#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১১
অপরাজিতা অপু
পৌষের কোন এক বিকেলের নরম রোদের মতই মিষ্টি শোনালো ‘তুমি’ সম্বোধন টা। এই প্রথম রুপমের মুখে তুমি শুনে আমার শরীর শিউরে উঠলো। হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। অভিমানের পাহাড় মিলিয়ে গেলো মুহূর্তেই। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বললো
” মন খারাপ?”
আমার ভেতরটা ছলকে উঠলো। আবেগে টলমল আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি। তবুও বাচ্চামো ভাবটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় অভিমানী কণ্ঠে বললাম
” মন খারাপ হবে কেনো?”
” সেটা আমি কিভাবে বলি? এতো কিছু হয়ে গেলো মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কত কথাই না হলো। সেসবের কারণে মন খারাপ হতেই পারে।”
আমি জানালার ধারে দাড়ালাম। মুখটা অন্ধকার করে দূরে কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকা ল্যাম্প পোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে বললাম
” শুধু কথা হলেই মন খারাপ হয়? নাহলেও তো মন খারাপ হতে পারে।”
রুপম আমার কথাটা ধরতে পারলো না। একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
” কি বলছো উল্টা পাল্টা? ঠিক করে বলো।”
আমি বললাম না। চুপ করেই থাকলাম। দুপাশের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে এলো না। নিরবতা ভেংগে রুপম বলল
” যদি চুপ করেই থাকবে তাহলে ফোন দিলে কেনো?”
আমার খুব অভিমান হলো। মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আমি মন খারাপ করে বললাম
” ঠিক আছে। বিরক্ত করলাম। এখন রাখছি।”
” ফোন করে কথা বললে বিরক্ত করা হয়না কথা না বলে চুপ করে থাকা টা বিরক্তির কারণ। তুমি এতো অবুঝ কেনো আজরা?”
আবারো মনের মাঝে ঢেউ খেলে গেলো। আমি চাপা নিশ্বাস ফেলে বললাম
” বিয়ে করে ফেললেন অথচ আমার সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করলেন না।”
” আমি তো সবটা তোমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তোমার বাবাকে বলেছিলাম বিয়ের আগে তোমার অনুমতি নিতে। উনি তোমাকে জিজ্ঞেস ও করেছিলেন। আর তুমি নিজেই বলেছ কোন আপত্তি নেই। এখন তো এসব কথা বলে লাভ নেই।”
” বাবাকে কেনো বলবেন? আপনি নিজে বলতে পারেন নি।”
রুপম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল
” সেদিন তো আমি তোমাকে বলেই দিয়েছি আমার কথা। এরপর আর কি বলার আছে? তুমি যখন বাসায় কিছুই বলোনি তাই তোমার বাবাকেই বলেছিলাম শুনে নিতে।”
আমি অভিমানী কণ্ঠে বললাম
” সেদিন কি বলেছিলেন? আপনার কিছুই করার নেই। যা করতে হবে আমাকেই করতে হবে। সেই যে চলে গেলেন আর একবারও কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। মনে হয়নি মেয়েটা একা একা কিভাবে সামলাবে? আপনি অদ্ভুত মানুষ।”
রুপম এর মৃদু হাসির আওয়াজ কানে এলো। কোমল কণ্ঠে বললো
” সেদিন আরো একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?”
আমি মনে করতে পারলাম না। রুপম বলল
” বলেছিলাম এমন সুন্দরী মেয়েকে আমি রিজেক্ট করতে পারবো না। তাই তোমাকেই সবটা করতে হবে। চান্স দিয়েছিলাম তো। তুমিই নিতে পারো নি। এখন আর কিছুই করার নেই। এখন চাইলেও আর সম্ভব না। কারণ এই তুমি টা আমার হতে আর কোন বাধা নেই।”
রুপম এর কথা শুনে লজ্জায় আমার শরীর কেপে উঠলো। কথা হারিয়ে গেলো কোথায় যেনো। লোকটা কি অদ্ভুত! আগে কখনো তো এমন কথা বলেনি। রুপম বলল
” কাল নতুন বছরের প্রথম দিন। আর আমাদেরও নতুন জীবনের শুরু। ভাবছি সেটা সেলিব্রেট করা দরকার।”
আমার ঠোটে লজ্জা মাখা হাসি। রুপম বলল
” কাল যদি তোমাকে শাড়ীতে দেখতে চাই সেটা কি সম্ভব?”
আমি মৃদু হেসে বললাম
” কেনো আজ দেখেন নি?”
” না। ”
” কেনো?”
” আজ দেখতে চাইনি। কারণ আমার তুমিটাকে আমার মতো করেই দেখতে চাই। যেমনটা ভেবে রেখেছি ঠিক তেমন টাই।”
আমি অবাক হয়ে বললাম
” আপনি কেমন ভেবেছেন আর আমি কেমন করে সাজবো? সেটা যদি এক রকম না হয়?”
” হবে। আমি তোমাকে প্রথমদিন যখন দেখেছিলাম তখনি আমার ভাবনার মতই দেখতে পেয়েছিলাম। তাই এবারও ব্যতিক্রম হবে না। কাল সকালে আমি বাসায় আসবো তোমাকে নিতে। রেডি থাকবে কিন্তু।”
রুপমের আত্মবিশ্বাস দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি। আমার উপরে একটা মানুষের এতো বিশ্বাস। অথচ কয়দিন আর হয়েছে তার সাথে পরিচয় হওয়ার। আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনের মাঝে কেমন অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কাল কি হতে যাচ্ছে। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ভাবতেই গা শিরশিরিয়ে উঠছে।
—
বাবার হাসির আওয়াজেই ঘুম ভেংগে গেলো সকালে। আমি অবাক হলাম। অনেকদিন বাদে বাবাকে এতো জোরে আর মন খুলে হাসতে দেখলাম। বিছানা ছেড়ে চুলগুলো খোঁপা করতে করতেই দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। বাইরে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত ঘুম কেটে গেলো। টেবিলে রুপম আর বাবা বসে খোশগল্পে মত্ত। সে গল্পের কারণেই এতো হাসি। আমি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছি। ভাবী টেবিলে চায়ের কাপ রেখে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো
” একটু আগেই এসেছে। তোমাদের নাকি কোথায় যাওয়ার কথা?”
আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। ভাবী ঠোঁট টিপে হেসে বলল
” বাব্বাহ! একদিনেই এতো পরিবর্তন। কাল পর্যন্ত তো কি করবে সেটাই বুঝতে পারছিলে না। আর আজ বাইরে যাচ্ছো তাও জানতে পারলাম না।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। কি বলবো এই কথার জবাবে। কিছুই মাথায় এলো না। ভাবী হেসে ফেলে বলল
” থাক বলতে হবে না। আমরা আর কাবাবে হাড় হবো না। তোমরাই ঘুরে বেড়াও।”
আমি লজ্জা পেলাম ভাবীর কথায়। ভাবী সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু রুপমের উপরে রাগ হলো। মানুষটা কেমন বেহায়া। সকাল সকাল চলে এসেছে। আর এদিকে আমি এখনো ঘুম থেকেই উঠতে পারলাম না। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো কাল বিয়ে হয়েছে মাত্র। আর আজ সকালে সে পাঞ্জাবি পরে সেজে গুজে একদম না জানিয়ে বাসায় এসেছে। লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি। আমি আর ভাবতে পারলাম না। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। টেবিলের এক পাশে দাড়াতেই বাবা বলল
” এই তো মামনি এসে গেছে।”
আমার অদ্ভুত অনুভূতি হলো। বাবা আমাকে জীবনে কয়েকবারই মামনি বলে ডেকেছে। আর সেসব আমার জীবনের খুব বিশেষ সময়। তবে এই ডাকটা আমার খুব ভালো লাগে। বাবা এমন ভাবে ডাকলে আমার ভেতরটা খুশীতে ভরে যায়।
” এইখানে বসো।”
বাবা মাঝখানের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন। রুপম এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমি চেয়ারে বসতেই বাবা উঠে বলল
” তোমরা কথা বলো। আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি।”
বাবা ঘরে চলে গেল। বুঝলাম আমাদের দুজনকে স্পেস দিয়ে চলে গেলো। আমি খুব সন্তর্পনে এদিক সেদিক তাকালাম। কেউ নেই সেটা নিশ্চিত হতেই চাপা আওয়াজে রুপম কে বললাম
” আপনি এই সময় কেনো এসেছেন?”
রুপম হাতের চকচকে সিলভার বেল্টের ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল
” এখন ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট। আর আমার জতদুর মনে আছে আমার সকালেই আসার কথা ছিলো।”
” তাই বলে এতো সকালে? আসার আগে আমাকে একবার জানানো উচিৎ ছিলো। ফোন করে আসতে পারতেন।”
রুপম আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
” মনে হচ্ছিলো তুমি ঘুমাচ্ছিলে। তাই বিরক্ত করতে চাইনি। ভাবলাম একদম বাসায় গিয়েই জানাবো। বাই দ্যা ওয়ে ঘুম কেমন হয়েছে ম্যাডাম?”
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। আমার বিরক্তি শেষ সীমা অতিক্রম করছে। তাই কোন উত্তর দিলাম না। রুপম পেছনে হেলে আরাম করে বসে বলল
” আমার তো খুব ভালো ঘুম হয়েছে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ জীবনের সবথেকে ভালো ঘুমটা কাল রাতেই হয়েছে।”
আমি বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। রুপম আমার চেহারা দেখে হেসে ফেললো। আমাকে বিরক্ত করতে পেরে সে যেনো খুব খুশী। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বললো
” এখনো তোমার ঘুম ভাঙেনি। চা টা খাও ফ্রেশ লাগবে।”
আমি এবার চায়ের কাপের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তারপর বললাম
” এটা আপনার চা। আমি কেনো খাবো?”
” তুমি যে পুরোটাই আমার। তাহলে এক কাপ চায়ে এমন বৈষম্য কেনো? তোমার আর আমার বলে আদৌ কি আলাদা কিছু থাকার কথা ছিলো?”
চলবে#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১২
অপরাজিতা অপু
সবার সামনে দিয়ে এভাবে শাড়ি পরে বেরোতে ভীষণ অসস্তি হচ্ছিলো আমার। সেটা যে রুপম কে বোঝাতেই পারছি না। আর বোঝাবো বা কি করে তার সাথে তো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। ওই তখন টেবিলে বসে যা কথা হয়েছে সেটাই। তারপর সে বাবার সাথে আবারো গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে। বেশ অসস্তির মাঝে শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। ভাবী এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই বলল
” তোমার দেখি সেন্সর খুব একটা কাজ করে না।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভাবী হাত থেকে শাড়িটা একদম ছিনিয়ে নিয়ে বলল
” এটা পরে বাইরে যেতে চাচ্ছো? বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাচ্ছো। এমন একটা ফ্যাকাশে রঙের শাড়ি পরবে?”
আমি মুখটা অন্ধকার করে বললাম
” শাড়ি পরবো কিনা সেটাই ভাবছিলাম আর রং নিয়ে তো এখনো ভাবিনি।”
ভাবী নিজের কপালে হাত রাখলো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
” এতো কনফিউশন নিয়ে সংসার কিভাবে করবে বলো তো? তোমাকে দেখে আমারই টেনশন হচ্ছে।”
আমি উত্তর দিলাম না। ভাবী আলমারি খুলে বেশ সময় নিয়ে একটা শাড়ি বের করে বলল
” এটা পরো। দেরি করবে না।”
আমি হাতে নিয়ে বসে পড়লাম বিছানায়। ভাবী বেরিয়ে গেলো। আমিও নিজের মত রেডি হয়ে দরজায় দাড়ালাম। আমার ঘরের দরজার ঠিক সামনা সামনি বসে আছে রুপম। বাবার সাথে গল্পে মত্ব। আমি অনেক্ষণ ধরেই সেখানে দাড়িয়ে আছি। রুপম বেখেয়ালি ভাবে এক পলক তাকাল আমার দিকে। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিলো। আমি একটু বিরক্ত হলাম। নিজেই আবদার করেছিলো শাড়ীতে দেখতে চায় আর এখন তাকানোর ফুরসৎ পাচ্ছেন না জনাব। অভিমানে ভারী হয়ে উঠলো বুক। আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবী এসে বলল
” বাইরে চলো।”
অভিমানী আমি মান ধরে রেখেই বললাম
” ওনাদের গল্প শেষ হয়েছে?”
” হয়েছে।”
আমি কথা বাড়ালাম না। বাইরে গেলাম। রুপম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতেই মাকে বলল
” আমরা আসছি মা।”
রুপম এর মুখে মা ডাক শুনে আমার মায়ের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো মা। রুপম সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে বলল
” চলো।”
আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম তার সাথে। পাশাপাশি হাঁটছি দুজন রাস্তার ধারে ঘেঁষে। কেউ কোন কথা বলছি না। আমি নাহয় অভিমান করেছি। কিন্তু এই লোকটার কি হয়েছে। কেনো কথা বলছে না আমার সাথে। আমি মনে মনে ভীষণ রাগ করলাম। নিজে থেকে কথা বলবো না একদম। যার কাছে আমার রাগ অভিমান এসবের কোন মূল্য নেই তার সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। রুপম হাত উচিয়ে একটা রিক্সা থামালো। তারপর রিক্সায় উঠে বসলো। আমি দাড়িয়ে রুপমের দিকে তাকিয়ে আছি। একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে রিক্সায় বসলাম। ঠিক প্রথম দিনের মতই এক পাশ ঘেঁষে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করেছে। বেশ অনেক্ষণ হল কেউ কোন কথা বলছি না। এবার আমার অসস্তি হচ্ছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রুপম আমার দিকে তাকালো না। কিছুটা হেয়ালি করে বলল
” কেনো? না জানলে কি যাওয়া যাবে না?”
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালাম। রুপম সামনের দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করলো। তার মাঝে কোন অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো না। আমি তার আচরণে ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছি। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম
” জানলেও কি কোন সমস্যা আছে?”
রুপম বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
” জানতেই হবে কেনো? আমি সাথে আছি সেটাই কি যথেষ্ট নয়? নাকি মনের সন্দেহ আছে যে কিডন্যাপ করে কোথাও নিয়ে যাবো।”
রুপম এর কথা শুনে আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। আমিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম
” হতেও তো পারে। কিভাবে বিশ্বাস করি। আজকাল কার মানুষকে একদম বিশ্বাস নেই। আর কদিনই বা হয়েছে আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়া।”
আমার কথাটা যে রুপমের ইগো তে লেগেছে সেটা তার চাহুনি দেখেই বুঝেছি। আর মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। এতক্ষণ যা ভাব নিচ্ছিলো এখন একটু হলেও জব্দ হয়েছে। রুপম হুট করেই আমার দিকে ঝুঁকে গেলো। তার উষ্ণ নিশ্বাস আমি আমার মুখের উপরে অনুভব করছি। এভাবে হুট করেই এতো কাছে আসার ব্যাপারটা আমার কাছে অসস্তিকর হয়ে উঠলো। আমি একটু পেছনে হেলতেই সে এক হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
” পড়ে যাবে। শেষে কিনা ঘুরতে যাওয়া বাদ দিয়ে হাসপাতালে হানিমুন করতে হবে।”
আমি স্থির হয়ে গেলাম। অস্থির নিশ্বাস ফেলে ভেংগে ভেংগে বললাম
” হানিমুন মানে?”
রুপম ঠোঁটের কোন প্রশস্ত করে বলল
” স্বামী স্ত্রী বিয়ের পরে হানিমুন করতে যায় এটা জানো না? ঠিক আছে আমি বুঝিয়ে দেবো। ইন ডিটেইল।”
রুপম ঠোঁট টিপে হেসে আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। আমিও সোজা হয়ে বসলাম কিন্তু দম এখনো বসছে না। আমার সামান্য খোঁচা মারা কথার বিনিময়ে এমন একটা কান্ড ঘটালো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না আমার। আমি অবচেতন মনে আবারো জিজ্ঞেস করলাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রুপম হেসে ফেলে বলল
” বললাম তো হানিমুনে।”
হঠাৎ ই আমার মনে ভয় গ্রাস করল। কিসের ভয় বুঝতে পারলাম না। তবে আমি এখনই কেঁদে ফেলার জোগাড়। কাদো কাদো কণ্ঠে বললাম
” প্লিজ! সত্যি কথা বলেন না।”
রুপম এবার হেসে উঠলো অদ্ভুতভাবে। আমি তাকালাম। আমাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে সে বেশ মজা পাচ্ছে। হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। বেশ আদুরে কণ্ঠে বললো
” ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। অধিকার থাকলেও সেটা জোর করে আদায়ে আমি বিশ্বাসী নই।”
বলেই আমার হাতে হাত রাখলো। আমি রুপমের স্পর্শে মৃদু কেপে উঠলাম। সে বুঝল কিনা জানি না। তবে আলতো করে ধরে থাকা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
” এই হাতটা যতক্ষণ তোমার এই হাত ধরে রাখবে ততক্ষণ কোন ভয় নেই আজরা। তুমি আমার কাছে আমার থেকেও দামী। আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। তবে আমি না থাকলে সে অন্য কথা।”
রুপম এর শেষের বাক্যটা আমার বুকের ভেতরে আঘাত করলো। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পিটপিট করে পানি আটকাবার চেষ্টা করে বললাম
” আপনি কেনো থাকবেন না?”
রুপম মৃদু হেসে বলল
“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”
আমি প্রায় কেদেই ফেললাম। রুপম এর ফোন বাজলো। আমি কোন রকমে চোখের পানি আটকিয়ে রাখলাম। ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেলাম না। কিন্তু এপাশে রুপমের অস্থিরতা বেড়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল
” ফাইল টা তো আমি বাসায় রেখেছি। কাল অফিস থেকে আসার সময় সাথে এনেছিলাম। রাতে চেক করবো বলে।”
থেমে গেলো রুপম। ওদিকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল
” কিন্তু আমি তো আজ ছুটিতে।”
খানিকবাদেই হতাশ সুরে বলল
” আচ্ছা ঠিক আছে। দেখছি।”
ফোনটা কেটে হাতের মুঠোয় ধরে কি একটা ভাবলো। আমি তার ভাবনা দেখে বললাম
” কোন সমস্যা হয়েছে?”
রুপম সামনে তাকিয়েই বলল
” আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে। তুমি আমার সাথে বাসায় যাবে আজরা? তোমাকে বাসায় রেখে আমি শুধু অফিসে যাবো আর আসবো। বেশি দেরি করবো না।”
আমি মাথা নাড়লাম। রুপম রিক্সা ঘুরিয়ে ওর বাসার দিকে নিয়ে যেতে বলল। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে ভেতরে নিয়ে গেলো আমায়। আমি বেশ ইতস্তত বোধ করছি। রুপম আমার অবস্থা বুঝে বলল
” তোমাকে দেখলে সবাই অনেক খুশি হবে। আগে ভেতরে চলো তারপর বুঝতে পারবে।”
আমি মনে সাহস নিয়ে ভেতরে গেলাম। রুপম এর কথা সত্যি। আমাকে দেখে তার পরিবারের লোকজন বেশ খুশি হলো। আমাকে তো ওর মা পাশে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। রুপম এক পর্যায়ে বলল একটা ফাইল দিতে অফিসে যেতে হবে। দিয়েই চলে আসবে। রুপম বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রুপম এর মা তো আমাকে দেখে রান্না করতে শুরু করে দিলেন। রাতে না খেয়ে নাকি যেতে দেবে না। নিরুপায় আমি কোন কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সময় পেরিয়ে গেলো। দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসবো। কিন্তু রুপম এখনো আসেনি। শাশুড়ি মা আমাকে বললেন রুপম কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আমি ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ পেলাম। ভাবলাম হয়তো কাজে ব্যস্ত তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। শাশুড়ি মাকে বললে তিনি কিছুটা ভাবুক হয়ে বললেন
” রুপম তো কখনো ফোন বন্ধ রাখে না। মিটিং এ গেলেও সাইলেন্ট করে রাখে। আমার অভিজ্ঞতা নেই বিধায় তেমন কিছুই বললাম না। শাশুড়ি মা কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার চিন্তা দেখে আমার মনে হলো অযথাই তিনি এমন করছেন। আমি তবুও কিছু বললাম না। রুপম এর বোন টিভি অন করলো। আমাকেও টিভি দেখতে ডাকলো কিন্তু আমি শাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাতে চাইলাম। এক সময় আমাদের গল্পের মাঝেই রুপমের বন চিৎকার করে উঠে বলল
” মা এদিকে আসো। দেখো কি হয়েছে?”
আমরা দুজনই সেখানে গেলাম। সে টিভির দিকে ইশারা করে দেখতে বলল। আমরা সেদিকে তাকালাম। তাকাতেই আতকে উঠলাম। টিভির স্ক্রীনে বড়ো করে ব্রেকিং নিউজ চলছে।
” এল সি কোম্পানিতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৭ টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।”
একজন সাংবাদিক লাইভ রিপোর্ট করছেন।
“৪ তলা এই অফিসে কয়েক হাজার কর্মী কাজ করতেন। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বের হয়ে এসেছেন। তবে তিনতলায় কয়েকজন কর্মী বের হতে পারেন নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চেষ্টা করেও তাদের কে বের করতে সক্ষম হন নি। ধারণা করা হয় তারা সবাই মৃ ত।”
শাশুড়ি মা সোফায় বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রীনে স্থির। মেয়েকে বললেন
” রুপম এর কলিগ সায়েমকে ফোন কর। রুপম এর খবর নে। অফিসে আগুন লেগেছে। ছেলেটা আমার কেমন আছে।”
বলতে বলতেই তিনি কেঁদে ফেললেন। আমার বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো। রুপম এর বোন তার কলিগ কে ফোন দিলো। তার কথা শুধু শুনতে পেলাম। সেটা শুনেই আন্দাজ করলাম রুপম ভেতরে আটকা পড়ে আছে। কি অবস্থায় আছে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো। শাশুড়ি মা এক চিৎকার দিলেন। আমার মাথা ঘুরে গেলো। আমি সোফায় বসে পড়লাম। একটা কথা শুধু মাথায় ঘুরছে।
“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”
চলবে
( আজকের পর্বটা রিচেক করার ইচ্ছা নেই। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)