#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৯,
রায়ার রুমে খাটে বসে আছে রাদ। কিছুক্ষণ হলো তারা রায়াদের বাসায় এসেছে। সবার সাথে পরিচিত পর্ব সেরে মাত্র রুমে এসে বসলো সে। রায়া এসেই আগে ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। রাদ একটু খানি দম নিয়ে লাগেজ থেকে কাপড় বের করে নেয়। গরমে হাসফাস লাগছে তার। এ কদিন তবু আবহাওয়া হালকা ঠান্ডা ছিলো। এখন আবার এতোটা গরম কেনো হচ্ছে কে জানে! শরৎ এর আকাশ তো সবসময় হালকা নীল মেঘে ভেসে থাকে আর মৃদু মন্দ বাতাসে আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য হয়। কিন্তু এতো গরম লাগছে মনে হচ্ছে সময়টা শরৎ নয় গ্রীষ্মের খরা। একটুপরই রায়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়। রাদ রায়ার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। এটা কি পড়েছে রায়া? থ্রি কোয়ার্টার লেডিস জিন্স আর হাফ হাতা টপস। গলায় কোনো স্কার্ফ অব্দি নেই। রায়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের চুল আচরাতে শুরু করে। রাদ রায়ার কাছে গিয়ে বলে,
” এগুলো কি ধরনের ড্রেস পরেছেন রায়া? আপনি এখন বিবাহিত, আমার বউ৷ ড্রেস বউদের মতোন পরুন। এরকম জিন্স টপস কেনো? ”
” বিদেশের মাটিতে বেরে উঠা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আর তার মাঝে দেশী বউ বউ আচার আচরণ আশা করা বোকামি মিঃ রাদ। ”
” তাই বলে এসব? আপনি ভুলে যাচ্ছেন ইহসাস, নাতাশা, আমার মামাতো দুই বোনের জামাইও আমাদের সাথে এসেছেন।”
” তো আমি কি করবো? ”
” বাঙালি ড্রেস পরুন। ”
” পারবোনা। ”
” প্লিজ রায়া! শাড়ি না হলো অন্তত থ্রিপিস পরুন। ”
রাদ করুণ চোখে তাকিয়ে কথা টা বলে। রায়া আর কিছু বলে না। রাদের দিকে তাকিয়ে আলমারী খুলে একটা থ্রিপিস নিয়ে ফের ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। রাদ হাফ ছেড়ে বাচে। সে নিজেও রায়া ওয়াশরুমে বিধায় রুমেই ড্রেস পাল্টে নেয়। নরমালই টাউজার আর একটা টিশার্ট পরে নেয়। এই অ’সহ্য গরমে আপাতত এগুলোতেই কমফোর্ট সে৷ রায়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রাদকে বলে,
” আপনি রেস্ট করুন। আমি মাম্মার কাছে যাচ্ছি। ”
” মাম্মা কি? মা-কে মাম্মা থেকে আম্মা ডাকেই অনেক শান্তি। ”
” বাংলা আভিজাত্যে বড়ো হলে হয়তো এটাই ডাকতাম। আফসোস রক্তে বিদেশীদের কালচার মিশে গেছে। ”
রায়া কথা টা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রাদ রায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজ মনেই বল, ‘ আপনাকে আপাদমস্তক বাঙালিয়ানায় সাজাবো রায়া। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছি, তাদের পছন্দের মর্যাদা আমি রাখবো। জীবনে কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হইনি, শুধু নিজের বউ যে নারী হবে, তার প্রতি আসক্ত গাড় হয় যেনো, এই আশায়। আপনার প্রতি আমার আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে। হালাল সম্পর্কের জোড় বুঝি এটাই। ছাড়ছিনা আপনাকে। এটা আমার নিজের কাছে নিজের জন্য ওয়াদা।’ এরপর রাদ ফোন নিয়ে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের খোজ নিতে শুরু করে। রাদদের নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ আর রাদের ছোটো বাবার সুপারশপ আছে। আপাতত দু ভাই মিলে এগুলোই দেখাশোনা করছে। ইহসাস এখনও নিজেদের ব্যবসাক্ষেত্রে ঢুকেনি। রাদ আর রাদের বড় ভাই ফারহাদ ব্যবসা দেখাশোনা করছে। ফারহাদ ব্যবসারই একটা কাজে চট্টগ্রামে আটকে গেছে। যার ফলে বিয়েতে তার উপস্থিতি নেই। সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলে কাজ কে সামলাবে! বাড়িতে এতো আনন্দ, অথচ বড় ভাই তার পাশে নেই। ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্থশ্বাস বেরিয়ে আসে রাদের।
” দুলাভাই, আসবো? ”
রাদের চিন্তা ভাবনার মাঝেই হিয়ার বড় মামার মেয়ে আফরা দরজায় দাড়িয়ে রাদকে প্রশ্ন করে। রাদ আফরা কে দেখে হাসিমুখে উত্তর দেয়,
” আরে বড় শালীকা। হ্যাঁ এসো।”
” দুলাভাই ফুফু নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকছে ডাইনিং টেবিলে। সব আয়োজন করা হয়েছে। সবাই বসেছে, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
” আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি। ”
আফরা রাদের কথা শেষ হতেই আচ্ছা বলে চলে যায়। রাদ তার ভাইয়ের কাছে ‘মিস ইউ ভাই ‘ লিখে টেক্সট করে ফোনটা বিছানায় রেখে চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। ”
১০,
ছাদের এককোণে দাড়িয়ে আছে হিয়া। দৃষ্টি রাতের অন্ধকার আকাশ দেখতে নিমজ্জিত। ছাদের একপাশে লাইট লাগানো আছে বিধায় ছাদে তেমন অন্ধকার নেই৷ আশেপাশের বাড়িরও লাইট জ্বা’লানো আছে এখনও৷ তাদের বাড়িটা গলির একদম শেষ মাথায়। এরপর আর কারোর বাড়ি নেই, তাদের বাড়ির পর একটা ছোট্ট খেলার মাঠি, তারপর ফসলি জমি। তার একপাশে একটা বস্তি এলাকা। সেখানের ছোট্ট ছোট্ট ঘরগুলোই জ্ব’লছে টিমটিমে লাইটের আলো। হিয়ার দৃষ্টি সেগুলোই ঘুরেফিরে দেখছে। তখন তার ফোনে আসা মেসেজটার কথা ভেবে এখনও ভয়ে কম্পন ধরে যাচ্ছে হিয়ার শরীরে। মেসেজ টা তার ভাইয়ের ক্লাসফ্রেন্ড এলভিনার। সে জানিয়েছে রায়ার বয়ফ্রেন্ড লুইস রায়া নিজের বিয়ের খবর দেওয়ার পর সু”ইসাইডের চেষ্টা করে হাসপাতালে এডমিট। সে বারংবার রায়াকে দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু রায়ার ফোনে কেউ কল দিয়ে পাচ্ছে না বলে হিয়ার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। দুই বোনকেই ফোনে না পেয়ে রায়া আর হিয়ার ভাই অন্তরের সাথে যোগাযোগ করেছিলো লুইসের বাবা মা। অন্তরের নিজের মাতৃভূমির প্রতি কোনো রকম আগ্রহ নেই। সেজন্য সে তাদের সাথে দেশেও আসেনি। অন্তরও রায়া আর লুইসের সম্পর্কের বিরুদ্ধে, অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে রায়ার সম্পর্ক হওয়ায় একপ্রকার রায়ার প্রতিও দ্বিরুক্তি প্রকাশ পায় অন্তরের। অন্তর লুইসের বাবা মায়ের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করায় তারা নিজেদের লোকজন দিয়ে অন্তরকেও আ”ঘাত করেছে। অন্তরের সেন্স নেই এখন। এলভিনা হিয়ার সাথে এফবিতে এড থাকায় তাকেই টেক্সট করে ব্যাপারটা জানিয়েছে। রায়ার বিয়ের জন্য কারোরই নিজেদের ফোনের দিকে নজর নেই। এই ঝা’মেলা গুলোর কথা বড় বোনকে, ভাইয়ের কথা বাবা মা-কে কিভাবে জানাবে হিয়া! চিন্তা করেও পথ পাচ্ছে না হিয়া। হিয়া নিজের চুল টে’নে ছাদের রেলিং এর সাথে বসে পরে। এ কোন পরিস্থিতিতে ফেললো তার বড়ো বোন!
” কি হলো? বেয়াইন সাহেবা ছাদে একা বসে আছে এভাবে? অথচ তার বাড়িতে আমরা অতিথি হয়ে এসেছি। সেদিকে খেয়ালই দিচ্ছেন না আপনি। ”
হিয়া কারোর গলার স্বর শুনে চোখ তুলে তাকায়। ইহসাসকে কথাগুলো বলতে শুনে তার ভেতরে কোনো রিয়েকশন দেখালো না। আগের ন্যায় মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়িয়ে বসে রইলো। ইহসাস হিয়ার এরকম চুপচাপ ব্যবহার দেখে অবাক হয়। এরকম তো হিয়া নয়। সে কিছু বললেই তো হিয়া গরম তেলে পানি পরার মতো ছ্যাৎ করে উঠে। কিছু কি হয়েছে নাকি? সারা বাড়িতে মানুষ আনন্দ হইচই এ ব্যস্ত। অথচ হিয়া কোথাও নেই। ব্যাপার টা খেয়াল করে সে হিয়াকে খুজতে খুজতে ছাদে চলে এসেছে। এসে হিয়াকে এই অবস্থায় দেখে একটু মজা করতে চাইলো, অথচ হিয়ার কোনো হেলদোল নেই। সে চেষ্টা ছাড়লো না। হিয়াকে রা”গাতে বলে,
” তখন খাবার বসে আপনি আমার ছবি তুলেছিলেন বেয়াইন সাহেবা! আমার অনুমতি ছাড়া আমার ছবি তুলেছেন কেনো? ”
হিয়া চমকে তাকায় ইহসাসের দিকে। সে ছবি তুলেছে ইহসাস বুঝলো কিভাবে! তখন তো সে খেতে ব্যস্ত ছিলো। হিয়া ইহসাসকে একপলক দেখে। ইহসাস তার সামনে এক হাটু মুড়িয়ে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লাইটের আবছা আলোয় ইহসাসকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় হিয়া। ইহসাসকে এই মুহুর্তে বড্ড মায়ার আ”ধার মনে হচ্ছে হিয়ার। কিন্তু সময়টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ফোনের ডাটা খোলাই ছিলো হিয়ার। মেসেন্জারের টুংটাং মেসেজ আসার শব্দ হয়। রায়ার শ্বশুর বাড়িতে থাকার সময় সে এলভিনাকে বলেছিলো, বাসায় এসে ফ্রি হয়ে মেসেজ দিবে। এরপর এলভিনার সময় হলে কল করবে। এলভিনার উত্তর পেয়ে ইহসাসে অগ্রাহ্য করে উঠে দাড়ায় হিয়া। রেলিং ঘেষে উল্টোদিকে ঘুরে কল দেয় এলভিনাকে। এলভিনা রিসিভ করতেই ফরাসী ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। ইহসাস অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে বাঙালি হয়ে ফরাসী ভাষা জানলো কি করে! জার্মানি থাকার সূত্রে ফরাসী ভাষা টুকটাক বিভিন্ন জায়গায় ফরাসীদের উপস্থিতিতে শুনেছে, কিন্তু সে জানেনা এসব ভাষা। কিন্তু হিয়া! সে কি করে জানলো? প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে ইহসাসের মাথায়। সে ছাদ থেকে যায় না। হিয়ার পাশে দাড়ায়। হিয়া ইহসাসকে দাড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আবার কথা বলায় মনোযোগ দেয়। প্রায় ৮মিনিট পর হিয়া ফোন কে”টে দেয়। ফোন কা”টতেই ইহসাস প্রশ্ন করে,
” আপনি অন্যদেশের ভাষা জানেন দেখছি। কিন্তু কিভাবে? ”
” ওমা! যাদের ঘরের মেয়েকে আপনাদের বাড়ির বউ করা হয়েছে, তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন না? ”
” বাড়িতে কিছু হলে আমার সেভাবে আগ্রহ থাকেনা কখনও। তাই জানিনা তেমন কিছু। আপনিই না হয় জানান। ”
” আমার জন্মই বিদেশের মাটিতে। তাদের দেশের ভাষা জানবো না! ”
হিয়া তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে কথাটা বলে। ইহসাস অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
” মানে? ”
” মানে তেমন কিছু না৷ আমার পরিবার আমার জন্মের আগে থেকেই কানাডায় সেটেল্ড। সেই সূত্রে আমিও কানাডিয়ান,আর বাবা মায়ের সূত্রে বাংলাদেশী। ”
” কিন্তু আপনি এতো ভালো বাংলা পারেন কীভাবে?”
” আমাদের পরিবারের বাধ্যগত নিয়ম, বিদেশ হোক বা অন্য গ্রহ বাঙালি যখন, বাংলা সম্পর্কে জানতেই হবে। ”
” ওহহ।”
ইহসাস ছোট্ট করে উত্তর দেয়। এরপর দুজনের মাঝেই চলে ঘোরতর নিরবতা, শব্দ শুধু ঝিঁঝি পোকার। রাত গভীর হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের শব্দও বাড়ছে। ইহসাসই নিরবতা কা”টিয়ে হিয়াকে বলে,
” আপনার ফোন টা দিন তো! ”
হিয়া অবাক হয় ইহসাসের কথায়। তার দিকে তাকিয়ে বলে,
” কি করবেন আমার ফোন দিয়ে? ”
চলবে?