রিকশা পর্ব -০৪

#রিকশা
।।৪।।
মনে মনে নিজেই নিজের মুণ্ডুপাত করছিল শুভ্রা। সব দোষ ভেন্যুতে ঢোকার আগে সাজিয়ে রাখা রিকশাটার।
এখানে এই রিকশাটা সাজিয়ে রাখার কী দরকার ছিল? ওটা দেখেই না এলোমেলো হয়ে গেল শুভ্রা, মনে পড়ে গেল গত রাতে পাঠানো পারভেজের মেসেজটার কথা আর রিপ্লাই দিয়ে ফেলল সে!
শুভ্রার হাতে ফোন, মেসেজটা জ্বলজ্বল করছে, “কিছু বললে না তো? আমি কিন্তু আপুর সামনেই এসে কথা বলব তাহলে!”
ওদিকে শাহরিয়ারও বলল, “কই কিছু বলছেন না তো?”
কী লিখবে, কী বলবে শুভ্রা? শাহরিয়ার এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “সমস্যাটা কী হচ্ছে, খুলে বললে ভালো হতো বোধ হয়!”
“আমাকে একটু গেটের কাছে যেতে হবে!” মরিয়া হয়ে বলে ফেলল শুভ্রা।
“গিয়ে?”
“আমি আসছি এখনই। আপনি আবার আপুকে কিছু বলবেন না প্লিজ!”
সামান্য কৌতুক বোধ করল শাহরিয়ার। “কেন গেটের কাছে যাবেন, সেটা না বললে তো আমাকে বলতেই হবে!”
“প্লিজ!” কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল শুভ্রা।
“ওকে, আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে?”
“আমি এখনই চলে আসব! জাস্ট একজনের সাথে দেখা করব, একটু কথা বলব আর চলে আসব!”
“কে সে?”
বলবে কি বলবে না, ভাবতে একটা মুহূর্ত সময় নিল শুভ্রা। তারপর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দৃঢ় গলায় বলল, “আমার হাজব্যাণ্ড!”
“আপনার এক্স?”
“এক্স না।“ নিঃশ্বাস আটকে রেখে এক দমে বলে ফেলল শুভ্রা, “আপু আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলেছে। আমার ডিভোর্স হয়নি এখনো।“
“অ!” যেন সব কিছু বুঝে ফেলেছে এমনভাবে মাথা নাড়ল শাহরিয়ার। “তাহলে ফিরেই যখন যাবেন উনার কাছে…”
“আমি ফিরব না!” দৃঢ় গলায় বলল শুভ্রা।
“তাহলে আবার দেখা করার জন্য এত উতলা হচ্ছেন কেন?”
“আমার কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে ওর সাথে। আমার চলে আসার জন্য ও আমাকেই দায়ী করে। অথচ…”
“অথচ যখন চলে আসছিলেন তখন ফেরায়নি, তাই তো?”
চুপ করে রইল শুভ্রা। চোখের সামনে ভেসে ছবির মত ভেসে উঠতে লাগল টুকরো টুকরো কিছু দৃশ্য।
স্ট্রিপ টেস্টে পজিটিভ এসেছে শুভ্রার! কি দারুণ খুশি লাগছে!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ঘুমন্ত পারভেজের গায়ে হাত রেখে ডাকল, “এই উঠো!”
কোনো নড়াচড়া নেই পারভেজের। অধৈর্য হয়ে এবার ঝাঁকুনি দিলো শুভ্রা, “এই এই উঠো!”
এবার ঘুম ভাঙল পারভেজের। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “কী? কী? কী হয়েছে?’
ফিক করে হেসে ফেলল শুভ্রা। “কিছু হয়নি এখনো কিন্তু হবে! তোমার কী মনে হয় কী হবে, ছেলে নাকি মেয়ে?”
শুভ্রার উচ্ছ্বাস স্পর্শ করল না পারভেজকে, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী হবে? কী বলছ?”
“আরে এখনো বুঝতে পারছ না? আমি প্রেগন্যান্ট!”
শুভ্রা আশা করেছিল পারভেজও খুশি হবে তার মতই। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ আবার উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল পারভেজ।
“কী হয়েছে?”
“না, হিসাব করছিলাম কোথায় ভুল হলো! তুমি ঠিক দেখেছ তো?”
“হ্যাঁ!” অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে লাগল শুভ্রার, পারভেজ খুশি হচ্ছে না কেন?
“ভালো।“ নিষ্প্রাণ গলায় বলল পারভেজ, “কত দিন পার হয়েছে মনে হয়?”
“এই তো, এ মাসেই সাইকেল মিস করলাম!”
“যাক তাও ভালো, খুব বেশি দিন পার হয়নি!”
“তার মানে?”
“দেখো শু”, উঠে বসে ওকে বোঝাতে শুরু করেছিল পারভেজ, “আমরা এখনো সেটলড না। এখনো সব ফার্নিচার কিনে উঠতে পারিনি। আর এই ছোট্ট এক রুমে…”
“এই ছোট্ট এক রুমে আমরা থাকব না তো! উঠে যাব অন্য কোথাও! এখনো তো সাত আট মাস বাকি আছে! বড় ফ্ল্যাট একটা খুঁজে বের করতে পারবে না তুমি?’
“খরচ কত বেড়ে যাবে সেই চিন্তা করেছ? তার ওপরে ডেলিভারি খরচ…”
“এত চিন্তা করছ কেন? নাহয় উঠে যাব আমার ফ্ল্যাটে!”
“না।“ দৃঢ় স্বরে বলল পারভেজ।
“মানে?”
“মানে ওখানে উঠলে তোমাদের হুকুমদারিতে চলতে হবে। দুদিন পর পর আসবে তোমার বোন আর তোমাকে কান পড়া দিয়ে যাবে…”
“কী সব আজেবাজে বলছ?”
“আজেবাজে না, আমিই ঠিক বলছি!”
কিছু ক্ষণ গুম হয়ে বসে ছিল শুভ্রা। তারপর বলেছিল, “তাহলে কী করতে চাও এখন?”
বাইরে তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি পুরোপুরি। সময়টা সুবহে সাদিক।
কিছুক্ষণ আগেই ফজরের আজান দিয়েছে। শুভ্রাদের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিচে রাস্তায় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসা অন্ধকার ভেদ করে “ঘুম হতে নামাজ উত্তম” সেই আহবানে সাড়া দিয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।
সেই পবিত্র সকালে শুভ্রার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলেছিল পারভেজ, “আমি বলছিলাম কী, তুমি আরেকটা বার ভেবে দেখো একটু। তুমি তো পরেও আবার প্রেগন্যান্ট হতে পারবে। মনে করে নাও না এটা একটা এক্সিডেন্ট?”
ছিটকে সরে গিয়েছিল শুভ্রা। “তুমি কী বলছ এসব? তুমি আমার বাচ্চাকে খুন করে ফেলার কথা বলছ? ভাবতে পারছ? কী করে পারলে?”
“যার কোনো নাম নেই এখনো, যার কোনো শেপ আসেনি, যে এখন শুধুই একটা ব্লাড ক্লট…”
“ব্লাড ক্লট? ও আমার বাচ্চা!”
“যা খুশি কর গিয়ে তুমি!” রেগে উঠেছিল পারভেজ, “আমি কিছু জানি না! কী দিয়ে কী হবে…”
“কী স্ট্রেঞ্জ তুমি! আমার ফ্ল্যাটে ওঠার চেয়ে আমার বাচ্চাটাকে খুন করে ফেলা তোমার কাছে সহজ অপশন বলে মনে হচ্ছে?’
“আমার আমার করছ কেন? বাচ্চাটা তো আমারও!”
“একই কথা তো আমিও বলতে পারি! ফ্ল্যাটটা তো তোমারও! যা কিছু আমার তাই কি তোমার না?”
“না।“
“এত কমপ্লেক্স কেন তুমি?”
“কমপ্লেক্স না আমি প্র্যাকটিক্যাল। তোমার মতো ইমোশনাল ফুল না যে সামান্য একটা ভুলের জন্য সারাটা জীবন নষ্ট করব! আর এখন তো তোমার ক্যারিয়ার বিল্ড আপেরও সময়!”
“বাহ! কত ভালো আমার হাজব্যাণ্ড! সবাই বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপ দেয় আর তুমি…”
“প্লিজ, একটা সেকেণ্ড থট দাও!”
“সেকেণ্ড থার্ড সব থট দেওয়া শেষ আমার! আমি এই বাচ্চা রাখব। তুমি আমার সাথে থাকলে থাকবা। না থাকলে নাই।“
“আমি কোনো মানে বুঝলাম না। যে বাচ্চাকে এখনো দেখইনি তার জন্য এত বেশি মায়া পড়ে গেল তোমার? আমি না থাকলেও কোনো অসুবিধা নাই?”
“না নাই।“
“বেশ তোমার যা ইচ্ছা তুমি করতে পারো। আমি আর এসবের মধ্যে নাই।“ বলে শুভ্রাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছিল পারভেজ।
আর শুভ্রা পাথরের মূর্তির মত জানালার সামনে বসে ভোরের আলো ফুটে ওঠা দেখেছিল সেদিন। এত বিষণ্ণ, এত বিবর্ণ, এত প্রাণহীন, এতটা মন খারাপ করা ভোর বুঝি আর কখনো শুভ্রার জীবনে আসেনি এর আগে!
এর আগেও আসেনি, এর পরেও যেন কখনো না আসে।
সেদিনও কোনো বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই অফিসে গিয়েছিল পারভেজ। আর নিজের ভেতরেই শক্তি সঞ্চয় করেছিল শুভ্রা।
নিজে নিজেই খোঁজ খবর করছিল কোনো গাইনি ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায়, কোথায় চেক আপ ডেলিভারি করলে কম খরচে করা যাবে। “আজ থেকে যাবতীয় অনলাইন শপিং বন্ধ”, নিজেই নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিল শুভ্রা। আনফলো করে দিয়েছিল সব শাড়ির পেইজ, অবসর সময়ে যেগুলোতে ঘোরাঘুরি করা ছিল ওর প্রিয় কাজ।
ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া থেকে আর এক পয়সাও বাজে খরচ করা যাবে না। সব জমা হোক একাউন্টে।
সেদিন রাতে পারভেজ বাসায় ফেরার আগেই খেয়ে নিয়েছিল শুভ্রা, ঘুমিয়েও পড়েছিল দুজন দুপাশ ফিরে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই অভ্যাস বশত এদিক ফিরে পারভেজের গায়ের ওপরে পা তুলে দিয়েছিল ও, আর পারভেজও ঘুমের মধ্যেই বুকে টেনে নিয়েছিল ওকে।
প্রাকৃতিক নিয়মেই চেনা শরীরের চেনা আহবানে ঘুমের ভেতরেও সাড়া দিয়েছিল দুই নারী পুরুষ। ভালোবাসাবাসি শেষ হতে হতে দুজনেই যখন জেগে উঠেছে পুরোপুরি শুভ্রা ভেবেছিল সন্ধি করে ফেলবে।
কিন্তু নিয়তি বোধ হয় অন্য কিছুই চেয়েছিল ওদের জন্য!
(প্রিয় পাঠক, গল্পটি পড়তে ভালো লাগলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই “নাটাই ঘুড়ি”। লিংক কমেন্ট সেকশনে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here