#অতঃপর_সন্ধি (২০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো পুষ্পিতা। চেহেরায় ফুটে ওঠেছে স্নিগ্ধতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছিল তানজিফ।পুষ্পিতাকে দেখে বিস্তীর্ণ হাসলো সে। পুষ্পিতা তানজিফের সামনে এসে দাঁড়ায়। তানজিফ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, কী?
তানজিফের টাই বেঁধে দিতে দিতে নতজানু হয়ে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ফিরবি কখন?’
পুষ্পিতার ব্যস্ত, পিটপিট করতে থাকা চক্ষু জোড়ার পানে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো তানজিফ। শরীরের দূরত্ব একটু একটু কমছে।মনের দিক থেকে দূরত্ব কতটুকু কমেছে তা জানা নেই তার।
‘আগে ব্যাংকে যাবো। টাকা তুলবো তারপর যাবো মালামাল কেনার জন্য। সেগুলো শো-রুমে রেখে তারপর আসবো বাসায়। রাত দশটা বাজতে পারে।’
টাই বাঁধা হয়ে গেলে পুষ্পিতা আলমারির গোপন ড্রয়ার থেকে গয়নার বাক্স বের করে। গয়নার বাক্সগুলো তানজিফের হাতে দিলো সে।
‘তোর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুদ্ধে আমিও সঙ্গী হতে চাই।’
বাক্স হাতে নিলো সে। খুলে দেখল কি কি আছে। অতঃপর সেগুলো বিছানার উপর রেখে পুষ্পিতার একটা হাত আলতো করে নিজের মুঠোবন্দি করল। হাতের উল্টোপিঠে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল কোমলভাবে।
‘এই যে হাতের মালিক আমার হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরেছে শক্তপোক্ত করে অটল আর দৃঢ়ভাবে। এটাই ঢের। এটাই আমার অনেক বড় সাপোর্ট। আর কিছু লাগবে না। মানুষটা আমার পাশে থাকুক শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার আর কোনো চাওয়া নেই।’
‘রাখ না আপাতত। তোর একটু হেল্প হবে।’
পুষ্পিতার নাক টেনে দু কাঁধে হাত রাখে তানজিফ।
‘না ম্যাম লাগবে না। যদি কখনো লাগে তখন বলবো।’
তৎপরে পুষ্পিতাকে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ায়। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে দু’হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে দু’হাত মুঠোবন্দি করে নিলো পুনরায়।
‘ আরশীতে থাকা মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিস?সে আমার মনের রানী। দোয়া কর, মনের রানীকে যেন বাস্তবেও রানীর মতো সোনাগয়না দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে পারি। বহুদিনের সাধনা সে আমার।’
কপালের একপাশে দীর্ঘ চুম্বন করে স্থান ত্যাগ করে দ্রুত।
নিজের প্রতিবিম্বকে দেখতে ব্যস্ত পুষ্পিতা। লালাভ চোখ জোড়ায় পানি টইটুম্বর। উন্মুক্ত পাপড়িদ্বয় পানির ভার সইতে না পেরে মিলিত হতেই গাল আলিঙ্গন করলো বারিবিন্দু। বুক ভেঙে আসছে তার। আঙুল দিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে স্পর্শ করলো সে।
‘ভালোবাসার সমীকরণ মিলাতে তুই বড্ড আনাড়ি পুষ্পিতা। পাগলাটে ছেলেটার ভালোবাসা আগে উপলব্ধি করতে পারলে আজ এভাবে দগ্ধ হতি না প্রণয়ের দহনে। তুই পুড়তি না। সুখের জোয়ারে ভাসতে গিয়েও পারছিস না তুই। কোথাও কিছু একটা নেই। কিছু একটার শূন্যতা অন্তর্দেশে।’
_______________
ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত তানজিফ। ক্লান্তিতে মুদে আসছে চোখ জোড়া। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে বিছানার দিকে নজর বুলালো। ছটফট করছে পুষ্পিতা। বালিশ একবার মাথার উপর দিচ্ছে তো আরেকবার মাথার নিচে। কোনোমতে স্বস্তি পাচ্ছে না। তানজিফ ডাকল তাকে।
‘পুষ্পিতা?’
পুষ্পিতা ভারী গলায় জবাব দিলো, ‘হুম।’
‘কিছু হয়েছে তোর?’
খানিক চুপ থেকে উত্তর দিলো,
‘না।’
বিশ্বাস হলো না তানজিফের। পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। শরীরে ধূলোবালি গিজগিজ করছে বলে কাছেও যেতে পারছে না। তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খাটে এসে বসল তানজিফ। কয়েকবার ডাকল সে পুষ্পিতাকে। কোনো সাড়াশব্দ পেয়ে পুষ্পিতার গা স্পর্শ করল।
দৈবাৎ পুষ্পিতা ফুঁপিয়ে উঠে তানজিফের কোমর জড়িয়ে ধরল। হতবিহ্বল হয়ে গেলো তানজিফ। পুষ্পিতা জড়িয়ে ধরায় শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো তার। ফাঁকা ঢুক গিলে পুষ্পিতার মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে লাগে।
‘কি হয়েছে না বললে বুঝবে কিভাবে?’
কান্নার প্রভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুষ্পিতার শরীর।
জোর করে টেনে পুষ্পিতার মাথা উপরে তুলে তানজিফ।
ভেজা নেত্রচ্ছদ ফোলে আছে। কপালের ছোট ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা মুখ জুড়ে। নাকের ডগা লাল। বাদে বাদে নাক টানছে সে। এলোমেলো সেই চুল পরম যত্নে কানের পিছনে গুঁজে দিলো তানজিফ। মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে আহ্লাদী স্বরে সুধাল,
‘কাঁদছিস কেন?’
আরো একটু আহ্লাদ পেতেই পুষ্পিতার কান্না মাত্রা বাড়লো যেন।
‘মাথা ব্যথা করছে।’
গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছে দিয়ে পুনরায় তানজিফ বলল,
‘তাই বলে বাচ্চাদের মতো কাঁদবি?’
‘আর সহ্য করতে পারছি না।’
উষ্ম শ্বাস ফেলে তানজিফ।
‘দিনে কান্না করেছিলি কেন?’
দৃষ্টি নত করে ফেলে পুষ্পিতা। জবাব দিল না সে।
‘গত তিনটা মাস এক ছাদের নিচে থাকার পর তোর অনেক অভ্যাস বদ অভ্যাস সম্পর্কে অবগত হয়েছি আমি। কাঁদলে তোর মাথা করে। অনবরত কান্নার ফলে এখন তা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আচ্ছা বাদ দে। আম্মুকে বলেছিলি বা ঔষধ খেয়েছিস?’
এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে জবাব দিল, ‘না।’
তানজিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
‘কেন?’
‘সারাদিন বা সন্ধ্যায় এতো ব্যথা ছিলো না। রুমে আসার পর বেড়েছে।’
‘আমার বুকে মাথা রাখবি? আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো। দেখবি ঘুম চলে আসবে।’
তানজিফের মুখপানে চেয়ে রয় পুষ্পিতা। কোনো প্রকার জবাব ছাড়া। পুষ্পিতা জবাব না দেওয়াতে ফিচেল হাসলো সে।
‘থাক তবে। বুকে মাথা রাখতে হবে না। তুই তোর বালিশে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি মুভটা নিয়ে আসি আর লাইট অফ করে আসি। আলোতে ঘুম আসবে না তোর।’
লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে সে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসতেই একটু স্বস্তি পাওয়ার লোভে তানজিফের বুকের এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পুষ্পিতা। তানজিফকে কোনো কিছু ভাবার ফুরসত দিলো না । চোখ বুঁজে বলল,
‘আমি ঘুমাবো৷ ডাকবিনা একদম।’
আঙুলের ডগায় একটু মুভ নিয়ে পুরো কপালে মালিশ করে দিতে লাগল সযত্নে। মুভ দেওয়া শেষ হলে চুলে বিলি কেটে দিলো। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হতেই বুঝতে পারলো পুষ্পিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও চুলের ভাঁজ হতে হাত সরালো না তানজিফ। দগ্ধ, উত্তপ্ত বক্ষঃস্থলে শীতলতা বিরাজ করছে শুধু এই মেয়েটা বুকে মাথা রেখেছে বলে। বুকের ছাতির সাথে পুষ্পিতার মাথাটা আরো একটু চেপে ধরে।
‘মনের বিশাল দূরত্ব কমছে কি পুষ্প?’
______________________
খুব সন্তর্পণে পুষ্পিতাকে বালিশে শুইয়ে দিল তানজিফ। ল্যাপটপ নিয়ে বসল কি কি অর্ডার এসেছে তা দেখার জন্য। একের পর এক অর্ডারের মেসেজ দেখে ওষ্ঠদ্বয় প্রশস্ত তার। চোখেমুখে উৎফুল্লতা ছড়িয়ে পড়ে। কাল বিলম্ব না করে নিজের পার্টনারকে ভিডিও কল করে তানজিফ। সময়ও দেখলো না যে কত রাত হলো। রিসিভ হতে মৃদুস্বরে চিৎকার করে উঠলো সে। পুষ্পিতার কথা মনে পড়তেই সামলে নিলো নিজেকে।
‘দুস্ত অর্ডার দেখেছিস?’
আশিক উত্তর দিলো,
‘দুস্ত আমার তো চোখ কপালে। গতবারের চেয়ে বেশি। আল্লাহ এইবার মুখ তুলে চাইবে।’
কথা বলার মাঝেই ঘুমন্ত পুষ্পিতা পুনরায় তানজিফের কোমর প্যাঁচিয়ে ধরলো। ল্যাপটপের মৃদু আলোতে মেয়েলি হাত দৃষ্টিগোচর হতেই মুখ টিপে হাসল আশিক। অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করে তানজিফ।
‘তোদের রোমান্স দেখানোর জন্য আল্লাহ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। বন্ধু মানুষ বউ নিয়ে ঘুমায় আর আমি এখনো মোবাইল নিয়ে।’
‘চুপ শা’লা। আমি তোর মতো লু’চ্চা না। আগে বউ ভালোবাসবে তারপর,,,,,,,,,,,’
অপর পাশ থেকে তানজিফের দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে নিমেষহীন চেয়ে রইলো আশিক।
‘পুষ্পিতার উপর সম্পূর্ণ অধিকার তোর। কেউ একজন ছিলো কোনো এক সময় ওর জীবনে। তাই বলে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিবি? মানুষের শারীরিক চাহিদা বলতেও তো কিছু একটা থাকে নাকি?’
আশিকের কথায় ফিচেল, নিরস হাসলো তানজিফ। নেত্রপাত করল ঘুমন্ত পুষ্পিতার মুখপানে।একহাতে খুব সাবধানে আগলে নিলো পুষ্পিতাকে।
‘চাইলেই অধিকার ফলানো না।অধিকার আদায়ও করা যায়। কিন্তু অন্তর্দেশে অনুভূতির বীজ বপন করা যায় না। আমি চাই ও আসুক।আমার সাথে মিশে যাক। দু’জনের মধ্যকার কোনো দূরত্ব মিটে যাক। তবে সেটা সম্পূর্ণ পুষ্পিতার ইচ্ছেয়। শারীরিক চাহিদার অজুহাতে অধিকার ফলাতে গিয়ে ওর মনে নেতিবাচক কোনো ধারণা আমি দিতে চাই না।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে খুব সাবধানে পুষ্পিতা ঘনকালো কেশে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।
গালে হাত দিয়ে তানজিফের কথা মনযোগ দিয়ে শুনে গেলে আশিক।
আবছায়া আলোতে পুষ্পিতার দিকে চাহনি স্থির রেখে পুনরায় বলল,
‘আমার তো এখনো বিয়ে করার কোনো প্লানিং ছিলো না শুধু মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য শত পাগলামি। কবুল শব্দটাকে আমি খুব বিশ্বাস করি। এর অদৃশ্য এক শক্তি থাকে। যা দুই প্রান্তের দুজন মানুষকে রূপান্তর করে একজনে ।অচেনা অজানা মানুষের মধ্যে তৈরী করে ভালোবাসার বন্ধন। আমি অপেক্ষায় আছি, এই কবুল শব্দটার জোরে পুষ্পিতা আমার দু’টো হাত ধরে বলবে, আজ থেকে আমি শুধু তোর।’
আকস্মিক আবারও কেঁপে উঠল পুষ্পিতার শরীর। ভয় পেয়ে গেলো তানজিফ। আতঙ্ক, শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখ জুড়ে। চোখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দেখল নেত্রপল্লব ভেজা পুষ্পিতার। অজানা আতঙ্কে বুকটা ধঁক করে উঠে তানজিফের।
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।#অতঃপর_সন্ধি (২১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘পুষ্পি মাথা কি বেশি যন্ত্রণা করছে? এই পুষ্পি?’
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভীতি, অভিশঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে মনে। ভয়বিহ্বল হয়ে পড়ল সে। ওপাশ থেকে আশিকও আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে।
‘আশিক তোর সাথে পরে কথা বলবো।আজকের অর্ডারগুলো তুই হ্যান্ডেল কর।’ ব্যস্ত গলায় বলল তানজিফ।
পায়ের উপর থেকে ল্যাপটপ সাইডে রেখে পুষ্পিতা
কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সে। বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিলো সযত্নে।
‘আমি ঔষধ আনছি। ব্যথা কমে যাবে।’
পুষ্পিতা কে রেখে উঠতে নিলেই তানজিফের হাত খাঁমচে ধরলো সে।
‘কোথাও যাবি না তুই। আমাকে ফেলে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে তোর বুকের সাথে মিশিয়ে রাখ।তোর বুকে অনেক উষ্ণতা। অনেক শান্তি। এই শান্তি আর কোথাও নেই।’ আরো কিছু বলতে চাইলো পুষ্পিতা এর আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তানজিফের উন্মুক্ত বুকে।
কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা স্পষ্ট তানজিফের। চিন্তিত হয়ে পুষ্পিতার কপালে হাত ঠেকাল। এতোক্ষণ বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারলো পুষ্পিতা গায়ে জ্বর। জ্বরের প্রকোপে ভাট বকে গেলো সে। ফিচেল হাসলো তানজিফ।
‘সজ্ঞানে তোকে এসব বলেনি তানজিফ। এমন দিন আসতে অনেক দেরি। আদৌও আসবে কিনা সন্দেহ।’
________________
সকালের সোনালি মিষ্টি রোদ চিকচিক করতে চোখ পিটপিটিয়ে তাকাল পুষ্পিতা। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। রোদের ঝলকানিতে চোখ মেলে রাখা দায়। ভ্রু যুগল কুঁচকে মিটমিট করে চোখ একবার খুলছে তো আরেকবার বুঁজছে। আচমকাই পুষ্পিতার চক্ষু জোড়া বড় আর স্থির হয়ে গেলো। বালিশের জায়গায় তানজিফের প্রশস্ত বুক দেখে নিদ্রা উবে গেলো। তানজিফ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
নিশ্বাস নিচ্ছে না সে। যদি তানজিফ জেগে যায়। লজ্জা আর ত্রপা আঁকড়ে ধরলো তাকে। নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছে। তানজিফের বুক ছেড়ে আসতে চাইলো কিন্তু চেয়েও পারলো না। অদৃশ্য এক মোহ মায়ায় আটকা পড়ে গেলো। তানজিফের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। খুব কাছ থেকে এই প্রথম সে তানজিফকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগে।
দেয়ালঘড়ির দিকে নজর পড়তেই চোখ চরাক গাছ পুষ্পিতার। কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে। জিভে কামড় দিয়ে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে সে। পুষ্পিতা উঠার সাথে সাথে তানজিফও বসে পড়ে। আহাম্মকের মতো পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। বুকে জ্বালা করতেই উন্মুক্ত বুকে নেত্রপাত করল সে। পুষ্পিতার নখের আচরে চামড়া ছিলে গিয়েছে অনেকখানি। নাকমুখ কুঁচকে সামনের দিক তাকাতেই দেখলো পুষ্পিতার ছায়াটুকুও নেই।
________________________
পরোটা বাজছেন সুমনা এহমাদ। ডিম পোঁচ করার ফ্রিজ থেকে ডিম বার করতেই সামনে এসে পুষ্পিতা দাঁড়াল। এক কানে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে অপরাধীর স্বরে বলল,
‘স্যরি স্যরি মামনি। কিভাবে এতো বেলা হয়ে গেলো একেবারেই টের পাইনি।’
‘হয়েছে হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। এসব করেই মন গলাও।’
চমত্কার হেসে আফসানা হককে কিছু বলার আগেই পিছনে এসে দাঁড়ায় তানজিফ।
‘এতো তিরিং বিরিং করিস কেন? দেখি চেক করতে দে।’
তানজিফের উন্মুক্ত বুকে সদ্য দেওয়া আঁচড়ের দাগ দৃষ্টিগোচর হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সুমনা এহমাদ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
‘তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আসি। একটু পরে অফিসের সময় হয়েছে বলে চিৎকার করবে।’
দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।
পুষ্পিতার কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর আছে কি না। তাপমাত্রা স্বাভাবিক মনে হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তানজিফ।
‘সারারাত জ্বালিয়ে মা’র’লি আমাকে। নিজের সাথে মিশিয়ে রাখ। একদম ছাড়বি না আমায়,,,,,,’
কপাল কুঞ্চিত করে তানজিফের দিকে তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারলো না।
‘মানে?’
তপ্ত শ্বাস ছাড়ল তানজিফ।
‘না কিছু না। রাতে জ্বর এসেছিলো তোর। এখন আর নেই।’
আর দাঁড়াল না তানজিফ। রুমের দিকে পা বাড়ায়।
চুলোর পাশে রাখা চারটে ডিম হাত নিলো পুষ্পিতা। একটা ডিম পোঁচ করা হয়ে গেলে আরেকটা ফ্রাইপ্যানে দেওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ হতেই তার হাত থেকে ছু মে’রে ডিমটা নিয়ে যান সুমনা এহমাদ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,
‘যা গোসল করে আয়।’
সুমনা এহমাদের কথায় তাজ্জব বনে গেলো পুষ্পিতা। বোকার মতো চেয়ে রইলো।
‘কি বললাম, শুনতে পাসনি? যা গোসল করে আয়।’
‘এই সকাল বেলা অকারণে গোসল কেন করবো?’
‘এতো কিছু বলতে পারবনা। গোসল করে তারপর খাবি।’
_________________
ঠান্ডা পানির ছাট লাগতেই আরো জ্বলতে থাকে তানজিফের বুক। নুইয়ে বুকে ফু দিতে লাগল।
‘তোর আবার কি হলো।’
ভয়ে চমকে উঠে তানজিফ। থুথু দিলো বুকে।
‘নিজে নখ দিয়ে করে এখন নিজেই জিজ্ঞেস করছিস?’
‘আমি আবার কখন করলাম?’
তানজিফ রগড় গলায় বলল,
‘সকালে। রাক্ষসী নখ কাটবি তুই।’
সুমনা এহমাদের গোসল করার কথাটা মাথায় আসতেই ত্বরিত গতিতে প্রশ্ন করলো,
‘তুই কি খালি গায়ে নিচে গিয়েছিলি?’
মাথা নাড়ে তানজিফ।
গোসলের রহস্য এতোক্ষণে উদঘাটন করতে পারলো পুষ্পিতা। লজ্জা ফুটে উঠলো তার আনন জুড়ে। জিভে কামড় মনে মনে বলল,
‘ইশ! জীবনে কিছু না করেও আজ এতো বড় লজ্জার মুখোমুখি হলাম।’
_________________________
গুটি গুটি পায়ে দিনগুলো বছরে রূপ নেয়।শরীরে দানা বাঁধে বার্ধক্য। মানুষ ধাবিত হয় মৃ’ত্যু’র দিকে।
বিবাহিত জীবনের একটা বছর গত হয়ে গেলো তানজিফ আর পুষ্পিতার। তবে দু’জনের মাঝে দূরত্ব বিলীন হতে গিয়েও হচ্ছে না। কোথাও যেন মিষ্টি সম্পর্কটা গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে।
আজ পুষ্পিতার ভীষণ ইচ্ছে করছে শাড়ি পড়তে। কালো রঙের জামদানী শাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো আলমারী উলোটপালোট করে ফেলেছে। রাগে আলমারি থেকে সব জামা কাপড় সারা রুমে ছুড়তে থাকে। অকস্মাৎ ছোট্ট একটা বক্স পায়ে পড়তেই তার মেজাজ আসমান ছুলো। মনে মনে ভর্ৎসনা করে বক্সটা হাতে নিলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল তার। বক্সটা খুলে বুকের ভেতরটা ধঁক করে উঠলো।
________________
লজ্জায় আড়ষ্ট পুষ্পিতা। মায়ানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
‘দেখি হাতটা বাড়ান।’
মায়ানের কথায় চমকে উঠলো সে। আড়ষ্ট স্বরে বলল,
‘জ্বি?’
‘হাতটা বাড়াতে বলছি।’
অনড় রইলো পুষ্পিতা। পুষ্পিতার কোনো ভাবাবেগ না দেখে নিজেই পুষ্পিতার হাতটা ধরে। কেঁপে উঠল পুষ্পিতা সমস্ত কায়া। বক্স থেকে ঘড়িটা বের করে পুষ্পিতার হাতে পড়িয়ে দিলো। চোখে চোখ রেখে অনুভূতি মিশ্রিত, নরম স্বরে বলল,
‘আজ এই মুহুর্ত হতে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কিছু সময় আমার। শুধুই আমার। এই ঘড়িটা আপনাকে তাই মনে করিয়ে দিবে। কমদামি হতে পারে অবহেলায় ঘড়িটা কে ফেলে রাখবেন না কখনো। একজনের ভালোবাসা মিশে আছে এটাতে।’
____________
পুরোনো মিষ্টি স্মৃতি মানসপটে ভাসতেই নির্জীব হাসলো পুষ্পিতা। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিরস গলায় বলল,
‘ভালোবাসা থাকলে কখনো এভাবে ছেড়ে যেতে পারতেন না মায়ান। আপনি আমাকে কখনো ভালোই বাসেন নি।যা ছিলো চোখের মায়া। যা চোখের আড়াল হলেই মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। আপনিও আমার কোথাও নেই মায়ান। মন থেকে আপনার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। অন্য কেউ সেই জায়গাটাকে একটু একটু করে নিজের করে নিচ্ছে। কোনো শূন্যস্থান অপূর্ণ থাকে না। কেউ না কেউ ঠিকই পূরন করে দেয়।’
ঘড়িটা হাতে নিয়ে থমথমে, বোধশূন্য হয়ে বিছানায় বসে রইলো পুষ্পিতা। মিষ্টি স্মৃতি গুলো আজ তিক্ত, বিষাক্ত। যত মনে পড়ে তত মনটা বিষাদে ভরে যায়।
‘কি যে পাগলামি করিস না তুই পুষ্পিতা।’
ছড়ানো ছিটানো কিছু জামাকাপড় হাতে নিয়ে বলল তানজিফ।
পুষ্পিতাকে এমন চুপচাপ নীরব দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। দু’পা এগিয়ে পুষ্পিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। পুষ্পিতা তখনো অন্যমনস্ক। কাঁধে হাত রাখতেই আঁতকে উঠল সে।
‘তুই ঠিক আছিস? আর হাতে,,,,,,, ‘
‘মায়ানের দেওয়া ঘড়ি।’
চমৎকৃত হলো তানজিফ। চাহনি নিক্ষেপ করলো চোখের দিকে। শুষ্ক মুখশ্রী, ভেজা আঁখি পল্লব। আর কিছু বলার সাহস পেলো না সে। বুকটা ভার হয়ে আসছে তার। এলোমেলো কাপড় গুলো একে একে ভাজ করে রাখলো আলমারিতে।
_________________
কালো জামদানী শাড়িটা পরিধান করে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত পুষ্পিতা। শাড়িটা তানজিফের ইনকামের টাকায় কেনা। প্রথম ইনকাম। ভাবা স্বামী প্রথম উপার্জনে কেনা উপহার। অন্যরকম এক প্রশান্তি। সেজন্য শাড়িটাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল সে।
গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল সে। সুমনা এহমাদ মাংসের পাতিল চুলো থেকে নামিয়ে রাখলেন।
‘যা পায়েস রান্না কর।’
এক গাল হেসে এক হাঁড়ি দুধ চুলোয় চাপিয়ে দিলো। দুধ ফুটতেই আধভাঙ্গা চালগুলো দিয়ে দিলো তাতে।
‘তোর সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে পুষ্পিতা। রুমে চল।’
‘পায়েস বসিয়েছি। এক সেকেন্ডের জন্য কোথাও গেলে দুধ উতলে পড়ে যাবে৷ এখানেই বল কি দরকারি কথা।’
‘আজকের এই বিশেষ দিনে তোকে সারাজীবনের জন্য মুক্ত করে দিতে চাই।’
#চলবে।