#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৮|
সাদিয়া মেহরুজ
রজনীর দ্বিতীয় প্রহর। দানবাকৃতির গাছ গুলোকে পেড়িয়ে ছুটে চলছে ট্রেন। ঝকঝক শব্দে মুখরিত চারিপাশ। মেহতিশার মাথা ধরে আসছে অতিরিক্ত শব্দের দরুন। সটান হয়ে বসল ও। ট্রেনের জানালা দিয়ে অদূরে ফেলে রাখা দৃষ্টিটা এবার সম্মুখে ছুঁড়ে দিল। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জোড়া চক্ষুর। মেহতিশা ললাট কুঞ্চিত করলো। সারতাজের তীক্ষ্ণ চাহনি তখনো তার মাঝে নিবদ্ধ। অদৃশ্য এক টানের ফলে মেহতিশা কেন যেন নিজের দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হলো। মিনিট দুয়েক একে অপরের নেত্রদ্বয়ের মাঝে তাকিয়ে রইল কেবল বোবা হয়ে। ট্রেনের হুঁইসেল বাজল। দু’জনের দৃষ্টি ছিটকে সরলো! দু’জন যখন উদ্যক্ত হলো ‘ কেনো তাকিয়ে ছিলেন? ‘ প্রশ্ন করতে তখনি দু’জনের দ্বিতীয়সত্ত্বা তাদের প্রশ্ন করলো,
-‘ তুই কেনো তাকিয়ে ছিলিস? নিজের বেহায়া দৃষ্টি সরাতে পারিসনি? ‘
প্রশ্নটা আর করা হলো না! দু’জনই নির্বাক তাদের দ্বিতীয়সত্ত্বার তোলা প্রশ্নে। আসলেই তো! সে কেন তাকিয়ে ছিল?
দ্বিধাময় প্রহর ভাঙল সারতাজ। গলা ঝেড়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কোথায় যাচ্ছিলেন? ‘
মেহতিশা নিজের স্বাভাবিক রূপে ফিরে এলো। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
-‘ ট্রেনটা চট্টগ্রাম বাদে অন্য কোথাও যাচ্ছে বুঝি? ‘
সারতাজের ভ্রু দু’টো কুঞ্চিত হয়ে কাছাকাছি এলো। মেয়েটা বোধহয় ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের। তেরছা হেঁসে শুধালো,
-‘ আপনার নাম মেহতিশা কে রেখেছিল? নামটা বেশ বেমানান আপনার ব্যাক্তিত্বের সাথে। আপনার নাম তো হওয়া উচিত ছিলো ‘ ঘাড়ত্যাড়া ‘ ওহ্ না আপনি তো মেয়ে, ‘ ঘাড়ত্যাড়ি ‘ নামটা পার্ফেক্ট আপনার জন্য। পরিচয় হওয়ার পর থেকে আপনাকে কেবল ঘাড়ত্যাড়ামিই করতে দেখলাম। ‘
মেহতিশা বক্র চোখে তাকাল কেবল। মুখ ফুটে কিছু বলল না। দু’পক্ষের নীরবতা চলল কিয়ৎক্ষণের জন্য। তারপর আচানক মেহতিশা বলে উঠলো,
-‘ শুনুন? ‘
সারতাজ ফোনে মত্ত। মেহতিশার ডাক শুনলো না। কিংবা বলা যায় ইচ্ছে করেই না শোনার ভান করে থাকলো। মেহতিশা তা বুঝে বলা আরম্ভ করলো,
-‘ যদিও বিষয়টা আপনার ব্যাক্তিগত তবুও বলা আন্টির সাথে প্লিজ কথা বলবেন। ওনার কোনো দোষ নেই বিশ্বাস করুন। উনি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ‘
-‘ জানি। ‘
মেহতিশা চমকাল! তার একটুও রাগও হলো। সব কিছু জেনে কেন সারতাজ তার মায়ের সাথে এমন ব্যাবহার করছে? সে চটে গেল,
-‘ সবকিছু জেনে তবে কেনো ঐ মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছেন আপনি? ‘
-‘ এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার মিস। এই বিষয়ে আপনার সাথে আমি কথা বলতে ইচ্ছুক নই। ‘
মেহতিশা দমলো! সারতাজকে কিছু বলাটাই বৃথা। সে তো আর সারতাজের ওপর চড়াও হয়ে কিছু বলতে পারবেনা। সে অধিকার কি আর তার আছে?
ইলার কাছে যাচ্ছিল মেহতিশা।মেয়েটা কাল সন্ধ্যায় তাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করেছে। তার ফুপি নাকি নিখোঁজ চারদিন ধরে। ভদ্রমহিলা কোথায় গিয়েছে জানা নেই। ইলা তাকে খোঁজার চেষ্টা করছে কিন্তু ফলাফল শূন্য! এই বিপদের ওপর পুনরায় আরেক বিপদ চড়াও হয়েছে ইলার ওপর। অনিক ঘন ঘন আসা শুরু করেছে বাড়িতে। ইলাকে উত্যক্ত করছে প্রতিনিয়ত। ও দরজা না খুললেও জানালার কাচ ভে ঙে ইলাকে উদ্দেশ্য করে বি শ্রী কথা বলেছে। বা জে ইঙ্গিত দিয়েছে। আর এই সম্পূর্ণ ব্যাপারে ইলাকে সাহায্য করতে কেও এগিয়ে আসেনি। এমনকি বাড়ির মালিকও নিশ্চুপ। ইলা তার নিকট সাহায্যের আবেদন করলে তিনি তাকে বাড়ি ছাড়তে বলেন। অনিকের জন্য বাড়ি থেকেও বের হতে পারছিলো না সে। তবে কাল সন্ধ্যার দিকে চুপিচুপি বেড়িয়ে দোকানে এসে মেহতিশাকে ফোন দিয়েছিল সে। কাল সন্ধ্যা থেকে মেহতিশা কেবল একটা কথাই ভেবে চলছে, তার ফুপি হটাৎ উধাও হলো কি করে? অনিকের হাত নেই তো এর পিছনে? পতেঙ্গার স্থানীয় পুলিশকে ফোন দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছে মেহতিশা। ইলাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ। তবুও এই মূর্হতে ইলার পাশে থাকা আবশ্যক ভেবেই তার চট্টগ্রাম যাত্রা। ইলাকে সে নিয়ে আসবে নিজের কাছে।
ঘড়িতে সময় দেখল সারতাজ। আর কয়েক ঘন্টা কেবল। তারপরেই সে পৌঁছাবে তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে। তার ফোনে কাল যে হোটেলটির কথা বলা হয়েছিল তা চট্টগ্রামে অবস্থিত। সারতাজ ভেবেছিল কয়েকবার, আসবেনা সে। তবে মনের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে শেষে উপস্থিত হলো চট্টগ্রাম।
_
রৌদ্রজ্বল প্রভাত। ঘড়িতে আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। পরনের শালটা ব্যাগে ঢুকিয়ে মেহতিশা উঠে দাঁড়াল। শীত শীত ভাবটা নেই রোদের কারণে। ট্রেন থেকে নামল সে।দৈবাৎ পাশে এসে দাঁড়াল সারতাজ নিজের ব্যাগ কাঁধে। মানুষের ভিড়ে মেহতিশার শ্বাস রুখে আসার উপক্রম।ভিড়ের মাঝে কেও হাত স্পর্শ করলো তার। চমকে হাতের প্রতি দৃষ্টি ফেলতেই লক্ষ করলো হাতটা সারতাজের। সে চড়া গলায় বলল,
-‘ কি সমস্যা? হাত ধরলেন কেন? ‘
সারতাজ তেরছা হাসল। তাচ্ছিল্যে ভরা কন্ঠে বলল,
-‘ পড়ে যেতেন একটু হলেই। তারপর পদদলিত হয়ে মা রা যেতেন, ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হতো তাই না? নির্বোধ মেয়ে! এই ভিড়ের মধ্যে বের হওয়ার কি ছিলো? আরেকটু পড়ে বের হলে বুঝি শহিদ হয়ে যেতেন আপনি। ‘
-‘ আমি নাহয় নির্বোধ। তা আপনার বুঝি অনেক বোধ! আপনি কেন বের হয়েছিলেন এই ভিড়ের মধ্যে? ‘
-‘ দূর থেকে দেখলাম আপনাকে। কেমন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে হাস ফাঁস করছিলেন। আম্মুর কাছের মানুষ বলে কথা। আপনাকে হেল্প করাটা জরুরি মনে হলো এই কারণে। ‘
মেহতিশা কিছু বলতে নিলো তবে তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সারতাজ তার হাত ধরে টেনে ভিড় ঠেলে বের করলো। দাঁড়াল গিয়ে ভীড় বিহীন স্থানে। মেহতিশা পুনরায় চেষ্টা করলো কন্ঠনালী দিয়ে কিছু কাঙ্ক্ষিত শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করতে কিন্তু দ্বিতীয়বারের মতো সারতাজ তাতে বাধা প্রদান করলো,
-‘ আরে থ্যাংক্স দেওয়ার দরকার নেই ইট’স ওকে। হ্যাভ এ গুড ডে! আল্লাহ হাফেজ। ‘
জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল সারতাজ। রেখে গেলো বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকা মেহতিশাকে।
_
রাত আটটা বাজতে আর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকি। লন জুড়ে পায়চারি করে সারতাজ লিফটে উঠলো। তাকে এখন তিনতলায় যেতে হবে। ৩২১ নাম্বার রুম এর সামনে সে স্থির হয়ে দাঁড়াল। কি করবে এখন? কার না কার কথায় সে এতো দূর অব্দি চলে এলো। চলে যাবে ভেবে উল্টো ঘুরতেই দরজা খোলার শব্দ তার কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খেলো। পিছন ফিরলো সারতাজ। দেখল সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক ভদ্র-মহিলা। ভদ্রমহিলা তাকে আপাদমস্তক পরখ করে শুধালো,
-‘ এসেছ তবে? আমি তো ভেবেছিলাম আসবে না তুমি। ‘
সারতাজ ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ আপনিই তবে আমায় ম্যাসেজ দিয়েছিলেন?’
-‘ হ্যা। ‘
-‘ আপনি বোধহয় আমার বাবা সম্পর্কে কিছু বলার উদ্দেশ্য এখানে আসতে বলেছিলেন। ‘
-‘ হুম। ভেতরে এসো বলছি। ‘
আলিশান কামড়া। কক্ষে কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি। রশ্মির তীক্ষ্ণতায় সারতাজের চোখ মুদে আসতে চাইল। তাকে বসতে বলে ভদ্রমহিলা কোথায় যেন উধাও হলেন। আশপাশ দেখছিল সারতাজ। হটাৎ তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল ভারী তিক্ত কিছু বার্তা,
-‘ আমি সেই গণিকা সারতাজ যে তোমাকে জন্ম দেয়ার পর ময়লার ঝুড়িতে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। তোমার জন্মদাত্রী মা আমি, জুইঁ। আর তোমার জন্মদাতা শরিফ উদ্দিন-ই। ‘
বিন্দু পরিমাণ নড়াচড়া করলো না সারতাজ। কেবল চুপটি করে জড় পদার্থের ন্যায় স্থির রইল। জুইঁ লম্বা পা ফেলে সারতাজের সামনে বসলো। অনুভূতিহীন কন্ঠে শুধালো,
-‘ শরিফের বিয়েতে মত ছিলোনা। ও সালমাকে বউ হিসেবে মানতে পারেনি। নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল ওর গণিকা মহল্লার। ঐ মহল্লার সরদারনী ছিলাম আমি। একদিন হুট করে আমাদের দেখা। ও আমার প্রেমে পড়ল! কটু প্রস্তাব দিলো। আমি ওর অর্থ দেখে প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। গর্ভে আসলে তুমি।বাচ্চা নেয়ার কোনো ইরাদা ছিলোনা আমার শরিফ জোর করায় এই পদক্ষেপ। ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছিল আমাদের। তোমায় যেদিন জন্ম দিলাম সেই সময় শরিফ বললো তোমায় ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে। বিনাবাক্যে রাজি হলাম কারণ তোমার প্রতি আমার কোনো মায়া, দয়া ছিলোনা। পরে বুঝলাম ঐটা ছিলো শরীফের চাল। সে তোমাকে সালমার হাতে তুলে দিতে এই কাজটা করতে বলেছিল। কেন করেছিল এমনটা জানা নেই। তারপর সব স্বাভাবিক হলো। আমি আর শরিফ টাকার নেশায় অন্ধ হয়ে দশ – বারো বছরের মেয়েদের রাতের আঁধারে তুলে এনে গণিকা মহল্লায় কাজে লাগাতাম।শরিফ এমপি হওয়াতে মেয়েদের তুলে আনার কাজটা সহজ হয়ে যায়। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি। হতদরিদ্র পরিবারের হওয়াতে মেয়েগুলো চুপ থাকতো। কেও কোনো প্রতিবাদ করেনি। নিজেদের চলমান কাজে বাঁধা না পেয়ে আমরাও আরো নি র্ম ম হয়ে গেলাম। কিন্তু ঐযে, আল্লাহ ছাড় দেন তবে ছেড়ে দেন না। ‘
জুইঁ থামলেন। তার অক্ষিপটে ভেসে উঠল বিভীষিকাময় সেই দিনগুলো। তিনি পুনরায় বললেন,
-‘ আমি এমন ছিলাম না। আমার সুন্দর একটা সংসার ছিলো। একটা পরিবার ছিলো। কিন্তু মাঝে আমার স্বামী মা রা গেলো চিকিৎসার অভাবে। টাকা দিতে না পারায় হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করে দিলো। ঐ ঘটনার পর আমি কেমন যেনো হয়ে গেলাম। আমার তিন বছরের মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে মিশে গেলাম আঁধারে। মেয়েটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমার মেয়েটা ছিলো ভীষণ সুন্দরী, মায়াবীনি। শরীফকে তো দূর পুরো দুনিয়া থেকে ওকে আড়াল করে রেখেছিলাম। বিধিবাম! মেয়েটা আমার পরে গেলো কু-নজরে। গণিকা মহল্লার সামনে চলে এলো ও। মেয়েটা আমায় ঘৃ ণা করতে শুরু করলো। দূরে দূরে থাকত! কাস্টমার’রা ওর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছিলো। অনেক টাকার অফার করতো কিন্তু আমি ঠান্ডা মাথায় ওদের না করে দিতাম। কারণ ওদের সাথে ঝামেলা মানেই আমার ব্যাবসা মাঠে মা রা পড়া। এই ঠান্ডা থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়াল আমার মেয়ের জীবনে। সেদিন প্রয়োজনীয় কাছে শহরের বাহিরে ছিলাম আর ঠিক ঐদিনই কিছু ন/র/প/শু আমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়। ওদের হাত থেকে বাচার জন্য ও পালিয়ে যায় আর তখনি রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয় ওর। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বাঁচার উদ্দেশ্যে ফোন দিয়েছিলো। য ন্ত্র ণা য় কা ত রা চ্ছিল ও তখন। মা মা বলতে বলতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মেয়েটা মা রা যাওয়ার পর পাল্টে যাই পুরো। জানতে পারি শরীফের হাত আছে আমার মেয়ে মা রা যাওয়ার পেছনে। ওই ঐ লোক গুলোকে আমার মেয়ে যেখানে থাকতো ঐ জায়গার ঠিকানা দিয়েছিলো। শরীফ আমার সাথে যুক্ত হয়েছিল কেবল টাকার জন্য কোনো প্রেম – টেমের জন্য নয়। শরীফসহ যারা আমার মেয়েটার মা রা যাওয়ার জন্য দায়ী তাদের সবাইকে খু ন করেছি আমি। নিজ হাতে কঠিন মৃ ত্যু দিয়েছি। গণিকা মহল্লা ধ্বংস করেছি। এবার আমার ধ্বংসের পালা। আর মাত্র কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ হয়তো আমাকে খুঁজে নিবে। আমি তোমাকে ডেকেছি এসব জানানোর জন্য। মনে হলো তোমার জানা দরকার। আর..আর, আমাকে ক্ষমা করে দিও। নিজেকে তোমার মা হিসেবে দাবী করবো না কারণ আমি এক ন/র/পি/শা/চী/নি। তোমার মা হতে পেরেছে সালমা। ওনাকে কখনো ক ষ্ট দিও না। সুখে থেকো তুমি। ‘
উঠে দাঁড়াল সারতাজ।তার মুখোশ্রীতে স্বাভাবিকতা। বেড়িয়ে যেতে যেতে একবার পিছু ফিরলো সে। ম্লান গলায় বলে উঠলো,
-‘ আপনার পা পে র শাস্তিই হয়ত আপনার মেয়ে পেয়েছে। যদি না আপনি এইসবে জড়াতেন তাহলে আজ হয়তো আপনার মেয়ে আপনার কাছ থাকত। টাকা ইনকাম করতে চেয়েছিলেন হয়ত সুখের জন্য কিন্তু অসৎ উপায়ে অর্জন করা টাকা কখনো সুখ দিতে পারেনা, দিতে পারে কেবল য ন্ত্র ণা! ‘
কামড়া থেকে বেড়িয়ে লিফটে চড়ল সারতাজ। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস অধর যুগল প্রসারিত হয়ে বেড়িয়ে এলো তার। হোটেল থেকে বের হয়ে সামনে এগোতে নিলেই ওপর হতে তার কিয়ৎ সামনে পড়লো কিছু। সে চেয়ে দেখল জুইঁকে। জুইঁয়ের মাথা ফে টে র ক্ত বেরুচ্ছে। আশপাশ থেকে ছুটে আসছে মানুষ। শুধু মাত্র সারতাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জুইঁয়ের উন্মুক্ত চোখ দু’টোতে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল জুইঁয়ের। ইশারায় সারতাজকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন বোধহয়। তবে সৃষ্টিকর্তা তাকে সে সুযোগ না দিয়ে দেহ থেকে প্রাণটা ছিনিয়ে নিলেন।
চলবে~#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৯|
সাদিয়া মেহরুজ
নির্জন অরণ্য। অবনীতে মধ্যাহ্নের বিচরণ। শুকনো পাতা ঝরে পড়ে লেপ্টে রয়েছে ভূমি জুড়ে। হীম শীতল সমীরে নৃত্য করছে বৃক্ষের পাতা গুলো। বুনো ফুলের মাদক মাদক সুভাসের রাজত্ব তখন অরণ্য জুড়ে।নাম না জানা পুষ্প আপন চিত্তে ফুটে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে সবুজ কাননে। পক্ষীরাজের অবাধ গুঞ্জন। ভীষণ সাবধানে কদম ফেলে এগোচ্ছে মেহতিশা। সঙ্গে ক্ষণকাল বেমালুম ভুলে নেত্র দিয়ে অহংকারী অরণ্যের সৌন্দর্য পরখ করছে। তার আচানক মনে হলো সে বনমানুষ হলে মন্দ হতো না। এই চমৎকার কাননে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারত কেবল তার সৌন্দর্য দর্শন করে।
পিছন থেকে পায়ের শব্দ প্রখর হচ্ছে। টনক নড়লো মেহতিশার। দ্রুত পা ফেলল। বক্ষঃস্থল শীতল করা দুশ্চিন্তা আবারও ভর করলো। অনিক তার পিছু নিয়েছে নিজের লোকবল নিয়ে। মেহতিশাই সঠিক ছিল। তার ফুপির নিরুদ্দেশ হওয়ার পিছনে হাত ছিলো অনিকের। সে এক ঢিলে দুই পাখি মা র তে চেয়েছিল। ফুপিকে আঁটকে রেখে অনিক তার পুষে রাখা ক্ষোভও মেটাতে পারবে আবার ফুপি নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে অনন্তপক্ষে ফুপির জন্য না হলেও ইলার জন্য মেহতিশা ছুটে আসতো এখানে তা অনিক জানত! তাই তো কৌশলে এসব করেছে। মেহতিশার অকস্মাৎ মনে হলো, সে বড্ড বোকা! অনিকের চাল আন্দাজ করতে পেরেও নিজেকে বিপদে ফেলতে কেন এখানে এলো? পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকালো সে। কেমন স্বার্থপরের মতো চিন্তা করছে! মেহজার মতো তো তার আরেক বোন ইলা। ওর কি দোষ? মেয়েটা তো নির্দোষ! ইলার বিপদে পাশে না দাঁড়ালে মেয়েটা তো আ ত্ন হ ত্যা করে বসত। অনেক দূর্বল এবং অল্পতেই ভেঙে পড়া মেয়ে ইলা।
দূর হতে দূরান্তে কেবল গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেহতিশা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে যে। অনিক আর তার লোকবলের হাতে ছিল অ স্ত্র। এই জিনিসটার জন্যই অনিকের সামনে দাঁড়ানো হয়নি তার। সে একা একটা মেয়ে আর তারা ছয়জন তাগড়া যুবক। এদের সাথে পেড়ে ওঠা সহজ না। যেখানে আত্মরক্ষার মতো কিছুই নেই তার। বেলা বাড়ছে। সাথে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। গলা শুকিয়ে কাঠ তার! পিছে তাকিয়ে দেখল অনেকদূর এসে পড়েছে। একটা শুকনো ভেঙে পড়া গাছের ওপর বসলো সে। তৃষ্ণা পেয়েছে প্রবল! সহসা শব্দ হলো কোথাও। উঠে দাঁড়াল মেহতিশা। সামনে সারিবদ্ধ গাছপালা থেকে বেড়িয়ে এলো হুট করে সারতাজ! মেহতিশা বিস্মিত গলায় চেঁচাল,
-‘ আপনি? ‘
গা ঝাড়ছিল সারতাজ আপনমনে। মাথা তুলে তার সামনে বিষ্ময়ভূষে দাঁড়ানো মেয়েটিকে সে দেখলো না। মেহতিশা এগোল। দাঁড়াল সারতাজের সম্মুখে। অতঃপর পুনরায় বিষ্ময় ঝাড়ল সে,
-‘ কি ব্যাপার? কথা বলছেন না যে। আপনি এখানে কি করছেন? ‘
মাথা তুলল সারতাজ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল মেহতিশার মুখোশ্রীতে। বলে উঠলো,
-‘ এইযে গাছগুলো দেখছেন না?এদের সাথে নাচতে এসেছি আমি। বুঝেছেন? ‘
বিষ্ময় কাটিয়ে শব্দ করে হাসল মেহতিশা। তারপর হটাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। গাম্ভীর্যতা অটুট রেখে শুধাল,
-‘ ফাজলামো করেন? ‘
-‘ না তো! প্রেমালাপ করছি। ‘
-‘ কি হয়েছে আপনার বলুন তো। ‘
-‘ কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আপনাকে। ম্যারাথনে রেসের অংশগ্রহণ করেছেন তেমন করে দৌড়াচ্ছেন, তখন পিছু ডাকলাম আপনাকে শুনলেন না কেন? ‘
-‘ বাই এনি চান্স আপনি কি আমার পিছু পিছু এই জঙ্গলে এসেছেন? ‘
-‘ হোয়াট ননসেন্স! আমার আর কাজ নেই নাকি? জঙ্গলেই আসছিলাম আমি। ‘
-‘ কি করতে? ‘
প্রতিত্তোর করল না সারতাজ। তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা গলা থেকে সরিয়ে হাতে নিলো। পা টিপে টিপে এগোল সম্মুখে। কিছুদূরে এক হরিণ ঘাস খাচ্ছে নিবিড় মনোযোগে। হরিণটা খাচ্ছে বললে ভুল হবে সে মুখে করে ঘাস ছিঁড়ে তার বাচ্চাটার মুখে দিচ্ছে। সারতাজ মূলত সেই মূর্হতটার ছবি তোলার উদ্দেশ্যেই এগোচ্ছে। মেহতিশা তা দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দুলালো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘ ঐযে শুরু হলো ফটোগ্রাফারের ফটোগ্রাফি। ‘
পুনরায় ভাঙা গাছটার ওপর বসলো মেহতিশা। দৃষ্টি আশপাশে বুলাল। আশ্চর্যজনক হলেও তার এখন ভীতির পরিমাণটা আগের থেকে কমেছে। কেন যেন সারতাজ আসায় তার সাহস ফিরে এসেছে। ভয় লাগছে না। আতঙ্ক কাবু করছে না অন্তঃকরণকে!
জুইঁয়ের লা শ পুলিশ নিয়ে গিয়েছে। মৃ ত্যু র পূর্বে জুইঁয়ের সাথে সাক্ষাৎ করাতে সারতাজকে ফেঁসে যেতে হয়েছিল আইনি জটিলতায়। তবে জুইঁ যেন সবকিছু গুছিয়েই গিয়েছিল। কক্ষে সিসি ক্যামেরা থাকায় এবং যাবতীয় সকল তথ্য ঠিকমতো প্রদান করার পর ঘন্টাখানেক আগে থানা থেকে মুক্ত হয়েছে সে। জে লে নেওয়া না হলেও জেরার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। সকল ঝামেলা শেষে অরণ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মন বিষন্ন ঠেকলে তার সময় কাটে কাননে ঘুরে বেড়িয়ে।
-‘ আপনি এখানে কি করছেন মেহতিশা? আপনার তো এখানে থাকার কথা নয় এ-সময়। জঙ্গল তো আমার আস্তানা। পেশার খাতিরে বছরের বেশির ভাগ সময় এখানেই পড়ে থাকি। ‘
মেহতিশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-‘ এভাবে বলছেন যেন জঙ্গল আপনি নিজের নামে কিনে নিয়েছেন। ‘
-‘ দুই লাইন বেশি বোঝেন কেন সবসময়? অদ্ভুত মেয়ে! ‘
ইতস্তত বোধ করছে মেহতিশা। ভাবছে অনিকের বিষয়টা সারতাজকে বলা আদও ঠিক হবে কিনা। তবে সারতাজকে না বলেও তো উপায় নেই। সে তার ফোন ফেলে এসেছে। উল্টোপাল্টা বোকার মতো ছুটতে ছুটতে অরণ্যে এসে পড়েছে। নিজের বোকামির জন্য রাগ হলো তার। কেনো জঙ্গলেই আসতে হলো তার? পুলিশ স্টেশন কিংবা শহরের দিকে ছুটলেই তো হতো!
-‘ শুনুন? ‘
সারতাজ ক্যামেরা রাখল। চাহনি ফেলল মেহতিশার পানে। মেয়েটাকে একটু অন্যরকম লাগছে না? শক্ত, কঠিনমনা মেহতিশা কেমন যেন নুইয়ে আছে। পা ফেলে এগোল সে। বসল মেহতিশার থেকে কিয়ৎ দূরে। নরম কন্ঠে সে শুধালো,
-‘ বলুন শুনছি। এনি প্রবলেম? ‘
-‘ অনিক…অনিক আমার পিছু নিয়েছে। ‘
সারতাজ ভ্রু’দ্বয় কুঁচকাল! প্রশ্ন করলো,
-‘ এই অনিকটা আবার কে? ‘
-‘ আমার স্বামী। আপনাকে বলেছিলাম…,’
-‘ ওহ হ্যা! তা উনি কেন আপনার পিছু নিয়েছে? ‘
সম্পূর্ণ বিষয়টা খুলে বলল মেহতিশা। সারতাজ মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনল। পরিশেষে কেমন ঠাট্টার সুরে বলল,
-‘ আপনার হ্যাজবেন্ড বেশ চালাক মানুষ দেখছি। ‘
-‘ ও আমার হ্যাজবেন্ড না। তালাক দিয়েছি ওকে। ‘
শক্ত গলায় শুধাল মেহতিশা।
-‘ কিন্তু একটু আগেই তো আপনি তাকে ‘ স্বামী ‘ বলে সম্মোধন করলেন। ‘
-‘ ঐটাতো আপনাকে মনে করানোর জন্য বলেছি আশ্চর্য! ‘
-‘ আচ্ছা, আচ্ছা। ‘
সারতাজ মনে মনে হাসল! মেহতিশাকে রাগাতে পারলে তার এমন পৈ শা চি ক আনন্দ হয় কেন? কে জানে!
-‘ এখন আমার কি করার আছে? ‘
মেহতিশা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটাকে এটাও বলে দিতে হবে? সে গলা ঝেড়ে মিনমিন করে বলল,
-‘ আমাকে একটু সাহায্য করুন। শুধুমাত্র জঙ্গল থেকে বের হতে সাহায্য করলেই হবে। কিংবা আপনার কাছে যদি ফোন থাকে তাহলে প্লিজ একটু কাছের কোনো পুলিশ স্টেশনে ফোন করুন। ‘
-‘ এটা বাংলাদেশ মেয়ে! এখানে শহর বাদে গ্রামে গেলেই যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না সেখানে জঙ্গলে নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশা করছেন কিভাবে? ‘
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল মেহতিশা। সেটাই তো! বোকার মতো কিসব বলছে সে। উঠে দাঁড়াল সারতাজ। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ চলুন সামনে যাই। জঙ্গলে আমি রাত কাটাতে পারলেও আপনার নিশ্চয়ই সেই অভিজ্ঞতা নেই। সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরী নেই। জঙ্গল থেকে বের হতে হবে। ‘
হাঁটা ধরলো দু’জন! শুকনো পাতায় মড়মড় শব্দ হচ্ছে। সঙ্কোচ নিয়ে মেহতিশা দ্রুত হাঁটা ধরতেই পা মরা গাছের ডালপালার সঙ্গে বেঁধে পড়ে যায় সে। সারতাজ তৎক্ষনাৎ পেছনে তাকায়। মেহতিশাকে ভূমিতে পড়ে থাকতে দেখে বিরক্তি নিয়ে শুধায়,
-‘ বাচ্চা নাকি? দেখে চলতে পারেন না? উঠুন জলদি! ‘
পায়ে কাটা বিঁধেছে মেহতিশার। র ক্ত পড়ছে সেখান থেকে। ব্যাথা চেপে রেখেই সে উঠে দাঁড়াল। সহসা মেহতিশার র ক্তা ক্ত পা দর্শন হলো সারতাজের। বিরক্তিতে অধর যুগল তার ‘ চ ‘ আকৃতির হলো। সে এগোতে নিলেই অদূরে কোথাও গু লি র শব্দ হলো। কারো আ র্ত না দ ছিটকে এলো দু’জনের কানে।
চলবে~
| পর্বটা ভীষণ অগোছালো লাগতে পারে। লেখার মনমানসিকতা ছিলোনা বিধায় পর্বটা অবিন্যস্ত হয়েছে। |