠা’ন্ডা মাথায় কথা বললেও এবার খানিক রে’গে গিয়ে কথা ফিরিয়ে দিলো। তবে গলার আওয়াজ স’চে’ত’ন রেখে।

‘সব কথায় টা’র্গে’ট করা ব’ন্ধ কর। তোমার বুঝি কোন দো’ষ ছিলো না? সবাই এমনি এমনি তোমার ওপর চ’ড়া’ও হতো? আমি কি চেষ্টা করি নি মানিয়ে নিতে? নিজেকে ভি’ক্টি’ম আর অন্যদের কা’ল’প্রি’ট ভাবা ব’ন্ধ করো।’

‘ছিলো বলেই তো নি’র’ব ছিলাম, স’র’ব হইনি। তবে ততটা দো’ষে’র ভা’গী’দার ছিলাম না যতোটা শা’স্তি আমার জন্য ব’রা’দ্দ করা হয়েছিলো। আপনি আর আপনার পরিবার আমাকে কখনোই আ’প’ন করে নে’ন’নি। আর না কখনো আমাকে আপন করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।’

‘ওহ্ জাস্ট শা’ট-আ’প ফাগুন, জাস্ট শা’ট-আ’প। তোমার প্রতিটা কথা তুমি সবার দিকে আ’ঙ্গু’ল তুলে বলছো। নিজেকে ভি’ক্টি’ম বানাচ্ছো আর সবাইকে কা’ল’প্রি’ট বানাচ্ছো। চার বছর আগে এমনো কিছু দিন গেছে যেদিন তুমি হাজার বার বলেছো ডি’ভো’র্স এর কথা। আমার চে’হা’রা দেখলেও ক্ষে’পে যেতে। আমার পরিবারকে কখনো নিজের পরিবার বলে মে’নে না’ও নি। আর সবসময় দো’ষা’রো’প করে গেছো আমার মা কে। আমার মা ছিলো তোমার চ’ক্ষু শূ’ল। সেসব আমারও মনে আছে। ভুলিনি সেসব। কই আমি তো সেসব কথা তু’লছি না। তাহলে তুমি কেনো তু’লছো?’

জাগ্রত এবার সমস্ত ধী’র স্থী’র আর ধৈ’র্যে’র সীমা অ’তি’ক্রম করে চি’ৎ’কা’র করে উঠেছে। স্থান, কাল, পাত্রের ভে’দ ভুলে ঢেলে দিয়েছে নিজ মনের সমস্ত রা’গ আর অ’ভি’যো’গ।

রাতের নি’ক’ষ ভূ’তূ’ড়ে আঁ’ধা’র গলিয়ে চলন্ত বাসটি হটাৎ সরব হয়ে উঠলো। জাগ্রতের চি’ৎ’কা’র করে বলা কথায় ঘুমন্ত যাত্রীরা সবাই জেগে গেছে। কেউ উ’ৎ’সুক’ভাবে চেয়ে আছে কেউ ভী’ষ’ণ ভাবে রে’গে আছে ঘুম ভাঙলো বলে। কেউ আবার নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করেছে নানান স’মা’লোচ’না। কেউ কেউ নিজেদের সিট থেকেই ছু’ড়ে মারছে রু’ক্ষ, ক’টা’ক্ষ শব্দের বা’ন। এরমধ্যেই একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। এসে বললেন জাগ্রতকে,

‘আপনারা মনে হচ্ছে স্বামী স্ত্রী। নিজেদের মধ্যে কোন স’ম’স্যা থাকলে বাড়ি গিয়ে মি’টি’য়ে নেবেন। এভাবে পাবলিক প্লেসে সি’ন’ক্রি’য়ে’ট করবেন না। আপনি তো পুরুষ মানুষ তাই ল’জ্জা শ’র’মের বা’লা’ই নেই। কিন্তু আপনার স্ত্রী একজন নারী। তার আ’ত্ম’স’ম্মানে আ’ঘা’ত লাগছে। হে’ন’স্তা হচ্ছে সে। নারীদের আ’ত্মস’ম্মান এর চেয়ে প্রিয় আর কিছু হয় না। যদি হয় তবে বুঝে নিতে হবে সে নারী মৃ’ত। ভেতরে ভেতরে মৃ’ত্যু ব’র’ন করে নিয়েছে সে। তাই নিজেদের ব্যা’ক্তি’গত আলাপ বাড়ি গিয়ে সেরে নেবেন।’

ফাল্গুনী অতি বিনয়ী কন্ঠে ভদ্রমহিলার কথার পিঠে বলে উঠলো,

‘দুঃ’খি’ত আন্টি, মা’ফ করবেন। উনি আর এমন করবেন না। আর আন্টি, উনি আমার স্বামী নন। আর না আমি উনার স্ত্রী। আপনি ভু’ল ভেবেছিলেন। আপনি সিটে গিয়ে বসে পড়ুন, চলন্ত বাসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়, যেকোন সময় দু’র্ঘ’টনা ঘটে যেতে পারে, যান।’

ভদ্রমহিলা সন্তুষ্ট হলেন ফাল্গুনীর কথায়। মুচকি হেসে চলে গেলেন ধীর পায়ে। ফাল্গুনী ঘাড় ঘুড়িয়ে দৃষ্টি ফেললো জাগ্রতর দিকে। জাগ্রত মাথা নি’চু করে নিয়েছে অনেক আগেই। এক হাতে কপালের এক পাশ ছুঁয়ে আছে চু’প’চা’প। ফাল্গুনী আরাম করে নিজের সিটে বসে মাথা এলিয়ে দিলো। তারপর নরম সুরে বললো,

‘স’রি ফিল হচ্ছে?’

জাগ্রত মাথা তুললো না। মাথা না তুলেই বললো, ‘স’রি, নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না’।

ফাল্গুনী খানিক হেসে দিলো। হাসি মুখেই বললো, ‘ভ’য়ে’র কোন কারণ নেই। এই আমি আর সেই আমির মধ্যে প্র’কা’ন্ড প্র’ভে’দ। বি’স্ত’র ফা’রা’ক। যাকে অন্যের সামনে একটা ধ’ম’ক দিলেও আ’ত্ম’স’ম্মানে আ’ঘা’ত পেতো, কেঁ’দে কে’টে নাকের জলে চোখের জলে বি’ক্রি’য়া ঘটিয়ে ফেলতো, তার সাথে এই আজকের ‘আমি’র কোন মিল নেই। আমি অন্তত পাই না। তাই আগের মতো লোকে কি বললো না বললো সেসব নিয়ে ভ’য় বা ল’জ্জা পাই না। আর তাই আপনার গি’ল্টি ফি’ল করার না’ট’ক টাও এখানে অ’হে’তুক আর অ’প্রোয়’জ’নীয়।

‘ফাগুন!’

‘ভু’ল করেও এই ভু’ল’টা আর করবেন না। আমার নাম ফাল্গুনী, ফাগুন নয়। আমি প্রথম থেকে এই পর্যন্ত শা’ন্ত ও ধী’র, স্থী’র ছিলাম, বাকি পথটাও তাই থাকতে চাচ্ছি। দয়া করে এবার চুপচাপ বসুন। একজন অচেনা ব্যাক্তির মতো দু’র’ত্ব বজায় রেখে মুখটা ব’ন্ধ রাখুন।’

জাগ্রত মাথা তুলে চাইলো। সরাসরি ফাল্গুনীর চোখে চোখ রাখলো। দৃষ্টিতে কোন ক্লে’শ নেই, দু’র্বো’ধ্য সে দৃষ্টি। ফাল্গুনী চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলতেই জাগ্রত ব’লি’ষ্ঠ ক’ন্ঠে জেদি কায়দার ডেকে উঠলো, ‘ফাগুন’ বলে।

ফাল্গুনী চোখ ব’ন্ধ করে নিলো। মি’শ্র অনু’ভূ’তি হচ্ছে। অল্প আ’বেগ, অল্প অভি’মান, কিছু ভ’য় আর আকাশ সমান রা’গ। সব মিলিয়ে ভেতরটা ফে’টে পড়ছে।

‘ঘুড়ে বসো’

জাগ্রতের কন্ঠ জো’রা’লো। দ্বিতীয় বার কোন সি’ন’ক্রি’য়ে’ট হোক তা ফাল্গুনী চায় না তাই জাগ্রতর কথা উ’পে’ক্ষা না করে ঘুড়ে বসলো। জাগ্রত চুপচাপ ক’ঠি’ন মুখে বসে আছে। কিছুক্ষণ চু’প থেকে তারপর বললো,

‘সে’পা’রে’শ’ন এর দিন থেকে আজ পর্যন্ত কোথায় ছিলে?’

ফাল্গুনী হেসে দিয়ে বললো, ‘আপনি যেভাবে অধি’কা’র দেখিয়ে প্র’শ্ন করছেন তাতে মনে হচ্ছে না আপনি আমার প্রা’ক্ত’ন স্বামী। শুনুন, আপনি আমার কাছ থেকে কোন উ’ত্ত’র পাবেন না। আমি বা’ধ্য নই।’

‘তাহলে আবারও চলন্ত বাসটি চি’ৎ’কা’রের আ’ও’য়া’জে র’ম’র’মা হয়ে উঠবে। হয় বাস যাত্রী আর ড্রাইভার আমাদের না’মিয়ে দেবে নয়তো আমি তোমায় নিয়ে নেমে যাবো। সবাইকে বলবো আমরা স্বামী স্ত্রী। তা প্র’মা’ণ করার জন্য তোমার আমার কাপল ফটো আছে আমার কাছে। আর সে’পা’রে’শন এর পেপার তো তোমার কাছে নেই। তাই সবার কাছে আমরা স্বামী স্ত্রী প্রমাণিত হলে দুজনকে একসাথে নামিয়ে দেবে। সবার সামনে নতুন আরেক সি’ন’ক্রি’য়েট তৈরি হবে। তখন কোথায় যাবে? ভোর হতে এখনো বেশ দেরি। কি করবে ভেবে নাও। আমি তো আর তোমাকে চাইছি না। চাইছি তোমার থেকে কিছু প্র’শ্নে’র উ’ত্ত’র। তোমাকে চাইলে না হয় মুখের উপর না করে দিতে। চাইছি তো উত্তর।’

জাগ্রত কথা শেষ করে নির্লিপ্ত মুখ করে চেয়ে রইলো ফাল্গুনীর দিকে। স’গ’র্বে হাত দুখানা ভাজ করে বুকের কাছ রেখে ফাল্গুনীর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। ফাল্গুনীর মুখা’ব’য়ব বি’বে’চনা করে বোঝা মু’শ’কি’ল সে জাগ্রতর কথায় ঠিক কতোটা প্র’ভা’বি’ত হলো। ভ’য় কি পেলো? নাকি রা’গ হলো? নাকি ক’ষ্ট হচ্ছে তার?

জাগ্রত কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাল্গুনী উঠে দাঁড়ালো। জো’রা’লো কন্ঠে ড্রাইভার মামা বলে ডেকে উঠলো বাস চালককে, বললো বাস থামিয়ে দিতে। ফাল্গুনীর এক কথায় বাস চালক থামিয়ে দিলো না বাস। ক’ন্ট্রা’কটর এগিয়ে এলো ফাল্গুনীর সামনে। জিজ্ঞেস করলো এখানে কেনো নামবে এখান থেকে কোন গাড়ী পাওয়া যাবে না এতো রাতে। টাঙ্গাইল পৌছাতে এখনো দু আড়াই ঘন্টা বাকি। ফাল্গুনী আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘সেটা আমি দেখে নেবো, আপনি থামিয়ে দিন।’ জাগ্রত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে যাচ্ছে শুধু। মুখে যেনো কিছু বলতেও ভু’লে গেছে। ক’ন্ট্রা’ক’টর কে বাস চালকের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সং’বি’ৎ ফিরে পায় জাগ্রত। বাস ক’ন’ট্রা’ক’টরকে ডাক দেয়, এগিয়ে আসলে বি’ন’য়ী কন্ঠে বলে উঠে,

‘মা’ফ করবেন ভাই। আমরা এখানে নামবো না। আমাদের টাঙ্গাইলের পুরাতন স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিবেন। আপনি যান।’

কন্ট্রাক্টর বিরবির করতে করতে চলে যায় সামনের দিকে। কন্ট্রাকটর যাওয়ার পর জাগ্রত সিটে বসে পড়লো ধ’প করে। সিটে এলিয়ে দেওয়া মাথা ঘুড়িয়ে চোখ বুলালো পুরো বাসে। অধিকাংশ যাত্রী ঘুমের মায়া ছেড়ে দিয়েছে। উ’ৎ’সু’ক চেহারায় উঁ’কি ঝুঁ’কি মারছে জাগ্রত আর ফাল্গুনীর দিকে। যেনো কোন বাংলা মুভির ক্লা’ই’ম্যা’ক্স সিন চলছে। দী’র্ঘ এক শ্বাস টেনে নিলো জাগ্রত। নিজেকে শান্ত করলো। ম’স্তি’ষ্ক ঘেঁ’টে মনে করলো চার বছর আগের কথা। একসাথে থাকার প্রথম ছয় মাসের কিছু সময় এমন ছিলো, ফাল্গুনী যখন রে’গে যেতো তাকে কোন কিছু করেই থামানো যেতো না। কান্নাকাটি করতো শুধু। বাড়ির কারো সাথে কথা বলতো না। শুধুমাত্র তার সাথেই একটু কথা বলতো। কিন্তু যা বলতো তার অধিকাংশই হতো তার মা কে নিয়ে। প্রচুর হা’ই’পা’র হয়ে থাকতো। তখন তাকে শান্ত করার জন্য একটা পদ্ধতিই কাজ করতো, তা হলো ভ’য়। ফাল্গুনীর লো’ক’ল’জ্জা’র ভ’য় ছিলো অ’ভা’ব’নীয়। কেউ তাকে কথা শুনাবে, খা’রা’প বলবে, ছো’ট করে কখনো কিছু বলবে তা সে মানতেই পারতো না। অতোটা ছোট বয়সেও আ’ত্ম’স’ম্মান নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায় সচেতন ছিলো। তাই ফাল্গুনীকে শা’ন্ত করাতে এভাবেই ব্ল্যা’ক’মে’ইল করতো জাগ্রত। যেভাবে আজ চেষ্টা করেছিলো কিছু কথা বের করতে। হটাৎ ফাল্গুনীর কথায় জাগ্রতর আবেশ ভ’ঙ্গ হলো। ফাল্গুনী বললো,

‘আর কতো না’ট’ক করবেন বলুন তো? মি’থ্যে’ই বা আর কতো বলবেন? অনেক তো হলো, এবার হা’ল ছেড়ে দিন। একটু পরেই বাস খা’লি হতে শুরু করবে। তখন সিট ব’দ’লে নেবো আমি। আপা’ততঃ কিছু সময় একটু চুপ থাকুন।’

‘কি মি’থ্যে বলেছি আমি? আর কি না’ট’ক’ই বা করলাম?’
‘করেননি বলছেন?’
‘প্লিজ ফাল্গুনী এতো হেঁ’য়া’লি আমি নিতে পারছি না। স্পষ্ট করে বলো। প্লিজ।’
‘বলবো বলছেন?’
‘ফাল্গুনী আ…..

জাগ্রত মাথা চেপে চিৎকার করে উঠলো ফের। অত্যাধিক অধৈর্য্য হয়ে বললো,

প্লিজ আমার ধৈ’র্যে’র প’রি’ক্ষা নিও না। আমি নিজেকে নি’য়’ন্ত্র’ণ করতে পারছি না। আর এটাও বুঝতে পারছি না তুমি কি করে এতোটা শা’ন্ত আছো! প্রথমে তা-ও মনে হচ্ছিল তুমি আমায় দেখে চ’ম’কে’ছ, অ’স্ব’স্তি’র স্বী’কা’র হচ্ছো, হয়তো কিছুটা ভ’য় ও পেয়েছো কিন্তু তারপরেই আবার বদলে যাচ্ছো! তোমাকে আমার অ’চে’না লাগছে, বড্ড অ’চে’না লাগছে। চার বছরে একটা মানুষের এতোটা ব’দ’ল কি সত্যিই অ’ভাব’নীয় নয়?

~চলবে
~চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here