প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব -০৯

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৯ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
পিয়াসা লজ্জায় তেতে উঠে ঘরের পিছনের রুমে চলে গেল। আয়মান ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। আলিশা মুচকি হেসে দিল।

আয়মানের মা বিরক্তিকর স্বরে, আন্দাজে কথা বলেন কেন আপনারা? বউ ছাড়া আর কেউ হতে পারেনা? আমার ভাগনী হয় সম্পর্কে সে।
তারা মুখে কুলুপ এঁটে চলে গেল।

______
সবুজ পল্লীর শান্ত সন্ধ্যাকে বিদায় জানিয়ে ধরনীর বুকে নেমে এলো শীতের সুদীর্ঘ হিম ঝরানো থমথমে রাত। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে হিমেল হাওয়া সাথে নিয়ে, কুয়াশার চাদর জড়িয়ে এলো শীতকাল। যেটা গ্রামে না এলে টেরই পেতনা শহর থেকে আসা এই চারজন মানুষ।

আয়মানের চাচাতো দাদী থাকে তাদের ঘরে সবসময়। তার সাথে এদের বন্ধন ঠিক নিজের দাদীর মতই। আপন দাদা দাদী বেশ কয়বছর আগেই গত হয়েছে। আলিশা ও পিয়াসা বেশ সময় ধরে দাদীর সাথে খোশগল্পে মেতে রইল। দুজনেরই মাথা ও পিঠ চাদর মুড়ি দিয়ে ঢাকা। দাদী ও মা ঘুমিয়ে গেলে তারা উঠে গেল।

আলিশা গিয়ে আয়মানকে বলল,
এই ভাইয়া আমি আর পিয়াসাপু একটু বের হবো। তুমি একটু আসনা। বাইরে ভীষণ অন্ধকার। একেবারে ভুতুড়ে পরিবেশ।

বের হবি কেন তোরা?

ব্যাঙের ডাক শোনার জন্য।

কিইই! সো বিরক্তিকর বলে আয়মান ভ্রু কুঁচকালো। এটা কার ইচ্ছেরে ?

আমাদের দুজনেরই। বলল আলিশা।

কি অরুচিকর ইচ্ছে তোদের। হাহ! মা, দাদী ঘুমিয়ে গিয়েছে?

কব্বেই? তাইতো সুযোগ পেয়েছি। নইলে আম্মু বের হতে দিত?

চল বলে আয়মান তার শালটা জড়িয়ে নিল গায়ে।
আস্তে করে দরজা খুলে বের হলো তারা তিনজন । আয়মান মোবাইলের টচের আলো ফেলছে সামনে। সেই আলোকে সঙ্গী করে পিয়াসা ও আলিশা এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে রাতের ক্ষীণ আওয়াজ ও প্রকট হয়ে কানে বাজে। পুরো বাড়ির সব ঘর গুলোতে মিটমিট আলো জ্বলছে।

বাড়ির সামনের দিকে যেতেই ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে অনেকগুলো ব্যাঙের ডাক শুনতে পেল তারা।
পিয়াসা ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিস করে আলিশাকে বলল,
এই খড়ের স্তুপের পাশ থেকে সাপের ফোঁসফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলিশা তীক্ষ্ণভাবে কান পেতে শুনল। ঠিক তাই। সে আয়মানকে বলল।

আয়মান মোটা গলায়,
কি বলিস তোরা? দেখিতো বলে অতি সাবধানী হয়ে চোরের মতো দুকদম পা এগিয়ে নিল। টচের আলো ফেলল আওয়াজ আসা স্থানটাতে।

পিয়াসা ও আলিশা গলাগলি করে আয়মানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে৷

চোখে আলো পড়াতেই ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটি তরুন ছেলে।
আয়মান চোখ বড় করে, কে রে তুই আমাদের বাড়িতে? কি করছিস এখানে?

আমি পাশের বাড়ির সুজন। প্রেমিকার লগে কথা কই আয়মান ভাই।

তারা তিনজন বুঝতে বাকি রইলোনা এই ছেলেটার সর্দি। তাই নাক টেনে টেনে কথা বলছে। আর নির্জন রাত বলে আওয়াজটা সাপের ফোঁসফোঁস শব্দের মতো মনে হলো।

আরেব্বাস! কি কঠিন প্রেম তোর সুজন। এই কনকনে ঠান্ঠা গায়ে মেখেও প্রেমিকার সাথে কথা বলছিস। তোর প্রেমের জয় হোক। এখন চলে যা।

পিয়াসা মুখ চেপে হুঃহুঃহুঃ করে রিনিঝিনি শব্দে হেসে ফেলল সুজনের এমন কান্ডে। আয়মান মুখকে একপাশ করে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে পিয়াসার হাসি শ্রবণ করল। এই প্রথম সে পিয়াসার প্রাণোচ্ছল হাসি শুনতে পেল। তার গোপন চিত্ত বিমোহিত। মোহাচ্ছন্ন। এমন শীতল করা হিমেল রাতেও তার হৃদয় উষ্ণতায় মাখামাখি হলো।

সুজন কে ডাক দিল নিজের কাছে। কাল বিকেলে বাজারে আমার সাথে দেখা করিস।

কেন ভাইজান? আমার কোন ভুল?

আরেহ নাহ। তোর প্রেমিকার জন্য একটা গিফট দিব। সুজন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আচ্ছা ভাই। স্থান ত্যাগ করল সুজন ।

এই ভাইয়া জ্বিন ভূতে ধরেছে নাকি তোমাকে? আজাইরা সুজনকে কেন গিফট দিবা? আমাকেই দিও সেটা। সওয়াবের পাল্লা ভারী হবে।

আয়মান আলিশার মাথায় হালকা টোকা মেরে, অবশ্য তুই ও পাওনা। আচ্ছা তোকেও দিব।

পিয়াসাপু পাওনা নয়?
নাহ। সে কি উপকার করেছে আমার?

ওরা ঘরে ফিরে আসে। আয়মান তার রুমে শুয়ে যায়। আলিশা গিয়ে তার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে। পিয়াসা তার জন্য বরাদ্দকৃত স্থান দাদীর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে।

আয়মানের চোখের কোনে ঘুমের লেশ মাত্র নেই। ঘুমেরা যেন হাওয়াই মিঠাইর মতো কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। তন্দ্রাহীন বিনিদ্র রজনী পার করছে। শীতার্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে । পাশের উঠানে কুকুরগুলাে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে। পাশের কোনাে মসজিদ থেকে হামদে নাত ও নাতে রাসুল গজলের প্রাণ জুড়ানো সুর ভেসে আসছে।

এদিকে পিয়াসার এক ঘুম হয়ে গিয়েছে। তার বড্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে। উঠতে হবে পানি খেতে। পাতায় পাতায় টুপ্ টুপ্ করে শিশির খসে পড়ছে। মনে হয় যেন অনেকগুলো ভূত পা টিপে টিপে চলছে । ভয়ে পিয়াসার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। রাত ও শেষ প্রহরে এসে পৌঁছাল। পিয়াসা নিঃশব্দ পায়ে বিছানা থেকে উঠে মাটিতে পা রাখল। সারা ঘর অন্ধকার। পানি যে কোথায়। খোলা দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে পিয়াসা আয়মানের রুমে উঁকি দিল।

আবছা আলোতেও আয়মান পিয়াসাকে দেখতে পেল । চট করে উঠে জিজ্ঞেস করল। পিয়াসা কি সমস্যা বল?

পানির মগ খুঁজে পাচ্ছিনা স্যার।

ভিতরে আস। পানির এনে দিচ্ছি।

আমিই পারব। মগ কোথায় বলেন।

নাহ। তুমি নতুন এ ঘরে। খুঁজতে গেলেই এটা ওটার সাথে হোঁচট খাবে। আর সবাই হুড়মুড়িয়ে চোর বলে চেঁচিয়ে উঠবে।

পিয়াসা দু’ পা বাড়িয়ে আয়মানের রুমে প্রবেশ করল।

আয়মান পিয়াসার পাশ কেটে উঠে গেল। এক গ্লাস পানি এনে দিল পিয়াসার হাতে। পিয়াসা চেয়ারে বসে গ্লাসটি দুইহাত দিয়ে যত্নের সাথে ধরে পুরোগ্লাসের পানি সব খেয়ে নিল।

আর খাবে পানি? খুব পিপাসা লেগেছে বুঝি?
হুম স্যার।

তুমি নিজেই ত আজলা আজলা জল। টেনে টেনে নেশাতুর চোখে বলল আয়মান। তোমার নামটা সুন্দর। কিছুটা কাব্যিক।

ও হ্যাঁ। মা সবাইর কাছে তোমার পরিচয় দিয়েছে ভাগনি হিসেবে। সেখানে তুমি যদি ভাইয়া না বলে এভাবে স্যার স্যার বল। মা মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেনা সবার কাছে? বল?

সম্মতি পোষণ করে পিয়াসা বলল,আন্টিকে ছোট করবনা। বিষয়টা মাথায় গেঁথে রাখলাম।

পিয়াসা চলে গেল। ভাবছে, আয়মান স্যার ও কি আমাকে ভালোবাসে নাকি। কথাবার্তার সুর তেমন কিছুইতো ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব। উনিতো পুরাই কাঠখোট্টা টাইপের বান্দা। নাকি দুই বন্ধু চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আমাকে জয় করার। কিন্তু আমার মাঝে এমন কিইবা আছে।

ভোর হয়ে গেল। দাদী আর মা তাড়াতাড়ি উঠে গেল। বড় এক হাঁড়ি রস উঠানে নিয়ে এলো রইসউদ্দীন। দাদী আগেই বলে রেখেছে খেজুরের রসের জন্য তাকে। খেজুর গাছের খাঁটি
রস বহুদিন পরে তারা দেখেছে। রান্নাঘরে মাটির চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিল তাদের ঘরের কাজে সাহায্যকারী পাশের বাড়ির দরিদ্র করিমন চাচী।

আলিশা ও পিয়াসা কাচা রস বাটিতে নিয়ে একটু খেল। চোখ চকচক করে উঠল দুজনের। একে অপরের দিকে চেয়ে। উফফস! কি মজা! অথেনটিক স্বাদ।

কাউন চাল দিয়ে ক্ষীর রান্না হবে এখন। মাটির চুলার একটু দূরে উঁচু কাঠের পিঁড়িতে বসে আছে আলিশা ও পিয়াসা। তার দাদী পানের বাটা নিয়ে বসেছে। একটু পর পর খিলি পান বানিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে। পিয়াসা বলল দাদীর তো পান খেয়েই পেট ভরে যাচ্ছে। নাস্তা খাবেন কিভাবে?

পান ভর্তি মুখে দাদী রসিয়ে রসিয়ে জবাব দিলো। নালো নাতনি নাহ। নাস্তা ঠিকই খাইতে পারুম। পান হইলো আমার কাছে নেশার জিনিসের মতন। যত পাই। তত খাই। আরো চাই। দিল ও ভরেনা। পেট ও ভরেনা।
ব্যাটা ছেলেরা যে একটা না শ্যাষ হইতেই আরেকটা বিড়ি ফুঁকে। ক্যামনে কও। ওই যে নেশা।

দাদী কি যে জোস একটা কথা বলছ তুমি। নেশার বস্তু যত পাই তত চাই। ভাললাগছে শুনে। বিপুল শান্তি পেলাম। রান্নাঘরের বেড়ার পাশে ব্রাশ করতে করতে বলল আয়মান।

মাথা উঁচিয়ে আয়মানের দিকে চাইল পিয়াসা ও আলিশা। দাদী বলল তুই ও শুনলি তাইলে?

এত মজার কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হব নাকি বুড়ি?

বউ শুনো তোমার পোলারে সাদি করাইয়া দিবা। মনে হয় লাইন মারে কোন মাইয়ার লগে।

আয়মান উঁকি দিয়ে মাকে দেখেই জিব কামড় দিল লজ্জায়। দ্রুত পুকুর ঘাটে চলে গেল।

আয়মানের মা বড় একটি নতুন হাঁড়িতে রস নেড়ে নেড়ে জ্বাল দিচ্ছে। করিমন চাচী চুলোর আগুন কন্ট্রোল করছে। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে অল্পসময়েই খেজুর রসের ক্ষীর তৈরি হয়ে গেল।

রসের ম – ম সুঘ্রান সারা রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়ল। পিয়াসা, আলিশা বায়না ধরল ঘরে গিয়ে টেবিলে খাবেনা নাস্তা। রান্নাঘরের মাটিতে বসেই খাবে। অরজিনাল গ্রামের আবহ অনুভব করতে চায় তারা।

বেতের একটি সুন্দর পাটি বিছানো হলো। নাস্তার বাটি চামচ ধুয়ে আনা হলো। আয়মানের মা একে একে সবাইকে বেড়ে দিল খেজুরের রসের ক্ষীর। নিজের জন্যও নিলেন। করিমন চাচীকেও দিলেন। একটু জুড়িয়ে গেলে বাটি হাতে নিল সবাই।

আয়মান এসেই চিলের মত ছোঁ মেরে পিয়াসার জুড়ানো বাটি হাতে নিল। গপাগপ খাওয়া শুরু করলো।
জাস্ট ওয়াও মা। অস্থির মজা হয়েছে।

পিয়াসা হা হয়ে চেয়ে রইলো আয়মানের দিকে।

আরেহ ভাইয়া তুমি কার ক্ষীর খেয়ে ফেলছ?

কার আবার? নাম লিখা আছে নাকি?

পিয়াসাপুর জুড়ানো বাটি খাচ্ছ। বেকুব।

আয়মান অর্ধেক শেষ করা বাটি পিয়াসার হাতে ধরিয়ে দিল। নিজের বাটি নিয়ে খাওয়া শুরু করল।

পিয়াসা গরম খাবার খেতে পারেনা। আবার খাওয়ার লোভ ও সংবরণ করতে পারছেনা। অগত্যা নিরুপায় হয়ে আয়মানের খাওয়াটাই খেয়ে পরে আরও নিল।

করিমনকে নিয়ে তার মা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল পিছনের বাগানে কচুক্ষেতের দিকে।

পিয়াসা সর‍্যি তোমার টা খাওয়ার জন্য।
সমস্যা নেই ভাইয়া। পিয়াসা স্মিত হেসে বলল।

আলিশা গাল টিপে হেসে ফেলল।

দাদী তুমি ঢাকায় বেড়াতে যেতে চাওনা কেন? বলল আয়মান।

হ যামু। তোগো ভাই বোনের বিয়ার কালে।

দাদী আমার টা বাদ দেও। সিরিয়ালে ভাইয়া এগিয়ে আছে।

আমি বিয়ে করবনা। বলল আয়মান।

কেন নাতি? তুই কি হি**ড়া?

আয়মান কিঞ্চিৎ রেগে গেল। দাদী তুমি আগের মতই ফাজিল আছো। আমি কেশবতী নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসি অনেকদিন ধরেই। তাকে না পেলে দ্বিতীয় কাউকে চাইনা। আয়মান উঠে গেল কলতলায় হাত ধোয়ার জন্য।

পিয়াসা নিশ্চিত হলো কিছু। বুঝে নিল তার মানে আয়মান স্যার বহু আগেই কোন ললনার জন্য প্রণয়ের জলসাঘর সাজিয়ে রেখেছে হৃদয়ের অন্তপুরে।

পিয়াসার ফোন বেজে উঠলো। রায়হান ফোন দিয়েছে।
পিয়াসার সব কুশলাদি জেনে নিয়ে বলল,
পিয়াসা আর চাইবনা তোমাকে। এই শেষ চাওয়া। তুমি রাজী থাকলে আমি বিয়ের প্রস্তুতি নিব। শীতের মধ্যেই তোমাকে একান্তভাবে নিজের করে পেতে চাই।

পিয়াসা থম মেরে রইলো। ওপাশ থেকে রায়হান বলল, মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। আমি বুঝে নিলাম তোমার আপত্তি নেই আমার ছায়া হয়ে বাঁচতে। অকুন্ঠ ভালোবাসা তোমার জন্য।

চলবেঃ ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here