#তি_আমো
পর্ব ২৬
লিখা- Sidratul Muntaz
ঈশান দ্বিতীয়বার আমাকে ঘরে ফেলে যাওয়ার মতো ভুলটা করল না৷ এই সুযোগে আমি তাকে ইচ্ছেমতো জ্বালিয়ে মারতে লাগলাম। প্রথমেই আমি ঈশানের গায়ে এক গাদা বমি করে ভাসালাম। সে বিড়বিড় করে বলল,” এইটাই বাকি ছিল। ”
আমি খিলখিল করে হাসলাম। ঈশান নিজের হাতেই আমার বমি পরিষ্কার করল। বিসমিকে পাঠানো হলো আমার ঘর থেকে কাপড় আনার জন্য। বোকা মেয়ে হাতে করে একটা নাইটি নিয়ে চলে এলো। ঈশান তাকে ধমক দিয়ে বলল,” এটা কার?”
বিসমি নিচু গলায় বলল,” আমি কিভাবে জানি কার? বিছানায় পেয়েছি তাই নিয়ে এসেছি। তারিন আপুর ব্যাগ কোনটা আমি তো জানি না।”
আমি হাসিমুখে বললাম,” আমি জানি। আমার ব্যাগে এত্তোগুলো ইঁদুর আছে। হাত দিলেই কামড়ে দিবে।”
বিসমি বিস্মিত হয়ে বলল,” ওরে বাপরে, ঈশান ভাই আমাকে মাফ করেন। আমি যাবো না।”
ঈশান বিরক্ত হয়ে বলল,” আরে মাতালের কথার কি কোনো বেইল আছে? যাও বলছি।”
” না। আমাকে যদি কেউ দেখে ফেলে আর কিছু জিজ্ঞেস করে তখন আমি কি বলব?”
ঈশান কড়া নির্দেশ দিল,” ভুলেও এই ঘটনা বলা যাবে না।”
” তাহলে?”
ঈশান চিন্তা করতে লাগল। এর মাঝে আমি দুইবার হাচি দিলাম। ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলে আবার না আমার ঠান্ডা লেগে যায়। এই ভয়ে ঈশান তৎক্ষণাৎ বিসমিকে দিয়ে আমাকে গোসলে পাঠাল। আমি ধমক দিয়ে বিসমিকে বাথরুম থেকে বের করে দিতে চাইলাম। বিসমি যখন কোনোভাবেই বের হচ্ছে না, আমি তার গায়ে পানি ঢেলে দিলাম। বিসমি রেগে-মেগে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল,” আমাকে আর ডাকবেন না। আমি আর এখানে আসব না।”
বিসমি চলে যাওয়ার পর ঈশান আমার কাছে এসে উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” এটা কি করলে তারিন? একজনই ছিল আমাদেরকে হেল্প করার মতো। এখন তাকেও তুমি রাগিয়ে দিলে।”
আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে বললাম,” আমাদের হেল্প করার জন্য ওকে লাগবে কেন? আপনিই তো আছেন।”
এই কথা শুনে ঈশান প্রথমে অবাক হলো। তারপর হাসল৷ তারপর কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” তাই? তাহলে আসো, আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেই, তোমাকে গোসল করিয়ে দেই।”
” হ্যাঁ আসুন।”
আমি সাথে সাথে দরজা খুলে ফেললাম। ঈশান তার আগেই ঝড়ের চেয়েও দ্রুত গতিতে ঘরের বাইরে চলে গেল। আমি খুব শব্দ করে হাসতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ঈশান ঘরে ঢুকল। ততক্ষণে আমি ভদ্র মেয়ের মতো পোশাক পরে, মাথা মুছ বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। ঈশান আমার কপালে হাত রাখল। আমি তাকিয়ে বললাম,” কি হয়েছে?”
” জ্বর আছে কি-না দেখছি।”
আমি আগ্রহপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,” আছে?”
” উহুম। নেই।”
আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললাম,” না,আছে!”
ঈশান মুচকি হেসে বলল,” আচ্ছা, আছে।”
আমি নরম গলায় আবেদন করলাম,” আপনি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ।”
ঈশান অবাক হয়ে বলল,” কেন?”
” আমার খুব শীত লাগছে।”
ঈশান আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার নাকে ধাক্কা লাগল ঈশানের পারফিউমের ঘ্রাণ। জীবনে প্রথম প্রেমের ছোঁয়ায় আমার শরীর ক্রমশ বিবশ হয়ে আসতে লাগল। হাত-পা কেমন অবশ অবশ লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল ঈশানকে সারাক্ষণ এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখতে৷ সে যদি আমায় ছাড়ে, তাহলে আমি মরে যাব। ঈশান হঠাৎ সতর্ক কণ্ঠে বলে উঠল,” তুমি ঘুমাচ্ছ না কেন তারিন?”
আমি চোখ বন্ধ রেখে উচ্চারণ করলাম,” ঘুমিয়ে গেলে তো এই আরামটা আর পাব না। আপনি আমার কাছে এভাবে থাকলে আমি কখনও ঘুমাতে চাই না। সারাজীবন জেগে থাকতে চাই।”
ঈশান সাথে সাথে আমায় ছেড়ে দিয়ে বলল,” এবার তাহলে ঘুমাও।”
আমি টলমল দৃষ্টিতে বললাম,” আমার ঘুম আসছে না। আমার…”
ঈশান আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,” আজকে আর কোনো কথা না। ঘুমাও৷ না ঘুমালে হবে না ভালো মেয়ে।”
আমি ঈশানের শার্টের কলার খামচে ধরে বললাম,” আমি ভালো মেয়ে হতে চাই না। আমার এভাবেই বেশ লাগছে। আপনার ভালো লাগছে না?”
ঈশান দুই পাশে মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বলল,” না। আমার আগের তোমাকে চাই। এই এলোমেলো, নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া কিউট তারিনের থেকে কাঠখোট্টা, রাগী তারিনকেই আমার বেশি পছন্দ ছিল। ”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,” কিন্তু সেই তারিন তো পঁচা। আপনাকে কষ্ট দেয়। আপনাকে চড় মারতেও দ্বিধা করে না।”
ঈশানের ঠোঁট দু’টোয় হালকা হাসি ফুটল,” তবুও আগের তারিন বেস্ট। সে আমার ভুল শুধরে দেয়। আমার বিবেকের দরজা খুলে দেয়। আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি৷ ”
” তাহলে আমার উপর রেগে ছিলেন কেন?”
ঈশান কিছুটা মনখারাপের স্বরে বলল,” রাগটা তোমার উপর ছিল না, রাগটা আমার নিজের উপর। আমি কতটা অন্যায় করলে তুমি আমাকে ওইভাবে আঘাত করতে পারো সেটাই ভাবছিলাম সারাদিন ধরে।”
” তাহলে আমার সাথে কথা বলছিলেন না কেন?”
ঈশান আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল,” তোমার সাথে কথা না বলে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছিলাম।”
আমি অভিমান ঝরা কণ্ঠে বললাম,” কিন্তু আপনি আমাকেও শাস্তি দিচ্ছিলেন। সারাদিন আমি কত কষ্ট পেয়েছি জানেন?”
” জানি। সেজন্য স্যরি।”
ঈশান নিজের দুইকানে হাত রাখল। আমি হেসে উঠে বললাম,” আই লভ ইউ।”
ঈশান আমার দুইহাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিতে দিতে বলল,” আই লভ ইউ টু।”
আমি মুগ্ধচোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি প্রশান্ত, কি স্নিগ্ধ, কি আশ্চর্য সুন্দর সে। সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল আমাদের। সুখের সময় হয়তো এভাবেই দ্রুত কেটে যায়। ঈশান অনেকটা সময় আমার সাথে ছিল। কিন্তু ভুল করেও আমার অচেতনতার সুযোগ নিল না। আমি দুষ্টমি করে বললাম,” মাত্র এক চড়েই আপনি এমন সাধু হয়ে যাবেন জানলে আরও আগেই চড় মারতাম।”
ঈশান রেগে বলল,” আচ্ছা তাই? এখন যদি আবার খারাপ হয়ে যাই তাহলে কি আবার চড় মারবে?”
” না। কারণ এবার আমিও একটা খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি। আমার মাথায় শুধু দুষ্ট চিন্তা আসছে। ইচ্ছে করছে আপনাকে জড়িয়ে ধরে জোরে একটা চুমু দেই।”
ঈশান দ্রুত বিছানা থেকে নেমে বলল,” তুমি শুয়ে থাকো এখানে। আমি বারান্দায় যাচ্ছি।”
আমি এই কথা শুনে পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ঈশানকে ডেকে বললাম,” শুনুন,আমার খুব ড্যান্স করতে ইচ্ছে করছে। ক্যান আই?”
ঈশান চোখ বড় করে বলল,” মানে? দেখো তারিন, প্লিজ আর ড্রামা না। আমি খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি।রেহাই দাও।”
আমি সাথে সাথেই বিছানায় উঠে লাফাতে শুরু করলাম। ঈশান মুখে হাত রেখে চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছে।
আমি লাফাতে লাফাতে হঠাৎ থেমে গেলাম। হালকা নিচু হয়ে ঈশানের মুখের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম,
” নিহা কোথায়? সে কি বাসর ঘরে ঢুকে গেছে?”
ঈশান আমাকে মানানোর উদ্দেশ্যে বলল,” হ্যাঁ। ওরা ঘুমাচ্ছে৷ এখন তুমিও ঘুমাও।”
আমি মুখ চেপে হেসে বললাম,” আপনি দেখি একটা ভেলকা! ধূর ভেলকা, বাসর রাতে কেউ ঘুমায়?”
ঈশান আমার হাত ধরতে এগিয়ে এলো। কিন্তু আমি ধরা দিলাম না। এক দৌড়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে ফেললাম। ঈশান অতিষ্ঠ হয়ে বলল, “তারিন একদম না। বের হবে না কিন্তু। খবরদার বলে দিচ্ছি। আর কোনো তামাশা না প্লিজ।”
আমি ঈশানের কথার তোয়াক্কা করলাম না। সহসা সবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছিল নাশফী, রিদি, আনিকা আর সামিয়া।তারা আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
আমি ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে নাশফী আপুর পাশে গিয়ে বসলাম। আমার উদ্ভট চাহনি দেখে নাশফী আপু কিছুটা সরে বসল। আমিও কিছু কম যাইনা। আরো এগিয়ে গেলাম নাশফী আপুর কাছে। একদম গা ঘেঁষে বসলাম। শয়তানি হাসি দিলাম। তাকে হালকা খোঁচা মেরে বললাম,” ঘটনা কি?”
নাশফী আপু যারপরনাই বিব্রত হয়ে জানতে চাইল,” মানে?”
আমি আগের মতোই মুখে হাসি রেখে বললাম,”কি করছিলে কালরাতে? রিফাত ভাইয়ার সাথে? বাগানের পেছন দিকে? একদম খুল্লামখুল্লা! ভেবেছো কেউ কিছু দেখবে না? আমি তো সব দেখে ফেলেছি!”
নাশফী আপু হা করে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে ভয়। ঈশান ছুটে এলো। সবার সামনেই ঈশান ‘এক্সকিউজ মি’ বলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইল।
আমি ঈশানকে জিভ দেখিয়ে সোফার উপর উঠে দাঁড়ালাম। এক লাফে সোফা থেকে নেমে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়াতে লাগলাম। তারপর আমার দেখা হলো আরিশার সাথে। মেয়ে আমাকে দেখেই রাগী দৃষ্টিতে চাইল৷ আমি ঈশানকে উদ্দেশ্য করে বললাম,” শুনুন, আপনি এই মেয়েকে আর কখনও কোলে নেবেন না।”
ঈশান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” কেন? ওর সাথে তোমার কি প্রবলেম?”
আমি হাত ভাজ করে বললাম,” জানি না। ওকে আমার ভালো লাগে না। আপনি ওর জন্য রোজ চকলেট আনেন। আমার জন্য কেন আনেন না? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?”
ঈশান নত স্বীকার করে বলল,” ঠিকাছে এখন থেকে তোমার জন্যেও আনব। এবার চলো।”
ঈশান আমাকে জোর করে কাঁধে উঠালো। কিছু পথ যাওয়ার পর আমি বললাম,” ওয়াশরুমে যাব।”
ঈশান এই কথা শুনে আমাকে কাঁধ থেকে নামাল। আমি আবার এক দৌড়ে বাগানের দিকে ছুটে গেলাম। ঈশান মাথায় হাত চেপে বলল,” ওহ শিট!”
আমি বাগানের বাইরে বের হলাম না। দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। ঈশান আমার কাছে এলেই আমি তার শার্ট খামচে ধরে বললাম,” ওই দেখুন, ভূত।”
ঈশান তাকিয়ে বলল,” কই?”
” আরে, এতোবড় ভূতটা চোখে দেখছেন না?”
” এটা ভূত নয় তারিন। এটা গাড়ি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,” গাড়ি এমন ভূতের মতো লাগছে কেন?”
” কারণ গাড়ির উপর কভার পরানো হয়েছে।”
আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম৷ চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল। ঈশানের বুকেই আমি হেলে পড়তে যাচ্ছিলাম। দৃষ্টি পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে আসার আগে ভাইয়াকে দেখলাম।
চলবে#তি_আমো
পর্ব ২৭
লিখা-Sidratul Muntaz
ঘুম ভাঙার পর যথারীতি আমার কিছু মনে নেই। একটা ফাঁকা ঘরে আমি শুয়ে আছি৷ ফ্যান ঘুরছে শো শো শব্দে। আমার গায়ে একটা মোটা কাঁথা। আমি কাঁথাটা সরাতেই আৎকে উঠলাম। আমার গায়ে একটা নাইট ড্রেস। জীবনে কোনোদিন নাইট ড্রেস পরিনি আমি। কাউকে এই ধরণের নাইট ড্রেস পরতে দেখলেও লজ্জায় মরে যাই। সেই আমার গায়ে কি করে এই নাইট ড্রেস এলো? খুব অস্বস্তি আর বিরক্তবোধ নিয়ে আমি মাথায় হাত রাখলাম। ভাবতে চেষ্টা করলাম। কালরাতে কি হয়েছিল? কিন্তু আমার কিছু মনে নেই। আশেপাশে চেয়ে বুঝলাম এটা নিহাদেরই বাড়ি। গতকাল নিহার বিয়ে ছিল। আমি একটা লাল শাড়ি পরেছিলাম। ঈশানের দেওয়া শাড়ি ছিল। সেই শাড়িটা এখন কোথায়? আমার সবকিছু এতো এলোমেলো লাগছে কেন? ইচ্ছে করল চিৎকার করে কাউকে ডাকি। তারপর জিজ্ঞেস করি, আমার কি হয়েছে? কিন্তু আমি কাউকে ডাকতে পারলাম না। থম মেরে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম এভাবেই। অকারণেই মনটা খুব খারাপ লাগছে। একটু পর দেখলাম মা ঘরে ঢুকল।
মাকে দেখে আমার ছোট্ট আত্মায় যেন কম্পন সৃষ্টি হলো। মা এখানে কিভাবে? তার চোখমুখ কঠিন, শক্ত। মা দরজা বন্ধ করল। তারপর দেখলাম বিছানার পাশ থেকে আমার ব্যাগটা তুলে একটা সেলোয়ার কামিজ বের করল। সেই কামিজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” পাঁচমিনিটে পরে আয়৷ তারপর তোর সাথে কথা হবে।”
সত্যি বলতে মাকে আমি এতোটা কঠিন গলায় কথা বলতে কখনও দেখেনি। ইতস্তত করে বললাম,” কালরাতে কি হয়েছিল, মা?”
মা জবাব না দিয়ে আমার ব্যাগটা গুছিয়ে খাটের পাশে রাখল। আমি সাহস করে আবার জানতে চাইলাম,” আমার গায়ে এই ড্রেস কিভাবে এলো?”
মা অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইতেই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম আমি। মা চোয়াল শক্ত করে বলল,” একবার বললাম না, পরে কথা হবে? যা বলছি তাই কর আগে।”
আমার কেন যেন মনে হলো, মা আমাকে ভুল বুঝছে। কারণ আমি সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করিনি। নিশ্চয়ই বিরাট কোনো ঘটনা ঘটেছে যা সম্পর্কে আমি এখনও অজ্ঞাত। মায়ের মনটা যদি এখন একবার পড়তে পারতাম, একবার জানতে পারতাম যে মা কি ধারণা করছে আমাকে নিয়ে তাহলে খুব ভালো হতো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে জামাটা ধরলাম। তারপর মাথা নিচু করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। জানি, আমার কোনো দোষ নেই। তবুও আমি বেসিনের আয়নায় নিজের শরীর বার-বার দেখলাম। আমার সাথে কি জঘন্য কিছু ঘটে গেছে? সেরকম কোনো আলামত না পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। কিন্তু তবুও দুশ্চিন্তায় আমার মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর মা কি বলবে আমাকে? দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর বের হতেই মা তেড়ে এসে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মারল। আমি স্তব্ধ। মা রাগে দুইহাতে আমার পিঠে অবিরাম মারতে লাগল। আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। কথা বলার শক্তি কিংবা সাহস কোনোটাই হলো না। শুধু গুটিয়ে রইলাম। মা কিড়মিড় করে বলল,
” আমার সারাজীবনের মান-সম্মান তুই এক নিমেষে নষ্ট করে দিলি তারু। তোকে কি দিইনি আমি? বাপ মরার পর থেকে তোর কোন আবদারটা অপূর্ণ রেখেছি? যখন যা বলেছিস, যেভাবে বলেছিস, তাই করেছি আমি। তারিফের সাথে, তোর দাদীর সাথে অসংখ্যবার মিথ্যা বলে তোকে বাঁচিয়েছি। এইসব কিছুর এই প্রতিদান দিলি তুই? বল মুখপুরী, কোন অপরাধের শাস্তি তুই আমাকে দিলি। বল নারে, বল!”
আমি অযথাই হু হু করে কাঁদতে লাগলাম। জানি না আমার কি দোষ, জানি না কোন অপরাধের কথা বলছে মা, শুধু জানি মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। কষ্টে মায়ের কণ্ঠ কাঁপছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ মা এতো কষ্ট পেয়েছিল হয়তো বাবার মৃত্যুর সময়। আমাকে মা প্রহার করেই যাচ্ছে কিন্তু আমি শারীরিক আঘাতের চেয়েও মানসিক আঘাতে জর্জরিত হচ্ছি অনেক বেশি। দরজায় করাঘাতের শব্দে মা থামল। আমি মেঝেতে সম্পূর্ণ লুটিয়ে পড়লাম৷ চোখের পানিতে আমার পুরো মুখ ভিজে গেছে। চুল দিয়ে চেহারা ঢাকার চেষ্টা করলাম। না জানি কে এসেছে!
একটু পর ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেলাম,” ওকে মেরেছ কেন মা? নিষেধ করেছিলাম আমি। ওর গায়ে হাত তুললে কেন?”
মা নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” আরও আগেই হাত তোলা উচিৎ ছিল। তাহলে আর এই দিন দেখতে হতো না।”
এই কথা বলে মা কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমিও ফুঁপিয়ে উঠলাম। না জানি কি অপরাধ করে ফেলেছি। জানলে না হয় পায়ে ধরে মাফ চাইতে পারতাম।
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানাল,” আমরা একটু পরেই বের হবো৷ সবকিছু গুছিয়ে নাও।”
এই কথা বলে ভাইয়া চলে যেতেই নিচ্ছিল। আমি মাথাটা তুলে চাইলাম তখন। ভাইয়া সাথে সাথে বলল,” আজ থেকে আমি জানব, আমার কোনো বোন নেই। যে ছিল, মরে গেছে।”
আমি সাথে সাথে ছুটে গিয়ে ভাইয়ার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া কিছু বলল না। শুধু আমাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,” বাড়িতে অনেক মানুষ আছে। মা ওকে বলো ড্রামা বন্ধ করতে। আমার মাথা গরম হওয়ার আগে যেন আমার পা ছাড়ে ও।”
আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,” কি করেছি আমি? কি অন্যায় করেছি? শুধু একবার বলব। তোমার যা শাস্তি দিবে সব মেনে নিব। শুধু আমার অন্যায়টা আমাকে জানতে দাও।”
ভাইয়া ভারী গলায় বলল,” পা ছাড় আগে। বিছানায় গিয়ে চুপ করে বস।”
আমি ভাইয়ার পা ছেড়ে দিলাম। চোখ মুছতে মুছতে কোনমতে বিছানার কাছে গেলাম। পিঠে তখন প্রচন্ড ব্যথা। কিন্তু আমার হুশ নেই। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কি ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি? এতো বাজে স্বপ্নও আমি দেখতে চাই না। ভাইয়া দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। মাথা উঠিয়ে দেখলাম মোহনা আন্টি। ভাইয়া বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে দরজার দিকে তাকাল। মোহনা আন্টি বিব্রত গলায় বললেন,
” স্যরি। ফ্যামিলি মিটিং হচ্ছে বোধহয়৷ আমার হুট করে চলে আসা ঠিক হয়নি। আমি কি পরে আসব?”
ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” এসেই যখন পড়েছেন তখন আর চলে যাবেন কেন?”
মোহনা আন্টি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলেন। ইতস্তত করে বললেন,” আসলে আমি একটা ইম্পোর্ট্যান্ট বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।”
ভাইয়া দায়সারাভাবে বলল,” একটু দ্রুত বললে ভালো হয়। আমাদের আরও অনেক জরুরী কাজ আছে।”
মোহনা আন্টিকে কিছুটা অসহায় দেখাল। তিনি হতাশা মাখা কণ্ঠে বললেন,” দেখুন, যেটা হয়ে গেছে সেটা তো আর আমরা বদলাতে পারব না। কিন্তু আমরা চাইলেই একটা সুন্দর সমাধানে আসতে পারি। এতে আপনাদেরও মান-সম্মানের উপর আঁচ আসবে না আর ছেলে-মেয়ে দু’টোও খুশি থাকবে।”
তারিফ ভাই ধারালো দৃষ্টিতে বলল,” যদি আমার বোনের খুশির কথা ভেবে বলেন, তাহলে সেটা আমরা বুঝে নিবো। আপনার এতো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আপনি ওর গার্জিয়ান না।”
আমি ভ্রু কুচকালাম। ভাইয়া কেন এইভাবে কথা বলছে মোহনা আন্টির সঙ্গে? আমি এবার সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম যে সব মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে গেছে। কিন্তু কেবল মিথ্যা প্রকাশের জন্য তো মা এইভাবে আমার গায়ে হাত তুলবে না। যেখানে মা কখনও আমাকে থাপ্পড় পর্যন্ত দেয়নি!
মোহনা আন্টি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন,” দেখুন তারিফ সাহেব, আপনি যদি বলেন আমার ছেলে মানুষ খু*ন করেছে, তাহলেও হয়তো বা আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু মেয়েদের অসম্মান? কখনোই না৷ এটা আমার ছেলের দ্বারা সম্ভব না৷ অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। যে যতই বলুক, নিজের ছেলের প্রতি আমার আস্থাটা সীমাহীন। পৃথিবীর সবাই মিলেও যদি তার বিরুদ্ধে কথা বলে তবুও আমি শুধু সেটাই বিশ্বাস করব, যেটা আমার ছেলে আমাকে বলবে। কারণ আমি মা হয়ে সন্তানের চোখের দিকে চেয়েই সত্য আর মিথ্যার ফারাকটা বুঝতে পারি।”
তারিফ ভাই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। মোহনা আন্টি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” আমার কথা আপনার হয়তো ভালো লাগছে না..”
ভাইয়া মোহনা আন্টিকে থামিয়ে রূঢ় স্বরে বলল,” আপনি কি এতোকিছুর পরেও নিজের ছেলের গুণগান করতে এসেছেন?”
মোহনা আন্টি আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,” না! একদমই না। আমি শুধু সত্যিটা বোঝাতে এসেছি। আমার ছেলে নির্দোষ। আর তারিনেরও এখানে কোনো দোষ নেই। আমি যতটা ঈশানকে বিশ্বাস করি, ততটা তারিনকেও বিশ্বাস করি। তারা এমন ভুল কখনোই করতে পারে না যে কারণে তাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে। তারা এমন ছেলে-মেয়ে নয়।”
এই সময় মোহনা আন্টির কথাগুলো শুনে আমার অসম্ভব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে এই মানুষটা আমাকে যতটা চিনেছে, আমার মা অথবা ভাইও হয়তো ততটা চিনতে পারেনি।
মোহনা আন্টির মুখটা দেখে অচিরেই মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় হলো। ভাইয়া আর মা আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল তাতে মনে হয়েছে আমি ভয়ংকর অপরাধী। কিন্তু মোহনা আন্টির তাকানোর ভঙ্গিটা আগের মতোই সরল, সুন্দর।
এবার মোহনা আন্টি সবচেয়ে বিশেষ কথাটি বললেন,” তারিনকে আমার এতো বেশি পছন্দ যে আমি সবসময় তাকে নিজের কাছে রাখতে চাই। আমার নিজের মেয়ে হিসেবে যদি আমি তারিনকে পাই, তাহলে আমার আর কিছুই লাগবে না। তারিনের সাথে ঈশানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, তাহলে তারিনকে আমায় দিয়ে দিন। ওর গায়ে যত কলংক লেগেছে, সব মুছে নিব আমি। ও আমার কাছে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। কথা দিচ্ছি, নিজের ছেলের চেয়েও আমি আমার মেয়েকে বেশি যত্নে আগলে রাখব।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু গড়াচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে যদি আমি উঠে গিয়ে মোহনা আন্টিকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম, তাহলে হয়তো কিছুটা শান্তি লাগতো মনে। কিন্তু ভাইয়ার দরাজ কণ্ঠের কাছে নিমেষেই খুব অসহায় হয়ে পড়লাম। ভাইয়া ক্ষীপ্ত স্বরে বলল,
” আপনার ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। এতোদূর ভাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এবার আসতে পারেন।”
মোহনা আন্টি করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। আমি সেই দৃষ্টিতে খুঁজে পেলাম আকুতি, মায়া, স্নেহ। ঠিক যেমন মায়ের মুখে থাকে। মোহনা আন্টি আমার কাছে মায়ের মতোই প্রিয় হয়ে উঠলেন মাত্র কয়েক মিনিটের এই ব্যবধানে। মাথায় অপরাধের বোঝা না থাকলে এই মুহূর্তে ভাইয়ার সিদ্ধান্তের উপর তীব্র প্রতিবাদ জানাতাম আমি। কিন্তু সেই জোর এখন আর আমার গলায় নেই। আমি মাথায় মিথ্যাবাদী আর অপরাধীর তকমা লাগিয়ে বসে আছি। আমাকে তো চুপ করেই থাকতে হবে। আজ শুধু নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। মোহনা আন্টি খানিক মিনতির স্বরে বললেন,” আরেকবার ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। আমি তারিনের ভালো চাই বলেই..”
ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত জবাব দিল,” ভাবার কিছু নেই। আপনি আসতে পারেন।”
মোহনা আন্টি আমার দিকে তাকালেন আরও একবার। আমিও যখন কিছু বলছি না, তিনি তীব্র হতাশা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভাইয়া সাথে সাথেই আমার দিকে চেয়ে কঠিন গলায় বলল,” তুই কি তোর অপরাধের জন্য অনুতপ্ত? ক্ষমা চাইছিস?”
আমি অভিমানী স্বরে জবাব দিলাম,” হ্যাঁ। আমি আমার অজানা অপরাধের জন্য অনেক বেশি অনুতপ্ত ভাইয়া। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
” তোকে ক্ষমা করার জন্যই এসেছি। কিন্তু শর্ত আছে। যদি সেই শর্ত মানতে পারিস, তাহলে সব ভুলে যাব আমি। সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বল, শর্ত মানতে রাজি তুই?”
চোখের জল মুছে মাথা নাড়লাম। নিশ্চিত জানি, ভাইয়া এখন বলবে ঈশানকে ভুলে যেতে। অথবা এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু। হয়তো বলবে, আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যাতে আমি ঈশানের ছায়াও মাড়াতে না পারি আর কোনোদিন। আচ্ছা, শেষবারের মতো ঈশানকে দেখার সুযোগটা কি হবে? ভাইয়া আসলে আমার প্রত্যাশ্যা অনুযায়ী কিছু বলল না। বরং ভাইয়া যেই কথা বলল তা আমার ভাবনারও অতীত। খুব সহজভাবেই ভাইয়া বলে ফেলল,” ঈশানকে বিয়ে করতে হবে তোর। সেটা আজকের মধ্যে হলেই ভালো হয়।”
আমি ভীষণ চমকে তাকালাম। ভাইয়া কথা শেষ করে আমার উত্তরের অপেক্ষায়। আমি হতভম্বের মতো উচ্চারণ করলাম,”কি?”
ভাইয়া এক কথা দুইবার উচ্চারণ করল না। শুধু বলল,” ভেবে দ্যাখ কি করবি! তোর হাতে সময় পনেরো মিনিট।”
আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ভাইয়া বুঝি আমার সাথে রসিকতা করছে। কিন্তু এমন মানুষ তো ভাইয়া নয়! তাহলে এসব কেন? যদি ঈশানের সাথেই ভাইয়া আমার বিয়ে দিবে তাহলে এই মাত্র মোহনা আন্টির প্রস্তাব নাকচ করল কেন? আমি হাজারটা প্রশ্নভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া বলল,” যদি সত্যি আমার বোন হয়ে থাকিস তাহলে আজ তুই সঠিক সিদ্ধান্ত নিবি। ”
আমি ধীর গতিতে মাথা নাড়লাম। ভাইয়া প্রশ্ন করল,” মানে কি? বিয়েতে রাজি তুই? হ্যাঁ নাকি না? এক কথায় উত্তর দে। ”
আমি মাথা নিচু করে উচ্চারণ করলাম,” হ্যাঁ। ”
ভাইয়া সন্তুষ্ট হয়ে বলল,” থ্যাংকস।”
এবার মায়ের প্রশ্ন শুনতে পেলাম,” ঈশান কি বিয়েতে রাজি হয়েছে?”
ভাইয়া মৃদু হেসে বলল,” রাজি কি হবে? সে নিজেই তো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।”
মায়ের কণ্ঠ থেকে দুঃখ সরে গিয়ে স্বস্তি প্রকাশ পেল,” আলহামদুলিল্লাহ। বিপদ তাহলে কাটবে মনে হচ্ছে। এতোকিছুর পরেও ছেলেটা বিয়ের প্রস্তাব দিল? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
” আমিও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, মা। সব আল্লাহর ইচ্ছা।”
” বিয়ের পর ঈশানকে বলবি তারুকে নিয়ে যেন খুব দূরে কোথাও চলে যায়।”
” সেটা দেখা যাবে। আগে বিয়ে তো হোক! তুমি সবকিছু গুছিয়ে নাও মা। আমরা বের হবো এখনি। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়।”
আমি ভাইয়া আর মায়ের কথার আগা-মাথা কিছু বুঝলামই না। কেবল অস্থির লাগছে। আমার আনন্দ করা উচিৎ নাকি দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হওয়া উচিৎ আমি জানি না! আমার অবস্থা ঠিক বিশাল সমুদ্রে কুল হারিয়ে ফেলা নাবিকটির মতো। ভাইয়া আর মা বাড়ি ফেরার আয়োজন শুরু করল। এর কিছুক্ষণ পরেই ঈশানকে দেখলাম। আমাকে জাগ্রত দেখে ঈশান দ্রুত ঘরে ঢুকে বলল,” আমি কি তারিনের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
মা বলল,” অবশ্যই বাবা৷ তোমরা কথা বলো। আমরা যাচ্ছি।”
তারিফ ভাই যাওয়ার সময় ঈশানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, ” ওকে ভালোমতো বোঝাও। যেন অতীত ভুলে খুশিমনে নতুন জীবনটা শুরু করে।”
মা আর ভাইয়া বের হওয়ার পর ঈশান দরজা বন্ধ করল। আমি মুখে দুইহাত রেখে কেঁদে ফেললাম। ঈশান আমার পাশে বসে বলল,” তোমার কি কালরাতের কথা মনে পড়েছে তারিন?”
আমি দিশেহারা হয়ে বললাম,” কিছু মনে পড়ছে না আমার। একটা কথাও না। আমি বুঝতেই পারছি না কিভাবে এসব হয়ে গেল। কি করেছেন আপনি বলুন তো?”
ঈশান শান্ত গলায় বলল,” আমি কিছুই করিনি। যা করার সব তুমিই করেছ। আমি সামলাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।”
” কি করেছি আমি?”
ঈশান আমাকে বিস্তারিতভাবে যা বলল তার সারমর্ম অনেকটা এমন-
গতরাতে আমাকে আর ঈশানকে ঘনিষ্ট অবস্থায় দেখে নেওয়ার পর নাশফী, সামিয়া, রিদিরা এই ঘটনা পুরো বিয়ে বাড়িতে ছড়িয়ে দিয়েছে। সবার কানে পৌঁছে গেছে যে আমি মদ খেয়ে জঘন্যভাবে মাতলামো করছি আর ঈশান আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে।একটা যুবতী মেয়ে আর একটা যুবক ছেলে ফাঁকা ঘরে একাকি থাকা মানে বিরাট অনর্থ। তার উপর আমি হুঁশেও ছিলাম না তখন। ভাইয়ার কানেও খবরটি যেতে বেশি সময় লাগেনি। আমি যে ড্রিংক করেছি এই কথাই ভাইয়া বিশ্বাস করতে পারছিল না প্রথমে। তারপর নিজের চোখে দেখার জন্য ভাইয়া বাগান থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। আর দরজার সম্মুখেই দেখতে পেল আমি নাইট ড্রেস পরে মাতাল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। ঈশান আমায় সামলাচ্ছে। সবকিছু বোঝার জন্য ওইটুকু ঘটনাই যথেষ্ট। আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। এরপর আমাকে একটা ঘরে এনে রাখা হলো। আর ভাইয়া ঈশানকে বাইরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল। ঈশান মনে মনে ঠিক করেছিল আজ ভাইয়াকে সব সত্যি জানাবেই। তার যা হওয়ার হবে। কিন্তু ঠিক তখনি ভাইয়া বলল,” তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ঈশান।”
ভাইয়ার এমন কথায় ঈশান থতমত খেয়ে গেল। এতো ঘটনার পর ভাইয়া যদি ঈশানকে মারধোরও করে তাও কম হয়ে যায়। কিন্তু উল্টা সে ঈশানকে ধন্যবাদ দিচ্ছে! ঈশান কিছুই বুঝতে পারল না।
ভাইয়া আরও বলল,” তোমার ওই বাজে ফ্রেন্ড ফাহিমের জন্য আমার বোনের আজকে অনেক বদনাম হতে যাচ্ছিল। ওই স্কাউন্ড্রেল নাকি জোর করে তারুকে মদ খাওয়িয়েছে? ”
ঈশান মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু ফাহিমের দোষ নেই।”
ভাইয়া রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে বলল, ” বন্ধুর হয়ে অকালতি কোরো না প্লিজ। আমি চিনি ওর মতো ছেলেদের। আমার বোকা বোনকে প্রেমের জালে ফাসিয়ে গ্রাস করতে চেয়েছিল। বাস্টার্ড একটা! তুমি ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে তাই না? আমাকে বলোনি কেন?”
ঈশান জবাব দিতে পারল না। ভাইয়া আফসোস কর্যে করতে বলল,” অসংখ্যবার তারুকে আমি ফাহিমের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু তারু একবারও আমার কাছে স্বীকার করেনি। আর আজ দেখলে তো কি হলো! কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল! আমারই ভুল। ফাহিম এই বাড়িতে আছে জানার পরেও তারুকে আমার একা এখানে পাঠানো উচিৎ হয়নি। কিন্তু তুমিও বিয়েতে থাকবে শুনে আমি তোমার উপর ভরসা করেছিলাম, ঈশান৷ তুমি কি এসব আটকাতে পারলে না?”
ঈশান সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্য বলল,” তারুর কিছু হয়নি, ভাইয়া। আপনি বিশ্বাস করুন!”
ভাইয়া মৃদু হেসে বলল,” জানি। তুমি থাকতে ওর কিছু হতেই পারে না। কিন্তু মান-সম্মানটা যে চলে গেল! আজকে আমার বোনের যে অসম্মান হলো সেটা তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তুমি এখানে ছিলে বলে ও না হয় বেঁচে গেছে। তুমি ওর ক্ষতি হতে দাওনি। ভাগ্যিস আজ এইখানে তুমি ছিলে ঈশান। নাহলে তারুর সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়ে যেতো। আমার অনুপস্থিতিতে আমার বোনের খেয়াল রাখার জন্য আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। ”
ঈশান যখন বুঝতে পারল, ভাইয়া ফাহিম ভাইকেই দোষী ভাবছে আর ঈশানকে ভরসা করছে তখন ঈশানের পক্ষে সত্যিটা স্বীকার করা আর সম্ভব হলো না। সেই সাহসটাই সে পেল না। মা এই ঘটনায় ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অনুষ্ঠানে একটা বাজে পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল। চারপাশে আমার নামে যা নয় বলা হচ্ছিল। যে কারণে মা এতো কষ্ট পেয়েছে। ঈশান সবাইকে আর কষ্ট দিতে চায়নি। যেখানে এতো হতাশার মাঝে আমার বাড়ির সবাই ঈশানের প্রতি একটু ভরসা করে ভালো আছে সেখানে ঈশান কিভাবে তাদের এই ভরসার দেয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে নিজের দোষ স্বীকার করবে? সবাই তো তাহলে একদঅম নিঃস্ব হয়ে যাবে। আমার পরিবারের কাছে ভালো হওয়ার জন্য নয় বরং সবাইকে ভালো রাখার জন্যই ঈশান সত্যিটা আর বলতে পারল না।
এদিকে বিয়ে বাড়িতে আমার এতোবড় একটা বদনামের পর সবাই হয়তো আমাকে ছি, ছি করবে৷ আমার বিয়ে হওয়া তো দূর, বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়বে। এসব নিয়ে ভাইয়া যখন হতাশায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল তখন ঈশান নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ভাইয়ার হতাশা দূর করল।
ভাইয়া এখন মনে-প্রাণে ঈশানকে ভরসা করছে। আর ফাহিম ভাইকে আগের চেয়েও দশগুণ ঘৃণা করছে। ভাইয়া যেহেতু জানে, মোহনা আন্টির ছেলে মানে ফাহিম ভাই তাই ভাইয়া মোহনা আন্টির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
আমি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বললাম,” সব আগের মতোই আছে ঈশান। বরং পরিস্থিতি এখন আরও জটিল হয়ে গেছে।”
ঈশান মাথা নেড়ে বলল,” তা তো হয়েছেই। কিন্তু কিছু যে করার ছিল না! আমি কোনো ভাবেই তোমাকে হারাতে চাই না। যেদিন তোমার ভাইয়া সত্যিটা জানবে সেদিনই আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব। ”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,” আমিও আপনাকে হারাতে চাই না। তাই ভাইয়াকে কখনও সত্যিটা জানতে দিব না।”
ঈশান আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতে নিতে বলল,” চিন্তা কোরো না। বিয়ের পর আমি তোমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাব। দুইবছর পর ফিরে আসব। তখন আমাদের একটা ছোট্ট প্রিন্সেসও থাকবে। আমরা সব দোষ স্বীকার করে নিব। আশা করি তোমার ভাইয়া আমাকে মাফ করে দিবে। করবে না?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,” হ্যাঁ নিশ্চয়ই করবে। আমি স্ট্রেইট ভাইয়ার পায়ে পড়ে যাব। ভাইয়া ক্ষমা না করে পারবেই না! আমার ভাইয়া খুব ভালো। সে এতো নিষ্ঠুর হবে না।”
ঈশান অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পিপাসার্ত কণ্ঠে বলল,” আমার পাশে থেকো তারিন৷ তুমি থাকলে আমি সব করতে পারি।”