কুঁড়েঘর ২ পর্ব – ৮+৯

##কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৪।

লিমা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস আড়াল করে আলতো হেসে বললো
” পরিচয় করিয়ে দেবো। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? আমাকে জানালি না কেনো আসার আগে?” রিধিশা হেসে বললো
” কোনো সমস্যা নেই। জানিয়ে আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ তো আর দিতে পারতাম না তাই না!”
রিধিশার কথায় লিমা বেগম হাসলো।

লিমা বেগম রিধিশাকে দুজনের কাছে নিয়ে মহিলাকে দেখিয়ে বললো
” উনি তোর ছোট মনি আর ছেলেটা তোর ভাইয়া হৃদ।”
রিধিশা আলতো হেসে দুজনকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। রিধিশার ছোট মনি মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” কতো বড় হয়ে গিয়েছো তুমি। জার্নি করে এসেছো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।” রিধিশা মাথা নাড়ে। লিমা বেগম রিধিশাকে তার রুমে নিয়ে যায়।

রিধিশা নিজের ঢুকে হাসলো। লিমা বেগম প্রতিদিনই রুমটা পরিষ্কার করে রাখে। লিমা বেগম চলে যেতে নিলে রিধিশা ডেকে বললো
” আম্মু ছোট মনি বা ভাইয়া দুজনকে ছোট বেলায় বা আগে তো কখনো দেখিনি। কোথায় ছিলো এতোদিন?” লিমা বেগম হাসি মুখে বললো
” মাত্রই তো এলি। ধীরেধীরে সব জানতে পারবি।” রিধিশা আর কিছু বললো না। লিমা বেগম চলে গেলে রিধিশা দরজা লাগাতে লাগতে ঠোঁট উল্টে বললো
” মনে হচ্ছে গভীর কোনো গর্তে খিচুড়ি পাকাচ্ছে।”
রিধিশা ড্রেস বের করে ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো।

লিমা বেগম দ্রুত পা চালিয়ে ড্রইংরুমে আসে। সাদিয়া বেগম আর হৃদের দিকে তাকিয়ে বললো
” কি করবে এখন? আমার চিন্তা হচ্ছে। রিধিশার বাবাও তো নেই, রাতে আসবে সে। রিধিশা এভাবে চলে আসবে শেটা তো ভাবিই নি।” সাদিয়া বেগম আশ্বাস দিয়ে বললো
” তুমি চিন্তা করো না। হৃদ তুই ব্যাগ গুছিয়ে নে। ওই বাড়িতে চলে যাবো আজকে।”

হৃদ দুজনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো
” এভাবে পালিয়ে কতোদিন সত্য লুকিয়ে রাখবে তোমরা তিনজন? সত্যিটা বেশিদিন লুকানো যায় না, আমি যেভাবে জানতে পেরেছি রিধিশাও একদিন জানতে পেরে যাবে। ভালো কথা বলছি এখনই রিধিশাকে সব সত্য জানিয়ে দাও। নাহলে আমি জানাবো। আমার বোনকে আমার মতো অন্ধকারে থাকতে দেবো না আমি! আর আমি কোথাও যাবোও না।”

হৃদ পা চালিয়ে তার রুমে চলে গেলো। সাদিয়া বেগম অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। লিমা বেগম মলিন গলায় বললো
” হৃদ ঠিকই বলেছে। এভাবে কতোদিন মেয়েটাকে অন্ধকারে ঠেলে রাখবো? সব বলে দেওয়াই ঠিক হবে।”
” কিন্তু রিধিশা কষ্ট পাবে। প্রথমদিন জানতে পেরে তুমি যতো ভেঙ্গে পরেছিলে রিধিশাও যদি ভেঙ্গে পড়ে।”

লিমা বেগম আলতো হেসে বললো
” চিন্তা করো না। আমার মেয়ে এই কয়েকমাসে এমনই শক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন ভেঙ্গে গেলে উঠেও দাঁড়াবে আর এটা তো স্বাভাবিক একটা বিষয়। এমন পরিস্থিতি মুখোমুখি প্রতিনিয়ত কতো মানুষই হয়। জানতে পারলে একটু কষ্ট পাওয়া স্বাভাবিক তবে সত্যি টা আর লুকিয়ে রাখতে চাই না।” সাদিয়া বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।

রিধিশা শাওয়ার নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলো একা একা। দোতলায় রিধিশার রুম সহ তিনটে রুম। ঘুরে ঘুরে বুঝলো তার ছোট মনি আর হৃদ বাকি দুই রুমেই থাকে।
রিধিশা রান্না ঘরে গিয়ে দেখে সাদিয়া বেগম আর লিমা বেগম রান্না করছে। রিধিশাকে দেখে সাদিয়া বেগম বললো
” আরে রিধিশা ভেতরে এসো!” রিধিশা হেসে ভেতরে ঢুকে বললো
” আমাকে দিন আমি হেল্প করছি আম্মুর।”
” না মা তোমার কিছু করা লাগবে না। গিয়ে বসে থাকো।” লিমা বেগম বললো
” কি কি খাবি সেটা বল। রাতে তোর জন্য সব রান্না করবো।”
” খাবো তো অনেক কিছু বাবা বাসায় কখন আসবে?”
লিমা বেগম হেসে বললো
” সন্ধ্যার পর আসবে। টেবিলে গিয়ে বস আর তোর ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয় খেতে বসবি এখন।”
রিধিশা মাথা বেড়ে উপরে চলে যায়।

রিধিশা হৃদের রুমের দরজা আধখোলা দেখে নক করে। ভেতর থেকে হৃদ এসে দরজা পুরোপুরি খুলে দেয়। রিধিশা দেখে অবাক হয়ে বললো
” তুমি! কিছু বলবে?” রিধিশা আমতা আমতা করে বলে
” হ্যা,আম্মু বললো নিচে খেতে খাওয়ার জন্য।” হৃদ হেসে বললো
” ভেতরে এসো!” রিধিশা একটু একটু করে ভেতরে যেতে থাকে তা দেঝে হৃদ হেসে বললো
” নিজের ভাইয়ের রুমে আসতে এমন করছো? এসে বসো এখানে।” রিধিশা লজ্জা পেয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

হৃদ রুমের আলমারি থেকে একটা গিফট বক্স এনে রিধিশার হাতে দিয়ে বললো
” এটা তোমার জন্য।” রিধিশা গিফটের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললো
” আমার জন্য গিফট কেনো?” হৃদ পাশে বসে বললো
” প্রথমদিন আসার আগে সবার জন্য গিফট কিনেছিলাম তোমার জন্যও কিনেছিলাম কিন্তু তুমি তো ছিলে না তাই দেওয়া হয়নি। তোমার জন্য তোলা ছিলো।”

রিধিশা হৃদের দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনি আমাকে চিনেন?” হৃদ মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা, ছোট থেকে চিনি।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কিন্তু আমি তো কখনো দেখিনি আপনাকে চিনিও না।” হৃদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” একটা অন্ধকার রুমে যখন কেউ থাকে তখন অন্যকারো উপস্থিত থাকলেও তাকে দেখতে পায় না আর চিনতেও পারে না। সেই রুমে আলো জ্বললেই তার পাশের মানুষটাকে দেখতে পাবে আর চিনতেও পারবে।”

” কিন্তু আপন মানুষ হলে অন্ধকারেও সেই ব্যাক্তিকে চেনা যায়।” হৃদ মুচকি হাসে রিধিশার কথায়।
” আপন মানুষকে চেনার জন্য প্রথমে আলোরই প্রয়োজন হয়। অন্ধকারে থেকে কখনো আসল সম্পর্কের মূল্যও বোঝা যায় না আর আপন মানুষও চেনা যায় না।”
রিধিশা অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” তাও ঠিক, আচ্ছা তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু আমার আপনাকে চেনা না চেনার মধ্যে এই কথার কি সম্পর্ক? আমি তো আলোতেও আগে আপনাকে দেখিনি আর অন্ধকারেও আপনাকে দেখিনি।” হৃদ সশব্দ করে হেসে উঠে
” বোঝনি আমার কথা তবে বুঝতে পারবে তাড়াতাড়ি। আচ্ছা চলো খেতে যাই পরে তোমার সাথে গল্প করবো।” রিধিশা মাথা নেড়ে হৃদের সাথে নিচে আসে। গিফট বক্স নিজের রুমে রেখে এসে টেবিলে বসে পড়ে।

সন্ধ্যার পর রিধিশার বাবা বাড়িতে আসে। রিধিশা ড্রইংরুমে বসেছিলো সবার সাথে। রিধিশার বাবা শফিক উদ্দিন প্রথমে রিধিশাল খেয়াল না করলেও পড়ে খেয়াল হতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হৃদ তা দেখে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। রিধিশা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে
” কেমন আছেন বাবা?” শফিক উদ্দিন কাঁপাকাঁপা গলায় উত্তর দেয়
” ভালো তুমি কেমন আছো?কখন এসেছো?”
” দুপুরে।” শফিক উদ্দিনের কপাল বেয়ে ঘাম পড়তে থাকে। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে রুম চলে গেলো।

হৃদ লিমা বেগমকে বললো
” মনি রিধিশাকে সব কখন বলবে?” লিমা বেগম রিধিশার দিকে তাকায়। চিন্তিত গলায় বললো
” কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”
” যতো তাড়াতাড়ি বলবে ততোই ভালো।”

.
লিমা বেগম রিধিশাকে বসিয়ে রেখে নিজেও সামনে বসে আছে। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শ্বাস রুদ্ধ একটা সময় মনে হচ্ছে তার। রিধিশা ধৈর্য ভেঙ্গে বললো
” কতোক্ষণ বসিয়ে রাখবে আম্মু বলছো না কেনো কি বলবে?” লিমা বেগম বড় একটা নিঃশ্বাস নেয়।

” আমার আর তোর বাবার পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো। তোর দাদা, দাদি আমাদের সঙ্গে থাকতো। অনেক চেষ্টা করার পরও প্রায় ৬ বছর পেড়িয়ে যায় আমাদের বাচ্চা হচ্ছিলো না। তোর বাবা ছিলো বাচ্চা পাগল। তোর দাদা, দাদিও মাঝে মাঝে কথা শোনাতো আমাকে বাচ্চা না হওয়ার জন্য। তারপর ৭ বছরের মাথায় জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। বাড়িতে খুশির জোয়ার নেমেছিলো। তোর জন্মের পর তোর বাবা তোকে আদরের দুলালী করে রাখে। তোকে প্রচুর ভালোবাসতো। তোকে একটু ব্যাথাও পেতে দিতো না।

দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো তারপর তোর বাবার ব্যবসায়ীক সূত্রে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে অনেক ঝগড়া হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এর সপ্তাহ খানেকের মাথায় তোর বন্ধুর বাবা বাড়িতে আসে যখন তোর বাবা বাসায় ছিলো না। আমার আর আমার শশুড়, শাশুড়ির কাছে তোর বাবার সবচেয়ে বড় সত্যি বলে যায়। আমাদের বিয়ের ২বছর হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বাচ্চা হয়নি দেখে তোর বাবা আড়ালে বিয়ে করে এক মেয়েকে। তখন আমরা বাড়ির কেউ বিশ্বাস করিনি। তোর বাবার বন্ধু কিছু ছবি সহ আরো কিছু প্রমাণ দিয়ে যায়। তারপর আমাদের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আমার শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে আমার পায়ে পড়ে যায় আর বলে এই কথা যেনো বাইরে না যায়। আমি চুপচাপ ছিলাম এসব শোনার পরও। তারপর আমি আড়ালে খুঁজতে থাকি তোর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী’কে পেয়েও যাই। সাদিয়া বাড়ি কিশোরগঞ্জ ছিলো। সব কিছু বলার পর সাদিয়া আমাকে জানায় সাদিয়া এসব কিছুই জানতো না। তাদের বিয়ের ৬ বছর হয়েছে আর তাদের ছেলে ছিলো হৃদ।

তারপর আমি আর সাদিয়া তোর বাবার বন্ধুর থেকে জানতে পারি। সে আর তোর বাবাই সাদিয়ার মা, বাবার বিয়ের প্রস্তাব দেয় তারপর বিয়ে পর্যন্ত এগিয়েছে। তোর বাবা সব কিছু আড়ালে রাখতে চেয়েছে আমাদের থেকে। ব্যবসার কথা বলে প্রতি মাসে সাদিয়ার কাছেই যেতো। সাদিয়া বিয়ের হওয়ার আগে থেকে জানতো তোর বাবা সাদিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে আর তোর বাবা অনাথ।

সব কিছু মিথ্যা মনে হয়েছিলো। তারপর আমরা দুজনই তোর বাবার সামনে আসি। তোর বাবা অবাক হয়ে গিয়েছিলো আমাদের একসাথে দেখে। তারপর সব সত্য প্রকাশ করে। আমি তোকে নিয়ে আমার বাবার বাড়ি চলে যাই। আমার মা,বাবা ছিলো না তাই ভাইয়ের বাড়িতে থাকতাম। ডিভোর্স চাইলে তো তোর বাবা আমাকেও ডিভোর্স দিতে চায় না আর সাদিয়াকেও না। কয়েক মাস পেড়িয়ে যায় আমার ভাই, শশুড়, শাশুড়ি অনেক বোঝায় তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোর জন্য আবার ফিরে আসি। সাদিয়া নিজ থেকে সরে যেতে চায় আমাদের জীবন থেকে কিন্তু তোর বাবা ছিলো অনড়।

আমি ভাবতাম সাদিয়ার কোন দোষ ছিলো না কারণ আমি সন্তান জন্ম দিতে পারিনি তাই সে বিয়ে করেছে। তার প্রথম বিয়ে সম্পর্কে সাদিয়া অজানা ছিলো।
তাই আমি চাইনি সাদিয়া তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক। কিন্তু আমার শশুড় শাশুড়ি সাদিয়াকে বাড়ির বউ করে তুলতে চায়নি। এসব নিয়েও একদফা ঝামেলা করি আমি। তারপর সাদিয়া দূড়ে থাকার কথা বললো তারপর তোর বাবা সাদিয়া আর হৃদের দায়িত্ব, আমার আর তোর দায়িত্ব নেয়। দুই সন্তানকে খুব বেশি ভালোবাসতো। তবে এতো বছরে আমি আর সাদিয়া তাকে সেই আগের মতো ভালোবাসতে পারিনি।

আমাদের সম্পর্ক ছিলো লোক দেখানো। তোর দাদা, দাদিও মারা যায়। তোর বাবা এভাবেই দুটো সম্পর্ক আড়ালে আড়ালে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে। কখনো কাউকে জানতে দেয়নি আর তোকেও এসব জানতে দেইনি আর হৃদকেও না। তবে হৃদ ছোট থেকে জানতো তার একটা ছোট বোন আছে আর কিছুই জানতো না। তোর বাবার গাফলতির জন্য হৃদ কয়েক মাস আগে জানতে পেরে যায় সব।

রিধিশা মূর্তির মতো বসে রয়েছে। মুখ দিয়ে কথাও বের হলো না। বাবার সম্পর্কে এসব শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। লিমা বেগম মাথা নিচু করে বসে আছে।

” তোর বিয়ের জন্য হঠাৎ করে তোর বাবা পাগল হয়ে উঠেছিলো। হুট করে এমন ব্যবহারে অবাক হয়েছিলো সবাই। তুই চলে যাওয়ার পর সাদিয়ার সাথে যোগাযোগ করেও কিছু জানতে পারি না। তারপর সাদিয়া একদিন আমাকে জানায় হৃদ কিভাবে যেনো আমাদের সম্পর্কে সব জানতে পেরেছে। কিভাবে জেনেছে সেটা একমাত্র হৃদই জানে। হৃদ সাদিয়া আর তোর বাবার উপর রেগে তার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

তোর বাবা চায়না তুই সত্যিটা জানিস। তুই মাহিনের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ায় তোর বাবা অসুস্থ হয়ে পরেছিলো তখন সাদিয়া এসেছিলো আর হৃদকে জোড় করে নিয়ে এসেছিলো। তোর বাবা ভেবেছিলো তুই তার উপর রেগে ঈদে বাড়িতে আসবি না তাই ওদেরকে বাড়িতে থাকতে বলে। কিন্তু হঠাৎ করে আজকে এসে পড়লি তুই । সত্যিটা বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। হৃদ জানতে পেরেছে তাই আজকে সব সত্যি তোর সামনেও খোলাস করলাম।

চলবে……..কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৫।

রুম অন্ধকার করে ব্যালকনির দোলনায় পা তুলে গুটিয়ে বসে আছে রিধিশা। লিমা বেগমের প্রত্যেকটা কথা তার কানে বাজছে বারবার। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কেঁদেও উঠে আবার চোখ মুছে নেয়। তার বাবা এমন করেছে বিশ্বাসই করতে পারছে না রিধিশা।

.
হাই তুলতে তুলতে ট্রেন থেকে নামলো নিশাদ। দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে মুখে পানি দিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। রিংটোন শুনে ফোন বের করে দেখে বাবা ফোন দিয়েছে। নিশাদ রিসিভ করে বললো
” বাবা ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছি আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
” হ্যা, আমি অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি আয়।” নিশাদ হেসে বললো
” তুমি ঘুমিয়ে পড়ো না! রাত জেগে অপেক্ষা করবে কতোক্ষণ?”
” এতোক্ষণ অপেক্ষা করলাম এখন আধ ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারবো না? কতো বছর পর তুই বাড়িতে আসছিস।”

নিশাদ কল কেটে বাইরে তাকায়।
“রিধিশার কথা মনে পড়ছে। কয়েক ঘন্টা না দেখেই মনে হচ্ছে কতোবছর ধরে কথা হয়নি, ঝগড়া করিনি।বাসায় গিয়ে ফোন করে জ্বালাতে হবে নাহলে ঘুমাতে পারবো না।” নিশাদ ভাবতে ভাবতে হাসতে থাকে।

বড় গেট পেড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ধোকার আগেই মৃণাল সাহেব এসে নিশাদকে জড়িয়ে ধরে। নিশাদ জড়িয়ে ধরে বললো
” কেমন আছো বাবা?” মৃণাল সাহেব আনন্দিত গলায় উত্তর দেয়
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই এসেছিস তাই আরো ভালো হয়ে গিয়েছি। তাড়াতাড়ি ভেতরে চল।”
নিশাদ মৃণাল সাহেবের সাথে ভেতরে চলে যায়।

ভেতরে ঢুকেই তার ফুফুর মুখোমুখি হয়। নিশাদকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। উমা বেগমকে তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিশাদের কাছে আসতেই নিশাদ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো
” কেমন আছেন?” উমা বেগম ধীর গলায় বললো
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো? এতো বছর পর বাড়িতে আসার ইচ্ছে হলো? বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি!” নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” ইচ্ছে করে বলেই তো এসেছি।”
মৃণাল সাহেব তাড়া দিয়ে বললো
” আহ! পড়ে কথা বলা যাবে। সরো তো এখন, ছেলেটাকে ভেতরে যেতে দাও।”

মৃণাল সাহেব নিশাদকে তার রুমে নিয়ে যায়। নিশাদ হেসে বললো
” আমি তো ভেবেছিলাম আমার রুমটা পাবো না।”
” কেনো পাবি না? আমার একমাত্র ছেলের রুম।”
বাবার কথায় নিশাদ হাসে।” মৃণাল সাহেব বললো
” ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।”
” আসছি তুমি গিয়ে বসো।” মৃণাল সাহেব হেসে চলে গেলো।

নিশাদ নিজের রুমে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। ১৫ বছর আগে এক্সিডেন্টে মা মারা যাওয়ার পরও এই বাড়িতে ছিলো নিশাদ। মায়ের স্মৃতি গুলো আকড়ে, তাকে অনুভব করতো। তখন ১০ বছর বয়স ছিলো। ‘মা ছাড়া বড় হবে’এসব কথা শুনে তার দাদি আর ফুফু মৃণাল সাহেবকে দ্বিতীয় বিয়ে করায়। উমা’কে বিয়ে করিয়ে আনে। মৃণাল সাহেব ব্যাবসার সূত্রে ঢাকা থাকতো বেশিরভাগ সময়।

নিশাদ ছোট বেলায় প্রচণ্ড জেদি আর রাগি ছিলো।
উমা’র বাবার বাড়ির লোকেরা’ নিশাদের মা’কে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতো তখন নিশাদ রেগে যেতো। তাদের কথার পিঠে কিছু বললে উমা নিশাদকে বকতো। দেড় বছরের মাথায় উমার ছেলে বাচ্চা হয়। তখন উমার ভাবি নিশাদের মা’কে নিয়ে ভালো মন্দ কথা উঠানোতে নিশাদ বাড়িতে তাণ্ডব চালায় আর উমাও রেগে গায়ে হাত তোলে।

এরপর নিশাদ বাবার কাছে চলে যাওয়ার জেদ করে।
এরপর থেকে নিশাদ বাবার সাথেই ঢাকা তাদের ফ্ল্যাটে থাকতো। গত পাঁচ বছর ধরে মৃণাল সাহেব আর ঢাকা যায়নি আর নিশাদও ১২ বছরে একবারও বাড়িতে আসেনি।
.
নিশাদ ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়। গিয়ে দেখে তার বাবা টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে আর ফুপ্পি খাবার এনে রাখছে। নিশাস গিয়ে বাবার পাশে বসে পড়ে।
দুই বছর আগে নিশাদের ফুপির স্বামী মারা গিয়েছেন। মাঝে মাঝেই ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসেন তিনি।
মৃণাল সাহেব নিশাদের প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললো
” কতো বছর পর বাপ ছেলে একসাথে খাচ্ছি।” নিশাদ মুচকি হাসি দেয় বাবার খুশি দেখে।

নিশাদ খাওয়া শেষে বাবার সাথে তার রুমে চলে যায়। মৃণাল সাহেবের রুমে মায়ের ছবি টাঙ্গানো দেখে নিশাদ অবাক হয়ে বললো
” মায়ের এই ছবিটা এখনও আছে?” মৃণাল সাহেব হেসে বললো
” কেনো থাকার কথা নয় নাকি? তোর কাছেও তো তোর মায়ের সব ছবি রয়েছে।” নিশাদ কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো
” আমি ভেবেছিলাম সরিয়ে ফেলেছো হয়তো!”
মৃণাল সাহেব হেসে উঠে শব্দ করে।

” আমার কথা বলছিস নাকি উমার কথা? উমা’কে কখনো আমি তোর মায়ের জিনিসে হাত দেওয়ার অধিকার দেইনি। আমার সামন ওকে নিয়ে কখনো কথাও বলেনি।
তোর মা’কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম কখনো ভুলতে পারবো না তাকে। পুরো বাড়িটাতেই তোর মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই রুমে আসলেই তোর মা’কে অনুভব করি আমি।”
নিশাদ বাবার দিকে তাকায়। তিনি চশমা খুলে বিছানায় গিয়ে বসে। নিশাদ ঘুমাতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

নিশাদ হাটতে হাটতে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলো। নিজের রুমটায় ঢুকে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। তার রুমটার মায়ের গায়ের ঘ্রাণ করছে। নিশাদ আলমারি থেকে মায়ের শাড়ি বের করে ঘ্রাণ শুকলো। নিশাদ শাড়ি জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
” বাড়ির আনাচে কানাচে তোমার স্মৃতি মা। তুমি নেই কেনো? তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে খুব মনে পড়ছে মা।” নিশাদ বেশ কিছুক্ষণ আলমারির কাছে বসে কাঁদে।

ধীরেধীরে নিজেকে সামলে দুই হাতে চোখ মুছে উঠে শাড়িটা গুছিয়ে রেখে দেয়। নিশাদ রুমের চারদিকে তাকায়। একটা দেয়াল জুড়ে পুরোটাই তার মায়ের অনেক ছবি ছিলো। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার আগে সব খুলে নিয়ে গিয়েছে নিশাদ। নিশাদ ফোন বের করে রিধিশা নাম্বারে কল করলো। রিং হয়ে কেটে
যায় কিছুক্ষণ পর। আরো কয়েকবার ট্রায় করেও রিসিভ না করাও নিশাদ রাগি গলায় বললো
” বাড়িতে গিয়ে দিন দুনিয়া ভুলে বসে আছে নাকি এই মেয়ে! এতো কল করলাম একটাও রিসিভ করার নাম নেই, ধুর!” নিশাদ বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো।

.
সূর্য উদয় হতেই গ্রামের মুরগির ডাক শুরু হয়। গাছে কিচিরমিচির পাখির শব্দও শোনা যাচ্ছে। মুরগির কক কক শব্দ শুনেই রিধিশার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রিধিশা বড়সড় হাই তুলে উঠে বসে। কানে শব্দ গুলো বেশিই বাজছে তার। রিধিশা চোখ বুলিয়ে দেখে সে ব্যালকনির দোলনাতেই বসে রয়েছে। রিধিশা চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললো
” আমি এখানেই বসে ঘুমিয়েছি? আমার তো খেয়ালই ছিলো না ঘুমানোর কথা আমি ঘুমালাম কখন?”

রিধিশা দোলনা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ব্যালকনি দিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে তাকায়। এখান থেকে মুরগি গুলোকে দেখতে পাচ্ছে। রিধিশার মনে হলো হেটে হেটে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে।
পাশেই দুটো মুরগিকে একে অপরকে ঠোকরাচ্ছে। মুরগি গুলোকে দেখে রিধিশার নিশাদের কথা মনে পড়ে যায়। রিধিশা ফিকফিক করে হেসে দেয়। দুই মুরগির কাছে আরেকটা মুরগি এসে পাখা দিয়ে মাথায় বাড়ি দেয় কয়েকটা তখন ঝগিরা কড়া মুরগি গুলো কক কক করতে করতে ঝগড়া বন্ধ করে।
রিধিশা এসব দেখে হাসতে হাসতে রুমে চলে গেলো।

ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মাত্র ৬টা বাজে।
আননোন নাম্বার থেকে মিসডকলও দেখলো। রিধিশা সেই নাম্বারে কল করে বসে। কিছুক্ষণ পর রিসিভও হয়।
” হ্যালো কে?”
” আমি রিধিশা। আপনি কে?” নিশাদের চোখের ঘুম উধাও হয়ে যায়। নিশাদ লাফিয়ে উঠে বসে চেঁচিয়ে বললো
” অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে। কোনো ম্যানারস নেই তোমার! কালকে এতোবার কল করলাম একবারও রিসিভ করলে না আর এখন বলছো আমি কে? কেউ কল করলে রিসিভ করতে হয় জানো না?”

রিধিশা তব্দা খেয়ে বসে থাকে। ব্যাক্তিটা নিশাদ কিভাবে হলো বুঝতে পারছে না। নিশাদ আবার ডাকতে থাকে তাকে। রিধিশা মুখ খুললো
” এই আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছে আপনি?” নিশাদ ভাব নিয়ে বললো
” নিশাদের কাছে এসব কোনো ব্যাপারই না। স্নেহার খাতায় তোমার নামসহ নাম্বার দেখেছিলাম। সেখান থেকেই এনেছি।”
” ছি! ছি! ছি! চুরি করে বলছেন এসব কোনো ব্যাপার না! সবার নাম্বার চুরি করেন নাকি?”
নিশাদ ধমকের স্বরে বললো
” হপপ! আমাকে চোর মনে হয়? আমি স্নেহার সামনে থেকে এনেছি আর স্নেহাকে বলে এনেছি। আমি চুরি করি না ঠিকাছে! আজকাল তো আমি আর আমার জিনিস চুরি হয়ে যাচ্ছে।”

নিশাদের কথা শুনে রিধিশা মুখ টিপে হাসে। নিশাদ হাই তুলে বললো
” তো বলো কেমন কাটিয়েছো কালকে? কালকে তোমার সাথে ঝগড়া না করা হয়নি। লাইফটা বোরিং মনে হচ্ছিলো। তাই রাতে ঝগড়া করার জন্য কল করেছিলাম তবে কথা তো হলোই না। এখন ঝগড়া করে ঠিক লাগছে।”
রিধিশা শব্দ করে হেসে উঠে। নিশাদ হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। রিধিশাকে কখনো হাসতে দেখেনি সেইভাবে।
রিধিশার হাসির শব্দের সাথে বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দটা যেনো তাল মিলিয়ে চলছে।

রিধিশা হাসতে হাসতে বললো
” একটু আগেই দুটো মুরগিকে ঝগড়া করতে দেখে আপনার কথা মনে করছিলাম।”
” তুমি কি করে বুঝলে দুটোই মুরগি? একটা মুরগি আরেকটা মুরগাও তো হতে পারে।”
” আপনাকে কে বললো? আপনি দেখেছেন নাকি?”
” কেনো হতে পারে না নাকি?”
” তা তো হতেই পারে।”

নিশাদ আফসোস স্বরে বললো
“তোমার আর আমার বাড়ি একসাথে কেনো হলো না বলো তো! তাহলে সামনা সামনি ঝগড়া করতে পারতাম।” রিধিশা বললো
” সারাজীবন ঝগড়া করলেও আপনার ঝগড়া করার ইচ্ছা শেষ হবে না।” নিশাদ সায় দিয়ে বললো
” তা ঠিক। আচ্ছা তুমি আমার ঘুম ভেঙ্গে দিয়েছো এখন আবার ঘুমাতে হবে আমাকে। রাখো, ফোন রাখো বেয়াদব মেয়ে। আর গ্রিন সিগনাল দিয়ে রাখবে। আমি যখন তখন কল দেবো।”

রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” ইশশ যেনো রাজা আদেশ।”
“হ্যা, এটাই সত্যি আমি রাজা তাও তোমার রাজা। আমার সব আদেশ পালন করবে নাহলে কারাগারে নিক্ষেপ করবো।” নিশাদ ফোন কেটে দেয়। রিধিশা মুখ ফুলিয়ে ফোনের দিকে তাকায়।
নিশাদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।

.
রিধিশা রুম থেকে বের হতেই সাদিয়া আর লিমা বেগমকে দেখতে পায়। রিধিশার দিকে চোখ পড়তেই দুজন একে অপরের দিকে তাকায়। রিধিশা চুপচাপ গিয়ে সোফায় হৃদের পাশে বসে পড়ে। দুজন চিন্তিত হয়ে রান্না ঘরে চলে যায়। হৃদ একবার রিধিশার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললো
” ঘুম কেমন হয়েছে?” রিধিশা শান্ত গলায় বললো
“খুব ভালো।” হৃদ কিছু বলবে বলবে ভেবেও আর বললো না। টিভি দেখতে থাকে। হৃদ নিউজ দেখছিলো রিধিশা হঠাৎ চ্যানেল পাল্টে কার্টুন দিয়ে দেয়।
হৃদ থতমত খেয়ে মতো রিধিশার দিকে তাকায়। রিধিশা আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here