রিকশা পর্ব -০৩

#রিকশা
।।৩।।
বড় হল ঘরটা গম গম করছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এসে ঢুকছেন। পুরো ভেন্যু নানা রঙের ঝলমলে শাড়ি, চকচকে অলংকারের উজ্জ্বলতা আর হাসিখুশি নারী পুরুষের কলকাকলিতে মুখরিত।
মাথার ওপরে বিজ বিজ জাতীয় একটা বিচিত্র শব্দ হওয়ায় মুখ তুলে উপরে তাকাল শাহরিয়ার। ড্রোন শট নেওয়া হচ্ছে।
মুখ নামিয়ে হাতে ধরে রাখা পেস্তা মালাইয়ের শরবতের গ্লাসে আলগোছে ছোট একটা চুমুক দিলো সে। ঢোকার পথেই সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে শরবতের গ্লাস।
শাহরিয়ার বসেছে এক পাশে রাখা একটা সোফায়। এ দিক থেকে দেখা যাচ্ছে অন্যদিকের সোফায় আম্মুর সাথে বসে আছে শায়লা আর তার ছোট বোন শুভ্রা।
মনে মনে হাসলো শাহরিয়ার। আম্মু ইন্টারভিউ নিচ্ছেন শুভ্রার।
উচ্চাভিলাষী পায়েলের সাথে বনেনি, পায়েল চলে যাওয়ার প্রায় চার মাস হয়ে গেল। এর মধ্যেই আম্মুর চেনা অল্প চেনা সবার কাছে পাত্রীর খোঁজ জানতে চাওয়া শেষ।
শায়লাকে কখন বলেছিলেন, জানে না শাহরিয়ার। তবে শায়লার হাবে ভাবে মনে হচ্ছে তার পক্ষ থেকে বেশ আগ্রহ আছে।
ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই সোফা বদলে এ পাশে এসে বসেছে শাহরিয়ার। আম্মুর বাছাবাছি পর্বে কোন গ্রেড পাবে শুভ্রা কে জানে?
তবে এটাও ভালো, এত অতিথিদের মধ্যে, অন্তত ব্যাপারটা অস্বস্তিকর হবে না।
এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে মাইক্রোফোনে। অতিথিদের খেতে বসার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
আম্মুর হাত নেড়ে ইশারায় এগিয়ে গেল শাহরিয়ার। আম্মুর চোখ মুখ উজ্জ্বল।
কী ব্যাপার, পছন্দ হয়ে গেছে নাকি মেয়ে?
খেতে বসা হলো এক টেবিলেই। এটাও গ্রিন সিগন্যাল হিসেবেই ধরা যায়, বুঝতে পারল শাহরিয়ার।
বার বার মেসেজ আসছে শুভ্রার ফোনে, লক্ষ্য করল সে। ফোনটা সাইলেন্ট করে সামনে রাখা কিন্তু এক এক বার ভাইব্রেশনে কেঁপে কেঁপে উঠছে আর অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার মধ্যেও।
শায়লা ফোনটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফোনটা নিয়ে কোলের ওপরে রাখা পার্সে ভরে ফেলল শুভ্রা। এতক্ষণে মেয়েটার মুখের দিকে ভালো করে তাকাল শাহরিয়ার।
গলায় ছোট্ট একটা চোকার, কানে রুবীর টপ আর হলুদ জামদানিতে ছিমছাম লাগছে মেয়েটাকে, দামি শাড়ি আর অলংকারের প্রদর্শনী অনুপস্থিত। পুরু মেক আপ নেই, লাল লিপস্টিক লাগানো পাতলা ঠোঁট জোড়া সুন্দর কিন্তু অস্থির, কেবলই নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে দাঁত দিয়ে। চোখের দৃষ্টি কেবলই এদিক ওদিক ঘুরছে।
ভালো করে খেতে পারল না মেয়েটা, শায়লা কড়া দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অল্প একটু ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে উঠে গেল। শাহরিয়ারের সাথে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলল শায়লা।
“আসলে ও একটু শাই টাইপের।“
“আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড!”
“তোমরা দুজন একটু হেঁটে আসবে নাকি সামনে থেকে?” শাহরিয়ারের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে দেখে তার মা কথাটা বলতেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল শায়লার, শাহরিয়ারের চোখ এড়াল না সেটা।
“তার কোনো দরকার নেই আন্টি, ও তো খুব ইন্ট্রোভার্ট! ওর আনইজি লাগবে…”
“তারপরেও আগের দিনকাল তো আর এখন নেই, একটু আলাদা কথা বার্তা হয়ে নেওয়া ভালো!”
“আন্টি আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে! আপনি পজিটিভ থাকলে আমাদের বাসায় কথা বলাই যথেষ্ট!”
“আমি মনে করছি না সেটা…”
আম্মুর কথার মাঝখানেই উঠে পড়ল শাহরিয়ার। ওদিকে এক পাশে শুরু হয়েছে নাচ।
গায়ে হলুদের আনন্দের মূল আকর্ষণ। শাহরিয়ার শুভ্রাকে আবিষ্কার করল সেখানে, নাচের দর্শকদের মধ্যে বসে আছে শুকনো মুখে।
শাহরিয়ারকে দেখে উসখুস করে উঠল মেয়েটা, ওর চোখ এড়াল না সেটা।
“আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না আসলে…এত মানুষের ভিড়ে…খুব সাফোকেটিং লাগছে…”
“আপনি চাইলে আমরা সামনে থেকে হেঁটে আসতে পারি!”
শাহরিয়ার কথাটা বলল কিছুটা কৌতূহল থেকেই। কোনো এক অজানা কারণে ওর কী সমস্যা সেটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে!
“না, আপু বকা দেবে!”
“বকা দেবে না, তোমরা ঘুরে আসো সামনে থেকে!” কথাটা বলল শাহরিয়ারের আম্মু।
“দেখি”, শুভ্রার গলার চোকারটা ঠিক করে দেওয়ার ভঙ্গিতে ওর কাছে এগিয়ে গেল শায়লা। আর সেই সুযোগে কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যথাসম্ভব ঠোঁট ফাঁক না করে বলল, “কোনো উলটাপালটা কিছু যদি বলেছিস, মেরে ফেলব একদম!”
খুব আস্তে আস্তে বলা কিন্তু তারপরেও শেষ তিন শব্দ কানে গেল শাহরিয়ারের। কৌতূহলের অন্ত রইল না তার।
কিনে দে কিনে দে রে তুই রেশমি চুড়ি,
নইলে করব তোর সাথে আড়ি…
গানের সাথে গ্রুপ ড্যান্স চলছে, শায়লা সমাদর করে বসার আসন জোগাড় করে দিলো শাহরিয়ারের মায়ের জন্য। নিজেও বসল তার পাশে চেয়ার টেনে।
নাচের দর্শকদের ভিড় ঠেলে বের হলো শুভ্রা আর শাহরিয়ার, মাথার ওপর দিয়ে আরো একবার বিজবিজ শব্দ করে উড়ে গেল ড্রোন। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা আর পেছনে ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে গানের শব্দ।
হল ঘর থেকে বের হতেই সামনে সুইমিং পুল, তার পাশে পাশে স্তম্ভগুলোর ওপরে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে প্রদীপ। হবু দম্পতির মঙ্গল কামনায় আলোর রোশনাই চারিদিকে, এত আলো আর এত আনন্দ, তবু কেন তার স্থায়িত্ব এত কম?
চোখে জল এলো শুভ্রার, না না ছি, এ সব কী ভাবছে সে, তার সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বলেই যে অন্যদেরও তাই হবে এমনটা তো নাও হতে পারে। সুইমিং পুলের পাশে প্রদীপসজ্জার দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্তরিক শুভকামনা করল শুভ্রা হবু দম্পতির জন্য, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এলো সেই প্রার্থনা, যাতে কোনো খাদ ছিল না।
‘হে আল্লাহ ওদের তুমি সুখে রেখো, ওরা যেন কখনো কষ্ট না পায়।“
ঘাম মুছে নেওয়ার অভিনয় করে হাতে ভাঁজ করে মুড়িয়ে রাখা টিস্যু তুলে আলগোছে চোখের কোণে জলের ফোঁটা মুছে নিল শুভ্রা, আপু এ কোন বিপদে ফেলল তাকে। কী কথা বলবে এখন এই লোকটার সঙ্গে?
“আপনি খুব ঘামছেন, এখানে কি খুব গরম লাগছে?”
লজ্জা পেয়ে গেল শুভ্রা, লোকটা এতক্ষণ কী বলল কিছুই তো শোনেনি সে। এদিকে ফোনের ভাইব্রেশনে আবারও কেঁপে উঠল পার্স।
“না, আয়্যাম স্যরি, আমি ঠিক আছি!”
পার্স খুলে ফোনটা বের করে মেসেজ চেক করল শুভ্রা, হায় খোদা, এ কি সর্বনাশ! কোন কুক্ষণেই যে পারভেজের মেসেজের উত্তর দিতে গিয়েছিল সে!
গত কাল রাতে এত দিন পর মেসেজ এসেছিল পারভেজের, শুভ্রাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করে। অন্তত শেষ একবার শুভ্রার সাথে দেখা করবার মিনতি করেছিল।
বুকের ভেতর থেকে অভিমান ঠেলে উঠেছিল শুভ্রার, কেন? এখন কেন?
এখন কেন এত সাধাসাধি? যখন পারভেজের কাছ থেকে একটুখানি সময় পাওয়ার জন্য, দুটো ভালো কথা শোনার জন্য তৃষিত চাতকের মত অপেক্ষায় থাকত শুভ্রা, তখন কোথায় ছিল ও?
একটু আগে যখন শায়লা তার কলিগদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল, একা বসে বোর হতে হতে কী মনে করে লিখে ফেলেছিল শুভ্রা, “এখন বিরক্ত করো না, আপুর সাথে গায়ে হলুদে এসেছি!”
“কোথায়?”
“হোটেল সোনারগাঁও।“
তারপর আর কোনো রিপ্লাই নেই। আধা ঘন্টা পর মেসেজ এলো, “আমি সোনারগাঁও এর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। প্লিজ আপুকে কিছু একটা বলে বের হও!”
ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে শুভ্রার। এ কি যন্ত্রণায় পড়া গেল?
হলরুমের গান ভেসে আসছে ক্ষীণ সুরে,
“কিনে দেবো, সাজিয়ে দেবো,
পরিয়ে দেবো তোকে রেশমি চুড়ি,
নিয়ে যাবো, শপিং করাতে
তোর কথা কখনো কি ফেলতে পারি?”
মিথ্যে, মিথ্যে! মিথ্যে কথা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি!
এ সব কিছু শুধু নিজের করে পাওয়ার আগে পর্যন্ত। নাহয় শুভ্রা যখন অসহায় হয়ে শুয়ে ছিল হাসপাতালের বিছানায়, তখন কোথায় ছিল পারভেজ?
(প্রিয় পাঠক, গল্পটি পড়তে ভালো লাগলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই “নাটাই ঘুড়ি”। প্রি অর্ডার লিংক কমেন্ট সেকশনে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here