#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১১
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
—-“ওরে আল্লাহ রে!বাছাও আমারে!মইরা গেলাম গো।শয়তান ছেমড়ি চুল ছাড় আমার,জলদি ছাড়।”
—-“তোর সব চুল যদি আমি আইজগা না ছিঁড়ছি!তয় আমার নামও লাইলি না।বুইড়া বেডা!বুড়া বয়সে পিরিত জাগছে না?আমারে বিয়ার প্রস্তাব দেছ!আমি তোর শখ মজায় দিমু।”
দোয়া মির্জা জায়নামাজে বসে ছিলেন।মাত্রই সালাম ফিরিয়ে দু’আ পড়ছিলেন। চিৎকার কানে আসতেই ভয় পেয়ে গেলেন।কি হয়েছে দেখার জন্য তড়িঘড়ি করে কামরা থেকে বের হলেন।সিঁড়ি কাছে আসতেই হাফিজ মির্জার ভুড়ির সাথে ধাক্কা খেলেন।ছিটকে পড়তেই নিচ্ছিলেন তার আগের মাসুক তাকে ঝাপটে ধরলো!হাফিজ মির্জার পরনে ভেজা লুঙ্গি,দেহের ওপরের অংশ সাবান মাখানো। মাসুক তার বাবার দিকে উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে!তৃণা মির্জা ছাদ গিয়েছিলেন।সিঁড়ির কাছে স্বামী,শাশুড়ী,ছেলেকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলেন।বিশেষ করে স্বামীর এই অবস্থা দেখে তিনি তাজ্জব বনে গেলেন!জিমি ভিডিও কলে তার হবু স্বামী সোহরাবের সাথে কথা বলছিলো,ফোন হাতে নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এলো!পুনর্বার লাইলি আর ইউসুফের চিল্লানোর আওয়াজ কানে বেজে উঠলো।সকলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো!!মোহিনী মির্জা রান্না ঘরে কাজ করছিলেন,হাতে খুন্তি নিয়ে তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন।হলরুমে হাজির হয়ে সকলের চক্ষু চড়ক!লাইলি আর ইউসুফ একে অপরের চুল ধরনের টানাটানি করছে।হাফিজ মির্জা তাদের থামানোর জন্য ব্যস্তসমস্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন!কিন্তু লাইলি আর ইউসুফের কাছে পৌছানোর পূর্বে লুঙ্গির সাথে পা বেজে পড়ে গেলেন!ধুরুম,একটা জোরালো শব্দ সকলের কানে বেজে উঠলো।হাফিজ মির্জার গায়ে লেগে থাকা সাবানের ফেনা ফ্লোরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।তৃণা মির্জা মুখে হাত দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন।জিমি ও মাসুক একবার হাফিজ মির্জার দিকে তাকাচ্ছে,আরেকবার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।ইতিমধ্যে লাইলি আর ইউসুফ একে অপরের চুল ছেড়ে দিয়েছে।কাচুমাচু মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।এতোকিছুর মধ্যে দোয়া মির্জা একদম ভাবলেশহীন!তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন।হাফিজ মির্জা ফ্লোরে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন!হাত ও ফ্লোরে সাবান ফেনা লেগে থাকায় বেশি সুবিধা করতে পারলেন না,পিছলে গেলেন।
——“শরীলের লগে লগে মাথার বেরেনও গরুর মতো বানায় ফেলছে।”
দোয়া মির্জা দাঁত কিড়মিড় দিয়ে ছেলেকে শাসালেন।এমতাবস্থায় হাসি চেপে রাখতে না পেরে মাসুক ও জিমি উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলো।মোহিনী মির্জা শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন।তাদের হাসি দেখে তৃণা মির্জাও ফিক করে হেঁসে দিলেন।হাফিজ মির্জা স্ত্রী ও ছেলের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন! “ঘরের শত্রু বিভীষণ” উক্তিটি একেবারে তার জন্যই উপযুক্ত।ইউসুফ এগিয়ে তাকে নিচ থেকে উঠালো।হাফিজ মির্জা উঠে দাঁড়াতেই পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে এলো।সকলে একেবারে চুপ!
—“মাসুক,শারাফকে ফোন দে!মিষ্টি আনতে বল!আসর নামাজের পরে কাজি আসবে।আমি সামনে থেকে লাইলি আর ইউসুফের বিয়ে দিবো।”
হাফিজ মির্জার রুক্ষ কন্ঠ কানে যেতেই মাসুক ঘাবড়ে গেল!যাইহোক না কেন,বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়।মনে পড়ে গেল,একটু আগের কাহিনি।এভাবে হাসাহাসি করা একদম ঠিক হয় নি তার!সুবোধ বালকের ন্যায় সে জবাব দিলো।
—–“জি আব্বা, এখনই ফোন দিচ্ছি।”
হাফিজ মির্জা প্রতিউত্তর করলেন না,ধপধপ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন।ফোনের উসিলা দিয়ে মাসুকও তার ঘরে চলে গেল।তার পেছন পেছন জিমিও নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।ইউসুুফ ও লাইলি ব্যতিত সকলে হলরুম ত্যাগ করলো।বিয়ের খবর কানে আসতেই ইউসুফ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।লাইলির মাথায় যখন পুরো বিষয়টি সেট হলো,সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।ইউসুফকে ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিলো।কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
—–“বুইড়া ব্যাডা,তোর জীবন আমি ছারখার কইরা দিমু।বিয়া করার শখ এ জন্মের মতো ঘুছায় দিমু।”
ইউসুফ দাঁত কেলিয়ে হেঁসে উঠলো। তারপর ফিচলে কন্ঠে উত্তর দিলো,
—–“শখ মিটানোর আগেই আমার বাচ্চার মা হই যাবি।তখন আর আমারে ছাড়তেও পারবি না।”
ইউসুফের কথার বিপরীতে লাইলি ভেংচি কেটে,হলরুম ত্যাগ করলো।
————-
—-“আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছিলেন বড়মা,শারাফের সাথে আমার বিয়ে দিবেন।তাহলে,ওই মেয়ের সাথে কি করে শারাফের বিয়ে হলো?আপনি তো সবসময় বলতেন শারাফ আপনাকে সম্মান করে,আপনার পারমিশন ব্যতিত কিছু করবে না।অথচ,আপনাকে না জানিয়ে সে বিয়ে করে নিয়েছে!আপনি বা এতো স্বাভাবিক আছেন কি করে?”
——“নওশিন আমি কিন্তু তোমাকে কখনো কথা দেই নি!আমি বলেছিলাম শারাফ চাইলে তোমার সাথে তার বিয়ে হবে।আর শারাফ চন্দ্ররেখাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে,এখানে আমি বা কি করতে পারি!”
—–“সত্যি বলতে কি বড়মা!আদোও কি একজন ধর্ষিতাকে কেউ কখনো নিজের বাড়ির বউ বানাতে চায়!তারা তো সকলের আমার মতো করুনার পাত্র!আর আপনারা তো ঝিল্লিপুর গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ!আপনাদের চাঁদোয়া মহলে চন্দ্ররেখার ন্যায় চাঁদকেই মানায়।আমি তো চাঁদের সে কলঙ্ক,যা প্রত্যক্ষভাবে চাঁদের সৌন্দর্য মলিন করে দেয়।”
সুধা মির্জা আজকে মির্জার গ্রুপের মেইন অফিস ভবনে এসেছেন।শারাফকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর থেকে এখানে তিনি খুব কমই আসেন।এখন নিজের ব্যক্তিগত কেবিনে বসে আছেন।এখানে আসার কিছু সময় পর নওশিন তার কেবিনে প্রবেশ করে।
নওশিনের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।সে লক্ষ্য করলো তার চোখ ভিজে গেছে।সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো!সুধা মির্জা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।ধীর পায়ে নওশিনের কাছে এগিয়ে গেলেন।কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই,নওশিন তাকে জাপটে ধরলো।
—–“আট বছর হয়ে গেছে বড়মা,তবুও সেই দিনটি আমাকে প্রতি মূহুর্ত তাড়া করে বেড়ায়!আমি শ্বাস নিতে পারি না,নিজেকে যে বড় নোংরা মনে হয়।সেই নরপিশাচ আমাকে জীবন্মৃত বানিয়ে দিয়েছে বড়মা।শেষ করে দিয়েছে আমাকে!আপনি আমাকে মেরে ফেলুন,প্লিজ!
নওশিনের আহাজারি সুধা মির্জার বুকে যেয়ে আঘাত করলো।তিনি আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলেন।মাথা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।মোলায়েম গলায় বলতে লাগলেন,
——-“শান্ত হও নওশিন!তোমার বড়মা সবসময় তোমার সাথে আছে।ভুলে গেছো!সেই পশুটিকে আমি নিজে তোমার হাতে শাস্তি দেওয়া ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম?তোমার সাথে করা সেই অনৈতিক কাজের শাস্তি সে এখনও পেয়েই চলছে।তুমি কিন্তু খুব ভালো করেই জানো,এই সুধা মির্জা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না।নিজের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকেও কিন্তু আমি ছাড় দেই নি!
নওশিন নিশ্চুপ! মনের ভেতরে চলতে থাকা ঝড়কে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।বেশ কিছু সময় নিয়ে নিজেকে সুস্থির করলো।সুধা মির্জাকে ছেড়ে, স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়ালো।চোখমুখে কান্নার রেশ লেগে আছে।নিজেকে সামলে সুধা মির্জাকে প্রশ্ন করলো,
—-“আপনি খেয়াল করেছেন রেখার সাথে আপনার চেহারা যে বেশ মিল আছে?আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে রেখার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক আছে! শারাফ কোনো কারণ ছাড়া ওকে বিয়ে করে নি,তাই না।”
সুধা মির্জা প্রথমে জবাব দিলেন না। বেশ কিছু সময় মৌন রইলেন!গভীর ভাবে কিছু ভাবলেন।তারপর ধীরে সুস্থে বলতে লাগলেন,
—–“রেখার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে।কি সম্পর্ক তা আমি তোমাকে সরাসরি বলবো না!সময় হলে নিজেই জানতে পারবে।আমার যতোটুকু ধারণা শারাফ আমার আর রেখার মাঝের সেই সংযোগ খুঁজে চলছে।সে এক প্রকার উঠে পড়ে লেগেছে!ইতিমধ্যে রেখার জন্য শারাফের মনে অগাধ দূর্বলতা তৈরি হয়েছে,তার চোখে রেখার জন্য আমি আলাদা ব্যাকুলতা দেখতে পেয়েছি।আমার ধারণা কতোটুকু সত্যি সেটা জানার জন্য,আমাকে শারাফের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। অনিশ্চিয়তার সাথে কিছুই বলতে পারছি না!”
কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,
—–“দেখো নওশিন, আমি কোনোভাবেই চাই না তুমি শারাফ আর রেখার মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করো।আশা করি তুমি আমার কথা রাখবে??
নওশিন সুধা মির্জার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো।মাথা নেড়ে সুধা মির্জাকে আশ্বস্ত করলো।কিছু একটা ভেবে হুট করে বললো,
—–আপনার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটির জন্য রেখা এই পৃথিবীতে এসে, তাই না?
সুধা মির্জার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
—-“বাহ!ধরেই ফেলেছো,আ’ম ইমপ্রেসড।”
নওশিন কথার প্রসঙ্গ বদলালো।সুধা মির্জার দু’হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—–“বড়মা,আমি আপনার কাছে শেষবারের মতো একটা জিনিস চাই।প্লিজ না করবেন,এইবারের মতো শেষ।আর বলবো না।প্লিজ! প্লিজ!প্লিজ,এইবারই শেষ। ”
সুধা মির্জার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।তিনি হয়ত নওশিনের অভিসন্ধি বুঝতে পারলেন।কিছুটা একটা চিন্তা করলেন।নওশিন সুধা মির্জার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
—–“ঠিক আছে,তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে যাবে!কিন্তু তার আগে আমাকে কথা দিতে হবে!আমার কথা শুনতে হবে, যা চাইবো তুমি তাই করবে.. ওকে?”
নওশিন তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে গেলো।মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
—–“ওকে, ওকে!প্রমিস আপনার সব কথা শুনবো।”
সুধা মির্জা তার কেবিনে থাকা লকার থেকে বেশ পুরনো একটা চাবির গোছা বের করলেন।সেদিকে চোখ পরতে নওশিনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।চাবির গোছাটি নওশিন থাকে তুলে দিতে দিতে তাকে পুনরায় সাবধান করলেন,
—–“যা করবে অতি সাবধানে,রাগের মাথায় ভুলভাল কোনোকিছু করবে না।মনে থাকে যেনো!আর এসব কিছু খোলাসা হয়ে গেলে কিন্তু,আমার চেয়ে বেশি তোমার ক্ষতি হবে!!
—–“আচ্ছা, মনে থাকবে।আপনি নিশ্চিত থাকুক।”
সুধা মির্জাকে আশ্বস্ত করে নওশিন কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।সেদিকে তাকিয়ে সুধা মির্জা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি কোনো ভুল করলেন না তো!নওশিনকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়াটা কি ঠিক হলো?ক্রোধে যদি ভুল কিছু ঘটিয়ে ফেলে!এছাড়া নওশিনেরও যদি কোনো ক্ষতি হয়?তিনি ল্যান্ডফোন থেকে বজলুকে কল করে,নওশিনের পিছু পিছু যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
চলবে
পরের পর্ব দিতে দেরি হবে।আশা করি
গঠনমূলক মন্তব্য করবেন,আর ভুল ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিবেন।