#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২১
#আফনান_লারা
________
লেভেন ঢেউয়ের সাথে হারিয়ে যাচ্ছিল আর একটুর জন্য।সজীব না থাকলে ওকে বাঁচানো যেতোনা কখনও।সজীবেরই অনেক কষ্ট হয়েছে লেভেনকে কিণারায় নিয়ে আসতে।লেভেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ততক্ষণে।সজীব ওকে তুলে বাসায় নিয়ে এসে ডাক্তারকে কল করে।কারণ তখনও লেভেনের জ্ঞান ফিরছিল না।লেভেন এমন পাগলামো এর আগেও করেছে।যখনই সজীবকে সে খুব করে চায় আর না পায় তখন সে এমন পাগলামি করে।এর আগে রাগ করে হিল ক্লাইম্বে চলে গেছিলো।প্রতিবার তো সজীব থাকেনা ওকে বাঁচানোর জন্য।একবার সত্যি সত্যি লেভেনের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছিলো। হাসপাতালে ছিল দশ দিন।তাও ওর এই পাগলামির শেষ নেই।সজীবকে সে নিজের করার যুদ্ধে নেমেছে।কে জানে নিয়তি কোন দিকে নিয়ে যায়।এতগুলো বছর একই জায়গায় থেকেও সে সজীবের ঠোঁট অবধি ছুঁতে পারেনি আর কবেই বা পারবে!
———
পূর্ণতা ফারাজের জন্য চা বানিয়েছে টাংকির পানি দিয়ে।বানানো শেষে দাঁত কেলিয়ে সে কাপটা নিয়ে ফারাজের কাছে এসে হাজির।
ফারাজ বইটা রেখে একটু চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।ঘুমানোর জন্য না,এমনিতেই চোখকে বিশ্রাম দিতে।মাঝে মাঝে চোখের ক্লান্তি দূর করতে ঘুম না আসলেও চোখটা বন্ধ করে রাখা উচিত।
পূর্ণতা কাপ সামনে ধরে বললো,’আমি কারোর জন্য কোনোদিন চা বানাইনি,আমার নিজের জন্য বানাতেই আলসেমি লাগে।কিন্তু আপনি এত করে বললেন,ফেলতে পারলাম না।আপনাদের বাড়িতে থাকি আপনাদের কথা তো শুনতেই হবে। ঐ যে বলেনা “দুধ দেয়া গরুর লাথিও ভাল”
তাই আপনাকে মান্য করতেই তো হতো’
ফারাজ কাপটা হাতে নিয়ে ভাল ভাবে দেখে বললো,’আপনার কাজ দেখে আমি সন্তুষ্ট হলাম ভীষণ।চা বরং আপনিই খান।’
পূর্ণতা চোখ বড় করে বললো,’ না না।আমি সকালে খালি পেটে চা খাইনা।আপনি খান’
‘তা কি করে হয়?একটা বিসকিট খেয়ে তারপর নাহয় খান।’
‘না না।আমি খাব না।সকালে চা খেলে আমার দুইদিন ধরে বমি বমি ভাব লাগে’
ফারাজ হঠাৎ কাপটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে।পূর্ণতা ধীরে ধীরে পিছোচ্ছে আর ফারাজ এগোচ্ছে।পূর্ণতা বুঝে গেছে ফারাজ ধরে ফেলেছে চা কোন পানি দিয়ে বানানো এবং সে এখন জোর করে খাওয়াবে ওকে।
তাই সে দিলো এক দৌড়।কিন্তু ফারাজ ওকে ঠিক সময়ে ধরে ফেলেছে।টান দিয়ে সামনে এনে সে পূর্ণতার মুখ টিপে ধরলো তারপর হেসে হেসে বললো,’চা তো খেতেই হবে।এত যত্ন করে বানিয়েছেন,এটা তো ফেলে দেয়া যায়না।আপনি একটু হলেও খাবেন।নিন হা করেন ‘
‘না না আমি খাব না।’
ফারাজ পূর্ণতাকে ঝাপটে ধরে জোর করে খাওয়াচ্ছিল ঠিক সেসময় দাদাজানের আগমন ঘটে।
তিনি ওদের দুজনের কাছে এসে বললেন,’কি হচ্ছে এখানে?’
ফারাজ পূর্ণতা দুজনে আলাদা হয়ে গেছে দাদাকে দেখে।
দাদাজান চোখ বড় করে দুজনকে দেখছেন।ভাল করে দেখা শেষে বললেন,’তোমরা নাকি বিয়েতে রাজিনা?’
” জ্বী”
‘জ্বী’
‘তবে এরকম চিপকাইয়া কি করতেছিলা?অবিবাহিত যুবক যুবতি ভোরবেলা একা একটা রুমে কি করে??মানুষ কি বলবে?তোমরা যদি দুজন দুজনকে পছন্দই না করো তবে সবসময় চিপকাই থাকো কেন?আমাকে জবাব দাও’
ফারাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণতা মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবার আগে ফারাজ ওর আঁচল টেনে ইশারা করে চুপ থাকতে বললো।
দাদাজান ওদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেছেন আর কিছু বলেননি।উনি যেতেই পূর্ণতা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনার দোষ সব। আমার হাত ধরে জোরাজুুরি না করলে দাদাজান এত সব বলতেন না’
‘তুমি ঝামেলা না করলে তোমাকে আমি চা খাওয়াতে জোর করতাম?’
‘চা তে কি সমস্যা? ‘
‘চা কোন পানি দিয়ে বানাইছো ভাবছো আমি জানিনা?’
পূর্ণতা মাথা চুলকে পালানোর চেষ্টা করে, ফারাজ আবার ওকে ধরে ফেললো।বললো আজ ওকে চা খেতেই হবে।অমনি দাদাজান আবার আসলেন,এবারও ওদের একই অবস্থায় দেখে বললেন,’ফারাজ!আজকের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে, তুমি ঠিক কাকে বিয়ে করতে চাও।এসএসসি পাশ,ইন্টার ফেইল নাকি অনার্স ফাইনাল ইয়ার কে’
এই কথা বলে দাদাজান চলে গেছেন।পূর্ণতা হাত ছাড়িয়ে বললো,’মগেরমুলুক!!! আমার মতামত কেউ জানতে চাইছেনা কেন!আমি এই বদমেজাজি লোককে বিয়ে করবোনা।এটা আমার শেষ কথা’
‘আপনাকে কে বিয়ে করবে?আমি না।এটা আমার শেষ কথা’
———
আনাফ বসে বসে একটা রোগীর ফাইল দেখছিল।সেসময় মা আবারও হাজির হলেন একটা মেয়ের ছবি নিয়ে।
ছবিটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে শুরুতে আনাফের সাথে তিনি কুশল বিনিময় শুরু করে দিলেন।আনাফ বেশ বুঝতে পারছে মা এমন কেন করছেন।
তিনি আনাফকে স্বাভাবিক দেখে একটা টুল টেনে ওর পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে ছবিটা এগিয়ে ধরলেন।আনাফ ছবিটা না দেখেই বললো,’মা আমার একজন পছন্দ করা আছে।তুমি আর কষ্ট করে খুঁজোনা’
মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন।ইয়া বড় হা করে বললেন,’কিহহহ।আগে বলিসনি কেন?মেয়ে কিসে পড়ে?বংশ কেমন?দেখতে কেমন?’
‘সব ঠিক আছে।একটা সমস্যা চলতেছে পরিবারে।সেটা শেষ হলেই বিয়ের তারিখ ফেলবো।তুমি আপাতত চিল করো’
‘চিল করে কেমনে!আমাকে তো আর চিল থাকতে দিলিনা।মেয়ের ছবি দেখা আমায়।নাহলে আজ রাতে ঘুমাতে পারবোনা ‘
আনাফ মুচকি হেসে ফাইলের পৃষ্ঠা উল্টে বলে,’চোখ ধাঁধালো সুন্দরী’
‘পড়ালেখা কেমন?’
‘ শিক্ষিত। আমার সব দিক দিয়েই ভাল লেগেছে ওরে।ঝামেলা শেষ হলেই বিয়েটা করে নিব’
‘কেমন ঝামেলা?’
‘তোমার ওসব জেনে কাজ নেই।গরম গরম কফি এনে দাও।
সকালে কফি না খেলে কাজে মন বসাতে পারিনা জানো তো।’
———–
সারথি চোখ খুলার পর থেকে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলনা।শরীর প্রচণ্ড ব্যাথা করছিল।কাল যে দখল গেছে।বাসায় ফেরার পর থেকে বারবার মনের কাছে সে জানতে চাইলো কেন সে মরতে গিয়েও মরেনা।বারবার কেন বেঁচে যায়।সে মরে গেলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যেতো।
এভাবে থেমে থাকলে হবেনা,আবারও মরার চেষ্টা চালাতে হবে।এবার এমন জায়গায় চেষ্টা করতে হবে যেন আনাফ ধারের কাছেও না থাকে। এবার সুইসাইড করলে কেউ আর বাঁচাতে আসবেনা।
মাথার ভেতর এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে সারথি বিছানা ছেড়ে নামে।তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
বাইরে বের হতেই অর্কের সাথে ধাক্কা লাগলো সেসময়।অর্ক হেঁটো হেঁটে পড়ছিল।সারথিকে দেখে সে ফিসফিস করে বললো,’জানো ফুপ্পি! ফারাজ চাচ্চু আর পূর্ণতা ম্যামের বিয়ের কথা চলছে,বড় বাবাকে বলতে শুনলাম।ডিসিশান পেন্ডিং।আজ রাতে জানানো হবে’
——-
পূর্ণতা দাদাজানের রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। সাহস পাচ্ছেনা ভেতরে যাওয়ার।শেষে অনেক কষ্টে সাহস কুলিয়ে বুক ফুলিয়ে ভেতরে ঢুকলো স।
কেড়কেড় করে একটা আওয়াজ হলো।কেমন যেন ভূতুড়ে ফিলিংস।
ভেতরে পা রেখে আবার ধপ করে পড়লো সে।ভেতরটা একেবারে নিচে ছিল।
ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দেখলো দাদাজান ধ্যান করছেন।পূর্ণতা ধীরে ধীরে কাছে এসে বললো,’দাদা আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল’
“শুনি”
‘ফারাজ ভাইয়া ভাল মানুষ।কিন্তু ওনাকে আমার পছন্দ না।আমি কদিন পর বাবার কাছে চলে যাব।আপনি অন্য একটা মেয়ে খুঁজে ভাইয়ার বিয়ে দেন, তাছাড়া ভাইয়াও আমায় পছন্দ করেননা’
‘তবে তোমাদের দুজনের একসাথে থাকাকে কি হিসেবে ধরতাম?’
‘ওটা তো খুনসুটি ‘
‘আমাকে বোঝাও??আমি পাঁচ যুগ পার করে এসেছি।আমাকে তুমি খুনসুটি আর প্রেমের তফাৎ সেখাও? বয়স কত তোমার?দুই যুগ?? আর আমি পাঁচ যুগ পার করা লোক।আমি বেশি বুঝি, কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ।
ঠিক আছে, যদি তোমাদের একজন আরেকজনকে পছন্দ নাই হয় তবে আমি একটা কথা বলে রাখি।আর একদিন ও যদি তোমাদের একসাথে দেখেছি ঐদিনই হুজুর ডেকে বিয়ে পরিয়ে দিব।এটা আমার শেষ কথা’
পূর্ণতা ঢোক গিলে চলে গেলো ওখান থেকে।খুব জলদি এই বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে, নাহলে দাদাজানের যে দাপট!ধরে বিয়ো পরিয়ে দিবে সত্যি সত্যি।রিস্ক নেয়া যাবেনা
পূর্ণতা বের হবার পর এবার ফারাজ এসেছে।দাদাজান সবে ধ্যানে আবার বসছিলেন, ফারাজকে দেখে থামলেন,ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কথার শোনার আশায়।
‘দাদাজান,আমি তো পূর্ণতাকে পছন্দ করিনা।আমাদের মাঝে কিছু নেই।আপনি শুধু শুধু সন্দেহ করছেন।আপনি বরং একটা মেয়ে পছন্দ করে দিন।আমি ওরেই বিয়ে করবো তাও পূর্ণতা না’
দাদাজান ফোন বের করে কাকে যেন কল করলেন।যাকে কল করলেন তাকে অনুরোধ করলেন আজকে বিকালে আসতে।ফারাজ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো কাকে আসতে বলেছে দাদা।
‘তোমার জন্য যে মেয়ে ঠিক করেছি তার বাবা মা আসবেন তোমায় দেখতে’
‘আগে তো ছেলেরা দেখতে যায়’
‘মেয়েকে আমার দেখা আছে।সুতরাং তারা দেখতে আসবেন।বকবক না করে গোসল করে আসো।আজ সাদা পাঞ্জাবি পরবেনা,রঙিন দেখে পরবা।যাও”
ফারাজ গাল ফুলিয়ে চলে আসলো।একে বলে “আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকানো।
পূর্ণতার সাথে বিয়ে ক্যানসেল করে এখন আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে হ্যাঁ বলেছে সে।
‘ধুর ধুর!”
মিসেস সোনালী নানান পদের পিঠা বানাচ্ছেন ফারাজের হবু শ্বশুর শাশুড়ির জন্য।তার ধারণা এখানেই বিয়ে হয়ে যাবে।আর দেরি না করে আয়জনে নেমে পড়েছেন তিনি।পূর্ণতাও হাত লাগিয়েছে,কারণ তিনি একা পারছিলেন না।
——
‘আচ্ছা ভাই,হাবিজাবি বাড়ির মানুষরা কেমন জানেন?আমার মেয়ে বিয়ে দিব তো।তাই খবর নিতে চাচ্ছি’
চায়ের দোকানদার চা কাপে ঢেলে গটগট করে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন,’নাম যেমন মানুষও তেমন,কাম ও তেমন’
জনাব হাবিবুল্লাহ টুলে বসে একটু এগিয়ে বললেন,’কেন?কি সমস্যা?খুলে বলেন’
‘ সেন্টু গেঞ্জি খুলে বলবো নাকি সাথে সব খুলে বলতে হবে 😁’
জবাব হাবিবুল্লাহ আরেকটু এগিয়ে ফিসফিস করে বললেন,’গোটা চামড়াটাই খুলে বলেন।আমার ছোট মেয়ে।বড়ই আদরের।খবর নেয়া ছাড়া তো বিয়ে দিব না।ভেতরের খবর জানা জরুরি’
‘আমি কিন্তু ভাই গীবত করিনা।মরা ভাইয়ের গোশত খাইতে চাইনা।যা বলতেছি সত্য বলতেছি।আপনি আবার বলিয়েননা যে গীবত করতেছি।শুনেন ভাই,প্রথম কথা, ওরা এক নম্বরের খাচ্চর।এই খাচ্চর দুনিয়াতে নাই রে ভাই।কি আর বলবো!’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২২
#আফনান_লারা
________
জনাব হাবিবুল্লাহ আশ্চর্য হয়ে বসে আছেন চা দোকানদারের কথা শুনে।এটা কি বললো তা ভাবতে গিয়ে মাথার ভেতর রফাদফা হয়ে যাচ্ছে।বেলায়েত আঙ্কেলের মতন একটা লোকের বাড়ির মানুষজন বুঝি এমন??তা কি করে হয়?মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে তিনি আবার জানতে চাইলেন খাচ্চর বলার কারণ কি।
দোকানদার চায়ের কাপ এগিয়ে ধরে বললেন,’ওদের টাংকির পানিতে কি থাকে জানেন?’
‘কি?’
‘ওদের বাচ্চাদের মুত।ছিঃ ছিঃ!আমি একদিন নিজের এই দুই চোখে দেখেছি জানেন?সিয়াম নামের পোলাডা প্যান্ট খুলে সরাসরি করতেছে।ছিছি!ঐ পানি ওরা খায়।আমি ভাবছিলাম হয়ত একদিন এমন করে।ওমা পোলা দেখি প্রতিদিন বিকাল চারটা দুই মিনিটে টাংকিতে উঠে হিসু করে।ছিছি!!’
জনাব হাবিবুল্লাহ চোখ বড় করে রেখেছিলেন।এসব শুনে এবার বললেন,’আর কি কি সমস্যা? ‘
‘আরে ভাই সমস্যা তো ওটাই।ঐ পানি দিয়ে দুনিয়ার সব কাজ করে।খাওয়া হইতে দৈনন্দিন যত কাজ আছে।সব!!’
‘গোসল ও?’
‘না,শুধু গোসলটা পুকুরে গিয়ে করে হয়ত।ঠিক জানিনা’
‘আর কোনো সমস্যা আছে?’
‘যে ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক করছেন,ছেলের যে অন্ধ জমজ বোন আছে জানেন?’
‘হুম’
‘ঐ মেয়ে যে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে।আর যাবেনা শুনলাম।সে খবর জানেন?
‘তাতে আমার কি?’
‘তাতে আপনার কি মানে!মেয়ে যে এখন ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে সেটা ভাবছেন?তারপর বলি মেইন ছেলের কথা।ছেলে কি ভাল চাকরি করে আপনি যে ডেং ডেং করে বিয়ে দিতে আসছেন?’
‘ছেলের চাকরি আসলে আমরা দেখছিনা।পরিবার ভাল বলেই এগোলাম।ছেলে তো যাই কামাই করে তা যথেষ্ট বলে মনে হলো আমার কাছে’
‘কি কামাই করে?সারাদিন বান্দরের মতন ঘুরফিরে।তারপর ছবি আঁকে সেটা বেচে আবার বান্দরের মতন ঘুরে।’
জনাব হাবিবুল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন,হাতের ঘড়িতে চেয়ে দেখলেন চারটা বাজে।আর দুই মিনিট পর সিয়াম টাংকির পানির বারোটা বাজাতে আসবে সেটা তিনি স্বচক্ষে দেখার জন্য চললেন সেদিকে ।
দোকানদারের কথামতন ছাদে তিনি সিয়ামকে দেখলেন।প্যান্ট খুলে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
পুরো দৃশ্য নিজের চোখে দেখে কপাল মুছতে মুছতে জনাব হাবিবুল্লাহ সোজা হেঁটে চলে গেছেন।
আর এই এলাকাতে পা রাখবেননা বলে শপথ ও করেছেন।
ওদিকে মিসেস সোনালী,পূর্ণতা সব তৈরি করে মেয়েপক্ষের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।সেসময় দাদাজানের কাছে ফোন আসলো ওনারা নাকি আসবেননা।তিনি জানতে চাইলেন কেন আসবেনা।উত্তরে জনাব হাবিবুল্লাহ জানালেন তাদের পরিবার ওনার পছন্দ হয়নি।লোকজনের মুখ থেকে পজিটিভ কিছু শোনেননি,যা শুনেছেন তার সবটাই নেগেটিভ।
বেলায়েত হোসেন বেজায় রেগে বসে আছেন।তিনি যতদূর অনুমান করেন তার পরিবার নিয়ে কেউ খারাপ বলতেই পারেনা।এত নামকরা বংশ তাদের।তবে কেন এভাবে বিয়ে ভেঙ্গে গেলো?নিশ্চয় ফারাজ পূর্ণতাকে নিয়ে লোকমুখে বাজে মন্তব্য শুনেছে তারা।
রাগে ক্ষোভে চুপ করে থাকলেন তিনি।সময়ের অপেক্ষাতে আছেন কেবল।
ফারাজ কান পেতে সব শুনেছিল দাদাজান যখন ফোনে কথা বলছিলেন।
সব শুনে মনের আনন্দে ধেইধেই করতে করতে চলে গেছে সে।ফারাজকে লাফিয়ে লাফিয়ে নিজের রুমে যেতে দেখে পূর্ণতা ভাবছে কি এমন হলো যে এই ব্যাটা এত খুশি!প্রতিমার চেয়েও সুন্দর মেয়ে পাইছে বাকি!
তারপর ভাবলো বিয়েটা মনে হয় হবেনা।তবে কেন হবেনা? নাহলে তো আবার পূর্ণতার ঘাড়ে এসে পড়বে। সেই চিন্তায় পূর্ণতার মন গেলো খারাপ হয়ে।
মিসেস সোনালী সব গুছিয়ে সোজা দাদাজানের রুমের দিকে গেছেন ওনারা কখন আসবেন তা জানার জন্য।
———–
আনাফ শুয়ে শুয়ে সারথির একটা
ছবি দেখছিল।সারথির একটা সমস্যা আছে বলেই কি সৃষ্টিকর্তা ওকে আরেক দিক দিয়ে এত দিলেন?কেন যেন আমার কাছে ওর দূর্বলতা সামনে আসেনা।সবার আগে সামনে আসে এই মায়াবী মুখ।নাহলে ডাক্তার হয়ে একজন বিবাহিত,অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করা সমাজ অন্য চোখে দেখবে।বন্ধুবান্ধবরা হাসাহাসি করবে।এতসব পেরিয়েও সে সারথিকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। সারথি হয়ত ভাববে দয়া দেখাচ্ছে আসলে কিন্তু তা নয়।সারথিকে ১ম দিন দেখার পর থেকেই আনাফের মনে ওর জন্য আলাদা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। ধীরে ধীরে কথা বলতে বলতে মনে হলো মেয়েটার মন স্বচ্ছ।ভুল জায়গায় পড়েছে মেয়েটা,হয়ত তার কপাল খারাপ সে জন্য এমনটা হলো ওর জীবনের সাথে।।
কাল সারথি যখন হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে ছিল তখন ছবিটা তুলেছে আনাফ।ওকে একা একা দেখার জন্যই এই কাজ করা।এমনিতে তো সহজে দেখা হয়না তাদের।
কিন্তু মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।সুইসাইডের চিন্তা যার মাথায় একবার ঢুকে তার থেকে ঐ চিন্তা বের করা মুশকিল হয়ে পড়ে।আবারও চেষ্টা করতে পারে।
‘ যদি আসার সময় ওর পরিবারকে বলে আসতাম ওকে চোখে চোখে রাখার জন্য।কি ভুল হলো!কাল একবার যাবো?না থাক!ওনারা আবার কি ভাববেন!’
——–
লেভেনের জ্ঞান ফিরেছিল অনেক আগেই।কিন্তু সে ইচ্ছে করেই চোখ খুলছেনা।ঠিক করে রেখেছে সারাদিনেও খুলবেনা।সজীবের বেডরুমে, ওর কাছাকাছি থাকার এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবেনা।
সজীব ভাল ডাক্তার একজনকে কল করে আসতে বলেছে।চিন্তা হচ্ছে লেভেনের জন্য।বেশি দেরি হলে আবার ক্ষতি না হয়ে যায়।কল দেয়া শেষে কাছে এসে ওর হাত ধরে সব চিন্তা করছিল সে,তখনই ও টের পেলো লেভেনের ঠোঁটে হাসি।অজ্ঞান হওয়া মানুষ তো হাসতে পারেনা।এবার সজীবের সন্দেহ হলো।সে বুঝে গেছে লেভেন নাটক করছে।তাই একটা বুদ্ধি বের করলো হাতেনাতে ধরার জন্য।তাই
লেভেনকে শুনিয়ে শুনিয়ে সারথিকে সে কল করে।আসলে সে কল করেনি।ওকে শুনিয়ে কথা শুরু করলো নিজে নিজেই।বললো,’সারথি আমার একা লাগে।আমার একটু তোমার সঙ্গ চাই সারথি।প্লিজ সারথি! আমাকে আর দূরে ঠেলে দিওনা’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সজীব এসব বলছিল।তখনই দেখলো লেভেন উঠে বসে গাল ফুলিয়ে চেয়ে আছে এদিকে।সজীবের মুখে হাসি ফুটলো ওকে দেখে।হাসতে হাসতে সে পেছনে ফিরে বললো,’সারথি আজ রাখছি।আমার ভালবাসার মানুষের জ্ঞান ফিরেছে’
———–
ফারাজ মনের আনন্দে একটা ছবি আঁকতে বসেছিল, সেসময় দাদাজান হাজির হলেন ওর রুমে।সে তখনও টের পায়নি।মুখে হাসি ফুটিয়ে মন দিল লাগিয়ে ছবি আঁকছে।
দাদাজান অনেকক্ষণ ধরে ওর আঁকা ছবি দেখছিলেন।একটা গ্রামের দৃশ্য আঁকছে ফারাজ।যদি এটা হতো পূর্ণতার ছবি তাহলে দাদাজান ধরে বিয়ে করিয়ে দিতেন।তার সন্দেহ ছিল ফারাজ নিশ্চয় পূর্ণতার ছবি আঁকছে।কারণ ওর মুখে যে হাসি ছিল এমনটা ভাবারই কথা।
পরে গ্রামের দৃশ্য দেখে তিনি হালকা কেশে জানান দিলেন তিনি এসেছেন।ফারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দাদাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
‘কিছু বলবেন দাদা?’
‘তোমার এত আনন্দে থাকার কারণ কি জানতে পারি?’
‘কিসের আনন্দ?’
‘আমি জানতাম তুমি ছবি আঁকার সময় দাঁত কেলাও না।তবে আজ কেলাচ্ছিলে কেন?’
‘কই না তো!’
‘আমার চোখে আমি এখনও ভাল দেখি।মিথ্যে প্রমাণ করবেনা ‘
‘মনোরম এক দৃশ্য দেখে মন থেকেই এমন হাসি আসে,আপনি দেখুন, আপনারো হাসি আসবে’
‘থামো!এসব আজগুবি লজিক আমাকে দেখাতে আসিওনা।আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি কেন এত খুশি।কারণটা সহজ।সেটা হলো হাবিবুল্লাহ তোমাকে দেখতে আসছেনা,বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছেন সেই খুশিতে তুমি এমন লাফাচ্ছো’
‘আরেহ না।ডাহা মিছা কথা।আমি তো জানতাম ও না। বিয়ে যে ভেঙে গেছে তা মাত্র শুনলাম’
‘শুধু একবার তোমার সাথে পূর্ণতা সম্বন্ধীয় কিছু শুনি তারপর দেখিও কি করি’
———-
পূর্ণতা বাগানে গিয়ে হেঁটে হেঁটে বাদাম খাচ্ছিল সেসময় খেয়াল করলো গেটের বাইরে এক লোক দাঁড়িয়ে বারবার করে কি যেন দেখছেন।বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে পূর্ণতা একটু এগিয়ে আসলো লোকটার দিকে।তারপর সালাম দিয়ে জানতে চাইলো ওনার কি চাই।লোকটা আর কেউ নয়, হাবিবুল্লাহ।চায়ের দোকানদার তো বাইরের লোক।বাইরের লোকের কথা ধরে বিয়ে ভাঙ্গা তার কাছে ভাল লাগেনি বলে আরও একবার যাচাই করতে চলে আসলেন।
‘তুমি এই বাড়ির কে হও মা?’
‘আমি বেড়াতে এসেছি।আমার বাবা এই বাড়িতে আগে থাকতেন।সেই সূত্রে আমার সাথে ওনাদের ভাল সম্পর্ক’
‘আচ্ছা তুমিও তো নতুন।তোমার কাছে এই বাড়ির মানুষদের কেমন লেগেছে?আমি শুনলাম ওনারা নাকি অপরিষ্কার? ‘
পূর্ণতা থতমত খেয়ে গেলো।তাও সব দিক বিবেচনা করে সে বললো,’ততটাও না।টাংকি ময়লা হলে পরিস্কার করানো হয়।এটা কোনো বড় ব্যাপারনা’
‘মনের দিক দিয়ে কেমন?’
‘বেশ ভাল।প্রতিটা মানুষ দারুণ মনমানসিকতা বহন করেন,আমার বেশ ভাল লাগছে ওনাদের সাথে থাকতে।’
‘ছেলে কেমন?’
পূর্ণতার মন চাইছিল সব সত্যি বলে দিতে কিন্তু ফারাজের বিয়ে হলে তো ওরই লাভ।নাহলে ফারাজ অবিবাহিত থাকলে ওর আর ফারাজের বিয়ে হবার ঝুঁকি আছে।তাই সে দাঁত কেলিয়ে বললো,’ওনার মতন ভাল ছেলে এই টলাকায় আর একটা নাই।এত ভাল এত ভাল!আপনার মেয়ে একদিনে পাগল হই যাবে’
‘পাগল হই যাবে মানে!’
‘মানে এত ভাল যে তাই।খুশিতে পাগল হই যাবে’
‘কিরকম ভাল?’
‘ ভদ্র ছেলে।মেয়েদের দিকে তাকায়না।ভাল বংশের ছেলে।আর কি লাগবে আপনার? ‘
‘তোমার প্রতি ওর ইন্টারেস্ট কেমন?’
‘আমাকে তো সহ্যই করতে পারে না।এটাই তো ভাল তাই না?’
‘তাহলে আমার মেয়েকে সহ্য করবে কিভাবে?’
‘আপনার মেয়ে তো আমার মতন বেড়াতে আসবেনা,বউ হয়ে আসবে তখন তারে সহ্য তো করতেই হবে’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৩
#আফনান_লারা
________
পূর্ণার কথাগুলো জনাব হাবিবুল্লাহর অনেক অনেক ভাল লাগলো। এতই ভাল লাগলো যে তিনি তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে আসতে বলে দিছেন।তারপর একসাথে দুজনে ঐ বাসায় যাবেন।লোকটাকে হাসিমুখে যেতে দেখে পূর্ণতা নিজেও খুশি খুশি বাদাম খেতে খেতে বাগানের আরও ভেতর দিকে গেলো।এই দিকটায় এত বনজঙ্গল। সাপ থাকা একেবারেই অস্বাভাবিক কিছুনা।মতিনকে অনেকবার করে সায়না বলেছে এগুলো পরিষ্কার করতে।মতিন এইদিকটা পরিষ্কার করতে আসে সেটা ঠিক কিন্তু বানুকে যখন বাউন্ডারির ঐ প্রান্তে দেখে তখন তার কাজ ভুলে সে প্রেমে লেগে পড়ে।এমন করে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে কাজটা হচ্ছেইনা।এইদিকে বর্ষার পানি পেয়ে বনগুলো যেন ফুলে ফেঁপে উঠে দিনের পর দিন।পূর্ণতা বন দেখে সাপগোপের কথা না ভেবে বনে হাত বুলিয়ে দেখে মনের সুখে বাদাম খাচ্ছিল।
তখন চিকন আকৃতির একট সাপ সেই বনের মধ্যেই ছিল।।পূর্ণা বনটাকে ধরে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দিয়েছে বলে সাপটার ডিস্টার্ব হলো ভীষণ।সে ভাবলো পূর্ণতা ওকে মারতে এসেছে সুতরাং আত্ন রক্ষার খাতিরে ধরে এক কামড় বসিয়ে দিতে হবে এই ভেবে সাপটা বেরিয়ে পূর্ণতার পায়ের কাছে গিয়ে বসিয়ে দিলো এক কামড়।
পূর্ণতার হাত থেকে বাদাম পড়ে গেলো তখনই।বাদামের খোসাটা গিয়ে পড়েছে সাপের মাথায়।আর একটুর জন্য সাপটা নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো।সে নিজেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে, এদিকে পূর্ণতা নিচে চেয়ে সাপের লেজ দেখে তার দুনিয়া দারি অন্ধকার হয়ে গেছে।চিৎকার চেঁচামেচি করে সে মাটিতে বসে পড়ে।সাপটা মোটেও বিষদর ছিলনা।কামড়ে পূর্ণতার ভয়টাই ওকে অসুস্থ করে তুলছে।ওর চিৎকার সবার আগে ফারাজ শুনেছে।কারণ সে তখন ছাদে ছিল।ছাদ থেকে বাগানে চেয়ে পূর্ণতাকে চেঁচামেচি করতে দেখে সে ছুটে আসলো এদিকে।ওকে দেখে পূর্ণতা আঙুল তুলে বললো,’খবরদার কাছে আসবেন না।’
‘কেন?আর আপনার কি হয়েছে?ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছেন কেন?’
‘সাপে কামড় দিয়েছে’
‘সেকি!!!দেখি দেখি!’
ফারাজ আরও এগিয়ে আসলো।পূর্ণতা ওকে আবারও থামিয়ে বললো,’দূরে থাকুন।দাদাজান বলছেন আমাদের একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিবেন’
‘তাই বলে কি মরতে দিব আপনাকে?’
ফারাজ নিচে বসে পূর্ণতার পা চেপে ধরলো।কামড়ের দাগ বসেছে,রক্ত ও বের হচ্ছিল।পূর্ণতা কাঁপছে অনবরত।ভয়ের কারণে তার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছিল।ফারাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকবার মতিনকে ডাক দিছে কিন্তু সে তো আবার কানে কম শুনে।দূরের আওয়াজ তার কানে জীবনেও আসেনা।বাধ্য হয়ে ফারাজ পূর্ণতাকে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে সোফায় বসালো।মিসেস সোনালী ওখানেই ছিলেন।এমনটা দেখে এসে জানতে চাইলেন কি হয়েছে।সাপের কামড় শুনে তিনি জোর গলায় সবাইকে ডাকা ডাকি শুরু করে দিছেন।এদিকে ফারাজ গেছে ফার্মেসীর দিকে।পূর্ণতা ভয়ে ভয়ে দাদাজান কোথাও আছেন কিনা সেটাই দেখছে।
ফারাজ বাতাসের গতিতে ছুটে ফার্মেসি থেকে একজন সাধারণ ডাক্তার নিয়ে এসেছে।
দোকানদার আজ অবাক হয়ে শুধু ফারাজের দৌড়ই দেখছিলেন।জীবনে এই ছেলেকে তিনি দ্রুত হাঁটতে পর্যন্ত দেখেননি।আর আজ তিনি কিনা দেখলেন ঐ ছেলে বাতাসের গতিতে ছুটছে।কি এমন হলো?
চায়ের দোকানে নিজের মেজো ছেলেকে বসিয়ে তিনি দেখতে নেমেছেন মূল কাহিনী।
আফসোস গেইট অবধি এসে আর ভেতরে ঢুকতে পারলেননা।মতিন ওনাকে বরাবরই অপছন্দ করেন।আজ সেটার প্রমাণ ও দিয়ে দিলো।
দোকানদারের বুকের ভেতর হাশপাশ করছে একটিবার জানার জন্য যে ফারাজ কেন ছুটছিল।শেষে বাধ্য হয়ে মতিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।হাসিমুখে গেটের উপর হাত রেখে বলেন,’মতিন মিয়া ভাল আছো?’
‘এতক্ষণ ছিলাম।আপনাকে দেখে ভাল থাকা বাপের বাড়ি চলে গেছে’
দোকানদার নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।মতিন যাই বলুক ওটাতে পাত্তা দেয়া যাবেনা।জরুরি হলো ভেতরের খবর জানা।
———-
‘ফারাজকে দেখলাম ছুটে একবার বাজারের দিকে গেলো,আবার দেখলাম ছুটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে।ঘটনা কি জানো?’
মতিন হাত তুলে বললো,’এত্ত বড় একখান সাপ বাগানে ঢুকছে।কাইট্টা দিছে আমাদের মেহমানকে।তাই ঔষুধ আনতে গেছে ভাই’
‘মেহমান?কিরকম মেহমান?’
‘দাদাজানের দূর সম্পর্কের এক ছেলের মেয়ে।নাম পূর্ণা’
‘ওহহহহ।বয়স কত?’
‘কেনো?ছেলে দেখবেন?’
‘দেখতে তো সমস্যা নাই’
‘এই হবে তেইশ/ চব্বিশ! ‘
‘তাহলে তো কেল্লা পথে!’
‘কেনো কেনো!’
‘ঘরেই তো ছেলে আছে।ফারাজের সাথে ওরে বিয়ে দিলেই হয়’
‘বিয়া বললেই হয়?ভাগেন তো!’
‘আরেহ মতিন ভাল বুদ্ধি দিলাম।কথাটা গিয়ে বেলায়েত আঙ্কেলকে কইও।যদি বিয়েটা ঠিক হয় তবে আমি হয়ে যাবো উকিল চাচা।তোমাকেও একটা কিছু বানিয়ে দিবো। চিন্তা করোনা’
মতিন ভেংচি কেটে অন্যদিকে ফিরে গেছে।এদিকে দোকানদার ভাবছে অন্য কিছু।মুখে যাই বলুক ভেতরে ভেতরে তিনি ভাবছেন ফারাজ আর পূর্ণতা হয়ত প্রেম করছে।
এসব ভাবতে ভাবতে নতুন গল্প বানাতে বানাতে তিনি তার দোকানে চলে গেছেন।
পূর্ণতার পায়ের ব্যাথা সারার জন্য কিছু ঔষুধ লিখে দিয়েছে ডাক্তার।তারপর চলে গেছে।পূর্ণতা এখন শক্ত হয়ে বসে আছে।ভয় ছাড়া বারতি কিছু নেই।হালকা পা ব্যাথা কেবল।ওটা সেরে যাবে।বেশি চিন্তাভাবনা করেনা সে এটা নিয়ে ।তার মাথায় শুধু ঘুরছে দাদাজান যেন আর উল্টাপাল্টা কিছু না ভাবেন।
ফারাজ অবাক করা কাজ করছে আজ,পূর্ণতাকে নিয়ে সে এত ভাবে তা পূর্ণতাও জানতো না।অবাক হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা।
———-
সারথি আজ আবারও একা একা বেরিয়ে পড়েছিল।সজীবকে সব ভুলে শেষবার ফোন করেছিল কিছুক্ষণ আগে।কলটা সজীবের দ্বারা ভুলে রিসিভ হয়।সে লেভেনকে নিয়ে হাসাহাসিতে মেতে ছিল।ফোন পকেটে থেকে চাপ লেগে রিসিভ হয়ে পড়ায় সারথি সব শুনেছে।সজীব ওখানে কত খুশি।
তার হয়ত তখন কল দেয়াটাও ঠিক হয়নি।
একা একা পথ চলছে সে।গন্তব্য যেকোনো একটা নদী।ডুবে মরবে।
কতক্ষণ দম বন্ধ থেকে সে চিরজীবনের জন্য মারা যাবে।ছাদ থেকে পড়ে,গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়েও যখন সে মরলোনা তবে আজ পানিতেই ডুবে মরার চেষ্টা চালাবে।এখানে নিশ্চয় আনাফ আসবেনা।পথে লোকদের জিজ্ঞেস করে করে সে পথ চলছে।কাছাকাছি একটা নদী আছে।এটা সারথি জানে এবার মানুষ জিজ্ঞেসা করে চলছে।
নদীর কাছাকাছি আসতেই লঞ্চ স্টিমারের আওয়াজ ভারী হয়ে উঠলো।সারথি বুঝে গেলো সে নদীর খুব কাছে চলে এসেছে।
পাশেই এক লোকের কথা শুনতে পেলো সে।লোকটা বাদামওয়ালা থেকে বাদাম কিনে খাচ্ছে আর বাদামের দাম বেশি কেন সেটা নিয়ে দরকষাকষি করছে।সারথি সেদিকে গিয়ে বললো,’ভাই আমাকে একটি নদীর কিণারা দেখিয়ে দেবেন?’
লোকটা বাদাম খাওয়া বন্ধ করে বললো,’মনে হয় চোখে দেখেননা।কি দরকার কিণারায় যাওয়ার?’
‘আমার ইচ্ছে পানির কিণারায় এসে স্রোত আঁচড়ে পড়ার আওয়াজ শুনব।প্লিজ বলে দিন’
লোকটা বললো সোজা গিয়ে নিচে নামতে।সারথি সেই কথামতন সোজা গিয়ে নিচে নামছে এবার।
অনেক কষ্টে নিচে নামলো সে।তারপর বসে থাকলো গালে হাত দিয়ে।
আজ ওখানে আনাফ ও এসেছে।তাজা ইলিশ মাছ কিনতে।পাঁচটা দশ মিনিটে একটা ট্রলার ইলিশ মাছ নিয়ে আসবে।ওটা থেকে নিলামের দরে সে ৩০টা ইলিশ মাছ কিনবে।আগে থেকে খবর নিয়ে রেখেছিল।অনেকদিন ধরে ইলিশ মাছ খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল।আজ সময় করে তাই সে এদিকে এসেছে।এখানে সে এসেছে আরও আধ ঘন্টা আগে।এত সুন্দর পানি দেখে তার গোসল করতে মন চাইলো।তাই গায়ের নীল রঙের টি শার্টটা খুলে কিণারায় শুকনো জায়গায় ফেলে সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।সাঁতরে পানির মাঝেও চলে গেছে।কি যে ভাল লাগছে তার।কতদিন পর নিজেকে কেমন যেন স্বাধীন মনে হচ্ছে।উপর থেকে একটা সেতু দেখা যায় সেটা দেখতে দেখতে আনাফ শুয়ে শুয়ে সাঁতার কাটছে।হাসা অবস্থায় হঠাৎ ডান পাশে তাকালো সে।দূরে বসে থাকা লাল শাড়ী পরা মেয়েটিকে একদম সারথির মতন দেখতে।ও এখানে কেন আসতে যাবে তা ভেবে আনাফ গুরুত্ব না দিয়ে সাঁতরে আরও দূরে চলে গেলো।স্রোত বেড়ে যাচ্ছে,
সন্ধ্যা নামছে বলে।সাঁতারানোর সময় আনাফ আরও একবার সেই কিণারায় তাকাতেই দেখলো মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েই হুট করে চোখের সামনে ঝাঁপ দিয়ে দিয়েছে পানিতে।
এটা দেখে আনাফ কোনোদিক না ভেবে দ্রুত সেদিকে সাঁতরে গেলো।মেয়েটিকে যতজন ঝাঁপ দিতে দেখেছে সবাই হইচই করতে করতে দেখতে চলে আসলো কিন্তু কেউ বাঁচাতে পানিতে নামলোনা।
সারথি দম ছেড়ে দিয়েছে ইচ্ছাকৃত। আনাফ যত দ্রুত পারছে আসছে কিন্তু স্রোতের কারণে তার বেগ কমে আসছে।ততটাও দক্ষ না সে।অনেকবছর পর পানিতে নেমেছে।এর আগে মনে হয় পাঁচ ছয় বছর আগে নানুর বাড়িতে পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল।তাই সাঁতারে তার
কষ্ট হচ্ছে।তাও কাছে এসে পানিতে ডুব দিলো সে।সারথি দম ছেড়ে যখন টের পেলো তাকে দিয়ে মরা হবেনা,তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।নাকে দিয়ে পানি ঢুকে তার ভেতরটা জ্বলছে।বাঁচার জন্য সে চোখ খুলে তাকালো।উপরটা অন্ধকার।সন্ধ্যা বলে কোনো আলো নেই পানির ভেতর।এমনিতেও সারথি চোখে অন্ধকারই দেখে সবসময়।
হাত উপরে তুলে সারথি উঠার চেষ্টা করলো।সে সাঁতার জানেনা।তাও উপরে উঠার বৃথা চেষ্টা করে সে ব্যর্থ।দম চেয়েও এখন সে ধরে রাখতে পারছেনা।হেরে গিয়ে সারথি আরও একবার দম ছেড়ে দিয়েছে ওমনি পিঠের তলা দিয়ে আনাফের হাতের ছোঁয়া পেলো সে।ততক্ষণে সে চোখ বুঝে ফেলেছে,জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।আনাফ ওকে শক্ত করে ধরে উপরে নিয়ে আসলো।উপরে তুলতেই সারথির মুখ দেখে আনাফ যেন আকাশ থেকে পড়েছে।ওকে জলদিতে কিণারায় নিয়ে এসে শোয়াতেই দেখলো আশেপাশে মানুষে ভীড় ধরে গেছে।জলদি করে সারথির আঁচল টেনে ওর গা ঢেকে পালস চেক করলো সে।পানি ঢুকে গেছে শরীরে।পেটে চাপ দিয়েও লাভ হচ্ছেনা।সারথির ঠোঁট ছুঁয়ে পানি বের করা কিংবা হাওয়া দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।পেটে চাপ দিয়েও পানি বের করা যাচ্ছেনা।দম আটকে আছে ওর মনে হয়।বাতাস ঢুকাতে হবে মুখে।সবাই বলছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে কিন্তু কেউ জানেনা আনাফ নিজেই ডাক্তার।সারথির মুখ ধরে সে বাধ্য হয়েই হাওয়া দিলো মুখে।অনেকবার দিয়েও কোনো রেসপন্স না পেয়ে সারথিকে তুলে সে সামনের দিকে গেলো।রোডেই তার গাড়ী।জলদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, এখনও বেঁচে আছে ও।
সকলে ওর পিছু পিছু আসছে।আনাফ সারথিকে গাড়ীতে তুলে ড্রাইভিং সিটে বসে স্পীড বাড়িয়ে হাসপাতালের দিকে গেছে।টি শার্টটা ওখানেই রয়ে গেছে।আনাফের গা খালি।সারথি এমন কিছু করবে তা জানা ছিল কিন্তু সেটা এত দ্রুত করবে তা জানা ছিল না ওর।
তার নিজেরই দম বন্ধ হয়ে আছে।সারথিকে বাঁচানো জরুরি।প্রাথমিক উপায়ে পারেনি বলে বুকের ভেতর ভয় ঢুকে আছে। ওরে যেকোনো মতে বাঁচাতে হবে।সারথি চোখ খুলছেনা এখনও।কাছেই একটা হাসপাতাল আছে এদিকে,নতুন হয়েছে।তবে চালু হয়েছে। ওটাতেই নিচ্ছে আনাফ।সারথি মরতে পারেনা।ওকে মরতে দিবেনা আনাফ,কিছুতেই না।এত সুন্দর জীবন নষ্ট হতে দিবেনা সে।
———–
পূর্ণতা তার রুমে বসে আছে।ড্রয়িং রুম থেকে মেহমানদের হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে।ফারাজকে হাবিবুল্লাহর পরিবারের কজন দেখতে এসেছেন।
তাদের নিয়েই যত হট্টগোল।পূর্ণতা চুপচাপ বই পড়ছে।ফারাজ তার নিজের রুমেই ছিল।হাবিবুল্লাহর পরিবার দেখে তার মেজাজ গরম হয়ে আছে।কিছু ভাল্লাগছেনা
ফারাজকে একটা নীল পাঞ্জাবি ধরিয়ে দাদাজান চলে গেছেন।ওটা পরে নিচে আসতে বলেছেন। ফারাজের রঙিন কিছু ভাল লাগেনা।দাদাজান ওকে ওর অপছন্দের সবকিছুতে বাধ্য করেন।
চলবে♥