মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৩৬

#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ছত্রিশ

রাফসান আস্তে আস্তে তুলতুলের পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা। অনুভব করলো তুলতুল নিঃশ্বাস ফেলছে। রাফসান জোরে একটা শ্বাস ফেললো, তারপর দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে, তার চিন্তা যে দূর হয়েছে তা নয় আরো বেড়েছে। কি হয়েছে তুলতুলের সাথে তার কিছুই সে জানে না। রাফসান ফ্লোরে বসে তুলতুলের মাথা নিজের কোলে নিল। আস্তে করে তুলতুলের মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়েই আঁতকে উঠে। দুইগালেই পাচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে, গালে আঁচড় ও রয়েছে। রাফসানের এটা দেখেই মাথায় রক্ত উঠে যায়। পশুগুলোর এতো সাহস ওর গায়ে হাত দিয়েছে? একটা মেয়েকে কিভাবে এমন ভাবে মারতে পারে? তার এখন সবগুলোকে নিজ হাতে খুন করতে পারলে শান্তি হতো। রাফসান রাগের চোটে হাত মুঠো করে ফ্লোরে একটা ঘুষি দেয় জোরে, রাগ কমছে না তার। চোখ গুলো লাল হয়ে ছিল এমনিতেও রাগের কারনে আরো লাল হয়ে আছে। রাফসান তুলতুলের গালে হাত বুলায়, তার চোখের এককোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে তা রাগ, ক্ষোভ, আর অসহায়ত্বের। তুলতুলকে এভাবে মার খেতে হয়েছে আর সে কিছুই করতে পারেনি। এর পেছেন যার হাত আছে তাকে সে ছাড়বে না, একদম পিছ পিছ করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। রাফসান তুলতুলকে ডাকে, কয়েকবার ডাকার পরও চোখ খোলে না। তাই সে তুলতুলকে আস্তে ঝাঁকি দেয়। এবার তুলতুল একটু নড়ে ওঠে, তারপর ধীরে চোখ খোলে তার চোখ লেগে আসছে, তাকাতে পারছে না। চোখ খুলে রাফসানকে দেখে সে মুচকি হাসে। আর রাফসান ভ্রু কুঁচকে ভাবে মেয়েটা এই অবস্থায় হাসছে কেন? বেশি শক আর ভয়তে কি পাগল হয়ে গেলো?

তুলতুল ওঠে বসার চেষ্টা করে, রাফসানও ধরে তাকে উঠতে সাহায্যে করে। বসে সে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আবার হাসে। কিন্তু রাফসান সেদিকে খেয়াল না করে তুলতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শান্তি লাগছে এখন তার, আজ দুইদিন পর নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে। এতটা মানসিক অশান্তির ভেতর ছিল যে তা বলার বাইরে। রাফসান তুলতুলের মাথার ওপর থুঁতনি রাখে। তার খেয়াল হয় তুলতুলও তাকে ধরেছে কিন্তু দূর্বল হাতে, কেমন গুটিসুটি মেরে তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তুলতুল রাফসানকে ধরেই কিছু একটা বলছিল, কিন্তু রাফসান তা বুঝতে পারলো না অস্পষ্ট ভাবে বলছে। তাই সে তুলতুলকে সামনে এনে কি বলছে শুনতে চায় কিন্তু তুলতুল ছাড়ে না। তারপরও সে তুলতুলকে ছাড়িয়ে তার সামনে এনে দুহাতে তার মুখ ধরে জিজ্ঞেস করে

-” কি বলছো? বুঝতে পারছি না? কি হয়েছে? ওরা কি তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে? গালে ব্যাথা করছে?” কিন্তু রাফসানের কথায় উত্তর না দিয়ে তুলতুল জড়ানো কন্ঠে আস্তে বলে

-” খারাপ! খুব খারাপ আপনি। কেন এত দেরি করে এসেছেন? জানেন ওরা আমাকে কত মেরেছে? আমি তো জানতাম আপনি আমার কিছু হতে দিবেন না, আপনি আসবেন। কিন্তু আসেন নি। ভালো না একদম, কেউ ভালো না।” বলে ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে।

রাফসান অবাক হয়। তুলতুল তার আসার অপেক্ষা করছিল, যে সে এসে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। এতটা বিশ্বাস করে তাকে? আর সে ঠিকসময় মতো প্রিয় মানুষকে বাঁচাতে আসতে পারে নি। রাফসানের ভেতর অপরাধ বোধ কাজ করে। সে তুলতুলের গালে হাত দিয়ে আস্ত বলে

-” কে মেরেছে তোমাকে তুলতুল? আর এই আঁচড় লেগেছে কিভাবে?”

তুলতুল রাফসানের হাত সরিয়ে দিল। তার গাল জ্বলছে। সে আস্তে করেই অস্পষ্ট ভাবে বলে

-” এক শয়তান আমার কাছে আসতে গিয়েছিল, তখন ওর থেকে নিজেকে বাঁচাতে আঁচড় লেগেছে। আমি জুতা দিয়ে মেরেছিলাম আর ওখানে পড়ে থাকা চেয়ারের ভাঙা টুকরো দিয়ে বারি দিয়েছি। কিন্তু আমাকে আবার থাপ্পড় মারে তারপর কিছু করতে গেলে শয়তানটার ফোন আসে আর আমাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যায়।” তুলতুলের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আর রাফসানের মনে হয় তার গায়ে যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। হাত মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে গাট হয়ে বসে আছে সে।

হঠাৎ দরজার দিকে পায়ের শব্দ পায় সে, সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রিভলবারের টিগারে হাত দিয়ে রাখে। হঠাৎ করেই আকষ্মিক ভাবে কেউ দরজার সামনে এসে গুলি করতে যায় কিন্তু গুলি ছোড়ার আগেই রাফসান শুট করে। এতদিন ধরে এসবের সাথে যুক্ত শত্রুর পায়ের আওয়াজেই সে বুঝতে পারে। তাইতো তীক্ষ্ণ ভাবে দরজার দিকে চেয়ে ছিল। রাফসান এগিয়ে গিয়ে রক্তাক্ত ভাবে পড়ে থাকা লোকটিকে পা দিয়ে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়, যেনো সব রাগ লোকটার ওপর ঝাড়ছে। তারপর দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার লোকজন তার খোঁজ করবে। সে তুলতুলের কাছে গিয়ে তুলতুলকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করে কিন্তু সে উত্তর না দিয়ে হাসতে থাকে। রাফসান ভ্রু কুঁচকায়। মেয়েটা হাসছে কেন এত? তার সামনে আসলে তো এমনিতে ভয় পায় আর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। রাফসানের ভাবনার মধ্যেই তার গালে টান পড়লো। রাফসান গালে হাত দিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। সে চোখ ছোট ছোট করে তাকে দেখছে। রাফসানের কিছু বলার আগেই তুলতুল রাফসানের গলা জড়িয়ে ধরে, রাফসান এতে পিছিয়ে যায়,পেছনে ফ্লোরের সাথে হাত দিয়ে ব্যালেন্স রাখে। পরে তুলতুলের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। আর তুলতুল সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তার গাল টেনে ধরে বলে

-” কি কিউট! আওও! গুন্ডাদের গাল এতো সফট আর কিউট হয়?” বলে তুলতুল রাফসানের গাল জোর টানতে লাগলো। আর রাফসান তুলতুলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে তুলতুলের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ বড়সড় একটা ঝটকা খেয়েছে। আর তা দেখে তুলতুল খিলখিল করে হাসে। রাফসান তুলতুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে হাসলে ভালো লাগে। ডানগালের একপাশে হালকা টোল পড়ে যা শুধু হাসলে বোঝা যায় অন্যথায় না। এতোদিন সে এটা দেখেই নি৷ দেখবে কিভাবে সে কি তুলতুলকে এভাবে কোনদিন হাসতে দেখেছে নাকি? দেখেনি তো। রাফসান এভাবে হা করে থাকতে থাকতেই তুলতুল উঠে দাঁড়ালো, তারপর পড়ে যাওয়ার অবস্থা হওয়ার পরেও সে কয়েক পা এগিয়ে রাফসানের কাছে গিয়ে তার পেটের একপাশের শার্ট হাত দিয়ে মুঠো করে ধরে বলে

-” এত রাগ কোথা থেকে আসে হুম? আমাকে খালি রাগ দেখানো।” তারপর রাফসানের থেকে একটু দূরে সরলো কিন্তু শার্টের থেকে হাত না সরিয়ে তাকে ব্যঙ্গ করে বলে

-” এইই মেয়ে এইইই! মানা করেছি না আমার সামনে আসতেএএএএএ। তোমারর সাহস তো কম নায়ায়া। হুহ্ আমি কি আপনার এই কথাতে ভয় পাই নাকি? একদম পাই না। আমি সাহসী নারী। বুঝতে পেরেছেন?” এবার সে টিচারের মতো করে জিজ্ঞেস করলো যে স্টুডেন্ট পড়া বুঝতে পেরেছে কিনা। রাফসানের হাসি পেলেও হাসতো না। তার মাথায় আসছে না তুলতুল কেন এমন করছে। যে মেয়ে তাকে দেখে ভয়ে জমে যায় সে তাকে ভয় পায় না বলছে? আশ্চর্যের বিষয়! তারপরেও রাফসান তুলতুলকে বললো

-” তাই তুমি ভয় পাও না? সত্যি সাহসী নারী তো তুমি? এখন আমি যা করবো তুমি তাতে ভয় পাবে নাতো?” একথায় তুলতুল রাফসানের দিকে একবার তাকালো। তারপর মুখটা অসহায়ের মতো করে মাথা নিচু করে আবার উঠিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে

-” আপনার কষ্ট হয় না? রাতে ঘুমাতে পারেন?” রাফসান কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করলো

-” কেন?”

-” একটা মাসুম, ছোট্ট মোট্টো মেয়েকে ধমকিয়ে কষ্ট দিয়ে আপনি কিভাবে ঘুমাতে পারেন?” রাফসান আবার বলে

-” কোন ছোট্ট মেয়ে?”

-” কেন আমি” বলে তুলতুল দুই গালে হাত দিয়ে কিউট করে চোখ পিটপিট করে তাকায়। আর রাফসান বিষম খায়। সে কাশতে শুরু করে। নির্ঘাত এ মেয়ে মানসিক চাপে পড়ে পাগল হয়ে গেছে। নাহলে এমন করছে কেন? রাফসানকে কাশতে দেখে তুলতুল কাছে গিয়ে তার বুকে হালকা করে থাপড় দিতে থাকে আর বলে ” শাত শাত শাত” রাফসান তুলতুলের এমন করা দেখে তার হাত ধরে সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে

-” কি করছো তুমি?”

-” কাশি থামাচ্ছিলাম, আমার বিষম লাগলে মা এমন হালকা থাপড় দিয়ে বলে শাত শাত সেরে যাবে।” রাফসান এবার তুলতুলকে দিকে তাকিয়ে বললো

-” ওটা মাথায় হবে বুকে না ফাজিল!” আর তুলতুল এমন ভাব করে যেনো সে বুঝেছে এরপর উঁচু হয়ে রাফসানের মাথায় হাত দিতে যায় কিন্তু রাফসান হাত ধরে ফেলে বলে

-” সেরে গেছে। আর লাগবে না।” রাফসানের চোখ যায় ধরে রাখা তুলতুলের হাতে দিকে। ওখানে কেমন যেন হয়ে আছে। সে হাত কাছে এনে দেখে তারপর তুলতুলকে জিজ্ঞেস করে

-” ওরা কি তোমায় কোনো ইনজেকশন দিয়েছে?”

-” হুম, আজকেও দিয়েছে দুইটা। প্রতিদিন দেয়, আমি অনেক ব্যাথা পাই।” তুলতুল রাফসানের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে। রাফসান আবার জিজ্ঞেস করে

-” তোমাকে কিছু খেতে দিয়েছে এ দুইদিন?”

-” পাউরুটি আর কলা দিয়েছে, পানি দিয়েছে। পানি না খেতে চাইলে জোর করে খায়িছে। তারপর না আমি অনেকক্ষণ পর চোখ খুলতাম।” রাফসানের মনে হচ্ছে তার গলা এখুনি কেউ এসে শক্ত করে চেপে ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। এতটা কষ্ট দিয়েছে তুলতুলকে তারা? ভেতরে তার আগুন জ্বলছে কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করলো না তুলতুলের সামনে। তুলতুলকে নিয়েই ফ্লোরে বসে পড়লো সে। তুলতুলকে ড্রাগস দেয়া হয়েছে, আর পানির সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে। ঘুমের ঔষধের এ্যাকশন কেটে গেলেও ড্রাগসের টা যায় নি। তাই এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে তা এখন রাফসান বুঝতে পারছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুলতুলকে কিছুদিন বন্দী রেখে তাকে মেরে ড্রাগস দিয়ে মাদকাসক্ত বানানো। হয়তো এরপেছনেও কোন কারন আছে। রাফসান নিজের গায়ের জ্যাকেট টা খুললো, যেটা সে গাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ আগে পরেছিল। তুলতুলকে জ্যাকেট পড়িয়ে দেয়, তারগায়ে ওড়না নেই। এতক্ষণ লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে থাকার কারনে সে বুঝতে পারেনি। জ্যাকেটের চেইন আটকে তুলতুলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়। তারপর গালের দিকে তাকায় খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে তার এই দাগগুলো দেখতে।

-” আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন? কতদিন দেখিনি আপনি জানেন? কত খুঁজেছি আপনাকে আমি, কিন্তু পাই নি জানেন? না জানেন না। আপনিতো শুধু মানুষকে মারতে জানেন। গুন্ডা একটা!” তুলতুল জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে। আর রাফসান অবাক হয় এটা শুনে যে তুলতুল তাকে খুঁজেছে। সে তো মনে করেছে সে তুলতুলের কাছ থেকে দূরে গেলে তুলতুল হয়তো খুশি হবে আর তাকে কখনো মনেও করবে না কিন্তু হয়েছে উল্টো। মানুষের কখন কাকে কোন সময়ে মনে ধরে যায় তা বুঝা যায় না। সে তুলতুলকে বলে

-” কেন খুঁজেছো আমাকে? তুমি তো আমাকে না দেখলে আরো খুশি হও বলো। মানে তোমার বয়েই গেছে আমার সামনে আসতে। তাহলে কেন খুঁজেছিলে আমায়? হুম!”

-” ভালোবাসেন তাই!”

-” ভালোবাসি? কাকে?”

-“যাকে বলেছেন তাকে।” রাফসান মুচকি হাসলো তুলতুলের কথায়। নেশার ঘোরেও সোজাসাপটা উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দিচ্ছে।

-” আপনাকে যখন আর দেখিনি তখন মনে হয়েছিল আপনাকেও আপুর মতো আর কখনোই দেখতে পাবো না। খুব খারাপ লাগতো আমার তখন। আপনাকে দেখতে মন চাইতো, কিন্তু আমি তো আপনাকে এরআগে কখনো দেখতে চাইতাম না। তাহলে কেন এমন হয়?” রাফসান তুলতুলের কথায় গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপরও সে বললো

-” ভালোবাসো তাই।” তুলতুলের জবাব দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে আবিরের কণ্ঠ শোনা গেলো

-” ভাই ঠিক আছেন? পরিস্থিতি স্বাভাবিক। বের হয়ে আসতে পারেন। ওদেরকে ধরা হয়েছে।” রাফসান উঠে তুলতুলকে উঠায় তার হাত ধরে সামনে আগায় কিন্তু তুলতুল পড়ে যেতে লাগে তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, মাথাও ব্যাথা করছে। রাফসান তুলতুলকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। আবির রাফসানকে একটা রুম দেখায় যে ওদের ওখানে বেঁধে রাখা হয়েছে। রাফসান রুমের দরজায় তুলতুলকে নামিয়ে রুমের ভিতর ঢোকে। আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে

-” স্বীকার করেছে এর পেছনে কে আছে?”

-” না ভাই প্রত্যেক টাকে জিজ্ঞেস করেছি কেউ কিছু বলেনি।”

-” ওহ আচ্ছা! সমস্যা নেই। থেরাপি দেওয়া হলেই গড়গড় করে বলে দেবে যে কার কুকুর এগুলো।” তারপর রাফসান তুলতুলের কাছে গিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে

-” এদের ভেতর থেকে কে তোমাকে জোর করার চেষ্টা করেছিল?” তুলতুল চোখ বড় করে লোকগুলোকে ভালো করে দেখে একজনকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখায়। রাফসান পেছনে ফিরে তাকে দেখলো। তারপর তুলতুলকে একটু সরিয়ে রেখে দরজাটা চাপিয়ে দেয়। তারপর সেই লোকটির কাছে যায় যাকে তুলতুল দেখিয়েছে। ইতিমধ্যে লোকটা মাথা নাড়ানো শুরু করেছে যাতে তাকে কিছু না করে। মুখ তার বাঁধা রয়েছে। কিন্তু রাফসান ক্রুর চোখে তাকায় লোকটির দিকে। এর সাহস হয় কি করে তুলতুলের ক্ষতি করার? রাফসানের চোখ লাল হয়ে রয়েছে। তাকে ভয়ংকর লাগছে এখন। রাফসান একটা ছুরি নিয়ে লোকটির মুখে ইচ্ছা মতো দাগ কাটে। লোকটির মুখ পুরো রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। তাও রাফসান থামছে না, এদিকে লোকটার মুখ দিয়ে গোঙানির মতো করছে।

-” তোর সাহস কি করে হয় ওর দিকে হাত বাড়ানোর? শালা মেয়ে দেখেই মাথার হুঁশ উড়ে গেছে? তুই কার গায়ে হাত দিয়েছিস জানিস তো? ভুল করেছিস না জেনে। তো ভুল যখন করেছিস এর মাশুল তো দিতেই হয় বাছাধন।” বলে আবির হাত থেকে দা নিয়ে লোকটার হাতে ওপর একটা কোপ দিল। হাত একদম শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু লোকটার মুখ বাঁধা থাকায় তার চিৎকার শোনা গেলো না। শুধু গো গো আওয়াজ হলো। রাফসান বাঁকা ভাবে হাসলো। লোকটি তা দেখে আর ভয় পায়। আর রাফসান রিভলবার বের করে সোজা লোকটার মাথায় গুলি করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে

-” একটাও যেনো ছাড়া না পায়। এর পেছনে কার হাত আছে আমি তা জানতে চাই। এমন অবস্থা করবি যাতে সেই ব্যক্তি এদের দেখে নিজে ভয় পায়। আর স্বীকার না করা পযন্ত এদের ওপর টর্চার চালাবি। কত তে আর বলবে না।” রাফসান বাইরে গিয়ে দেখে তুলতুল দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে। হয়তো খারাপ লাগছে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। রাফসান গিয়ে তুলতুলকে কোলে তুলে বের হয়ে যায় বাড়িটা থেকে তারপর গাড়িতে গিয়ে তুলতুলকে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দেয়। আর সে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তুলতুল বিরবির করে কিছু বলছে। কিন্তু রাফসান তা বুঝতে পারলো না। তার গাড়ি টা একটা সাইকেলকে পাশ কাটিয়ে যায় তা দেখে তুলতুল বলে

-” সুন্দর না সাইকেলটা? আমারও ছিল কিন্তু কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।” বলে কাঁদো কাঁদো মুখ করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে

-” আমি সাইকেলে উঠবো।” রাফসান তুলতুলের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মুচকি হেসে তার গাল টেনে দিয়ে বলে

-” এখন তো গাড়িতে আছো। পরে একসময় আমি সাইকেলে চড়িয়ে তোমাকে নিয়ে ঘুরবো। ঠিকাছে?” কিন্তু না তুলতুল জেদ করে সে এখনি উঠবে। কিন্তু রাফসান কিছু বলে না দেখে সে ডোর ওপেন করতে যায় চলন্ত গাড়ির আর রাফসান তা দেখতে পেয়ে তার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে গাড়ি লক করে দেয়। গাড়ি থামিয়ে রাগ করে তুলতুলকে ধমক দিয়ে বলে

-” সমস্যা কি তোমার? একবার বলেছি না? তাহলে তুমি চলন্ত গাড়ি থেকে কোন সাহসে নামতে যাও?” তুলতুলের গাল সে চেপে ধরেছিল রাগে। তার খেয়াল নেই যে তুলতুলের গালে ব্যাথা। তুলতুল এতে জোরে কান্না করে। রাফসানের হুঁশ আসে সে তুলতুলের গাল চেপে ধরেছিল। রাফসান নিজের ওপর রাগ করে স্টিয়ারিং এ ঘুষি দেয়। আর তুলতুল ফুপিয়ে কেঁদে উঠে আরো। রাফসান কিছু বলতে গিয়েও বলে না, সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিছুক্ষণ পরে জ্যামে আটকা পড়ে। তখন তাদের গাড়ির পাশে একটা বাইক এসে থামে। বাইকে সামনে একটা ছেলে রয়েছে আর পেছনে একটা মেয়ে তাকে ধরে বসে আছে। তুলতুলের কান্না ততক্ষণে থেমে গেছে। সে নাক টেনে ওদের দিকে টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে থাকে। তারপর জোরে জোরে বলে

-” নাইস কাপল! এইযে ভাইয়া কতদিন বিয়ে হয়েছে? আপনাদের তো অনেক মানিয়েছ। তো বাচ্চা কাচ্চা কোথায়? নাকি ওদেরকে ফেলে নিজেরা ঘুরতে যাচ্ছেন? এটা তো ঠিক না। বাচ্চারা তো মন খারাপ করবে। নাকি আপনাদের বিয়েই হয়নি? পালিয়ে যাচ্ছেন নাতো?” বলে তুলতুল ভ্রু উঁচু করে তাদের দিকে তাকায়। আর বাইকে বসা মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে রাফসানের দিকে তাকায়। কিন্তু রাফসান সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তুলতুল আবার বলে

-” পালিয়েই যাচ্ছেন তাই না? আমি সবাইকে বলে দেব। এই তোমরা শুনো….. ” তুলতুল আর বলতে পারে না রাফসান তুলতুলের মুখ চেপে ধরে। রাস্তা ক্লিয়ার হয়েছে তাই রাফসান কোন দিকে না তাকিয়ে একহাত দিয়ে তুলতুলের মুখ চেপে আরেকহাত দিয়ে ড্রাইভিং করে। লজ্জাজনক পরিস্থিতি। তুলতুল বাচ্চাদের মতো করছিল, রাফসানের পাশের গাড়িতে একটা মেয়ে ছিল বোধহয় সে তুলতুলের কান্ড দেখা খিকখিক করে হাসছিল। সেটা রাফসান না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছে। সে কিছুদূর গিয়ে তুলতুলের মুখ ছেড়ে দিয়ে বলে

-” জীবনটা কষ্টের, এর থেকেও বেশি কষ্ট ড্রাগস দিয়ে মাতাল করা কোন মেয়েকে সামলানো উফফ!” রাফসানকে রাগ করতে দেখে তুলতুল মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকে। রাফসান তুলতুলকে ফোন এগিয়ে কথা বলতে বলে। সে ফোন কানের কাছে নেয়। ওপাশ থেকে তিয়াসের কণ্ঠ ভেসে আসে। তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে সে খুব অস্থির হয়ে আছে। তুলতুল বলে

-” ভাইয়া?” অপাশ থেকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তেজিত ভাবে তিয়াস বলে ওঠে

-” তুলতুল তুই কোথায়? ঠিক আছিস বোন? কি হয়েছে তোর? কথা বলছিস না কেন? তুই ঠিক আছিস?”

-” হু” তুলতুল জবাব দেয়।

-” তুই কোথায় বল? আমি এখনি আসছি। কোথায় আছিস তুই? ”

-” ঠিক আছি”

-” হ্যালো তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? কি হয়েছে? তুলতুল তুই শুনতে পারছিস?”

-” হু” তুলতুল চোখ খুলে রাখতে পারছে না আর। রাফসান তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নেয়।

-” তুলতুল ঠিক আছে। ডোন্ট ওয়ারি! ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে। ” বলে ফোন কেটে দেয় রাফসান। তারপর তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুল তার গায়ের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সে একহাত দিয়ে তুলতুলকে ধরে ড্রাইভ করে।

তুলতুল আধশোয়া হয়ে বসে আছে। রাফসান তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছে। একটু আগে রোমানা চৌধুরী দেখা করে গেছে তার সাথে। বেশি কথা বলেনি তুলতুল অসুস্থ দেখে। রাফসান রুমে ঢোকে হাতে খাবারের ট্রে। সে হাতের খাবার পাশের টেবিলে রেখে তুলতুলের পাশে বসে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বলে

-” কেমন লাগছে এখন?” তুলতুল মাথা নাড়ে। রাফসান চামচ দিয়ে খাবার তুলে তুলতুলের মুখের সামনে ধরে। তুলতুল খাবে না বলে কিন্তু রাফসানের চোখ রাঙানো দেখে খেয়ে নেয়৷ সে অবাক হয় যে রাফসান তাকে খায়িয়ে দিচ্ছে? তবুও কিছু বলে না। খাওয়া শেষ হলে রাফসান তাকে কিছু ঔষধ দেয়। সে খেয়ে নেয়। রাফসান তুলতুলের দিকে তাকায়। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বসে। তুলতুল ভড়কে যায় এতে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেতে লাগলো। রাফসান একদৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে

-” ভালোবাসো আমায়?” তুলতুল বিষম খায়। সে কাশতে থাকে। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে হার্ট এখুনি বের হয়ে আসবে এত জোরে বিট করছে। আর রাফসান পানির গ্লাস তার হাত থেকে সরিয়ে মাথায় হালকা থাপড় দেয়। তার এই কাজে তুলতুলের তার করা কান্ড মনে পড়ে, সে লজ্জা পায়। রাফসান আবার জিজ্ঞেস করে

-” ভালোবাসো? ” সে তুলতুলের চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না। একভাবে তাকিয়ে আছে। তুলতুল এদিক ওদিক তাকিয়ে অস্বস্তিতে আমতাআমতা করে মাথা নাড়ায় মানে “না সে বাসে না” রাফসান আরো একটু কাছে এগিয়ে যায় তার। সে ঢোক গিলে তা দেখে। রাফসান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে শান্ত স্বরে

-” ভালোবাসো কি আমাকে?” বলে সে তুলতুলের চোখের দিকে তাকায়। এবার তুলতুল আর চোখ সরায় না। সে রাফসানের চোখের চাহনিতে আটকে গেছে।ঘোরলাগা ভাবেই উপর নিচ মাথা নাড়ে। আর রাফসানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। সে তুলতুলের কপালে হালকা ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে। তুলতুল রাফসানের বুকের সাথে লেপ্টে মাথা ঠেকিয়ে আছে আর রাফসান তুলতুলের মাথায় থুঁতনি ঠেকিয়ে। যদিও তার মনে হাজারো রকম চিন্তা চলছে। কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ? সত্যি জানলে কোনদিন আদৌও কি তুলতুল তাকে ভালোবাসবে? পূর্নতা পাবেতো তাদের ভালোবাসা? কিন্তু সে সব চিন্তা ক্ষনিকের জন্য বাদ দিয়ে প্রিয়তমাকে বুকে আগলে ধরে রাখলো।

চলবে…..

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here