#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১১
________________
২৫.
–“বাজার আরো বাকি আছে,তৃপ্তি?”
কন্ঠটা পরিচিত তৃপ্তির।এই কণ্ঠ খুবই নিকট হতে ব্যক্ত হয়েছে। যার দরুণ,লোকটার নিঃশ্বাস সরাসরি তৃপ্তির ঘাড়ে।হয়তো বেশ ঝুঁকেই এমন ফিসফিস করে কথাটা বলেছে মানবটা।ভরা বাজারে এহেন কান্ডে তৃপ্তি ব্যাপক অবাক।পরক্ষণে নিজের বাম দিকে লোকের উৎপাত বাড়লে,সেই মানব তার বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে আড়াল করলো তৃপ্তিকে,
–“চারিদিকে খেয়াল রাখা উচিত তোমার।”
দোকানদার তৃপ্তির এগিয়ে দেওয়া হাত থেকে টাকা নিলে সে পেছনে ফিরে।আদ্রিনকে প্রশ্ন করার পূর্বেই সে তৃপ্তির হাত চেপে ভিড়মুক্ত জায়গায় এনে দাঁড় করায়।চমকিত তৃপ্তি তাকে প্রশ্ন করে,
–“বাজার করতে এসেছেন?”
আদ্রিন বুকের উপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়।ঘামে জবজবে সে।বাবার সাথে সেই ছোট্ট বেলায় এমন বাজারে আসা হতো তার।কিন্তু,বেশ বছর অতিক্রম হলো,আদ্রিনের এমন বাজারে প্রবেশ করার।সে আলগোছে হাসলো। ঘাড়ের উপরিভাগের চুল স্পর্শ করে বললো,
–“নাহ।তোমাকে দেখতে এসেছি।”
তৃপ্তি হতবাক।ছেলেটা সেই যে ম্যাজিক,ম্যাজিশিয়ান এর কথা বলে উধাও হয়েছে,তার আজ দেখা মিললো।আর সে কিনা বলছে,আদ্রিন তাকেই দেখতে এসেছে! একখান ফোন বা মেসেজ দেয়নি লোকটা তাকে।এইসবে আবার অভ্যস্ত সে।লোকটা সদা ব্যস্ত থাকে তার কাজ নিয়ে।বাঁকা নজরে সে আদ্রিনের পানে তাকায়।তার অধরে তির্যক হাসি।আদ্রিন বেশ জানে,তৃপ্তি তার কথা বিশ্বাস করতে বেগ পাচ্ছে।
–“আমাকে দেখতে?আপনি কিভাবে জানেন আমি এইখানে আছি?”
তৃপ্তি তার ভারী বাজারের ব্যাগটা নিচে রাখতে নিলে,আদ্রিন তা ছিনিয়ে নেয়। উল্টোমুখি কদম ফেলার পাশাপাশি সে তৃপ্তিকে নরম সুরে নির্দেশ দেয়,
–“বাহিরে আসো,তৃপ।এইখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
ছেলেটা থামলো না।লম্বা কদম তার বাহিরে যাওয়ার জন্যে চঞ্চল।ভ্রু কুঁচকে তৃপ্তিও তার পিছু চললো।অতঃপর আদ্রিন তার গাড়ির সম্মুখে গিয়েই স্থগিত করলো পায়ের গতি। উচ্ছ্বাসিত তৃপ্তি পুনরায় আদ্রিনকে প্রশ্ন করলো,
–“সেদিন তো বেশ ম্যাজিক,ম্যাজিশিয়ান এর কথা বলছিলেন।সেই যে গায়েব হলেন,আজ আপনার দেখা মিললো।এছাড়াও আপনি কিভাবে জানেন,আমি বাজারে এসেছি?”
আদ্রিনের দৃষ্টি গভীর।ঘর্মাক্ত তরুণীর ঘামে ভেজা মুখশ্রী যেনো অন্যরকম আকর্ষণ। চীন দেশীয় নারীর ন্যায় চেহারা হওয়ার সুবাদে,এই র’ক্তিম আভা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে আদ্রিনের বক্ষ পিঞ্জিরায়।দুইজনের দৃষ্টি মিললে তৃপ্তি বিচলিত হয়।নজর ঘুরিয়ে শান্ত করে নিজেকে।নিছক এই অনুভূতি পিষিয়ে মা’রছে তৃপ্তির ভেতরকার সত্তায়।না এই অনুভূতি আগানোর সাহস তার আছে,না এই আদ্রিন নামক মানবকে তার সহিত দেখা না করার আবেদন করার সাহস আছে।অজানা বেড়াজালে বন্ধী তৃপ্তি।পুনরায় তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলে মায়া হয় তার আদ্রিনের প্রতি।ব্যাগ হাতড়ে টিস্যু এগিয়ে দিলে,আদ্রিন হাসিমুখে সেটা নেয়।
–“ইন্ডিয়া ছিলাম,আ’ত্মগোপনে।মায়ের একমাত্র দুর্বলতা আমি।তাই,ইলেকশনের পূর্বে আমার গোপনীয়তা মায়ের কাছে বেশ জরুরি।তবে,আমি মাকে না জানিয়েই চলে এসেছি গতকাল।রেস্ট নিয়ে সোজা তোমার কাছেই ছুটেছি।আর তুমি কিভাবে ভাবলে আমি গায়েব ছিলাম?তোমার বান্ধুবির বাসার নিচে যে সিএনজি তোমার জন্যে অপেক্ষা করতো,সেটা আমার নির্দেশনায়’ই আসতো।কিন্তু,তুমি ভেবেছো আধ বুড়ো লোকটা তোমার সেবায় নিয়োজিত!”
আদ্রিন ঘামের আস্তরণ গলা থেকে সরিয়ে টিস্যু হাতের মুঠোয় রাখলো।তৃপ্তির অবাকের অন্তিম নেই।আলেয়ার বাসায় নিচে উপস্থিত সিএনজি ড্রাইভারের আময়িক ব্যবহারে সে এক পর্যায়ে ভেবেই নিয়েছিলো সিএনজি ড্রাইভার তাকে নিজ ইচ্ছায় সুরক্ষিত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছাতে উদ্যত।কিন্তু,এইখানে কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টো।তাছাড়া,এই লোক মাকে না জানিয়ে দেশে ফিরে আবারও বিপদ বাড়াতে এসেছে!
–“আপনি আসলেই পাগল।আন্টি আপনাকে আ’ত্মগোপনে থাকতে বলেছে আর আপনি এখানে ঘুরঘুর করছেন?”
–“মধু যেখানে মাছিও সেখানে থাকবে,তাই না?”
আদ্রিন তৃপ্তির নিকট খানিক মাথা ঝুঁকালো। তিরতির অনুভূতিতে তৃপ্তি এক কদম পিছু হটলো আলগোছে।এই লোক তাকে এলোমেলো করতে উস্তাদ।
–“কি..কিসব বল..ছেন?আমি এইখানে,আপনি কিভাবে জানতেন, এটার উত্তর দিন আগে?”
এলোমেলো ভঙ্গিতে তৃপ্তির প্রশ্ন।
আদ্রিন একহাত পকেটে পুরে অপর পাশে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলো,
–“বললাম ই তো,আমি ম্যাজিশিয়ান।আমি সব জানি।”
তৃপ্তি ভ্রু নাচিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করলো।লোকটা সত্যি পাগল,উন্মাদ।
–“পাগল মশায়,আপনার ম্যাজিকের কথা বাদ দিয়ে আমার বাজারের ব্যাগ দিন।আমি বাসায় ফিরবো।”
গাড়ির বাম দিকের দরজা খুলে আদ্রিন বললো,
–“গাড়িতে উঠো।”
দরজা খোলা রেখেই বাজারের ব্যাগ গাড়ির পেছনের অংশে রেখে তৃপ্তির পানে উঁকি দিলো পুনরায়,
–“এইখানেই থাকার প্ল্যান আছে তোমার?”
–“রিক্সা নিয়ে যাবো আমি।”
তৃপ্তির স্বর ভারী।
–“এতদিন পর দেখা আমাদের।জিদ করো না।আমার জিদ ঠেলার শক্তি করো আগে,এরপর জিদ করবে।”
আদ্রিন ভেতরে বসে পড়লে,তৃপ্তিও বসলো।ছেলেটা কিভাবে তার দিকে তাকিয়ে।যেনো এখনই চিবিয়ে খাবে।তাই তৃপ্তি আর দিরুক্তি করলো না।
–“আন্টি বকেনি আপনাকে?”
তৃপ্তির প্রশ্ন।
–“কেনো?”
আদ্রিনের দৃষ্টি সম্মুখে।
–“না বলে এসেছেন দেশে,তাই?”
–“আমি আমার ফার্ম হাউজে উঠেছি। আম্মি এখন ভীষণ ব্যস্ত।ইলেকশন পিছিয়েছে তাই আম্মির মাথা নষ্ট।এছাড়া আমি বেশ সিক্রেটলি থাকছি।ফার্ম হাউজে যারা আছে,ওরা সবাই আমার লোক।আমার খবর বাহিরে প্রকাশ করবে না।যাদের থেকে ছুটে এসেছি তারাও আমার লোক।অথচ আম্মি জানেই না। আম্মিকে আমি জাস্ট শান্তনা দিয়ে রাখছি আর কিছুই নয়।”
আদ্রিনের কথার পিঠে তৃপ্তি জবাব দিলো,
–“বুঝেছি।”
–“সবই বুঝো,শুধু আমাকে ছাড়া।”
মিনমিনে সুরে বললো আদ্রিন।
–“জ্বী?”
তৃপ্তি হতবম্বল।
–“কিছুনা।”
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে সময় কাটলো।তৃপ্তিই এইবার মুখ খুললো প্রথমে,
–“আমাদের বাসায় আসুন একদিন।অনেক ঋণী যে আমি আপনার প্রতি।”
–“সম্পর্ক ছাড়া তোমার বাড়িতে যাওয়াটা আমার জন্যে কষ্টের।জাস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে যেতে পারবো না।বাদ বাকি তুমি জানো,কিভাবে আমার ঋণ শোধ করবে।”
আদ্রিনের কণ্ঠে তেজী ভাব।
–“ফ্রেন্ড কি কোনো সম্পর্কে পড়ে না?”
তৃপ্তি মুখ কুঁচকালো।
–“চুপ থাকো মেহেবুবা।আমার না,কেমন যেনো মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
নীরব হু’মকিতে চুপ করলো তৃপ্তি।এই লোকের সমস্যা কি?নিজেই এতক্ষণ হাসি ঠাট্টা করছিল,আর নিজেই এখন ক্ষেপলো।তৃপ্তি নিজের কোলে অবস্থিত ব্যাগ খাঁমচে বসে।
পাশে আদ্রিন ফুঁসছে।এই মেয়ে সব বুঝে,তবে আদ্রিনের মন বুঝে না কেনো?
গাড়ি হতে তৃপ্তি নামলে আদ্রিন থমথমে কণ্ঠে আওড়ালো,
–“আমার ঋণ শোধ করবে,মেহেবুবা।নাহলে,ভবিষ্যতে আমার ঋণের ভারে খুঁজেই পাবে না তুমি নিজেকে।আর আমি দেখতে চাই,ঋণ শোধের জন্যে কি করতে পারো তুমি।”
বাজারের ভারী ব্যাগ দারোয়ান এসে নিয়ে যাচ্ছে উপরে।তৃপ্তি গাড়ির জানালার ধারে মুখ টেনে বললো,
–“কিভাবে শোধ করবো?আপনি ট্রিট নিচ্ছেন না,বাসায় দাওয়াত নিচ্ছেন না,টাকা তো নিবেন’ই না।তাহলে?”
–“তুমি জানো কিভাবে!তবে আমি অপেক্ষায় রইলাম তাসরিয়া জামান তৃপ্তির ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা দেখার।আলবিদা,মেহেবুবা।”
তৃপ্তির জবাবের অপেক্ষা না করেই আদ্রিন ছুটলো।মিররে এখনো তৃপ্তির অবয়ব বিদ্যমান।মেয়েটা বড্ড চমকিত।
অন্যদিকে আদ্রিনের ঋণ শোধের পরিকল্পনায় জর্জরিত তৃপ্তি।তার তুখোড় বুদ্ধি আজ যেনো কোথায় লোপ পেলো।
২৬.
সন্ধ্যায় আজ তৃপ্তির কাজ নেই। প্রিয়কে নিয়ে তাই সে হাঁটতে বেরিয়েছে।পিছে চামেলী।প্রিয় তৃপ্তির হাত চেপে পাশাপাশি কদম ফেলছে সযত্নে।আবাসিক এলাকায় সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার।অনেক মানুষই সন্ধ্যার সময় হাঁটতে বেরই।বাচ্চাদের জন্যে একটা ক্লাব আছে এইখানে।রেজিস্ট্রি করলে বাচ্চারা সন্ধ্যায় এই ক্লাবে নিজেদের ইচ্ছামতো গ্যাজেট ব্যাবহার করে খেলতে পারে।চামেলী প্রিয়কে এইখানে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে অনেক পূর্বেই।তবে খুব কম আসা হয় তাদের।প্রিয়র পড়ার চাপ প্রচুর।আজ পড়া থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে তাই প্রিয়র বায়না এই ক্লাবে ঢুকবে।তৃপ্তি আর চামেলী দ্বিমত করলো না।প্রিয়কে নিয়ে সেথায় যায়।প্রিয় ব্যস্ত খেলায় মেতে উঠতে।চামেলী গার্জিয়ান সেকশনে চলে যায়।তৃপ্তি মোবাইল হাতে বেরিয়ে যায় প্লে গ্রাউন্ডে।সেথায় উপস্থিত বেঞ্চিতে নিজের অবস্থান জারি করে।ঝিরঝির পবনে পরিবেশ শান্ত,শীতল।তৃপ্তি চুলের খোঁপা খুলে দেয়।কৃষ্ণ-সোনালী বর্ণের কেশ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।মৃদু পবনে সেই কেশ দুলোয়মান।
–“তৃপ্তি মিস!”
কণ্ঠ শুনে নজর উপরে তুলতেই দেখলো সাফা দাঁড়িয়ে।তার পাশে একজন অচেনা পুরুষ।তৃপ্তি আদুরে ভঙ্গিতে গাল ছোঁয়ালো সাফার,
–“কি খবর সাফা? কার সাথে এসেছো?”
–“আমার চাচ্চু।”
সাফা হাসলো।
পরপর পুরুষালি কণ্ঠ ভেদ করলো তৃপ্তির কর্ণে,
–“হ্যালো,আমি রাজনীতিবিদ শাকিল।”
–“হ্যালো।”
তৃপ্তি মৃদু হাসলো।এতদিন যাবত তৃপ্তি সাফাকে ড্রইং করায়,কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো তার বাবা বা চাচ্চু কাউকে দেখলো না।তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকে।
–“সাফা তুমি ভেতরে যাও।আমি এইখানেই আছি।ছুটির পর ঠিক এইখানে আসবে।”
–“ওকে।বাই মিস,বাই চাচ্চু।”
সাফা হাত নাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
তৃপ্তি একটু গুমোট।শাকিল ছেলেটা তার বেঞ্চের অন্য কিনারায় বসেছে।টুকটাক কথাও চালাচ্ছে। যা তৃপ্তির পছন্দ হচ্ছে না।অবশেষে তার মোবাইল বেজে উঠলো।স্ক্রিনে আদ্রিনের নাম ভাসছে।তৃপ্তি “এক্সকিউজ মি” বলে কে’টে পড়লো সেই স্থান হতে।দূর হতে শাকিল তার পানেই চেয়ে।তবে তৃপ্তি বেখবর।দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই এক স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা।
–“কি হয়েছে?ঘন নিঃশ্বাস কেনো?”
আদ্রিন প্রশ্ন করলো।
–“কিছুনা।এতো প্রশ্ন করেন কেনো সবসময়?”
–“কেনো?বিরক্ত হও?”
আদ্রিন চেয়ারে গা এলিয়ে প্রশ্ন করলো।মিটিং শেষে এই মেয়েটার কণ্ঠ শুনতে মনটা কেমন হাহাকার করছিলো তার।তাই তো সকল ক্লান্তি একপাশে রেখে ফোন করলো মেয়েটাকে।
–“সবসময় এমন জটিল কথা।আপনি এমন প্যাচাল কেনো?”
মুখ টিপে হাসে তৃপ্তি।লোকটাকে আজ সে বড্ড জ্বা’লাবে।
–“আমি মধুর কথা বললে,তোমার গাল দেখতে চেরির মতো লাগবে।কিন্তু,এখন বলে লাভ কি?আমি তোমায় সামনে নেই যে,তোমার লাজুক রূপ উপভোগ করবো!”
তৃপ্তি চুপ।লোকটাকে জ্বা’লানোর পূর্বে লোকটা নিজেই তো তৃপ্তির গায়ে আগুন ধরালো যেনো।গালজোড়া উষ্ণ,নাকে বিন্দু ঘাম তার।লজ্জা পাচ্ছে সে।
ওড়না সমেত ঘামটুকু মুছলো তৃপ্তি,
–“আমি রাখছি।কিসব বাজে কথাবার্তা।”
তৃপ্তি ফোন রাখলো।তার মুখশ্রী লাজুক,আবেদনময়ী।কেবল আদ্রিনের কারণেই তার এমন লাজুক রূপের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।
আজ শাকিল নামের ছেলেটাও তৃপ্তির এমন লাজুক মুখটা উপভোগ করলো বিনা অনুমতিতে।আদ্রিন যদি এই মুহূর্তে এইখানে উপস্থিত থাকতো,তাহলে তৃপ্তির দিকে নজর দেওয়ার কারণে তার আঁখি দুটো কি স্বাভাবিক থাকতো?
.
–“ভাবী,আদ্রিনের জন্যে পাত্রীর খোঁজ চালাচ্ছি আমি।আপনি ঐ মেয়েটার ভূত ছেলেটার মাথা থেকে নামাবেন কবে?”
মিনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো ইনায়াকে।ইনায়া পত্রিকা হতে নজর তুললো,
–“ইলেকশনের ঝামেলার মাঝে আমি নতুন কোনো ঝামেলা চাচ্ছি না।আর ঐসব থার্ড ক্লাস মেয়ের ভূত আমি নামাবো?আমার ছেলের জিদ কমলে,মেয়েটাকে সে আপনাপনি ভুলে যাবে।এছাড়া তুমি কি জানো,খুব জলদি মেয়েটা দূর হবে আমার আদ্রিনের জীবন থেকে?”
মিনা হচকালো,
–“কিভাবে দূর হবে?”
–“রিয়ানার দেবর পছন্দ করেছে তৃপ্তিকে। সম্ভবত কয়েকদিনের মাঝে প্রস্তাব পাঠাবে..”
ইনায়া সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার পূর্বে আদ্রিনের গর্জন শোনা গেলো,
–“কি?আরেকবার বলো!”
আদ্রিন কাল রাতেই বাড়ি ফিরেছিলো ফার্ম হাউজ হতে।অথচ ইনায়া এর কিছুই জানেনা।রাগী চোখে সে মিনার দিকে তাকালে আদ্রিন তার মায়ের সামনে এসে টেবিলে আঘাত করলো হাত দ্বারা,
–“কি বলেছো আবার বলো, আম্মি।”
–“রিয়ানার দেবর তৃপ্তিকে বিয়ে করতে চায়।”
মিনা হুট করে বললো।পরপর সে নিজের মুখে হাত রাখলো অনুতপ্ত হয়ে।
–“তোমার মেয়েকে বলো নি?তৃপ্তি মেয়েটা শুধু আমার জন্যেই লিখা আছে?তোমার মেয়ে জানেনা,আমি ঠিক কতটা চাই তৃপ্তিকে?তাহলে,তোমার মেয়ে কিভাবে এই কাজটা করলো?হাউ?”
আদ্রিন নিজের সামনে রাখা কাপ ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে।ঝনঝন শব্দে ঘরের বাকী মানুষ খাবারের রুমে উপস্থিত হলো।রাফি বিচলিত কণ্ঠে বলল,
–“হুয়াট হ্যাপেন্ড ভাই?”
–“কল রিয়ানা।”
আদ্রিনের আঁখি রক্তিম।তার মোবাইল রুমে।সকালের নাস্তা করতে এসেই এহেন কান্ডের শিকার হবে তা সে ভাবেনি কস্মিককালে।
রাফি দ্রুত কল লাগলো বোনকে।
–“রিংগিং।”
ঝাপটে নিলো আদ্রিন রাফির মুঠোফোন।
–“আদ্রিন!বিহেভ ইউর্সেলফ।কিসব পাগলামি করছো?”
ইনায়া খেঁকিয়ে উঠলে বাঁকা হাসে আদ্রিন,
–“পাগলামি শুধু মেয়েটার জন্যেই দেখাচ্ছি না।একবার সে আমার কথায় রাজি হউক, আই স্যয়ার;আমার পাগলামি দেখে আফসোস করবে তুমি, আম্মি।”
–“হ্যাঁ রাফি বল।”
রিয়ানার কথার পিঠে চেচিয়ে উঠলো আদ্রিন,
–“তোমার দেবরকে বলো তৃপ্তির উপর হতে নজর সরাতে।তুমি কি জানো না কিছু?নাকি জেনেও মায়ের সাথে তাল মেলাচ্ছো?তৃপ্তি শুধু আমার।আই লাভ হার।নো মোর ওয়ার্ডস।শাকিল বাড়াবাড়ি করলে আমি কি করবো ভালো জানো আপু। ডোন্ট ফোর্স মি টু বি আ বিস্ট।”(আমাকে পশু হতে বাধ্য করো না।)
রাফির হাতে ফোন ধরিয়ে আদ্রিন নিজ কক্ষে ফিরলো।
রিয়ানা অবাক।সে এই প্রস্তাবে রাজি নয়। শাকিলকেও জানিয়েছে,আদ্রিনের অনুভূতি।মাকে কেবল বলেছিল শাকিল ছেলেটা পছন্দ করে তৃপ্তিকে।এইসব অসম্ভব, এটাও সে মাকে জানিয়েছে।আদ্রিনের অনুভূতি তৃপ্তির প্রতি কেমন,সেটা রিয়ানা বেশ জানে।তবে,মা কেনো বাড়তি কথা বলে অযথা ছোট করলো তাকে তার ভাইয়ের সামনে?ভাই কি তার সাথে আর কথা বলবে না?আঁখি ভার হয় রিয়ানার।ভাইকে মানানোর জন্যে যা করতে হয় সবটা করবে সে।তার রাগ ভাঙানো পাহাড় কা’টার সমান।ভাবুক রিয়ানা আঁচলে চোখ পুছে।
আদ্রিন রেগে।ফটাফট তৈরি হলো সে।পরক্ষণে দ্রুত ছুটলো অফিসে।মিনিট বিশেকে সকল কাজ তন্ময়কে বুঝিয়ে সে বেরিয়ে এলো অফিস হতে।ফোন লাগালো তৃপ্তিকে।ফোন রিসিভ হতেই আদ্রিন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের ন্যায় তাকে প্রশ্ন করলো,
–“দেখা করবে, রাইট নাও।”
–“ভার্সিটি যাচ্ছি।আমি রিক্সায়।”
তৃপ্তি এক কানে হাত চেপে বললো।প্রচুর ট্র্যাফিক রাস্তায়।
–“আই ওয়ানা সি ইউ,শেষ কথা এটা আমার।ভার্সিটিতে কাহিনী হোক,এটা চাও?”
–“কি হয়েছে আপনার?”
–“যেখানে আছো রিক্সা হতে নামো।আমি আসছি।”
তৃপ্তি ঠিকানা বলতে দেরী করলো না।এই লোকের কণ্ঠে আজ অস্থিরতা।কি হয়েছে এটা না জানা অব্দি তৃপ্তির নিজেরই শান্তি মিলবে না।লোকটার জন্যে তার পিছুটান এবং বর্তমান দুইটাই বেশ তুখোড় হচ্ছে দিনদিন।
আদ্রিনের অবস্থা বিদ্ধস্ত।চোখে তার বেজায় রাগ।কেমন যেনো হিংস্র।তৃপ্তি তার সাথেই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে।আদ্রিন তাকে নিয়ে বেশ দূরেই এসেছে।এইদিকে মানুষের তেমন দেখা নেই। আড় চোখে লোকটার দিকে তাকালে মেয়েটা অন্য অনুভূতিতে ডুবে যায়। ছাই রঙের ঢোলা টিশার্ট বাতাসে তার শরীরে লেপ্টে আছে।অস্থির ফোলাভাব দৃশ্যমান। খরশান গালে খোঁচা দাড়ি।চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।জেলে সেট করা নেই আজ তারা।হাত দুটি পকেটে গুঁজে ।কিয়ৎ সময় খামোশ থেকে তৃপ্তি বললো,
–“কিছু বলবেন?এইখানে দাঁড়িয়ে আছি কেনো আমরা?”
আদ্রিন ফিরলো তৃপ্তির পানে।সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,
–“শাকিলকে চিনো?”
তৃপ্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
–“জ্বী?”
আদ্রিন তৃপ্তির বাহু ধরে টানলো,কাছে আসলো তার মেহেবুবা।হুট করেই তৃপ্তির মাথার উপরিভাগে নিজের অধরের ছোঁয়া দিয়ে আদ্রিন আদেশের সুরে বললো,
–“শাকিল নামের ছেলেটার সাথে কখনো কথা বলবে না।ছেলেটা বেয়া’দপ।”
#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১২.
______________
২৭.
–“শাকিল!কেনো,উনার সাথে কথা বললে কি হবে?”
তৃপ্তির নজর সন্দিহান।সাথে হঠাৎই আদ্রিনের উষ্ণ ছোঁয়ায় মেয়েটা আরো নুইয়ে পড়েছে।এই মুহূর্তে তেজী গলায় কথা বলাটা শ্রেয় ভাবছে তৃপ্তি।নাহলে,নিজের ভালো লাগার অনুভূতি হুট করেই প্রকাশিত হবে।যেটা সে এখনকার জন্যে মানতে নারাজ।তৃপ্তি কিছুটা দূরে সরতে চাইলে তার বাহু ছেড়ে দিলো আদ্রিন।সম্মুখে অবস্থিত বট গাছের পানে চেয়ে আদ্রিন তাকে প্রশ্ন করলো,
–“তার মানে তুমি চিনো সেই বেয়াদপ’কে?”
আদ্রিনের স্বর গুমোট।
তৃপ্তির বাঁকা দৃষ্টি আদ্রিনের অবয়বে নিবদ্ধ।ছেলেটা আজ কেমন থমথমে।ঠিক যেনো ঝড় আসার পূর্বের পরিবেশের লাহান।শাকিল এবং তার সাথে কথা বলাটা নিয়ে কি এমন হলো বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে তৃপ্তির।সে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হলো আদ্রিনের দিকে। মানবটার দৃষ্টি এখনো স্থির।কিছু একটা ভাবছে সে।
–“উনার সাথে কথা বলা বা না বলা নিয়ে কি সমস্যা!হয়েছে টা কি বলবেন?”
এক হাত চুলের মাঝ বরাবর চালিয়ে অবাধ্য চুলগুলোকে ঠিক করলো আদ্রিন।তৃপ্তির বাক্যে শাকিলকে “উনার” উচ্চারণ করাটা আদ্রিনের ভেতরকার রাগকে এইবার সামনে এনেই ফেললো।সজোরে গাড়ির উপরিভাগে আঘাত করে গর্জন করে উঠে আদ্রিন,
–“হুয়াট উনি?তোমার ‘উনি,উনার’ সব আমি। ডোন্ট কল হিম,উনার।জাস্ট কল হিম,আ বাস্টার্ড।”(তাকে উনি,উনার ডাকবে না।তাকে কেবল জারজ/বেজম্মা ডাকবে।)
আদ্রিনের গর্জনে হকচকিয়ে উঠলো তৃপ্তি।যেভাবে সে এগিয়ে এসেছিল,ঠিক একইভাবে পিছু হটলো রমণী।সে ভীত।
–“এখন বলো,ছেলেটাকে কিভাবে চিনো?”
পরপর প্রশ্নে আদ্রিন আবারও তৃপ্তিকে আদেশ দিলো,
–“আমি জানি তুমি মিথ্যা বলার মেয়ে নও।”
তৃপ্তি হতবাক।এই শাকিলের জন্যে আদ্রিন এতো উতলা কেনো হচ্ছে?তাছাড়াও আদ্রিনের কণ্ঠে আক্রোশ স্পষ্ট।প্রথমে আদ্রিনকে কিঞ্চিৎ বিরক্ত করবে বলে চিন্তা করলেও তার শেষ বাক্য শুনে তৃপ্তি আর কাহিনী রটালো না। ওড়নার এক পাল্লা আঙ্গুলে প্যাঁচানো অবস্থায় তৃপ্তি জবাব দিলো,
–“প্রিয়কে নিয়ে সোসাইটির ক্লাবে গিয়েছিলাম।সেখানেই দেখা হয় শাকিলের সাথে।আমার তো নামটাও মনে ছিলো না,আর না তার সাথে রিলেটেড কোনো কথা।দেখায় হয়নি আমাদের আর।জাস্ট হাই, হ্যালো হয়েছিল তাও পাঁচ মিনিটের জন্যে।এরপর কিছুই না।উনাকে আমি সেদিন প্রথম দেখেছিলাম আর শেষ।”
আদ্রিন ফিরে তাকায় তার সত্তায়।মেয়েটা এক দমে কথা শেষ করেছে।এখন কেমন গম্ভীর শ্বাস ফেলছে।শিহরণ জাগে আদ্রিনের অন্তরে।সাথে রাগও। এতো সময় ধরে সে তৃপ্তির পিছে ঘুরছে,তাকে নিজের মতো মানিয়ে আসার সময় দিচ্ছে।সেখানে কিনা একদিনের দেখায় কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে শাকিল?নিজের রাগকে দমন করলো সে।হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ।তৃপ্তির প্রতি তার আরো যত্নশীল হতে হবে।নাহলে মেয়েটার পাথর মন অতি দ্রুত গলবে কিভাবে?আর সেই মন না গলা অব্দি শান্তি হবে না আদ্রিনের।মেয়েটাকে যে তার চায়।সারাজীবনের জন্যে চায়।
–“বুঝেছি।রাগ করেছো?”
আদ্রিনের কণ্ঠে এখন আক্রোশ নেই।কেমন শান্ত সেই সুর।তৃপ্তির সুপ্ত মনে লজ্জার আভা।এতো আবেগ মাখা কন্ঠে কোনো পুরুষ তাকে প্রশ্ন করেনি কস্মিককালে।তৃপ্তি এমন সুযোগ দেয়নি কাউকে।
–“আমি ঠিক আছি।আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে,
আপনার রাগ কমেছে।আমার না।”
তৃপ্তি মুখে হাত রেখে হাসলো।
তার হাসিতে আদ্রিনের অধর প্রসারিত।সে দাঁড়ালো তৃপ্তির সম্মুখে।মেয়েটা তার চেয়ে উচ্চতায় বেশ বেটে। আজ কি সে উচুঁ জুতো পড়েনি?
আদ্রিনের উপস্থিতির টের পেয়ে মাথা সোজা করলো তৃপ্তি।আদ্রিনের বুকের দিকটা তার দৃষ্টিতে দৃশ্যমান।নিজের মাথার উচ্চতা বৃদ্ধি করলো।আদ্রিন তার পানে তাকিয়ে।স্থির তার দৃষ্টি।পবনের বেহিসাবি ঝাপটায় এলোমেলো হয় তৃপ্তির চুল।তার এহেন এলো চুলের খেলা বড্ড মনে ধরলো আদ্রিনের।নিজ হাতেই তৃপ্তির মুখের উপর ঝাপটে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো আদ্রিন।লাজুকতা হানা দিলো তৃপ্তির মুখশ্রীতে।সে দ্বিধা কে’টে বললো,
–“সকল প্রশ্ন শেষ?যেতে পারি এইবার?অফিস নেই?”
–“ছিলো।ক্যান্সেল করেছি।সব কাজ তন্ময় সামলাবে।”
আদ্রিন কথা শেষে সম্মুখে কদম ফেলে হাঁটছে।তার হাঁটা যেনো তৃপ্তিকে নির্দেশ দিলো,”আমার সাথে আসো।” তৃপ্তিও আদ্রিনের না বলা নির্দেশনা বুঝে তার পিছু হাঁটছে।পাশাপাশি পৌঁছালে সে আদ্রিনকে প্রশ্ন করলো,
–“আমার ভার্সিটি আছে।আমি যায়?”
–“তোমার জন্যে কাজকর্ম থেকে ছুটি নিয়েছি,আর তুমি যাবে যাবে করছো?এই পৃথিবী আসলেই নির্দয়। যার পুড়ে তাকে আরো পোড়ায়।”
আদ্রিনের কথা শেষে তৃপ্তির তার জবাব দেওয়ার পূর্বে হুট করেই আদ্রিন তৃপ্তির হাত চেপে ধরলো।তৃপ্তির পা ততক্ষণে গর্তের ভেতরে প্রবেশ করলো বেখেয়ালিতে।হঠাৎই পা বেঁকে গেলেও তৃপ্তি পড়লো না আদ্রিন তার হাত ধরে রাখায়।উল্টো তৃপ্তি নিজেকে বাঁচাতে আদ্রিনের বাহু খাঁমচে ধরলো।
–“আরে আস্তে।পড়ে যাবে,বাবা।”
–“থ্যাংকস। আপনি না থাকলে আমি এতক্ষণে চিৎপটাং হতাম।”
তৃপ্তি হাসলো।
–“সাবধানে চলবে,মেহেবুবা।”
–“চলি।আপনি থাকলেই কেবল অন্যমনস্ক হয়ে যায়।”
–“কেনো?”
আদ্রিন প্রশ্ন করলো।পাশাপাশি হাঁটছে তারা।আদ্রিন এখনো তৃপ্তির হাত চেপে।যদিও তৃপ্তি ছাড়াতে চেয়েছে তবে আদ্রিন এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই বুঝেনি।
–“কিজানি!”
তৃপ্তি আচমকা লজ্জায় চুপ করলো।প্রথমে সে ভেবেছিল জোর করে ভার্সিটি ফিরে যাবে।কিন্তু তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে কই?এইযে আদ্রিন শান্ত,
নিরিবিলি পরিবেশে তার হাত ধরে পাশে হাঁটছে।সুন্দর এই পরিবেশে মনের পিছুটানকে ছেড়ে বেহায়া মন বড্ড লোভী হচ্ছে।তাই ফিরে যাওয়ার বায়না করলো না সে।হোক না মনটা কিঞ্চিৎ বেহায়া,তৃপ্তিও তো মানুষ।অনুভূতি বরাবরের মতো বিশাল পাথরের কাছেও হেরে যায়।তৃপ্তির ক্ষেত্রও কি তা?নাকি তার ব্যথিত হৃদয় মায়ের সাথে ঘটা ঘটনার কারণে এই অনুভূতিকে কখনোই প্রকাশ করবে না?
২৮.
ঝুম বৃষ্টিতে পরিবেশ মুখর।সাফাকে ড্রইং করানোর পাশাপাশি তৃপ্তি বাইরে তাকিয়ে।জানালা ভিজে একাকার।তীব্র বর্ষণের শব্দ জানালার কাঁচে আছড়ে পড়ছে।রিয়ানা আজ এই রুমেই আছে।অযথা এটা সেটা নাড়াচাড়া করছে বা এটা সেটা গোছাচ্ছে।তৃপ্তি সেদিক মাথা ঘামালো না।তার বাড়ি তার ঘর,তার যা ইচ্ছা তাই করা জায়েজ আছে।তৃপ্তি ড্রইং করানোয় মন দিলো।তবে,আজ তার মন চঞ্চল।বৃষ্টি তৃপ্তির কাছে সর্বদা একই লেগেছে।কখনো মনে চাঞ্চল্যতা অনুভব হয়নি।কিন্তু,তার আজ ব্যতিক্রম লাগছে।বেহায়া মন বারংবার স্মরণ করছে আদ্রিনের কথা।বৃষ্টি কি এমন পদার্থ যা মনের অজান্তে লুকিয়ে থাকা প্রিয় মানুষের কথা স্মরণ করায়!তৃপ্তি পলক ঝাপটায়।তীব্র অস্থিরতা তার মনের গহীনে।
সাফা তার ড্রইং শেষ করে বিদায় জানিয়েছে তৃপ্তিকে।অথচ,তৃপ্তির সেদিক খেয়ালেই নেই।তার মন ডুবে আছে আদ্রিনের কল্পনাতীত চেহারায়।ছেলেটা ভীষণ আকর্ষণীয়।তার বাঁকা হাসিটা রহস্যময়,কিন্তু ভয়ংকর সুন্দর।না হাসলেও ছেলেটার ধারালো চেহারার গঠনে, নেশাক্ত চাহনিতে বুকটা ভার হয় তৃপ্তির।
–“তৃপ্তি?”
রিয়ানার ডাকে নিজ ঘোর হতে ফিরলো তৃপ্তি।সাফাকে দেখতে না পেয়ে সে অস্থির কণ্ঠে বলল,
–“জ্বী আপু!সাফা কোথায়?”
–“তোমার ছাত্রী ড্রইং শেষে তোমাকে বিদায় জানিয়েই চলে গেলো।তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
তৃপ্তি হচকালো।সে চিন্তিত ঠিকই, রিয়ানারই ভাইয়ের জন্যে।আলতো হেসে তৃপ্তি মাথা নাড়ায়,
–“নাহ।আমি ঠিক আছি।আসলে ঘুম পাচ্ছিলো তাই খেয়াল করিনি।”
–“সমস্যা নেই।বৃষ্টি দিনে সবারই বেশি ঘুম পায়।”
রিয়ানা সাফার চেয়ারে বসলো।
তৃপ্তি বিদায় জানিয়ে উঠতে নিলে রিয়ানা থামায় তাকে,
–“শুনো!”
তৃপ্তির গতি স্থগিত।পুনরায় চেয়ারে বসে আওড়ায়,
–“জ্বী আপু।”
–“আমার সাথে যাবে আদ্রিনের কাছে?আমার ভাই বড্ড রাগ করেছে আমার সাথে।তুমি ওকে একটু বলবে, আমার সাথে দেখা করতে!আমার ফোনটাও তুলছে না সে।”
আকুতি করলো রিয়ানা।
–“অবশ্যই আপু।”
তৃপ্তি ফোন বের করলে রিয়ানা আবারও বলে,
–“তুমিও সাথে থাকবে আমার।”
–“আমি?”
তৃপ্তি প্রশ্ন করলো।
–“হ্যাঁ।তুমি ছাড়া আমি এই ছেলের রাগ ভাঙ্গাতে পারবো না।”
তৃপ্তি কারণটা বুঝলো না।তাও সে মাথা নাড়িয়ে বিনা প্রশ্নে উত্তর দিলো,
–“আচ্ছা।সমস্যা নেই।”
তৃপ্তি আদ্রিনকে ফোন করলে প্রথম দু’বারে আদ্রিন ফোন তুললো না।তৃপ্তির মুখের অবস্থা আন্দাজ করে রিয়ানা বললো,
–“হয়তো বিজি।একটা কাহিনী হয়েছে।মা আমার ভাইকে কিসব বলেছে।আর এইসবের জন্যে ভাই আমাকে ভুল বুঝে আর কথায় বলছে না।একটামাত্র ভাই,এইসব করলে বলো ভালো লাগে?”
তার জবাবে তৃপ্তি কথা চালিয়ে যাচ্ছে রিয়ানার সাথে।সত্যিই তো,ভাই বোন যতোই দোষ করুক বা মারামারি/ ঝগড়া করুক,কথা বন্ধ করলে বড্ড অস্বস্তি হয়।তার আর রূপমের সম্পর্কটাও যে এমন!
তাদের কথায় মাঝেই আদ্রিনের ফোন এলো।
–“হুঁ,বলো মেহেবুবা।”
–“ফ্রি আছেন?”
–“আধ ঘন্টা বাদে ফ্রি।তুমি ঠিক আছো?”
আদ্রিন চিন্তিত।
–“হুম।একটু দেখা করতে চাইছি।”
–“আচ্ছা। কোথায় আছো?পিক করবো আমি।”
–“নাহ।আমি আসতে পারবো।আপনার অফিসের পাশের রেস্তোরা ‘ফুড ইজ হ্যাপিনেস’ এ দেখা হচ্ছে তাহলে।”
তৃপ্তি সংক্ষিপ্ত পরিসরে কথা শেষ করলো।পরক্ষণে রিয়ানা তৈরি হলে,সাফা সমেত তারা বেরুলো রেস্তোরার উদ্দেশ্যে।
যথা সময়ে আদ্রিন এলো।রিয়ানাকে দেখে সে ভরকে গেলেও,তৃপ্তি তাকে থামার ইঙ্গিত দিলো ইশারায়। এতেই শান্ত হলো আদ্রিন।সাফাকে নিজের সাথে দাঁড় করিয়ে রিয়ানা এবং আদ্রিনের উদ্দেশ্যে তৃপ্তি বললো,
–“আমরা কিড জোনে আছি।”
অতঃপর রেস্তোরার অভ্যন্তরে অবস্থিত কিড জোনে গেলো তৃপ্তি।উদ্দেশ্য,ভাই বোন নিজের খুনসুটি মিটিয়ে নিক!
–“আদ্রিন,তুই না জেনেই বোনের উপরে রাগ করেছিস।”
রিয়ানা বললো।
আদ্রিন চেয়ারে গা এলিয়ে বসলো।নির্লিপ্ত তার ভঙ্গিমা,
–“জেনেই রাগ করেছি।”
–“বোন কিছু বুঝে না?আমি জানি তুই তৃপ্তিকে পছন্দ করিস।আমি কেনো শাকিলের তৃপ্তিকে পছন্দ, এইসব নিয়ে কথা বাড়াবো?সেদিনই সব চ্যাপ্টার ক্লোজ করেছি আমি।মা একটু বেশি করে,বুঝিস না?”
–“মানে?”
আদ্রিন অবাক হয়।
–“আমি শাকিলকে বলেছি,আমার ভাইয়ের পছন্দ তৃপ্তি। এতেই শাকিল চুপ করে গেলো। ও তো বাচ্চা নয় যে,তোর এতদিনের ভালো লাগার মাঝে বাম হাত ঢুকাবে!”
রিয়ানা স্বস্থি পেলো সব কথা বলে।
–“তৃপ্তি আমার পছন্দ নয়,ভালোবাসা।”
আদ্রিন সোজা হয়ে বসলো।
–“সে জানে?”
–“না জানলে সরাসরি বলবো।ওকে শুধু সময় দিচ্ছি কিছুদিন।সবকিছু জোর দিয়ে হয় না আপু।আমার জন্যে ওর মনে মায়া আছে আমি জানি।মায়া থেকেই তো লাভের সৃষ্টি হয়।মায়া হয়েছে,ভালোবাসাও হবে।না হয়ে উপায় নেই।প্রথম ভালোবাসা আমার ও,যেতে দিবো না কোথাও।”
আদ্রিন পিছে তাকায়।তৃপ্তি এবং সাফা খেলতে ব্যস্ত।অসাবধানতায় সরে যাওয়া ওড়না বারবার ঠিক করছে তৃপ্তি।বিরক্তবোধ হয় আদ্রিনের।কম মানুষ নেই এইখানে,কিড জোনে আরো বেশি।
–“খাবার অর্ডার করো,আপু।আমি আসছি।”
পকেটে মোবাইল পুরে আদ্রিন কিড জোনের দিকে যাচ্ছে।
তৃপ্তির খবর নেই।সে বেখেয়ালি এবং খেলায় মত্ত।সাফা আর সে বর্তমানে ছোট আকারের রঙিন বলের সমাহারে ডুবে।খিলখিলিয়ে হেসে উঠা তৃপ্তির অবয়ব ঘায়ে’ল করছে অব্যক্ত প্রিয়তমের অন্তর।ছেলেটা হাত বাড়িয়ে সাফাকে টেনে তুললো। অপর হাত বাড়িয়ে তৃপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,
–“বেখেয়ালি মেয়ে।”
তৃপ্তি আদ্রিনের হাত আঁকড়ে উঠে পড়লো।পেটে তার খিল ধরে আছে,তীব্র হাসির দরুণ।খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে সে আদ্রিনকে প্রশ্ন করলো,
–“কি করেছি আমি?”
–“এলোমেলো করেছো আমাকে।”
আদ্রিনের স্বর গম্ভীর।
–“জ্বী?”
তৃপ্তি চমকালো।
–“বাচ্চাদের মতো খেলায় মেতে ছিলে,আশে পাশে খেয়াল ছিলো তোমার?”
–“কেনো?কি হয়েছে?”
–“কিছুনা।”
আদ্রিনের কন্ঠ এখনো গম্ভীর।তৃপ্তি ভেংচি কে’টে মিনমিনে সুরে বলল,
–“পাগল একটা।”
–“তোমার জন্যেই হয়েছি,মেহেবুবা।”
পাশে ফিরে নিচু হয়ে জবাব দিলো আদ্রিন।তৃপ্তির হাত ছেড়ে চেয়ার টেনে তাকে বসার ইঙ্গিত দেয় সে।
অন্যদিকে তৃপ্তি হতবাক।তার দৃষ্টি আদ্রিনে আবদ্ধ।ছেলেটা তাকে বসতে ইঙ্গিত দিয়েই সাফার সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠলো।তৃপ্তি ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভাবনায় মশগুল। তার মিনমিনিয়ে বলা কথাটুকু আদ্রিন শুনলো কিভাবে?ছেলেটা কি সত্যিই জাদুকর!
চলবে…..
ইনস্টাগ্রাম।