#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫ (২য় খণ্ড)
আজ শনিবার। কোহিনূর প্রায়ই বেশ দ্রুতই ঘুম থেকে ওঠে সকালে। কাজের চাপে আজও তাড়াতাড়িই উঠেছে। তখন সবে সকাল সাড়ে ছয়টা। শীতের আমেজে মজে উঠেছে প্রকৃতি। শীত শীত করছে একটু। আলো ফুটতেও দেরি হয় এখন। বেশ খানিকক্ষণ গার্ডেনে এক্সারসাইজ করে যখন সে ব্ল্যাক কফি নিতে কিচেনে ঢুকতে চায় তৎক্ষনাৎ কিচেনে এক অন্য মানবীকে দেখে পিছিয়ে আসে। হাতে কফির মগ নিয়েই পিছু ফিরে নয়নতাঁরা তার বিগ ব্রাদারকে এমন ভড়কে যেতে দেখে গোল গোল চোখে তাকায়। কোহিনূর স্বস্তির শ্বাস নিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“তুমি? এত সকালে? কয়টা বাজে?”
কোহিনূর হুড়মুড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ি নষ্ট হলো না তো? নাহ, সবে সকাল সাড়ে ছয়টা পার হয়েছে। নয়নতাঁরা নিজের ছোটো চুলের ঝুঁটিতে হাত বুলিয়ে কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সেটা তো আমারও প্রশ্ন বিগ ব্রাদার! কয়টা বাজে আসলে? রাতটা কি এত বড়ো হয়ে গেল? নাকি ঘড়ি নষ্ট?”
“রাত যতই বড়ো হক। নয়নতাঁরা আহমেদের পক্ষে ঘুম থেকে দশটার আগে ওঠা অসম্ভব! আজ এত সকালে তুমি! আই ক্যান নট বিলিভ!”
নয়নতাঁরা এবার রাগ নিয়ে কোহিনূরের হাতে মগ ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“নয়ন চাইলেই সব করতে পারে। শুধু তুমি নিজে একা অলরাউন্ডার নও বুঝলে? আমিও শাহিদ আহমেদের মেয়ে!”
বলেই নিজের ছোটো চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় নয়ন। তার এমন কথা এবং কাজে নিজের হাসিটা আঁটকে রেখে মগটা একবার চেক করে নেয় কোহিনূর। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কফিও বানিয়েছ! সূর্য ঠিক ডিরেকশনে উঠেছে তো?”
“বাহিরে গিয়ে দেখে এসো।”
“কফির মধ্যে কিছু মিশিয়ে দাওনি তো?”
নয়নতাঁরা এবার ক্ষে’পে যায়। এতদিন পর সে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। তার ভাইয়ের উচিত তাকে উৎসাহ করা। কিন্তু তা না করে খুব সুন্দর করে তার মজা উড়িয়ে চলেছে। সহ্য করা যায় না! ছোঁ মে’রে কোহিনূরের হাতের মগটা টেনে নিয়ে তেতে উঠে বলল,
“খেতে হবে না তোমার কফি। নিজে বানিয়ে খাও। আমি খাব এই কফি।”
বলেই মূহুর্তেই এক চুমুক দিয়ে নাক সিটকায় নয়নতাঁরা। জিহ্বা বের করে কেশে উঠে ফের মগটা কোহিনূরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এগুলো মানুষ খায়? কফিতে মাত্র এক চামচ চিনি আর এতগুলো করে কফি বিন!”
কোহিনূর এবার স্বাচ্ছন্দ্যে কফিতে চুমুক লাগায়। দৃঢ়তার সুরে বলে ওঠে,
“বেশি মিষ্টি খেলে ডায়বেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে নয়তবা অল্প বয়সে পেকে যাওয়ার। যেমন তুমি পেকেছ!”
ভেংচি কাটে এবার নয়নতাঁরা। কিচেন থেকে বাহিরে বেরিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলে,
“তোমার এমনিতেই ডায়বেটিস হয়ে যাবে খুব দ্রুত। আমার ভাবিটা তো পুরোই মিষ্টির দোকান। অবশ্য তোমার একান্ত। হিসেব করে বলো তো কয়টা মিষ্টি খেয়েছ আজ অবধি?”
সরু চোখে তাকায় কোহিনূর। নয়নতাঁরা আসলে কী বলতে চাইছে সেটা বুঝতে খানিকটা সময় লেগে যায় ওর। কথাটা বুঝে উঠতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় সে। ততক্ষণে নয়ন হাওয়া! তাকে কী আর পাওয়া যায়?
খুব সূক্ষ্ম চোখে নিজের লক্ষ্য ঠিক করছে কোহিনূর। ফট করেই ট্রি’গারে চাপ দিতেই সরাসরি লক্ষ্যভেদ হয়। রি’ভলবা’র থেকে হালকা ধোঁয়ার আভাস পাওয়া যায়। মেহরাজ রুমে ঢুকে আসে। বিনয়ের সাথে বলে,
“স্যার, রাগিনী ম্যাডাম এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”
রি’ভলবা’র থেকে চোখ সরিয়ে চকিতে তাকায় কোহিনূর। ধীর পায়ে ঘরটাতে প্রবেশ করে রাগিনী। আকাশি এবং সাদা রঙ দুটোর মিশ্রনে একটা লং স্কার্ট পড়েছে সে। গলায় ঝুলানো সাদা ওড়না। কোহিনূরের চোখটা যেন না চাইতেও সেখানেই থামল। বদলে গেল চাহনি। এ যেন আকাশে ভেসে বেড়ানো এক স্বচ্ছ মেঘ! যাকে ছুঁতে মনটা দাবি করে। রীতিমতো আন্দো’লন করে। মেহরাজের গলা খাঁকারিতে নড়েচড়ে উঠে ঢক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে হাত থেকে টেবিলে রাখে রি’ভলবা’র কোহিনূর। মেহরাজ মিটমিটিয়ে হাসে। কোহিনূরকে লজ্জা বা বিব্রত করে আজকাল সে বেশ মজা পায়। আগে এমন কোনো বিষয় ছিল না যাতে তার স্যার লজ্জায় নেতিয়ে যাবে। এখন বিষয়বস্তু পেয়ে মোটেও সুযোগ ছাড়ে না সে। হাসতে হাসতে তার খেয়াল হয় কোহিনূর তার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। তাৎক্ষণিক চোখমুখটা ফ্যাকাশে হয় তার। দ্রুত দরজার দিকে ফিরে বিদ্যুৎ বেগে প্রস্থান নেয়।
“ব্যাপার কী? এমনিতেই তো সারাদিন কল্পনার শহরে সারাদিন রাজত্ব করো। এমনভাবে দখল করেছ সরাতেও পারি না। এখন যদি সামনাসামনি হুটহাট করে আসো তাহলে আমি তো শে’ষ! আমার চাকরিটা খে’য়ে ফেলার বুদ্ধি আঁটছ বুঝি?”
রাগিনী ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কোহিনূর রি’ভলাবা’রই ঘাঁটাঘাঁটি করছে তখনও। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে রাগিনী বলে ওঠে,
“ঠিক আছে। তাহলে আমি বরং চলে যাই।”
উল্টো পথে হাঁটা ধরবে রাগিনী সেই সময় খপ করে তার বাম হাতটা চেপে ধরে টেনেই নিজের সংলগ্নে নিয়ে আসে কোহিনূর। অন্যহাতে তার চিবুক ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
“মেয়েরা বড্ড বেশি বোঝে! তুমিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।”
“বেশি বোঝার কী পেলেন? আপনি যা বলেছেন সেই অনুযায়ীই তো কাজ করতে যাচ্ছিলাম।”
“আমার মুখের কথায় শুনতে হবে? মনের কথা তোমার মনকে স্পর্শ করতে পারে না?”
রাগিনী এবার মিষ্টি করে হাসে। রিনরিনে সুরে বলে,
“স্পর্শ করতে পারে তো। আপনার মনের কথার তীব্রতা এবং গভীরতা এতটা তীক্ষ্ণ কেন কোহিনূর সাহেব? সেই কথাই তো আমার দৃঢ় মনটার দ্বার ভেঙে প্রবেশ করতে পেরেছে।”
রাগিনীর নাক টেনে দেয় কোহিনূর। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“এত সকাল সকাল ম্যাডামের আগমন ঠিক কী কারণে?”
এক হাতের টিফিনবক্সটা কোহিনূরের সামনে তুলে ধরে রাগিনী।
“বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম। এতদিন তো রাগিনীর হাতের খাবার ছাড়া মেন্টাল পেশেন্ট কোহিনূরের চলত না। তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।”
“এসব বলতেই আমার মনে পড়ে গেল তোমার সেই গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়ানোর কথা। কী সাংঘা’তিক বুদ্ধি করেছিলে তুমি! বিয়ের পর এমন সাংঘা’তিক বুদ্ধি করবে না প্লিজ! তাহলে প্রতিদিন আমায় ডক্টরের কাছে ছুটতে হবে।”
রাগিনী এবার শব্দ করে ওঠে। তার হাসির প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয় ঘর। কোহিনূর মনে মনে খুব করে চায় এই হাসিটা দেখার সৌভাগ্য তার সারাজীবনের জন্য হোক। এই হাসিটার আধিপত্যও শুধু তার হোক!
“এখানে আপনি প্র্যাক্টিস করেন?”
রি’ভলবা’রের দিকে তাকিয়ে আনমনে কথাটা প্রশ্ন করে রাগিনী। কোহিনূর অমায়িকভাবে উত্তরে বলে উঠল,
“আমি কেন? আমাদের এখানকার সবাই কমবেশি করে। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে এলেও যখন মাথায় অনেক বেশি প্রশ্ন ঘোরে তখন এখানে এসে ইচ্ছেমতো নিশানা ঠিক করি আর বু’লেট নষ্ট করি। মাঝে মাঝে নিশানা হিসেবে মেহরাজও বাদ যায় না।”
“কী বলছেন? উনাকে নিশানা হিসেবে ব্যবহার করেন? কী ভয়ানক! একবার এদিক থেকে ওদিক হলে কী হবে ভেবেছেন?”
কোহিনূর নরম সুরে বলে,
“আমার মনে কী জানো? ও আমায় ভীষণ বিশ্বাস করে। প্রথমে ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করলেও ঠিকই আমার কথা মেনে সামনে এসে দাঁড়ায়। ও চাইলেই ট্রান্সফার নিতে পারে অথবা চাকরি ছাড়তে পারে। এই শহরে চাকরির অভাব নেই। মেহরাজ একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ওর কোয়ালিফিকেশন অনেক ভালো। তবুও কেন যেন সে এখানেই পড়ে আছে।”
“উনি আপনাকে সম্মান করেন। শ্রদ্ধা করেন, ভালোও বাসেন।”
কোহিনূর মলিন হাসে। আসলেই হয়ত তাই। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে, আলোচনা করে এক অন্যরকম প্রশান্তি আসে তার মনে।
রাগিনী এখনো ফ্যালফ্যাল করে রিভ’লবা’রের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। বিষয়টা খেয়াল করে কোহিনূর তার হাতে রি’ভলবা’র তুলে নিয়ে বলল,
“ট্রাই করবে?”
শিউরে উঠল রাগিনী। দুই ধাপ পিছনে সরে গিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“না না! একদম না। রেখে দিন ওটা। আমার ভয় করে।”
“কিছু হবে না। সাহস করে দেখো না একবার!”
“আপনি জানেন তো আমার ফোবিয়া আছে!”
কে শোনে কার কথা? কোহিনূর রাগিনীর ব্যাগ আর টিফিন বক্স চেয়ারে রেখে রাগিনীকে নিজের সামনে এনে একবারে বুকের সাথে ঠেকিয়ে ধরল। রাগিনীর এক হাতে রি’ভলবা’র তুলে দিতেই থরথর করে কাঁপুনি শুরু হলো তার। তার ভয় পাওয়া দেখে হতাশ হয় কোহিনূর। এত ভয় পেলে চলে? রাগিনীর কাঁধে থুঁতনি রেখে সে ধীর গলায় বলে,
“ভয় পেতে নেই রাগিনী। ভয় জয় করতে হয়। নির্জন আহমেদ কোহিনূরেট স্ত্রী হতে যাচ্ছো তুমি! এই বিষয়ে ভয় থাকলে চলবে না। তোমার বাবার কথা কিন্তু আংশিক সত্য! আমাকে অনেক কিছু সামলাতে হয়, মোকাবেলা করতে হয়। সেই হিসেবে এতটুকু তোমার রাখতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য সাহস সঞ্চয় করতে হবে রাগের রানি!”
রাগিনী মুখ কাঁচুমাচু করে নিশানার দিকে তাকায়। কোহিনূর ফের বলে,
“জাস্ট একবার! সাহস করো। দেখবে ভয় জয় হয়ে গিয়েছে। ভয়ের সামনাসামনি আসতে হয়! তবেই তা অতিক্রম করা যায়।”
রাগিনী ঢক গিলে বড়ো শ্বাস নিতেই তার হাত ধরে ট্রি’গারের কাছে রাখল কোহিনূর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামান্য শব্দে বু’লেট বেরিয়ে গেঁথে গেল নিশানা থেকে কিছুটা দূরে। মাথা ঘুরতে থাকে রাগিনীর। ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে তার। বেশি শব্দ হয়নি। রি’ভলবা’রে সাইলেন্সার লাগানো। ফলে দ্রুতই ধাতস্থ করতে পারে নিজেকে রাগিনী। কোহিনূর তার গাল টিপে ধরে আশ্বস্ত করে বলে,
“মাই ব্রেভ ইয়ং লেডি!”
বুকটা এখনো ধুকপুক করছে রাগিনীর। নিজের হাতের ঘড়ি দেখে বেশ দ্রুত সরে এসে চেয়ারে রাখা ব্যাগটা কাঁধে তুলে বলে,
“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে ফিরতে হবে।”
“তাড়া কীসের এত? আরেকটু থেকে যাও! শান্তি মিলেনি তো আমার।”
রাগিনী কড়া গলায় বলে,
“মিলতে হবেনা শান্তি। কাজ করুন আপনি। অফিসে এসে ফাঁকিবাজি করলে চাকরি থাকবে?”
রাগিনীর দুটো কাঁধ ধরে কোহিনূর তার সামনে দাঁড় করিয়ে মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“এই শান্তি চিরজীবনের জন্য পেতে হলে যদি চাকরিটা নাও থাকে তবুও আমি রাজি।”
“মি. অফিসার! চাকরিটা না থাকলে বউকে কী খাওয়াবেন?”
রাগিনীও এবার কোহিনূরের কাঁধে দুটো হাত তুলে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে। কোহিনূরও ভণিতা ছাড়াই বলল,
“চায়ের দোকান নিয়ে বসব। যা ইন’কাম হবে তাতে তোমার হবে না? তুমি মাঝে মাঝে আসবে। এসে আমার ক্লান্তি এবং ঘর্মাক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসবে। ব্যস…তাতেই আমার কলিজা ঠাণ্ডা হবে রাগিনী!”
রাগিনী মাথা নুইয়ে লজ্জা নিয়ে হাসে। মানুষটা বোধহয় সত্যি পা’গল। তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
“এখন আমি যাই। নয়ত দেরি হয়ে যাবে।”
বলেই যাওয়ার জন্য দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় রাগিনী। ফের ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
“জানেন তো! আমি যখন কাল স্টেশন থেকে ফিরে যাই আর রাতে বাবা ফিরে আসে তখন তার আচরণ অন্যরকম ছিল।”
“কেমন ছিল?”
“এমন ব্যবহার করছিল যেন সব স্বাভাবিক। যেন বাবা জানত আমি ফিরে আসব। এমনকি আমার সঙ্গে বসে একসাথে ডিনার করতে করতে গল্পও করেছে।”
কোহিনূর শব্দহীন হেসে নরম সুরে শুধায়,
“তাতে তুমি বেশ খুশি তাই না?”
রাগিনী চোখেমুখে চমক নিয়ে দ্রুত মাথা ঝাঁকায়। পরমূহুর্তেই উৎসুক পানে চেয়ে বলে উঠল,
“আপনি কবে বাবার সঙ্গে কথা বলতে যাবেন? আমার হাতে তো সময় নেই। রেজাল্ট দিলে আমায় চট্টগ্রাম ফিরতে হবে।”
কোহিনূর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রাগিনীর ডানহাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে তার হাতের পিঠে আলতো করে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে বলে,
“এই ডার্ক ম্যাক্সের কেইসটা ক্লোজ হলেই সব হবে। একটু সময় দাও প্লিজ!”
রাগিনী বিশ্বস্ত হয়ে মাথা দুলায়। কোহিনূরের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে সে। কোহিনূর তার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো আরেকটা দীর্ঘশ্বাস। সে ভরসা পাচ্ছে না নিজের প্রতি। এই কেইস নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেকারণেই তার সময় চাওয়া।
শেরাটন রেস্টুরেন্ট বিকেল পাঁচটায় এসে বসে আছে নয়নতাঁরা। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। তবুও রায়ানের দেখা পেল না সে। বোধহয় একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে। রায়ানকে সে আসতে বলেছিল ছয়টায়। অতিরিক্ত অধীর হয়ে সে আগেই এসে বসে আছে। বারবার স্টাফ এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে অর্ডার নেওয়ার জন্য। নয়নতাঁরা বারবারই কফি অর্ডার করছে। খানিকক্ষণ পর সে ওয়াশরুমে আসে। আয়নায় দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কিনা! আজ সে বেশ যত্ন করেই সেজেছে। প্রায় একঘণ্টা ধরে জামা বাছাই করেছে। শেষমেশ নীল রঙের একটা গাউন পড়েছে। তবুও তার চিন্তা হচ্ছে মানুষটা একটা বারের জন্যও মুগ্ধ হয়ে তাকাবে তো?
ছয়টা পেরিয়ে সাড়ে ছয়টায় ঘড়ির কাঁটা ছুঁইছুঁই। রায়ানের আসার নাম নেই। নয়নতাঁরা ভার মুখে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। একবার করে ফোন দেখছে। ফোনে সময় দেখে বলে,
“লোকটার মনে আছে তো আমি তাকে ইনভাইট করেছিলাম? হয়ত মনেই নেই। এতকিছুর মাঝে আমাকে আর আমার কথা মনে রাখার মতো স্পেশাল মানুষ বোধহয় আমি নই।”
এসব ভেবে ফ্যাকাশে হয় নয়নতাঁরার মুখশ্রী। মনে মনে ভাবছে কল করবে কিনা মানুষটিকে। পরক্ষণেই মত পাল্টে থম মে’রে বসে থাকছে। সময় কাটতে থাকল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে ছুটতে থাকল। মিলল না রায়ানের দেখা। ধীরে ধীরে ভারাক্রান্ত হলো নয়নতাঁরার ছোট্ট মনটি। বিষণ্ণ হতে টিস্যু হাতে নিয়ে দ্রুত মুছে ফেলল ঠোঁটের হালকা গোলাপি লিপস্টিক। ওয়েটারকে বিলের কাগজ দিতে বলল। মানুষটি আর আসবে না! #গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৬ (২য় খণ্ড)
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেও যখন নয়নতাঁরা হাতে বিলের কাগজ পেল না তখন আরো একদফা বি’রক্ত হলো সে। একেই তো মনটা নিরাশায় ছেয়ে গিয়েছে। প্রতীক্ষার মাঝে এসেছে ক্লান্তি। তার মাঝে আরো অপেক্ষা অসহ্য করে তুলছে তাকে। এই রেস্টুরেন্টে এত খামখেয়ালি হয় তার তো জানা ছিল না! নয়ন উঠে দাঁড়ায়। লং গাউনটা ভালো করে হাত দিয়ে গুছিয়ে নিতে থাকে। সামনে এগিয়ে রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে,
“এক্সকিউজ মি! আমার বিলের কাগজ আমি অনেকক্ষণ আগে চেয়েছিলাম। এখনো আমায় দেওয়া হয়নি কেন?”
রিসেপশনে থাকা লোকটি কিছুটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু আপনার বিল তো পে হয়ে গিয়েছে, ম্যাডাম!”
নয়নতাঁরা এবার ভ্রু কুঁচকায়। এ কোন মুসিবত? তখন এক পুরুষালী কণ্ঠে আশ্চর্য হয়ে মাথা উঠিয়ে তাকায় সে।
“ড্রেসের সামান্য অংশ তোমার হিল জুতোর নিচে পড়েছে। সেটা সামলাও। নয়ত পড়ে যাবে।”
দখিনা বাতাস বয় নয়নতাঁরার মনে। চোখের সামনে থাকা সাদা রঙের কোট পরিহিত ব্যক্তিটির অস্তিত্ব আদেও সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখা পরখ করতে মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন ছোটাছুটি করতে শুরু করে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। সামনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রায়ান নয়নের বিস্ময়টা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলে,
“আই এম রিয়েলি সরি। আই এম লেট। হঠাৎ একটা কাজ পড়ল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলো। দেখতে যেতে হয়েছে। তাই এতটা লেট। একারণেই কারোর ইনভাইটেশন আমি গ্রহণ করি না। বুঝলে?”
নয়নতাঁরা হকচকিয়ে বলে,
“আপনি?”
“হুমম আমি। আমাকেই তো বোধহয় ইনভাইট করেছিলে তাই না?”
নয়নতাঁরা মাথা ঝাঁকাল দ্রুত। তৎক্ষনাৎ রায়ান আবারও বলল,
“তাহলে কি আমরা গিয়ে বসতে পারি? কষ্ট করে যখন এসেছি তখন ট্রিট না নিয়ে ফিরছি না।”
নয়ন নিজের উতলা হৃদয়কে সামলে বিচলিত হয়ে বলল,
“হ্যাঁ চলুন!”
নয়নতাঁরা নিজের গাউন সামলে ঘুরে গিয়ে চেয়ারে বসতে চায়। ততক্ষণে স্টাফ টেবিলের সঙ্গে চেয়ার লাগিয়ে দিয়েছে। রায়ান বেশ সাবলীলভাবে চেয়ারটা সরিয়ে নয়নের হাত ধরে হাতে বসতে সাহায্য করে। অতঃপর রায়ান নিজে গিয়ে বসতেই নয়নতাঁরা অকস্মাৎ প্রশ্ন করে,
“আমার কফি খাওয়ার বিল কি আপনি পে করেছেন?”
“হুমম।”
ছোট্ট করে জবাব দিয়েই স্বীকার করে নিলো রায়ান। নয়নতাঁরা এবার অসন্তোষ হয়ে বলল,
“আপনি কেন দিলেন? এটা কেমন হলো? ট্রিট দিতে আমি এসেছি আর আপনি উল্টে আমাকে ট্রিট দিয়ে যাচ্ছেন? পুলিশ মানুষের বেশি টাকা বলে সেটা সবাইকে দেখাতে হবে?”
দর্শনেন্দ্রিয় এবার দীর্ঘ হলো রায়ানের। গলা খাঁকারি দিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“তুমি বিষয়টাকে ট্রিট হিসেবে নিচ্ছো কেন? ধরে নাও এটা আমি লেট আসার কারণে ছোট্ট করে দুঃখিত বলার মাধ্যম। এখন আসল ট্রিট তুমি দেবে। এইযে আমি মেনু কার্ড নিলাম। আর ইচ্ছেমতো অর্ডার করব। সামাল দিতে পারবে তো?”
“নয়নতাঁরা আহমেদ মোটেও ভীতু নয়। পারলে পুরো মেনু কার্ডে যত আইটেম আছে অর্ডার করে ফেলুন। সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
রায়ান স্বভাবসুলভ মৃদু হাসে। তারপর মেনু কার্ডে চোখ বুলাতে থাকে। নয়নতাঁরার দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই শুভ্রতায় ঢাকা রায়ানের মাঝেই। মানুষটার গাম্ভীর্য এবং শান্ত ভাবের মাঝে মিষ্টতা লুকিয়ে আছে কে জানে! যা প্রতিটা ক্ষণে নয়নকে আকৃষ্ট করে!
খাওয়ার আগে নয়নতাঁরার কাছে গোলাপ ধরল রায়ান।
“এগেইন সরি। নয়নতাঁরা ফুলের কাছে এই গোলাপ ফুল সমর্পণ করলাম।”
নয়নতাঁরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর গোলাপটা হাতে নিলো। এভাবে সুন্দর হেসে স্নিগ্ধ গোলাপ দিয়ে সরি বললে তো আইসক্রিমের ন্যায় গলে যেতে ইচ্ছে করবে! ফুলটা নিয়েই সে প্রশ্ন করল,
“অন্য মেয়েকে গোলাপ দিচ্ছেন জানলে আপনার প্রেমিকা বুঝি রাগ করবে না?”
“প্রেমিকা? কীসের প্রেমিকা?”
“প্রেমিকা কীসের হয় জানেন না বুঝি?”
রায়ান কপাল কুঁচকায়। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
“কী করে জানলে আমার প্রেমিকা আছে?”
“চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।”
রায়ান এবার হালকা শব্দ করে হেসে দিলো। যেন নয়ন কোনো মজার কিছু বলে ফেলেছে। তার হাসির কারণ না বুঝে উৎসুক পানে চেয়ে রইল নয়নতাঁরা। হাসতে হাসতেই রায়ান উত্তরে বলল,
“পুলিশের আবার প্রেমিকা? পুলিশদের যেখানে বউ খুঁজতেই কষ্ট হয় সেখানে প্রেমিকা পাওয়া তো বিলাসিতা তাঁরা ম্যাডাম।”
রায়ান সংক্ষিপ্ত আকারে নয়নের নামটা শুধুমাত্র যখন তাঁরা উচ্চারণ করল তখন কৌতূহলী নয়ন হকচকিয়ে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“তাঁরা?”
“হুমম! ছোটোবেলায় যখন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি তখন সবাই তোমায় নয়ন বলেই ডাকত। আমি তো একটু ব্যতিক্রম ডাকব বলে ঠিক করেছিলাম। তাই তাঁরা ডাকতাম। অভ্যেসটা রয়ে গিয়েছে।”
নয়নতাঁরা হতভম্ব। ওর মস্তিষ্কে রায়ানের একটা কথাও বোধগম্য হলো না। রায়ানও কিছু না বুঝেই ফট করেই কথাগুলো বলার পর বুঝতে পারল নয়নের এসব কিছু জানার কথা নয়। নয়ন তখন বেশ ছোটো ছিল। পরিস্থিতি সামলাতে রায়ান খাবারের দিকে চেয়ে বলল,
“ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে খাবার। খেতে শুরু করতে পারি আমরা?”
নয়নতাঁরা তখন দিশেহারা হয়ে মাথা ঝাঁকাল। দুজন খেতে শুরু করল। তবে নয়ন মাঝে মাঝে রায়ানের দিকে চেয়ে তার বলা কথার মানে খুঁজছে খাবারের খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে। এরই মাঝে রায়ানের ফোনে মেসেজ আসায় স্ক্রিন অন হয়। না চাইতেও নয়নের দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। লক স্ক্রিনে এক চেনা পরিচিত মুখ দেখে খাওয়া বন্ধ হয় তার। চোখ বড়ো বড়ো করে বলে ওঠে,
“আরে ওটা তো বিগ ব্রাদারের ছোটোবেলার ছবি! ভাইয়ার পাশে ওটা কে?”
রায়ান পাশে রাখা ফোনটা দ্রুতই হাতে নিয়ে স্ক্রিন অফ করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। স্ক্রিনে তার আর নির্জনের ছোটোবেলার ছবি সেভ করে রাখা ছিল। রায়ানের এমন তাড়াহুড়োর কাজে নয়ন আরো বিস্মিত হলো। কিছু বলতে উদ্যত হলেও রায়ান কথা বলে থামিয়ে দিল তাকে।
“ওটা আমি আর আমার এক ভাইয়ের ছোটোবেলার ছবি। তুমি ভুল দেখেছ। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।”
রায়ান খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। নয়নতাঁরার মন আর বসে না। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা চিন্তা করে। সে নিশ্চয়ই ভুল দেখেনি!
ঘড়ির কাঁটা প্রায় রাত বারোটা ছুঁইছুঁই। রাগিনী রিও এর পাশে বালিশে ঠেস দিয়ে ঘুমে ঢুলছিল। ফোনের রিংটোনে চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল সে। পাশে থাকা ফোনটা নিয়ে নম্বর না দেখেই রিসিভ করে বসল। ফোনের ওপাশে থাকা পুরুষালী কণ্ঠ রাগিনীর চোখের ঘুমটা তাড়ি’য়ে বয়ে আনলো প্রেমের দোলা।
“ম্যাডাম, জেগে আছেন!”
“হুঁ! আপনার কলের অপেক্ষা করছিলাম।”
ওপাশে থাকা কোহিনূর সন্দিহান হয়ে বলে,
“কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে বসে বসে ঘুমোচ্ছিলেন।”
রাগিনী চোখ ঢলে নাক টেনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠল,
“চোখটা লেগে এসেছিল। বাড়ি ফিরিছেন?”
কোহিনূর কিছুটা নীরব থেকে নিচু আওয়াজে বলল,
“বাড়িতে তো এসেছি। তবে শ্বশুরবাড়িতে।”
এবার ঘুমটা যেন সারারাতের জন্য উড়ে যায় রাগিনীর। বুকের বাম পাশে এক রেখে তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে বলে,
“কী? কোথায় আপনি?”
কোহিনূর হাসতে গিয়েও থেমে যায়। এই মূহুর্তে উচ্চস্বরে হাসা মানে চোরের মতো ধরা পড়া। সেটা সে চাইছে না। ফিসফিস করে বলে,
“তোমার প্রিয় কাঠগোলাপের গাছের নিচে।”
রাগিনী জানালার কাছে যায়। ফোনটা কানের কাছে রেখেই আশেপাশে তাকায়। সেখানে কোনো আলো নেই। রাস্তার ধারে থাকা সোডিয়ামের লাইনের ঝাপসা আলোতে দেখা গেল সামান্য একটা অবয়ব। অবিশ্বাস্য হয়ে বলল,
“পা’গল হয়েছেন নাকি? কেউ দেখে ফেললে কী হবে জানেন?”
“আর যাই হক সিনেমার মতো বিয়ে টিয়ে আর দিয়ে দেবে না। দিলে ভালোই হতো। বিনা পরিশ্রমে ফল পেয়ে যেতাম।”
“যান তো বাড়িতে। এখন সৈয়দ কাকা টের পেলে আবারও চোর চোর বলে খোঁজ শুরু করবে।”
কোহিনূর রাগিনীর কথাটিকে পাত্তা দিল না খুব একটা। বরং আবদার ধরে বলল,
“একবার নিচে আসবে প্লিজ!”
“উঁহু! এই সময় একদমই না।”
রাগিনী অকপটে বারণ করাতেও কোনো হেলদোল হলো না কোহিনূরের। সে আরো আদুরে গলায় বলল,
“একবার নিচে আসবে প্লিজ ফিউচার সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম?”
রাগিনী শক্ত থাকার চেষ্টা করে বলল,
“না!”
“বউরানি! একবার নিচে আসবে প্লিজ?”
রাগিনীর এবার মনে হয় সে নিজেই পা’গল হয়ে যাবে! এভাবে বললে কীভাবে বারণ করবে সে? দিশেহারা হয়েই জবাব দেয়,
“ধুর, আসছি!”
রাগিনী কল কাটল। শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকা রিও কে একটু দেখেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো চুপি চুপি। আশেপাশে উঁকি দিয়ে করিডোর ফাঁকা পাওয়ায় হাঁটতে লাগল সে। এক পর্যায়ে হুট করেই সিঁড়ির কাছে কাউকে দেখেই যেন ধরা পড়ে গেল। নিমিষেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠতেই অভিরূপের বিষাদময় চেহারাটা দৃশ্যমান হলো তার। ঢক গিলে রাগিনী জিজ্ঞেস করল,
“আপনি? এত রাতে? ঘুমান নি?”
অভিরূপ অন্যদিকে ফিরে জবাবে বলে,
“না। ঘুম আসছিল না।”
“ওহ! ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য দরকার। বিশেষ করে আপনার আরো বেশি দরকার।”
“কেন? ঘুম বুঝি মন এবং মস্তিস্ক থেকে সেই চাহনি এবং সেই কণ্ঠ মুছে ফেলতে পারবে যেটা আমায় আকৃষ্ট করেছে?”
অভিরূপের বলা কথায় রাগিনী প্রস্তুত ছিল না। রাগিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়াতে অভিরূপ তাকে পরখ করে কথা পাল্টে বলল,
“তুমি এত রাতে কী করছ? হাতে ফোনও দেখছি। তার সাথে কথা বলছিলে?”
রাগিনী বিব্রত হয়ে পড়ে। মাথা নুইয়ে ফেলে। কী বলবে সে? আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে,
“না মানে…”
“ছাঁদে গিয়েছিলাম। তখন নিচে একজনকে দেখলাম।”
একেই যেন বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। রাগিনী এবার অসহায় চোখে তাকায়। অনুরোধ করে বলে,
“কাউকে বলবেন না প্লিজ!”
অভিরূপ রাগিনীর ভীতু দৃষ্টি খানিকটা উপভোগ করে হেসে দেয়।
“তুমি কিন্তু বেশ সাহসী! কোনো কোনো মেয়ের সঙ্গে অন্য পুরুষের বিয়ে হয়ে যায় তবুও সে তার প্রেমিকের কথা বলতে পারেনা। বাট ইউ আর ডিফরেন্ট। এঙ্গেজমেন্টের দিনেই সাহস করে সরাসরি আমায় ভয়েসে বলে দিলে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। তাহলে দেখা করতে কীসের ভয়?”
রাগিনী যেন আশ্বস্ত হয়। অভিরূপের কথায় একটু ভরসা পায় সে। মিনমিন করে বলে,
“আসলে বাবা এখনো মেনে নেয়নি।”
“মেনে নিতে কতক্ষণ? একদিন না একদিন ঠিক মেনে নেবে। দরকার হলে আমি দায়িত্ব নিয়ে মানাব উনাকে। তোমাদের বিয়ে দেখে তারপরেই আমি যাব।”
বিয়ের কথা শুনে মৃদু হাসে রাগিনী। হাসিতে লুকিয়ে লজ্জার আস্তরণ। অভিরূপ আবারও বলে,
“অনেকক্ষণ ধরে তোমার সে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু। যাও দেখা করে এসো। আমি এদিকটা সামলে নিতে পারব।”
রাগিনী কথা বাড়ায় না। নেমে আসে সিঁড়ি দিয়ে। আস্তে করে পেছনের দরজা খুলে পা টিপে টিপে বেরিয়ে যায়। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির কাছে এগিয়ে যেতেই রাগিনীর মাথায় খেলে যায় এক দু’ষ্টুমি বুদ্ধি। নিঃশব্দে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে চিমটি দিতে উদ্যত হতেই কোহিনূর সামনে ফিরে তাকিয়ে বেশ সহজেই রাগিনীর হাত চেপে ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিজের কাবু করে ফেলে। তাকে একেবারে অপ’রাধীর ন্যায় চেপে ধরে নিজের বুকের সঙ্গের লেপ্টে ধরেছে কোহিনূর। ফিসফিস করে সে বলল,
“মতলব ভালোই করেছিলে! কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি একজন ট্রেনিং প্রাপ্ত অফিসার। কারোর পায়ের শব্দ আমি সহজেই আন্দাজ করতে পারি।”
“দ্যাটস নট ফেয়ার অফিসার। আপনি এই এডভান্টেজ সবখানে নিতে পারেন না।”
কোহিনূর তার দাড়ি ভরা গাল রাগিনীর গালে ঠেকিয়ে বলল,
“আমি সব পারি। তুমি পারবে তো?”
রাগিনী বেশ ব্যগ্রতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী?”
“এই অফিসারকে সামাল দিতে? আমার কিন্তু থার্ড ডিগ্রী দিতে পছন্দ করি। তখন রোমান্সের থার্ড ডিগ্রী কিন্তু চলতেই থাকবে।”
রাগিনী এবার চোখ খিঁচে কোহিনূরকে ঠেলে দূরে সরানোর চেষ্টা করে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“বেশরম কোথাকার!”
কোহিনূর রাগিনীর এমন প্রতিক্রিয়া বেশ উপভোগ করে। রাগিনী ছিটকেই দূরে সরে আসে। কৌতূহলের সাথে বলে,
“আপনি এখানে এলেন কী করে? দারোয়ান চাচা কিছু বলেনি?”
“তোমার দারোয়ান চাচা কিছু জানলে তো! মেহরাজের দৌলতে কীভাবে চোরের মতো অন্যের বাড়িয়ে পাঁচিল টপকে ঢুকতে হয় সেটাও শিখে গিয়েছি।”
রাগিনীর এবার হাসি পায়। কোনোরকমে হাসি আঁটকে সামনে থাকা মনের মানুষটিকে ভালো করে দেখে নেয়। আবছা আলোতে তার ক্লান্তিতে ভরাট এক চেহারা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। চুলটা ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করেছে লোকটা। গায়ে পরে রাখা এখনো অফিসের পোশাক। নিশ্চয় কাজ শেষ করেই এখানে ছুটে এসেছে? এবার কণ্ঠ ভার হয় রাগিনীর।
“এত রাতে এভাবে কে আসতে বলেছে আপনাকে?”
কোহিনূর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর রাগিনীর হাতটা নিজের হাতের উপর নিয়ে উত্তরে বলে,
“আসলে কাল আমি কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। আসতে দুইদিন সময় লাগবে। তাই আমাদের দুইদিন দেখা হচ্ছে না।”
রাগিনীর মনটাও একটু খা’রাপ হয়। তবে সেটা কোহিনূরকে বুঝতে না দিয়ে বলে,
“ওই ডার্ক ম্যাক্সের কেইসটা নিয়ে?”
“হুমম। ইনফরমেশন পেয়েছি পাঁচ বছর আগে মা*রা যাওয়া ডার্ক ম্যাক্সের আসল বাড়ি ওখানেই ছিল। ওখান থেকে ওর স্ত্রী নাকি মাঝেমধ্যেই যাওয়াআসা করত। সেখানে ওর বাড়ি গিয়ে ইনভেস্টিগেট করতে হবে। কারণ এই কেইসটাও ডার্ক ম্যাক্সকে জড়িয়েই। পাঁচ বছর আগে যদি ডার্ক ম্যাক্স মা’রা যায় তবে ডার্কের পরিচয় কে ঘুরছে? কেনই বা ঘুরছে? সেটা জানা প্রয়োজন। তবেই হয়ত মেইন ক্রি’মিনা’ল অবধি পৌঁছাব।”
রাগিনী একগাল হেসে কোহিনূরের দুটো গালে আলতো স্পর্শ করে। নম্র সুরে বলে,
“অল দ্যা বেস্ট মাই অফিসার। আমিও চাই এই কেইস তাড়াতাড়ি শেষ হক।”
কোহিনূর মাথা দুলায়। রাগিনীর মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছের সৃষ্টি হয়। আকাঙ্ক্ষা দমাতে না পেরে সে নিজের পায়ের জুতো খুলে কোহিনূরের পায়ের জুতোর উপর উঠে দাঁড়ায়। কোহিনূর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গাল ধরে মুখটা নিচু করিয়ে তার কপালে আলতো ঠোঁট চেপে সামান্য শব্দ করে বলে,
“আপনার অপেক্ষায় থাকব।”
এই প্রথম রাগিনী স্বইচ্ছায় কাছে এলো। তার কোমল ঠোঁটের ছোঁয়া নিজ থেকে প্রদান করল। বুকটা ধুকপুক করছে কোহিনূরের। শ্বাসপ্রশ্বাস তীব্র হচ্ছে। সে রাগিনীর মাথায় হাত রেখে শুধু মৃদু হাসল।
পরদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। কুড়িগ্রামের মধ্যে কোহিনূর আর তার টিম তখন আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বাড়িটা চিনতে সক্ষম হলো। বাড়িটা বেশ ছোটোখাটো হলেও বাড়ির সামনে খোলা জায়গা আছে। অনেকদিন বাড়িতে কেউ প্রবেশ না করায় ভূতুড়ে ভূতুড়ে ভাবটা চলে এসেছে। অনেকে বলাবলি করছে, এখানে নাকি সন্ধ্যের পরপরই বেনামি ছায়া দেখা যায়। কখনো কখনো দেখা যায় ভয়ানক সব আ’ত্মার। কখনো শোনা যায় কান্না। তবে পুলিশ এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এসব বিশ্বাস করতে নেই। তাদের কাজ তাদেরকে করতেই হবে। কোহিনূর সবাইকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। যদি মিলে যায় কোনো সামান্য পরোক্ষ ইঙ্গিত। তাও হয়ে উঠতে পারে অমূল্য রতন!
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]