#ক্যাসিনো ©লেখিকা_(মায়া)
#পর্ব_৩৪
মেহমেতের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজের দুই হাতে দিয়ে নিশানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে মেহমেত। কিন্তু নিশান তার রাগ ক্ষোভ সব শক্তি হাতের দ্বারা প্রকাশ করছে। গলা থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বৃথা হয়ে পড়ছে।
এমন ধস্তাধস্তির আওয়াজে কারারক্ষী দৌড়ে আসে তাদের কাছে। নিশানের হাতে লাঠি দ্বারা আঘাত করে তবুও সে ছাড়ে না। দাঁতে দাঁত চেপে নিশান শুধু উচ্চ আওয়াজে বলতে থাকে !!
আমি ছাড়বো না তোকে ,,মেরেই ফেলবো আমি তোকে।
যখন নিশান কে মারার পরো ছেড়ে দেয় না তখন সেই কারারক্ষী অন্য ৩জন কারারক্ষী কে ডেকে নিয়ে আসে তার পর তালা খুলে তাকে দুই জন মিলে ধরে সরে নিয়ে যায়। বার কয়েক লাঠি দিয়ে নিশান কে আঘাত করে তারা।
মেহমেত ছাড়া পেয়ে যেন জান ফিরে পায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। এক জন কারারক্ষী তাকে পানি নিয়ে এসে দেয় । মেহমেত ঢকঢক করে পানি টুকু খেয়ে ফেলে!
কমিশনার খবর পেয়ে দ্রুত কারাগারে আসে । মেহমেতের এমন অবস্থা দেখে তিনি চাপা স্বরে বলেন।
এই জন্য বলেছিলাম ওর সাথে দেখা না করাই ভালো। পাগল হয়ে গেছে সে। পাগল কথা টা শুনে হঠাৎ পুরো হাজত কাঁপিয়ে হাসতে থাকে নিশান আর বলতে থাকে… পাগল আমি!! হা হা হা হা…পাগল আমি নই, পাগল তোমরা যে দোষী সে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক উঁচু করে। আর আমি কোন দোষ করিনি, আমার শাহানা ও কোন দোষ করেনি। আমার পরিবার সেও দোষ করেনি,, কিন্তু আমাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, আমার শাহানা কে মেরে ফেলেছে, আমার পরিবার কে বাধ্য করা হয়েছে আত্মহত্যা করার জন্য,,তার পর নিশান মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে, কিছু ক্ষন থম মেরে থাকার পর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগে।
মেহমেতের ভিতরে কেমন করে উঠলো,চাপা কষ্ট যেন ক্ষনে ক্ষনে গ্রাস করছে তাকে। নিশানের পরিবার আত্মহত্যা করেছে!!
তিন দিনে ঐ পরিবার কে যত খানি সে দেখেছিল তাতে চিনেছিল হাজার কষ্টেও কি ভাবে হাসতে হয়, বাঁচার তাগিদে কিভাবে লড়াই করে যেতে নয়। নিশানের মা বাবার মত মানুষ হয় না। আর নির্জনীর সেই লজ্জা মিশ্রিত হাসি সব যেন চোখের সামনে ভাসছে তার। মানুষ গুলোর সাথে কি করে এসব হলো?? মেহমেতের হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। এখনো নিশান কাঁদছে তার কান্নার সেই স্বরে রয়েছে হাজারো রকম কষ্ট যন্ত্রনা রাগ ক্ষোভ.. যা সে কিছুতেই কোন কিছু তে প্রকাশ করতে পারছে না বলে এমন করুন কান্না জুড়ে দিয়েছে।
মেহমেতের মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নিশান আর শাহানার শত্রুতা কাদের সাথে ছিল?? কে তাদের এমন করুন হালের জন্য দায়ী?? কে দোষী???
মেহমেত নিশানের কাছে আবার যেতে চাইলে কমিশনার বাধা দিয়ে বলে এখন উঠুন আর যান! ওর মত আসামীর কাছে কেউ সেফ না । মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে ওকে। মেহমেত কমিশনার কাছে বলে প্লিজ আর ৫মিনিট দেন আমাকে,ওর সাথে আমার কথা বলতেই হবে, নিশান কে দোষী কে এসব করেছে?? আমি জানি ভাই তুই কখনো এমন কাজ করিসনি। আমি তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো। তুই শুধু এক বার বল কে এসবের পিছনে আছে???
নিশানের কান্না এক বারে বন্ধ হয়ে গেল! জোরে চিৎকার দিতে দিতে বলে , তুই জানিস না?? কিছুই জানিস না তুই?? সেদিন গাড়ি পাঠিয়ে কোথায় নিয়ে যেতে বলেছিলি আমাদের?? আর ঐ বক্সে ড্রাগস ছিল তুই রেখেছিস আমাদের ঘরে!! নিশান ভাই কি বলছিস তুই এসব আমি তো সেদিন__
মেহমেত আর কিছু বলতে না দিয়ে কমিশনার তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মেহমেত কাকুতি মিনতি করে বলে প্লিজ স্যার আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দেন ও আমাকে ভুল বুঝছে। আমি তো সেদিন আসিনি ওদের নিতে! স্যার প্লিজ!
মেহমেত অসহায় দের মতো পিছনে দৃষ্টিপাত করে নিশান জেলের রড ধরে আবার নিচে বসে পড়ে কান্না শুরু করে। মেহমেত চিৎকার দিয়ে বলে! ভাই তুই আমায় ভুল বুঝিস না। আমি আসবো আবার তোকে নিয়ে যাবো আমি। তুই এক দম চিন্তা করিস না।
কমিশনার মেহমেতের কথায় কেমন ঘাবড়ে যাচ্ছে বার বার। মনের ভিতর এক অজানা ভয়ে বার বার শুকনো ঢুক গিলছে।
মাসুমা চিন্তায় সবাই কে এক করে দিচ্ছে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল তার ছেলে কোথায়?? ছেলেটা এখনো ঠিক মত সুস্থ হয়নি আর এমন অবস্থায় আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে! তাকে খুঁজে এনে দাও আমায়। কাছে ফোন ও নেই যে ফোন দিবে।
মাসুমা সবাই কে পাগল করে ফেলছে. আরিফা আর আবদুল হামিদের কথা কিছু তেই বুঝতে চেষ্টা করছে না। যে চলে আসবে মেহমেত। শান্তনা দিচ্ছে বার বার তবুও অস্থির হয়ে পড়ছে সে। ওরা নিজেরাও মনে মনে খুব চিন্তিত। কিন্তু তা প্রকাশ করলে মাসুমা আরো ভেঙে পড়বে। হামিদ খান ভিসি কে ফোন দিয়ে শুনেছেন যে সে ভার্সিটিতে গেছিল কিনা। উনি বলেছেন, দুপুরেই সে বের হয়ে গেছে। খুব পাগলামী করছিল। কিন্তু এখন মেহমেত কোথায়???
মেহমেত মরার মত হয়ে চোখ মুখ শুকে এলোমেলো পায়ে হেঁটে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। আরিফা ভাই কে স্বস্তি পায়। দৌড়ে ভাইয়ের কাছে যায়। উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ভাইয়া কোথায় ছিলি এতো ক্ষন তুই?? দেখ মা তোর জন্য পাগল করে ফেলছে আমাদের। মেহমেত ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। মাসুমা আর হামিদ খান দৌড়ে ছেলের কাছে এসে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে বাবা তোর ?? মেহমেত ঠিক আছো তুমি?? শরীর খারাপ লাগছে তোমার?? আরিফা পানি নিয়ে আসো ! কি হলো কথা বলছিস কেন? কোথায় গেছিলি এমন হাল কেন তোর??
ভাঙা গলায় মেহমেত মা বলে ডুকরে কেঁদে উঠে। মা শাহানা !! নিশান!
মা আমি কত দিন হসপিটালে ছিলাম??
আরিফা পানি নিয়ে আসে , ৩মাস ধরে কোমায় ছিলি ভাইয়া তুই.. আমরা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম যে আবার তুই সুস্থ হবি. সামনের মাসে আব্বু তোকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করতো। কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমতে তুই ভালো হয়ে গেছিস??
কেন ভালো হয়েছি আমি?? আমার সব থেকে কাছের বন্ধুদের এই করুন হাল দেখার জন্য?? মাসুমা ছেলে কে কিভাবে শান্তনা দিবে ভেবে পায় না। ছোট বাচ্চাদের মত করে মেহমেত চোখের পানি ফেলছে। আর আহাজারি করছেন। যেমন বাচ্চারা কোন সখের খেলনা হারিয়ে ফেললে কান্না করে।
মেহমেত পরবর্তী এক বছর শুধু নিশান কে ছাড়ানোর জন্য কাজ করে যায় খাওয়া দাওয়া ঘুম সব যেন হারাম হয়ে উঠেছে তার কাছে। ভার্সিটির যে সব ছাত্র ছাত্রী রা নিশানের নামে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের কোন খোঁজ নেই। নিশানের সাথে তার ৬_৭মাস দেখা হয়নি। কমিশনার কোন মতে তার সাথে দেখা করতে দেয়নি। কোন উকিল নিশানের কেস নিবে না । নিশানের বিরুদ্ধে কেউ পদক্ষেপ নিতে ঘোর নারাজ। লক্ষ লক্ষ টাকার এমাউন্ট কেও নাকোচ করে দিচ্ছে। কোন মতেই কোন প্রমান পাওয়া যাচ্ছে না। মেহমেতের মুখের কথায় কিছুই আসবে যাবে না। যারা নিশান আর শাহানা দের বিয়ে পড়িয়েছিল সেই কাজী অফিসি সেখানে আর নেই। আর উকিল নাকি নিখোঁজ!
যেখানে সব আশা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তখন অসৎ পথ অবলম্বন করে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় করে নিশানের যাবত জিবন কারাদণ্ড থেকে মুক্ত করতে না পারলেও তার শাস্তি টা কমাতে পেরেছিল মেহমেত। লাস্ট নিশানের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল মেহমেতের সেটাও জজ সাহেব কে কারী টাকা ঘুষ দিয়ে অনুমতি নিতে হয়েছিল। কমিশনার কে না জানিয়ে।
শেষ বার যখন নিশান কে দেখেছিল! তার থেকে কয়েক গুণ অবস্থা খারাপ নিশানের। খাওয়া দাওয়া নাকি ছেড়ে দিয়েছে। সারা দিন এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। মেহমেতের ডাকে কোন সাড়া দেয়নি সে। এক মনে তাকিয়ে ছিল। শুধু তার নির্ঘুম ওয়ালা চোখ দুটো কি যেন বলতে চাচ্ছিলো।
________________&&____________
দিন দিন আমার নিজের অবস্থা খারাপ হতে চলেছিল, নিজেই যেন একটা জীবন্ত লাশ হয়ে উঠেছিলাম। বাবা মা খুব চিন্তায় পড়ে যায় আমাকে নিয়ে। মা দিন রাত এক করে আমার একটু হাসি মুখ দেখার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আরেক নতুন বছর চলে আসে। আমাকে স্বাভাবিক আর ব্যস্ত রাখার জন্য কম্পানিতে আসা যাওয়া করতে বলে। পরে ভেবে দেখি আমি আমার কষ্ট টা বেশি প্রকাশ করে ফেলেছি। যার কারণে আমার পরিবার কেও আমি কষ্ট দিচ্ছি। তাই আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়ার নাটক করতে থাকি, নিজের কষ্ট গুলো একান্ত নিজের করে নেয়। নিশান কে মানসিক হাসপাতালে রাখা হয় ২বছর । তার পর অন্য জেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন মতেই আর নিশানের সাথে দেখা করতে পারিনি। তিন বছর পর মা বাবা তোমাকে আমার বউ করে আমার কাঁধে স্বামী হওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দেয়। যেন পিছনের সব কিছু ভুলে যায়।
আমার শুধু ওরা বন্ধু ছিল না। আমার ভালো থাকার মন্ত্র ছিল তারা। শাহানার মত মেয়ে হয় না। এক জন সাধারণ ছেলের মাঝে অসাধারন ভালো গুনের প্রেমে পড়েছিল! তাকে হারাতে পারবে না বলে বেকার অস্থায়ী এক জন মানুষ কে বিয়ে করে নিয়েছিল। অথচ দিন শেষে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে নিজেই হারিয়ে গেছে।
আর নিশান! স্বপ্ন দেখতো সব সময় মা বাবা বোন কে ভালো রাখবে! মা বাবার সকল দুঃখ কষ্ট ঘুচাবে.. বোন কে ভালো কোনো ছেলের হাতে তুলে দিবে। তার এই স্বপ্নে নতুন ভাগিদার হয়ে আসে শাহানা। তার সাদা কালো জীবন টাকে গুছিয়ে রঙিন করার দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। তার বিদ্যা সাগর প্রতিষ্ঠিত হবে দুনিয়া কে সে চিৎকার করে জানাবে যে এই আধারাম ভীতু মানুষ টা শুধু তার, শুধুই তার একান্ত ব্যাক্তি সে। তার প্রানপ্রিয় স্বামী নিশান!!!!
মেহমেতের চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে! আমি এই ১০টা বছর শুধু এটা জানার জন্য ছটফট করছি কে বা কারা ওদের জীবন টাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি এক বার যদি জানতে পারতাম তারা কে ছিল??মেহমেত চোয়াল শক্ত করে বলে বিশ্বাস করো মরিয়ম আমি ওদের নিজের হাতে খুন করে ফেলতাম। আমার সব থেকে বড় দুঃখ হলো ওমন নিশানের দুরাবস্থায় আমি ওর পাশে থাকতে পারিনি আর ও আমাকে ভুল বুঝেছে। মরিয়ম মেহমেত কে নিজের বাহুডরে আবদ্ধ করে নিয়ে শান্তনা দিতে থাকে। আমি এই কেস আবার লড়বো আপনি এক দম কান্না করবেন না। আমিই ওদের সবাইকে খুঁজে বের করবো। সবাই তার শাস্তি পাবে। কিন্তু এসব করেছে কে ?? সেটা আমাদের নিশান ঠিক বলতে পারবে!! আমি আবার দেশবাসীর কাছে নিশান কে নির্দোষ প্রমাণিত করবো। তার নামে যে কুৎসিত রটনা করা হয়েছে তার ইতি আমি টানবো!!!
নিশানের সামনে এবার মুখোমুখি হওয়ার সময় এসে গেছে!! মরিয়মের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তাদের সে ঠিক মতো জানে না তবুও বুকের ভিতর এক শুস্ক ব্যাথা অনুভব করছে। আর মেহমেতের তাহলে কত টা কষ্ট হচ্ছে তা উপলব্ধি করতে পারছে সে।
চলবে _____???
কেমন হয়েছে জানাবেন। গল্প টা কি অতি তারাতারি শেষ করে দিবো?? নাকি আর একটু বাড়াবো?? আপনাদের মূল্যবান মতামত চাই!!!