চাদোঁয়া মহল পর্ব -১০

#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১০
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

—–“দেখে শুনে সাবধানে গাড়ি চালাবি কিন্তু!রাস্তায় রেখার হাত ধরে রাখিস।দুপুরে আসতে দেরি হয়ে গেলে,ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিস….কেমন?”

—-“আমি দৈনিক অফিসে আসা যাওয়া করি!কই কখনো তো এমন উপদেশ দেও না?আজ এতো চিন্তা করছো যে?”

মোহিনী মির্জার কপাল কুঁচকে তাকালেন।ছেলের এসব উদভ্রান্ত কথায় তিনি বেজায় বিরক্ত। কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলেন,

—–“তোর জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে না।পরের বাড়ির মেয়েকে সাথে নিয়ে যাচ্ছিস,তার জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে!

মায়ের কথা শুনে শারাফ কিছু বললো না।ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি দেখা গেলো।জিমি সিমি এক পাশে দাঁড়িয়ে তৃণা মির্জার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। চন্দ্ররেখাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে মোহিনী মির্জা তার দিকে এগিয়ে গেলেন।বিড়বিড় বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে মাথায় ফু দিলেন!চন্দ্ররেখার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোহিনী মির্জা বেশ অবাক হয়ে গেলেন।ঠিক যেন যুবতী সুধা মির্জা!!সিল্কের সাদা পাড়ের কালো শাড়ি,মাথায় সাদা রঙের হিজাবে ভীষণ অমায়িক লাগছে।মুখে বিরাজ করছে ক্ষীণ হাসি!

উপস্থিত সকলকে বিদায় জানিয়ে চন্দ্ররেখাকে নিয়ে শারাফ তাদের গন্তব্য রওনা দিলো।গ্যারাজের সামনে এসে শারাফ ভ্রু কুঁচকালো!তাদের চারটে গাড়ি,সুধা মির্জার গাড়িটি অনুপস্থিত!সচারাচর গ্রামের বাহিরে গেলে তিনি গাড়ি ব্যবহার কর থাকেন!শারাফকে চিন্তত মনে হলো।রেখা নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

—–“কোনো সমস্যা!”

চন্দ্ররেখার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো শারাফ।রেখা সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,”মাশাল্লাহ,আমার বরের হাসি তো ভীষণ সুন্দর!”

—–“আপনি পাশে থাকলে আমি সব সমস্যার সমাধান করতে পারবো।”

শারাফ সযত্নে চন্দ্ররেখাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে শাড়ির আঁচল তার কোলে তুলে দিলো।রেখা মুগ্ধ চোখে শারাফের কার্যকলাপ অবলোকন করলো।

——–

ঝিল্লিপুরে আসলে গ্রাম বলা চলে না,কয়েকটা এলাকা নিয়ে একটা পরগনার মতো!এখান থেকে শহর পৌঁছাতে এক ঘন্টার মতো সময় লাগে।চন্দ্ররেখা ঘড়ির দিকে তাকাল… দশটা বেজে পনেরো মিনিট কেবল!তারা বাসা থেকে বেড়িয়েছে,ইতিমধ্যে আধঘন্টা হয়ে গেছে।গাড়ির বন্ধ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সে!কয়েকটা ঈগল একসাথে আকাশে উড়ছে।কালো সাদা রঙের মেঘমালারা ধীরে ধীরে ভেসে বেড়াচ্ছে!হয়ত বৃষ্টি হবে।থমথমে অম্বরের পানে চেয়ে থেকে রেখা বেশ বিতৃষ্ণা বোধ করলো।সেখান থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো।এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে শারাফ!হাতের শার্ট কনুই অবদি গোটানো।তার খাড়া খাড়া চুলগুলো স্থির হয়ে আছে!কালো রঙের শার্টে বেশ মোহনীয় লাগছে তাকে।সাথে সাদা রঙের ডেনিম জিন্স !রেখা জানে শারাফ ইচ্ছে করে তার সাথে মিলিয়ে একই রঙের শার্ট পড়েছে!শারাফ সামনে থেকে চোখ সরালো। চন্দ্ররেখার দিকে তাকিয়ে হুট করে ডান চোখে টিপ দিলো।ঘটনার আকস্মিকতায় রেখা হতভম্ব হয়ে গেলো।সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে পেরে বেশ লজ্জায় পেলো!রেখার লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে শারাফ ঠোঁট কামড়ে ফিচলে হাসি দিলো।

——–

হসপিটালের সামনে গাড়ি থেমেছে ইতিমধ্যে দশ মিনিট হয়ে গেছে।শারাফ এক নজরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে!না নিজে গাড়ি থেকে নেমেছে,আর না রেখাকে নামতে দিচ্ছে।কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে সে।রেখা গাড়িতে বসে উশখুশ করছে!দীর্ঘ দশ মিনিট পর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো শারাফ।রেখাকে গাড়ি থেকে বের করলো।প্যান্টের পকেট থেকে মাক্স বের করে পড়িয়ে দিলো!তার হাত ধরে হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করলো।কেবিনে প্রবেশ করবে এমন সময়,আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত এক মহিলা তড়িঘড়ি করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।মহিলাটির চোখ জোড়া কেবল খোলা।তার সাথে শারাফের চোখাচোখি হলো!চন্দ্ররেখা তার বাবার কেবিন থেকে একজন মহিলাকে বের হতে দেখে বেশ অবাক হলো।মহিলাটিকে তার বেশ চেনা চেনা মনে হলো!কিছু জিজ্ঞেস করবো তার পূর্বে মহিলাটি এক নার্সের সাথে ধাক্কা খেলো।নিজেকে সামলে সে এক প্রকার পালিয়ে বেরিয়ে গেলো। পিছনে থেকে নার্সটি ডেকে উঠলো,

——-“আরে আপনার পার্স তো এখানেই রয়ে গেছে। ”

ততক্ষণে মানবীটি লিফটে চড়ে গেছে, সাথে সাথে লিফটের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে।শারাফ নার্সটির দিকে এগিয়ে গেলো।কিছু বলতেই নার্স তার হাতের পার্সটি শারাফকে দিয়ে দিলো!দূর দাঁড়িয়ে রেখা শারাফের কার্যক্রম অবলোকন করছিলো।শারাফ পার্সটি হাতে নিয়ে রেখার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

——-“আপনি মহিলাটিকে চিনেন!

——“হয়ত হ্যাঁ!হয়ত বা না!

শারাফের এমন খামখেয়ালি কথায় রেখা বেশ বিরক্তবোধ করলো।মাক্সে আবৃত থাকা অবস্থায়ও শারাফ রেখার এই বিরক্তি উপলব্ধি করতে পারলো।কথার প্রসঙ্গ বদলে চেহারায় মৃদু হাসি টেনে বলল,

—-“জলদি চলুন,দেরি হয়ে যাচ্ছে!বাবাকে দেখতে যাবেন না।

শারাফের কথায় রেখার টনক নড়ল।শারাফকে রেখে সে কেবিন প্রবেশ করলো।শারাফ ডাক্তারের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল।

———

—-” হে রে!নওশিনকে তোর কেমন লাগে?”

—-“কেমন লাগবে!বোনকে তো বোনের মতোই লাগবে?”

—–“ধ্যাত, আমি সেটা বলছি না!ওকে তোর বউ করে এ বাড়ি আনলে কেমন হবে?আমার ভাইটা নিরুদ্দেশ হলো আজ আট বছর!সেই থেকে আপা নওশিনের সব দায়িত্ব পালন করছেন।আমি চাই এবার তুই ওর দায়িত্ব নিয়ে নে।”

তৃণা মির্জার কথায় বিতৃষ্ণা বোধ করলো মাসুক।মায়ের কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো।

—–“লিসেন মা!ছোট থেকে নওশিনকে আমি বোনের নজরে দেখে আসছি।তার প্রতি আমার তেমন কোনো অনুভূতি নেই!তুমি যদি আমাকে এখন বিয়ে করাতেই চাও,তাহলে আমার বউ হিসেবে সিমিকে মেনে নেও।”

বিস্ফোরিত দৃষ্টি তৃণা মির্জা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এমন কিছু হবে বহু আগেই তিনি সন্দেহ করছিলেন,তাই বলে ছেলে এতো জলদি মনের কথা জানিয়ে দিবে ভাবতে পারেন নি!ছেলেরই বা দোষ কোথায়!!তিনি তো জিজ্ঞেস করেছে। তৃণা মির্জার বুক হাসঁফাস করছে।মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই কোনো তুফান আসবে।প্রথমে শারাফের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে,তারপর এতোবছর পর তাজওয়ার চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা,চন্দ্ররেখাকে দেখে সুধা মির্জার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, এখন আবার ছেলের এই কাহিনি।আদোও কি পরিবারের কেউ বিষয়টা নরমালি নিবে! এর মধ্যে সিমি মাসুকের চেয়ে দু’বছরের বড়,যদিও সেটা কোনো বিষয় না।কিন্তু মেয়েটা তো আইএলসের জন্য কোচিং করছে।ভালো সুযোগ পেলে হয়ত দেশে বাহিরে একবারের জন্য চলে যাবে!কিভাবে কি হবে!আবার হামিদ মির্জাই বা চন্দ্ররেখার বিষয়টি কিভাবে নিবেন? রেখা তো এখনো সম্পূর্ণ বিষয়টি কিছুই জানে না,শারাফ তো তাই বললো!মেয়েটারই বা দোষ কোথায়?বাবা মায়ের কৃত কর্মের ফল তো ভোগ করছেই।তৃণা মির্জা বুক থেকে চাপা শ্বাস বের হয়ে এলো।

——

চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। শব্দবিহীন কান্না!বুকপটে নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে।বাবা কি কোনোদিনও ঠিক হবে না!এইতো কিছুদিন পর কোর্টে হেয়ারিং! এরপর সব আগের মতে হয়ে যাবে। শারাফ তো বলেছিলো,জানোয়া*রটাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিবে!বাবাকে সবাই আগের মতো সম্মান করবে।বাবা এসব কিছুই কি দেখবে না!

ডাক্তার শাখাওয়াত শামীম চন্দ্ররেখার বাবার বাল্যবন্ধু। বর্তমানে তাজওয়ার চৌধুরীর চিকিৎসাও তিনিই করছেন।কেবিন বাবার সামনে কিছু সময় বসে থেকে,বিভিন্ন দোয়া পরে ফু দিয়ে বের হয়ে ডক্টরের চেম্বারে গিয়েছিলো চন্দ্ররেখা।সেখানে যেতেই শারাফ আর ডক্টরের কথোপকথন মধ্যে কিছু কথোপকথন শুনতে পায় সে।

—-“মি.মির্জা আমি মিথ্যা কোনো আশ্বাস দিতে চাই না!রেখার স্বামী হিসেবে আপনি তার বর্তমান গার্ডিয়ান! তো আপনার কাছে কথা গুলো আমি অনায়াসে বলতে চাই!”

—-“জি বলুন ডক্টর। ”

—-“আশা করি আপনি রেখাকে বুঝাতে পারবেন।তাজওয়ারের দুটো কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে গেছে।এর মধ্যে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সব মিলিয়ে ডায়ালাইসিস করানো অসম্ভব একটি ব্যাপার।এসব রোগীদের কোমা থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই বললেই চলে।আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাবো।তারপর বলছি আপনারা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকবেন।”

—–“কিন্তু ডক্টর আর কোনো উপায় কি নেই!”

—-“আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাবো। বাকিটা আল্লাহর হাতে।”

শারাফ কিছু বলছিলো!চন্দ্ররেখার কানে কোনো কথাই প্রবেশ করলো না।ধীর পায়ে হেঁটে হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেলো।এখন গাড়ির ভিতরে নির্জীব ভাবে বসে আছে। ভাবনা শেষ হতেই খেয়াল করলো,শারাফকে সে কিছু না বলেই চলে এসেছে।

পর মূহুর্তে লক্ষ্য করলো শারাফ হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে আসছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে!গড়িয়ে গড়িয়ে কিছু ঘাম শার্টে পড়ছে।সে সব জায়গায় ভিজে যাচ্ছে।এতোটুকু সময়ে তাকে বেশ এলোমেলো লাগছে।রেখাকে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলো!তাকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।শারাফ ড্রাইভং সিটে বসে বেশ শব্দ করে দরজা লাগালো। কিছু কড়া কথা শোনাতে যাচ্ছিলো!কিন্তু রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার সে বুঝে গেল।তার আর ডক্টর সব কথা রেখা শুনে নিয়েছে।কিছুটা কাছে যেয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো।রেখা প্রতিবাদ করলো না,জড়িয়েও ধরলো না।চুপটি করে শারাফের বক্ষে মিশে রইলো,চোখ থেকে অবিরাম অশ্রুধারা বইতে লাগলো।শারাফ ফিসফিস করে বললো,

—–“আমি আছি তো!সব ঠিক করে দিব। আপনার এই নিশ্চুপ থাকা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে আমাকে।”

চন্দ্ররেখা বরাবরই নির্লিপ্ত।হয়ত নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। আদোও কি কোনো সন্তান বাবার এমন পরিস্থিতির কথা শুনে শান্ত থাকতে পারে?কিন্তু রেখাকে যে পারতেই হবে!

চলবে

গল্পটা কি ভালো লাগছে না?🥲

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here