পুনর্মিলন পর্ব -২৬+২৭

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৬+২৭

“লাকি আমার কতা হুন মা। তুই পলাইয়া যা একমুহি। এক কাম কর তর ইস্কুল মেডাম সাহানা আছে না হের বাড়িত যাইয়া উঠ। হের মনডা এক্কেলে ফেরেশ। হের মতন ভালা শিক্ষিতো মানুষ আমি আর দেহি নাই। হে তরে সাহায্য করবো দেহিস। তুই যা মা আর বেলা বারাইস না।”

খুশির উত্তেজিত গলায় কাঁপা কন্ঠের ফিসফিসানি কথায় নড়চড় হলো না লাকির। কোন হেলদোল নেই এক রত্তি মেয়েটার। সেই যে দু লাইনের এক জবাব দিয়ে বসে আছে তারপর আর রা নেই মুখে। লাকির নিরবতা তুফান চালিয়ে যাচ্ছে খুশির মনে। এতোদিন যেই মেয়েটার অল্প কথায় মুখ আঁটানোর স্বভাব ছিলো তার মনের মতো, অতি পছন্দনীয়; আজ তা তিক্তস্বাদ লাগছে অতিব।

খুশি দরজার বাইরে চোখ বুলালো একবার সতর্ক দৃষ্টি ফেলে। ফিরে এসে ফিসফিস করে শক্ত গলায় বলে উঠলো,

“পরথমে যহন বিয়ার কতা হুনলি তহন তো মুখের উপুর না করলি মুখপুরি, বউ মরা রতন কুমার এর নাম হুনার পর এক কতায় রাজি হইলি কেন? তর মনে কি আছে আমারে ক; এহনো সময় আছে। তুই চিনস রতনরে? আঁখির বিয়াতে তো তুই যাস নাই আর ওই রতনরে-ও দেহস নাই, তাইলে কেমনে চিনস তুই?”

অগ্রাহ্য দেহভঙ্গিমায় নতমস্তকে বসে থাকা লাকি এবার মাথা তুলে চাইলো খুশির পানে। অচঞ্চল সে চাহনি। নির্বিকার ভঙ্গিমায় বলল,

“আঁখির যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল আমি তার নামও জানতাম না, চেনা তো দূরে থাক। এ-ও জানতাম না রতন-ই ছিলো কি না তার হবু বর এর নাম।”

“তাইলে নাম পরিচয় হুইনা ঠিকানা জিগাইলি কেন? আর পুরা ঠিকুজিকোষ্ঠী জাইনা তারপর বিয়ার জন্য সায় কেন দিলি যদি নাই চিনস!”

লাকি মুচকি হেসে জবাব দিলো,

“তুমিও দেখছি তোমার বোনের মতোই বোকা হয়ে যাচ্ছো দিনদিন। মানুষ জিজ্ঞাসাবাদ কেনো করে? জানলে করে নাকি? না জানলেই তো করে। তাকে চিনলে তোমায় শুধাবো কেনো?”

“দেখ আমি এতোকিছু জানি না তুই বাইর অ, তরে আমি ওই নেশাখোর লম্পটের লগে বিয়া দিমু না। তরে আমি অন্যকোতাও পলাইয়া থুইয়া আমু। উঠ, আয় আমার লগে।”

খুশি টানলো লাকিকে। লাকি উঠলো না। জবাব ও দিলো না। কুলুপ এঁটে বসে রইলো মুখে। খুশি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। হাউমাউ করে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো বুক ফেটে। ডাকলো উপরওয়ালাকে। সঁপে দিলো লাকির ভাগ্য তার উপর। সেই জানে মেয়েটার কপালে কি আছে! আবার ভাবলো লাকির বাপ-ই শেষ ভরসা। সে যদি মানা করে দেয় তাহলে আর লাকি নিজে থেকে যেচে কিছু বলবে না। তারপর আবার মনে চাঁড়া দিয়ে উঠলো আরেক চিন্তা; যদি সুভাষ চন্দ্র জোর করে নিজের মেয়ে বলে নিয়ে চলে যায় তাহলে আটকাবে কি করে?

হটাৎ-ই বাইরে থেকে পুরুষ কন্ঠের শোরগোলের আওয়াজ ভেসে এলো। খুশি র ঘোর ভাঙলো সহজেই। দরজার ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো সুভাষ চন্দ্র আট দশজন সঙ্গী সাথী নিয়ে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। সবার পেছনে নজর গেলে দেখা মেলে রতন এর মুখমন্ডল। ঠিকরে পড়ছে চেহারায় বিয়ের আমেজ। পোশাক আশাকে মনে হচ্ছে মেয়ে দেখতে নয় সোজা বিয়ের মন্ডবেই এসেছে বিয়ে করতে। খুশি ভয়ভয় চেহারা নিয়ে পিছন ফিরলে আরও অবাক হয়ে যায় লাকির কান্ড কারখানা দেখে। দু’হাতে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। লাকি পুরোনো টিন এর ট্রাঙ্কটা খুলে একটি লাল টুকটুকে শাড়ি বের করে তা নিজের গায়ে জরিয়ে দেখছে। নেড়েচেড়ে এপাশ ওপাশ করে বারবার দেখছে। তবে হাত-পায়ের গতিবিধি যাই হোক না কেনো মুখের আদোলে তার কোন ছিটেফোঁটাও নেই। একদম নির্বিকার, অনুভূতিহীন মুখাবয়ব।

খুশি হাল ছেড়ে দিলো না। চোখমুখ মুছে বাইরে যেতে নিলো সুভাষ চন্দ্রের সামনা-সামনি হতে। তখন হটাৎ পিছন থেকে ডেকে উঠলো লাকি। বলল,

“যখন দেখাশোনা চলবে তখন বলো আমি পাত্রের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। নয়তো বিয়ে হবে না।”

খুশি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। পিছু ফিরেই সজোরে চড় হাঁকিয়ে বসলো লাকির বাম গালে। এবারেও নির্বিকার রইলো লাকি। যেমন সর্বদা থাকে।

খুশির মনে এবার ভয় হতে লাগলো লাকিকে নিয়ে। সবাইতো মেয়েটার নিস্তব্ধতার সাথে পরিচিত। নিস্তব্ধতার আড়ালে বিধ্বস্তার সাথে তো কারও আলাপ নেই।

ছোট থেকেই মেয়েটা এক কষ্ট বুকে চেপে বড় হয়েছে। সর্বদা তার হাত ধরে প্রশ্ন করে গেছে তাকে বারংবার, “তাকে কেনো তার পরিবার ত্যাগ করলো? বাকি মানুষগুলো না-হয় বাদ যাক নিজের মা কেনো বুকে আগলে রাখলো না? মায়েরা তো সন্তানকে আগলে রাখতে সব করতে পারে তাহলে তার মা কেনো করলো না?”

এসবের উত্তর তার কাছে ছিলো না। শুধু বুঝিয়ে গেছে তার সন্তান হচ্ছিলো না বলে তাকে দিয়ে দিয়েছিলো নিজের সন্তানের মতো পালন করতে।

ছোটবেলা থেকে খেলার সাথীদের কাছ থেকে, আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া রাস্তার মেয়ে বলে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। এলাকার প্রতিটি ইট কাঠের দেয়াল-ও যেনো জেনে এসেছে লাকিকে তার বাবা-মা পালতে পারবে না বলে দিয়ে দিয়েছে অন্যকাউকে। এক কথায় ফেলে দিয়ে ঘারের বোঝা নামিয়েছে শুধুমাত্র।

_____________________

সকালের নাস্তা শেষে অফিসে বের হবে বলে জাগ্রত তৈরি হয়ে নিচ্ছে নিজের রুমে। দুহাতের অবস্থান শার্টের বোতাম এ হলেও দৃষ্টি পরে আছে দরজার দিকে। অপেক্ষায় আছে কখন আসবে ফাল্গুনী। গতকাল এত করে বলে দিলো অফিসে বের হওয়ার সময় সব কাজ ফেলে শুধু তাকে সময় দিতে কিন্তু তার তো কোন পাত্তাই নেই। জাগ্রত পুরো তৈরি হয়ে নিয়ে রুমের এদিক সেদিক পায়চারী করলো কতক্ষণ। তারপর শক্ত মুখাবয়ব নিয়ে বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে ফাল্গুনীর খোঁজ করতে। ড্রয়িংরুমে জিনিয়া আর জেমি ছাড়া কাউকেই দেখতে পেলো না জাগ্রত। জেমিকে জিজ্ঞেস করল,

“তোমার মামি কোথায় জেমি?”

জেমি জবাব দিলো না কোন। শুধু চাইলো তার মায়ের চোখের দিকে। জিনিয়া বলল,

“জেমি কথা খুব কম বলে দাভাই। বৌমনি বোধহয় ওয়াশরুমে।”

নির্বাক ফিরে চলে গেলো জাগ্রত তার রুমে। দু’মিনিট বাদে ফাল্গুনী এসে দেখে জাগ্রত বিছানায় বসে আছে দু’হাতের মুষ্টিতে থুতনি বসিয়ে। দরজা থেকেই দেখতে পেলো শার্টের বোতামগুলো এলোমেলো ভাবে লাগানো। ফাল্গুনী জিভ কামড়ে হাত মুছতে মুছতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জাগ্রতর বাহু ধরে টেনে দাঁড় করালো ঠোঁট জোড়ায় একটা মিষ্টি করে হাসি টেনে। বোতাম গুলো ঠিক করে লাগিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,

‘সরি। আজকেই লাস্ট। আর কখনো আপনি অফিসে বেরোনোর আগে আপনার কাছ ছাড়া হব না; সে যত কাজ-ই থাকুক না কেন।”

জাগ্রত পারলো না মুখাবয়বে গম্ভীরতা ধরে রাখতে। একটুখানি ঠোঁট এলিয়ে শব্দহীন হেসে ফেললো। বোতাম পর্ব শেষ হলে ফাল্গুনীর দু’হাত ধরে ফেললো নিজের দু’হাতের এক থাবায়। দু’হাতে একটু কাছে টেনে নিয়ে কপালে উষ্ণ অনুভূতির স্পর্শ এঁকে দিলো টুপ করে। ফাল্গুনী লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়, নড়চড় করলো না। অনুভব করলো শুধু বুকের পাঁজরে ধুকপুক করা তীব্র অনুভূতি।

জাগ্রত বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল,
“আসার সময় বাসা দেখে আসবো। সুবিধা মতো পেলে একেবারে কনফার্ম করে আসবো যাতে কাল পরশু সিফট হয়ে যেতে পারি। সাবধানে থেকো আর ফোন যেনো খোলা থাকে আর সাথে থাকে। ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করবে। আসছি।”

জাগ্রত চলে গেলে ফাল্গুনী বাইরে গিয়ে জিনিয়ার সাথে টেবিলে বসলো আড্ডা দিতে। উদ্দেশ্য শ্বাশুড়ি মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু তথ্য বের করে নেওয়া। জাগ্রতর কাছ থেকে তা সম্ভব নয় তাই জিনিয়াই একমাত্র ভরসা।
কথায় কথায় যেটুকু জেনে নেওয়া যায় সেটুকুই লাভ। বাকিটা পরে সামলে নেওয়া যাবে। ফাল্গুনীর দৃঢ় বিশ্বাস জাগ্রতর মা অসুস্থ ছিলেন না। তার প্রমাণ জাগ্রতর মা নিজেই। অতীত হাতড়ালে তাকে নিয়ে যতটুকু স্মৃতি ভেসে উঠে চোখের সামনে সবটাতেই শুধু তার নাটক, নাটক আর নাটক। আর কেউ না জানুক সে নিজে তো জানতো তার অসুস্থতায় কতোটা সত্যতা ছিলো! তাহলে মৃত্যু কি করে সেই অসুস্থতা থেকেই হলো? কোন রহস্য তো অবশ্যই আছে।

জিনিয়ার সাথে কথা বলতে বলতেই ফাল্গুনীর ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো। কে ফোন দিয়েছে তা দেখতে পেয়ে ফাল্গুনীর চোখমুখ জুড়ে আঁধার নেমে এলো। বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেললো বড় করে। জিনিয়াকে “একটু আসছি” বলে রুমে চলো গেলে কথা বলতে। এদিকে জিনিয়ার সন্দেহ হলো ফাল্গুনীর মুখভঙ্গি দেখে। হটাৎ করে কার এমন কল এলো যে চোখমুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো এক মুহুর্তেই আর রুমে চলে গেলো আলাদা কথা বলতে। জিনিয়া একটু এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে কান পেতে দাঁড়ালো। ফোনের ওপাশ থেকে বলা কথাগুলো শুনতে না পেলেও খুব অনায়াসেই স্পষ্ট শুনতে পেলো ফাল্গুনীর মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো। সন্দেহ দৃঢ় হলো জিনিয়ার।

____________________

শেষমেশ নিসান আর আঁখিকে বরন করে ঘরে তোলেনি চন্দনা। নিসান এর হাত ধরে খুব সাধারণভাবেই গৃহপ্রবেশ হয়েছে আঁখির। না ছিলো দুধে-আলতায় ভরা বিশাল আকারের থালা, না ছিলো রঙীন পায়ের ছাপ ফেলে যাওয়া লাল পেড়ে সাদা শাড়ী আর না আড়ম্বরপূর্ণ বরন ডালা। ছিলো শুধু ডালাসমেত মন খারাপ এর পরিপূর্ণতা।

নিসান আঁখিকে নিয়ে ভেতরে আসার পরও মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু চন্দনা সেই সুযোগটাই দেয়নি। ঘরে দরজা দিয়ে বসেছিলেন কিছুসময়।

দু’জনেই এতদূরের সফর করে ক্লান্ত। আঁখি তো রাস্তায় দুইবার বমিও করেছে। দূরের পথে চলাফেরা করার অভ্যেস যে ছিলো না কখনো। এই তো প্রথম এতদূরে আসা। নিসান এরও মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ। লম্বা সফর তার ওপর আবার এতো এতো দুশ্চিন্তা, সব মিলিয়ে মাথা ফেটে পড়ছে ব্যাথায়।

রুমে ঢুকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দুজনেই স্নান করে নিয়েছে সবার আগে। আগের দিন নিসান এর কথায় দোলা গিয়ে শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছিলো চারটে, সাথে ছিলো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছু। স্নান করে সেখান থেকেই একটা কালো পেড়ে লাল জমিন এর শাড়ি পড়েছে আঁখি। মাথাভর্তি করে সিঁদুর ও পড়েছে; তবে তা নিসানের হাত থেকেই আবদার করে পড়ে নিয়েছে। নিসান এর আগামীকাল থেকে অফিস করতে হবে তাই মাথা ব্যাথা নিয়েও এসেই লেগে পড়ছে অফিসের ফাইলপত্র নিয়ে।

ঘরে বসে থাকতে আঁখির মনে কেমন অপরাধবোধ অনুভব হচ্ছে। নিসান এর সঙ্গে এক ঘরে বসে থাকতে ভীষণ লজ্জাও করছে। আবার বাইরে যেতেও ভয় লাগছে। অনেক ভেবে আমতা আমতা করে নিসানকে ডেকে উঠলো আঁখি, “শুনছেন?”
নিসান চকিতে তাকালো আঁখির দিকে। তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? এখনও বমিভাব হচ্ছে নাকি?”
“না না বমিভাব না, আমি একদম ঠিক আছি, সুস্থ আছি। অন্য কথা বলার ছিলো।”
“যেভাবে নড়বড় করে শুনছেন বলে ডেকে উঠলে তাতে তোমায় অসুস্থ বলেই মনে হলো। সোজাসাপ্টা গলায় ডাক দেওয়া যায় না?”
“বলছিলাম যে আমি একটু বাইরে যাই? মানে মায়ের কাছে যাই?”
নিসান মুখ গম্ভীর করে বলল,
“কোনকিছুতেই তাড়াহুড়ো করতে নেই আঁখি। আজকে সবে এক ঘন্টা-ও হয়নি তুমি এবাড়িতে এসেছো আমার হাত ধরে, এখন মায়ের মনের অবস্থা কি তা বুঝতে পারছো? বাবাও নেই বাড়িতে। মা বোধ হয় এখন রান্নাঘরে আছে। দেখলে তো আমি আসার পর কতো সময় নিয়ে চেষ্টা করলাম মায়ের সাথে একটু কথা বলার; পারলাম না তো। মাকে একটু সময় দাও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন মা ভীষণ রেগে আছে, রাগের মাথায় কি বলবে না বলবে তুমি কষ্ট পাবে। তাই বলে ভেবো না মা আমার বদমেজাজী বা ছোট মনের। শুধু মায়ের রাগটা একটু কমতে দাও দেখবে মা তোমায় নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবে। হয়তো দোলা দি’র থেকেও বেশি। ঘরে বসে থাকো কোথাও যেতে হবে না। অন্তত আজ তো নয়ই।”

আঁখি মাথা নত করে রইল কিছুসময়। তারপর সাহস পুঁজি করে নতমস্তকেই বলে উঠলো, “তাহলে আপনি অন্যকোথাও থাকুন না। আপনার সাথে এক ঘরে এভাবে দরজা ভিড়িয়ে বসে থাকতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। মা যেদিন নিজে থেকে মেনে নেবেন আমায় সেদিন থেকে নাহয় একঘরে থাকবো দুজন।”

নিসান হাতের ফাইলটি টেবিলে রেখে দিয়ে আঁখির কাছে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে কি যেনো একটা ভেবে বেরিয়ে গেলো রুমের বাইরে তৎক্ষনাৎ। আঁখির মন খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলো নিসান হয়তো রাগ করলো তার কথায়।

নিসান রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো তার মা বসে বসে সবজি কাটছে দুপুরের রান্নার জন্য। কাল বিলম্ব না করে এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখমুখ কাচুমাচু করে মাথায় দু’পাশে দু আঙ্গুল চেপে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

“একটু কফি করে দেবে মা! মাথা ব্যাথায় অসহ্য লাগছে সবকিছু। আর মাথায় একটু ঠান্ডা তেল দিয়ে মালিশ করে দাওনা। আর পারছি না, এখন বমি বমিও লাগছে।”

চন্দনা রাণীর বুকটা ধক করে উঠলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো নিসান এর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। মাথা ব্যাথা উঠলে যে লাল হয়ে যায় ছেলেটার চোখ, পাগল হয়ে যায় ব্যাথায়। বেশিক্ষণ মাথা ব্যাথা থেকে গেলে বমিও করে। মনের ভেতরটা জ্বলে গেলেও কঠিন মুখ করে চন্দনা বলে উঠলো,

“যাকে যত্ন করে ঘরে তুলেছিস নিজের মর্জিতে তাকে বল তোর সেবা করতে। যা এখান থেকে।”

“নিসান কপালের দু’পাশে দুই আঙ্গুল ডুবিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল,

“সে আমার সেবা আর কি করবে মা, ঘর থেকেই তো বের করে দিলো আমাকে। এখন এসব ঝামেলা আমার ভাল লাগছে না। আগে মাথা ব্যাথা টা কমুক তারপর না-হয় দেখা যাবে বাকিটা। তুমি কি একটু কফি করে দেবে? নাকি আমিই করে নেবো?”

জ্বলে উঠলো চন্দনার বুকের ভেতরটা। ছেলেটা মাথা ব্যাথায় চোখ মেলে চাইতে পারছে না আর সে কিনা স্বামীকে সেবা না করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বসে আছে! রাগে হাতে ধরে রাখা পুইশাক এর লম্বা ডাটাটাও রাখতে ভুলে গেলো, হাতে নিয়েই ফটাফট কফির জন্য জল বসিয়ে দিলো চুলায়। দু’মিনিটে কোনমতে জলে বলক তুলে দুধ, চিনি, কফি পাওডার মিশিয়ে কফি করে নিলো ঝটপট। নিসানের হাতে কফির কাপ তুলে দিয়েই ত্রস্ত পায়ে ছুট লাগালো নিসান এর ঘরের দিকে। হাতে এখনো রয়ে গেছে পুঁইশাকের ডাটাটুকু। নিসান-ও পিছু নিয়ে এগিয়ে গেলো মায়ের সঙ্গে।

নিসান চলে যাওয়ার পর আঁখি আর ঘরের দরজা আটকায় নি। হাট করে খোলাই রয়ে গেছে দরজার কপাট জোড়া। সে তো নিসান রেগে গেলো সেই দুঃখে বসে আছে মন খারাপ করে। দুই-এক ফোঁটা অশ্রুও ঝড়িয়েছে মনের দুঃখে।

চন্দনা দরজা খোলা পেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে গেলো রুমের ভেতর। আঁখি বিছানায় পিছু ঘুরে বসে ছিলো মন খারাপ করে। আচমকা কারও পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ শুনে পিছু ফিরেই দেখতে পেলো শাশুড়ী মায়ের অগ্নিমূর্তি রূপ। আঁখির আত্মা যেনো শুঁকিয়ে চৌচির হয়ে গেলো।

“এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দাও! কোন সাহসে বের হতে বলেছো আমার ছেলেকে? বলো, কোন সাহসে বলেছো?”

এতোক্ষণে নিসানও ঢুকে গেলো রুমে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ কুঁচকাতে কু্ঁচকাতে এগিয়ে এলো খানিক মায়ের কাছে। তাড়াহুড়োয় কফি তো নয় নিম পাতার সরবত করে দিয়েছে মা জননী। এদিকে আঁখি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভীতিবিহ্বল চেহারা নিয়ে। শ্বাশুড়ী মায়ের কথার জবাবে কি বলবে না বলবে তা নিয়ে শংকায় আছে। চন্দনা অধৈর্য হয়ে আবারও বলে উঠলো,

“কি হলো কথা কেনো বলছো না? আমার ছেলেকে ঘর থেকে বের কেনো করেছো বল?”

চান্দনার সাথে সাথে নিসানও বলে উঠলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলো। তোমার সেন্টিমেন্টাল ডায়লগ টা শোনাও মা’কে।”

আঁখি ভয়ের দমকে এবার কেঁদেই দিয়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে তার। চোখের জল মুছতে মুছতে জবাব দিল,

“আমি শুধু বলেছিলাম আপনি যতদিন না আমাকে মেনে নিচ্ছেন ততদিন আমরা আলাদা ঘরে থাকবো। আমি তো উনাকে বের করে দিই নি।”

চন্দনা খানিক অবাক হলো আঁখির সরলতায়। মেয়েটা কেমন অল্পতেই চোখের জল ছেড়ে দিলো! চোখে মুখে কি মায়া লোপ্টানো। আবার মনে হলো নাকি নাটক করছে? চন্দনার ঘোর ভাঙলো নিসান এর কথায়।

“একই তো হলো। আমি মানছি আমার ফ্যামিলির অমত সম্পর্কে কিছু না জানিয়েই বিয়ে করেছি তোমায়, তাই বলে আমায় মুখের উপর প্রশ্ন করবে যে আমি কেনো ফ্যামিলির অমতে তোমায় কিছু না জানিয়ে বিয়ে করলাম? কি হলো বাসে থাকতে করোনি এমন প্রশ্ন?”
আঁখি চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল,
“আমি তো সেভাবে বলিনি।”
“বলেছো তো?

চন্দনা যা বোঝার বুঝে গেছে এতোক্ষণে। নিসান এর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে নাম ধরে ধমকে উঠলো এবার। গর্জে উঠে বলে উঠল,

“মায়ের কাছে বউ এর পাঠ পড়াতে এসেছিস নিসান? নাটক করছিস তুই? বাহ! বউ এর গুনগান গাওয়ার ভালো বুদ্ধি এঁটেছিস দেখছি। তা হয়েছে বউকে নির্দোষ প্রমাণ করা? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?”

আঁখি হতবিহ্বল! বুঝলো না কিছুই। একবার নিসান এর দিকে চাইলো তো আরেকবার শ্বাশুড়ী মায়ের দিকে। এদিকে নিসান জিভ কামড়ে ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে। এক হাত কফিতে আঁটকে থাকায় আরেক হাতে কান ধরে বলল, “মাথা ব্যাথা তো সত্যিই করছে মা। আমার চোখটা দেখছো তো?”
“নিসান! এসব বন্ধ কর।”
“কি করতাম বল। আমাকে কিছু ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিয়েছো তুমি? খুনের আসামীকে-ও অন্তত নিজের হয়ে জবাবদিহি দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আমি তো তাও পাইনি। তুমি অন্তত আমাকে আমার দিকটা তুলে ধরার সুযোগ তো দেবে? কিন্তু দিচ্ছ না। তাই একটু নাটক করলাম। এ আর নতুন কি বলো? বাবা আর আমার তো নিত্য কর্ম এসব, তুমি রাগছো কেনো? তবে আঁখি কিন্তু কিছুই জানতো না। ও এখনও কিছু বুঝেছে কিনা সন্দেহ। একটু জিজ্ঞেস করেই দেখো না।”

“সর সামনে থেকে।”

চন্দনা রাণী নিসানকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রুমের বাইরে। এ রুমে আর কিছুক্ষণ থাকলে তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে। যেতে যেতে দরজার বাইরে থেকে উচ্চ স্বরে বলে গেলেন,

“ড্রেসিং টেবিলে ঠান্ডা তেল আছে দেখো মেয়ে, নিসান এর মাথায় তেল মালিশ করে দাও। ও মাথা ব্যাথা সহ্য করতে পারে না।”

চন্দনা চলে গেলে নিসান গিয়ে আঁখির চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “অভ্যেস করে নিন মেডাম, আপনার বরটা একটু পাগলাটে। মাঝেমাঝেই এমন পাগলামো করে বসে। আপনার শ্বাশুড়ী মা এসবে অভ্যস্ত। তাই আপনিও অভ্যাস করা শুরু করুন। তবে হ্যাঁ, অকারণে কিন্তু আমি কিছুই করি নি। দেখলে তো মা কতোটা সহজ হয়ে গেলো?”

আঁখি নিসান এর বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। বড্ড ভয় পেয়ে গেছিলো আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়ে। নিসান আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো, “আহা কি সোনায় বাঁধানো কপাল আমার! মাথা ব্যাথা করছে আমার আর মাথায় হাত বুলিয়ে সেবা করছি আমি তোমার।”

আঁখি হেসে উঠলো খিলখিল করে। চোখ মুছে ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিয়ে এসে নিসানকে বসালো বিছানায়। নিজের কোলে নিসান এর মাথা নিয়ে তেল মালিশ করতে লাগলো যত্ন করে।

~চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here