গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে ২ পর্ব ৭+৮

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৭ (২য় খণ্ড)

চারিদিকে ধুলো-ময়লা আর মাকড়সার জালের আধিক্য লক্ষ্য করা গেল বাড়ির সদর দরজা খুলে প্রবেশ করতেই। কাঠের দরজাটাও ঘুন ধরে গিয়েছে। মড়মড়ে আওয়াজ করছে। কখন যেন ভেঙ্গে পড়ে! এমন ধুলোমাখা জায়গাতে সকলের হাঁচি কাশি বাড়ল। সকলে যে যার মাস্ক মুখে পড়ল। পেছনে থাকা মেহরাজ পকেটে থাকা মাস্ক খুঁজে পেল না। হাতড়ে বুঝতে পারল সে মাস্ক আনতে ভুলে গিয়েছে। বেরিয়ে এলো হাতে পড়ার দুটো গ্লাভস। তা দেখেই সরু চোখে তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে তা ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে। কোহিনূর দেখলে খবর আছে তার। কিন্তু ততক্ষণে যার দেখার এবং বুঝেই নিয়েছে যা বোঝার। তার কড়া দৃষ্টি দেখে ততক্ষণে থতমত খেয়েছে মেহরাজ। টর্চের আলোতে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে রাগের ছাপ। তবে কোহিনূর কিছু না বলেই কাশতে কাশতে নিজের মাস্ক বের করে এগিয়ে দিল মেহরাজের দিকে।
“টেক ইট।”

মেহরাজ হাত বাড়িয়ে নিতে চাইল না। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
“বাট স্যার…”

“আমি এটা এখনো ইউজ করিনি। তুমি ইউজ করতে পারো।”

“আপনি কী ইউজ করবেন স্যার?”

বলেই একটা হাঁচি দিল মেহরাজ। কাশিও উঠল বেশ। কোহিনূর তার হাতে মাস্ক ধরিয়ে তীব্র সুরে বলল,
“আমার ধুলোতে তেমন সমস্যা হয় না। তোমার তো এলার্জি আছে।”

এতটুকু বলেই মেহরাজকে কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল কোহিনূর। মেহরাজ কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মুচকি হাসল কোহিনূরের যাওয়ার পানে চেয়ে। কাশতে কাশতে মাস্ক পড়ে নিলো মুখে।

নাকে হাত দিয়ে আশেপাশে টর্চের লাইট দিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে তথ্য। যদি কিছু পাওয়া যায়? কোহিনূর প্রথমেই দেয়ালে থাকা সকল ছবি ঘেঁটে নিলো। ফ্যামিলি ফটো পেলেও সুবিধা। তবে সে হতবাক হলো! তেমন কোনো ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নেই। তা কি সরানো হয়েছিল আগেই? নাকি অন্যকিছু? এই ড্রয়ার, টেবিল সব ঘেঁটে দেখা হলো। খুব একটা বেশি কিছু পাওয়া গেল না। তাদের দলের একজন বেশ তাড়াহুড়ো করে এসেই ডায়েরী এগিয়ে দিলো একটা। বলল,
“স্যার ডায়েরীটা খাটের নিচ থেকে পেয়েছি। বাট তেমন কিছু লেখা নেই এতে। কিছু অদ্ভুত সংকেত দেওয়া আছে মনে হচ্ছে। আর নিচে লেখা আছে…”

কোহিনূর ইশারায় তাকে থামাল। নিজেই ডায়েরী খুলে দেখল মনোযোগ দিয়ে। আসলেই কিছু সংকেত রকমেরই দেওয়া আছে আর নিচে লেখা,
‘আজকের দিনটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রূপার ওপর আমার কেমিক্যাল দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। এর কার্যক্ষমতা দেখা যাবে পাঁচ বছর পর।’

কোহিনূরের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। রূপা কে? সেটা তার বোধগম্য হলো না! ফলে বিষয়টা আরো বিগড়ে গেল। তবে শান্ত রূপে থেকে বড়ো শ্বাস নিয়ে ডায়েরীর পাতা উল্টিয়ে দেখতে পেল আরো কিছু সংকেত। আর নিচে আগের মতোই লেখা,
‘আমার এক্সপেরিমেন্ট অনেকটা সাকসেসফুল। তবে আমি এর সম্পূর্ণ প্রসেসিং ভুলে গিয়েছি। ব্যাপার নয়! এখন থেকে রূপা নিজের জ্ঞান এবং বুদ্ধিতে নয় আমাদের জ্ঞানে চলবে। তার নিউরনের কার্যক্ষমতা অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে। এভাবে আমরা তাকে কাজে লাগাতে পারি।’

কোহিনূর হতবিহ্বল হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রূপা নামক মানবীকে তাহলে ডার্ক ম্যাক্স এক্সপেরিমেন্ট করতে ব্যবহৃত করেছে। কিন্তু কে এই নারী? আদেও কি তার অস্তিত্ব আছে? সব ভাবনাকে বাগড়া দিয়ে সংকেতের মানে ভেবে নেয় কোহিনূর। প্রথম পাতায় বেশ সুন্দর করে ‘Ca0H’ লেখা আছে। কোহিনূর বিড়বিড়িয়ে বলে,
“যদি আমি এটাকে কোনো কেমিস্ট্রি দিয়ে সংকেত ভাবি তাহলে Ca তে ক্যালসিয়াম, O তে অক্সিজেন আর H তে হাইড্রোজেন হচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো মিলছে না। যদি আমি বিষয়টাকে অন্যভাবে ধরি। O কে অক্সিজেন না ভেবে জিরো ধরি তাহলে নম্বরিং করে ২০০১ হচ্ছে। অন্যদিকে অপরপাশের লেখায় ‘Ca0C’ একইভাবে ভেবে হচ্ছে ২০০৬। এই লোকের ডায়েরীর কথা অনুযায়ী সেটাই মিলছে।”

“বাট স্যার এতে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রূপা কে? আর এসব কথা দ্বারা কি বোঝাচ্ছে?”

তখন মেহরাজও এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে সে সব কথায় শুনেছে। সে বলল,
“আই থিংক এই রূপা মেয়েটাকে দিয়ে সে এক্সপেরিমেন্ট করেছে। সে যদি বেঁচেও থাকে তবে ক্রি’মি’নাল টিমের মধ্যে সেও আছে।”

“সেটা তো ঠিক। আরো কিছু পাও নাকি দেখো!”

সকলে আবার ব্যস্ত হয়। অনেক খুঁজে ড্রয়ারে থাকা একটা সাদা রুমাল খুঁজে পেল কোহিনূর। প্রথমে সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সেটা ফে’লে দিতে গেলেও পরবর্তীতে রুমাল থেকে এসে নাকে ঠেকল বেশ অন্যরকম গন্ধ। নাক সিটকে ফেলে কোহিনূর। নিজেকে ধাতস্থ করে নাকটা কাছে নিয়ে এসে অদ্ভুত গন্ধ পেল সে। ভালো করে ঘ্রাণ নিতেই মনে হলো এটা কোনো কেমিক্যালের গন্ধ। এটাকে সে ফেলল না। একটা ব্যাগে ভরে নিলো। সেখানে আর তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। রাত বেড়ে যাওয়ায় বেরিয়ে এলো তারা। বাড়ির আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও আহামরি কোনো তত্ত্ব পাওয়া গেল না। কারণ এতগুলো বছরে সব কিছুর বদল হয়েছে। এই গ্রামে খুব একটা মানুষজন থাকে না। সকলে বদলি হয়েছে। যারা পুরোনো তাদের জিজ্ঞেস করে পাওয়া গেল এখানে একজন মহিলা ছাড়া কেউই থাকত না। অথচ বাড়ি ঘেঁটে অন্যরকম তথ্য পাওয়া গিয়েছে। নিজের টিম নিয়ে হেঁটেই যাচ্ছিল কোহিনূরের। সামনে গাড়ি আছে। হাঁটার মাঝে কোহিনূরের দূরদৃষ্টি খেয়াল করে এক চেনা লোককে। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। এখানে ছোটো বাজার থাকার কারণে কিছু জায়গায় লাইট লাগানো। সেই লাইটের আলোতে দেখা মেলে রাশেদ সাহেবের। কোহিনূরের দেখা পাওয়া যাবে এখানে সেটাতেও রাশেদ সাহেব যেন প্রস্তুত ছিলেন না। ভূত দেখার মতো চমকালেন উনি। কোহিনূর উনার সামনে পড়ে যাওয়ায় যেন এড়িয়ে যাওয়ার পথও পেলেন না। কোহিনূর তার টিমকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে ইশারায়। সকলে চলে যায়। থেকে যায় শুধু সে। সে নিজেও রাশেদ সাহেবকে দেখে বেশ বিস্মিত এবং অভিভূত।
“স্যার আপনি? তাও এখানে?”

রাশেদ সাহেব বেশ বিব্রতবোধ করলেন। যেন প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত তিনি। কাঁপা সুরে বললেন,
“আমার এক সহযোগী পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলাম। তার মা নাকি অসুস্থ তাই। কিন্তু অফিসার আপনি এখানে?”

“কেইসের কিছু ইনভেস্টিগেশন করার ছিল। সেই সূত্রেই আসা। এখানে আপনার দেখা পেয়ে যাব ভাবিনি।”

“কেইসের কারণে এখানে?”

কেহিনূর নির্লিপ্ত ভাব নিয়েই জবাব দেয়,
“জি। আমরা কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। এখানে থাকা এক বাড়িতে ভালোমতোই সার্চ করলাম।”

রাশেদ সাহেব বেশ অস্থির হয়ে শুধালেন,
“কোন বাড়িতে?”

“আরো ভেতরে গিয়ে পুরোনো বাড়ি। গেটের কাছে বোধহয় লেখা ছিল ‘দেওয়ান বাড়ি’।”

রাশেদ সাহেব যেন এবার আঁতকে উঠলেন। নিজের উদ্দীপনা সামাল দিতে না পেরে ফট করে বললেন,
“দেওয়ান বাড়ি?”

কোহিনূর ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাল। সে ইচ্ছে করেই বাড়ির নামটা বলেছে শুধুমাত্র রাশেদ সাহেবের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এবং লোকটির প্রতিক্রিয়া বেশ সন্দেহজনক! কোহিনূর শান্ত সুরে বলল,
“আপনি জানেন ওখানে কে থাকত?”

পরক্ষণেই বড়ো শ্বাস নিয়ে তিনি বললেন,
“না। আমি কী করে জানব? আমি এখানকার বাসিন্দা নাকি? অফিসার নির্জন দেখি কাউকেই সন্দেহের কাতারের বাহিরে রাখে না।”

কোহিনূরও এবার না চাইতেও তাল মিলিয়ে হাসে।
“কী করব বলুন স্যার? আমাদের কাজই তো এটা। নিজেদেরও সন্দেহের বাহিরে রাখতে পারিনা।”

রাশেদ সাহেব ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন। কোহিনূর কাঁধে আলতো করে হাত দিয়ে বললেন,
“আশা করছি খুব দ্রুত কেইস সলভ করতে পারবে তুমি।”

কোহিনূর আর কিছু বলে না। বিদায় নিয়ে চলে আসে। মনে থেকে যায় ক্ষীণ সন্দেহ এবং সংশয়। প্রশ্ন থেকে গেল অনেকটা।

দুটো দিন পেরিয়েছে। ঘটেছে নতুন দিনের আগমন। সেই আগমনে কারোর প্রতীক্ষা বেড়েছে আর কারোর জটিলতা। এত এত মানুষ সকলেই যেন নতুন কিছুর অপেক্ষায়।

নিজের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ ঘাঁটছিল কোহিনূর। চোখ বুলিয়ে নিতে নিতেই সে সামনে থাকা মেহরাজকে ফট করে বলল,
“আজকে কয় তারিখ, মেহরাজ?”

“এগারো তারিখ স্যার।”

খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে নেয় সে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সত্যি? তাহলে তো আর বেশি সময় নেই।”

“কীসের স্যার?”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মেহরাজ। কোহিনূর না চাইতেও মুখ ফসকে বলে,
“আরে, রায়ানের জন্মদিন! হাতে একদম সময় নেই। কী যে করি!”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই কোহিনূরের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। যেন এই কথা বলা এবং এতটা আগ্রহ দেখানো তার উচিত ছিল না। সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসল সে। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল,
“আই মিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব মেম্বারদের বার্থডেতে তো সবাই মিলে উইশ করা হয়। নতুন যারা জয়েন করেছে তাদের বিষয়টা জানিয়ে রাখা ভালো। তুমি জানিয়ে দিও। নয়তবা, তার এসিস্ট্যান্ট শেখর আছে তো! আমার হাতে এসবের জন্য এত সময় নেই।”

বলেই ব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গি ধরে কোহিনূর। মেহরাজের হাসি পায় ভীষণ। আসলে তার সামনে থাকা এই শ্রদ্ধেয় মানুষটির চালচলন বোঝা বড়ো দায়! লোকটি বুঝতে দিতে চায় না কখনো সে বাকিদের নিয়ে কতটা ভাবে। রায়ানের জন্মদিন নিয়ে যে কোহিনূর কতটা প্রকোপিত সেটা মেহরাজের জানা। কিন্তু মানুষটি যে স্বীকার করার নয়!

“আসতে পারি?”

মেয়েলি রিনরিনে কণ্ঠ শুনে তীব্র অভিঘাত লাগল কোহিনূরের হৃদয়ে। এই অভিঘাত য’ন্ত্রণা বা ব্যথার ছিল না। এটি ছিল তৃপ্তিদায়ক। এই রসহীন খবরের কাগজে আর মন টিকে থাকে? চোখের পিপাসু দৃষ্টি সকলের আগেই ছুটে যায় নিজের পিপাসা নিবারণ করতে সেই অভিঘাতী নারীর দিকে। নারীটি যত এগোচ্ছে কম্পন বাড়ছে সর্বাঙ্গে। তার পরিপাটি হাসি মনের তুষ্টি আরো বাড়িয়ে দিলো! মেয়েটি এতটা প্রলুব্ধা কেন? মনটাকে কোহিনূর আজকাল মাঝে মাঝে শাসায়। কেন তার মনে আসে এত লজ্জাহীন চিন্তা?

সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে মেহরাজ। রাগিনী ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে পড়তেই কোহিনূর ইশারায় কাছে ডাকে তাকে। রাগিনী টেবিলের এপাশে আসতেই তার হাত ধরে তাকে কোলের ওপর বসায় কোহিনূর। রাগিনী তার গলা পেঁচিয়ে নরম সুরে বলে,
“কখন এসেছেন?”

“কাল যে বললাম আজ সকালে ফিরব। ভোরবেলায় পৌঁছে গিয়েছি।”

“তাহলে তো ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। তবুও এখন অফিসে বসে আছেন?”

কোহিনূর রাগিনীর গালটা আলতো টেনে ধরে বলে,
“না আসলে তোমার এই সুন্দর আগমনটা চোখ ভরে দেখতে পেতাম কী বলো?”

“দেখায় তো সময় তো চলে যায়নি।”

“তোমায় মন ভরে দেখার একটা সুযোগও আমি ছাড়তে চাই না মাই সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম!”

কোহিনূর আপনমনে কথাটি বলে রাগিনীর ঘন চুলের ঘ্রাণ নিতে মত্ত হয় সে।
“ওখানে গিয়ে কোনো ইনফরমেশন বা কিছু পেলেন?”

“কিছু কিছু জিনিস পেয়েছি বাট সেটাও ফরেনসিক ল্যাবে আছে এখনো অবধি। এতটুকু ভালোই বুঝেছি এই কেইসের যেই মূল নাম ডার্ক ম্যাক্স! তার কেমিস্ট্রি এবং রিসার্চের প্রতি অনেক ঝোঁক। আর অন্যদিকে এই লোকটার জীবনকাহিনী পাঁচ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের ডা*কাতি আর সেদিনের বলা ওই কবিরের ডার্ক ম্যাক্স নামটা উচ্চারণ করার পর যেন ওই কেইসটা আবারও শুরু হয়েছে। ব্যাংকের ডা’কা’তিতেও যেভাবে সেখানে থাকা লোকজনকে জ্ঞান হারা করেছিল সেটাতে বোঝা যায় এটাও কোনো কেমিক্যালের টেকনিক।”

“তাহলে বলতে চাইছেন ডার্ক ম্যাক্স বেঁচে আছে?”

বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল রাগিনী। কোহিনূর মাথা নাড়াল।
“না বেঁচে থাকার সম্ভবনা নেই। উনার পোস্টমর্টেমও করা হয়েছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে তবে সেটা তার কাছের কেউ। হতে পারে তার ছেলে অথবা মেয়ে আবার তার ভাইও হতে পারে!”

রাগিনীও বেশ বিভ্রান্ত হলো এবার। আসলেই বিষয়টা বেশ জটিল। কোহিনূর কথা বলতে বলতে ফট করে প্রশ্ন করে বসল,
“আচ্ছা, তোমার বাবা কি গতকাল বা তার আগের দিন কোথাও গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ গিয়েছিল তো। কোন যেন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। হঠাৎ এই প্রশ্ন? আপনি জানলেন কী করে?”

সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করে রাগিনী। কোহিনূর দ্রুত কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
“ইটস ম্যাজিক মাই ইয়ং লেডি! শুধু হবু বউয়ের প্রতি নয় আমার শ্বশুরমশাইয়ের প্রতিও টেলিপ্যাথি কাজ করে।”

রাগিনী বেশ বুঝল কোহিনূর কথাটা ঘোরাতে চাইছে। তৎক্ষনাৎ সে কথা ধরে বলল,
“মোটেও আমার কাছে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না মি. অফিসার। বলুন কী করে জানলেন?”

“সেদিন রাতে রাস্তায় দেখলাম তো!”

এবার রাগিনী ক্ষ্যান্ত হলো। কোহিনূরও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এ যেন মেয়ে নয় পুরো গোয়েন্দার হেড। সাইকোলজি নিয়ে পড়া স্টুডেন্টদের কাছে একারণেই পদে পদে ধরা খেতে হয়। কে জানে ভবিষ্যতে আর কতবার ধরা খেতে হবে!

সকাল সকাল অভিরূপকে একপ্রকার টে’নেহিঁ’চড়ে সঙ্গে করে জগিং-এ নিয়ে এসেছে নোমান। আগে অভিরূপের দৈনিক রুটিনের মাঝে ছিল সকালে উঠে জগিং করা। ভেবেছিল বাহিরে বের হলে ছেলেটা একটু স্বাভাবিক হবে। তার ভেতরের চাঞ্চল্য রূপটা বাহিরে আসবে। সে আবারও হাসবে। কিন্তু তা হলো না। বিপরীতটা ঘটল বরং। মাস্ক পড়ে থাকা সত্ত্বেও অভিরূপ প্রেমীরা চিনতে দেরি করল না তাকে। মূহুর্তে ভিড় জমে গেল। সেসব কোনোরকমে সামাল দিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে অভিরূপকে নোমান বলল,
“দুনিয়ায় যেখানে যাবি সেখানে জ্বা’লা! তোকে নিয়ে গিয়েও শান্তি নেই।”

অভিরূপ হাঁটতে হাঁটতেই বলল,
“এই থিংক তোর আরেকটা অশান্তি হাজির হতে চলেছে।”

হাঁটা থামাল দুজনেই। নোমান কিছু বুঝল না। হাত নাড়িয়ে বলে উঠল,
“কী বলছিস?”

“সামনের ফুটপাতে তাকিয়ে দেখ।”

নোমান অভিরূপের কথা অনুযায়ী সামনেই তাকায়। যানবাহনের মাঝে দেখা গেল চশমা পড়া নোমানের সেই কাঙ্ক্ষিত শুকনো মরিচকে। সেই মূহুর্তেই সে অভিরূপকে খুঁচিয়ে বলল,
“ওহ হো! চল না একটু ওর সাথে লেগে আসি!”

“আমি যাব কেন? তুই যা। লেগে আয়। দেখিস রাস্তার মধ্যে মা’রামা’রি শুরু করে দিস না। আমি একটু দোকান থেকে পানি কিনতে যাচ্ছি।”

বলেই দোকানের দিকে হাঁটা দেয় অভিরূপ। নোমানও পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে থাকা মানুষের সমাগম ঠেলে এসে দাঁড়ায় উর্মিলার পাশে। তখনও মেয়েটা সেদিকে খেয়াল করেনি। সে ব্যস্ত খালি কোনো রিকশা বা অটোর খোঁজ করতে।
“ওদিকে কাকে দেখছ?”

আচমকা এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে তাকায় উর্মিলা। নিজের চশমা ঠিক করে দেখতেই সেই গা জ্ব’লানো হাসিটা দেখে মুখ ফুলিয়ে উর্মিলা বলে,
“যাকেই দেখি আপনার কী সমস্যা?”

“আমি ভাবলাম তুমি দেখতে পাচ্ছো কিনা তাকে তাই আমি আরেকটু দেখতে সাহায্য করি।”

উর্মিলা তেলেবেগুনে জ্বলে বলে উঠল,
“এসেছে সাহায্য করতে! লাগবে কোনো সাহায্য!”

“আরে যাচ্ছো টা কোথায়?”

“ভার্সিটিতে।”

নোমান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“তো খালি গাড়ির খোঁজ করছ?”

উর্মিলা জবাবে কিছু বলল না। আসলে সকাল থেকে তার মেজাজ ঠিক নেই। মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সে। তর্কের মূল বিষয়বস্তু ছিল বিয়ে! এখন নাকি তার বিয়ে নিয়ে ভাবা উচিত। তবে উর্মিলা এই বিষয়ে বেশ উদাসীন। সেসব নিয়েই বিরক্ত সে। তাকে এবং নোমানকে একটা ফাঁকা অটো ক্রস করে যেতেই নোমান বলল,
“ওইতে একটা ফাঁকা অটো গেল মিস.। দেখতে পাওনি? চোখে আরেকটা চশমা লাগাও। শুধুমাত্র এটা দিয়ে হবেনা বোধহয়!”

ব্যস…উর্মিলার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল এবার। দ্রুত চোখ থেকে চশমা খুলে নোমানের হাতে ধরিয়ে ফুঁসে উঠে বলল,
“একটাও চশমা লাগবে না আমার। আপনার চশমা আপনি রাখুন। আমি চশমা ছাড়াই ওইপাশে পার হবো এখন।”

বলেই বিলম্ব না করে উর্মিলা ঝাপসা দৃষ্টিতে এপাশ ওপাশ থেকে চলতে লাগল। এরই মাঝে কল এলো তার। সব মিলিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। রাস্তায় বড়ো বড়ো যানবাহনের হর্ণের আওয়াজ কানে আসতেই আঁতকে উঠল। কিছু না ভেবেই সরে পিছিয়ে যেতে লাগল। কর্ণকুহরে নোমানের ডাকটা ভেসে এলো। পুরোটা শোনা আর হলো না তার। ঘটে গেল আকস্মিক ঘটনা।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮ (২য় খণ্ড)

হসপিটালের এক কেবিনের বেডে শুয়ে রয়েছে উর্মিলা। পরনে ঢিলেঢালা নীল রঙের শার্ট আর প্যান্ট। গায়ের অল্প অংশ সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। মাঝে মাঝে রাগে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে সামনে ভীরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নোমানের দিকে চাইছে। আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে ঝটকা দিয়ে। সোফায় অভিরূপ ভাবলেশহীন হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থেকে ভাবছে কোথা থেকে কী হয়ে গেল! নার্স ধীর পায়ে এগিয়ে গেল উর্মিলার ডান পায়ের কাছে। আঁতকে উঠে তাকাল উর্মিলা। ব্যান্ডেজ করে ঝুলিয়ে রাখা পায়ে নার্স হাত ছোঁয়াতেই ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“হাত লাগাবেন না প্লিজ!”

“ওকে ম্যাডাম। টেক কেয়ার।”

বলেই বেরিয়ে যায় নার্স। পা নাড়ানোর সাধ্য নেই উর্মিলার। রাস্তায় যানবাহন থেকে বাঁচতে পিছিয়ে গিয়ে সোজা ম্যানহোলে পড়েছিল সে। সেই সঙ্গে ডান পায়ের হাড় বেশ ভালোভাবেই নড়ে গিয়েছে। স্থানচ্যুত হয়েছে। ডক্টর বলেছে সারতে প্রায় দুইমাস লাগবে। আর সাতদিন হসপিটালে এডমিড থাকতে হবে। নিজের পায়ে নিজেই কুঁ’ড়াল মা’রার মতো কাজ করেছে সে।

বেশ খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে উর্মিলার কেবিনে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল রাগিনী। চোখ বড়ো বড়ো করে আগে নিজের বান্ধবীর বেগতিক অবস্থা দেখে হতভম্ব হলো সে। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কিরে! কীভাবে হলো এসব?”

অগ্নি দৃষ্টিতে নোমানের দিকে তাকাল উর্মিলা। নোমান হালকা কেশে তা না দেখার ভান ধরল। উর্মিলার দৃষ্টিতে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে সরু চোখে রাগিনীও নোমানের দিকে তাকাল। যখন ছেলেটি দেখল দুজনের কেউই দৃষ্টি সরাচ্ছে না তৎক্ষনাৎ সে মিনমিন করে বলল,
“আরে বাবা আই এম সরি তো! আমার কী দোষ?”

উর্মিলা চিল্লিয়ে বলল,
“চুপ করুন। কোনো কথা বলবেন না। সব দোষ আপনার। না আপনি রাস্তায় আমার সঙ্গে লাগতে আসতেন আর না আমি ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে নিজের বে’হাল দশা করতাম।”

“তোমায় চশমা ছেড়ে কে যেতে বলেছিল? আমি? তুমিই স্বইচ্ছায় নিজের এই দশা করেছ তবুও আই এম দ্যা গ্রেট নোমান সারওয়ার সরি বলছি তাও সমানে আমায় দোষারোপ করে চলেছ।”

“ওমনি দোষ আমার হয়ে গেল? রাস্তায় কে লাগতে বলেছে আপনাকে আমার সাথে?”

নোমান তৎক্ষনাৎ নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে স্বীকার করে বসে,
“আমি কী করব? তোমাকে দেখলেই পেছনে লাগতে ইচ্ছে করে।”

পরক্ষণেই আরো রেগেমেগে যেন আ’গুন জ্ব’লে উঠল উর্মিলার মাথায়।
“দেখেছিস রাগিনী? দেখেছিস? কত বড়ো ফা’জিল লোক!”

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ল উর্মিলা। পায়ে টান পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে আর্ত’নাদ করে উঠল। সকলেই চমকাল। সবচেয়ে বেশি যেন ব্যথিত হলো নোমান। সে দ্রুত পায়ের নিকট গিয়ে এদিক-ওদিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। অন্যদিকে রাগিনী দুজনের এই বিতর্কে বেশ ভালোই পুরো কাহিনীটা বুঝতে পেরেছে। সেও অভিরূপের ন্যায় ভাবলেশহীন হয়ে চেয়ে রইল। নোমান এবার উর্মিলার সংলগ্নে গিয়ে তার পকেটে সযত্নে রাখা চশমাটি বের করে চুলগুলো আশপাশ থেকে সরিয়ে উর্মিলার চোখে দিয়ে বলল,
“যেটা তোমার সবচেয়ে প্রয়োজন তা কখনো হাতছাড়া করো না শুকনো মরিচ। তুমি ব্যথিত হলে আমার মনও ভীষণ পীড়া দেয়।”

ফরেনসিক ল্যাবের মেইন দরজাটা টেনে ভেতরে প্রবেশ করে কোহিনূর আর মেহরাজ। নাকে একটা উদ্ভট গন্ধ আসায় দুজনেই চোখমুখ খিঁচে ফেলে। কোহিনূর তো বলেই বসে,
“মনে হচ্ছে ডক্টরস্ গত দশ-পনেরো দিনের ময়লা ল্যাবে জমা রেখে দিয়েছেন।”

কথাগুলো রিসার্চ করা দুই ডক্টরের কানে এলে দুজনেই কোহিনূরের দিকে চেয়ে তাকান। ফরেনসিক স্পেশালিষ্ট ডক্টর আবসার মাইক্রোস্কোপে আবারও চোখ লাগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমাদের জ্বা’লা তুমি বুঝবে না অফিসার। তোমার কাজ তো দৌড়াদৌড়ি করা, গো’লাগু’লি করা অবধিই সীমাবদ্ধ।”

ডক্টর আবসারের কথায় মুচকি হাসে তার জুনিয়র ডক্টর সাদিফ। কোহিনূর ফের বলল,
“কী এমন জ্বা’লায় আছেন আপনি জানতে পারি?”

“অবশ্যই। এখানে এসো।”

কোহিনূর এগিয়ে যায়। ডক্টর আবসার সরে এসে ড্রয়ার থেকে কোহিনূরের উদ্ধার করা সেই সাদা রুমালটা বের করে একটা বড়ো লাইটের নিচে ধরে। তারপর কোহিনূরকে একটা বিশেষ চশমা পরিয়ে বলে,
“এবারের কেইসটা সলভ করতে অবস্থা করুণ হওয়ার আশঙ্কা দেখছি আমি। এই ক্রি’মি’নাল অ’স্ত্র কম মাথার বুদ্ধি বেশি ব্যবহার করে।”

“আসল কথায় আসুন তো আপনি। মাথা আমারও আছে ডক্টর!”

“যেই রুমালটা তুমি এনেছ তার মধ্যে গুপ্ত কিছু মেসেজ ছিল। সেটা যাতে খালি চোখে দেখা না যায় সেকারণে বিশেষ পন্থা ব্যবহার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে অন্যরকম কালি তৈরি করার চেষ্টা করেছে। আর সফলও হয়েছে।”

কোহিনূর এবার নিচে রুমালের দিকে তাকাল। আসলেই সাদা রুমালে চশমা পরিহিত অবস্থায় কিছু লেখা সে ধরতে পারছে যা খালি চোখে কোনোভাবেই সে দেখতে পায়নি। সেখানে এখন স্পষ্ট লেখা, ‘আমি জে’ল থেকে পা’লিয়ে এসেছি। জে’লে থাকা আমার কাছে অপ’মানের। যেখানে আমার উঁচু একটা পদে থাকা উচিত সেখানে আমাকে আসা’মীর মতো জে’লে রাখা হয়। এটা আমার কাছে লজ্জার। বেঁচে থাকলে আমায় আবার সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই আমি আত্ম’হ’ত্যার পথ বেছে নিলাম। তবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে আমার প্রিয়জন। সঙ্গে থাকবে রূপাঞ্জনা। একটা কথা! রূপার নিজের চিন্তাশক্তি ক্ষমতা নেই ঠিকই। কিন্তু ও যদি কখনো এমন কাউকে নিজের আপনজন অথবা তার কথা মনে ধরে যায় তাহলে সেটাই নিজের লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিজের সকল কার্যক্রম সম্পূর্ণ করবে। আর তাকে যেন কখনোই না ছাড়া হয় যে আমার এই পরিণতির জন্য দায়ী। আমার ভাইয়ের মৃ’ত্যু যেন আমার অংশের হাতেই হয়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কোহিনূর। মাথাটা ঘুরছে এবার। তবে এতটুকু বুঝেছে ভাইয়ের প্রতি এত ক্ষো’ভ কেন ছিল ডার্ক ম্যাক্সের। আগের সব তথ্য নিয়ে জানতে পেরেছে ডার্ক ম্যাক্সকে পুলিশের হেফা’জতে করতে তার ভাই সাহায্য করেছিল। কিন্তু তার ভাই কি বেঁচে আছে? নাকি তাকেও মে*রে ফেলা হয়েছে? ভাবনার মাঝে আচমকা রাশেদ সাহেবের কথা মাথায় এলো কোহিনূরের। না চাইতেও সেই লোকটাকেই এসব কিছুর মাঝে প্যাঁচাতে ইচ্ছে করল। কিন্তু নিজের সন্দেহের কথা প্রকাশ করবে কী করে কোহিনূর?

রাত হলো। রাস্তায় কমতে থাকল লোকজনের উপস্থিতি। নিস্তব্ধতা তখন বাড়তে থাকল। দূর আকাশে মেঘের আড়াল থেকে দেখা দিলো চিকন রেখার ন্যায় চাঁদ। ঢাকায় শীত একটু দেরিতেই পড়ে। ভোরের দিকে শীতের আমেজটা হালকা পাওয়া যায়। তাছাড়া আবহাওয়া যেন এত যানবাহন আর কলকারখানার যাঁতাকলে পি’ষে যায়।

আগের চেয়ে আরো বেশি দুর্দশায় পড়েছে রূপাঞ্জনা। এখন আর উঠতেও যেন ভেতর থেকে প্রাণ বেরিয়ে আসে। সারা শরীরে বি’ষ যন্ত্র’ণা হয়। কাউকে বলতে পারে না। বললেও শোনে না। শুধু খাবার সময় ঠিকই অদ্ভুতভাবে তাকে খাবার দিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ম করে তাকে তিনবেলা খাবার দিতে কেউ ভোলে না। তবে শুয়ে শুয়ে থেকেও যেন কোমড়টা ব্যথা করে তার। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো আজকে হাঁটার চেষ্টা করবে। এভাবে আর কত? আজকাল যেন সে মৃ*ত্যুকে নিজের সামনে দেখে। দিন দিন তার অবস্থা যা হচ্ছে সে নিজেই বুঝতে পারছে সময় যেন আর বেশি নেই। রূপা ওঠার চেষ্টা করে। দেয়াল ধরে ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। তার পা যেন অকেজো হয়ে পড়েছে। নড়বড়ে চলন দিয়ে যেন সে তৎক্ষনাৎ মুখ থুবড়ে পড়বে। সামান্য উঠে দাঁড়াতেই সে হাঁপিয়ে উঠেছে। পায়ের ধাপ একটু একটু করে ফেলে দরজার কাছে আসে সে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় বিভিন্ন রকমের সরঞ্জাম নিচে ছিটানো। দুর্বল চোখেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করে সে। ভালো করে খেয়াল করে দেখে এসব বো*ম তৈরির জিনিস। কয়েকদিন ধরেই রূপাঞ্জনা লক্ষ্য করেছে আশেপাশের সকলে ব্যস্ত। তারা কি নতুন কোনো অ্যা*টাকের প্ল্যানিং করছে? এতদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল তারা। কারণ ডা*কাতির পর স্বাভাবিকভাবেই লুকিয়ে না থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই ডার্ক ম্যাক্সের আগমনে দরজা থেকে কপাটের কাছে সরে আসে রূপা। সে চায় না মুখোমুখি হতে। এবার কানে আসে ডার্কের ভার কণ্ঠ।
“রূপাকে রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে?”

মিনমিন করে জবাবটাও কর্ণকুহরে ভেসে আসে রূপার।
“না বস। এইতো কাজ শেষে যাচ্ছিলাম।”

“তোর কাজ করার চক্করে আমার কাজটা অসম্পূর্ণ থাকবে নাকি? এমনিতেই ওই শা*লির কৈ মাছের প্রাণ। তোর এই অনিয়মের জন্য যদি ওর শরীরে ঠিকমতো পয়*জন না যায় আর ও বেঁচে গেলে ওই কেমিক্যাল পয়’জন দিয়ে তোকেই মা’রব। বুঝতে পেরেছিস?”

চমকে ওঠে রূপাঞ্জনা। দুরুদুরু বুকে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর যেন সম্ভব হচ্ছে না। র’ক্ত চলাচল যেন এক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল। মস্তিষ্ক ততক্ষণে তার অসুস্থতা এবং এই মৃ’ত্যুসম য’ন্ত্রণার মূল কারণ জেনে ফেলেছে। সে আবার শুনতে পায়,
“আমি এখনি খাবার দিয়ে আসতেছি।”

রূপা বিলম্ব না করে ঝড়ো গতিতে এসে বিছানায় গা এলিয়ে অন্যপাশ ফিরে চাদর টেনে চোখ বুঁজে নেয়। কিছু মূহুর্ত কাটতেই আগমন ঘটে কারোর। স্টিলের থালা রাখার শব্দটা পায় সে। আর পুরুষালী কণ্ঠ বলে,
“খাবার রাখলাম। খাইয়া নিবা।”

রূপাঞ্জনা অন্যপাশ ফিরেই থাকল। কিছুক্ষণ পর ঘরটা নীরব হওয়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিলো সে। হাতের কাছে খাবারের থালা টেনে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল খাবারের দিকে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এখানে থাকলে আমার ম’রণ নিশ্চিত। আমায় পালাতে হবে।”

পরক্ষণেই মাথায় আরেকটা প্রশ্ন আটকালো রূপাঞ্জনার। পালিয়ে কোথায় গিয়ে বাঁচবে সে? আদেও বাঁচতে পারবে? তার যে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এখানে থাকলে মৃ’ত্যু নিশ্চিত আর বাহিরে গেলে হাজতবাস নিশ্চিত। সে তো নিজেই নিজের জন্য কোনো পথ খোলা রাখেনি। তবে মনটা একটাই জিনিস চাইছে তা হলো সুন্দর করে বাঁচা।

সবে ঘুমানোর জন্য বিছানায় এসে বসেছেন রাশেদ সাহেব। কয়েকদিন ধরে রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুমটা চোখে আসছে না। কারণটা হয়ত ভয়ে বা আতংকে। অজানা কোনো সত্যি উন্মোচনের সংশয়! তিনি নিজের মেয়ের কথা ভেবে নিজেকে শান্ত করেন। উনার নিজের মেয়ের শান্ত এবং মিষ্টি মুখশ্রী দুনিয়ার যে কাউকে ভুলিয়ে দিতে বাধ্য। কিছুক্ষণ আগেই তার আদরের কন্যা ঔষধগুলো খাইয়ে দিয়ে তবেই ঘুমোতে গেল। আচ্ছা কখনোও কি তার সেই আদুরে মেয়েটা তাকে ঘৃণা করতে পারে? ভাবতেই বুকে যেন একটা পাথর চেপে বসল। বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতেই ফোনটা বেজে উঠল উনার। কিছুটা বিরক্ত হলেন। এত রাতে কে? ফোনটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে নিলেন তিনি। অপরিচিত নম্বর। তবুও বিভিন্ন কারণে উনি রিসিভ করেন।
“হ্যালো? আমি সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদ বলছি। আপনি কে?”

অপরপাশটা কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর মেয়েলি একটা দুর্বল কণ্ঠ শুনতে পেলেন রাশেদ সাহেব।
“আমি জানি এটা আপনি। সব ভালো করে জেনেই আপনাকে কল করেছি।”

কণ্ঠটা চিনতে খুব বেশি সময় লাগল না রাশেদ সাহেবের। গলা শুঁকিয়ে এলো উনার। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত গলায় বললেন,
“কী সমস্যা শামীমা? কেন বারবার আমার পিছু করছ?”

“পিছু করার যথেষ্ট কারণ আপনিই করে দিয়েছেন। এতগুলো আপনাকে পাগলের মতো খুঁজেছি শুধুমাত্র একটাই কারণে। আমার সন্তানের খবরটা একবার আমাকে দিন। আর বিরক্ত করব না!”

“একটু আগেই বললে অনেক বছর কেটে গিয়েছে। এত সময় চলে গিয়েছে। আমাদের পথ আলাদা হয়েছে। আজ আমিও তোমায় চিনি না, তুমিও আমায় চেনো না। অযথা আগের অতীত টেনে বর্তমানকে নষ্ট করে দিও না। আমি অনেক ভালো আছি।”

এবার ওপাশ থেকে উত্তপ্ত কণ্ঠ শোনা গেল।
“স্বা’র্থপর লোক! নিজে তো ভালো আছেন! কিন্তু আমার ভালো থাকার কী হবে? আমার সবকিছু কেঁ’ড়ে নিয়ে আপনার তো ভালো থাকারই কথা।”

রাশেদ সাহেবের মেজাজটাও বিগড়ে এলো এবার। তড়িঘড়ি করে বললেন,
“তোমার এসব কথা শোনার জন্য আমার সময় নেই। পরেরবার কখনো কল করবে না আমাকে।”

বলেই কলটা কেটে দিতে চান রাশেদ সাহেন। এবার ওপাশ থেকে কান্নারত সুর শোনা যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে শামীমা।
“দয়া করুন আমাকে। একটা বার আমার সন্তানের কথা আমায় বলুন। কেমন আছে সে? একটা বার আমায় জানান।”

রাশেদ সাহেন ঢক গিলে চুপ থাকেন। তার চুপ থাকা দেখে শামীমা বলেন,
“বেঁচে আছে তো সে?”

“জানি না আমি। তোমার সন্তানের কথা আমি জানি না। আমি শুধু আমার মেয়ের কথা জানি। তোমার সন্তান পারলে তুমি খুঁজে নাও।”

শামীমা কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করে বলেন,
“কেউ জানে না আপনার এই সুন্দর মনের ভেতরটা কতটা কুৎসিত। আমি সবাইকে জানিয়ে দেব। আমি পুলিশের কাছে যাব। বিচার চাইব।”

রাশেদ সাহেব এবার তাচ্ছিল্য করে হাসেন। হাসতে হাসতেই বলেন,
“গিয়ে কী বলবে? বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদ কী করেছে তোমার সাথে? কে বিশ্বাস তোমার কথা? তুমি একটা সামান্য পিঁপড়ে যার কথা কারোর কান অবধি পৌঁছাবে না। এসব হু’মকি আমাকে দিতে এসো না। পরবর্তীতে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবে না। ফলাফল ভালো হবেনা।”
আর অপেক্ষা না করে কল কেটে দিলেন রাশেদ সাহেব। অতীতের বেড়াজালে যেন আবারও আটকা পড়তে চলেছে জীবন!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here