#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৩ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
পিয়াসা থমকে দাঁড়িয়ে যায় বাসার সামনের খালি স্থানেই। পুলিশ কেন তাদের বাসার সামনে? ছোটবেলায় চোখের সামনে দেখা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর হতেই পুলিশ দেখলেই পিয়াসা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায়। তার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালায়।
এত মানুষের জটলা কেন তাদের বাসার সামনে? সব বাসার মানুষ তাদের বাসার ভিতরে কেন? পাশের বাসার মিনা আন্টি এসে পিয়াসাকে বুকে চেপে ধরে। টেনে নিয়ে যায় বাসার ভিতরে।
তার বাবার নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। পিয়াসা বাবার বুকের উপর আছড়ে পড়ে। আকাশ মাটি এক করে গলা ফাটিয়ে বিলাপ করে। নানান প্রশ্নবাণে পরিচিতজনদের জর্জরিত করে ফেলে। সবাই চুপ হয়ে নিরবে অশ্রু ফেলছে।
পুলিশ তাকে জানায় আপনার বাবাকে আপনার সৎ মা বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। আমরা ফোন পেয়ে এসেছি। যদিও তিনি পুরোদমে অস্বীকার করছে। আমরা উনাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। লাশ ও নিয়ে যাচ্ছি। পোস্ট মটের্ম হবে।
পুলিশ চলে গেলে আশেপাশের মানুষ ও চলে যায়। সৎ মায়ের বোন এসেছে সৎ বোন দুটোকে নিয়ে যেতে। পিয়াসা যেখানে নিজেই এতিম অসহায় হয়ে গেল। সেখানে বোনদের কিভাবে নিজের করে রাখবে। সবাই বলাবলি করছে এই মেয়েটার কি হবে এখন। কোথায় যাবে। কে আশ্রয় দিবে এই উঠতি বয়সের মেয়েটাকে।
পিয়াসা নয় বছরের সৎ বোন রিয়াকে জিজ্ঞেস করে বাবার মৃত্যুর কারণ। সিমা রিয়ার চেয়ে তিন বছরের বড়। সে সত্যিটা বলবেনা। কিন্তু সে জানে রিয়া হুড়হুড় করে যা জানে বলে দিবে।
ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরে জানতে চায়,
রিয়া পুলিশ যে বলল আব্বুকে তোর আম্মু বিষ খাইয়েছে।
এটা সত্যিই বোন?
রিয়া কাঁপতে কাঁপতে বোন পিয়াসার হাত ধরে বলল,
আপু তুমি সকালে স্কুলে যাওয়ার পর আম্মু আর আব্বু তোমাকে নিয়ে ঝগড়া লাগছে। আব্বু বলে পিয়াসাকে অনেক পড়াশোনা করামু।
আম্মু বলে নাহ। কলেজ পাসের পর বিয়া দিয়া দিমু তারে। ওর পিছনে টাকা খরচ করলে আমার দুইটারে কিভাবে পড়ালেখা শিখামু?
এভাবে অনেক কথা কাটাকাটির পর আব্বু বলে,
আমার শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আমার মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিমুনা।
আম্মু তখন নিজে নিজে অনেক বকল তোমাকে। এরপর আব্বু বাইরে চলে যায় নামাজ পড়তে। আসার পর আম্মু ভাত দেয়। ডাল দেয়। আব্বু খেয়ে শুয়ে থাকে। তারপর বলে পেটব্যথা, বমি ও করে দিছিলো। মিনা আন্টির জামাই ডাক্তার আনছে। বলে আব্বু নাই।
পিয়াসা বেদনার্ত মুখে বলে, আব্বু ওই কথাটা না বললেই বেঁচে যেতরে রিয়া।
রিয়া পিয়াসার গলা পেঁচিয়ে ধরে, ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে বলে, আপু আম্মু কবে ছাড়া পাবে? আমাদেরকে ছোট খালা নিয়ে যাবে। তুমি কার কাছে থাকবা?
পিয়াসা হুহু করে অশ্রুপাত করতে লাগলো। বলল, তা আমি কি করে জানব রে। আর আব্বুর লাশ দাফন হোক আগে। তারপর গ্রামে চলে যাব কোন আত্মীয়ের বাড়িতে।
এদিকে প্রত্যাশিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। পিয়াসার কোন খবর নেই। রায়হান বিচলিত হয়ে পড়ল। ভয়ে ফোন ও দিতে পারছেনা। সাইলেন্ট না থাকলে ফোন বেজে উঠবে। পরে সৎ মায়ের হাতে মেয়েটা মার খাবে। এই ভেবে
দুই শব্দের ছোট্ট একটা মেসেজ দিল।
“কেমন আছ পিয়াসা? এনি প্রবলেম?”
প্রতিক্ষার প্রহর কেটে গেল। তবুও কোন রিপ্লাই এলনা। রায়হানের মাঝে অস্থিরতা বেড়ে দিগুণ হয়ে গেল।
পরপর টানা দুইদিন পিয়াসা কলেজে আসছেনা। কোচিং ও করছেনা। সে যে পিয়াসাকে খুঁজছে এটা দ্বিতীয় কাউকে বুঝতে দিলনা খুব সচেতনভাবেই।
এদিকে আয়মান ও কোচিং ক্লাসে অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করল,
তোমাদের সাথের আরেক বন্ধু আসেনা কেন? কিছু জান তোমরা?
জেবা, জুলি,নাহিদ উৎকন্ঠা নিয়ে জানাল,
স্যার জানিনা। পিয়াসাতো ক্লাস মিস করেনা ভুলেও। বরং ও বাসা থেকে বাইরে থাকতে পারলেই বাঁচে। আমরা কোনভাবেই খোঁজ নিতে পারছিনা। ওর তো মোবাইল ও নেই।
বাইরে থাকলে বাঁচে মানে? ও অসুস্থওতো হতে পারে।
তা হতে পারে। কিন্তু তেমন অসুখ বিসুখ তো দেখিনা তার। স্যার পিয়াসার সৎ মা ঘরে। আমরা এর বেশী কিছু জানিনা। স্যার কোনভাবে কি ওর খোঁজ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়না?
ওদেরকে চিন্তাগ্রস্ত মুখে দেখে আয়মানের ও চোখের কোণে চিন্তার রেখা পরিষ্ফুটিত হলো । বলল,অফিস থেকে ওর বাসার এড্রেস বের করা যায় কিনা দেখি।
তাই করেন স্যার প্লিজ। আজই। পারলে এক্ষুনি।
দেখছি বলে আয়মান উঠে গেল অফিসে। একটু পর পিয়াসার এড্রেস বের করে আনল। তোমরা কেউ গিয়ে খবর নিতে পারো। যে মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে অভিভাবকের। সেটা অফ পাচ্ছি।
নাহিদ বলল স্যার আমি আর হিরন কাল যাব। আজতো সময় নেই।
আচ্ছা যেও তোমাদের সুবিধামতে।
রায়হান আর থাকতে পারছেনা। বিকেলেই পিয়াসাদের বাসায় চলে গেল। মনে মনে স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল সেদিন ধরনীর বুকে বৃষ্টি দিল বলে। নয়তো আজ কিভাবে তাদের বাসা চিনতো।
পিয়াসাদের গেটে ঢুকে ছোট একটি ছেলের সাহায্য নিয়ে বাসার ভিতরে গেল রায়হান। তাকে দেখেই বাসার ভিতরের লোকজন সরে গেল।
পিয়াসা রায়হানকে দেখেই বিস্মিত হলো। চোখ কপালে তুলে ক্ষীণ স্বরে,
স্যার আপনি?
রায়হান থম মেরে গেল পিয়াসাকে দেখেই। অনিমেষ চেয়ে রইলো পিয়াসার দিকে। তিনদিন আগেও যে মেয়েটা ছিল প্রাণোচ্ছল, সজীব। আজ সেই মেয়েটাকে দেখতে কতটা নিষ্প্রাণ, নির্জীব লাগছে। পিয়াসা যেন পুইঁয়ের কচি ডগার ন্যায় তরতর করে বেড়ে উঠছে,আচমকা ঝড়ে ঝাপটাতে মরমর করে ভেঙ্গে পড়েছে। তার কল্পনার ঘোর কাটে কানে কুকুরের বিদঘুটে ডাক কানে আসতেই ।
তোমার ফোন বন্ধ। কলেজেও যাচ্ছনা। তাই খবর নিতে এলাম। এসেতো কারণ শুনলাম ওই ছেলেটার কাছে।
পিয়াসা ঢুকরে কেঁদে উঠলো বাবাকে স্মরণ করে। রায়হান তার সামর্থ্যনুযায়ী পিয়াসাকে শান্তনা দিল। তার খুব ইচ্ছে করছে পিয়াসার মাথায় নির্ভরতার হাতটুকু রাখতে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে নেই।
পিয়াসা রায়হানকে নাস্তা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তা বুঝতে পেরে রায়হান বলল,
পিয়াসা ফরমালিটির কোন প্রয়োজন নেই। আমি এখন উঠি। তোমার এত বড় দুঃসময়ে আমি কিভাবে কি করতে পারি তাই ভাবছি। কাল কলেজে অবশ্যই আসবে। তুমি মাইন্ড করবে নয়তো তোমার হাত খরচের জন্য কিছু দিতাম।
রায়হান চলে যাওয়ার সময় অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল,
পারলে ফোন অন করে একটু যোগাযোগ করো আমার সাথে। কথা আছে জরুরী।
পিয়াসা ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত মুখে মাথা হেলিয়ে মৌনতা প্রকাশ করল।
রায়হান এতসময় কি বলল না বলল তা পিয়াসার তেমন হৃদয়ঙ্গম হলনা। কিভাবেই বা হবে। যে বাবা বুকে পিঠে করে বড় করেছে তাকে,যে বাবা তার জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেই বলি হয়ে গেল কারো রোষানলের। সে বাবা তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে। তার পুরো হৃদয়টা জুড়ে তার বাবা।
থেমে থেমেই পিয়াসা বাবার জন্য কান্না জুড়ে দিচ্ছে। নিজের নিস্তেজ শরীরটাকে আশি বছরের বৃদ্ধার মতো টেনে টেনে নিয়ে গেল বিছানার উপরে। গা এলিয়ে কাত হয়ে পড়ে রইলো।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেড়েছেড়ে আবার বালিশের নিচে রেখে দিল। মিনা আন্টি এসে জোর করে দু’লোকমা ভাত মুখে তুলে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে অভুক্ত ছিল পিয়াসা। তাই সামান্য ভাত খাওয়াতেই শরীর ছেড়ে দিল। দুচোখে নেমে এলো এক পাহাড় ঘুম। তার সাথে রাতে মিনা আন্টি নিজেই ঘুমিয়েছে।
পরের দিন সকালেই হিরন, নাহিদ,তুলি এলো পিয়াসাদের বাসায়। ঘটনার আকস্মিকতা শুনে তারা ভীষণ মর্মাহত হলো। পিয়াসা তুলিকে জাপটে ধরে কান্না করতে লাগল। তারা কি বলে শান্তনা দিবে সে ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। কিছুসময় অতিবাহিত হলে, তাদের সাথে কলেজে যেতে অনুরোধ করল পিয়াসাকে।
পিয়াসা মিনমিন ভেজা কণ্ঠে জানাল,
নারে আমার পড়াশুনা করার টাকা নাই। আব্বুর এ ঘরের যে ছোট দুটো বোন ছিল আমার। তাদেরকে নিয়ে গিয়েছে তাদের খালা। আমি এ শহরে একা কোথায় থাকব। তোরাই বল। গ্রামে ফুফু আছে। দূর সম্পর্কের এক খালা আছে। তাদের কাছে গিয়ে উঠবো।
হিরন বলল,কেন তোদের এই বাসায় থাকবি। যে মিনা আন্টির কথা বললি উনি তোর খেয়াল রাখবে।
এ বাসার দুই মাসের ভাড়া বাকি। সকালে বাড়িওয়ালা এসেছে। উনি বলছে উনার ভাড়া দিতে হবেনা। আমি যেন বাসা ছেড়ে দিই। বাসার সব জিনিসপত্র বেচে উনি টাকা নিয়ে নিবে। তাতেই উনার পাওনা টাকা শোধ হয়ে যাবে।
শুনে ওরা হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। পরে বলল, অন্তত বের হয়ে আয় আমাদের সাথে। বাইরের আলো বাতাস একটু গায়ে লাগুক তোর।
নারেহ। তোরা চলে যা । আমার কিছুই ভালোলাগছেনা। পুরো দুনিয়াকে বিভীষিকাময় লাগছে। কোথাও যেন কোন আলো নেই। পিতামাতাহীন একটা এতিম মেয়ের জীবন কতটা নির্মম আর দুর্বিষহ হতে পারে, তা এই কয়দিনে মর্মে
মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
বন্ধুরা কলেজে চলে গেল ব্যর্থ হয়ে। গিয়ে ক্লাসের সবাইকে পিয়াসার বিষয়ে জানালো। আয়মান স্যারকে জানালো।
আয়মান শুনে চমকে উঠলো। ওদেরকে বলল, এটা কোন কথা হলো। ও পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো। অন্তত ফাইনাল পরিক্ষাটা শেষ করুক। আমার কোচিং-এর বেতন আর দিতে হবেনা। আর অফিসে বললে অধ্যক্ষ তার বেতন ও মওকুফ করে দিবে নিশ্চিত।
ওরা জানাল, স্যার ও থাকবে কোথায়?
একটু থেমে আয়মান বলল, এটাও প্রশ্ন। ঢাকা শহরে কে কাকে কয়দিন রাখে। দেখি রায়হানের সাথে আলাপ করে থাকার কোন বন্দোবস্ত করা যায় কিনা।
আর তোমরা বিকেলে একটু কষ্ট করে আবার যেও পিয়াসার কাছে। আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিও। ওকে বুঝিয়ে বললে আশাকরি শুনবে। যার বিপদ তার মাথা কাজ করেনা। এ সময় অন্যদের এগিয়ে আসতে হয়।
বন্ধুরা বেশ সন্তুষ্ট হলো আয়মান স্যারের উপর।
কিয়ৎক্ষন ভেবে পূনরায় বলল আয়মান, আচ্ছা থাক আমিই নিজেই যাব। ফোনে কাজ নাও হতে পারে।
তাহলেতো বেশ ভালো হয় স্যার। যেভাবেই হোক ওর গ্রামে যাওয়া বন্ধ করতেই হবে। আমরা এমন ভালো,মিষ্টিভাষী বন্ধুকে ছাড়া নিরানন্দ জীবন চাইনা। আয়মানকে তারা বাসার ঠিকানা ভালো করে বুঝিয়ে দিল।
বিকেলে ক্লাস শেষে আয়মান একটি রিকশা নিয়ে পিয়াসার বাসার দিকে রওনা দিল। বাসার কাছাকাছি যেতেই আয়মানের দৃষ্টি আটকে গেল সামনের একটি স্থানে।
দেখতে পেলো রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে বন্ধু রায়হান রিকসা ডাকছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াসা।
আয়মান এক আকাশ অবাক বিস্ময় নিয়ে নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো। যেন পৃথিবীতে এইমাত্র ঘটে যাওয়া কোন অত্যাশ্চর্য জিনিস তার দৃষ্টিগোচর হলো। সে যেন নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।
চলবে…৩