#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২০।
ব্রেক টাইম শেষ হওয়া পর্যন্ত রিধিশা আর জোতি, মাহিনের সাথে কফিশপে বসে ছিলো। টাইম শেষ হতেই দুজন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। মাহিন বের হয়ে যাবে দেখে নিশাদও বেরিয়ে গেলো। নিশাদ মাহিনের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। মাহিন নিশাদের তীক্ষ্ম চোখ জোড়া দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে নিশাদের যাওয়ার দিকে। এভাবে তাকানোর কারণ খুঁজে পায়নি সে। মাহিন ঠোঁট উল্টে গাড়িতে উঠে চলে গেলো।
ভার্সিটি ছুটি হতেই রিধিশা প্রতিদিনকার মতো লেকের কাছে আসলো। দু-তিন দিন পর আসা হয়েছে আজকে। রিধিশা আলতো হেসে কয়েকটা ফুল নিয়ে গিয়ে বসার জায়গায় বসে পড়লো। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর কারো অস্তিত্ব অনুভব করে তবে চুপচাপ বসেই থাকে। নিশাদ ছাড়া আর কেউ হবে না ভালো করেই জানে।
হুট করে নিশাদ রিধিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিধিশা শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে বললো
” কি! এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”
নিশাদ বাঁকা হাসি দিয়ে রিধিশার গালে কিছু ঘষে লাগিয়ে দিলো। রিধিশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। চেঁচিয়ে বলে
” এই শয়তান লোক কি লাগিয়েছেন আপনি?” নিশাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো
” এই তো তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফট এটা।”
রিধিশা নিশাদকে সরিয়ে পানির কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখে গালে কাঁদা মাখিয়ে দিয়েছে। রিধিশা চোখ বড়বড় করে নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদ চুলে হাত বোলাতে বোলাতে জ্যাকেট টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়লো।
রিধিশার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। রিধিশা রেগে বললো
” বজ্জাত, ঘাড় ত্যাড়া, শয়তান একটা ছেলে। আপনাকে কি যে করবো আমি! আপনার ওই মিলি কে বলবো আপনি বারবার আমার পেছনে পড়ে থাকেন।” লেকের পানি দিয়ে ঘষে কাঁদা গুলো মুছে উঠে আসে। নিশাদ শিশ বাজিয়ে বললো
” আরেহ বাহ! তোমাকে একদম লাল টমেটো লাগছে। বাসায় রান্না হয়ে গিয়েছে নাহলে আজকে টমেটোর তরকারি খেতে ইচ্ছে করছে, রান্না করতে বলতাম।”
রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে নিচ থেকে খামছে মাটি উঠিয়ে নিলো। হাত এগিয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিশাদের গালে মাখিয়ে দিলো। নিশাদ হচকচিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গা ঝেড়ে মাটি সরিয়ে অগ্নিচোখে রিধিশার দিকে তাকালো। রিধিশা চোখ রাঙ্গিয়ে বললো
” কি এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? নিজে যখন তখন কিছু না তাই না? নিজের বেলায় ষোলো আনা আমার বেকায় দুই আনা? আমি তো দুই আনা নেবো না। ষোলো আনাই নেবো।” নিশাদ রিধিশার ওড়নার একটা কোণা টেনে গাল মুছতে মুছতে বললো
” তোমাকে দুই আনা না এখন বিশ আনা ফেরত দেবো।” রিধিশা ওড়না ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য টেনে বললো
” বেয়াদব ছেলে ওড়না ছাড়ুন! এখন যদি একটা চিৎকার করি না! গণপিটুনি খেয়ে ছাড়া পাবেন।”
নিশাদ ওড়নাটা শক্ত হাতে ধরে রেখে বললো
” আচ্ছা! তাহলে করো চিৎকার। আমিও দেখি আমাদের দেশ এতো নিরাপদ কবে হল!” রিধিশা মুখ বাঁকায়। নিশাদ রিধিশা ওড়না ছেড়ে আচমকা রিধিশার হাত টেনে লেকের পানির উপর রিধিশাকে ধরে রাখে। রিধিশা চিৎকার করতে থাকে তাকে সরানো জন্য। নিশাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” এবার বলো আমার পেছনে লাগবে আর? আর বেয়াদবি করবে?” রিধিশা ক্ষেপে বললো
” আমি বেয়াদবি করি? আপনি নিজেই তো বারবার আমার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকেন। অসভ্য ছেলে! আপনার মতো ছেলে দেখিনি আমি। আপনাকে লোকেরা এতো ভালোবাসে কি করে? ছি! আমার মনে হয় একমাত্র আমিই আপনাকে ভালো করে চিনি।”
নিশাদ ধমক দিয়ে বললো
” এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দেবো। এক যদি ফেলে দেই না তোমাকে! পানিতে ঢুবে মরবে যদি আমি না বাঁচাই তোমাকে। আমি কিন্তু জানি তুমি সাতার জানো না। পিকনিকে তাই তো ট্রলারে উঠোনি পড়ে যাওয়ার ভয়ে। আর এই লেকের পানি অনেক গভীর বুঝলে। কিন্তু এখন যদি তোমাকে ফেলে দেই?”
রিধিশা চোখ বড় বড় করে ঢোক গিলে বললো
” দে…দেখুন আমাকে ফ..ফেললে কিন্তু খুব খারাপ হবে! এখনই আমাকে সরান এখান থেকে।” রিধিশা আরো করে শক্ত করে নিশাদের হাত ধরলো। নিশাদ হাতের বাঁধন হালকা করতেই রিধিশা চিৎকার করে উঠে।
নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বললো
” মরার মুখে থেকেও আমাকে হুমকি দিচ্ছো! ভয় ডর নেই না? তুমি তো অনেক সাহসি তাই না?”
রিধিশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” না, না ভালো করে দেখুন, দেখুন! আমি অনেক ভয় পাচ্ছি। প্লিজ ছাড়বেন না আমাকে।”
” আচ্ছা তাহলে সরি বলো! এখন যদি কেনো জিজ্ঞেস করো তাহলে ছেড়ে দেবো।”
” সরি, সরি। সারাজীবনের জন্য সরি। আপনার সাথে দেখা কেনো হয়েছিলো সেটার জন্য আরো বড় সরি। দেখা না হলে এই দিনই আসতো না।”
নিশাদ হেসে রিধিশাকে হেচকা টানে সেখান থেকে সরিয়ে আনে।
রিধিশা বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে। নিশাদ রিধিশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রিধিশা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। রিধিশাকে স্বাভাবিক লাগছে না। নিশাদ আলতো স্বরে ডাকলো
” রিধিশা!” নিশাদের ডাকে রিধিশা চমকে উঠে। নিশাদ এগিয়ে এসে বললো
” ঠিকাছো তুমি? আরে তোমাকে পানিতে ফালাইনি। এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?” রিধিশা ব্যাগ নিয়ে এলোমেলো পায়ে ছুটে চলে যায়। নিশাদ কয়েকবার ডাকলেও শুনলো না। নিশাদ বাইক নিয়ে পেছনে ছুটলো। রিধিশা রাস্তায় থেমে পড়ে। নিশাদ দ্রুত দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে রিধিশার কাছে আসে। বাইক থেকে নামতে নামতে রিধিশা চলে যেতে চাইলেও যেতে পারে না। হাত-পা কাঁপছে মেয়েটার। নিশাদ রিধিশাকে দোকানের বেঞ্চিতে বসিয়ে বললো
” শান্ত হও একটু ধরো পানি খাও।” রিধিশা পানি খেয়ে ধীরেসুস্থে একটু শান্ত হয়।
নিশাদ চিন্তিত হয়ে বললো
” ঠিকাছো এখন?” রিধিশা মাথা নেড়ে সায় জানায়। রিধিশা উঠে চলে যেতে নিলে নিশাদ বললো
” দাঁড়াও। আমার সাথে চলো তওমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
রিধিশা শান্ত গলায় বললো
” তার দরকার পরবে না। আমি যেতে পারবো এখন।”
নিশাদ ধমক দিয়ে রিধিশাকে বাইকে উঠতে বলে। রিধিশা দূরত্ব রেখে কোনোরকমে বসে। রিধিশার
স্টুডেন্ট এর বাসায় তাকে পৌঁছে দিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে আসে নিশাদ।
.
রিধিশা বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষ করলো। ভার্সিটির ফি দেবে কালকে। টাকা বের কতে দেখে ৪হাজার টাকা রয়েছে বাকিটা মাস শেষ হওয়ার আগে পেয়ে যাবে। রিধিশা ৩হাজার টাকা ব্যাগে রেখে দেয়। ১হাজার টাকাও বের করে রাখে। রান্নার কিছু জিনিস কিনতে হবে। এখনকার দিনে জীবনি চলা যেনো পুরোটা টাকার উপরই নির্ভর করে। টাকা ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা মুশকিল হয়।
রিধিশার ভাবনার মাঝে ফোনের তীব্র রিংটোন বেজে উঠে। মায়ের ফোন এসেছে। রিধিশা রিসিভ করে কিছু বলার আগেই লিমা বেগম বললো
” রিধি সুখবর শোন। পরের সপ্তাহের শেষের দিকে মাহিনের পরিবার আসছে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। তখন মাহিনের বাড়ির লোক তোকেও বাড়িতে দেখতে চায়।”
রিধিশা অবাক স্বরে বললো
” এতো তাড়াতাড়ি সব কিছু?”
” কোথায় তাড়াতাড়ি? তখন তো বিয়ের তারিখ ঠিক করতে আসবে। তারপর বিয়ের জন্যও তো সময় নেবে, অনেক সময় বাকি। আর তুই কিন্তু এবার আসার জন্য না করিস না। এখন তোর সম্মতি রয়েছে আর বিয়ের তারিখ ঠিক হবে তাই ছেলের পরিবারও তোকে সব কিছুতে চায়।”
” ঠিকাছে ঠিকাছে। আগে সময় হোক আমি আসবো।”
________
ব্যস্ততার মাঝে দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেড়িয়ে যায়। রিধিশার বাড়ি যাওয়ার দিনও এগিয়ে এসেছে। মাহিন নিয়মিত রিধিশার সাথে কথা বলে। কয়েকদিনে আরো দুবার দেখাও করতে হয়েছে মাহিনের কথায়। দুই দিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কিছু সময়ের জন্য ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে। একদিন জোতিকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো। মাহিনের সাথে রিধিশার একটা বন্ধু সুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। রিধিশা চুপচাপ, গুটিয়ে থাকতে চাইলেও মাহিন থাকতে দেয় না। মাহিন খুব ভালো একটা ছেলে সেটাও বুঝতে পারছে রিধিশা।
জোতি, মাহিনের হাসি মজা সব সময় লেগে থাকে।
নিশাদ সব সময় রিধিশার পেছনে লেগে থাকে। রিধিশা নিশাদের হঠাৎ নতুন নতুন আক্রমণের জন্য ভয়ে থাকে। নিশাদের থেকে দূড়ে থাকতে চাইলেও নিজেও দূড়ে থাকতে পারে না আর নিশাদ নিজেও
দূড়ে থাকার সুযোগ দেয়না বললেই চলে। দেখা হলেই নিশাদ রিধিশার সাথে ঝগড়া করতে চলে যাবে কারণে হোক বা অকারণে।
চলবে……
[নায়ক তো চেঞ্জ হয়ে গেলো এখন কি হবে?আসল নায়ক কে হবে?]#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২১।
রিধিশা টিউশনি থেকে আজকে আবার বাসায় ফিরে এসেছে। নিশাদ ব্যালকনি দিয়ে রিধিশাকে দেখেই বুঝলো আজকে এই মেয়ে আবার ভার্সিটি বন্ধ করবে। নিশাদ তৈরি হয়ে সূর্যদের রেখে আগে আগে বেরিয়ে গেলো। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিধিশার জন্য।
কিছুক্ষণ পর রিধিশাকে নামতে দেখে রিধিশার সাথে হাটতে থাকে। রিধিশা একবার আড়চোখে নিশাদের দিকে তাকিয়ে সোজা হাটতে থাকে।
নিশাদ বললো
” ফাঁকিবাজি মেয়ে আজকেও ভার্সিটি বন্ধই করছো তুমি? তোমার দেখি বিয়ে ঠিক হয়ে প্রমোশন হয়েছে। ভার্সিটি বন্ধ করে করে প্রেম করতে চলে যাও।”
রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
“আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আপনার কি? আপনি নিজের কাজ করুন গিয়ে নাহলে ওই মিলিকে নিয়ে প্রেম করুন বাধা কে দিয়েছে?”
” আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস নেই কারো বুঝেছো?
আমি যদি কাউকে বিয়ে করতে চাই তাহলে তাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে বিয়ে করবো। কেউ কিছু করতে পারবে না শুধু চেয়ে চেয়ে আমার বিয়ে দেখবে।”
রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” হ্যা, পৃথিবীতে তো একমাত্র আপনারই সব ক্ষমতা রয়েছে আর কারো নেই, না? আমার তো মনে হচ্ছে যেই বাড়ির মেয়েকে তুলে আনবেন সেখানে গিয়ে আগে মার খাবেন তারপর বেঁচে থাকলে হয়তো বিয়ে হবে।” নিশাদ আড়চোখে তাকিয়ে বললো
” সেটা সময় হলেই দেখিয়ে দেবো। এখন চলো আমার সাথে। তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। আজকে তোমাদের খুব ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাস রয়েছে।”
নিশাদ রিধিশার হাত টেনে বাইকের কাছে নিয়ে বললো
” উঠে বসো। তুমি আমার সাথে যাবে আজকে।”
রিধিশা মেকি হাসি দিয়ে বললো
” হ্যা, তারপর ওই মিলির কাছে অপমানিত হবো তাই না? এটাই চান বোধয় আপনি। ছাড়ুন আমাকে, কথায় কথায় হাত ধরেন কেনো? আমাকে ছুঁতে না করেছি না?”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” তোমাকে ছোঁয়ার জন্য বসে নেই আমি। ঠিকাছে তোমাকে ছোঁবো না।” বলেই রিধিশার চুল টেনে ধরে। রিধিশা রেগে ক্ষিপ্ত গলায় বললো
” আবার চুল ধরে টানছেন? আপনার কি আমাকে শান্তিতে দেখতে ভালো লাগে না নাকি? চুল ছাড়ুন আমার।”
নিশাদ এক হাতে চুল ধরে রেখে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো
” তোমাকে ছোঁয়া যাবে না কিন্তু চুল ধরলে তো ছোঁয়ার তালিকায় পড়ে না। এবার এভাবেই নিয়ে যাবো তোমাকে।” রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” ধুর, ছাড়ুন না! আমার দরকারি কাজ আছে।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” তোমার দরকারি কাজ আমার সব জানা আছে। ঘুরতে যাবে, প্রেম করবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসবই তো!”
রিধিশা ব্যাগ থেকে পিন বের করে নিশাদের হাতে হালকা গুঁতো দেয়। আচমকা গুঁতো খেয়ে নিশাদ চমকে উঠে। রিধিশার চুল ছেড়ে হাত দেখতে থাকে। এরমাঝে রিধিশা হাসি দিয়ে বললো
” কিছুই হয়নি হাতে। এবার একাই যান ভার্সিটিতে।” রিধিশা দৌঁড়ে চলে গেলো।
নিশাদ রাগে টগবগ করতে থাকে। মাহিনকে দেখার পর থেকে রিধিশা মাহিনের সাথে দেখা করতে যায় কথাটা জানলে একদমই সহ্য করতে পারে না নিশাদ।
নিশাদ রাগে এক ধ্যানে বসে রয়েছিলো তখন সূর্য এসে পেছনে বসতে বসতে বললো
” কিরে? একসাথেই যখন যাবি এতো আগে বের হয়েছিলি যে? চল সাদি আর রেহান বাইক নিয়ে আসছে।” নিশাদ কথা না বলে স্টার্ট দেয় বাইক। স্প্রিডে বাইক চালাতে দেখে সূর্য শক্ত হয়ে বসে থাকে। নিশাদের রাগ যে নাকের ডগায় রয়েছে টের পাচ্ছে সেটা।
.
রিধিশা রেস্টুরেন্টের ভেতরে একটা নিস্তব্ধ জায়গায় বসে রয়েছে। কোনো টেবিল খালি না থাকায় এখানে বসতে হয়েছে। শুধু মাঝে একটা থাই গ্লাসের উপস্থিতি রয়েছে তবে সেখানে কোনো শব্দই এখানে আসছে না। রিধিশা মাহিনের অপেক্ষায় বসে রয়েছে তেমনও নয়। মাহিন সামনে চুপচাপ বসে রয়েছে। রিধিশা মাহিনের কথা শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। কিছু সময় পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু মাহিন ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা ছাড়া কিছুই বলেনি।
রিধিশা গলা ঝেড়ে বললো
” আর কতোক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবেন? কি বলতে চান বলুন! আপনাকে চুপচাপ দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু হয়েছে।”
মাহিন নিচু স্বরে বললো
” আমি যা বলতে এসেছি সেটা বলবো ভেবেই আমার নিজের উপর লজ্জা অনুভব হচ্ছে। সব কথা শোনার পর আপনিও হয়তো আমাকে খারাপ মনে করবেন।”
রিধিশা মাহিনের দিকে ভালোভাবে তাকালো। তিনদিন আগেই দেখা হয়েছিলো তখন একদম হাসি-খুশি প্রাণ সচ্ছল মনে হচ্ছিলো কিন্তু দু দিনের মধ্যে কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারছে না রিধিশা। মাহিনের উজ্জ্বল চোখে মুখে অন্ধকার হয়ে আছে। চেহারায় লজ্জা, দ্বিধা আর অনুতপ্তর চাপ প্রকাশ পাচ্ছে। রিধিশাও মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে। শান্ত গলায় করলো
” দেখুন যা বলার বলুন তারপর কি হবে সেটা তো বোঝাই যাবে। কিন্তু কি হবে ভেবে কিছু যদি নাই বলেন তাহলে সমস্যা সমাধান হবে না। আপনি তো সেইদিন বললেন আমরা বন্ধু এখন নিজেই কথা বলতে পারছেন না আমার সাথে?”
মাহিন রিধিশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো সাথে সাথে। বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
” আপনাকে আমার এক বন্ধুরা কথা বলেছিলাম যার মা হসপিটালে ভর্তি ছিলো। তাকে গত পরশু দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে আরেকজনকে দেখতে পেয়েছি। আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড মানে তারা’কে। আমি ওকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকমাসে একদম চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। একটু কথাও হয়েছিলো। হসপিটালে কি করছে সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু উত্তরে শুধু হেসে চলে গিয়েছিলো।
চলে আসার আগে তারা’র বোনকে পেয়েছিলাম। আমাকে দেখেই অনেক কেঁদেছে। তারপর ওর বোনের থেকে জানতে পেরেছি আমাদের ব্রেকাপ হওয়ার পর থেকে তারা কিছুদিন পর সুইসাইড করে। তারপর শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। আমার জন্য প্রতিদিন রাতে কাঁদত। দিনদিন অসুস্থ হতে থাকে তখন তারা’র বাবা তারা’কে নিয়ে লন্ডনে চলে যায় তারাকে সুস্থ করার জন্য। সেখানে তিন মাস থাকে আর সাইক্রেটিস ডক্টরের মাধ্যমে কাউন্সিল করতে থাকে। আগামী মাসে এসেছে। এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও মাঝে মাঝে পাগলামি করে আমার জন্য। যখনই এমন হয় তখনই
হসপিটালে একজন সাইক্রেটিস এর সাথে দেখা করে। সব জানার পর সেইদিনই তারা’র সাথে যোগাযোগ করে আমি দেখস করি। তারা আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর কেঁদে দেয়। আমারও নিজেকে অসহায় লাগছিলো। তারা আমাকে ওর কাছে ফিরর যেতে বলছে। তারা এখনও জানে না আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
রিধিশা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে থেকে বললো
” এতো কিছু হয়ে গেলো কিন্তু আপনি কিছুই জানতেন না?” মাহিন মাথা নিচু করে বললো
” আমি সত্যি জানতাম না আর তারা’র বাবা তারা’র অবস্থার জন্য আমাকে দায়ি মনে করছে। তাই এতো মাসে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ বা আমি এসব জানতে পারি এমন কোনো সূত্র রাখেনি।”
রিধিশা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো
” আপনি ক তারা’র কাছে ফিরে যেতে চান?”
“আমি জানি না কি করবো। মা-বাবাকে বলার পর থেকে ওরা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে আমার সাথে। তারা’র সম্পর্কে ওরা জানতো না তাই রেগে আছে। আর এখন আমি আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছি। বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে আপনার, আমার দুজনের পরিবারের মান-সম্মানে আঘাত পড়বে আর হলে তারা’কে আমি পাবো না। মনে হচ্ছে দুই নৌকায় অয়া দিয়ে চলছি আমি।” মাহিন রিধিশার দিকে তাকিয়ে দেখে রিধিশা চুপচাপ বসে আছে। মাহিন ধীর গলায় বললো
” সত্যি বলতে আপনার সাথে এই কয়েকদিনের পরিচয়ে আপনার প্রতি ভালোলাগা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিলো কিন্তু তারা’কে দেখার পর মনে হচ্ছে ভালোবাসার সামনে বাকি সব ফিকে। এতোদিন আমার মনে হতো তারা আমাকে ভুলে মুভ অন করেছে কিন্তু এখন সব জেনে নিজেকে নিচু একটা মানুষ মনে হচ্ছে। প্রথমে কয়েকবার তারা’র খোঁজ খবর নিতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। আমি ভাবতাম তারাই সব খোঁজ খবর নেওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে তাই পরে আর চেষ্টাও করিনি। এখন আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছি কি করবো বুঝতে পারছি না।”
রিধিশা হাসলো মাহিনকে দেখে। মাহিন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রিধিশার হাসি দেখে। রিধিশা হাসতে হাসতে বললো
” যেই কারণে দিশেহারা হয়ে রয়েছে সেটা তো কোনো কারণই না। আমাদের বিয়ে তো এখনও ঠিক হয়নি। এই সপ্তাহের শেষে পরিপূর্ণ ভাবে বিয়ের ডেট সহ সব ঠিক হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এখনও হয়নি। আর মান-সম্মান যাওয়ার মতো এখনও কিছুই হয়নি। আমি আমার বাসায় আগেই বলে রেখেছিলাম বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু না জানানোর জন্য। আর আপনার বাড়িতেও এখন আপনার ব্যাপারে সবটা জানে তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই।”
মাহিন অবাক হয়ে বললো
” মজা করছেন আপনি? এতোকিছু হলো আর বলছেন কোনো সমস্যা নেই?”
রিধিশা আলতো হেসে বললো
” আপনি একটু আগেই তো বললেন ভালোবাসার সামনে সব কিছু ফিকে। তাহলে এসব ধরছেন কেন? আমি বাসায় বলবো বিয়েটা আমি নিজে ভাঙছি তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। আপনাদেরও আর কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। আমার মাধ্যমে যদি দুটো মানুষ তাদের ভালোবাসাকে কাছে পায় তাহলে খুব খুধি হবো আমি ।”
মাহিন চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আবার সেই উজ্জ্বলতা নিভেও যায়। মাহিন ঢোক গিলে বললো
” আমি জানি আপনার খারাপ লাগছে।” মাহিনের ছোট্ট মুখটা দেখে রিধিশা হেসে দেয়।
” খারাপ লাগছে না তবে সত্যি কথা হলো আপনার মতো ভালো ছেলে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। আমার আপনার বিয়েটা হলে আমি নিজেই নিজেকে একটা দেয়াল মনে করবো। আপনাদের দুজনের ভালোবাসার মাঝে আমি একটা শক্ত দেয়াল হয়ে গিয়েছে এমন মনে করবো। তাই কারো জীবনে দেয়াল হতে চাই না আমি। আর এখন আমি মন থেকে চাই বিয়েটা না হোক। আর এই কয়েকদিনের পরিচয়টা একটা বন্ধুত্বের পরিচয় হয়ে থাক।”
মাহিন ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আমি। আমি ভাবিনি এতো সহজে সব কিছু আপনি মেনে নেবেন।”
রিধিশা হেসে বললো
” আমি কাদছি না আর আপনি ছেলে হয়ে কাঁদছেন? চোখ মুছে এবার হাসুন। আপনাকে এতোদিন শুধু হাসতে দেখে বিরক্ত লাগতো এখন মনে হচ্ছে আপনাকে হাসি ছাড়া মানায় না। চটপট কফি বা কিছু অর্ডার করুন। আপনার গার্লফ্রেন্ডকে ফিরে পেয়েছেন একটা ছোটখাটো ট্রিট তো পেতে পারি?”
মাহিন হেসে দেয় রিধিশার কথায়। রিধিশার সব জড়তাও যেনো কেটে গিয়েছে।
.
রিধিশা টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে। এসেই লিমা বেগমকে ফোন করে বললো বিয়ে করতে চায় না। লিমা বেগম কারণ জিজ্ঞেস করলে রিধিশা বললো
” আমি পড়াশোনা করবো চাকরি করবো তারপর বিয়ে করবো।” লিমা বেগম রেগে বললো
” আরে তুই কি ছেলে নাকি যে চাকরি পেয়েই বিয়ে করতে হবে? তুই কি তোর বরকে খাওয়াবি নাকি?”
রিধিশা হেসে বললো
” একটু আধটু তো খাওয়াবোই। এখন ফোন রাখো বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছি বাবাকে বলে দাও। আমার এসব বিয়ে বিয়ে ভালো লাগছে না। একবার বাড়ি থেকে বের হয়েছি আবার জোড় করলে দুনিয়া থেকে চলে যাবো।” লিমা বেগম রেগে কিছুক্ষণ ধমকে ফোন কেটে দিলো। রিধিশা ফিকফিক করে হাসলো। রিধিশার খুবই খুশি লাগছে। মাহিন তার ভালোবাসা ফিরে পাবে সেই জন্য ভালো লাগছে রিধিশার।
ফ্রেশ হয়ে রান্না করতে গিয়ে দেখলো হলুদ, মরিচ, লবণ কিছুই নেই। রিধিশা বিরক্ত হয়ে বললো
” শেষ হওয়ার আর সময় পেলো না? এতো রাতে এখন দোকানে যেতে হবে আমার।”
রিধিসজা সাজেদা বেগমের ঘরে গিয়ে কলিং বেল বাজায়। হেনা দরজা খুলে রিধিশাকে দেখে বললো
” রিধিসবা ভেতরে এসো!” রিধিশা জোরপূর্বক হেসে বললো
” নাহ ভাবি আসলে একটু দরকারে এসেছিলাম।”
” কি দরকার বলো! কিছু লাগবে?”
” রান্না করবো মসলা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই একটু দোকানে যাওয়া লাগবে। নয়নকে একটু বলো না আমার সাথে আসতে?”
” আরে এখন আর যেতে হবে না। এসো আমি দিচ্ছি আর কালকে কিনে নিয়ে এসো।” রিধিশা মাথা চুলকে বললো
” অনেক জিনিস লাগবে তো ভাবি। এতো জিনিস কিভাবে নেবো?” হেনা হেসে বললো
” আমাদের পর করে দিচ্ছো মেয়ে? একটু জিনিস নিয়ে কি তোমাকে খোঁটা দেবো ভাবো? আচ্ছা দাঁড়াও নয়নকে ডেকে দিচ্ছি।” হেনা নয়নকে ডেকে নিয়ে এসে বললো
” সাবধানে যেও দুজন।” রিধিশা নয়নকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে কিছু দূড় সামনের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে নেয়। টাকা দিতে গিয়ে রিধিশার চোখ কপালে উঠে গেলো। রিধিশা চোখ বড়বড় করে বললো
” এইটুকু জিনিস পাঁচশ টাকা?” দোকানদার কিটকিট করে হেসে বললো
” আপনার শশুড় হইলে ফ্রিতে দিতাম। আপনার শশুড় তো না আমি, যে কম নিমু। বাজারে যা দাম সব কিছুর এখন আরো কম নিলে আমরা খাইলে পারমু না। ঠিক দামই কইছি এখন টাকা দেন তাড়াতাড়ি।”
রিধিশা রেগে বললো
” আরে আমাকে কি গাধা মনে হয় আপনার? কয়েকদিন আগেও দুইশো টাকা দিয়ে কিনেছি এসব। কয়েকদিনে কি তিনশো টাকা বেড়ে গেছে?”
দোকানদার চেঁচিয়ে উঠে রিধিশার উপর। রিধিশা সব জিনিস রেখে চলে আসতে নিলেই দেখে রেহান আর নিশাদ এসেছে।
নিশাদ একবার রিধিশার দিকে তাকিয়ে দোকানদারকে কে জিজ্ঞেস করে
“কি হয়েছে এখানে? কি নিয়ে ঝগড়া করেন আপনি?”
দোকানে থাকা আরেকজন লোক সব গরগর করে বলে দেয়। রেহান সব শুনে শার্টের হাতা গুটিয়ে গালি দিতে দিতে বলে
” মানুষকে গিলে খাওয়ার ধান্দা নাকি তোদের? দুপুরে আমি নিজে তিনশো টাকা দিয়ে এগুলোসহ আরো কত জিনিস নিয়ে গেলাম আর ৪ঘন্টার মধ্যে পাঁচশো টাকা হয়ে গেলো?” রিধিশা চোখ বড়বড় করে তাকায়।
দোকানদারের অবস্থা খারাপ। এলাকার সবাই নিশাদ, রেহান, সূর্য, সাদি সব গুলোকে হারে হারে চেনে। দোকানদারের পালানোর রাস্তাও নেই যে পালাবে।
চলবে…….