নূরবাহার সকল পর্বের লিংক | মিমি মুসকান |পর্ব -১

( ১ )

-“হারাম’জাদা! এরপর থেই্কা তোরে আমার বাড়ির সামনে দেখলে ঝাটা দিইয়া বারি মাইরা বিয়ার সাধ মিটিইয়া দিমু কইলা দিলাম।

ঝাটা হাতে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রক্তবর্ণ দৃষ্টি ধারণ করে মুনসী ঘটকের দিকে ফিরে আছে ঠাকুমা। মুনসী ঘটক বগলের নিচে ছাতা রেখে পানের পিক ফেলে জোর গলায় বলতে লাগল, “হ, আমিও দেইখা নিমু। জাত পাত ছাড়া এই মাইয়ার বিইয়া তুমি কেমনে দাও? বুঝোতো আর নাই, এই গাঁয়ের ঘটক আমি। মুনসী ঘটক! আমারে ছাড়া তোমার নাতনীর বিয়া কেমনে দাও হেইঠাই দেখমু। মা হিন্দু বাবা মুসলমান, এই মাইয়ারে কোন বেডায় ঘরে তুলবো, তোমাগো তেজ দেইখা রাখমু!”

-“অ্যাই অ্যাই, আমার নাতনীর দিকে কুনজর দিলে তোর চোখ উপরাইয়া ফেলমু হারাম’জাদা। তুই এহনো এহানে দাড়াইয়া গলা ফাটাস্, বাইর হ কইলাম, আমার বাড়ি থেকে বার হ তুই! নইলে এখন লোকজন জড়ো কইরা তোরে গাছের লইগা বাইন্ধা রাখমু!”

-“আমারে তেজ দেখাইয়া কামডা ভালা করলা না বুড়ি!”

বলেই হন হন করে পা ফেলে হাঁটা ধরল মুনসী ঘটক।‌ঠাকুমা রেগে থু থু ফেললেন রাস্তার সামনে। বির বির করে কিছু কুৎসিত গালিও দিলেন। ঝাটা টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠাকুমার বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। তবুও শরীর ভেঙ্গে যায় নি। স্বামী মারা গেছে ৩০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেল। সাদা শাড়িতে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বিধবা নিয়ম পালন করে যাচ্ছে তখন থেকেই। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গঙ্গা জল বাড়ির সামনে ছিটিয়ে দিলেন। ওমন অশুভ শক্তি যেন তার বাড়ির সামনে আর না আসতে পারে এই চাইতে লাগলেন প্রভুর কাছে।

রহিম মিয়ার দোকানের‌ কাছে এসে পানি দিয়ে কুলি করতে লাগল মুসনী ঘটক। রহিম মিয়া মুখের এক পাটি দাঁত দেইখায় হাসল। বলল, “কি গো মুনসী ঘটক, খবর কি তোমার?”

-“খবর ভালা না, দাও এক খিলি পান দাও।

রহিম মিয়া পান বানাইয়া হাত তুলে দিল। মুনসী ঘটক পান চাবাতে চাবাতে বসে পড়ল। রাগ তার এখনো কমে নাই। শরীর রাগে ফে’টে যাচ্ছে। ওই বুড়িরে একটা শা’য়েস্তা করতেই হইবো। এতো বড় সাহস , তারে ঝাটা হাতে তেড়ে আসে। ওই নাতনীর কপালে খুব দুঃখ আছে। রহিম মিয়া খানিকটা আঁচ করতে পেরে কইলো, -“কিছু কি হইল নাকি?”

-“আর হইল।”

-” ওই দিকে কাগো বাড়ি গেছিলা?

-“ওই বুড়ি গো বাড়ি!

-“ক্যান? এতিম মাইয়ার লইগা সম্বন্ধ নিইয়া গেছিলা?’

-” আর সম্বন্ধ, তুমি লেইখা রাখো রহিম , ওই মাইয়ার বিয়া দাওয়ান সম্ভব না। কেউ করবো না এই মাইয়ারে বিয়া।

দাঁত কেলিয়ে হেসে উপহাস করল রহিম মিয়া। চামচ দিয়ে চায়ের কাপ নেড়ে কইলো, -“বিয়া শাদির ব্যাপার আল্লাহর হাতে। ওই মাইয়ার বিয়া না হইলে আর কার হইবো। রূপ দেখছো ছেড়ির মাশা আল্লাহ। এ গাঁয়ে এই মাইয়া তুমি দুইটা পাইবা। কিন্তু হ মাইয়ার কপাল খারাপ।”

-“খারাপ না, কও ওই বুড়ি খারাপ করতাছে। মাইয়া বাঁচলে ওর ঢকের লইগাই বাঁচবো। পাশের গাঁয়ের মহেন্দ্র রে চিনো না!

-“রাজেন্দ্র বাবুর পোলা না!

“হ , বুঝো মাইয়ার কপাল কি ভালো। সেইখান থেইকা সম্বন্ধ আইছে!

“কি কও কি?

“তাইলে আর কি কই, সেদিন দুপুরে আমারে ডাইকা কইলো ওই মাইয়ারে নাকি তার পোলার মনে ধরছে।

“এতো বড় বংশে জাত পাত ছাড়া এই মাইয়ার বিয়া দিবো কইতাছে?

“তইলে, মাইয়া সোনার চামচ মুখে দিয়া না জন্মাইলে কি হইবো, ভাগ্য টা ঠিকই স্বর্ণ দিয়া বাধাইয়া আনছে।

“তা আর যা কইছো, কিন্তু মাইয়া তো অনেক ছোট।

“কিসের ছোট , ওই বয়সে তোমার মাইয়ারে বিয়া দাও নাই। কি তোমার মাইয়া সুখে নাই।

রহিম মিয়া হাসল। মুনসী ঘটক চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, “তইলে কও, এই অবদি যার বিয়া দিছি তার’ই ভাগ্য খুলছে, তোমার মাইয়ার কথাই ধরো। কি সুখে আছে না। এই বুড়ির কাছে যাইতাম না। এর আগে আরো দুইবার যাইয়া ফেরত আইছি‌। কিন্তু রাজেন্দ্র বাবু শুধু কইলো বইলা। নইলে ওই বুড়ির বাড়িতে আমি পা রাহি, অকল্যাণ অক্যালণ! পুরো গ্রেরাম টারে শয়তানের আস্তানা বানাইয়া ছাড়লো, তওবা তওবা!”

হন হন করে হেঁটে আসার শব্দ। মুনসী ঘটক সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জমিদার সাহেব হেসে বলল, “কেমন আছেন মুনসী ঘটক?

“এই তো জমিদার সাহেব আপনার দোয়া, কেমন আছেন?

“ভালো, ভালো।

বসে পড়লেন জমিদার সাহেবও। তার পাশে বিশাল শরীর নিয়ে মতি মিয়া থমথমে মুখে দাঁড়ানো। তার কাজ মালিকের আদেশ পালন করা। জমিদার সাহেব বেশ পরিপাটি। পড়নে সাদা রঙের পাজামা পাঞ্জাবী। পূর্বের ঘটা ঘটনা বর্ণনা করতে সময় লাগলো না মুনসী ঘটকের। মন দিয়ে কথাগুলো শুনলেন জমিদার সাহেব। রহিমা মিয়া ইতোমধ্যে ঘন দুধের চা নিয়ে হাজির। জমিদার সাহেব চায়ের কাপ মুখ দিতেই মুনসী ঘটক আর্জি জানাল , “কিছু না মনে করলে জমিদার সাহেব রে একটা কথা কই?

“কি কথা?

“কইতাছি এই বুড়ি আর বুড়ির নাতনীরে গ্রেরাম থেকে বার কইরা দেন। এদের গ্রেরামে রাখলে আল্লাহ পাক নারাজ হইবো।

তার কথায় মাথা নাড়ল রহিমা মিয়ার। জমিদার সাহেব গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। এর অর্থ তিনি আর কথা শুনতে চান না!

——

সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে, ঠাকুমা প্রদীপ হাতে তুলসী তলায় দাঁড়ানো। চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। মাইয়াটা এখনো তো ঘরে আইলো না। আজ আইলে তার খবর আছে। দিন দিন এই মাইয়া যে বড় হইতাছে তার কি কোন খবর আছে। এই মাইয়ারে নিয়া এই বুড়ির কতো জ্বালা, মাইয়াটা কি বুঝে এসব কিছু। হতাশার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বুড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল! হাত জোর করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হরি হরি!”

ঘন্টার শব্দ বেজে যাচ্ছে। দৌড়ে বাড়িতে ঢুকল ন’বছর বয়সী ছোট একটা মেয়ে। অন্ধকারে তাকে চেনার উপায় নেই। সে দৌড়ে ছুটে এলো ঠাকুমার সামনে। প্রদীপের আলোয় চেয়ে রইল ঠাকুমার দিকে। ঠাকুমার পুজো এখনো শেষ হয়নি। হাসি হাসি মুখে চেয়ে দেখছে ঠাকুমা কে। পুজো শেষ হতেই জোরে বলে উঠল, “ঠাকুমা!

“তুই এসে গেছিস রে মুখ’পুরী।

খিটখিট হাসির শব্দ । এই মেয়েটিকে যাই বলো না কেন শুধু খিটখিট করে হাসি। বাহার না হয়ে মেয়েটার নাম হাসি হলেই বোধহয় ভালো হতো। প্রদীপের আলোয় বাহারের মুখখানি দেখে চমকে উঠলো ঠাকুমা! “এতো রূপ নিইয়া এই মাইয়া কেন আইলো এই ঘরে। তার এই রূপ তার সর্বনাশের কারণ!” চট করে গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দিলো ঠাকুমা। কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো মেয়ে না বাহার। রোজ’ই এমন দু চারটে চড় পড়ে তার গালে।

“এতোক্ষণে তোর আসার সময় হলো। নবাবজাদি হইয়া গেছিস। আছিস তো ফকিরের ঘরে, এতো কিসের নবাবজাদি তোর।

আবারো হেসে উঠল বাহার। কোলের কাছে মুঠো করে থাকা আঁচলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেখ দেখ ঠাকুমা, তোর লইগা ফুল আনছি। তোর মায়ের পায়ে দিবি না!”

চকচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঠাকুমা। মনের ভেতর কথা বাজছে তার। “আমার মা কেন তুই হলি না রে মুখপুরী। ফুল গুলো তইলে তোর পায়ের দিতাম আমি।”‌

বাহার আবারো বলে উঠল, “কিরে ঠাকুমা! ফুল নিবি না!”

চলবে…

#নূরবাহার
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here