গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে ২ পর্ব ৩০ ও শেষ

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ (২য় খণ্ড)
[অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ]

নিস্তব্ধ, বিমূঢ় অভিরূপ। হাত-পা অসার হয়ে আসছে। সাদা চাদরে মোড়ানো অবিকৃত সেই দেহের দিকে তাকাতেও রুহ্ কেঁপে উঠছে তার। ম্লান চোখে তবুও বহু কষ্টে তাকাল সেদিকে। সে বিশ্বাস করেনি রাগিনীর পড়া চিঠির কথা। সে মানে না, ওই চিঠি রূপার। সে শুধু জানে রূপাঞ্জনা নামক নারী যার সারাজীবন ছিল জটিলতায় পরিপূর্ণ সেই নারীর সঙ্গে বহু পথ চলা বাকি। তার জীবনের জটিলতা কাটানো বাকি। হাতে হাত রেখে একে অপরকে ভরসা জোগানো বাকি। এসবকিছু ফেলে রূপা যেতে পারেনা! চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করতে থাকে অভিরূপ। নোমান দূর থেকে এবার নিকটে আসে তার। কাঁধে রাখতেই অভিরূপ ভারাক্রান্ত গলায় বলে,
“আই থিংক ইটস ড্রিম! অ্যা ব্যাড ড্রিম!”

নোমানের ইচ্ছে করছে না অভির আশা ভাঙতে। কিন্তু সত্যের সামনাসামনি তাকেও অবশ্যই হতে হবে। এখানে মিথ্যে আশা দিয়ে লাভ কী? নোমান উপলব্ধি করেছে, তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু সব ছেড়ে এই মেয়েটাকেই ভালোবেসেছে।
“ইটস নট ড্রিম অভি!”

চোখ খুলতে পারল না অভিরূপ। তার আগেই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল সে। বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। যেন শ্বাস রোধ করছে কোনো অজানা শক্তি! নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না সে। তার চিৎকারে জমা হলো সমস্ত লোকজন। অভিরূপ সকলের পরিচিত মুখ। সকলে হতভম্ব এমন একজন মানুষকে এখানে ভেঙে পড়তে দেখে কানাঘুষা শুরু হলো পরক্ষণেই। অভিরূপের সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। দিশাহারা হয়ে পড়েছে সে। ফট করেই অভিরূপ টান দিলো সাদা কাপড়টি লা;শের মুখের কাছ থেকে। আকস্মিকতায় এমন দগ্ধ মুখ থেকে চোখমুখ খিঁচে ফেলল সকলে। এমন চেহারা দেখার মতো নয়। চেনা যায় না। তবে অভিরূপের মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল না। ভেজা জায়গায় পা জড়িয়ে বসে সেই বিশ্রী মুখশ্রী মনোযোগ দিয়ে দেখল অভিরূপ। পোড়া গালে হাত রাখল সে। নোমান তার এক হাত ধরে দূরত্ব সুরে বলল,
“অভি কী করছিস?”

অভিরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে নোমানের দিকে তাকাল। নিজের হাত ছাড়িয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিপাত করে সেই হাতের আঙ্গুল ঠোঁটে এনে ইশারায় চুপ থাকতে বলল নোমানকে। ছেলেটার এমন র;ক্তিম, ম/রো ম/রো, নিষ্প্রাণ দৃষ্টি দেখেই আঁতকে উঠল নোমান। কথা বাড়াল না। অভিরূপ ফের তাকাল মৃ/তদেহের দিকে। রাগিনী তখনও চিঠি ধরে মুখ লুকিয়ে কেঁদে চলেছে একাধারে। দগ্ধ মুখটির উপর উপুড় হতেই অভিরূপের চোখের পানির একটা ফোঁটা পড়ল সেই মুখে।
“শেষ কবে কেঁদেছি মনে নেই। আমি কাঁদার মানুষ নই। কারণ জীবনে কখনো কষ্ট জিনিস আমি অনুভব করিনি। যখন যা মন চেয়েছে করেছি, যখন যেখানে ইচ্ছে হয়েছে গিয়েছি। ব্যস…শুধু তোমায় আঁকড়ে ধরে এক অজানা গন্তব্যে হাঁটা দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। এটা অপূর্ণ হয়ে গেল। তুমি আমার হবে না তাহলে কেন এসেছিলে রূপা আমার জীবনে? এক রাশ তীব্র যন্ত্রণা আর অপূর্ণতায় ভরিয়ে দিলে আমাকে। আমি মানতে পারিনা রূপা! তোমার সব অপরাধ আমি মেনে তোমায় চেয়েছি! কিন্তু তুমি এত জেদি যে আমায় ছেড়ে চলে গেলে। কেন রূপা?”

কোহিনূর বুঝতে পারল এসব লা;শ যতক্ষণ এখানে রাখা হবে ততক্ষণ অভিরূপের পাগলামি বাড়বে, রাগিনী অসুস্থ হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে বাড়তি লোকজনও অভিরূপকে দেখতে পেয়ে ছবি তোলা থেকে শুরু করে ভিডিও করা অবধি শুরু করে দিয়েছে। তাই সে সেখানে উপস্থিত হওয়া রায়ানকে ইশারা করতেই রায়ান মাথা দুলিয়ে তার কনস্টেবলদের উদ্দেশ্যে বলল,
“এই তোমরা তাড়াতাড়ি করি যত লা/শ আছে গাড়িতে তোলো। পোস্টমর্টেম, ডিএনএ টেস্টের দরকার আছে। ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে যাও। ফাস্ট!”

তিনজন কনস্টেবল মেহরাজকে ধরল। বাকি তিনজন ধরতে গেল সেই ম/রদেহকে যাকে রূপা বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তবে তাকে স্পর্শ করার আগেই শাসিয়ে উঠল অভিরূপ। কনস্টেবল-গুলো পিছু সরে গেল।
“আমার রূপাকে কেউ ধরলে হয় আমি তাদেরকে মে/রে দেব নয়ত নিজে ম;রে যাব!”

“অভি! কী বলছিস এগুলো? এখানে কতক্ষণ লা/শ রাখবে ওরা?”

নোমানের করা প্রশ্নে অভিরূপ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“লা/শ? কীসের লা/শ?”

“তুই যার সামনে বসে আছিস। পুলিশকে তার কাজ করতে দে।”

হুট করেই দগ্ধ দে-হটাকে আগলে ধরল অভিরূপ। পাগলের মতো প্রলাপ বকতে থাকল।
“না দেব না ওকে নিয়ে যেতে। ও আমার সাথে থাকবে।”

“তুই কী করবি ডে/ড বডি নিয়ে?”

অভিরূপ অসহ্য হয়ে প্রতিত্তোরে উচ্চস্বরে বলল,
“বারবার কেন ডে/ড বডি বলছিস ওকে? আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম। তেমন বউ সাজাব। আমি গান গাইব ও আমার সঙ্গে তাল মেলাবে।”

কথাগুলো বলে সেই দগ্ধ কালো মুখশ্রীতে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে ফেলল অভিরূপ। এটাই তার প্রথম ভালোবাসার পরশ। আর হয়তবা এটাই শেষ! রাগিনী তখন অভিরূপের কাণ্ড দেখে স্তব্ধ। অন্যদিকে রূপার মৃ/তদেহ দেখে মর্মাহত। কান্নার শব্দও আসছে না তার। তবে চোখ দিয়ে ঠিকই অনবরত অশ্রুপাত হয়ে যাচ্ছে। কোহিনূর গিয়ে একহাতে আগলে দাঁড়াল রাগিনীকে। ভরসার স্থান পেয়ে কোহিনূরের কাঁধে মাথা রাখে রাগিনী। ম্লান গলায় বলে,
“আত্মগ্লানিতে আমি শেষ হয়ে যাব, কোহিনূর!”

কোহিনূর আলতো করে রাগিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আস্তে করে বলে,
“ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে।”

রায়ান নোমানের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
“অভিরূপ ইজ আউট ওফ হিজ কন্ট্রোল। ওকে ওখান থেকে সরাতে হবে।”

“কিন্তু কী করে? ও এখন যেমন আচরণ করছে ওকে কখনোই এমন করতে দেখিনি আমি।”

“দরকার হলে জোর করে সরাতে হবে। কতক্ষণ ওই মৃ/তদেহ নিয়ে নিজের আবেগ ভাসাবে? আমি জানি এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যদি সে সত্যি ওই মেয়েটাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে এটা ওর জন্য খুবই কঠিন একটা সময়। কিন্তু যতক্ষণ ও এখানে থাকবে ও আরো ভেঙে পড়বে।”

রায়ানের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে নোমান। অভিরূপের দিকে অসহায় পানে চাইল নোমান। বড্ড আফসোস হচ্ছে তার। নিজের উপর ক্ষুদ্ধ সে। যদি জোর করে অভিকে ফিরে নিয়ে যেতে পারত দেশে তাহলে বোধহয় তার এই বিধ্বস্ত অবস্থা হতো না।

মৃ/ত্যুর পর শরীর ভারী হয়। তবুও সেই প্রাণহীন শরীরটাকে নিজের বুকে টেনে তবে দম নিলো অভিরূপ। দুহাতে জড়িয়ে থমথমে গলায় বলল,
‘তুমি চিন্তা করো না রূপা! আমি জানি তুমি পুলিশে ভয় পাও। কিন্তু এখন ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আছি। আমি থাকতে তোমায় কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। শান্তিতে থাকো আমার কাছে।”

এসব কথাবার্তা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আরো ভেঙে পড়ল রাগিনী। অনুনয়ের সুরে বলল,
“অভিরূপকে দেখছেন, কোহিনূর? আমার জন্য সে আজকে এতটা বিধ্বস্ত! ভালোবাসা পূর্ণতা দিলে সব সুখ একত্রে বয়ে আসে। কিন্তু অপূর্ণতা দিলে সব দুঃখ, ব্যথা একসাথে জীবনে হানা দেয়।”

কথার মাঝে থেমে একটা শ্বাস নিয়ে রাগিনী ফের বলল,
“আর উনার অপূর্ণতার কারণ আমি। একদিন উনি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্ণতা প্রদানে সাহায্য করেছিলেন। আমি তার বদলে শুধু একরাশ যাতনা দিলাম।”

“ওকে এখন সামলাতে হবে রাগিনী। মৃ/ত্যু রূপাকে ডেকেছিল। তাকে সাড়া দিতে হতো। নিজেকে দোষ দিও না।”

“মস্তিষ্ককে বোঝানো যায় যে যাকে সে চায় তাকে পাওয়া সম্ভব নয়। তাকে নিজের ভাষায় ঠিকই সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু মন অবাধ্য, অবশীভূত! ওকে আমরা নিজের ভাষা বোঝাতে পারি না। অভিরূপকে কী করে বোঝানো যাবে?”

কোহিনূর আর কথা বাড়াল না। কেননা, রাগিনী যেটা বলছে সেটা সত্যি কথা। শেষমেশ অভিরূপে পাঁচ-ছয়জন সহ নোমান টেনে তুলল সেখান থেকে। গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো তাকে। নোমান গাড়ির দরজা লক করে দিলো। তবুও হার মানল না অভিরূপ। চিৎকার, চেঁচামেচি ছটফট করতে থাকল অনবরত। তবুও না পেরে গাড়ির জানালা হাত দিয়ে ভাঙতে চাইল সে। নোমান তৎক্ষনাৎ তার হাত ধরে রুক্ষ সুরে বলল,
“পাগল হয়ে গিয়েছিস? এখন ক্ষতি করবি তুই? বাহিরে সব লোকজন তোর তামাশা বানাচ্ছে। আর এমন করিস না প্লিজ!”

“তুই আমাকে বুঝতে পারছিস না। বাহিরের লোকজন যা ইচ্ছে ভাবুক, যা ইচ্ছে করুক। আই ডোন্ট। আমাকে রূপার কাছে যেতে দে। ওকে পুলিশ নিয়ে যাবে নোমান। আমাকে যেতে দে।”

অভিরূপের কান্নারত গলা ব্যথিত করল নোমানকে। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখে বলে উঠল,
“পুলিশ কিছু করবে না। তোর রূপা ফিরে আসবে।”

থমকাল অভিরূপ। চোখ দুটো ভরে গেল উচ্ছ্বাসে। মুখরিত হয়ে উঠল তার লাল চেহারা। নোমানের হাত ধরে বলল,
“সত্যি?”

নোমান ঢক গিলল। সে জানে না সে কী বলছে! তবে এটা জানে যা বলছে এই মুহূর্তে তা না বললে অভিরূপকে সামলানো যাবে না। তাই বুকে পাথর চেপে বলল,
“ওটা রূপা তোকে কে বলল? পোস্টমর্টেম, ডিএনএ টেস্ট সব হোক। দেখা গেল ওটা রূপার লা/শই নয়।”

অভিরূপের মনে জাগল আকাশ সমান আশা। নিজের আলাদা চিন্তা শক্তি করার ক্ষমতা নেই তার বিধায় নোমানের প্রতিটা অক্ষর সে বিশ্বাস করছে। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
“হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। রূপাঞ্জনা আমাকে ছেড়ে যাবে না। ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়। ঠিক আমার ভোরের সুন্দর স্বপ্নও সত্যি হবে।”

ঠান্ডা পরিবেশ। শিরশির করছে শরীর। তবুও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেই শীতল ঘরে প্রবেশ করল কোহিনূর। সবেমাত্র তার কপালে ব্যান্ডেজ পড়েছে। বুকে কাঁচের টুকরো দিয়ে আ/ঘাত করা স্থানেও পড়েছে মোটাসোটা ব্যান্ডেজ। একহাত প্লাস্টার করা। পায়ের কদম পড়তে চাইছে না তবুও জোর করেই এগিয়ে এলো সে। চারিদিকে মৃ/তদেহ! কোহিনূর খুঁজে ঠিক মেহরাজের নিকট পৌঁছে গেল। প্রিজারভেশন করে রাখা হয়েছে মেহরাজের শরীর। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। রাতের মধ্যেই শেষ কাজ সম্পূর্ণ করা হবে। চাদরটা উল্টে মেহরাজকে শেষবারের মতো দেখে নিলো কোহিনূর। তার কপালে হাত ছোঁয়াল একবার।
“তোমাকে বড্ড মিস করছি মেহরাজ! কথায় কথায় নিজের রাগ উপড়ে ফেলার মানুষ আর পাব না।”

মেহরাজ নিরুত্তর। তার উত্তর পাওয়ার কথাও না। কোহিনূর জানে। সব জেনেও এসেছে এখানে। নিজের মনে জমানো কথাগুলো সব বলে দিতে। আর তো সুযোগ পাবেনা কখনো!
“আমার সিক্রেট ফাঁস করে দিতে হলেও তোমার বেঁচে থাকা জরুরি ছিল মেহরাজ।”

কোহিনূর থামল। চোখের পানি ঠেলে বেরিয়ে আসছে। কোহিনূর আঁটকে রাখছে। ঢক গিলে বলল,
“সারাজীবন আগ বাড়িয়ে কাজ করে গেলে তুমি। ইউ নো হোয়াট? আমার সব সিক্রেট তো তুমি জানতে! শেষ সিক্রেটটাও জানিয়ে দিতে এসেছি তোমাকে।”

মেহরাজের ফ্যাকাসে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও কোহিনূর নিজে উপলব্ধি করে নিলো মেহরাজের পুলকিত মুখ। চোখ বন্ধ করে বলল,
“তুমি আমার কাছে শুধুমাত্র সিক্রেট টিমের সাধারণ একটা মেম্বার ছিলেনা। আমার ছোটো ভাই ছিলে। এই ছোটো ভাইটাকে খুব স্নেহ করতাম আমি। ভালোবাসতাম। ছোটো ভাইটাকে হারিয়ে বড়ো ভাই আজকে একা হয়ে পড়েছে।”

ফরেনসিক ল্যাবের জুনিয়র ডক্টর সাদিফের আগমন ঘটে সেখানে। ধীর গলায় কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলে,
“স্যার, আপনাকে সিনিয়র ডেকেছেন।”

মেহরাজকে ভালোমতো ঢেকে দিলো কোহিনূর। বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। বলল,
“যাচ্ছি আমি।”।

ডক্টর সাদিফ চলে গেলে কোহিনূরও বেরিয়ে আসে। ডক্টর আবসারের ল্যাবের দিকে হাঁটা দেয়। কাঁচের গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রায়ানের দেখাও পেয়ে যায় সে। রায়ানের পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়াতেই ব্যস্ত ডক্টর আবসার বলে ওঠেন,
” সব কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে। রিপোর্ট চলে এসেছে।”

“কী এসেছে রিপোর্টে?”

ভার গলায় প্রশ্ন করল কোহিনূর। মাঝখান থেকে ডক্টর সাদিফ বলল,
“এই বডি রূপাঞ্জনার। তবে পোস্টমর্টেম অনুযায়ী বো/ম ব্লা/স্ট সে ম/রেনি। মেয়েটার মৃ/ত্যুর কারণটা ভিন্ন।”

“ভিন্ন মানে? তাহলে কীভাবে…”

কোহিনূরের কথার মাঝে ডক্টর আবসার ফোঁড়ন কেটে বলে,
“মেয়েটার ব/ডি চেক করেছি। তার বডির কিছু অঙ্গ ঠিক নেই। তার ব্রেইন স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে তার ব্রেইনের নিউরন প্রায় নিরানব্বই পার্সেন্ট ড্যামেজ। শুধু তাই নয়, তার মৃ/ত্যুর কারণ এই ব্রেইন ড্যামেজই।”

রায়ান আর কোহিনূর হতভম্ব হলো এবার। বিস্ময় নিয়ে রায়ান জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু ওর ব্রেইন ড্যামেজ হলো কী করে? হাউ?”

“তোমরা আমাকে যেসব ইনফরমেশন দিয়েছ সেটা থেকে আমি ওর ব্রেইন নষ্ট হওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছি। অফিসার কোহিনূর বলেছিল, ওই ডার্ক ম্যাক্স একসময় কাউকে দিয়ে অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। সেটা হলো কারোর চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার এক্সপেরিমেন্ট। আর ওই পরীক্ষা এই মেয়ের উপরই করা হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, তার চিন্তা ক্ষমতা নষ্ট করার কারণে আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে না কোনটা সঠিক কোনটা ভুল। যখন সে যার সঙ্গে সময় কাটায় তখন তার কথা ঠিক মনে হয়। কিন্তু এভাবে আস্তে আস্তে ওর ব্রেইন ড্যামেজ হতে থাকে। ওর কানে চেক করে দেখলাম অনেক র;ক্ত জমাট বাঁধা। বোঝাই যাচ্ছে নিউরন নষ্ট হওয়ার কারণে কান দিয়ে র;ক্ত গড়ানোতে তার মৃ;ত্যু ঘটেছে। বো/ম ব্লা/স্ট না হলেও তার মৃ/তদেহই পেতে তোমরা। জীবিত পেতে না।”

কোহিনূর ভেতর থেকে মুষড়ে পড়ে। হাত দিয়ে নিজের চুলটা চেপে ধরে। ভবতেও পারছে না! এই মেয়েটাও কোথাও গিয়ে কোনো ষড়/যন্ত্রের শিকার! এটা ভাবলে তার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যাচ্ছে যে এসবের পেছনে কোনো না কোনোভাবে তার স্ত্রীর পিতা অর্থাৎ রাশেদ সাহেব দায়ী! বেঁচে যেত মেয়েটা! সুস্থভাবে বড়ো হতে পারত। কিন্তু, অবৈধ সম্পর্কের মাশুল গুনতে হলো তাকে।

রাগিনীকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ছাঁদে খুঁজে পাওয়া গেল তাকে। হাঁটতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে কোহিনূরের। তবুও জোর খাটিয়ে এসে হুট করে রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসতেই আনমনা রাগিনী চমকে তাকাল। পরক্ষণেই নিজের প্রিয় মানুষটিকে দেখে শান্ত হয়ে গেল সে। হলো অন্যমনস্ক! কোহিনূর দম নিয়ে বলল,
“কী ভাবছ?”

“ভাবছি আমার হসপিটালে যাওয়াটাই ভুল ছিল। আমি না গেলে রূপাকে ম;রতে হতো না আমার জন্য। আমার জন্য প্রাণ চলে গেল মেয়েটার। ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করেছি। উনার কান্নাকাটি দেখে আমি মুষড়ে পড়েছি। আমার তো মা নেই। কিন্তু দেখুন, আমি অন্য এক মায়ের থেকে তার সন্তানকে কেঁড়ে নিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে, আমি আর আমার বাবা একই। বাবা যা করেছিল আমিও তা করেছি। সন্তানের থেকে মাকে আলাদা করেছি।”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজের ক্রন্দন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল রাগিনী। পারল না। ঝুঁকে পড়ল কোহিনূরের বুকে। মুখ লুকিয়ে ফেলল উষ্ণ স্থানে। এখানে মন ভরে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। কোহিনূর নিজের শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে তার প্রিয়তমাকে নিজের নিকটে এনে বলল,
“সিলি গার্ল! তুমি মোটেও এমন কিছু করো নি। তুমি রূপাঞ্জনার মৃ;ত্যুর জন্য দায়ী নও। তার মৃ/ত্যুর কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।”

চলবে….#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ (২য় খণ্ড)
[অন্তিম পর্বের মধ্যমাংশ]

অভিরূপ ঘুমিয়েছে। বলতে গেলে জোর করে ঔষধ দিয়ে ঘুমিয়ে রেখেছে নোমান। অভিরূপের গায়ে সুন্দর করে চাদর জড়িয়ে দিয়ে তার পাশে বসল নোমান। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা এতটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু হয়ে গেল। মস্তিষ্ক এখনো বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারছে না। ফোনের ভাইব্রেশন অনুভব করল সে। পকেট থেকে ফোন বের করে উর্মিলার নম্বর দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে বাহিরে এসে কল রিসিভ করল।

“হ্যাঁ বলো।”

“আমি কী বলব? আপনি বলুন। কী অবস্থা ওইদিকে? সব ঠিকঠাক আছে?”

উর্মিলার চটপটে কণ্ঠ। নোমানের কণ্ঠে বিষণ্নতা। ভার গলায় নোমান বলল,
“আর ঠিকঠাক! সবকিছু ততটাই বিগড়ে গিয়েছে যতটা ঠিকঠাক ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ। বুঝতে পারছি না কী করব।”

উর্মিলা দ্বিধান্বিত হয়ে শুধাল,
“কেন? কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে নাকি? রাগিনী ঠিক আছে? আর কোহিনূর জিজু? আমি রাগিনীকে কলেই পাচ্ছিনা।”

“সবাই ঠিক আছে উর্মিলা। ঠিক নেই শুধু অভি। অন্যদিকে, মেহরাজও মা/রা গিয়েছে।”

চিন্তা আরো বেশি হলো উর্মিলার। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“কী বলছেন! আর অভিরূপ ভাইয়ার কী হয়েছে?”

“রূপাঞ্জনা মানে রাগিনীর মতো যেই মেয়েটা ছিল! অভি তো তাকে ভালোবাসত। সে মা;রা গিয়েছে। আর অভিরূপ পাগলামি করছে। মারাত্মক ভালোবাসত মেয়েটাকে।”

উর্মিলা নীরব রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর নম্র সুরে বলল,
“এখনো কী পাগলামি করছেন উনি?”

নোমান দরজা খুলে একবার দেখে নিলো অভিরূপকে। ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
‘না ঘুমাচ্ছে। আমি ওকে একটা মিথ্যা আশা দিয়েছি যে রূপা ফিরে আসবে।”

উর্মিলা এবার কিছুটা গম্ভীর হলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“দেখুন বাস্তবতাকে তো বদলাতে পারব না আমরা। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া।”

নোমান অপরাধীর মতো অনুতাপের সাথে বলল,
“কী বলব আমি তাহলে? মেয়েটা গেল তো গেল আমার বন্ধুটাকেও ভেতর থেকে মৃ/ত বানিয়ে দিয়ে গেল।”

“মৃ/ত্যু তো সবসময় অছিলা খোঁজে নোমান। মানুষ পৃথিবীতে আসবে যাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু অভিরূপ ভাইয়াকে তো বাঁচতে হবে তাই না?”

নোমান এবার অধৈর্য হয়ে উত্তরে বলল,
“কিন্তু কী করে উর্মিলা? আজকেই তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম। উনি বাবাকে নিয়ে যেতে বলছেন কথা বলতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে।”

উর্মিলা নোমানকে আশ্বস্ত করে বলে,
“সেসব পরে হবে ক্ষণ। আমি মাকে বুঝিয়ে বলব। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় এদেশে থাকলে উনি আরো ভেঙে পড়বেন। আপনি উনাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যান।”

“দেখি কী করা যায়। থ্যাংক ইউ, উর্মিলা। আমার পাশে থাকার জন্য।”

নোমানের কথায় মৃদু হাসে উর্মিলা। বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে,
“থ্যাংক ইউ বলার কী আছে? আপনার সমস্যা মানে আমারও সমস্যা।”

“তাই তো! রাখছি এখন।”
নোমান কল কেটে দেয়। মনে প্রশ্ন জাগল, আসলে এখন কী করলে সব স্বাভাবিক হবে পুনরায়? তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু যার মুখে কিনা হাসি সবসময় লেগে থাকত তার এমন দশা মানতে পারছে না নোমান।

সোজা হয়ে বসে রয়েছে কোহিনূর। মুখে নেই কোনো কথা। গোধূলি বেলায় আকাশটা রঙ দেখাতে শুরু করেছে। তবে পুরো শহর এখনো ভিজে। কিছুটা বৃষ্টির জলে আবার কিছুটা প্রিয়জন হারানোর যাতনায়। কোহিনূরের হঠাৎ অনুভূত হলো তার কাঁধের দিকের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। ঘাড় বাঁকিয়ে নিতেই নাকে এসে ঠেকল সুগন্ধি অগোছালো কৃষ্ণ বর্ণের কেশ। রাগিনী নাক টানতেই কোহিনূর বুঝল মেয়েটা অঝোরে নীরবে কাঁদছে। কোহিনূর তার একহাতে রাগিনীর চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে জিজ্ঞেস করে,
“এই বোকা মেয়ে! এখনো কাঁদছ কেন? আমি তো তোমাকে বললাম রূপার মৃ/ত্যুর কারণ। তুমি তার জন্য দায়ী নও।”

রাগিনী কোহিনূরের একহাতে জড়িয়ে কান্নারত সুরে জবাব দিলো,
“এতক্ষণ যে আমি শুধু আত্মগ্লানির জন্য কাঁদছিলাম সেটা নয়, কোহিনূর। রূপা বোন হয় আমার। আর সবচেয়ে বেশি মনে আ/ঘাত লাগছে এই কথা ভেবে যে আমার বাবা যে আমাকে এত যত্নে বড়ো করতে পেরেছে কিন্তু অন্য মেয়েটাকে ছুঁ/ড়ে ফেলে দিয়েছে। বাবা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। কিন্তু অন্যদিকে আরেক মেয়ের কাছে তিনি সবচেয়ে নি/কৃষ্ট বাবা। শুধু নিকৃ/ষ্ট বাবা নন উনি দুনিয়ার সবচেয়ে জ/ঘন্য স্বামী।”

কোহিনূর মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে চাইল। তার আগে রাগিনী আবার বলতে লাগল,
“জানেন! রূপা বাঁচতে চেয়েছিল। ওকে যখন আমার বাড়িতে রেখেছিলাম গোপনে ও আমায় বলেছিল ও পালিয়ে এসেছে। ও বাঁচতে চায়। ওকে আমি নিজহাতে খাইয়েছিলাম সেদিন। তখন আমার অদ্ভুত ভালো লেগেছিল। বড়ো বোন হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল ওকে বাঁচানো। আমি ব্যর্থ হয়েছি।”

“তুমিই তো আমাকে বলেছিলে, মৃ/ত্যু শুধু বাহানা খোঁজে। তুমি যদি প্রাণপণ চেষ্টাও করতে ওকে বাঁচাতে পারতে না, রাগিনী।”

রাগিনী সোজা হয়ে বসল। একরাশ ঘৃণা নিয়ে বলল,
“সব ওই মানুষটার জন্য হয়েছে। যে কিনা সম্পর্কে আমার বাবা হয়। এতদিন যাবত মানুষটাকে ভালোবেসেছি, উনাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মন ভরে যেত। তবে এখন থেকে আজীবন উনাকে আমি ঘৃণা করে যাব। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুধু ঘৃণা পাবেন উনি।”

কোহিনূর এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল,
“সত্যি বলতে তোমার বাবা তোমাকে আসলেই অনেক ভালোবাসেন। তোমাকে নিয়েই উনার দুনিয়া। সব চিন্তা তোমায় ঘিরে। সেদিন রায়ান যখন উনাকে জেরা করছিল তখন উনি যখন মুখ খুলতে চাইছিলেন না রায়ান তোমার কথা উল্লেখ করতে গেলেই উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন আর নির্দ্বিধায় সব স্বীকার করেছিলেন। আর যাই হোক তোমার প্রতি উনার ভালোবাসা শুদ্ধ।”

টাগিনী উসখুস করে শুকনো গলায় বলল,
“রূপা তাহলে সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো কেন? শুদ্ধ ভালোবাসা না হোক নিজের বাবা হওয়ার দৌলতে সামান্য কর্তব্য তো পালন করতে পারত।”

“তা তো আমি জানি না রাগিনী।”

হাফ ছেড়ে উত্তর দিলো কোহিনূর। রাগিনীও মুখ ভার করে বলল,
“আমি আর উনার কথা শুনতে চাই না। বাদ দিন। আমি এই দিন ভুলে যেতে চাই। এই হৃদয় বিদারক মুহূর্তগুলো মনে রাখতে চাই না। একটু ভালো থাকতে চাই।”

রাগিনীর দিকে ফিরে তার গালে হাত আলতো করে স্পর্শ করে কোহিনূর। আশ্বাস দিয়ে বলে,
“তোমার সুখের কারণ আমি হতে চাই। তোমায় নিজের সবটা দিয়ে খুশি রাখতে চাই। সময় দাও আমাকে। আমি বিশ্বাস করি, সময় সবটা ঠিক করে দিতে পারে!”

রাগিনী অশ্রুসিক্ত নয়নে কোহিনূরের সেই হাতের তালুতে চুমু খেয়ে সম্মতি জানাল। তারপর কিছুটা বিচলিত হয়ে কোহিনূরের হাতে, বুকে স্পর্শ করে বলল,
“কোথায় কোথায় লেগেছিল আপনার? ব্যথা করছে?”

কোহিনূর মলিন হাসে। নিজের বুকে হাত রেখে বলে,
“সবচেয়ে বেশি ব্যথা লেগেছিল এখানে। যখন রূপার লা/শ তোমার ভেবেছিলাম। ওই মুহূর্ত এখনো মনে পড়লে দম আঁটকে আসে আমার। রূপার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব এই কারণে যে সে নিজের কথা চিন্তা না করেই আমার অর্ধাঙ্গিনীকে রক্ষা করেছে।”

কোহিনূরের বুকে সাবধানে মাথা রাখল রাগিনী। মনটা বিষণ্ণ তার। তাকাল গোধূলিতে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে। মনে পড়ল অতীতের কিছু কথা। ফট করেই খানিকটা হেসে ফেলল সে। কোহিনূর শুধাল,
“কী ব্যাপার?”

“আমার মনে পড়ছে সেই গোধূলি বেলার কথা। আপনি এসেছিলেন। আমায় বন্দি করতে। আমি বন্দি হয়েছি। তবে আপনার বক্ষপিঞ্জরে।”

কোহিনূর ঠোঁট টিপে হেসে একহাতে রাগিনীর পৃষ্ঠদেশের এলোমেলো চুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জেলে বন্দি করলে একসময় ঠিক ছাড় পেয়ে যেতে। কিন্তু সরি রাগের রানি। আমার হৃদয়কোণের অভ্যন্তর থেকে তুমি কখনোই ছাড় পাবে না।”

রাগিনী কিছু বলল না। চোখ বুঁজল নির্বিঘ্নে। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের পানে তাকিয়ে রইল কোহিনূর। উড়ে গেল কয়েক ঝাঁক পাখি। বইতে লাগল শীতল হাওয়া।

কাটল মৌসুম। স্রোতের ন্যায় বইতে লাগল সময়। বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হলো নির্বিশেষে। জায়গাটা চট্টগ্রাম। সৌন্দর্যের এক শহর। ঘুরতে পছন্দ করা মানুষদের কাছে বেশ পরিচিত জায়গা। পতেঙ্গা সমুদ্রের কথা শোনা যায় মুখে মুখে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের অবস্থানও এখানে। ব্যস্ত শহরের মানুষও ব্যস্ত। বিকেলের মুহূর্ত। যানবাহনে ছুটে চলেছে অনেক জনগণ। সেখানকার এক হাসপাতালে ভীষণ ভিড়। সবাই নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সেখানকার ৩০৪ নম্বর কক্ষের উপরে বড়ো বড়ো করে লেখা, ‘সাইকোলজিস্ট রাগিনী তাজরীন আহমেদ’।

সেখানকার সেই কক্ষের ভেতরে তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করল ওয়ার্ডবয় দুলাল। কাঁচের টেবিলের সামনে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলল,
‘ম্যাম, আজকের মতো সব পেশেন্ট দেখা শেষ। শুধু একজন বাকি আছেন। পাঠিয়ে দেব?”

সোজা হয়ে বসে চোখ তুলে তাকাল চেয়ারে বসে থাকা সাদা এপ্রনে আবৃত হাস্যোজ্জ্বল নারীটি। বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হবে?”

“না মানে ম্যাম ওই আরকি!”

ভ্রু কুঁচকে গেল রাগিনীর। দুলাল আমতা আমতা করছে। কানে নিজের অগোছালো চুল গুঁজে বলল,
“কী ওই আরকি? এনি প্রবলেম?”

দুলাল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“না ম্যাম। আমি এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল দুলাল। রাগিনী গালে হাত দিয়ে দুলালের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত!”

দুলালের ব্যবহার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের কিছু পেশেন্টের ফাইল চেক করতে মনোযোগী হলো রাগিনী। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দরজা খোলার শব্দ কানে এলো তার। সেদিকে না তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
“প্লিজ সিট!”

ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে রাগিনী অনুভূত করল লোকটি চেয়ারে এসে নীরবে বসেছে। রাগিনী প্রশ্ন করল,
“বলতে শুরু করুন আপনার সমস্যা।”

“আমার সমস্যা বড়োই গুরুতর সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম! আপনি আমার দিকে না তাকালে আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। প্লিজ লুক ইনটু মাই আইস, ম্যাডাম!”

চমকে তাকাল রাগিনী। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে চোখজোড়া সরু হয়ে এলো তার। চোখেমুখে ছড়াল উচ্ছ্বাস। তবুও রেগে যাওয়ার ভান করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“আপনি তো খুব… ”

কালো কোট পরিহিত কোহিনূর অসহায় মুখ করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমার প্রবলেম শুনবেন না ম্যাডাম? আমি আমার মনের অসুখ থেকে মুক্তি চাই প্লিজ!”

রাগিনী এবার উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“শুনি কী সেই অসুখ? কী সেই সমস্যা?”

“আমি একটা নারীর প্রতি প্রবল আসক্ত হয়ে পড়েছি। মন থেকে মস্তিষ্ক আর মস্তিষ্ক থেকে সারা শরীরে সেই নারীর প্রেমের শেকড় গজিয়েছে। মন চায় সারাদিন তাকে নিজের সংলগ্নে রেখে দিতে। কিন্তু তার এত কাজ থাকে যে সে আমাকে দেখার সময়ই পায় না। আমার থেকে নিজের কাজকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। এটা কিন্তু আমার সাথে অন্যায় হচ্ছে।”

রাগিনী কী প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারল না। কখনো রাগ হচ্ছে তো কখনো হাসি। হাসিটা চাপিয়ে রাগই দেখিয়ে সে বলল,
“মানেটা কী! আমি আপনাকে কম ভালোবাসছি? আপনি এবার বেশি বেশি বলে ফেলেছেন।”

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। কোহিনূরের দিকে তেড়ে যেতেই কোহিনূর সাবধানে ধরে নিলো তাকে। জোর করে নিজের কোলের উপর বসিয়ে রাগিনীর পেটে আস্তে করে হাত রেখে বলল,
“আস্তে আস্তে! আমার ওয়াইফ আর বেবির ব্যথা লাগবে তো।”

“আপনি এমনিতেই আপনার ওয়াইফকে মানসিক ব্যথা দিয়েছেন। আপনাকে আমি কম ভালোবাসি?”

রাগিনীর অভিমানী কণ্ঠ। কোহিনূর রাগিনীর গাল টেনে বলল,
“তাকে একটু রাগাতে বলেছি কথাগুলো। তাছাড়া আমি তো বলেছিলাম আমি ব্যতীত আমার স্ত্রী যেসব কাজে মনোযোগী হবে সেই প্রত্যেকটা কাজকে আমি হিংসে করব।”

রাগিনী মুখ ফুলিয়ে কোহিনূরের গাল চেপে ধরে বলল,
“বাবা হতে যাচ্ছেন অফিসার কোহিনূর! তবুও একটুও বদলালেন না।”

“বুড়ো বয়সেও এই কোহিনূর একই রকম রয়ে যাবে। কাজ শেষ তোমার? বাড়ি যাই চলো। অনেকক্ষণ বসে থেকে কাজ করেছ। রেস্ট নিতে হবে তোমার। আমার আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়েছে। তাই ভাবলাম নিতে চলে আসি।”

“এখনি বাসায় যেতে হবে?”

উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাগিনী। কোহিনূর মৃদু হেসে রাগিনীর কানের পিঠে চুল গুঁজে দিয়ে বলে,
“কেন যেতে মন চাইছে না?”

“না মানে অনেকদিন ধরে সমুদ্রের পাড়ে যাইনি। আজ যেতে মন চাইছে।”

ছোটোদের ন্যায় বায়না ধরে বলল রাগিনী। কোহিনূরের কণ্ঠ শক্ত হলো এবার। জোরালো গলায় বলল,
“নেভার এভার! সারাদিন ডিউটি করো। তোমার উপর পরিশ্রম যায়। বেবির উপর পরিশ্রম যায়। এখন বাড়িতে গিয়ে রেস্ট না নিলে দুর্বল হয়ে যাবে রাগিনী।”

রাগিনী তৎক্ষনাৎ উল্টো বুঝ দিয়ে বলল,
“শরীর ঠিক রাখার সাথে সাথে মন ঠিক রাখাও জরুরি। এখন যদি সমুদ্রে না যাই আমার মন খারাপ হবে। আমার মন খারাপ হলে বেবিও বিষণ্ণ হয়ে যাবে। এটা তো ঠিক না তাই না?”

কোহিনূর এবার রাগিনীর দুটো গাল চেপে ধরে কড়া সুরে বলল,
“ঠিক না হোক। তাও আমার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছো এখনি।”

রাগিনী বেশ কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকাল কোহিনূরের মন গলানোর জন্য। তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। কোহিনূর দাঁড়িয়ে রাগিনীকে চেয়ারে বসিয়ে পায়ের সাধারণ স্লিপার হাত দিয়ে খুলে দিয়ে বেশ যত্ন করে রাগিনীর জুতো পড়িয়ে দেয়। মাঝখানে বাঁধা দেয় রাগিনী।
“কেন এসব করেন আপনি? আমি নিজে জুতো পড়তে পারি তো!”

“তুমি বেশ ভালো করে জানো রাগের রানি আমি তোমার এসব কথা কর্ণপাত করব না। অযথা এসব বলে নিজের মুখের বুলি নষ্ট করো কেন?”

কথা শেষ হতে না হতেই রাগিনীর হাতটা ধরে বাহিরে নিয়ে এলো কোহিনূর। বেশ সাবধানে একধাপ একধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলে রাগিনী ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি। এখনো একাই হাঁটতে পারি। আরো কয়েকমাস যাক। বেবি বড়ো হয়ে নেক তারপর হয়ত হাঁটতে কষ্ট হবে।”

“তখন না হয় কোলে করে নিয়ে হাঁটব। প্রবলেম আছে কোনো?”

কোহিনূরের নির্লিপ্তে সাবলীলভাবে বলা কথায় আশেপাশের নার্স সহ অনেকেই চোখ গোল গোল করে তাকালে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাগিনী। মনে মনে বলে, লোকটা জীবনেও বদলাবে না। বেশরমই রয়ে যাবে!

সময় বয়ে গিয়েছে প্রায় আড়াই বছর। অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে এই সময়ে। পরিবর্তন ঘটেছে জায়গারও। কোহিনূর চট্টগ্রামে ট্রান্সফার নিয়েছে রাগিনীর সঙ্গে রাগিনীর পড়ালেখার জন্য। এখন রাগিনী প্র্যাক্টিস করার লাইসেন্স পেয়েছে। সে নিজেও নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। তাদের ছোট্ট টোনাটুনির সংসারে এক নতুন সদস্যের আগমনও ঘটতে চলেছে। তিন মাসের গর্ভবতী রাগিনী। প্রথম মা-বাবা হওয়ার আকাশসম উচ্ছ্বাস রয়েছে কোহিনূর আর রাগিনীর মাঝে। রয়েছে এক পৃথিবী আনন্দ! নয়নতাঁরার স্টাডি শেষ করার জন্য লন্ডন পাঠিয়েছে কোহিনূর। তবে তার আগে মিসেস. রমিলা রায়ানের সঙ্গে নয়নের বিয়ে ঠিক করেও রেখেছেন। নয়ন দেশে ফিরলে রায়ান আর নয়নতাঁরার বিয়ে সম্পন্ন হবে।

সকালটা আজকে অন্যরকম। জায়গাটা দার্জিলিং। পাহাড়ি রাস্তা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে রিসোর্ট। আঁকাবাঁকা পথ। কুয়াশায় ঘোলাটে পরিবেশ। ভরাট চা বাগান। সঙ্গে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য। আর কী চাই! নানানরকম মুগ্ধকর প্রকৃতি প্রদত্ত সুর যেন কর্ণকুহরে ভেসে আসে হরহামেশাই। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি দেখে যেন মনে হয় প্রকৃতির আরেক মাধুর্য। সবসময় সচল ঝর্ণা মনকে নাড়িয়ে তোলে। সেখানকারই এক নামি-দামি রিসোর্টে অবস্থান করছে এখনকার টিনএজারদের এবং খ্যাতিমান গায়ক। গানেরই কিছু শুটিং চলছে তার। সেকারণেই মূলত এখানে আসা। সকাল সকাল খোলা বারান্দায় পায়ে পা তুলে বেতের চেয়ারে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার সুন্দরতম দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের নম্র ঠোঁট তুলসীপাতার চায়ের কাপে ছোঁয়ায় অভিরূপ। নিজের অবিন্যস্ত ভাবে কপালে হেলে থাকা চুলগুলো উপরে তুলে বাহিরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করে সে। তার ফোনটা বেজে ওঠে নিজ ছন্দে। কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে আপনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে কল কেটে গেল কিয়ৎক্ষণেই। আবারও বাজল রিংটোন। শব্দহীন হেঁসে ফোনটা তুলে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চিল্লানি ভেসে আসতেই ফোনটা কান থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে সরিয়ে নিলো সে।
“হোয়াটস ইউর প্রবলেম অভি? সাথে সাথে কল পিক আপ করতে কী হয় তোর?”

ওপাশের আওয়াজ কমতেই কানটার কাছে ফোন ধরে অভিরূপ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,
“একবারেই কল পিকআপ করলে তোর এই ক্যাঁচক্যাঁচি গলাটা শুনতে পেতাম না। আর তুই জানিস, তোকে টেনশনে দেখতে আমি কতো ভালোবাসি!”

নোমান রাগ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ জানি আমাকে টেনশন না দিলে তোর একবেলার খাবার হজম হবে না। ওখানকার ওয়েদার কেমন?”

“ইটস অওসাম। ইয়াহাপার ঠান্ডে ঠান্ডে পানি ছে নাহানা চাহিয়ে!”

“যেটা বলতে তোকে কল করেছিলাম সেটা শোন!”

অভিরূপ মনোযোগী হয়ে বলল,
“ইয়েস স্যার, বলিয়ে!”

নোমান কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“কাল কোহিনূরের বোনের দেশে ফেরার কথা। সো মি. রায়ান কিছু এরেঞ্জ করেছে। আমাদের ইনভাইটেশনও দিয়েছে। তোকে কল করেছিল ধরিস নি তুই।”

“ওহ ইয়েস! শুটিং বিজি ছিলাম। পরে দেখলাম কল করেছিল।”

দায়সারা হয়ে জবাবে বলল অভিরূপ। তৎক্ষনাৎ নোমান আগুনশিখার ন্যায় জ্বলে উঠে বলল,
“কলব্যাক করতেও পারিস নি? তোর কেয়ারলেস ভাব কখনো যাবে না?”

“মনে হয় না!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নোমান। সে জানে এই ছেলেকে কোনোমতেই সে শুধরাতে পারবে না। তাই চেষ্টাও করতে চাইছে না। অপরদিকে ঠোঁট কামড়ে হাসি নিবারণ করতে গিয়ে শব্দ করে হাসে নোমানের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে। নোমান তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“তুই কি যেতে চাস ওখানে?”

অভিরূপ নীরব থাকে। স্মরণে আসে অতীতের কিছু কথা। মনে নাড়া দেয় মাটিচাপা দিয়ে রাখা কিছু যাতনা। নোমান তার উত্তর না পেয়ে বলে,
“তোকে ছাড়া আমার ওখানে গিয়ে ভালো লাগবে না। সো আমি তোকে নিতে আসছি আজই।”

অভিরূপ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“এই না না। তুই তোর বউকে ছেড়ে আমাকে নিতে আসবি! মাথা ঠিকঠাক আছে তো তোর? বিয়ে করেছিস বউয়ের দিকে নজর দে। নয়ত তোর বউ আমাকে সতিন ভেবে বসবে। আমি কিন্তু এসব চাই না।”

“আরে না। উর্মিলাই বলছিল তোকে নিতে যাওয়ার কথা।”

অভিরূপ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“যাই বলুক। আমি ওসব রিস্ক নিতে পারব না। আমার এত কেয়ার নেওয়ায় তোর বউ আমাদের ইয়ে না ভেবে বসে!”

নোমান ভ্রু কুঁচকাল। ব্যগ্র হয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ইয়ে?”

অভিরূপ ইতস্ততবোধ করে বলল,
“ইয়ে মানে গে…”

নোমান বিস্ফো/রিত কণ্ঠে বলল,
“হোয়াট দ্যা…! রাখ তুই ফোন রাখ।”

নোমান আর দেরিই করল না। কেটে দিলো কল। অতঃপর বড়ো একটা শ্বাস নিলো সে। কাপড় গোছাতে গোছাতে উর্মিলা নোমানের পাশে এসে নরম কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে? রেগে গেলেন কেন ওভাবে!”

নোমান নিজেকে সংযত করে বলল,
“তুমি জানো তো আমাকে রাগাতে কতটা পছন্দ করে সে। কীসব বলছে জানো?”

“কী বলছে?”

“বলছে যে আমি ওর বেশি কেয়ার করলে নাকি তুমি আমাদের ইয়ে ভাববে।”

উর্মিলার ভ্রুদ্বয় সংকুচিত হলো। নিজের চিকন ফ্রেমের চশমাটা ঠিকঠাক করে চোখে লাগিয়ে বলল,
“ইয়ে মানে?”

নোমান গলা খাঁকারি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। বলতে অস্বস্তি লাগছে তার।
“আরে ইয়ে!”

“কী ইয়ে?”

নোমানের রাগ লাগল এবার। ঠোঁট ভিজিয়ে জোর গলায় বলল,
“তুমি নাকি আমাদের গে ভাববে!”

উর্মিলা থতমত খেল। বিষম উঠে গেল তার। কিছুক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে চলে গেল সে। নোমান বসে রইল গালে হাত দিয়ে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বেড থেকে নেমে বারান্দায় গেল নোমান। উর্মিলা তখন কাপড় মেলে দিতে ব্যস্ত। নোমানকে দেখে উর্মিলা আনমনে বলল,
“তাহলে অভিরূপ ভাইয়া ভালোই আছেন তাই না? আগের মতো প্রাণোচ্ছল হয়েছেন।”

নোমান কিছুটা ভেবে উত্তর দিলো,
“আমার সেটা মনে হয় না উর্মিলা। সে যেটা দেখাচ্ছে ভেতরে সে ততটাই বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সে ভালো আছে রূপার জন্য। রূপা ওকে ভালো থাকতে তাই সে চেষ্টা করছে ভালো থাকার।”

“তাও ভাগ্য সহায় ছিল। সেকারণে উনার মেন্টাল কন্ডিশন নরমাল হয়েছে। তাও পুরো ছয়মাস ট্রিটমেন্ট করার পর।”

নোমানের খারাপ লাগে ভীষণ। বুকটা ভার হয়ে আসে। আফসোস করে বলে,
“যদি ওর মস্তিষ্ক থেকে সেসব স্মৃতি মুছে ফেলা যেত তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি আমি হতাম।”

উর্মিলা কাপড় বালতিতে রেখে দিয়ে নোমানের সংলগ্নে এসে স্থির হলো। নোমানের বাহুতে হাত রেখে মলিন সুরে বলল,
“যেটা সম্ভব নয় সেটা ভাবতে নেই। আফসোস আরো দৃঢ় হয়।”

নোমান আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। দুহাতে জড়িয়ে তার ভরসার মানুষটার কাঁধে নিজের থুঁতনি ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। উর্মিলাও নির্বিঘ্নে তার প্রিয় মানুষটির পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগল।
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ (২য় খণ্ড)
[অন্তিম পর্বের শেষাংশ ১]

বাড়িতে এসেই ফিওনা আর রিওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। রিও আর ফিওনা আগের চেয়ে অনেক বড়ো হয়েছে। শরীরের গঠনের পরিবর্তন হয়েছে। শরীর চওড়া হয়েছে। গায়ের লোমগুলো তুলনামূলকভাবে বড়ো হয়েছে। রাগিনীকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ছুটে এলো রিও দৌড়ে। রাগিনীর পায়ের সাথে গা ঘেঁষে আহ্লাদী আচরণ করতে লাগল সে। রাগিনী হেসে দিয়ে নিচু হয়ে বসে রিওকে কোলে নিতেই রিও জিহ্বা বের করে রাগিনীর গালে ঠেকিয়ে লেহন করে দিলো। রিও আর ফিওনার তুলো দিয়ে তৈরি ছোট্ট ঘরের দিকে তাকাল রাগিনী। ফিওনার চাঞ্চল্য কমে গিয়েছে বেশ ক’দিন ধরেই। সে জানে এই চটপটে স্বভাব কমার কারণ। রিওকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে তুলোর ঘরটাতে বসিয়ে দিয়ে ফিওনার মাথাতেই হাত বুলিয়ে দিলো সে। হাসি মুখে বলল,
“আমি জানি তুমিও মা হতে যাচ্ছো। তোমার জন্যও সময়টা অনেক কঠিন ডিয়ার ফিওনা। কিন্তু তোমার যত্নের কোনো কমতি হবেনা।”

ফিওনা রাগিনীর পানে তুষ্টি নিয়ে তাকাল। তারপর কয়েকবার ডেকে উঠল। দরজা খোলার আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই রিও তৎক্ষনাৎ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেন তেড়েফুঁড়ে গেল দরজার দিকে। তার এমন হা/মলে পড়া দেখেই রাগিনী বুঝে ফেলল কোহিনূর এসেছে। উঠে দাঁড়াল রাগিনী। কোহিনূর ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়েছে রিও-এর খামচে দেওয়ার ভয়ে। রাগিনী নরম সুরে রিও-কে ডেকে বলল,
“রিও! কাম হেয়ার!”

রিও পেছন ঘুরে ছুটে এলো রাগিনীর কাছে আর রাগিনী তাকে নিজের কাছে তুলে নিতেই কোহিনূর আবারও ঘরে এসে রিও আর ফিওনার খাবার নিতে রাখতে রাখতে বলল,
“এতগুলো দিন পেরিয়ে এলো এই বদ বিড়াল এখনো আমাকে সহ্য করতে পারে না। সো মি. রিও আপনার কোন পাকা ধানে আমি মই দিয়েছি?”

বলেই রিও-এর গাল টেনে দিতেই রিও আরো ক্ষেপে উঠল। রাগিনী রিওকে সামলে বলল,
“গিভ হিম রেসপেক্ট। সেও কিন্তু বাবা হতে যাচ্ছে।”

কোহিনূর প্রফুল্লচিত্তে বলল,
“ওহ রিয়েলি! মি. রিও তুমিও বাবা হতে যাচ্ছো, আমিও বাবা হতে যাচ্ছি। অন্তত এই সূত্রে হলেও চলুন ফ্রেন্ডশীপ করে ফেলি!”

কোহিনূর রিও এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে রিও নিজের সামনের এক পা বাড়িয়ে দিয়ে কোহিনূরের হাত ঠেলে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় সে কোহিনূরের সঙ্গে কোনোমতেই বন্ধুত্ব করতে চায় না। রিও আর কোহিনূরের এমন কাণ্ড দেখে শব্দ করে হাসল রাগিনী।

চা শেষ করে হাতে ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে ঢুকল অভিরূপ। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে নিজের লাগেজ খুলে টিশার্ট খুঁজতে লেগে পড়ল। এটা ওটা ঘাঁটতেই আঁড়চোখে তাকাল দেয়ালের দিকে। চোখ বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করল,
“কী দেখছ এভাবে?”

সে জানে নিজের করা প্রশ্নের উত্তর সে পাবে না। তবুও মুখ থেকে হাসি সরে গেল না তার। বরং ঠোঁটজোড়া আরো খানিকটা প্রশস্ত করে গ্রীন কালার একটা টিশার্ট বের করে দেয়ালের দিকে দেখিয়ে বলল,
“এটা কেমন লাগবে আমাকে? মানাবে?”

পুরো ঘর নিস্তব্ধ। নেই অভিরূপ ছাড়া অন্য কারোর অস্তিত্ব। তবুও অভি প্রশ্ন করা বন্ধ করছে না। উত্তর পাচ্ছে না তবে নিজের মতো উত্তর সাজিয়ে নিচ্ছে।
“ভালো লাগছে না তাই না? ওকে দেন ডার্ক ব্লু কেমন লাগছে?”

কিছুক্ষণ থেমে অভিরূপ আগ্রহ নিয়ে বলল,
“ভালো লাগছে? ওকে তাহলে এটাই ফাইনাল।”

মুখ থেকে কথা শেষ হওয়ার পরপরই মুখ থেকে হাসি বিলীন হলো অভিরূপের। উজ্জ্বল মুখটাতে দেখা দিলো বিষণ্নতার আঁধার। স্তব্ধ হলো সে। টিশার্টটা আস্তে করে হাত থেকে ফ্লোরে পড়ল তার। ধীর এবং এলোমেলো পায়ে দেওয়ালের কাছে গিয়ে সেখানে লাগিয়ে রাখা বড়ো ফ্রেমের ছবিটাতে থাকা রমনীর গালে হাত ছুঁইয়ে দিতেই মস্তিষ্কে পরিপূর্ণ হলো যন্ত্রণা। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর এক তীব্র ব্যথা। ধপ করে নিচে বসে পড়ল সে। ছবিটা রূপার আর অভিরূপের। ছবিতে তারা দুজন রিকশায় বসে। রূপা রাস্তার পানে তাকিয়ে আর অভিরূপ রূপার পানে। ছবিটার মধ্যে রূপাকে ইডিট করে বসানো হয়েছে। এই ছবিটা নিজের কাছে সবসময় রেখে দেয় অভিরূপ। অনুভব করে রূপাকে। একলা সময় ছবিতে থাকা নারীটির সঙ্গে কথোপকথন চলে তার। এভাবে হয় দিন আর রাত! রূপার ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময় যখন ফোনের শব্দ সেই কাজে ব্যাঘাত ঘটালো তখন বিরক্তি নিয়ে তাকাল অভিরূপ। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে মায়ের নম্বর দেখে রিসিভ করল সে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল।
“হ্যালো, অভি!”

“হ্যাঁ মা। বলো।”

“কেমন আছো? খাওয়াদাওয়া ওখানে ঠিক করে করছ তো?”

চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস. সুরভী। সঙ্গে সঙ্গেই অভিরূপ আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ফিকার না কারে, মাম্মা। আমি ঠিক আছি আর অনেক অনেক খাচ্ছি। যখন যা ভালো লাগছে তাই অর্ডার করছি বাট আইসক্রিম বাদে।”

“ওটা তো তোমার খাওয়া চলবেও না। গলা ঠিক রাখতে হবে তো।”

অভিরূপ কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
“গলা ঠিক রাখার চক্করে আমার ফেবারিট আইসক্রিম খেতে পারছি না। অনেক হয়েছে এত নিয়ম মানা যাচ্ছে না। তুমি আমার ফেবারিট ভ্যানিলা আইসক্রিম বানিয়ে রাখবে আমি বাড়ি গিয়ে সারাদিন আইসক্রিম খাব। ডিল ডান?”

মিসেস. সুরভী শব্দ করে হেসে বললেন,
“ওকে ডান।”

মিসেস. সুরভী আর কিছু বললেন না। হালকা কাশলেন। উসখুস করতে থাকলেন। অভিরূপ আন্দাজ করতে পারল তার মায়ের না বলা কথাগুলো। আগ্রহ নিয়ে বলে উঠল,
“আরো কিছু বলবে মা?”

মিসেস. সুরভী এবার বড়ো শ্বাস নিয়ে সাহস করে বলেই ফেললেন,
“আসলে, তোমার বাবার বন্ধু আছে না আব্রাহাম আংকেল বলে ডাকো? উনার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে। তাই তোমার আংকেল নিজে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।”

“আশা করছি তুমি আর বাবা তাদের মানা করে দিয়েছ!”

অভিরূপের কণ্ঠসুর মুহূর্তেই পাল্টে গেল। গম্ভীর এবং ভরাট কণ্ঠসুরে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মিসেস. সুরভী। তবুও তিনি বললেন,
“কী করে মানা করি এত সহজে, অভি? তুমি বোঝার চেষ্টা করো। মেয়েপক্ষ নিজে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আর লিমা মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী, পড়াশোনা জানে আর মডেলিং করে অনেক পরিচিতি তার।”

অভিরূপের চোয়াল শক্ত হলো।
“এটা কোথায় লিখা আছে যে মেয়েপক্ষ প্রস্তাব দিলে বারণ করতে নেই? আই হোপ, আমার সাথে কথা বলা শেষ করার পরই তুমি তাদের জানিয়ে দেবে বিয়েতে আমার ইন্টারেস্ট নেই।”

“তুমি কি আজীবন বিয়ে না করে থাকবে ওই মেয়েটার জন্য? তুমি একমাত্র ছেলে অভিরূপ। আমার সাধ তোমার বিয়ে নিয়ে। কত স্বপ্ন আমার! তোমার জন্য আমি নিজের স্বপ্ন পূরণ না করেই ম/রে যাব।”

মিসেস. সুরভী এবার আবেগঘন কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন। তাকে থামাতে অভিরূপ নরম হলো কিছুটা।
“কে বলেছে আমি বিয়ে করব না? আমি অবশ্যই বিয়ে করব। যেদিন আমার মনের কোনো স্থান রূপাঞ্জনা নামক মেয়েটার দখলে থাকবে না। যেদিন অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আমি মুগ্ধ হবো সেদিন সেই মুহূর্তে আমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করব।”

মায়ের উত্তরের প্রতীক্ষা করল না অভিরূপ কেটে দিলো কল। গলা দিয়ে কোনো শব্দ আর বের হতে চাইছে না। চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। উপরদিকে ছবিতে রূপার মুখের পানে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি জানি, অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আমি আর মুগ্ধ হতে পারব না। আর না রূপাঞ্জনা নামটা আমার হৃদয় থেকে মুছবে।”

রূপার হাসি মুখটা কল্পনা করল অভিরূপ। রেগে বলল,
তুমি হাসছ? আমি শুধু তোমার জন্য ভালো আছি। তুমি প্রতিদিন আমার স্বপ্নে এসে আমায় ভালো থাকতে বলো। বলে দিয়েছ, আমি ভালো থাকলে তবেই তুমি ভালো থাকবে। আমি ভালো আছি অনেক ভালো আছি।”

একটু থামল অভিরূপ। ফের নিজে নিজের প্রলাপ বকে বলল,
“সবাই জানে, অভিরূপ চৌধুরী নিজের জীবনে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অভিরূপ নিজে জানে সে এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সে তার প্রেয়সীর প্রাণহীন দেহটা দেখেছিল। অভিরূপ চৌধুরী! যাকে অনেক মেয়ে চায় কিন্তু সে এমন একটা মেয়েকে চেয়েছে যে কিনা তাকে এমনভাবে প্রত্যাখান করে দিয়েছে, তাকে জোর করে পাওয়ার রাস্তাও সে রাখেনি।”

নিচু হয়ে হাঁটুতে হাত রেখে নিচের মুখ লুকিয়ে নিলো অভিরূপ। কাটল বেশ কিছুক্ষণ। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই তার মুখের প্রতিক্রিয়া পাল্টে হাসতে দেখা গেল। উঠে গিয়ে নিজের গিটার বের করে রূপার ছবির সামনে চেয়ার নিয়ে বসে নিজের মতো সুর তুলতে তুলতে নিজেও চিকন সুরে গেয়ে উঠল,
“যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিলো নৌকার পালে চোখ রেখে,
যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিলো নৌকার পালে চোখ রেখে,
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো,
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো।”

শাওয়ার সেরে এসে বসতেই টাওয়াল হাতে নিয়ে রাগিনীর চুল সযত্নে মুছে দিতে শুরু করল কোহিনূর। রাগিনী মাথা আরো এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘কাল নয়ন ফিরছে?”

“হ্যাঁ সকালের ফ্লাইটে। আমি এয়ারপোর্টে যাব। ওকে নিয়ে আসব।”

রাগিনী মুহূর্তেই বায়না ধরে বলল,
“আমিও যাব!”

“এখান থেকে অনেকটাই দূরে এয়ারপোর্টে। তোমার যাওয়ার দরকার নেই।”

রাগিনীর রাগ হলো এবার। তেতে উঠে বলল,
“আপনি না নিয়ে গেলে একাই চলে যাব। সবসময় আমাকে বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছেন।”

কোহিনূর অকপটে জবাব দিল,
“কারণ আমাদের বেবি তোমাকেও বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে।”

“তা বেবি পেটে থাকলে মাও বেবি হয়ে যায় এটা বুঝি এই বই থেকে জানলেন?”

চাদরের নিচ থেকে বইটা বের করে কোহিনূরকে দেখিয়ে দিলো রাগিনী। কোহিনূর থতমত খেয়ে রাগিনীর চুল মুছে দেওয়া বন্ধ করে দিলে রাগিনী খিলখিল করে হাসল। কোহিনূর আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,
“এটা কোথায় পেলে?”

“আপনি যেখানে রেখেছিলেন সেখান থেকে। এসব বই পড়তে পড়তে আপনি আমার জন্য অভার থিংক করতে শুরু করেছেন।”

কোহিনূর ‘কেয়ার ওফ মাদার অ্যান্ড বেবি ডিউরিং প্রেগন্যান্সি’ নামক বইটা ছোঁ মে/রে নিয়ে নিলো রাগিনীর থেকে। আর বলল,
“এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবেনা। যাও চিরুনি নিয়ে চুল ঠিক করে নাও।”

ভেংচি কেটে বেড থেকে উঠে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায় রাগিনী। হাতে চিরুনি নিয়ে শুধায়,
“নয়ন আসছে তবে রায়ান ভাই কি তার জন্য কোনো প্ল্যান করেছে?”

“উমম… ইয়াপ! ইটস স্পেশাল!”

রাগিনী আরো কিছু বলতে গেলে তার ফোনটা বেজে উঠল। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে গলা শুকিয়ে এলো তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কানে ধরে গম্ভীর গলায় বলল,
“হ্যালো!”

ওপাশ থেকে কিছু কথা শুনে ভেতর থেকে যেন সর্বস্বান্ত হয়ে গেল রাগিনী। হৃদয় থেকে র;ক্ত ক্ষরণ হতে লাগল একটু একটু করে। পায়ের জমিন যেন নরম হয়ে গেল। নড়বড়ে হয়ে পড়তে নিলে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলো সে। কোহিনূর ছুটে এসে রাগিনীর বাহু ধরতেই কল কেটে দিলো রাগিনী। নিজের স্ত্রীকে মুহূর্তের মাঝেই মূর্তির ন্যায় হতে দেখে অস্থির হয়ে কোহিনূর জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে রাগিনী? এমন করছ কেন? কী হয়েছে বলো আমায়!”

রাগিনী তবুও অনেকটা সময় ধরে চুপ করে রেখে থেমে থেমে কয়েকটা অক্ষর মাত্র উচ্চারণ করল,
“আমি এতিম হয়ে গিয়েছি আজ।”

আর একটাও কথা উচ্চারণ করল না রাগিনী। নিজেকে কোহিনূরের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে দরজার কাছে গুয়ে দাঁড়াল। পেছনে না তাকিয়ে আবার বলল,
“আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। আপনি গাড়ি বের করুন। লা/শ নিতে যেতে হবে।”

কোহিনূর ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কী করে হলো এমনটা বুঝতে পারছে না। রাগিনীর পিছু পিছু যেতে চেয়েও যেন গায়ে শক্তি হচ্ছেনা। নিজের উপর খানিকটা জোর খাঁটিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

খাটিয়াতে করে শাহ্ রাশেদের মৃ/তদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শেষ কার্য সম্পাদন করা হবে উনার। কোহিনূরও যাচ্ছে রাগিনীর বাবার খাটিয়া ধরে। বেশি মানুষ হয়নি বাড়িতে। কারণ সবাই জেনেছে মানুষটির অপরাধ সম্পর্কে। একজন অপরাধীর শেষ কার্যে কেউ আসবে না স্বাভাবিক। নিজের বাবাকে নিয়ে একবারের জন্য চলে যাওয়া একমনে উপরের করিডোর থেকে দেখছে রাগিনী। চোখে না রয়েছে কোনো অশ্রু, না রয়েছে কোনো প্রলাপ আর না করছে কোনো অভিযোগ। সে সম্পূর্ণ নীরব। এ যেন পাথরের হৃদয়! শাহ্ রাশেদ হার্ট অ্যাটাক করেছেন জেলেই এবং সঙ্গে সঙ্গেই মৃ;ত্যু ঘটেছে এমনটাই জানতে পেরেছে রাগিনী। আর পুলিশ তাকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছে। সেটা এখনো খোলার সময় পায়নি সে। চিরকুটের কথা মনে আসতেই হাতে ধরে রাখা চিরকুটের ভাঁজ খুলতেই নিজের বাবার চিরচেনা প্যাঁচানো হাতের লেখায় চোখজোড়া বিদ্ধ হয় রাগিনীর।
“আমি কখনো ভাবিনি আমার রাজকন্যার সুন্দর চোখজোড়া একদিন আমায় ঘৃ/ণায় বিদ্ধ করে ফেলবে। তোমার চোখে আমি সীমাহীন ঘৃ/ণা দেখেছি যেদিন সেদিনই আমার বাঁচার ইচ্ছে ম/রে গিয়েছিল। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি কত বড়ো ভুল করেছিলাম রূপার সাথে। কিন্তু উপলব্ধি করেও কোনো লাভ ছিল না। আমি অপেক্ষা করছি মৃ/ত্যুর। এই জ্বালা সহ্য হচ্ছেনা আমার। যেই ছোট্ট মুখে তুমি আমায় ছোটোবেলা থেকে ‘আই লাভ ইউ, বাবা ‘ বলতে ঠিক সেই মুখ থেকে ‘ আই হেইট ইউ’ শোনাটা আমার কাছে খুবই যন্ত্রণার ছিল। আমি আর কিছুই চাইনা। শুধু চাই আমার ছোট্ট মেয়েটা ভালো থাকুক। এটা ভেবে আমি খুবই খুশি যে কোহিনূরের মতো একটা ছেলের হাতে তোমায় তুলে দিতে পেরেছি। শুধু শেষ ইচ্ছে ছিল তোমার ওই মুখে যদি ‘আই লাভ ইউ, বাবা’ শুনতে পেতাম তাহলে আমার আর চাওয়ার কিছুই থাকত না। ভালো থেকো মাই প্রিন্সেস। আই লাভ ইউ মাই চাইল্ড!”

চলবে…

(বি.দ্র. অবস্থাটা এমন যে দুভাগ করার পরেও ফেসবুক সাপোর্ট করছে না। পোস্ট করার পর কেটে দিয়েছে। সম্পূর্ণ পোস্টে আসেনি। তাই আবারও দুভাগ করতে হলো। বাকিটা সকালে পাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ (২য় খণ্ড)
[অন্তিম পর্বের শেষাংশ ২]

রাগিনী চোখ বুঁজে নিলো। ঢল গিলে নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সব ক/ষ্টগুলো গিলে নিতে চাইল। শ্বাস ঘন হতে শুরু করল তার। চোখ খুলল সে। সামনে দেখতে পেল শামীমাকে। মলিন পানে শামীমার দিকে চাইতেই শমামীমা তার গালে হাত রেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“কষ্ট হচ্ছে?”

রাগিনী মাথা নাড়াল। তার কষ্ট হচ্ছে না। পরক্ষণেই শামীমা রাগিনীকে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। রাগিনী বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কেন কষ্ট হবে? উনাকে বাবা বলে আমি মানিই না। উনাকে আমি একজন অপরাধী হিসেবেই চিনি। আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।”

শামীমা বুঝতে পারলেন মেয়েটা নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে চাইছে না। কথা বাড়ালেন না তিনি। আগলে রাখলেন নিজের মেয়ের মতো আরেক মেয়েকে।

রাত হলো। ধরনী জুড়ে অন্ধকার নামল। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। ঘরে একা একা টেবিলের কাছের চেয়ারে বসে আছে রাগিনী। বেশ অন্যমনস্ক সে। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল কোহিনূর। প্রথমে বেডে চোখ বুলিয়ে রাগিনীকে দেখতে না পেয়ে টেবিলের দিকে তাকালে অগোছালো মানবীকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। কোহিনূর তার নিকটে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিষণ্ণ সুরে বলল,
“মন খারাপ? বাবার জন্য খারাপ লাগছে?”

রাগিনীর র;ক্তিম বর্ণের লোচন দুটো দুহাতে কচলে গমগমে আওয়াজে বলল,
“আমি কি বলেছি আমার মন খারাপ?”

রাগিনীর পাল্টা উদ্ভট প্রশ্নে কোহিনূর পাশে থাকা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রাগিনীর সামনা-সামনি বসল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি বললে তারপর আমাকে বুঝতে হবে?”

“সেটা কখন বলেছি?”

“বাবা মা/রা গিয়েছে তোমার। অথচ তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়তেও দেখিনি। কেন এভাবে নিজের কষ্ট লুকিয়ে যাচ্ছো? কী বোঝাতে চাইছ এভাবে তুমি? তোমার বাবা একজন অপ/রাধী সেকারণে তোমার তার মৃ/ত্যুতে কষ্ট হচ্ছেনা এটা বোঝাচ্ছ?”

রাগিনী প্রতুত্তরে কিছুই বলল না। নির্বাক ও নির্জীব হয়ে রইল সে। কোহিনূর বুঝল সে এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাইছে না তাই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলল,
“রাত হয়েছে অনেক। খেয়ে ঘুমাবে চলো। খাবার এনেছি আমি।”

বিছানায় রাখা খাবারের ট্রে হাতে নেওয়ার সময় কোহিনূর দেখল সে পানি আনতে ভুলে গিয়েছে। বিলম্ব না করে সে উঠে বাহিরের দিকে হাঁটা ধরে বলল,
“একটু ওয়েট করো। আমি পানি নিয়ে আসছি।”

কোহিনূর যাওয়ার সাথে সাথেই নিজের মাথা টেবিলে ঠেকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিলো রাগিনী। কিছু একটা মনে করে ফোনের লক খুলে ফোনের রেকর্ডিং অপশনে গেল সে। সেখানে তার কলে কথা বলা সমস্ত রেকড হওয়া থাকে অটোমেটিক। খুঁজে খুঁজে রাশেদ সাহেবের সঙ্গে বলা কলের কথোপকথন বের করল সে। রেকর্ড অন করতেই সে শুনতে পেল তার বাবার গলা। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল তার। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরল। তার বাবার গলার সুর যেন নিষ্প্রাণ এবং পাথর হয়ে যাওয়া রাগিনীকে জাগিয়ে তুলল।
‘পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের খাবার-দাবারেরও খেয়াল রাখবে। বাহিরে বেশি রোদে একদম ঘোরাঘুরি করবে না। রাত জাগবে না। সাবধানে রাস্তায় চলাফেরা করবে, ডিয়ার। আই লাভ ইউ মাই প্রিন্সেস!’

রাগিনী আর দমাতে পারল না নিজের ব্যথাগুলো। নিজের জন্মদাতা পিতাকে চিরজীবনের মতো হারানোর যাতনা সইতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো সে। আটকা আটকা গলায় বলল,
“আই লাভ ইউ, বাবা।”

রাগিনী কল্পনা করে নিলো তার বাবা এই মুহূর্তে থাকলে নিশ্চিত তাকে থামিয়ে বলতেন, ‘তুমি এখনো বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করো রাগিনী। বড়ো হয়েছ। একজন সাইকোলজিস্ট হয়েছ। সামনে মা হতে যাচ্ছো। এখনো আমার মেয়েটাই বাচ্চা রয়ে গেল।’

এসব মনে করে কান্নার বেগ বেড়ে গেল তার। সেই কান্নার আওয়াজ কোহিনূরের কর্ণগোচর হতেই দূরন্ত বেগে রাগিনীর কাছে ছুটে এলো কোহিনূর। চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল,
“কী হয়েছে রাগিনী?”

রাগিনী মুখে কিছু বলল না। তবে কোহিনূর শুনতে পেল তার ফোনে বাজতে থাকা রাশেদ সাহেবের বলা কথার রেকর্ড। সেটা শুনেই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে রাগিনীকে আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল সে। রাগিনী কিছু বলল না। নির্বিঘ্নে অশ্রুপাতের মাধ্যমে করতে থাকল নিজের কষ্টের নিবারণ। কোহিনূর নীরবে মাথা নুইয়ে রাগিনীর চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিতে ব্যস্ত রইল। মাঝে মাঝে কান্না করা ভালো। কান্না কষ্টকে হালকা করে। বুকের ভার কমে যায়। কোহিনূর রাগিনীকে আটকাবে না।

কেটে গেল আরো এক সপ্তাহ। প্রথম তিনদিন বেশ ভেঙে পড়লেও নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখায় রাগিনী এখন বেশ স্বাভাবিক হয়েছে। তাছাড়া কোহিনূরের হরহামেশাই রাগিনীকে হাসানোর চেষ্টায় এখন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে রাগিনী। আজকে নয়নতাঁরার দেশে ফেরার কথা। রেজাল্টের জন্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করেছে নয়ন লন্ডনে। তাই দেশে ফেরার ডেটও পিছিয়ে গিয়েছে কিছুটা। কোহিনূর সকাল সকাল অফিসে এলেও নিজের বোনকে নিতে যেতে হবে তাই দ্রুতই নিজের কাজ সেরে নিতে থাকল সে। একসময় নিজের কাছের ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে সে ব্যস্ত মনে ডেকে উঠল,
“মেহরাজ! গাড়ি বের করো। আমি বের হবো।”

মেহরাজের কোনো সাড়া পেল না কোহিনূর। কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলে অন্যকেউ একজন কোহিনূরের কেবিনের দরজা খুলে ধীর গলায় বলল,
“স্যার গাড়ি বের করব? আজ আপনি আবারও আমার নামের বদলে মেহরাজের নাম নিয়ে ফেলেছেন।”

থতমত খেয়ে তাকাল কোহিনূর। নিজেকে কোনোমতে সামলে জবাবে বলল,
“হ্যাঁ গাড়ি বের করো, মাহাদ। আমার বোন আসবে আজ। তাকে নিতে যাব।”

মাহাদ ছেলেটা সম্মতি জানিয়ে চলে যেতেই মাথা নুইয়ে কপালে হাত রাখল কোহিনূর। টেবিলে থাকা তার আর মেহরাজের একসঙ্গে তোলা ছবির ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আড়াই বছর কেটে গিয়েছে মেহরাজ। তুমি নেই এখানে। কিন্তু আমার প্রতিটা প্রয়োজনে আগে তোমার নাম উচ্চারিত হয় আমার মুখ দিয়ে। কিন্তু তোমার সাড়া আর পাই না। তুমি হন্তদন্ত হয়ে আর আমার কাছে আসো না।”
হাফ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কোহিনূর। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

একহাতে ট্রলি ব্যাগ এবং কাঁধে সাইড ব্যাগ। পিঠ বিস্তৃত তার চুল হাঁটার সাথে সাথে দুলছে। এপাশ ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে ভিড়ের মাঝে নিজের চেনা মানুষগুলোকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে নয়নতাঁরা। সুদীর্ঘ দুটো আঁখি উৎসুক হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার ভাই, প্রিয় ভাবীজান আর প্রিয় মানবটিকে। অবশেষে পেছন থেকে লম্বাচওড়া এবং প্রশস্ত মানুষকে কালো কোট পরিহিত দেখতে পেয়েই মুখে হাসিটা দীর্ঘ হলো তার। হাতের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে গেল সেদিকে। সময় না দিয়েই সেই লোকটির গলা ধরে ঝুলে পড়ে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“বিগ ব্রাদার! মে আ গেয়া!”

ফট করেই নয়নের এমন কাণ্ডে পড়ে যেতে নিলো কোহিনূর। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নয়নের হাত ধরে নিজের সামনে এনে শক্ত গলায় বলল,
“আসার সাথে সাথে শুরু করে দিয়েছ? কখনো বদলাতে পারো না তুমি?”

নয়নতাঁরা ফট করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে থাকা রাগিনীর কাছে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে বলল,
“তুমিও তো আসার সাথে সাথে শুরু করে দিয়েছ। তুমি কখনো বদলাতে পারো না?”

“আমি কী শুরু করে দিয়েছি?”

ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল কোহিনূর। নয়ন সাথে সাথে ভেংচি কেটে জবাবে বলল,
“ওইযে তোমার কড়া গলায় ক্যাঁচক্যাঁচ কথা।”

কোহিনূর চোখ গরম করে তাকালে রাগিনী দুজনকেই বাঁধা দিয়ে বলল,
“আসার সাথে সাথে দুজনকে এখানেই শুরু হয়ে যেতে হবে?”

নয়নতাঁরা ফের কোহিনূরকে মুখ ভেঙ্গিয়ে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে নিজের ভাবীজানকে উষ্ণ আলিঙ্গন করে বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, মাই ডিয়ার ভাবীজান! ছোট্ট পুচকি আসতে চলেছে বাড়িতে। আমাকেও কংগ্রাচুলেট করো। আমিও তো ফুপি হতে যাচ্ছি।”

“কংগ্রাচুলেশনস নয়ন!”

নয়নের হাত ধরে বলল রাগিনী। তাদের কথোপকথনের মাঝে ঢুকে কোহিনূর দৃঢ় গলায় বলল,
“আমাকেও তো কেউ কংগ্রাচুলেশনস বলো। আমিও তো বাবা হতে যাচ্ছি নাকি!”

কোহিনূরকে নয়ন একহাতে ঠেলে দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“সো হোয়াট? আই ডোন্ট কেয়ার!”

কোহিনূর আরো কিছু বলতে উদ্যত হলে নয়নতাঁরা আশেপাশে তাকিয়ে কাঙ্ক্ষিত আরেক ব্যক্তিকে না পেয়ে ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল,
“আচ্ছা আর কেউ আসেনি আমায় নিতে?”

“কেন আর কারোর কি আসার কথা ছিল নাকি?”

রাগিনীর এমন কথায় বিব্রত হয়ে পড়ল নয়নতাঁরা। অসহায় দৃষ্টিপাত করল সে তার ভাবীর দিকে। অন্তত তার তো জানার কথা সে কার কথা বলছে। সেও জানে না? তবে ভাই থাকার কারণে মুখ ফুটে কিছু বলতে চাই না আর।
“না তেমন কারোর তো আসার কথা ছিল না। ওই আরকি!”

“তাহলে বাড়ি যাওয়ার যাক চলো।”

নয়নতাঁরার লাগেজ নিজের কাছে টেনে নিয়ে ব্যস্ত সুরে বলল কোহিনূর। নয়নতাঁরা এবার অপ্রসন্ন হয়ে সম্মতি জানালে এয়ারপোর্ট থেকে বাহিরে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করল তারা। কোহিনূর হাঁটছে আগে আগে। নয়ন আর রাগিনী পিছু পিছু। হাঁটার মাঝে কোহিনূর একটু পরপরই পিছু ফিরে তাকাচ্ছে রাগিনীর দিকে। মেয়েটা ঠিক করে হাঁটছে কিনা সেটা দেখার জন্য। সেটা লক্ষ্য করে নয়নতাঁরা বলল,
“ভাবী হয় আমার। তোমার বেশি খেয়াল রাখছি। তুমি সামনে তাকিয়ে হাঁটো।”

“বউ হয় আমার। দরকার পড়লে ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারি।”

নির্লিপ্তে বলা কোহিনূরের কথায় নয়ন বিরক্তির রেশ ধরে বলল,
“আমার গায়ে শক্তি নেই বলে এভাবে বলছ?”

কোহিনূর উত্তর দিলো না আর। নয়নতাঁরা রাগিনীর কানের কাছে মাথা নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“সত্যিই কি তিনি আমায় রিসিভ করতে আসেন নি?”

রাগিনীর হাসি পেল ভীষণ। তবে সেটা কোনোমতে চেপে রেখে গম্ভীর হওয়ার প্রচেষ্টা করে প্রতিত্তোরে বলল,
“কার কথা বলছ তুমি তখন থেকে বলো তো?”

নয়নতাঁরা আরো একবার বিষণ্ণ হলো। ফ্যাকাসে হলো উজ্জ্বল মুখ।
“না কারোর কথা না। চলো।”

দীর্ঘদিন পর সেই চেনা বাড়িতে ফিরল নয়নতাঁরা। তবে চটপটে নয়নতাঁরা হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। অথচ এয়ারপোর্টেও সে ছিল চটপটে। ভার মুখে গাড়ি থেকে নামল সে। একবার দেখে নিলো নিজের বাড়িটা। মনে আসছে বারবার ইন্সপেক্টর রায়ানের কথা। মিসেস. রমিলা তার সঙ্গে রায়ানের বিয়ে ঠিক করেছিল ঠিকই কিন্তু রায়ান বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলেনি। তাদের যতবার ফোনে কথা হয়েছে ততবার রায়ান পড়াশোনা আর খাওয়াদাওয়া ব্যতীত কিছুই বলেনি। আর বিগত কয়েকদিন ধরে যেন নয়নের ফোন কলও এড়িয়ে চলছিল রায়ান। নয়নের মনে হলো রায়ান হয়ত তাকে ঠিক করে মেনে নিতে পারছে না অথবা পছন্দ করে না। এসব ভাবনা আসতেই মন বিষিয়ে গেল তার। তার ভাই আর ভাবী বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। নিজের ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে এলোমেলো পায়ে প্রবেশ করল সে। সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখমুখ জড়িয়ে গেল তার। মাথা চুলকে চিৎকার দিয়ে বলল,
“বিগ ব্রাদার! বাড়িটা এমন অন্ধকার বানিয়ে রেখেছ কেন? না জানালা খুলে রেখেছ আর না লাইট দিয়ে রেখেছ! আশ্চর্য তোমার কর্মকাণ্ড! এই অন্ধকারে চলতে গিয়ে ভাবীজান যদি পড়ে যায় কী হবে?”

কথাগুলো বলতে বলতে হাতড়ে লাইট খুঁজতে থাকল নয়নতাঁরা। কাঙ্ক্ষিত স্থানে যাওয়ার আগেই ঝলমলিয়ে উঠল আলো। চোখমুখ খিঁচে বুঁজে নিলো নয়ন। আস্তেধীরে নেত্রপল্লব মেলতেই স্তব্ধ হলো সে লোকজনের সমাগম দেখে। বাকহারা হয়ে দেখল মিসেস. রমিলার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সেই সাথে কোহিনূর এবং রাগিনীকে। তাদের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে উর্মিলা আর নোমান। আর সবার মাঝে দাঁড়িয়ে নয়নের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। এত প্রতীক্ষার পর নিজের মনের মানুষের দেখা পেয়ে যেন অশ্রু ধরে রাখতে পারল না সে। রায়ান একটু একটু করে এগিয়ে এলো তার দিকে। নয়নে হৃৎস্পন্দনের গতি দ্রুত বাড়তে থাকল। সকল প্রতিক্রিয়া মিলে একাকার হয়েছে তার। রায়ান বিনীত সুরে জিজ্ঞাসা করল,
“কেমন আছো, তাঁরা?”

শুকনো ঢক গিলে নয়ন অভিমান করে উত্তর দিলো,
“জানি না।”

“তোমার খবর তুমি জানো না? তাহলে আমার খবর রাখবে কী করে?”

নয়ন তেজি গলায় জবাব দিলো,
“আপনার খবর আমি রাখতেও চাই না। আমাকে আপনি একটুকুও সহ্য করতে পারেন না তাই না? সেকারণেই এয়ারপোর্টে নিতে আসেননি।”

রায়ান এবার নয়নের মাঝে অভিনিবেশ করল। ভালো করে পরখ করল মেয়েটির মাধুর্য। তার কথায় এবং কাজে চাঞ্চল্য রায়ানকে উৎকণ্ঠিত করে তোলে। হয়ত মায়ের সিদ্ধান্ত ভুল নয়। এই মেয়েটাই তার জীবনের আলো! সেই ছোটোবেলা থেকে নয়নের প্রতি তার অধিক আগ্রহ সবাইকে তাক লাগাত। সেই আগ্রহ তখন আকর্ষণ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন নয়নের নিজের মনের কথা ইনিয়েবিনিয়ে বলার চেষ্টা করার ভঙ্গি বেশ কাছে টানে। কখনো কখনো নিজের অজান্তে নয়নের মোহে আবিষ্ট হয়েছে সে। খুব গভীর চিন্তা করলেই বোঝা যায়।
“আমার আকাশটা খুব অন্ধকার। সেখানে চাঁদের মতো টিমটিম করে জ্বলছে আমার মা। যে খুব কষ্টে আমার আকাশটাকে সামান্য আলো দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার একটা সঙ্গী প্রয়োজন। একটা সন্ধ্যাতাঁরা ভীষণ দরকার। তুমি কি আমার আকাশের তাঁরা হবে? সকলের আগে দীপ্তিমান হবে তুমি, তাঁরা? আমার একমাত্র তাঁরা হতে কি তুমি রাজি?”

রায়ানের এহেন কথায় যেন নয়নের পায়ের জমিন কাঁপতে আরম্ভ করল। এ যেন তার দিবাস্বপ্ন! কথাগুলো বারবার কানে প্রতিধ্বনিত হওয়ায় পাগল পাগল অনুভূতি জাগল নয়নের মনে। রায়ান আবারও নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমার মায়ের বউমা হবে তুমি প্লিজ? নিজের জন্য কিছু চাই না। আমি আবার এত স্বার্থপর না। আমি শুধু আমার মায়ের জন্য একটা ছটফটে বউমা চাই!”

লজ্জাবতী নয়নতাঁরা ফিক করে হেঁসে দিলো। শোনা গেল বাড়ি ভর্তি লোকজনের হাসি। সকলের হাসিতে মুখরিত হলো পরিবেশ। নয়নতাঁরা এবার লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে নিলো। সবার সামনে রায়ান তাকে এসব বলছে! ভাবতে পারছে না সে। অতঃপর রায়ানের শীতল দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে নিজের কাঁপা হালকা ভিজে হাতটা রায়ানের হাতের উপর রাখল। খুশি, উচ্ছ্বাস যেন আকাশসম হলো তার। এই মানুষটিকে পাওয়া তার কাছে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। রায়ান নয়নের হাতটা সুন্দর করে নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে বলল,
“আমার একটাই দাবি। আমি যদি দশ বাচ্চার বাবাও হয়ে যাই তবুও যেন আমার তাঁরার চটপটে স্বভাব না কমে। তার এই চাঞ্চল্যতা আমি নিজের পুরো জীবন ভরে দেখে যেতে চাই।”

মৃদু হাসে নয়ন। একহাতে ফিওনাকে ভালো করে ধরতেই রায়ান ফের চিন্তিত হওয়ার ভান ধরে বলে,
“তবে হ্যাঁ, বলে তো দিলাম দশ বাচ্চার বাবা হওয়ার কথা। কিন্তু বাচ্চাগুলো তোমার স্বভাব যেন না পায়! তাহলে কিন্তু আমাকে হিমশিম খেতে হবে।”

বলেই শব্দ করে হাসতে শুরু করে রায়ান। নয়নতাঁরা চোখজোড়া সরু করে তার বুকে আলতো করে ধা/ক্কা দিয়ে বলে,
“পাঁজি পুলিশ!”

এবার সকলের মনযোগ কেঁড়ে নিলো এক গিটারের সুর। সিঁড়ির উপরের আড়াল থেকে ভেসে আসা সেই সুর তোলা মালিককে সকলে উপলব্ধি করতে পারলেও নয়নতাঁরা পারল না। এবার সুন্দর গানের গলা চমকে দিলো নয়নকে। মুগ্ধ করল সকলকে।
“কঠিন! তোমাকে ছাড়া একদিন,
কাটানো এক রাত
বাড়াও দুহাত,
হয়ে যাও বাঁধা বিহীন!
বলো! কবিতা হয়ে চলো।
বাগানে দাবানল, জমানো জল
হয় যেমন ঠিকানাহীন!”

মন দিয়ে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল অভিরূপ। প্রশস্ত হেসে তাকাল নয়নের দিকে। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে তাকিয়ে রয়েছে নয়ন। অভিরূপ এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নামতে নামতে আবার গেয়ে উঠল,
“ও চেয়েছি যতবারই, হয়েছে ছাড়াছাড়ি
মরেছি ততবারই, এসেছে এক বেদনা দিন।”

নিচে নেমে সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো অভিরূপ। সকলকে একসঙ্গে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। নয়নতাঁরা ছুটে এসে আগ্রহ নিয়ে বলল,
“আপনিও এসেছেন! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

“নো! তুমি বাস্তবেই আছো। যে আমাকে আর আমার গানকে এত পছন্দ করে তার বিয়ের আগে না এসে পারি?”

“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ!”

অভিরূপ নয়নতাঁরা সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ঘুরিয়ে রায়ানের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
“আমি এখন গান গাইব আর সবাইকে একসাথে গানে তাল মেলাতে হবে।”

সবাই হাসিমুখে সম্মতি জানালে অভিরূপ সহ সকলে গানে তাল মেলাতে আরম্ভ করলে সুন্দর হয়ে উঠল মুহূর্তটি। মুখরিত হলো পরিবেশ। উজ্জীবিত হলো আশপাশ। মাঝে রাগিনী ফিসফিসিয়ে বলল,
“নয়নকে দারুণ মানিয়েছে কিন্তু রায়ান ভাইয়ের পাশে।”

কোহিনূর খানিকটা ভাব নিয়ে বলল,
“দেখতে হবে তো কার বোন!”

রাগিনী মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকাল কোহিনূরের কথায়। অভিরূপকে একবার পরখ করতেই রূপাঞ্জনা নামটি স্মরণ হলো তার। আক্ষেপ নিয়ে আওড়াল,
“ব্যস…শুধু ওই মানুষটার পাশে যদি আমার বোনটাও থাকত তাহলে…”

“আবার সেসব ভেবে মন খারাপ করছ? এটা সম্ভব নয়।”

“মন তো মানে না, কোহিনূর।”

কোহিনূরের কথা অগ্রাহ্য করে বলে দিলো রাগিনী। মাথাটা আবার ভার লাগছে তার। ভার কমাতে তার সবচেয়ে জানা নিরাপদ স্থান কোহিনূরের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলো সে। তার একটাই চাওয়া! যারা চলে গিয়েছে তারা ওোরে ভালো থাকুক। আর যারা আছে তারাও ভালো থাকুক, প্রশান্তিতে কাটুক জীবন!

দিন ও রাত্রীর সন্ধিক্ষণ! অর্থাৎ গোধূলিবেলা! রাগিনী ঘরে রিও-কে নিয়ে পায়চারী করছে। ভাবছে কোহিনূরের কথা। লোকটা কিছুটা সময় আগে তড়িঘড়ি করে কোথাও বেরিয়ে গেল। বলেও গেল না কোথায় যাচ্ছে। কোহিনূর সচরাচর এমনটা করেনা। রাগিনীর প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পেরে সবসময় সে চেষ্টা করে যাতে রাগিনীকে চিন্তায় না পড়তে হয়। কিন্তু আজকে রাগিনীকে চিন্তায় ফেলেছে। দুবার কলও করেছে কোহিনূরকে সে। কোহিনূরকে কলে পাওয়া যায়নি। রিও-কে নিয়ে যেই না রাগিনী বিছানায় বসল টুং শব্দ করে মেসেজের টোনটা কানে পৌঁছায় রাগিনীর। দেরি না করে হাতড়ে ফোনটা নিয়ে কোহিনূরের নম্বর দেখে উত্তেজনা বাড়ল তার। মেসেজ ওপেন করতেই ছুটে গেল ঘাম।
‘আমি একটা বিপদে পড়েছি রাগিনী। প্লিজ এই ঠিকানায় চলে এসো!’

ঢক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে রাগিনীর। শ্বাসটা ঘন হলো তার। কম্পন ধরল সারা শরীরজুড়ে। শক্তি জুগিয়ে কোনোরকম উঠে বাহিরে বেরিয়ে গেল সে।

গাড়ি থেকল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তার একপাশে পকেটে দুহাত গুঁজে আকাশের দিকে স্মরণ করে গম্ভীর ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দেখা পেয়েই গেল রাগিনী। ড্রাইভারকে তখনি গাড়ি থামাতে বলল সে। গাড়ি স্থির হলেই নামতে দেরি নেই তার। ঝড়ের গতিতে গিয়ে কোহিনূরের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে কোহিনূরের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে কতগুলো প্রশ্ন করে ফেলল রাগিনী।
“কী হয়েছে আপনার? ঠিক আছেন? কীসের বিপদ হয়েছে?”

রাগিনীর কানের নিচে হাত রাখল কোহিনূর। নিজের শীতল দৃষ্টি দ্বারা শান্ত করল তাকে। শান্ত সুরে বলল,
“আমি ঠিক আছি রাগের রানি!”

“তাহলে বললেন যে বিপদ হয়েছে।”

কোহিনূর সায় দিয়ে বলল,
“হয়েছে তো। সেই দীর্ঘদিন আগেই বিপদটা ঘটে গিয়েছে। ঠিক এই জায়গায়, এই রাস্তায়, এই গোধূলি বেলায়!”

রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে চারিপাশটাতে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। রাস্তাটা তার ভীষণ চেনা। এই সেই রাস্তা যেই রাস্তায় কোহিনূরের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। প্রথম সাক্ষাৎ ছিল পাগলামিতে ভরপুর! সেসব কথা মনে হতে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল রাগিনী। হেসে দিয়ে বলল,
“আপনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ছিল তো এখানেই।”

“সেজন্যই তো ইচ্ছে হলো এখানে এসে তোমার সঙ্গে একটু স্মৃতিচারণ করতে।”

রাগিনী কোহিনূরের পেটে গুঁতো দিয়ে বলল,
“আমার সঙ্গে দেখা হয়ে আপনি বিপদে পড়েছিলেন?”

কোহিনূরের মৃদু হাসিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল রাগিনী। ফট করেই কোহিনূর তার চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে বলল,
“অবশ্যই। তবে সে এক ভয়ানক সুন্দর বিপদ! যেই বিপদে আমি সারাজীবন বাঁধা পড়তে চাই।”

রাগিনী মাথা নুইয়ে ফেলল। কোহিনূর তার হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
“আমাদের বেবি যখন বড়ো হবে তখন তাকে এখানে নিয়ে এসে বলব, জানিস, বাবা! তোর মা খুব ধুরন্ধর ছিল। আমি তাকে বাঁধতে এসেছিলাম আইনের দড়িতে। সে আমায় বেঁধে দিয়েছে ভালোবাসার দড়িতে।”

রাগিনী খুশির সঙ্গে রেগেও গেল। তেজ দেখিয়ে কোহিনূরকে আলতো ধা/ক্কা দিয়ে বলল,
“আপনিও বা কেমন অফিসার শুনি? আমাকে বাঁধতে এসে নিজে বাঁধা পড়ে গেলেন?”

কোহিনূর জবাবে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু কপালের বাম পাশে নিজের শুষ্ক ঠোঁটদ্বয়ের স্পর্শ ঠেকিয়ে দিলো। গরম শ্বাস উপচে পড়ল রাগিনীর কাঁধে। কোহিনূর নিজমনে বলল,
“এমনই ছিল এক দিন-রাত্রীর সন্ধিক্ষণ!
যেদিন আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গিয়ে পড়েছিল এক জীবন্ত কাঠগোলাপের উপর।
অতঃপর তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই হৃদয় পড়েছিল ভয়ানক বিপাকে!
সময়ের সঙ্গে সন্ধি হলো আমার হৃদয়ের সঙ্গে তার হৃদয়ের।
সেই যে বউরানি আমার জীবনে এলে,
আজীবনের জন্য আমার হলে।
গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে!”

….সমাপ্ত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here