নিয়তি পর্ব -০১

#নিয়তি
#নুসাইফা_আশরাফী_আনিফা
#সূচনা___পর্ব

সে ছিল অতি সাধারণ পরিবারের এক চমৎকার সুন্দরী তরুণী। তার ছিল কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা। পরিচিত হবার, প্রশংসা পাওয়ার লোভ যেন তার অস্থিমজ্জায় জড়িত। কিন্তু এসব পাওয়ার কোন উপায়ই ছিল না তার। স্বপ্ন জয়ের পথে পা দেবার আগেই পাড়ার বখাটে ছেলেদের চোখ পড়ে তার উপর। দারিদ্র্য পিতা উপায় না পেয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধানে নেমে পড়েন। যার তার হাতে তো তার আদরের একমাত্র ছোট্ট মেয়েটি কে তুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু বাঁধ সাধল অন্য জায়গায়। বিয়ের বাজারে যৌতুক বিহীন উপযুক্ত পাত্র পাওয়াই যেন দুষ্কর। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় দারিদ্র্য পিতা তার আদরের মেয়ের জন্য সঠিক পাত্রের সন্ধান পেয়েই গেলেন।

তার সকল আশা আনন্দ পরিচিতি ও প্রশংসা পাওয়ার কোন ধনী মর্ডান ছেলেকে বিয়ে করার স্বপ্ন যেন এখানেই ভাটা পড়ল। তাই স্কুলের সামান্য শিক্ষক হুজুর টাইপ ছেলেটির সাথে বিয়ে সে স্বীকার করে নিয়েছিল। তবুও প্রায়ই তার মনে সর্বদা বেদনা ভরা দুঃখ আর বেপরোয়া সব স্বপ্ন জেগে উঠত। সে ভাবত ফেলে আসা তার স্বপ্নগুলো নিয়ে। এসএসসি পরীক্ষার পর ভালো একটা কলেজে ভর্তি হবে। সেখানে মেয়ে বন্ধুদের পাশাপাশি থাকবে তার অনেক ছেলে বন্ধুও। তাদের সাথে গল্প আড্ডায় কেটে যাবে তার দিন। তার সদ্য জেগে ওঠা ছোট্ট কিশোর মনে যে আরো কত স্বপ্ন উঁকি দিত হয়তো তার হিসাব মিলবে না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দশম শ্রেণীতে পা রাখতে না রাখতেই তাকে বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে।

তার স্বামী নামের পুরুষটি ছিল বেশ চটপটে, বুদ্ধিমান আর মিশুক প্রকৃতির লোক। সে যেমন নম্র-ভদ্র, মানবিকতা সম্পন্ন তেমনি বেশ ধার্মিক আর দ্বীনদার এক পুরুষ। মায়ের পছন্দেই মেহজাবিন নামের মেয়েটিকে তার বিয়ে করা। স্বাভাবিক ভাবে তারও চাওয়া ছিল দ্বীনদার ধার্মিক কোনো নারীই হবে তার একমাত্র জীবনসঙ্গীনী। কিন্তু মায়ের যুক্তির কাছে সে পরাজিত। তাছাড়া ইস্তিগফারে পজেটিভ ফল আসায় বিয়েতে সে আর অমত করেনি। হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। বিয়ের পর না হয় মেয়েটিকে সে নিজের মতো করে গড়ে তুলার চেষ্টা করবে। আল্লাহ চানতো এই মেয়েটিই হয়তো হয়ে উঠবে তার মনের মতো বউ!

আজ তার বিয়ের প্রথম রাত। দরজাতে কয়েকবার টুকা দিয়ে সাড়া না পেয়ে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে সে, তারপর ছিটকিনিটা আটকে দেয়। খানিকপর এগিয়ে এসে গলা ঝেড়ে মেহজাবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আসসালামু আলাইকুম…।

মেহজাবিন বিরক্ত দুঃখ হতাশা ও নৈরাশ্যে কাঁদতে কাঁদতে একদম নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। সেই যে কতগুলো মেয়ে তাকে কনের সাজে এখানে বসিয়ে গেছে, এরপর কতটা সময় চলে গেছে তা সে বলতেই পারবে না। ফেলে আসা স্বপ্নগুলোকে হাতড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ধরূন আশপাশের সবকিছু ভুলে সে প্রায় অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অপরিচিত গলার আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙল। চট করে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই হাসিমাখা একখান মুখ দেখতে পেল।
-আ… আ.. আপনি ক..কে আপনি?

মেহরাব এই প্রথম স্বচক্ষে মেহজাবিনকে দেখল। মেহজাবিন কে এক পলক দেখেই মন থেকে মাশাআল্লাহ বলে উঠল মেহরাব!
-সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব জানো নিশ্চয়!
-জ…. জ্বি ওয়া…লাইকুমুস সালাম…

-ওহম.. জ্বি আমি মেহরাব। এবার নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ।
মেহজাবিন কোন উত্তর করল না।

মেহরাব বেশ কিছুক্ষণ ওকে পরখ করল। ও যে খুব নার্ভাস ফিল করছে সে বুঝাই যাচ্ছে। কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখের কোণে এখনও পানি টলমল করছে। সে এগিয়ে এসে মেহজাবিনের মাথায় হাত রেখে কিছু একটা বিড়বিড় করে পড়ে।

আঁতকে উঠে মেহজাবিন!
তা দেখে মেহরাব বলে,
-ভয় নেই….। আমায় তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। নাও ওয়াড্রবের দ্বিতীয় ড্রয়ারে তোমার প্রয়োজনীয় সব জিনিস রাখা আছে। ভালো একটা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নাও। এই নাও চাবি। মা-ই এটা তালা দিয়ে রেখেছেন। বলতে বলতে মেহরাব মেহজাবিন এর হাতে চাবিটা ধরিয়ে দেয়।
আর শুনো, ওয়াড্রবের ডান পাশে তোমার মোহরানার টাকাটা রাখা আছে। পরে তোমার সুবিধামতো রেখে দিও।

আজ পর্যন্ত বাবার কোন কথারই অবাধ্য হয়নি মেহজাবিন। এখানে আসার আগেও বাবা কিছু কথা বলেছিলেন তাকে। কথাগুলো বলার সময় সে তার বাবার মুখে দেখেছিল তৃপ্তির হাসি আর চোখে আনন্দের অশ্রু। বাবার বক্তব্য ছিল এরকম-
-মারে, তুই আমার সবচেয়ে আদরের মেয়ে, হৃদয়ের টুকরো! আল্লাহ তোকে সহীহ বুঝ দান করুন এই দোয়াই করি। এতো দিন তুই তোর বাবার স্নেহ-মমতার সুকোমল ছায়ায় বড় হয়েছিস। তোদের সুখ শান্তিই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের অভাব তোদের কখনো বুঝতে দেইনি। তোদের শিক্ষা দীক্ষা, চারিত্রিক সংশোধন ও উন্নতির একমাত্র জিম্মাদার ও দায়ী ছিলাম আমি, তোদের বাবা। আজ থেকে তুমি একটা নতুন সংসারে পা দিচ্ছো, সেখানে তোমার যাবতীয় স্বভাব চরিত্র চাল চলন আচার ব্যবহারের জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী মা…। আজ আমি তুমায় কিছু কথা বলব। এগুলোকে তুমি আদেশ বা উপদেশ যা ইচ্ছা মনে করতে পারো। আমি আশা করি আমার মেয়ে এই কথাগুলো মেনে চলবে ইনশাআল্লাহ….

-ওহম ,,,ওহম,,,
মেহরাবের হাঁচির শব্দে ভাবনার জগতে ভাটা পড়লো তার। নাহ সে তার বাবার সব কথা মেনে চলবে। বাবার মুখে সে সবসময় অমন হাসিই দেখতে চায়। আজ থেকে সে তার স্বামীর আদর্শ বউ হওয়ার চেষ্টা করবে ইনশাআল্লাহ..।এর জন্য যা যা করা লাগে সবি সে করবে। সে তাকিয়ে দেখলো মেহরাব সোফায় হেলান দিয়ে একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছে।

-জ্বি,,, হয়ে গেছে….! ফ্রেশ হয়ে মেহরাবের সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল সে।

মেহরাব বই থেকে মুখ তুলতে তুলতে বলল,
-কি হয়ে গেছে?
মেহজাবিনকে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বইটা সোফায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর বলল,
-তুমি আমার নামাজের সঙ্গী হবে। চলো দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তিনি মে আমাদের দুজনকে বৈধভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। বলে মেহরাব হাতটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
এরপর নামাজ পড়ে মহান রবের কাছে ওদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল।

মেহরাব এগিয়ে গেল ওয়াড্রবেরর দিকে। একটু পর দুটি প্যাক হাতে ফিরে এলো। হাত বাড়িয়ে একটি প্যাক মেহজাবিনকে দিয়ে অন্যটি বুকের সাথে আগলে রেখে, বলল,
-প্যাকটা খুলো মেহের……

মেহজাবিন চমকে উঠে বলে,
-আ.. আমার নাম মেহজাবিন, মেহের নয়!
-আমি জানি তোমার নাম মেহজাবিন। কিন্তু আমি তোমায় মেহের বলে ডাকব। এতো ফজিলতপূর্ণ আর খুব সহজ সুন্নাতটাকি ছেড়ে দেয়া যায়। মা আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর করে হুমায়রা বলে ডাকতেন জানো তো….?

মেহের চুপচাপ প্যকটি খুলতে লাগল,,
-এ..এটা….
-হ্যাঁ এটা জায়নামাজ বোরকা আর হিজাব। এগুলো বাসর রাতে তোমার স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার। কি গ্ৰহণ করবে না?

মেহের ওগুলোকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল গুমোট বাঁধা কষ্টে। আজ থেকে সে বন্দিনী। তাকে কোথাও বেরুতে হলে খালাম্মা সেজে বেরুতে হবে। বহু কষ্টে চোখের পানি ধরে রেখেছিল সে।

মেহরাব অন্য প্যাকটি বাড়িয়ে ধরে বলে,
-এতে কি আছে জানো?
-……
-এতে আছে পবিত্র কোরআন শরীফ। তুমি কোরআন পড়তে পারো?
-জ্বী,,,পারি কিন্তু…….
-আলহামদুলিল্লাহ.. আজ থেকে আমরা দুজনে মিলে পবিত্র কোরআন শরীফ সহীহ শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ….।
-জ্বি ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব..।

মেহরাব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-মেহের তোমার বয়সটা খুব অল্প। আচ্ছা তুমি এবার কোন ক্লাসে পড়তে?
মেহেরের চোখের পানি যেন আর বাঁধ মানতে নারাজ। হেঁচকি দিয়ে কান্না চলে এলো। ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছিল তার। কোনমতে বলল,
-কে..ক্লাস টেনে..

মেহরাব বলল,
-জানি তোমার চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। থাকারই কথা, এই বয়সটাইতো রঙিন। আমি আজ তোমার সব কথা শুনব, যদি তুমি বলো! আর আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব তোমার সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত করার। তার আগে লক্ষি মেয়ের মতো কান্নাটা বন্ধ করো প্লিজ..। যাও চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসো–আর আমি এই ফাঁকে দু’কাপ কফি করে নিয়ে আসি কেমন…!
এভাবে একে অন্যের সুখ দুঃখের কথা শুনতে শুনতে চলে গেল সেই রাত।

আজ তাদের বিয়ের তিনমাস পূর্ণ হলো। মেহজাবিন স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মেহরাবের জন্য কফি বানাতে গেল!
হ্যাঁ সেদিন মেহরাব তাকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল ধর্মীয় নির্দেশগুলো তাকে যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে। মেহের এখন পূর্ণ পর্দা করেই স্কুলে যায়। লেখাপড়া, নামাজ, নিয়মিত দুজন মিলে কোরআন তেলাওয়াত, সংসারের টুকিটাকি কাজ, শ্বাশুড়ির সেবাযত্ন, শ্বাশুড়ি আর মেহরাবের সান্নিধ্যে ভালোই কাটছে মেহজাবিনের দিন। এখন মেহেরের নিজের কাছে নিজেকে খুব সুভাগ্যবতী মনে হয়, যে তার মতো একটি মেয়ে মেহরাবের মতো খাঁটি দ্বীনদার পুরুষের স্ত্রী হতে পেরেছে।পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেমন লোহা সোনা হয়। তেমনি মেহরাবের ছোঁয়ায় সে যেন সঠিক পথের ঠিকানা পেল। ইসলামের ছায়াতলে যে এতো শান্তি তা সে এ বাড়িতে আসার আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। এখনকার মনের অবস্থা সে যেন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। সে এখন সহীহ শুদ্ধ ভাবে কোরআন শরীফ পড়তে পারে। নিয়মিত শ্বাশুড়ির সাথে নামাজ আদায় করে। তার মনের খুশির খুড়াকটা যেন সে পেয়ে গেছে। এখন পুরো বাড়িটা সে মাতিয়ে রাখে। এ যেন তার ছোট্ট সংসার।মেহেরের বাবাও ভীষণণ খুশি মেয়ের এমন পরিবর্তনে।

-আসসালামু আলাইকুম….. আপনার কফি..
বলে কফির কাপটা বাড়িয়ে ধরল মেহের।

কফিটা নিতে নিতে মেহরাব জবাব দিল,
-ওয়ালাইকুমুস সালাম…। জাযাকিল্লাহু খাইরান..
-ওয়া আংতুম ফা জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

-বাহ তোমার তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি। আলহামদুলিল্লাহ.. মুচকি হেসে বলল মেহরাব।
মেহজাবিন লজ্জাবনত মুখটা নিচু করল। তাকে মাথা নিচু করে নিজের হাত মুচড়াতে দেখে মেহরাব প্রশ্ন করল,
-কি, কিছু বলবে?
-হুম! চটপট জবাব মেহেরের।
-দাড়িয়ে না থেকে এখানটায় বসো…এবার বলো কি বলবে!
-না মানে…আ….আমি

(চলবে ইনশাআল্লাহ….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here