ডাকপাড়ি পর্ব -২৪+২৫+২৬

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৪
#আফনান_লারা
________
পূর্ণতা এত হইহুল্লড় শুনে বাধ্য হয়েই নিজে নিজে বের হয়েছে দেখার জন্য।ড্রয়িং রুমে যেতে যে সিঁড়ি আছে সেটাতে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই দেখার চেষ্টা করছে পূর্ণতা।
সোফায় মধ্য বয়স্ক তিনজন বসে আছেন।একজনকে সে চিনে।জনাব হাবিবুল্লাহ তিনি।সবাই হাসছে।শুধু কি কথা নিয়ে হাসছে তা বুঝতে পূর্ণতা আরেকটু নিচে নামে।তখন বুঝে তারা ফারাজ আর ওর হবু বউয়ের গুণ নিয়ে মজা করছে।দুজনের নাকি অনেক মিল।বিয়ের পর কোনো ঝগড়া হবেনা এটা ওনাদের ধারণা।পূর্ণতা সব শুনে আবারও রুমে আসতে গিয়ে দেখতে পায় ফারাজকে।সে নীল পাঞ্জাবি পরে এদিকেই আসছিল।পূর্ণতাকে দেখে রেগে গেলো সে।ব্রু কুঁচকে বললো,’কি সমস্যা?আপনার তো রেস্ট করা উচিত।এদিকে কি করেন?’

‘আমি ন্যাকামি পারিনা।সাপকে ভয় পাই,সাপের কামড়ে না।আমি বেশ ভাল আছি।আপনি যান ওদিকে।সবাই আপনার অপেক্ষায় আছে’

ফারাজ আর কিছু না বলেই চলে গেলো।পূর্ণতা আর রুমে গেলো না।ওখানে দাঁড়িয়েই দেখছে কি হয়।
ফারাজ সবাইকে সালাম দিয়ে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাব হাবিবুল্লাহর সাথে এসেছেন ওনার স্ত্রী আর বোন।সবাই ফারাজের দিকে চেয়ে আছে এখন।ফারাজের লজ্জা লাগলো।প্রথমবার এভাবে কেউ ওকে দেখতে এসেছে।তার উপর কেমন করে যেন সবাই চেয়ে আছে।
হাবিবুল্লা্হ ফারাজকে বসতে বলেন।ফারাজ ঠিক আছি বলে দাঁরিয়ে ছিল কিন্তু দাদাজানের ধমকে বসতে বাধ্য হলো।দাদাজান ওর ঘাড়ে হাত রেখে হাসি মুখে বললেন,’ও আমার আদরের নাতি।আমার কথায় বলতে গেলে উঠে- বসে।ছোটকাল থেকেই আমায় খুব সম্মান করে।ঠিক অর্কর মতন।অর্ক হলো ফাহাদের ছেলে।ফাহাদকে তো চিনেনই।সে এখন নাই এখানে।বিয়ের কথা পাকা হলেই এসে পড়বে।আপনারা মিষ্টি মুখ করুন না সকলে।বসে আছেন কেন?’

হাবিবুল্লাহ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।ফারাজকে প্রশ্ন করা জরুরি। প্রশ্ন সব গুছিয়েই এনেছেন, এবার শুধু বলার পালা।ওনাকে এভাবে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে ফারাজের দাদা বলেন ‘আপনার কিছু জানার থাকলে জেনে নিতে পারেন ওর থেকে’

‘হ্যাঁ অবশ্যই।আচ্ছা বাবা তুমি যে চাকরি করো সেটাতে তোমার ইনকাম কিরকম?’

‘ ছবি যত আঁকবো তার উপর নির্ভর করে পারিশ্রমিক। ‘

‘তার মানে ত্রিশ দিনে ত্রিশ টা ছবি আঁকলে একটা ছবি এক হাজারের উপরে বিক্রি করলে তোমার বেতন দাঁড়ায় ৩০হাজার?’

ফারাজ হাসলো।হাসিকে এক পাশ করে বললো,’ছবি তো সহজে আঁকা যায়না আঙ্কেল।একটা ছবির পেছনে সময় এবং মেধা দুটোই দিতে হয়।একটা ছবি আঁকতে আমার চার পাঁচদিন লেগে যায় অনায়াসেই’

‘তার মানে তোমার তো মাসে পনেরো হাজার ও আসেনা? ‘

ফারাজ আবারও হাসলো।তারপর বললো,’৩০হাজারই পাই।এবার বলবেন কিভাবে।আমি বলছি কিভাবে।আমার একটা ছবি এক হাজার নয় বরং চার হাজারেও বিক্রি হয় কখনও কখনও।’

‘এত দাম?’

‘আপনি নিজের চোখেই দেখে নিন।আপনার পেছনে দেয়ালে যে ছবিটি টাঙানো ওটা আমারই আঁকা’

‘এক্সিলেন্ট!আমি তো ভাবলাম জানতে চাইবো এটা কোথা থেকে কেনা’

দাদাজান পায়ের উপর পা তুলে বললেন,’খাঁটি সোনা আমার নাতি।এবার আপনার মেয়ে নিয়ে কিছু বলুন’

‘তাকে নিয়ে বলে শেষ করা যাবেনা।রুপে গুণে সব দিক দিয়েই আছে।কমতি পাবেননা।যাকে বলে পারফেক্ট ‘

‘আমাদের ছেলে তো পারফেক্ট না।আপনার পারফেক্ট মেয়ের জন্য তো সরকারি চাকুরজীবি খুঁজতে পারেন,আমাদের ছেলে কেন?’

‘একটা পেলে একটা পাইনা”

‘তো এখন বুঝি পেয়েছেন?’

মিসেস সোনালী তখন দাদাজানের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,’মেয়ের হয়ত কোনো সমস্যা আছে নাহলে এত পারফেক্ট মেয়ে আমাদের ফারাজের জন্য কেন আসবে?’

জনাব হাবিবুল্লাহ হালকা ঝেড়ে কেশে বললেন,’আসলে হয়েছে কি! আমার মেয়ের একবার ফোনে বিয়ে হয়েছিল।ছেলে আসেনি দেশে তার আগেই ছেলের সাথে ওর ডিভোর্স হয়ে যায়।এটা তো বিয়ে ছিল না তাই না?ওদের তো একসাথে থাকা হয়নি। এটা নিয়ে অনেক পরিবার কটু ভাবে।এটাই আসলে সমস্যা, তাছাড়া আমাদের মেয়ের কোনো সমস্যা নেই’

দাদাজান ফারাজের মুখের দিকে তাকালেন।ফারাজ চুপ করে আছে।মিসেস সোনালী গেলেন রেগে তাও দাদার ভয়ে গলার আওয়াজ কমিয়ে বললেন,’কি কারণে ডিভোর্স হয়েছিল?’

‘আর কি বলবো আপা!ছেলে চায় সারাদিন ফোনে কথা বলতে।পারোনা ফোনের ভেতর ঢুকে আমার মেয়েটাকে বিদেশে নিয়ে যায়।এত জ্বালাতন কার সহ্য হয়?বাথরুমে গেলেও ভিডিও কল দেয়।কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এমন করতে পারে?১ম দশ বারোদিন বাথরুমেও ভিডিও কলে কথা বলেছে।তাও হয়না ছেলের।সে চায় যতবেলা বাথরুমে যাবে ততবেলা ভিডিও কল।
মেয়ের কি খাওয়া দাওয়া নাই?জীবন নাই?ছেলে নাহয় চাকরির কাজে সারাদিন বসে থাকে অফিসে তাই বলে কি আমার মেয়েও বসে থাকে?তারউপর ছেলের মা- বাবা বিয়ে হয়েছে বলে আমার মেয়েকে তাদের বাসায় নিয়ে রেখেছেন।যে কাজ ওখানে!!কি করে সময় দিবো ছেলেকে?’

‘এটাই কি ডিভোর্সের কারণ?এটা তো তুচ্ছ একটা ব্যাপার!’

‘আপা সমস্যা তো সেটা না।মেয়ে গিয়ে দেবরকে এসব নিয়ে বলতো।কষ্টের কথা শেয়ার করতো!ওমনি হয়ে গেলো বিপত্তি।আজকালকার মানুষ এত নিচ!!আমার মেয়েকে সন্দেহ করে! মেয়ে নাকি দেবরের সাথে প্রেম করে।কত বড় অভিযোগ তুলেছে ভাবতে পারেন?’

‘তো আপনারা দুই পরিবার মিলে বুঝাননি?’

‘বুঝাইছি মানে!ছেলের পরিবার আরও খারাপ।তাদের ও এক কথা আমার মেয়ে নাকি দেবরের সাথে ইটিশপিটিশ করে’

দাদাজান বার বার ফারাজের দিকে তাকাচ্ছেন।ফারাজ চুপ করে শরবতের দিকে চেয়ে আছে।পূর্ণতা সব শুনে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে উপরে চলে গেছে।এমনটা হবে আশা করেনি।ফারাজের বিয়েটা হয়ে গেলেই বাঁচা যাবে।শুরুতেই এমন একটা প্রস্তাব আসলো!!কে সত্যি কথা বলছে কে জানে!মেয়েটা যদি ভাল হয়ে থাকে তবে যেন এর সাথেই ফারাজের বিয়ে হয়।
——–
সজীব আজ তার সেই ট্রলি ব্যাগটা খুলে ভেতরের জামাকাপড় বের করছো যেটা সে বাংলাদেশ থেকে আসার পথে এনেছিল।সারথি গুছিয়ে দিয়েছিল ব্যাগটা।দেশে যেগুলো সে পরে,মালেশিয়াতে সেগুলো পরেনা।তাই ব্যাগটা জামাকাপড় সহ তুলে রেখেছিল।এখন ব্যাগটা প্রয়োজন বলে বের করে নিজে নিজে জিনিসপাতি সব বের করছে।হঠাৎ ওর শার্টটা টান দিতেই ঝুনঝুন আওয়াজে কি যেন পড়লো।
একটা ঘড়ি।সজীব অবাক হয়ে ঘড়িটা নিয়ে দেখছে।একটা সুইচ আছে তাতে।সেটাতে টিপ দিতেই সারথির গলা শোনা গেলো।এই ঘড়িটা সজীব আর সারথির বিয়ের সময় সজীবের বাবা সারথিকে দিয়েছিলেন।এটাতে ভয়েস রেকর্ড করে গিফট দেয়া যায়।সারথি সেটাই করেছে এবং কোনোভাবে লুকিয়ে এটা সজীবকেই পাঠিয়েছিল।
সারথি বলছে——-

সজীব ভাইয়া,
জানেন আমার খুব শখ ছিল স্বামীকে ভাইয়া বলে ক্ষেঁপাবো।কিন্তু আপনাকে আর ক্ষেঁপাবো কি আমি নিজেই ভয়ে থাকতাম আপনার সাথে কেমন করে কথা বলা উচিত তা নিয়ে।আপনাকে বুঝতে আমার অনেক সময় লাগতো।সেই সময় পাইনি।আপনি যেন খুব জলদি চলে যাচ্ছেন।আবার কবে আসবেন জানিনা।আপনাকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।একটা অন্ধ মেয়ে এত ভাল পরিবারের একমাত্র বধু হতে পেরেছে এর চেয়ে আর পাওয়ার কি আছে!
তবে হয়ত স্বামীর ভালবাসা চাওয়াটাও বড় কিছুনা।আপনি সেটা দিবেন কিনা তাও জানিনা,কিন্তু আপনার ছোট ছোট কিছু কেয়ার আমার কাছে অনেক মাইনে রেখেছে।আমি সেগুলো নিয়েই দিনের পর দিন থাকতে পারবো। আপনার মনে আছে? আমি খাটের সাথে পায়ে চোট পাওয়ায় আপনি ঘুরতে যাওয়া ক্যানসেল করে বসে বসে পায়ে বরফ দিচ্ছিলেন আমার?
আমার না খুব মনে পড়বে সেই মূহুর্তগুলো। আপনার এই সামান্য কেয়ারে আমার এত যায় আসে,আর আপনি যেদিন আমায় ছুঁবেন সেদিন হয়ত আমি মূহুর্তগুলোকে গুনে গুনে মনে বন্দী করে রেখে দিবো।সেগুলো সারাজীবন বুকে ধরে কাটিয়ে ফেলবো।জানিনা কেন এত ভালবাসি।আমি কোনো মূল্য চাইনা,শুধু পাশে চাই।এরপর অনেক ব্যাথা পাবো।চেয়ার টেবিলের সাথে।নতুন বাড়ি তো।পরিচিত না কিছুর সাথে।
আপনি জলদি ফিরবেন।এখানে আমার এখন আর কেউ নেই আপন বলতে।আপনার বাবা মাও দূরে চলে যাবেন।একা কতদিন থাকবো?প্লিজ জলদি আসবেন’
———-
সারথিকে বেডে এনে আনাফ নিজের পরিচয় দিতেই দুজন ডাক্তার ওর সাথে পরিচিত হয়ে সারথির জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় লেগে পড়েছে।আনাফই পারতো কিন্তু তার হাত পা কাঁপছিল।পারছিল না কিছু করতে।ডাঃ জহির আনাফকে রেস্ট নিতে বললেন।আনাফ ডাক্তারের একটা পোশাক পরে পাশে থাকা চেয়ারে বসে আছে।মাথা কাজ করছেনা।সারথি এত বড় সিদ্ধান্ত কেনো নিয়েছে।সজীব কিছু করেনি তো?যার জন্য ডেস্পারেট হয়ে সে এই কাজ করেছে!সেটাই হবে নাহলে সারথির এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আর কোনো কারণ দেখছেনা সে।
সারথির জ্ঞান ফিরেছে অল্প সময়ের ভেতরেই।জহির আনাফকে ডাক দিলো তখন।আনাফ ছুটে এসে সারথির হাত চেপে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে।সারথি চোখ খুলেছে। আনাফের স্পর্শ পেয়ে চিনতে পেরেছে কিন্তু কিছু বলছেনা।আনাফ জহিরকে ইশারা দিতেই সে আর বাকি ডাক্তার চলে গেলো।আনাফ সারথির কানের কাছে মুুখ নিয়ে বললো,’আপনি এমনটা করতে পারেননা সারথি।আপনার সেই অধিকার নেই।’

সারথি কাঁপা স্বরে বলে,’কেন পারিনা?

‘আমি বলছি তাই পারেন না।একটা মানুষের জন্য আপনি কেন নিজের জীবন দিবেন?’

‘আমার জীবন,আমার ইচ্ছে।আপনি কেন বারবার আমায় বাঁচান?আমাকে শান্তিতে মরতেও দেবেননা?আপনার মাথায় ঢোকেনা কথাটা!এই জীবন আমার অসহ্য হয়ে গেছে’

‘আমায় বিয়ে করবেন মিসেস সারথি?’

‘একজন পছন্দ করে বিয়ে করে মাঝ রাস্তায় হাত ছেড়ে দিয়েছে।ধোকা খেয়েছি,আর খেতে চাইনা।’

‘যদি আমি হাত ধরে রাখি সারাজীবন? ‘

‘আমি সজীবকে ভালবাসি।আমার পক্ষে অন্য কাউকে ভালবাসা অসম্ভব। ‘

কথাটা বলে সারথি উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা।আনাফ ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলে,’আমায় ভালবাসতে হবেনা।টায়ার্ড হয়ে হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন বাড়ি ফিরলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজনবোধ হয়।পাশে বসে গল্প করার,কেয়ার করার মানুষের অভাব।সেগুলো করলেই হবে’

‘ঐ যে বললাম ভালবাসতে পারবোনা।কেয়ার তো ভালবাসা থেকেই আসে।যদি ভালোই না বাসি তবে ওগুলো আসবে কোথা থেকে?’

‘সজীবকে বিয়ের আগে চিনতেন?চিনতেন না।বিয়ের পর তার সাথে কয়েক মাস থেকে তার প্রেমে পড়েছিলেন।আমার সাথেও নাহয় সেটাই হোক।
আমি যতদূর জানি একদিনেই প্রেমে পড়ে যাবেন আমার’

সারথি জোর দিয়ে উঠে বসলো।গায়ে হাত দিয়ে টের পেলো তার সারা শরীর ভেজা।গলা খুশখুশ করছে।গলায় হাত দিয়ে সে চুপ করে থাকলো।আনাফ একজন স্টাফকে ডাক দিয়ে রঙ চা আনতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে টুল টেনে বসে সারথির দিকে তাকিয়ে থাকলো।সারথি আঁচল দিয়ে গা ঢেকে বসে আছে।আনাফ এবার বললো,’আমার বাসায় চলুন। ফ্রেশ হবেন।আলাদা একটা দুনিয়ার সেটা।সজীবের কথা মনে পড়বেনা একবারও’

‘সেখানেই সজীবের বাসা।আমি ধোকা খেয়ে ধোকা দেয়ার মানুষ নই’

‘এভাবে বসে থাকলে জ্বর হবে আপনার।আর আমার কেবল একটাই বাসা না।আমার নিজস্ব বাসাও আছে। যেটা আপনি দেখেছেন সেটা আমার বাবার বাসা।’

‘জ্বরেই মরলে বাঁচি’

‘এত মরার শখ?বিষ এনে দিবো?’

‘দিন’

আনাফ উঠে চলে গেছে।সারথি বিছানার চাদর খাঁমছে নিজেই নিজেকে দুষছে।এত কিছু করেও সে মরতে পারলোনা।বারবার আনাফকে যেন কেউ খবর দিয়ে দেয়।
‘যেই জায়গাতেই থাকি কোথা থেকে চলে আসে।ওনার জন্য মরাটাই মুশকিল হয়ে গেছে আমার।উনি তো জানেননা আমার এভাবে বেঁচে থাকা কত কঠিন।যাকে ভালবাসি সে অন্য কউকে ভালবাসে,তাকে নিয়েই সুখী আছে।এই কথা জেনে কার বেঁচে থাকতে মন চাইবে?হয়ত যারা খুব শক্ত মনের মানুষ তারা ভুলে থাকতে পারে।কিন্তু আমি মোটেও শক্ত না।আমি পারছিনা সইতে।’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৫
#আফনান_লারা
________
জনাব হাবিবুল্লাহ তার স্ত্রী এবং বোনকে নিয়ে চলে যাবার পর থেকে “হাবিজাবি” বাড়িতে নিরবতা পালন হচ্ছে।কেউই ড্রয়িং রুম ছাড়েনি।যে যার জায়গায় বসে গভীর ভাবনাচিন্তা করছে।এমনটা তারা কেউ আশা করেনি।ফারাজ অনেকক্ষণ বসে ছিল সকলের মন্তব্য শোনার জন্য।কিন্তু কেউ কিছু বলছেনা দেখে সে উঠে চলে যাওয়া ধরতেই দাদাজান অবশেষে মুখ খুললেন।বললেন,’তোমার কি পছন্দ হয় মেয়েটাকে?সব তো শুনলে।আমি এ ব্যাপারে জোর দেবোনা।তোমার জীবন,তুমি একটা মানুষের সাথে সংসার করবে।তোমার মত সবচাইতে জরুরি।বলো তোমার মত’

‘বড়দের বুদ্ধি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।আমি আপনাদের মতের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিবো।আর আমি জানি আপনারা আমার জন্য খারাপ কিছু চয়েজ করবেননা”

ফারাজ চলে গেলো কথাটি বলে।দাদাজান বুঝে গেলেন ফারাজের মতামত।মিসেস সোনালী ওনার দিকে চেয়ে আছেন কি হবে তা শুনার জন্য।সোনালীর দিকে চেয়ে এবার বেলায়েত হোসেন বললেন,’এই পরিবার বাদ।আমার হাতে আরও মেয়ে আছে,দেখি।একজনকে ভাল লেগে যাবে
আপাতত এটা বাদ বলতে লোক লাগিয়ে খবর নেবো ঘটনা সত্যি কিনা তারপর সিদ্ধান্ত নিব’

মিসেস সোনালীর মুখে হাসি ফুটলো।তিনি খুশি হয়ে রান্নাঘরে চলে গেছেন।শ্বশুরের উপর ভীষণ খুশি হলেন তিনি।তাই ওনার পছন্দের পাকোড়া বানাবেন এখন।মন ভাল থাকলেই মজার মজার খাবার বানান মিসেস সোনালী।এখনও তাই।
দাদাজান মুখ ভার করে বাগানের দিকে গেছেন।
ফারাজ তার রুমে আসতেই হঠাৎ প্রতিমার কথা মনে পড়ে গেলো।ড্রয়ার খুলে পেন্সিলে আঁকা তার একটি ছবি সামনে ধরে চেয়ে থাকলো ফারাজ।

‘এই মেয়েটিকে দেখলে দাদাজান এক দেখাতেই হ্যাঁ বলে দিতেন।কিন্তু আমার কি ভাগ্য!হাজার চেষ্টা করেও তাকে ধরে রাখায় অক্ষমই রয়ে গেলাম। কেন যে সেই দিনে ওর সাথে জড়িয়ে গেছিলাম।কেন যে আমাদের দেখা হলো।
আচ্ছা!যাকে পাবোনা তার সাথে এত গল্প কেন রটে?যাকে নিজের পাশে দাঁড় করাতে পারবোনা তার সাথে মনের মিল কেন হয়?
কেন একটা মানুষ জীবনে এসে জীবনকে বদলে দিয়ে সেই মানুষটা নিজেই চলে যায়?তাহলে সেই খনিকের আনন্দ জীবনে কেন আসে?আগেই তো ভাল ছিলাম।অল্প সময়ে অধিক আনন্দ জীবনে এসে আবার অল্প সময়েই চলে যায় জীবনকে অন্ধকার করে দিয়ে।
না সেদিন প্রতিমার প্রেমে পড়তাম আর না আজ তার জন্য বুক পুড়তো!
যাকে পাবোনা তাকে নিয়ে কত কল্পনা ছিল।মানুষ কল্পনা করে না পাওয়ার জন্যই।কারণ কল্পনা বাস্তব হয়না বলেই সেটা কল্পনা!’

ছবিটা আগের জায়গায় রেখে ফারাজ চুপ করে বসে থাকলো বিছানায়।কাল একবার পার্কে যাবে।নতুন ছবি আঁকবে।অনেকদিন ছবি আঁকা হয়না।পার্কে যাওয়া ছাড়া ছবিতে মন বসবেনা।
মেঘে ডাক দিলো তখন।ফারাজ বিছানায় উঠে সেই পাশের জানালাটা টান দিয়ে আটকে দিয়েছে।
বাতাসে জানালা বাড়ি খাচ্ছিল।সিরিয়াস সময়ে কোনো কিছুর শব্দ ফারাজের পছন্দ নয়।জানালা বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়েছে সে।
পূর্ণতার রুম থেকে কিসের যেন আওয়াজ বের হচ্ছে।ফারাজ কৌতূহল নিয়ে দেখতে গেলো সেদিকে।
এসে দেখলো পূর্ণতা জানালার দ্বারে বসে জানালা ধরে রাখছে জোর দিয়ে যেন না আটকে যায়।এদিকে ফারাজ বন্ধ করে এসেছে আর এদিকে পূর্ণতা চাইছে যেন জানালা না আটকে।মেঘ ডাকার পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।পূর্ণতা চোখ দুটো বন্ধ করে জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টির পানিতে ভিজছে।
হাবিজাবির জানালাগুলোর উপর ছাউনি নেই বলে বৃষ্টি হলেই পানির ঝাঁপটা ভেতরে ঢুকে পড়ে।সেই পানিতেই ভিজছে পূর্ণতা।ফারাজ অবাক হয়ে দেখছিল।সেই জায়গা দিয়ে মিসেস সায়না যাচ্ছিলেন তখন।ফারাজকে মূর্তির মন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি নিজে ওর পেছনে এসে দেখলেন ও আসলে কি দেখছে।ভেতরে বসে থাকা পূর্ণতাকে দেখছে বলে তিনি মুচকি হাসলেন।এরপর ফারাজের কান টেনে ধরে বললেন,’আব্বাকে বলবো?’

ফারাজ হকচকিয়ে কাকির দিকে তাকালো।কাকি হাসছেন অনবরত।সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না,এদিকে মিসেস সায়না হাসির কারণে কিছু বলতেই পারছেননা।শেষে ফারাজ মুখে হাত রেখে বললো,’এমনি দেখছিলাম এর বাইরে কিছুইনা।কাকি হেসোনা প্লিজ।পূর্ণা জানলে নিজেকে অনেক কিছু মনে করবে। ও আসলে কিছুইনা।বাদামের খোসার মতন একেবারে’

মিসেস সায়না কোমড়ে হাত রেখে বললেন,’তুমি কি জানো ভাজা বাদাম খোসা সহ খেলে আলাদা টেস্ট পাওয়া যায়?’

‘জানিনা তো’

‘তবে খেয়ে দেখবে একদিন তারপর পূর্ণতার মূল্য বুঝতে পারবে,তুমি তো ওরে খোসা বললে।’

ফারাজ লজ্জা পেয়ে মাথার চুল চুলকে চলে গেলো ওখান থেকে।
———–
চায়ের কাপ হাতে সারথি চুপটি করে বসেছিল।আনাফ বাইরে জহিরের সাথে আলাপ করছে সারথিকে নিয়ে।জহির আনাফকে চিনেছে।একদিন পরীক্ষার হলে তাদের সিট পাশাপাশি পড়েছিল।কথায় কথায় জহির জানতে চাইলো সারথির এই হাল কেন হয়েছে। সে ভেবেছে সারথি আনাফের স্ত্রী। আনাফ কথাটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেছে।এই টপিক নিয়ে আর আলোচনা করেনি।
এরপর জহিরকে বিদায় দিয়ে আনাফ রুমে ঢুকতেই দেখলো সারথি কাঁদছে। আনাফ কোনো শব্দ করেনি।চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।সারথি আওয়াজ করে কাঁদছিল না মোটেও।আনাফ শুধু ওর চোখ মোছা দেখছে। একটা সময়ে সারথির অশ্রু গড়ানো বন্ধ হলো।সে বাকি চা টুকু খেয়ে টেবিল হাতিয়ে তাতে কাপটা রাখে।আনাফ এবার ওর কাছে এসে বললো,’আমি চাই আপনি আমার সাথে আমার বাসায় চলুন’

‘আমি কোথাও যেতে চাইনা।আমাকে আমার পথে চলতে দিন প্লিজ।আপনার কোনো অধিকার নেই আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করার’

‘একটা মানুষ যখন বারবার মরতে চাই তখন তার মাঝে তার বোধবুদ্ধি বলে কিছু থাকেনা তখন মনুষ্যত্ব দিক দিয়ে অন্য একটা মানুষকেই দায়িত্ব টা নিতে হয় ‘

‘এটা কোথাও লেখা নেই।আমায় একা থাকতে দিন এটাই আপনার করা মহৎ উপকার হবে আমার জন্য’

‘তা হচ্ছেনা।আপনি মেন্টালি দূর্বল হয়ে গেছেন।ডাক্তার হিসেবে আপনাকে ফেলে চলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। চলুন আপনাকে আপনার বাসাতেই পৌঁছে দিয়ে আসি’

সারথি বিরক্ত হয়ে নামলো বিছানা থেকে।সে তার বাড়িতে যেতেই রাজি।
আনাফ ওর হাতটা ধরে বললো,’সামনে লিফট আছে তাই ধরলাম হাত,অন্য কিছু ভাবিয়েননা’

সারথি আনাফের সাথে চুপচাপ চলছে।গাড়ীতে বসার পর আনাফ ঝুঁকে ওর সিট বেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে এসে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।গাড়ী চলছে তার গতিতে।অনেকক্ষণ পর সারথির মনে হলো আনাফ ওকে বাড়ির দিকে নিচ্ছেনা তাই সন্দেহ নিয়ে সে প্রশ্ন করলো এত দেরি কেন হচ্ছে।আনাফের ঠোঁটে হাসি ভাসছে কেবল।সারথি সেটা দেখেনি।আনাফ চুপ বলে সারথি আবারও জানতে চাইলো এক কথা।
আনাফ মোড়ে ঢুকে বললো,’আমরা আমার বাসায় যাচ্ছি,হাবিজাবিতে না’

‘আপনি বলেছিলেন আমাকে আমার বাড়িতে দিয়ে আসবেন।তাহলে কথার খেলাপ কেন করছেন?’

‘সবসময় আপনার কথায় কেন চলতে হবে আমায়?আপনাকে আপনার বাড়িতে রেখে আসলে আবারও সুইসাইড করার চেষ্টা করবেননা তার কি নিশ্চয়তা?’

‘আপনি গাড়ী থামাবেন নাকি আমি চেঁচাবো?’

‘জানালা বন্ধ,গান ও চালিয়ে দিলাম।এবার চেঁচান’

আনাফ হাসিমুখে তার কাজে নিয়োজিত ওদিকে সারথির রাগ বেড়েই চলেছে।চেয়েও কিছু করতে পারছেনা।আসলেই সে বাড়ি ফিরলে পরেরদিন আবার মরতে বের হতো।আনাফ এমন কেন করছে!বয়সে বড় বলে মুখের উপর কিছু বলতেও পারছেনা।এদিকে জোর করে সব করিয়ে নিচ্ছে।একা বাসায় কি করে থাকবে সে।মানুষ কি বলবে!

“সমাজ বোঝেন আপনি?”

‘বুঝি’

‘তাহলে আমায় কেন একা একটা বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

‘একা না তো।ওখানে আমার ছোট বোন পড়াশুনা করে।ওর কলেজ পাশেই বলে সে আমার কেনা নতুন বাসাতে থাকছে এক বছর হলো।ওর সাথেই থাকবেন।ওর সাথে থাকলে এবং পরিবেশ আলাদা বলে আপনার মানসিক ভাবনার উন্নতি ঘটবে’
——–
আনাফের বাসা সারথি যেমন ফাঁকা ভেবেছিল,এসে বুঝলো তার চেয়ে বেশি ফাঁকা।যেন কেউ থাকেনা এখানে।আনাফের উপর আরও সন্দেহ হলো সারথির।হতে পারে আনাফ মিথ্যে বলছে।ওর কোনো বোনই নাই এখানে।তাই সে আনাফের উপর চড়াও হয়ে বলে,’আপনার বোন কই তাহলে?’

আনাফ হাসলো।সে বুঝতে পেরেছে সারথি তাকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।তাই সে তার বোনকে ডাক দিয়ে সোফায় এসে বসে।ওর বোনের নাম অধরা।ভাইয়ার ডাক শুনে বই থেকে মুখ তুলে ছুটে আসলো সে।এসে সারথিকে দেখে তার দৌড়ের বেগ কমে গেলো।সারথিকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে বললো,’ও কে ভাইয়া?’

‘নাম সারথি,আমার হবু বউ’

সারথি এ কথা শুনে মেজাজ দেখিয়ে বললো,’আন্দাজে কথা বললে আমি একা একা বের হয়ে চলে যাবো।আমাকে তো চেনেন আপনি!’

অধরা হা করে চেয়ে রইলো সারথির দিকে।তারপর আনাফের পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,’সত্যি তোমার হবু বউ?’

‘একেবারে সত্যি।কেমন আছিস সেটা বল।বাসায় ঢুকে প্রথমে আমাদের অতিথীর তো মনে হয়েছিল বাসাটাই ফাঁকা’

‘তুমি তো জানো আমার সামনে পরীক্ষা তাই পড়তেছিলাম।তা এই আপুটার ব্যাপারে আম্মু জানে?

‘নাহপরে জানাবো।তোকে এই দায়িত্ব নিতে হবেনা।বুয়াকে বল খাবার দিতে।আমার খিধে পেয়েছে’

‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এখন কি খাবে?ডিনার তো বানানো হয়নি’

‘যা আছে তাই দিতে বল।’

অধরা আবারও সারথিকে দেখতে দেখতে চলে গেছে।সারথি যেমনি দাঁড়িয়ে ছিল তেমন করেই দাঁড়িয়ে আছে।আনাফ ওর কাছে এসে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে বললো,’ভয় নেই,আমি থাকবোনা এখানে।আমার বোনের সাথে থাকবেন।মন ভাল হয়ে যাবে আপনার’

সারথি সোফায় হাত রেখে বললো,’ডান পাশে কি বারান্দা?বাতাস আসছে বারবার’

‘নাহ,ওহ আরেকটা কথা।ভুলেও ডান পাশে যাবেননা।এখানে বড় দরজা।সেটা পের হলেই নিচে সুইমিং পুল।আমি তো সবসময় থাকবোনা আপনাকে বাঁচাতে।অধরা একা একা আপনাকে পানি থেকে তুলতেও পারবেনা।সুতরাং এটা থেকে দূরে থাকবেন।’

এই কথা বলে আনাফ নিজের কপালে নিজে চড় মারলো
“””পাগলকে সে বলেছে সাঁকো না নাড়াতে।”””

পাগল তো নাড়াবেই।সারথি মরতে চায় সে সুযোগ খুঁজবে মরার জন্য।ধুর ধুর!!”
——–
পূর্ণতা বৃষ্টি দেখা শেষে রুম থেকে বের হতেই দেখে সিয়াম প্যান্টের চেইন খুলতে খুলতে ছাদের দিকে যাচ্ছে।
বাচ্চা ছেলেদের ছোট কাল থেকে শাসন না করলে বড় হয়ে আরও শয়তান হবে।পূর্ণতা এই টাইপের ছোট বাচ্চাদের পিটিয়ে কিংবা লজিক দিয়ে সোজা করেছে অনেকবার।এখন মনে হয় এই বাড়ির বাচ্চাদেরও ঠিক করতে হবে।বাধ্য হয়ে কাঠের স্কেলটা খুঁজে সে সিয়ামের পিছু নিলো।সিয়াম সবসময়কার মতন টাংকিতে হিসু করতে এসেছে।টাংকির পাশেই চেয়ার একটা দাঁড় করিয়ে সেটাতে উঠে দাঁড়াতেই দুম করে পিঠের উপর স্কেলের বাড়ি খেয়ে ভয় পেয়ে পেছনে তাকালো।পূর্ণতা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,”নামো ওখান থেকে।নাহলে এমন পিটা পিটবো যে হিসু আসাই বন্ধ হয়ে যাবে”

সিয়াম ভয় পেয়ে নিচে নামলো।পূর্ণতা ওর কান টেনে ধরে চললো দাদাজানের রুমের দিকে।তার কাছে গিয়ে আজ বিচার করবে এই শয়তানির’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৬
#আফনান_লারা
________
সিয়ামকে টানতে টানতে দাদার রুমের সামনে এনে থামে পূর্ণা।সিয়াম ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।এতদিন বাড়ির সকলে সিয়াম আর অনন্তের কুকীর্তি চাপা দিয়ে রেখেছিল।হয়ত দাদাজান নিজেও জানেননা এ ব্যাপারে। সিয়াম ভয়ে শেষ।উনি এসব জানলে সিয়ামকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।সিয়ম মনে মনে কল্পনা করছে বাড়ি থেকে বের করে দিলে তাকে তো রাস্তায় থাকতে হবে,তখন খিধা পেলে ব্রেড ছাড়া আর কি পাওয়া যাবে?ঠাণ্ডা লাগলে কি গায়ে দেবে?এ বয়সে সে কি করে টাকা কামাই করবে?এত কিছু ভাবতে ভাবতে দেখলো পূর্ণতা দরজায় নক দিয়ে ফেলেছে।দাদাজান সেসময় নামাজ পড়ছিলেন,এশার নামাজ।
কোনো সাড়া না পেয়ে পূর্ণতা “আসছি” বলে দরজাটা একটু ফাঁক করলো।ভেতরে চেয়ে দেখলো দাদাজান নামাজ পড়ছেন।
তখনই সিয়াম এক দৌড়ে পালানো ধরতেই পূর্ণতা খপ করে ওকে আবার ধরে বললো,’মাথায় স্কেলের বাড়ি খেয়েছো কখনও?’

‘নাহ’

‘আমি আমার অনেক ছাত্রর মাথায় স্কেলের বাড়ি দিয়েছি।মাথায় মারলে কি হয় জানো?দুনিয়াদারি অন্ধকার হয়ে যায়।মগজ নড়ে ওঠে।মনে হয় এর চেয়ে ব্যাথার আর কিছু নাই।তুমি যদি আর দুষ্টামি করো তাহলে তোমার মাথায় স্কেলের বাড়ি দিবো।আমি কিন্তু সিরিয়াস’

সিয়াম ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে রইলো।মনে মনে শপথ করেছে আর পালাবেনা।
পূর্ণতা ওর থুঁতনি টেনে দিয়ে বললো,’গুড বয়।এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকো।দাদাজানের নামাজ শেষ হলে তোমার বিচার হবে,মোক্ষম বিচার।দাদাজান আজ এর একটা বিভেদ করবেনই’
——-
দাদাজানের নামাজ শেষ হবার পর তিনি উঠে বিছানায় বসে বললেন,’পূর্ণা??সিয়াম?তোমরা দরজার বাহিরে কি করো?’

পূর্ণা ডাক শুনে সিয়ামকে টেনে নিয়ে গেলো দাদার কাছে।তারপর গাল ফুলিয়ে বললো,’আপনি জানেন এই বাঁদরটা কি করে সবসময়?’

‘কি করে?’

‘টাংকিতে হিসু করে।ছিঃ ছিঃ!কতবড় খবিশ হলে এমনটা করতে পারে।পুরো এলাকা এ ব্যাপারে জানে।আর আপন জানেননা?’

‘কে বলেছে আমি জানিনা?আমি সব জানি।না জানার ভান ধরে থাকি’

‘আপনি কি প্রশয় দিচ্ছেন?’

‘মোটেও না।আগে তো বিচ্ছুগুলো খাটের তলায় এই কাজ করত।এখন সেটা বন্ধ হয়েছে।টাংকিতে করে তো ওর বাপ মায়ে খায়।আমার কি?আমি তো সাপ্লাই আর পুকুরের পানিতে নিত্যদিনের কাজ করি।’

পূর্ণতা সিয়ামের কান বরাবর একটা চড় দিয়ে বললো,’শাসন না করলে আরও বিগড়ে যাবে।এটা এক প্রকার বেয়াদবি।আপনার উচিত শাসন করা’

‘কারোর থেকে সম্মান আশা করলে তাকে সম্মান করতে হয়,তার কথা মানতে হয়।নিজের দাপট সবসময় থাকেনা।দাপট বজায় রাখার এটাই একটা পন্থা।আমি মানিক আর সুমনের বাবা।তাদের এবং তাদের বউদের, বাচ্চাদের,নাতিদের কিছু জিনিস আমায় ছাড় দিতে হবে তা নাহলে আমি এই বাড়িতে টিকতে পারবোনা।যেহেতু আমি তাদের পয়সায় তিন বেলা ভাত খাই,তারা আমায় মাথাায় করে রাখে সেহেতু তাদের কিছু জিনিস আমাকেও মেনে চলতে হবে, তাই নয় কি?’

‘আপনি ওদের বাবা মায়ের সাথে সামনা সামনি এ ব্যাপারে আলোচনা করে দেখুন।বিষয়টা মিটে যেতে পারে’

‘আলোচনা করার আসলে সময় হয়ে উঠেনা।আমি যেহেতু পানিটা ব্যবহার করিনা সেহেতু আমার কিছু যায় আসেনা।তাও তুমি যখন বলছো, কাল একবার আলোচনা করবো।’

‘এখন সিয়ামকে কিছু বলুন।ওই যত নষ্টের গোড়া’

দাদাজন সিয়ামের দিকে গাল ফুলিয়ে চেয়ে বললেন,’তোমার মুসলমানির কথা মনে আছে সিয়াম?’

সিয়াম ঢোক গিলে এক দৌড় দিয়েছে সাথে সাথে।আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।পূর্ণতা মিটমিট করে হাসতে হাসতে চলে গেলো।
———–
সারথি সোফায় যেমন বসেছিল তেমনই বসে আছে।আনাফ ডাইনিং থেকে ওকে দেখতে দেখতে পাউরুটি গিলছে।অধরা এতক্ষণ এইসব দেখে শেষে বললো,’কি হলো?বউ হতে না হতেই চোখে হারাচ্ছো?’

‘চোখের হারানোর মতন হলে তো হারাবোই।চেহারা দেখেছিস?ওকে মিস ওয়াল্ডে যাওয়া উচিত ছিল।আন্ডারগ্রেটেড বিউটি’

অধরা ফিক করে হেসে বললো,’তবে পরেরবছর নিয়ে যেও।সময় তো আছেই ‘

‘নাহ।বিয়ের আগে যা করেনাই বিয়ের পরে তা কেন করবে?না থাক।পরে আবার অন্য কেউ এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে’

‘বিসিএস ক্যাডার ছাড়া আর কে নেবে?হাহাহা’

আনাফ অধরার কান টেনে ধরে বলে,’আমার বউ এই প্রথম বাসায় আসলো,বুয়াকে বল ভাল কিছু বানাতে’

‘তুমি রাতে থাকবে?’

‘হ্যাঁ,তবে তুই সারথিকে সেটা বলবিনা’

‘বলবোনা মানে?সে কি নিজের চোখে দেখবেনা?’

‘না।সে চোখে ভাল মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখেনা’

‘আজব কথা বলতেছো!আমরা কি ভাল না?’

‘নাহ,আমরা সবাই খারাপ মানুষ।তুইও খারাপ।আমরা জীবনে একটা না একটা খারাপ কাজ করেছি যার কারণে সারথি আমাদের দেখবেনা।তার আলাদা ক্ষমতা আছে।সে তার চোখ দিয়ে কেবল ভাল মানুষ,ভাল জিনিস দেখে’

‘এটা কেমন কথা!কি খারাপ কাজ করলাম আমি?তুমি নাহয় করেছো।কিন্তু আমি কি করলাম?’

‘তুই ছোটকালে বাবার পকেট কেটে টাকা চুরি করেছিস,মনে আছে?বিশ আগস্ট ২০১১’

অধরা জিভে কামড় দিয়ে ফেললো।আনাফ আরেকটা পাউরুটি মুখে পুরে দেখলো সারথি সোফায় বসে সোফার কভার খাঁমচাচ্ছে। আনাফ এবার ফোন বের করে কাকে যেন ফোন দিলো।অর্ডার দিলো রড,সিমেন্ট, বালু’

অধরা আরেকটু কাছে এসে জানতে চাইলো এসব দিয়ে কি করবে।

‘এই কাঁচের দরজা পুরা বন্ধ করে দেয়াল তুলে দিব’

‘কি বলছো ভাইয়া!ড্রয়িং রুমটা সুন্দর করছে একমাত্র এই দরজা।এটা বন্ধ করলে কেমন লাগবে জানো?পুরা অন্ধকার’

‘আঠারো ওয়াটের দুইটা লাইট বসিয়ে দিবো।আলো আর আলো দেখবি।তর্ক করবিনা।আমি যেটা বললাম সেটাই হবে’

আনাফ পানির বোতল নিয়ে সারথির সামনে দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে নিচে পুলের দিকে তাকালো।তার খুব শখ ছিল বিয়ের পর বউ যখন ভোরে এই জায়গায় এসে দাঁড়াবে সে ঘুম ঘুম চোখে এগিয়ে এসে কোমড়ে জড়িয়ে তার কাঁধ মাথা রেখে আরও পাঁচ মিনিট ঘুমাবে চোখ বন্ধ করে।
সারথিকে দিয়েও সেটা পূরণ হতে পারে কিন্তু অনুভূতিটার চেয়েও জরুরি সারথির নিরাপত্তা। আর তাই তার সেই ইচ্ছা ভঙ্গ করে সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কি দরকার সেই ভাললাগার যেটা আসল মানুষটারই ক্ষতি করবে?নাহয় অন্য কিছু দিয়ে অনুভূতিটা পূরণ করে নিবো’

আনাফ নদীতে গোসল করার পর থেকে তার গায়ের থেকে আতরের গন্ধ আসেনা।সারথি বুঝতে পারেনা তার আশেপাশে আনাফ আছে কিনা।
অধরার সন্দেহ লাগলো সারথিকে।সে কাছে এসে সারথির চোখের সামনে হাত নাড়ালো অনেকক্ষণ। ওর হাতের ব্রেসলেটের একটা ঝুনঝুনি লাগানো ছিল বলে আওয়াজ হচ্ছিল।সারথি সেটা শুনে বললো’কে?’

‘আমি অধরা।আপু তুমি আমায় সত্যি দেখোনা?’

‘নাহ’

‘তার মানে আমি এত খারাপ?এতটাও খারাপ না!

‘তুমি খারাপ সেটা কে বললো?’

‘ভাইয়া বললো তুমি নাকি শুধু ভাল মানুষ চোখে দেখো।খারাপদের দেখোনা’

সারথির রাগ হলো আবারও আনাফের উপর।
সব কিছু নিয়ে মজা করে লোকটা।বিরক্তি নিয়ে সারথি বললো,’আচ্ছা ডাক্তাররা এত বাঁদর হয়?’

‘আনাফ ভাইয়া ছোট থেকেই ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল।কিন্তু আব্বু আম্মু জোর করে মেডিকেলে পড়িয়েছে।তাই ইচ্ছে করেই বাঁদরামি বন্ধ করে নাই।ডাক্তার দের যে গাম্ভীর্য থাকে তা ভাইয়ার নাই।জোর করে পড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত করলে এমনই হয়’

‘ওনাকে দিয়ে রোগীর ক্ষতি হবেনা তো?’

‘আরেহ না কি বলো!ভাইয়া মেডিকেলে ভাল মার্কস পেতো সবসময়।ভাইয়ার মেধা ভাল বলেই আব্বু আম্মু জোর করে মেডিকেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে।তারা চেয়েছিল মেধাটাকে এই লেভেলে ইনবেস্ট করুক।
যদিও ইঞ্জিনিয়ারিং লেভেল ও খারাপ না কিন্তু আব্বুর স্বপ্ন ছিল তার একমাত্র ছেলে ডাক্তার হবে।’
———–
ফারাজ আজ পার্কে এসে চুপচাপ ছবি আঁকছিল।আজ কেন যেন ছবিতে কিছুতেই মন আটকাতে পারছেনা সো।বারবার মন অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে।সেদিনের ঐ ভদ্রলোকের কথাগুলো মাথার চারদিক দিয়ে ঘুরছে।
লোকটা সামান্য কয়েকটা লাইনে কত কি বুঝিয়ে গেলো।

ছবিতে মন না বসলে ঐ ছবি আর ছবি হয়ে ওঠেনা।অসম্পূর্ণ থেকে যায় সব দিক দিয়ে।খাতাটা ব্যাগে পুরে ফারাজ আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।অন্যসময়ে গলা ছেড়ে তার সবচেয়ে প্রিয় গানটা বারবার করে গাইতো ফারাজ।
আর আজ চেয়েও গলায় সেই গানটার সুর আনতে পারছেনা।কি অদ্ভুত মানুষের জীবন রেখা।
কবে কোন মূহুর্তে একটা মোড় নিয়ে নেয়, মানুষ তার আগেরদিনও বুঝতে পারেনা।কি সুন্দর প্রতিমাকে মনে করে সবকিছু ঠিক চলছিল,কি থেকে কি হয়ে গেলো।পার্কে আসার পর থেকে শুরুতে মনে হচ্ছিল ফারাজ এখনও আগের ফারাজ আছে।বসবে,ছবি আঁকবে।মন জুড়ে প্রতিমাকে নিয়ে ভাববে।আর এখন যেন প্রতিমাকে নিয়ে ভাবাটাই দোষের!
ব্যাগটা গুছিয়ে রাখতেই ফারাজের ফোন বেজে ওঠে।দাদাজানের কল।দাদাজান অতি গুরুত্বপূর্ণ নাহলে কখনওই ফারাজকে কল দেননা।তার মানে কিছু একটা হয়েছে নাহয় হতে যাচ্ছে।ভয়ে ভয়ে ফারাজ রিসিভ করলো।

‘তুমি কোথায়?বলবেনা যে পার্কে আছো’

‘হ্যাঁ,ওখানেই আছি’

‘বাড়ি ফিরবে জলদি,ফেরার পথে ভাল দেখে কমলা কিনে আনবে’

‘কেনো?’

‘আজ আরেকটা পরিবার আসবে’

‘ছেলেকে মেয়েরা কেন দেখবে?আগে তো ছেলেরা মেয়েকে দেখে’

‘তোমার জন্য যতগুলো মেয়ে বাছাই করে রেখেছি এদের সবাইকেই আমি স্বচক্ষে দেখেছি যার কারণে ঘটা করে গিয়ে তাদের দেখার প্রয়োজন নেই বলেই তারা আসছে আমাদের দেখতে’
——
ফারাজ ফোন রেখে চললো ফলের দোকানের দিকে।কি ঝমেলা!প্রতিমা চলে যাবার পর এমন ভাবে বিয়ের জালে ফেঁসে যেতে হবে কে জানতো!চারিদিকে শুধু বিয়ে আর বিয়ে।সবখানে বিয়ে নামক শব্দটা তিরিংবিরিং করে যাচ্ছে ঠিকই তবে বিয়েটা আর হয়ে উঠছেনা।
বিয়ে বলতে যতটা সহজ আসলে কিন্তু ততটাই কঠিন।
‘ তা বিয়েতে না নামলে জানতাম না।আজ আবার কারা আসছে কে জানে।কমলা আমি নিতাম কেন?মেয়েরা আসার সময় কমলা আনবেনা?জনাব হাবিবুল্লাহ তো আপেল আনছিলেন।ওগুলা কেটে এদের খাইয়ে দিলেই হয়।মাঝখান দিয়ে আমার তিনশ বিশ টাকা বেঁচে যাবে’

কমলা কিনে ফারাজ বাড়িতে ফিরেছে।মতিন এসে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো।ফারাজ গায়ে ফু দিয়ে ফ্যান চালিয়ে সোফায় বসে। খুব গরম আজকে।একটু শরবত খেলে ভাল হতো।কিন্তু হাবিজাবি বাড়িতে শরবত আশা করা একটা মানুষের জন্য মস্ত বড় ভুল।
হঠাৎ সে দেখলো সিয়াম এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসছে ফারাজের দিকে।ফারাজ ভাল করে সব দেখে বললো,’আমি এই শরবত খাচ্ছিনা’

‘জেঠিমণি সাপ্লাই পানি দিয়ে বানিয়েছে।নাও খাও’

‘সত্যি তো?’

‘একদম।বিশ্বাস না হলে গিয়ে জিগাও’

ফারাজ গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোক খেলো।খোয়ে আবারও সিয়ামের দিকে চেয়ে বললো,’এটা পূর্ণা বানিয়েছে?’

সিয়াম থতমত খেয়ে বলে,’তুমি কিভাবে জানলে?’

‘মা শরবতে ইসবগুলের ভুষি দেয়না।এটা পূর্ণা ছাড়া আর কারোর কাজ না এই বাড়িতে’

‘ধীরে বলো,পূর্ণা ম্যাম বলেছে ওনার কথা বললে দাদাজান রেগে যাবেন’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here