কুঁড়েঘর ২ পর্ব – ৬+৭

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২২।

দোকানদার ঢোক গিলে রিধিশাকে বললো
” দ..দুইশো টাকা দাও।” রিধিশা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দোকানদের দিকে। দুইশো টাকা দিয়ে সেখান থেকে সরে আসে। রেহান আর নিশাদ দোকানদারকে কিছুক্ষণ শাসিয়ে চলে আসে।
রিধিশা নয়নকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় এসে রান্না শুরু করে।

.
ভার্সিটিতে এসার পর সময় পায়নি পরে ব্রেক টাইমে জোতিকে মাহিনের ব্যাপারে সব বললো। সব শুনে জোতি মূর্তির মতো বসে রয়েছে। জোতি রেগে বললো
” তোকে আমার ইচ্ছে করছে দুটো থাপ্পড় দিতে। বেয়াদব মেয়ে! তুই ভালো মানুষ সাজতে গিয়েছিলি কেনো? এতোদিন ধরে বিয়ের কথাবার্তা সব বলে এখন বিয়ে ভাঙ্গার কথা বললো আর তুই আরো উৎসাহ দিয়ে এসেছিস? তোর উচিৎ ছিলো রিয়েক্ট করার। মাহিন ভাইয়াকে ভালো ভেবেছিলাম আর উনি কি করে বসলো এসব?”
রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” আমার তো মনে হচ্ছে তুই শুধু শুধু রিয়েক্ট করছিস।
এখানে রিয়েক্ট করার মতো ঘটনা ঘটেনি যে রিয়েক্ট করবো। প্রথম যখন দেখা হয়েছিলো তখনই মাহিন তারা’র কথা ক্লিয়ার করেছে। মাহিন ভালোবাসে একজনকে সেখানে আমি বিয়েটা না ভেঙ্গে কি ওদের ভালোবাসার মাঝে দেয়াল তৈরি করবো? মাহিন যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমি যদি বিয়েটা না ভাঙতাম তাহলে মাহিন চুপচাপ আমাকে বিয়ে করে নিতো কিন্তু আমার কারো মাঝে দেয়াল হওয়ার ইচ্ছে নেই। বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছে বলে যে আমি সারাদিন কাঁদবো তেমন কিছুই না। আমার মনে হচ্ছে মাহিন আর তারা’র পর আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো ওদের বিয়ে হলে। এবার তুই মাহিনকে দোষাদোষী করা বন্ধ কর।”

জোতি রেগে বললো
” হ্যা তোর তো সব কিছুই পানির মতো স্বাভাবিক মনে হয়। মাহিনের থেকে তোর উপর বেশি রাগ হচ্ছে আর তোকে মারতে ইচ্ছে করছে।” জোতি রেগে উঠে চলে গেলো। রিধিশা ডাকলো না জোতিকে। জোতির রাগকে অকারণে রাগ করা মনে হচ্ছে। রিধিশা উঠে ক্লাসে চলে গেলো।
জোতি রেগে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন রেহান ডাকলো পেছন থেকে কয়েকবার। জোতি পা না থামিয়ে আবার ঘুরে রেহানের সামনে গিয়ে মেজাজ নিয়ে বললো
” কি হয়েছে বলো।” রেহান হেসে বললো
” বিকেলে আজকে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। আমি ফোন করলেই তৈরি হয়ে চলে আসবে।” জোতি রেগে বললো
” তুই একাই ঘুরতে যা। কোথাও যাবো না আমি।”
জোতি হনহন করে চলে গেলো। রেহান হা করে তাকিয়ে আছে। রেহানের সাথে নিশাদরাও ছিলো। জোতির কথা শুনে তিনজন রেহানের দিকে তাকায়।

রেহান মন খারাপ করে ফেললো। নিশাদ বললো
” তোর উপর রেগে আছে হয়তো। তোরা কি ঝগড়া করেছিলি?”
” আরে না। কয়েকদিন আগে ঝগড়া করে ব্লক দিছিলো তারপর দুঘণ্টা পরই খুলে ফেলছে এরপর তো আর ঝগড়া হয়নি কোনো।” সূর্য শান্তনা দিয়ে বললো
” তাহলে চিন্তা করিস না। গিয়ে কথা বল তাহলে বুঝবি কি হয়েছে।” রেহান মাথা নেড়ে চলে যায় জোতির কাছে যাওয়ার জন্য। নিশাদ আশেপাশে তাকিয়ে রিধিশাকে খুঁজলো কিন্তু চোখে পড়লো না কোথাও। সাদি নিশাদকে বললো
” নিশাদ তোরও কি কেউ রাগ করেছে?” নিশাদ বুঝতে পেরে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো
” আমার কে রাগ করবে? আমার কি বউ আছে?”
সূর্য সাদির দিকে তাকিয়ে বললো
” বউ ছাড়াই তো আজকাল কতজনের ভাবনায় ডুবে থাকিস। যার ভাবনায় ডুবে থাকিস তারা তো রাগ করতেই পারে তাই না!” সাদি সায় জানিয়ে সূর্যর সাথে মুখ টিপে হাসলো। নিশাদ কিছু বললো না গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।

.
রিধিশা আজকে লেকের পার আসলেও পানির থেকে দূড়ে গাছের নিচে বসে থাকে। চোখ বন্ধ করে মুঠো পুড়ে ফুলের ঘ্রাণ শুকতে থাকে। ওড়নায় টান পড়তেই চোখ খুলে দেখে পাশে নিশাদ বসে বসে তার ওড়না নিয়ে ওড়নার মাথায় থাকা পমপম বাবল গুলো দেখছে। রিধিশা ওড়না টেনে কোলে রেখে বললো
” কি? আমার ওড়না ধরেছেন কেনো?”
” কেনো তোমার ওড়না কি গিলে ফেলছি আমি?
রিধিশা ভেঙচি দিয়ে ফুল গুলো নিয়ে বসে থাকে।

নিশাদ রিধিশার হাত থেকে ১টা ফুল নিয়ে বললো
” জোতিকে তখন দেখলাম রেগে কোথায় গেলো? কার উপর রেগে ছিলো আর কেনো?” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে বললো
” আমার উপরই রেগে চলে গিয়েছে।” নিশাদ অবাক হয়ে বললো
” তোমার উপর কেনো? কি করেছো বেচারির সাথে? তুমি দেখি সত্যি দজ্জাল মেয়ে।” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” ওইটা শুধু আপনারই মনে হয়। জোতি এমনি রেগেছে আমি বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছি তাই।”

নিশাদের চমকে হা করে তাকিয়ে থাকে রিধিশার দিকে। নিজের কানে শোনা কথাটা যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। নিশাদ বিস্ময়ের স্বরে বললো
” কি বললে তুমি? আরেকবার বলো তো!”
রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
” আরেকবার কেনো বলবো? কানে শুনেন না আপনি?” নিশাদ যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
নিশাদের খুশির জোয়ার ভাটা বইতে থাকে।
” কেনো ভেঙ্গেছো বিয়েটা? ছেলেটা কি খারাপ?”

” নাহ মাহিন খুব ভালো ছেলে তবে যেই কারণে বিয়ে ভেঙ্গেছি সেটা অনেক বড় কাহিনী। এতোকথা আপনাকে বলে কি করবো?” নিশাদ মুখ কালো করে কোণা চোখে তাকায়। আবার হাসি মুখে বললো
” ভালো হয়েছে বিয়ে ভেঙ্গেছে। তুমি আর আমি নাহয় একসাথেই বিয়ে করবো।” রিধিশা থমথমে চেহারায় নিশাদের পানে তাকায়।
নিশাদ গলা ঝেড়ে সামনে তাকিয়ে বললো
” যদিও মনে হয় না তোমাকে কেউ বিয়ে করবে তবে চিন্তা করো না আমি আছি তো!” রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” কেনো আপনি আমাকে বিয়ে করবেন নাকি? আপনি আমাকে বিয়ে করার আগে বিবাহিত কোনো লোকের দ্বিতীয় বউ হয়ে যাবো।”

” ইশশ! তোমাকে বিয়ে করার জন্য যেনো আমি মরে যাচ্ছি? তোমাকে বিয়ে করার কথা তো স্বপ্নেও ভাবি না আমি। আমার বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই তোমার।আমার বউ আমার মনের মতো হবে।”
রিধিশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। নিশাদ খুশিতে বাইক নিয়ে বাসায় ছুটলো।

আজকে সকাল পর্যন্ত সিগারেট এর গন্ধে নিশাদের ঘরে যাওয়া যাচ্ছিলো না। সে এখন বাইরে থেকে খাবার এনে লাউড স্পিকারে গান ছেড়ে পার্টি করছে।
ঘরে এসে সূর্যরা সবাই এসব দেখে অবাক হয়েছিলো। এখন নিজেরাও যোগ দিয়েছে। নিশাদের কয়েকদুনের অবস্থা দেখে রেহানরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। এখন নিশাদকে দেখে মনে হচ্ছে নিশাদ বিশ্ব কাপ জিতে এসেছে।

___________

নিশাদ আজকে দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠে। কালকে অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলো তাই উঠতে দেড়ি হয়ে গিয়েছে। নিশাদ তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটির জন্য বের হচ্ছিলো তখন পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে স্নেহার আম্মু ডাক দেয় নিশাদকে। নিশাদ সূর্যকে বাইক বের করতে বলে স্নেহার আম্মুর কাছে এগিয়ে যায়।
স্নেহার আম্মু বললো
” নিশাদ তোমার চেনা পরিচিত কোনো টিচার থাকলে আমাকে জানিও তো! স্নেহার টিচার ছিলো তার আগামী মাসে বিয়ে তাই আর পড়াতে পারবে না। স্নেহার জন্য নতুন টিচার লাগতো আর কি। স্নেহা একটু বেশিই চঞ্চল মেয়ে তো তাই অনেকেই পড়াতে চাইছে না।” নিশাদ বিড়বিড় করে বললো
” সবারই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি? চারপাশে শুধু বিয়ের কথা শুনি।”

” কিছু বললে নিশাদ?” নিশাদ চমকে বললো
” হ্যা আন্টি আমি খুঁজে দেখছি। কাউকে খুঁজে পেলে আজই জানাবো।” স্নেহার আম্মু সায় জানায়। নিশাদ দৌঁড়ে চলে যায়।

রিধিশা জোতির রাগ কমিয়ে ফেললেও ব্রেক টাইমে রেহান এসে এখন জোতিকে চেপে ধরেছে। কালকে জোতি তার সাথে একদমই কথা বলেনি তাই বেচারা চিন্তায় হার্ট এট্যাক করে প্রায়। রেহান অসহায় গলায় বললো
” দেখো কোনো ভুল করলে সরি। শাস্তি দিলে তাও দাও কিন্তু রাগ করে থেকো না প্লিজ জোতি! তুমি বললে তোমাকে এখনই শপিং এ নিয়ে যাবো। তুমি যা বলবে তাই করবো তাও ব্রেকাপ করো না প্লিজ!”

জোতি কপাল চাপড়ে বললো
” আরে কালকে রিধির উপর রাগ করেছিলাম তোমার উপর কেনো করবো? তোমার সাথে তো কোনো ঝগড়া হয়নি আমার।” রেহান নাক মুখ ফুলিয়ে রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” তোমার জন্য আমি হসপিটালে পৌঁছে যেতাম। তোমার রাগ আমার উপর দিয়ে গিয়েছে কালকে।” রিধিশা ফিকফিক করে হেসে দেয়। জোতি রেহানকে বললো
” চলো আজকে ফুচকা ট্রিট দেবে তুমি।” রেহান চোখ বড়বড় করে বললো
” ট্রিট! কিসের ট্রিট?”
“তোমার উপর রাগ কররে ব্রেকাপ করিনি সেই ট্রিট।”
রিধিশা, নিশাদ, সূর্য, সাদি সবাই হাসতে থাকে। জোতি সবাইকে নিয়ে ফুচকা স্টলের কাছে গিয়ে ফুচকা অর্ডার দেয়।

ফুচকা অর্ডার দিয়ে বেঞ্চে বসে কথা বলতে থাকে। নিশাদ চুপচাপ রিধিশার দিকে তাকিয়ে আছে। রিধিশার মাঝেমাঝে চোখ পারলেও অস্বস্তিতে পড়ে চোখ সরিয়ে নেয় কিন্তু নিশাদ এক ধ্যানে তাকিয়েই থাকে। সবাইকে ফুচকা দিলে সবাই খাওয়া শুরু করে। রিধিশা খুব মজা করে খাচ্ছে। নিশাদের প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছে। রেহান নিশাদের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো
” তুই তো ফুচকা কোনোদিন খাসনি আজকে ট্রায় করে দেখ। মরিচ সরিয়ে খাস।” নিশাদ মরিচ সরিয়ে সরিয়ে ফুচকা খেতে থাকে। উপরের মরিচ সরালেও ভেতরে মাখানো কাঁচামরিচ গুলো খেয়ে ঝালে হু হা করতে থাকে নিশাদ। সাদি গিয়ে পানি নিয়ে আসে নিশাদের জন্য।
” এইটুকু ঝালেই এই অবস্থা? মুখে কি মিষ্টির দোকান বসিয়ে রাখেন?” নিশাদ নাক টানতে থাকে। রেহান বললো
” নিশাদের ঝালে এলার্জি আছে। একবার ঝাল খেয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলো।” রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে আরেকটা ফুচকা মুখে দেয়। তার মুখে এক ফোটা ঝাল লাগলো না। রিধিশা মনে মনে বললো
“এই ছেলে দেখি মিষ্টির পাতিল অথচ আমার সাথে ঝগড়া ছাড়া আর কিছু করে না।”

চলবে…….#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৩।

ঝালের জন্য নিশাদের আর ফুসকা খাওয়া হয়নি।ফুচকা খাওয়া শেষে রিধিশা আর জোতি ক্লাসে চলে যায়। নিশাদ সূর্যদের নিয়ে তাদের ক্লাসে চলে গেলো।
ছুটির পর রিধিশা প্রতিদিনের কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে আসে। কাঠগোলাপ গাছে ফুল ফোটে না কয়েকদিন ধরে কৃষ্ণচূড়া গাছেই ফুল হয় এখন।
ফুল তোলার সময় রিধিশার চোখ যায় নিশাদের দিকে। নিশাদ পানির বসে ছিলো হয়তো এখন তার কাছেই আসছে। রিধিশা দুটো ফুল নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই নিশাদ দৌঁড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বললো
” এই মেয়ে কোথায় যাও? তোমার জন্য এতোক্ষণ ধরে বসে আছি আর তুমি পালিয়ে যাচ্ছো!”

রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” আমার জন্য অপেক্ষা করতে কে বললো?” নিশাদ রাগি গলায় বললো
” তুমি বললেই অপেক্ষা করতে হবে? মানুষের কি দরকারি কাজ থাকে না নাকি?” রিধিশা অবাক হয়ে দুই গালে হাত রেখে হা করে তাকিয়ে বললো
” কি! আমার সাথে কি দরকারি কাজ আপনার?”
নিশাদ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” একদম ঢং করবে না। চলো, ওইদিকে চলো বলছি।”
রিধিশা নিশাদের সাথে আবার আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।

” স্নেহাকে মনে আছে তোমার? স্নেহার টিচারের বিয়ে তাই টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে। স্নেহাকে পড়াতে হবে তোমার। কখন পড়াবে?” রিধিশা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো
” সময় নেই আমার।” নিশাদ মাথা চুলকে বললো
” একটু মেনেজ করো না! পাশেই তো বাড়ি সন্ধ্যার পরও পড়াতে পারবে।” রিধিশা ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো
” ভেবে দেখবো।” রিধিশা চলে যেতে নিলে নিশাদ আবারও ডাকে।

” আবার কি?” নিশাদ চোখের পলক ফেলে তার কাছে আসতে বলে। রিধিশা আবার এসে দাঁড়াতেই নিশাদ বললো
” কয়েকদিন পর ঈদের ছুটি দেবে বাড়ি যাবে না?”
রিধিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” জানি না। আপনি যাবেন না?”
” হ্যা। আচ্ছা তোমার পরিবারে কে কে আছে?”
” সব্বাইইইই আবার কেউ না।” নিশাদ রাগি চোখে তাকালে রিধিশা দাঁত কেলিয়ে চলে যায়।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রিধিশা স্নেহার ব্যাপারে ভাবতে থাকে।
” সিয়ামের টিউশনিটা ছেড়ে দিলে স্নেহাকে পড়াতে পারবো। সন্ধ্যার পরও তো সময় নেই। সিয়ামের মা’র সাথে কথা বলতেও ভয় লাগে। গম্ভীর আর রাগি মহিলা। সিয়ামের মামা’কেও কেমন যেনো মনে হয়। ” রিধিশা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়।

.
সকালে টিউশনিতে গিয়ে সিয়ামকে পড়ানো শেষ করে ভয়ে ভয়ে সিয়ামের মা’কে টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। সিয়ামের মা গম্ভীর গলায় বললো
” আমিও তোমাকে কয়েকদিনের মধ্যে না করে দিতাম। সিয়ামের জন্য আমি নতুন টিচার খুঁজে পেয়েছি।” সিয়ামের মা বেতন দিয়ে দেয় রিধিশার হাতে। রিধিশা বিদায় নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যায়।

ভার্সিটি ছুটির পর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকে নিশাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিশাদকে আসতে দেখে রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” প্রতিদিন আমি আসার আগে চলে আসেন আর আজকে আসারই নাম নেই! কোথায় ব্যস্ত ছিলেন এতোক্ষণ?” নিশাদ হা করে নিশ্বাস ফেলে বেঞ্চিতে গিয়ে আরামে বসে কলার টেনে বললো
” তুমি আসার পর থেকে আমি নিজের attitude টাই হারিয়ে ফেলেছি। তাই সুযোগ পেয়ে সবাই সৎ ব্যাবহার করছে। আর কাউকে সুযোগ দেওয়া যাবে না বুঝেছো?” রিধিশা ক্ষেপে বললো
” আপনি আমাকে আমাকে বলছেন? আমি কি করেছি এখন?”

নিশাদ বিরক্ত হয়ে মুখ কুঁচকে বললো
” এই যে এই তোমরা মেয়েরা না বেশি বেশি বোঝো! যা বলতে চাই তা কখনো বোঝনা। পুরো কথা না শুনেই উল্টো পাল্টা কথা বুঝে নাও।”
” তো পুরো কথা বলেন না কেনো? আপনাকে আটকে ছিলাম নাকি আমি?”
” একটু সময় লাগবে তো নাকি? যাই হোক বলো তোমার কথা। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে কেনো?”
রিধিশা শান্ত হয়ে বললো
” স্নেহার ব্যাপারে কথা বলার জন্য। আমি সকালে সময় বের করে নিয়েছি। সকালে ভার্সিটিতে আসার আগের সময়টাতে পড়াবো আমি স্নেহাকে।” নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” ঠিকাছে। আন্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো কাল। আর শোনো স্নেহাকে পড়ানোর পর তুমি আমাকে রান্না করে দেবে।”

রিধিশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। রেগে বললো
” কি? আমাকে আপনি টিউশনি খুঁজে দিচ্ছেন নাকি রান্না করার কাজ দিচ্ছেন? রান্না করার জন্য বুয়া খুঁজে নিন আমি আপনার জন্য কেনো রান্না করবো?”
নিশাক কয়েক পা ফেলে এগিয়ে এসে বললো
” আরে! রান্না করলে বুয়া হয়ে যায় নাকি? তুমি নিজে রান্না করে খাওনা? আমাকে রান্না করে দিলে অসুবিধা কোথায়?”

” মজা করছেন? আমি রান্না করে খাওয়া আর আপনাকে দেওয়া কি এক হলো? আমি কোন হিসেবে আপনাকে রান্না করে দেবো?”
” কেনো কেনো? বিয়ের পর কি জামাই কে রান্না করে খাওয়াবে না তুমি?” রিধিশা কিড়মিড় করে তাকিয়ে বললো
” আপনি কথায় কথায় আমার বিয়ের কথা তুলেন কেনো? আমার বিয়ে হলে আমার জামাইকে রান্না করে মুখে তুলে খাওয়াবো এটা আমার দায়িত্ব। কিন্তু আপনাকে কোন দুঃখে রান্না করে খাওয়াতে যাবো? আমাকে একদম রান্না করার কথা বলবেন না। একদিন করেছিলাম বলে কি প্রতিদিন করবো? বুয়া খুঁজে নিন, হুহ!”
নিশাদ পেছন থেকে বললো
” বুয়ার রান্না আর তোমার রান্নার এক হলে কি তোমাকে বলতাম নাকি?” রিধিশা শুনেও চলে গেলো।

.
সকালে একটা টিউশন পড়িয়ে নিশাদের বিল্ডিং এর ৬ তলায় চলে যায়। লিফট থেকে বের হতেই চমকে যায়। নিশাদ কালো জ্যাকেট পড়ে লিফটের সামনে হাটছে। রিধিশা বলে উঠে
” এভাবে ভূতের মতো লিফটের সামনে ঘুরছেন কেনো? যদি কোনো বাচ্চা বা বয়স্ক মানুষ থাকতো তাহলে তো ভয় পেয়ে মারা যেতো।” নিশাদ তারা দিয়ে বললো
” তাড়াতাড়ি চলো! তোমার জন্যই তো এতোক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে চলো!” রিধিশা নিশাদের সাথে যেতে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বললো
” পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কি আছে? আমি তো একাই পরিচিত হতে পারি।”
” বেশি কথা বলো কেনো? শোনো এখানে বেশি কথা বলবে না আর আন্টি কিছু জিজ্ঞেস না করলে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না।”

রিধিশা বিচিত্র মুখ বানিয়ে বললো
” আমার মনে হচ্ছে আমি বাচ্চা পড়াতে আসিনি। নিজেই পড়তে এসেছি আর আপনি আমার গার্ডিয়ান।” নিশাদ ঠান্ডা গলায় ধমক দিয়ে বললো
” চুপ করো!” রিধিশা দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে।
কলিং বেল বাজানোর পর স্নেহার আম্মু দরজা খুলে দেয়। স্নেহার আম্মু হেসে দুজনকে ভেতরে আসতে বললো। রিধিশা আলতো হেসে ভেতরে যায় আর নিশাদ ভদ্র ছেলের মতো ঢুকে গিয়ে বসে পড়লো। স্নেহার আম্মু রিধিশার সাথে কথা বলতে থাকে এর মাঝে স্নেহা চলে আসে। স্নেহা রিধিশাকে দেখেই খুশি হয়ে যায়।
দৌঁড়ে রিধিশার কোলে উঠে বললো
” আপু কেমন আছো তুমি?” রিধিশা হেসে বললো
” ভালো তুমি কেমন আছো?” স্নেহা খুশি হয়ে বললো
” অনেক ভালো। তুমি আমার বাসায় কি করে এসেছো?”

স্নেহার আম্মু বললো
” স্নেহা এখন থেকে তোমার আপু তোমাকে পড়াবে। তুমি ম্যাম বলবে আর যাও বই নিয়ে এসো।” সবেহা খুশি হয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। স্নেহার আম্মু বললো
” স্নেহা তোমাকে চেনে কিভাবে?”
রিধিশা ঢোক গিললো প্রশ্ন শুনে। নিশাদ আলতো হেসে বললো
” রিধিশা সাজেদা আন্টির বাসায় ভাড়া থাকে। স্নেহার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।”

স্নেহার আম্মু হেসে উঠে গেলো স্নেহাকে আনার জন্য। নিশাদ গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো
” ম্যাডাম! এবার তো আগুনে জ্বালাবো আপনাকে।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে ভেংচি দেয়। স্নেহা বই নিয়ে আসলে নিশাদ কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায় ফ্ল্যাটে।

____________

এক সপ্তাহ পেড়িয়ে যায়। ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে ঈদ উপলক্ষে। রিধিশা লিমা বেগমকে না জানিয়েই বাড়িতে যাওয়ার চিন্তা করেছে। বিয়েটা ভাঙ্গায় লিমা বেগম রেগে আছে তাই কয়েকদিনের মাঝে একবার শুধু কল করেছিলো। তাও রেগে রেগে কথা বলে কথা শেষ করেছিলো। রিধিশা তাই না জানিয়েই যাচ্ছে।
তৈরি হয়ে সাজেদা বেগম আর হেনার থেকে বিদায় নিয়ে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যায়। বের হতেই নিশাদকে দেখতে পায়। সিগারেট খেতে খেতে হাটছে নিশাদ।

রিধিশাকে লাগেজ হাতে দেখেই আফসোস স্বরে বললো
” এখনই চলে যাচ্ছো? আমার সকালের ট্রেনের সিট পাইনি নাহলে তোমার সাথে চলে যেতাম।” রিধিশা চোখ ছোট ছোট করে বললো
” এমনভাবে বলছেন যেনো আমার আর আপনার বাড়ি একই গ্রামে!” নিশাদ হেসে বললো
” একই গ্রামে না তো কি হয়েছে? পাশাপাশি গ্রামে সাথে যাওয়া তো যেতো! চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

রিধিশা হাটা থামিয়ে বললো
” আমি একাই যেতে পারি।”
” আমি বলেছি নাকি তুমি একা যেতে পারো না? তোমার মতো বদ মেয়ে দুটো দেখিনি। যাই হোক, ভালো থেকো আর সাবধানে যেও। কয়েকদিন তো দেখাও হবে না আর তোমাকে জ্বালাতেও পারবো না।” রিধিশা আলতো হেসে বললো
” আপনিও সাবধানে থাকবেন।” নিশাদ মুচকি হাসলো। রিধিশা রিকশা নিয়ে চলে গেলো।

.
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে লাগেজ রেখে বসে থাকে নিজের সিটে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যায়। রিধিশার পাশের সিটে একজন অল্প বয়সি হিন্দু মহিলা বসেছে। বিয়ে হয়েছে শাখা সিঁদুর দেঝে বুঝেছে।
সময় যতো কাটতে থাকে রিধিশার মনের আনন্দের পাল্লা ভারি হতে থাকে।
দীর্ঘ তিনঘণ্টা পর ট্রেন থামার পর রিধিশা ভিরের মাঝে নেমে পড়ে। ট্রেনে দেড় ঘন্টা ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। আর কিছু সময় হিন্দু মহিলার সঙ্গে একটু আধটু কথা হয়েছিলো। রিধিশা সিএনজি ধরে ধরে সওজা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। ভাড়া মিটিয়ে
বাড়িতে চলে যায়। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর হাসতে থাকে। লিমা বেগম তাকে দেখলে খুশি
হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো কিন্তু সামনের ব্যাক্তিতে দেখে রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। একটা ইয়া লম্বা ছেলে দরজা খুলেছে। বিস্ময়ের যেনো ছেলেটার চোখ জোড়া বেরিয়ে আসবে তেমন চেহারা। রিধিশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভেতর থেকে লিমা বেগমের গলা শুনতে পায়। জিজ্ঞেস করেছে কে এসেছে। রিধিশা ভেতরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই ছেলেটা এক পাশ হয়ে যায়। রিধিশা ভেতরে ঢুকেই দৌঁড়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে।
লিমা বেগম হতভম্বের মতো হয়ে রয়েছে। রিধিশা জিজ্ঞেস করে
” কেমন আছো আম্মু? তুমি রাগ করেছিলে তাই না বলেই এসে পরেছি।”

রিধিশা লিমা বেগমকে ছেড়ে তার দিকে তাকায়। লিমা বেগমের মুখে হাসি না দেখে রিধিশা বললো
” তুমি খুশি হওনি?” রিধিশা দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা দরজা বন্ধ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। সোফায় আরেকজন মহিলার দিকে তার চোখ পড়ে। রিধিশা তিনজনকে পুনরায় পর্যবেক্ষণ করে। তিনজনের মধ্যে বিস্ময় দেখা যাচ্ছে। রিধিশা এসেছে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আম্মু দুজন কে?” তিনজনের মধ্যে কারো মুখেই কথা নেই।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here