#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৮
দাদিনের শারীরিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। অথচ বাড়ির কেউই এ ব্যাপারে অবগত নয়। এই বৃদ্ধা বয়সে এসে আজ তার মনের কোণে অভিমান জন্মেছে। বড্ড বেশি অভিমান৷ সেই অভিমান থেকেই কাউকে জানায়নি। আজকাল তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই অভিমান যার ওপর সে কি কখনো টের পাবে? এখন যে সে ভীষণ ব্যস্ত। আগামীকাল রুদ্র, হৈমীর ছেলেমেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। তাই নিয়ে সকলের যত তোড়জোড়। নিজের ঘরে একাকী বসে আছেন দাদিন। তিনবেলা খাবার সময়ই তার খোঁজ করেন বড়ো বউমা। এছাড়া বাড়ির কারো সময় নেই দুদণ্ড তার কাছে বসার৷
এই পৃথিবীতে স্বার্থহীন মানুষ একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বিশেষ কোনো জায়গায় প্রচণ্ড পরিমাণের স্বার্থপর। স্বার্থপরের পাশাপাশি আমরা মানুষরা বড়োই নির্ভরশীল প্রাণী। মানুষের পাশে স্বার্থপর আর নির্ভরশীল শব্দ দুটো বেশ শোভনীয়। এই যে দাদিন। এককালে তার স্বামী, সন্তান নিয়ে ভরা সংসার ছিল। তাদের জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল অসীম। স্বামী, সন্তানের কেউই তাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও কল্পনা করতে পারতো না। সময়ের বিবর্তনে আজ পরিস্থিতি বদলেছে। স্বামী পৃথিবী এবং তার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন পরপারে। এপারে সে সন্তানদের নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছে। তিন পুত্রকে বিয়ে করিয়ে সংসারী করেছে। ঝড়ঝাপটা পেরিয়েছে অনেক। বড়ো ছেলের করা ভয়াবহ অপরাধ ছিল সেই ঝড়ের সূত্রপাত। মেজ ছেলের পাশে থেকে নাতি, নাতনিকে সামলেছে এক হাতে। সেই সব দিন কি ভুলার মতো? সেইদিনও এই সংসারে সে অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল। হ্যাঁ আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারীরাই সংসারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের মতোন। আজ দাদিনের নিজেকে এ বাড়ির এক ফেলনা বস্তু মনে হচ্ছে। যার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। তাই তো এত অবজ্ঞা! তার রুদ্র কত বড়ো হয়ে গেল! বাড়িতে বউ নিয়ে এলো। আগামীকাল বাচ্চাদের নিয়ে আসবে। কানায় কানায় ভরে ওঠবে সুখে। সেই সুখের একাংশেও কি থাকবে সে? নাহ থাকবে না। কারণ সে এখন রুদ্রর চোখে একজন স্বার্থপর মহিলা ছাড়া আর কিছুই না। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল দাদিন। আশপাশে তাকিয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিল। বড়ো ছেলে দিলওয়ারের একাধিক বার মিসড কল! ইদানীং দিলওয়ারের ফোন ধরেন না তিনি। একবার ভুল করলে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু একই ভুল বার বার করলে তার কোনো ক্ষমা হয় না। ফোনটা বেজে ওঠল আবারো। না চাইতেও রিসিভ করল দাদিন। তৎক্ষনাৎ ওপাশ থেকে ভেসে এলো দিলওয়ারের উতলা কণ্ঠস্বর,
-” মা ভালো আছো? ফোন ধরো না কেন? কী হয়েছে মা? ”
-” কী হওয়ার বাকি আছে আর? ”
অসহায় স্বর দাদিনের। দিলওয়ার মিনতি স্বরে বলল,
-” আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমি ফেঁসে গেছি মা। এখান থেকে বের হওয়া আর সম্ভব না। ”
-” বড়ো দুজনের দায়িত্ব নিতে হয়নি। তারা নিরাপদে ছিল, আছে। কিন্তু ছোটোটাকে তো জলে ভাসিয়ে দিলি। তোর কি মরার ভয় নাই? উপরে একজন আছে দিলু। ”
আঁচলে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল দাদিন। দিলওয়ারের প্রথম স্ত্রীর সন্তান রাদিফ, সাদমান। বাবার ছায়া ছাড়াই তারা আজ বড়ো হয়েছে। রাদিফ একজন সফল ব্যবসায়ী। সাদমানের পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্মানো রিমন? তার ভবিতব্য কী? রুদ্র, সূচনা, রাদিফ, সাদমান বিনা দোষে তারা একটি শূন্যতা নিয়ে বড়ো হয়েছে। কিন্তু জলে ভেসে যায়নি। অথচ রিমন সে যে জলে ভাসা। বাবা, মায়ের পাপের ফল সে কেন ভোগ করবে? ছেলেটা এখনো বাচ্চা। শুনেছে কলেজ ছাত্র। শতহোক তারই তো বংশধর। নিজেকে সামলাতে পারলেন না দাদিন। দিলওয়ার মা’কে শান্ত করতে বলল,
-” বিশ্বাস করো মা আমি ওদের জন্য করতে চাই কিন্তু পারি না। হাফিজা আমাকে চাপে রাখে। ওর বুড়ো বাপটা আস্ত শয়তান। ”
-” মা হয়ে বলতে কষ্ট হয় তবুও সত্যি আমি বলব। তুই তোর পাপের ফল ভোগ করছিস। ”
দিলওয়ার ঘনঘন শ্বাস ফেলল। দাদিন বলল,
-” তোর জন্য আমি অনেক করেছি। আমার থেকে তুই আর কিছু পাবি না দিলু। শেষ যা আছে আমি তোর ছোটো ছেলের নামে করে দিব। তুই আর আমার সাথে যোগাযোগও করিস না। রুদ্র আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। রিমনের জন্য কিছু করলে এই দূরত্ব আরো বাড়বে। কিন্তু আমি কী করব! তোর মতো কু’লাঙ্গারকে পেটে ধরে আমিও তো বিপদে পড়েছি। ”
ফোন কেটে দিল দাদিন। শরীরটা ভালো লাগছে না। প্রেশার বাড়ছে বোধহয়। ত্বরিত প্রেশারের টেবলেট খেয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল সে। মন আনচান করছে। আয়ুকাল বোধহয় খুব বেশি দিন নেই। যা করার শিঘ্রই করতে হবে। ইদানীং প্রয়াত স্বামীকে বেশ স্বপ্নে দেখে। যেন তিনি তাকে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন! ভাবতেই গা শিউরে ওঠল বৃদ্ধার। দু’চোখের কোণ ঘেঁষে ঝড়ল অশ্রুজল। পৃথিবীটা মায়ার নাকি পৃথিবীর মানুষগুলো?
__________________
সূচনা মা হচ্ছে! সদ্য মামা হওয়ার পর বাবা হওয়ার সংবাদ পেয়ে মাহেরের উচ্ছ্বাস দু-চোখ ভরে দেখেছে সূচনা৷ এবার সদ্য বাবা হওয়ার পর মামা হবার সংবাদ পেয়ে রুদ্রর উচ্ছাস দেখছে। আদরের ছোটোবোনটি মা হবে? বিস্ময়ে কণ্ঠরোধ হয়ে গেল রুদ্রর। দু’হাতে সূচনার গাল চেপে ধরে কপালে চুমু খেল। মাহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” অভিনন্দন। ওর খেয়াল রাখবেন সব সময়। ”
এরপর সূচনার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
-” যখন যা ইচ্ছে করবে বলবি আমায়। যা খেতে মন চাইবে শুধু একবার বলবি। আর শোন, এখানেই থাকবি। ও বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
তীব্র প্রতিবাদ জানালো মাহের। বলল,
-” উহুম, নো। আপনার থেকে এখন এমন কিছু আশা করছি না রুদ্র। আমার বউ আমার সন্তান ক্যারি করার পুরো সময়টাই আমার পূর্ণ সাপোর্ট পাবে। আর এরজন্য তাকে অবশ্যই তার বাড়ি থাকতে হবে। ইয়েস, তার বাড়ি শেখ বাড়ি নয় খান মঞ্জিল। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমী রুদ্রর কুঁচকানো ভ্রু দেখে চট করে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলল,
-” কেমন লাগে? ”
রুদ্র কিঞ্চিৎ দমে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
-” সে হবে… ”
ঈষৎ হেসে মাহের বলল,
-” ভাগ্না, ভাগ্নি আসার পর দিন দুয়েক থাকব আমরা৷ এরপর ফিরে যাব আশা করি আপত্তি নেই? ”
ঘোর আপত্তি থাকলেও হৈমীর ভাবসাব দেখে রুদ্র বলতে বাধ্য হলো,
-” নাহ, না আপত্তি নেই৷ ঠিকভাবে ওর যত্ন নিলে আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
মাহের আশ্বস্ত করে বলল,
-” আপনার মতো মানুষ যদি এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীর প্রতি এতটা যত্নশীল হতে পারে। তাহলে আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন। ”
চোখমুখ অনুজ্জ্বল করে ‘ হুম ‘ বলে বোনের দিকে তাকাল রুদ্র। বলল,
-” বাইরে যাব মিষ্টি আনতে। আর কী খাবি বল? ”
-” মিষ্টি তো আমার আনবার কথা? ”
রুদ্র মাহেরের দিকে তাকাল। অনুভব করল, স্বামী এবং বাবাদের অধিকার সবার আগে। সেই সঙ্গে বোনের সুখের কিনারাও খুঁজে পেল৷ গোপনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
-” তবে চলুন। ”
.
.
সকালবেলা হৈমী, রুদ্রর মধ্যে কথা কাটাকাটি চলল। বাচ্চাদের আনতে রুদ্র, মাহের আর ছোটো কাকি যাবে৷ হৈমীকে কিছুতেই নিয়ে যাবে না রুদ্র। পেটের সেলাই খোলা হলেও পুরোপুরি সুস্থ নয় হৈমী। তাই তাকে নিয়ে বেরোনোর সাহস পায় না রুদ্র। কিন্তু হৈমী দমবার পাত্রী নয়। সে কেঁদে অস্থির! বাচ্চাদের নিজের কোলে বসিয়ে বাড়ি আসবে। রুদ্র শুরুতে ভালো করে বোঝালেও শেষে চটে গেছে। তার চটে যাওয়ায় হৈমীর কষ্ট বেড়েছে দ্বিগুণ। এমনিতেই বাচ্চাদের থেকে এতদিন দূরে থাকা মেনে নিতে পারেনি৷ তারওপর এই অসুস্থতায় রুদ্র ধমক খেল। বহুদিন পর। সবমিলিয়ে কষ্টরা আকাশ ছুঁয়েছে। হৈমীর কান্না দেখে মায়া হলো রুদ্রর। কী করবে, কীভাবে বোঝাবে? শেষে শান্ত হয়ে বুকে টেনে নিল। আদর পেয়েও জেদ ভাঙল না হৈমীর। রুদ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” আচ্ছা যাবে। এরপর যদি কোনো সমস্যা হয় তোমার খবর আছে। রুদ্র সম্পর্কে যদি ধারণা কম থাকে যেতে পারো! ”
ঢোক গিলল হৈমী। দোনোমোনো করে শেষে বলল,
-” যাব না। ”
রুদ্র বিছানা ছাড়তে গিয়ে থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” সিরিয়াস? ”
থমথমে কণ্ঠে হৈমী বলল,
-” আপনার সন্তানদের আপনিই নিয়ে আসুন। আমার এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ”
তীব্র রাগে চোয়াল ফুলে গেল রুদ্র। এই মেয়ে কেন তাকে বুঝে না? সহসা কাছে এসে দু’গালে চেপে ধরে। ফোঁস ফোঁস করে বলল,
-” আমি তোমাকে জাস্ট বোঝাতে পারি না। ”
ঠিক যেভাবে কাছে এসে গাল চেপে ধরল সেভাবেই আবার সরেও গেল। নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে গাড়ি চাবি হাতে নিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলল,
-” রাগ করো, আরো রাগ করো৷ বেশি করে রাগ করো। ”
হৈমী অনড় রইল। রুদ্র এতে আরো ক্ষেপে গেল৷ মৃদু চিৎকার করে বলল,
-” আরো রাগ করো। রেগে আমাকে খু’ন করে দাও। আমি অপরাধী, অপরাধী তো? ওঠলে অপরাধী হবো, বসলে অপরাধী হবো৷ মরণ হয়েছে না আমার মরণ? ”
পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, রুদ্রর চোখ এমন দেখাল, মুখের কথা এমন শোনালো যে অভিমানের ভীড়েও ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল হৈমী। সেটুকু দেখে গটগট পায়ে রুম ত্যাগ করল রুদ্র। শোনা গেল তার উচ্চকণ্ঠে বলা বাক্যগুলো,
-” সূচনা, হৈমীর খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দে। ”
এর কয়েক মিনিট পরই রুদ্র হুড়মুড়িয়ে রুমে এলো৷ হৈমী ফোন টিপছিল তখন। রুদ্রকে দেখে চিন্তিত গলায় বলল,
-” কিছু ফেলে গেছেন? ”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল,
-” তোমাকেও যেতে হবে। উপায় নেই। ”
চোখ দু’টো চকচক করে ওঠল হৈমীর। খুশিতে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। তখনি ঝটপট রুমে এলো সূচনা। বলল,
-” এই হৈমী রেডি হও। এক কাজ করো তোমাকে যে খিমার বোরখা কিনে দিলাম ওটা পড়ো। এতে সুবিধা হবে। ”
রুদ্র ইতস্ততভাবে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হৈমী বলল,
-” তোমার ভাই তো নিয়েই যাবে না। কত ঝগড়া হলো। হঠাৎ আবার নিয়ে যাবে যে? ”
-” ইস ভাইয়া কী পাগল! বাবা, মা ছাড়া বাচ্চা দেবে নাকি স্পেশালি মা ছাড়া। ওদের ভালো, মন্দ তো তোমাকেই বুঝিয়ে দেবে। স্পেশাল চাইল্ড না ওরা?
তাছাড়া বাবুরা মায়ের বুকের দুধপান করতে পারছে কিনা এটা দেখাও জরুরি! ”
আঁতকে ওঠল হৈমী। লজ্জায় মরি মরি হয়ে বলল,
-” ছিঃ কী বলো? আমি কিছু দেখাতে পারব না। ”
বোকা বনে গেল সূচনা। মাথায় হাত রেখে বলল,
-” হায় কপাল! আরে গাধী, তুমি সম্পূর্ণ সেভলি বাবুদের খাওয়াতে পারবে৷ ডক্টরদের শুধু প্রবলেম হচ্ছে কি হচ্ছে না তাই জানাবে। ”
নিজের বোকামিতে ভীষণ লজ্জিত হলো হৈমী৷ সূচনা টের পেয়ে বলল,
-” ইস লজ্জা পেতে হবে না। বাচ্চা মেয়ে এরওপর নতুন মা। এসব স্বাভাবিক আমি কিছু মনে করিনি। ”
দরজার বাইরে থেকে সমস্তই শুনল রুদ্র। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। বিব্রতও লাগছে। তবুও রোগ আর ডাক্তার এ দু’টো বিষয়ে লজ্জাদের স্থান দিতে নেই। তবুও হৈমী তো তার বউ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে মহিলা ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করার।
_________________________
সব কাজ সেরে সুস্থ ও নিরাপদে বউ বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো রুদ্র। হৈমী আজ ভীষণ খুশি। প্রচণ্ড তৃপ্ত যাকে বলে। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে সে। ছেলেটা রুদ্রর কোলে। মাঝপথে যাওয়ার পরই ছেলেটা কাঁদতে শুরু করল। আত্মা ধক করে ওঠল রুদ্র, হৈমী দুজনেরই! হৈমী চোখ গলেও পানি বেরিয়ে এলো। রুদ্রর দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,
-” ও কাঁদছে কেন? ”
হতভম্ব হয়ে গেল রুদ্র। হৈমী কী করে বাচ্চাদের সামলাবে? ও নিজেই তো বাচ্চা। এই বাচ্চা কী করে দু দু’টো বাচ্চা সামলাবে? বাচ্চার কান্নায় নিজেই কেঁদে ফেলছে। অথচ তার না কেঁদে বাচ্চাদের সমস্যা বোঝা উচিৎ ছিল এবং সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ ছিল। রুদ্রর চিন্তিত মুখে তাকিয়ে ছোটো কাকি বলল,
-” এই ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে। ছোটো বাচ্চা তো ঘনঘন খেতে দিতে হয়। দেখি আমার কাছে দাও। ”
কাকির কথা শুনে রুদ্র ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামালে ড্রাইভার সহ মাহেরও বেরিয়ে গেল। কাছেই এক দোকানে চা খেতে বসল ওরা। রুদ্র ছেলেকে ছোটো কাকির কাছে দিয়ে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিল। ছোটো কাকি পজিশন ঠিক করে হৈমীকে সাহায্য করল। রুদ্র তখন নড়াচড়া করা বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সহসা মেয়েটাও কেঁদে ওঠল৷ ডক্টর বলেছে মেয়েটা অত্যাধিক দুর্বল। জন্মানোর পর সে অনেক পরে রেসপন্স করেছে। এখনো সবকিছুতেই কম প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেহেতু তার জমজ বাচ্চা সেহেতু খেয়াল রাখতে হবে দুদিক সমান রেখে। মেয়েটা যখন কেঁদে ওঠল তখন রুদ্রর বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। হৈমীও ঘাড় ফিরিয়ে ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। ছোটো কাকি বলল,
-” ওরও বোধহয় খিদে পেয়েছে। এমন হয় জমজদের৷ একজন কাঁদলে আরেকজ কাঁদে। একজনের জ্বর হলে অপরজনেরও জ্বর আসে। খিদের বেলাও মনে হয় তাই। সর্বনাশ হয়েছে গো হৈমী। তুমি সামলাবে কী করে! ”
রুদ্রর মেজাজ খারাপ করল। কোথায় সাহস দেবে তা না ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সে নিজেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। তাহলে হৈমীর মনের অবস্থা কী! কেশে ওঠল রুদ্র। মেয়েটাকে থামাবে কী করে? করুণ চোখে তাকাল হৈমীর দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” ওর হয়েছে? ”
হৈমী কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-” বুঝতে পারছি না। ”
ছোটো কাকি বলল,
-” রুদ্র ওকে আমার কাছে দাও। ”
পরিস্থিতি দেখে হাসফাস লাগল রুদ্রর। ছোটো কাকির সামনে ইতস্ততও লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বাচ্চাদের সুবিধা আগে দেখতে হবে। সব লজ্জা, বিব্রতবোধ একপাশে রেখে কেবল বাচ্চাদেরই প্রাধান্য দিল রুদ্র, হৈমী। তারা যে নতুন বাবা, মা। সবকিছুতেই বড্ড কাঁচা। তাই ছোটো কাকির সামনে এ মুহুর্তে লজ্জা পাওয়া মানে বাচ্চাদেরই ক্ষতি! বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাচ্চারা আবার কান্না শুরু করল। এর মানে আবার খিদে পেয়েছে ওদের৷ রুদ্র, হৈমী দুজনেই হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে কারো সঙ্গে ভালো, মন্দ কথা না বলেই বাচ্চাদের নিয়ে উপরে চলে গেল। হৈমীকে সাপোর্ট দিল ছোটো কাকি। সূচনা ছুটে এলো, এলো হামিদাও। রুদ্র যেন ভরসা পেল। হামিদা হৈমীর মা আর সূচনা তার নিজের বোন৷ এই দু’জন মানুষের কাছে বাচ্চা সহ হৈমীকে ছেড়ে দেয়া যায় নিশ্চিন্তে। দিনটা তারাই সামলাক। রাতটা সে আর হৈমী সামলে নেবে। ভেবেই রুদ্র সূচনার কোলে মেয়েকে দিয়ে বলল,
-” ওদের একসঙ্গে খিদে পায়রে। হৈমীকে সাহায্য কর। ও সামলাতে হিমশিম খায়। ”
ভাইয়ের করুণ স্বরে আচমকা হেসে ফেলল সূচনা। বলল,
-” আরে ভাইয়া তুমি চিন্তা করো না। নতুন নতুন এমন হয়ই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
-” দু’জনকে ও সামলাবে কী করে রে? এখন আমি ফ্রি আছি। সব সময় তো থাকব না৷ গোটা বিজনেস পড়ে আছে। বাবা কতদিন দেখবে আর? ”
-” উফফ ভাইয়া টেনশন নিচ্ছ কেন? হৈমীর ওপর ভরসা রাখো। সবশেষে ও কিন্তু ওদের মা। আর মায়েরা সব পারে সব। দু’জন কেন? পাঁচজন হলেও ঠিক সামলে নেয়। তুমি অযথা টেনশন করছ। ”
.
.
সময় গড়াতে গড়াতে রাত নামল। ডিনার সেরে বসার ঘরে সবাই মিলে আলোচনায় বসল। বিষয় বাচ্চাদের নাম কে রাখবে? কী রাখবে? হৈমী তখন নিজের ঘরে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে মেয়েটাকে বুকে আর পাশেই হাতের কাছে ছেলেকে শুইয়েছে। হামিদা বসে নাতি, নাতনিকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। আর মেয়েকে বোঝাচ্ছে কীভাবে কী করবে। এমন সময় রুদ্র ঘরে এলো। শাশুড়ির সামনেই বউকে জিজ্ঞেস করল,
-” ওদের নাম কী রাখবে? ”
হৈমী রুদ্রর দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। বলল,
-” আপনি রাখুন। আমার মাথা কাজ করছে না। ”
হামিদা মুচকি মুচকি হাসল। বলল,
-” তুমিই রাখো বাবা। মেয়েটা একেবারে দুই সন্তানের জননী হয়ে দিশেহারা। ”
হৈমী মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। হামিদা বলল,
-” একা জ্বালিয়েছিস এবার দেখ দু’টো কেমন জ্বালায়। ”
রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল হৈমী। বলল,
-” জ্বালাক তবুও ওরা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকুক আম্মু। আমি ওদের খুব আদর করব খুব ভালোবাসব। ”
হামিদা মেয়ের কথা শুনে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হলেন। মনে মনে বললেন,
-” আল্লাহ আমার মেয়েটাকে বোঝদার করুক। সুখী করুক। ”
ঘর ছেড়ে ফিরে আসার পর চাচাত ভাইরা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,
-” ভাবি কী নাম বলল? ”
-” আমায় রাখতে বলেছে। ”
মাহের বলল,
-” আপনিই রাখুন। ”
রুদ্র চুপচাপ গিয়ে বসল সূচনার পাশে। দীর্ঘক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল,
-” আমাদের ছেলে রুদ্রিক শেখ। আর মেয়ে রুদবা শেখ। রুদ্র এণ্ড হৈমী’স সন এণ্ড ডটার রুদ্রিক, রুদবা। ”
চলবে…#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৯
সময় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনও এগিয়ে চলে। দূর বহুদূর। রুদ্র, হৈমী, মাহের, সূচনা। ওদের জীবনও এগিয়ে গেছে বেশ। সূচনা এখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। হৈমীর কাছে খবর এলো, তার মেয়ে বেবি হবে। খবরটা শুনে সে বেজায় খুশি। রুদ্র বাড়িতে নেই। সাতসকালে ঢাকা চলে গেছে সে। সপ্তাহে দু’দিন অফিস যাচ্ছে। কাজ থেকে দীর্ঘদিন বিরতি চলার পর এবার ধীরেধীরে কাজে ফিরছে। সেই সঙ্গে সংসারীও হচ্ছে। বেচারা বউ, বাচ্চা ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারে না। অফিসে কাজের ফাঁকে বাচ্চাদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলে। দু’টো বাচ্চা সামলে হৈমীর অবস্থা নাস্তানাবুদ। ছেলেটা খুব বেশি দুষ্টু। সবে বসতে শিখেছে। হাত, পায়ে একটুও স্বস্তি নেই। মেয়েটা একেবারে শান্ত। হৈমীর ধারণা রুদবা বাবার স্বভাব পেয়েছে। আর ছেলেটা বুঝি তার স্বভাব পেয়ে গেল! মাঝেমধ্যে এই নিয়ে অবশ্য রুদ্রর সঙ্গে তার তর্ক চলে। রুদ্র বেশ কৌতুক করেই বলে,
-” সারাজীবন তো আমার শাশুড়িকে জ্বালিয়েছ। এবার তোমার জ্বলার পালা। ”
হৈমী তখন চোখ, মুখ শক্ত করে মেয়ে কোলে রুদ্রর চোখের সামনে থেকে চলো যায়। ছেলেটাকে রেখে যায় রুদ্রর মাথা খেতে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কীভাবে যেন রুদ্র ম্যানেজ করে নেয় সবটা। রুদ্রিকও বাবার কোলে খুব একটা বাড়াবাড়ি করে না। হৈমী তখন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ছেলেকে শাসন করতে আসে। রুদ্র তখন নিজেকে বাহবা দিয়ে বলে,
-” যে ছেলের মা’কে কন্ট্রোল করতে জানে সে ছেলেকেও কন্ট্রোল করতে জানে। তুমি জানো না এটা তোমার ব্যর্থতা। ”
এভাবে প্রায়ই তাদের খুনসুটি চলে। সবসময় রুদ্রিক ফুল এনার্জিতে থাকে। আর রুদবা জন্ম থেকেই দুর্বল প্রকৃতির। তার প্রতি বিশেষ যত্ন সব সময় নেয়া হয়। রুদ্র হৈমীর তুলনায় কম চিন্তা করে রুদবাকে নিয়ে। সে পুরোপুরি নিশ্চিত মেয়েটা তার মতো গম্ভীর প্রকৃতিরই হবে। আর ছেলেটা হবে মায়ের মতোন। হাই লেভেলের দুষ্টু।
.
.
রাতে এসে বোনের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলল রুদ্র। এ বাড়িতে সে আসতে চাইলেও শাশুড়ির জন্য আসতে পারে না। এতে অবশ্য মন খারাপ হয়নি। বাবা, ভাইকে বুঝিয়ে বলেছে শাশুড়ি মা তার যত্ন করতে চায় বলেই যেতে দেবে না। এরপর থেকেই প্রতিমাসে দু’বার করে মেয়েকে দেখে আসেন রিদওয়ান শেখ। মনকে দেখার জন্য রুদ্রর মনটাও ভীষণ ছটফট করছিল। তাই বলল, আগামীকাল হৈমী আর বাচ্চাদের নিয়ে সে আসছে। রুদ্রর এহেন কথা শুনে হৈমী, সূচনা দু’জনই বিস্মিত হলো। বাচ্চা হওয়ার পর একবারো বাপের বাড়ি যায়নি হৈমী৷ রুদ্র যেতে দেয়নি৷ কত রাত চোখের পানি ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেছে। রাগ হয়েছে, কথা বলা বন্ধ করেছে। লাভ হয়নি। অথচ আজ নিজে থেকেই নিয়ে যেতে চাইছে। প্রথমে মনে হলো, পুরোটাই সূচনার জন্য। সূচনাকে দেখতে মন চেয়েছে বলেই। কিন্তু পরে ভাবল, তাহলে রুদ্র একাই গিয়ে দেখে আসতে পারত। বাচ্চাদের সহ তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই যেত না?
পরেরদিন সত্যি সত্যি নিজের বাড়ি এলো হৈমী। নাতি, নাতনি কাছে পেয়ে হামিদার খুশি যেন ধরেই না। মাহেরও ভাগ্না,ভাগ্নিকে নিয়ে বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়াল৷ সূচনা ওদের কোলে নিতে পারল না বলে তার খুব মন খারাপ হলো। মাহের রুদবাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেদের ঘরেই শুইয়ে দিল। রুদ্রিক তখন মায়ের কোলে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। হৈমী অতিষ্ঠ মুখে বিছানার এক কোনে গিয়ে বসল। বসাতে যেন দ্বিগুণ রেগে গেল ছেলেটা। সে তার ফোকলা দাঁতে মায়ের গলায় কামড়াতে শুরু করল! দন্তহীন কামড় তবুও ব্যথায় ‘ আহ ‘ সূচকে শব্দ করল হৈমী। মাহের দ্রুত এসে ভাগ্নাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করল। তবুও কান্না থামানো গেল না। হামিদা শুরু করল,হায় হুতাশ। দোয়া, দরূদ পড়ে ফুঁ দিতে লাগল নাতির সারা গায়ে। সূচনা ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলল,
-” ওর বোধ হয় এখানের পরিবেশ ভালো লাগছে না।”
রুদ্র কিছু সময়ের জন্য বাইরে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর হৈমীকে কাঁদতে দেখল। মাহেরের কোলে ছেলে কাঁদছে। বিছানায় বউ কাঁদছে। বোন এসে চিন্তিত মুখে স্বামীর কোলে রুদ্রিকের দিকে তাকিয়ে। হামিদা দোয়া দরূদ পড়ে সমানে ফুঁ দিচ্ছে রুদ্রিককে। এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে অধর কামড়ে এগিয়ে এলো সে। মাহেরে থেকে রুদ্রিককে নিয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আকাশের চাঁদ, তাঁরা দেখিয়ে দীর্ঘক্ষণ ছুটোছুটি করে শান্ত করল ছেলেকে। ছয়মাসের একটা বাচ্চা সামলাতে গিয়ে সবার কী বেহাল দশা হলো! আর রুদ্র জাস্ট ছয় মিনিটেই শান্ত করে ফেলল। রুম থেকে ছেলের শান্ত ভাব টের পেয়ে হৈমীর কান্নার বেগ বাড়ল। মায়ের দিকে তাকিয়ে নালিশ জানালো,
-” দেখেছ ঠিক বাবার মতো হয়েছে। বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। আমাকেও চিনে না। ”
হামিদা চিন্তিত মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” রুদ্রিক তোর মতো হয়েছে রে। তুইও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেই এমন করতিস। তোর জন্মের পর পাঁচ বছর বাবার বাড়ি গিয়ে রাত কাটাতে পারিনি। ঠিক এই দৃশ্যটাই তখন হতো। তিনবার এমন হওয়ার পর তোর বাবা বলেই দিল মেয়ে বড়ো, বুঝদার না হলে বাপের বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই! ”
দূর্ভাগ্যবশত হামিদার উক্ত কথাটি শুনে ফেলল রুদ্র। ঘুমন্ত ছেলেকে হৈমীর দিকে বাড়িয়ে ধরে গম্ভীর মুখে বলল,
-” সিদ্ধান্ত নিয়েছি সামনের মাসে ওদের নিয়ে ঢাকা চলে যাব। এখান থেকে অফিস করতে সমস্যা হচ্ছে। রুদ্রিক, রুদবাকে ছেড়ে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই এ মাসটা হৈমী এখানেই থাকবে। ”
রুদ্রর কথা শুনে হৈমী অবাক হয়ে গেল। হামিদা আঁতকানো সুরে বলল,
-” কী বলছ বাবা! ছোটো দু’টো বাচ্চা নিয়ে কীভাবে একা থাকবে ওখানে? ”
হৈমী রুদ্রিককে বুকে আগলে আশ্চর্য মুখে তাকিয়ে রইল। রুদ্র হৈমীর দিকে গম্ভীর চাহনি ছুঁড়ে শাশুড়িকে জবাব দিল,
-” সমস্যা হবে না। ”
-” তুমি বুঝতে পারছ না। জমজ বাচ্চা নিয়ে এভাবে থাকা যায় না। তাছাড়া হৈমীর পড়াশোনা। ওখানে একা বাচ্চা, সংসার সামলে পড়াশোনা হবে কী করে? তুমি কি ওর পড়াশোনাও বন্ধ করতে চাইছ? ”
রুদ্র শাশুড়ির চোখে দৃঢ়তার সঙ্গে দৃষ্টি মেলালো। বলল,
-” বাসায় পড়বে। পরীক্ষার সময় এখানে এসে পরীক্ষা দেবে। আমি পড়াব ওকে। ”
হামিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” এভাবে হয় না। ”
হৈমী বলল,
-” আপনি আমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন? ”
সহসা রুদ্র শীতল চাহনি ছুঁড়ল। হৈমীর বুকটা ধক করে ওঠল তৎক্ষনাৎ। হামিদা আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ে জামাইয়ের জন্য খাবার বাড়তে গেল। রুমে এখন হৈমী, রুদ্র আর ঘুমন্ত রুদ্রিক। হৈমী রুদ্রিককে বিছানায় শুইয়ে দিল যত্ন করে। এরপর রুদ্রর সঙ্গে সরাসরি কথা বলল,
-” আপনি কী চাইছেন? ”
রুদ্র ভণিতা ছাড়াই বলল,
-” শান্তিতে সংসার করতে চাইছি। ”
-” আর আমার চাওয়া? ”
ভ্রু কুঁচকে গেল রুদ্রর। বলল,
-” তোমার কী চাওয়া? ”
হৈমী এক মুহুর্ত ভাবল। সত্যিই তো তার চাওয়াটা কী? অনেক ভেবেও পেল না কিছু। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী কোনোকালেই ছিল না সে। তাই ওটা বাদই দিল। আর তখনি মনে পড়ল টিশার দেওয়া সেই বুদ্ধিটার কথা। এছাড়া রুদ্রকে আরেকটু জব্দ করতেও ইচ্ছে করল। তাই বলল,
-” আপনার কথা পূরণ করা। ”
-” মানে! ”
আচমকা ওঠে রুদ্রর সামনে দাঁড়াল হৈমী। মুখোমুখি হয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” বাচ্চাদের নিয়ে একাই চলে যান ঢাকা। কথা তো এটাই ছিল৷ ওদের জন্ম দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ। আমি সে কথা পূর্ণ করতে চাই৷ এতদিন সময় দিয়েছিলাম ওরা একটু বড়ো হওয়ার। ”
-” হৈমী! ”
চাপা ধমকে শিরদাঁড়া সোজা হলো হৈমী৷ মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিল একদফা। ওড়নার কোণা ধরে নাচাতে নাচাতে বলল,
-” আপনার চাওয়া পূর্ণ করাই একমাত্র চাওয়া আমার। ”
রুদ্র নিজেকে শান্ত করতে চেয়েও পারল না। সহসা হৈমীর বাহু টেনে নিজের কাছে আনল। মুখশ্রীতে কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-” তুমি এখন বাচ্চা নেই হৈমী৷ তোমার দু’টো বাচ্চা আছে, একটা স্বামী আছে। ”
-” ওহ। ”
-” কী ওহ তুমি জানো না তোমার দু’টো বাচ্চা আছে? ”
-” তা জানি কিন্তু স্বামী তো একটাই। ”
চোখ কটমট করে দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল,
-” বাজে বকছ। ”
শব্দ করে হেসে ফেলল হৈমী। রুদ্র আচমকা ওর ঠোঁটে হাত চেপে নিচু গলায় বলল,
-” রুদ্রিক ওঠে যাবে। ”
সচেতন হয়ে ছেলের দিকে একবার তাকাল হৈমী। এরপর রুদ্রর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। রুদ্র কিয়ৎকাল থম ধরে বসে থেকে বলল,
-” এখন আর পাগলামি করার বয়স নেই হৈমী। আমরা এখন দু’টো শিশুর বাবা, মা। যা হয়েছে সব ভুলে যাও ওদের জন্য আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে থাকতে হবে। ”
ভ্রু বাঁকিয়ে হৈমী বলল,
-” শুধুই ওদের জন্য? ”
রুদ্র এক মুহুর্ত নিশ্চুপ রইল। হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল প্রগাঢ় চোখে। কীভাবে কী বোঝাবে? আজো তো এই মেয়েটাকে মনের কথা সোজাসাপটা বলতে পারল না। তার দু’টো বাচ্চার মা’কে সে কতখানি ভালোবাসে আর কবে বলতে পারবে? দোনোমোনো করে খোলা দরজার পানে তাকাল রুদ্র। ধীরেসুস্থে ওঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল হৈমীর কাছে এলো। হৈমী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে সামনাসামনি এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে বলল,
-” আজ এগারো মাস হৈমী। তোমার আমার মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সেই সম্পর্কটা নেই। যেই সম্পর্কটা না থাকলে পুরুষ বাধ্য হয় পরনারীতে আসক্ত হতে। গত কয়েকমাসে তুমি নিজে থেকেই অসংখ্যবার আবদার করেছ। এটা তোমার অধিকার। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি কেন জানো? সেই রাতে তুমি বলেছিলে আমি নাকি তোমার শরীরটাকে ভালোবাসি। যেদিন এই শরীরটা না থাকবে সেদিন তোমার প্রতিও আমার কোনো মোহ থাকবে না। বাবু হওয়ার আগে পরের সময়টুকু আমি শুধু বাবুদের জন্য সেক্রিফাইস করছি। ব্যস। তুমি হয়তো ঠাট্টা করে এসব বলেছিলে। কিন্তু কথাগুলো আমার লেগেছিল ভীষণ ভাবে৷ সেই লাগা থেকেই এখন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমি অন্তরঙ্গ হইনি। আর হ্যাঁ বৈধভাবে পাইনি বলে অবৈধভাবে পাওয়ার বাসনাও জাগেনি মনে। আমি তোমাকে বোঝাতে পারলাম কি না জানি না৷ তুমি বুঝেছ কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না। শুধু বলব, রুদ্র নিজেকে অসংখ্যবার ভেঙেছে, অসংখ্যবার গড়েছে৷ এই রুদ্র হৈমীর কাছে শুধু মানসিক সুখ চায়। সেদিন হসপিটালে আমি বাবুদের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, শুধু তোমার জন্য৷ আজ যদি তুমি বলছ, ওদের আমাকে দিয়ে তুমি চলে যাবে। তাহলে বলব, ওদের দিয়ে নয় বরং নিয়েই আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে যাও। ”
চমকে ওঠল হৈমী। সহসা রুদ্রর ঠোঁটজোড়ায় হাত রাখল। হতভম্ব স্বরে বলল,
-” আপনি চুপ করুন। অনেক বলেছেন আর কিছু শুনতে চাই না আমি। ”
আলগোছে হৈমীর হাতটা সরিয়ে দিল রুদ্র। দু-হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে দায়সারা ভাবে বলল,
-” আমি চুপই রইলাম। আছি তো চুপ। তোমার কাছে কিছু চাওয়ার নেই৷ শুধু বাচ্চাদের দায়িত্ব নাও, আমার কাছে থেকে যাও। ”
হৈমীর চোখদুটো টলমল করছিল। চট করে সে রুদ্রর বুকে কয়েকটা কিল বসাল। অভিমানের স্বরে বলল,
-” এমন করে বলছেন যে আমি ওদের মা নই৷ পর কেউ। আরে আশ্চর্য! আমার সন্তান ওরা। আমার আদুরে বাচ্চা, কলিজার টুকরো। ওদের দায়িত্ব নিতে আপনার বলতে হবে কেন। আপনার থেকে ওদের জন্য আমার দরদ বেশি বুঝলেন। ”
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে দৃষ্টি আড়াল করল। নিজের ভয়াবহ শৈশব মনে পড়ছে তার। হৈমীর তখনকার কথা শুনে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠেছে। যে ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে। যে পরিস্থিতি সে মোকাবিলা করেছে। তা যেন তার সন্তানরা না করে। হৈমী যদি বাচ্চাদের ছেড়ে চলে যায় তাহলে রুদ্রিক, রুদবাও যে তার মতো মাতৃহীন বড়ো হবে। যেই কষ্ট সে ভোগ করেছে তা তার সন্তানরাও করবে এটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। হৈমী পেছন থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল,
-” ভয় পাচ্ছেন ? ”
রুদ্র কিছু বলতে উদ্যত হতেই হামিদার ডাক পড়ল,
-” হৈমী জামাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে আয়। মাহের অপেক্ষা করছে। ”
________________________
দাদিনের সাথে রুদ্রর সম্পর্কের কোনো উন্নতি নেই। দিনকে দিন অবনতি হয়েই চলেছে। এরই মধ্যে দাদিন গোপনে সুরভির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পাশাপাশি শেখ বাড়ির অর্ধেক অংশ রিমনের নামে লিখে দেয়ার বন্দোবস্তও করেছে। মায়ের দ্বারা এমন কিছু হতে পারে কল্পনাতীত ছিল রিদওয়ানের। মানুষ যা কল্পনা করতে পারে না তা ঘটে যায় অনায়াসে। আবার যা কল্পনা করে তা কখনোই ঘটবার নয়। রিদওয়ান মায়ের এই কর্মের জন্য সরাসরি এক রাতে প্রশ্ন করে। রাগারাগি করে, শেষে অভিমান করে মধ্যরাতেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাটা সম্পূর্ণ গোপন থাকত। যদি না ছোটো কাকি রিনা দরজার আড়ালে থেকে সব কথা না শুনত। রিনা কাকি সব কথা শুনে রুদ্রর কানে লাগিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে দাদিনের প্রতি ঘৃণাটা তীব্র হয় রুদ্রর। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যতদ্রুত সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তার বিশ্বাস বাবাও আর এ বাড়ি মুখো হবেন না৷ হওয়ার কথাও নয়৷ প্রাক্তন স্ত্রী বড়ো ভাইয়ের বউ হয়ে তার সন্তানের মা হয়ে এ বাড়িতে অধিকার আদায় করবে। চোখের সামনে এসব দেখে কি স্থির থাকা সম্ভব? নাহ সারাজীবনের জন্য এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকানোর সময় এসেছে। রাদিফ, বড়ো চাচিরাও হয়তো একই কাজ করবে৷ বাকি রইল ছোটো চাচা। তার পরিবার আর আর দিলওয়ার শেখের পরকীয়ার বউ বাচ্চাই হয়তো এ বাড়িতে রাজত্ব করবে বাকি জীবন। মানতে কষ্ট হলেও মানতে হবে। জীবন তো এটাই…
.
.
কিছুদিন পর,
মধ্যরাত। সূচনার পেইন ওঠে আচমকা। মাহের মাকে সঙ্গে করে সূচনাকে নিয়ে সরাসরি হসপিটাল চলে যায়। পথেই ফোন করে দেয় সূচনার বাবা আর রুদ্রকে। রুদ্র আসার পর পরই নার্স জানায় সূচনার ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হয়েছে। এর পরমুহূর্তেই ভেতর থেকে সাদা তয়ালে পেঁচানো ধবধবে সাদা মুখের টকটকে লাল ছোট্ট গোল ঠোঁট, মাথা ভর্তি কুচকুচে ঘন চুলের বাচ্চাটিকে নিয়ে আসে। সদ্য দাদি হওয়া হামিদার কোলে তুলে দেয় উল্লসিত মুখে। দু’হাতে মুখের সমস্ত ঘাম মুছে নেয় মাহের৷ মুগ্ধ চোখে সদ্য জন্মানো নিজের অংশটুকুতে তাকিয়ে রয়। নার্সের উদ্দেশ্যে কাতর স্বরে প্রশ্ন তুলে,
-” ওর মা, ওর মা ঠিক আছে? আমার বউ। ”
নার্স প্রশস্ত হেসে জানায়,
-” একদম ঠিক আছে। কোনো চিন্তা করবেন না। ”
সূচনার বাবা, রুদ্রর চিন্তিত মুখে এক চিলতে হাসির দেখা মেলে। রুদ্র ঝটপট হৈমীকে ভিডিয়ো কল দেয়। দেখায় সূচনা, মাহেরের মেয়েকে। নিজের ছোটো বাচ্চা দু’টোর জন্যই হৈমী আসতে পারল না। ফোনেই বাচ্চা দেখল। খুশিতে গদগদ হয়ে মাহেরকে বলল,
-” এই ভাইয়া ওকে তো আমার ছোটোবেলার মতো লাগছে। ”
মাহের তৃপ্তি ভরে হাসল। বলল,
-” ফুপির মতো হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ”
রুদ্র ঘোর বিরোধিতা জানালো,
-” না ঘুমানোর ফলে তোমার চোখে সমস্যা হচ্ছে হৈমী। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সূচনার ছোটোবেলার মুখ। বাবা, তুমি দেখছ তো? ”
রিদওয়ান শেখ নাতনির মুখের দিকে মমতা ভরে তাকিয়ে ছিলেন। রুদ্রর কথায় মাথা নাড়লেন। হৈমী নাক ফুলালো। রুদ্রর চোখে দুষ্টু হাসি। যা দেখে হৈমী ফুঁসে ওঠল। ভাইকে বলল,
-” ভাইয়া সত্যিটা তুমি বলো। ”
মাহের বলল,
-” কার মতো হলে তুমি খুশি? ”
হৈমী একটুক্ষণ ভেবে বলল,
-” তোমার আর ভাবির মতো। ”
মাহের আলতো হেসে বলল,
-” আমাদের মতোই হয়েছে হৈমী। তোমার, আমার মুখের আদল তো একই। বাবা, ফুপির আদলটাই পেয়েছে। ”
হামিদা ঠোঁট টিপে হাসলেন। আমাদের মানুষদের মাঝে এটা খুবই পরিচিত চিত্র। যখন কোনো নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসে। তার আপনজনেরা হুড়মুড়িয়ে লেগে পড়ে কার সঙ্গে তার ঠিক কী কী মিল রয়েছে। সদ্য জন্মানো শিশুটি ঠিক কার মতো হয়েছে? এই উত্তর মেলানো পরিবারের লোকদের জন্য যেন বাধ্যতামূলক।
চলবে…#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬০
যার জীবনে আত্মিক শান্তি নেই। তার জীবনের কি কোনো মূল্য আছে? শেখ বাড়িতে অবস্থানরত ঐ বৃদ্ধাটি ভুগছে তীব্র মানসিক অশান্তিতে। কোনটা ঠিক হবে? আর কোনটা বেঠিক? এই নিয়ে অশান্তিতে ভুগছে মানুষটা। সকলেই যার যার জীবনে ব্যস্ত৷ এরই মধ্যে ঢাকা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ রুদ্রর। বউ, বাচ্চা নিয়ে আগামীকালই চলে যাবে সে। হৈমী ছেলে, মেয়ে দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। রুদ্র ডিভানে বসে ল্যাপটপ ঘাটাঘাটি করছে। স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে সে বলল,
-” শুনছেন? ”
গম্ভীর স্বর রুদ্রর,
-” বলো। ”
-” শুধু কাজই করবেন না। এদিকটায় নজর রাখুন একটু। আমি নিচে যাচ্ছি। ”
-” কী দরকার? ”
-” দাদিনের সঙ্গে গল্প করতে। বাবুদের নিয়ে তো সময়ই হয়না তেমন৷ কাল চলে যাব তাই দাদিনের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসি গিয়ে৷ উনার বোধহয় শরীরটা ভালো নেই। চোখ, মুখ কেমন ফুলে গেছে। ”
এক মুহুর্ত মুখ শক্ত করে রইল রুদ্র। পরোক্ষণেই রাশভারী স্বরে বলল,
-” দরকার নেই। অন্য কাজ থাকলে করো। ”
কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো হৈমী। বলল,
-” দেখুন এত জেদ ভালো নয়। বড়োরা ভুল করলেও সেটা ক্ষমার চোখে দেখতে হয়। তাছাড়া আপনাদের ভুল বুঝাবুঝির মাঝে আমাকে টানবেন না। ”
-” তুমি আমার বউ। আমার সঙ্গে জড়িয়ে সবকিছু এখন তোমারও। ”
-” এই ব্যাপারে না। আমি আপনার মতো বুক-পিঠ ছাড়া মানুষ না। ”
রুদ্রর চোখ যেন কপালে উঠে গেল। স্থিরভাবে তাকাল হৈমীর বুকের দিকে। হকচকিয়ে গেল হৈমী। লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে বলল,
-” কী আশ্চর্য ব’দ আপনি! এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? বুড়ো বয়সে ভীমরতি হচ্ছে? ”
বুড়ো কথাটি শুনেই চোয়াল শক্ত হলো রুদ্রর। ইগোতে লাগল খুব। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” বুড়ো মানে? ”
-” বুড়োই তো। মাঝরাতে এত খুঁচানোর পরও যার আমার প্রতি ফিলিংস আসে না। সে নিঃসন্দেহে বুড়ো! কপাল মন্দ বুড়ো জামাই কপালে জুটেছে। বাচ্চা গুলোও বুড়ো একটা বাবা পেল। এ জীবনে আর বোধহয় ভাই, বোন দেখার কপাল হবে না ওদের। ইস খুব আফসোস হয়। ”
বুকের ভেতর যেন বিস্ফোরণ ঘটল রুদ্রর। আজ সত্যিই সে বলতে বাধ্য নারী মন বোঝা মুশকিল। জিলেপির প্যাঁচের চেয়েও শতগুণ প্যাঁচ রয়েছে এদের মনে৷ এই যে সম্মুখে দাঁড়ানো বিশ ছুঁই ছুঁই মেয়েটা। এই মেয়েটাই এক দিন তাকে কত কী উপাধি দিয়েছে। ধ’র্ষক বলেছে। সে শুধু তার শরীরের প্রতি আসক্ত। তার প্রতি শুধুই শরীরের টান মনের টান বলে কিছু নেই। আরো কত কীই তো বলেছে। এতসব অপমান বুকে নিয়ে যখন সে সত্যিই প্রমাণ করতে ব্যস্ত আসলে সে আগের সেই রুদ্র নেই৷ সময়, পরিস্থিতি তাকে অনেক পরিবর্তন করেছে। কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভালোবাসা সে বুঝতে শিখেছে। ঠিক তখনি আবার তার পুরুষত্বে প্রশ্ন তুলে বসল! অফিসে কত মেয়ে স্টাফ তাকে চোখ দিয়ে গিলে খায় অথচ নিজের বউ কিনা বলছে সে বুড়ো!
গরম তেলে পেঁয়াজ দিলে যেমন ফুঁস করে ওঠে৷ সেভাবেই ফুঁস করে ওঠল রুদ্র। অদ্ভুত করে তাকাল মুখে খই ফুটা হৈমীর পানে। এরপর বাঁকা হাসি ঠোঁটে লেপ্টে ওঠে এসে সামনে দাঁড়াল। মুখ নিচু করে হৈমীর চোখে প্রগাঢ় দৃষ্টি ছুঁড়ে হুঁশিয়ারি দিল,
-” আমার দুই বাচ্চার কচি মা, এতগুলো মাস জমিয়ে রাখা ফিলিংসের ধকল সামলাতে প্রস্তুত থাকো। তোমার দুই বাচ্চার বুড়ো বাবার ইন্টেনসিটি অফ ফিলিং কতখানি আগামীকাল থেকে হাড়ে হাড়ে টের পাবে। ”
এক নিমিষে হাসিহাসি মুখখানি হারিয়ে গেল হৈমীর৷ বুকের ভেতরটায় বেসামালভাবে দ্রিমদ্রিম শব্দে মুখরিত হলো। ফোলা ফোলা গালদুটো রঙিন হয়ে পাকা টমেটোর মতো দেখালো। বেসামাল নিঃশ্বাস ফেলা, সীমাহীন ভয়, লজ্জায় গুটিয়ে যাওয়া হৈমীকে আপাদমস্তক দেখে দুর্বোধ্য হাসল রুদ্র। চোখের ইশারায়া কত শাসানি যে শাসালো। হৈমীর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো সেই ইশারা দেখে। অবস্থা টের পেয়ে মাথা দুলিয়ে আরেকটু হেসে সামনে থেকে সরে গেল রুদ্র। তবে তার গুনগুন করে ছন্দ আওড়ানো শুনতে পেল হৈমী,
-” যাচ্ছে দিন, আসছে রাত। বোঝাবো কাল অনুভূতির জোয়ার। ”
ছন্দ শুনে মাথা ভনভন করে ওঠল হৈমীর। বারকয়েক ঢোক গিলে বাচ্চাদের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। বিরবির করে বলল,
-” কাল রাতে তোরা জেগে থাকবি। জেগে তোদের থাকতেই হবে। ”
_________________
হৈমীর সঙ্গে গল্পের ফাঁকে দাদিন বলেছে, আগামীকাল হৈমী যেন গোপনে তার থেকে একটা চিঠি নিয়ে যায়। নিয়ে তার শশুরকে দিয়ে বলে, ফোনে এসব বলতে পারবে না বলেই চিঠি লিখেছে সে। হৈমী দাদিনকে কথা দেয় সে নিয়ে যাবে। দাদিনও রাতের বেলা বদ্ধ ঘরে বসে ছেলেকে একটি চিঠি লিখতে বসে।
আমার রিদু,
আজ তুই অনেক বড়ো। আমার তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে সফল তুই৷ আমার তিন নাড়িছেঁড়া ধনের একজন তুইও বাবা। যার মধ্যে কখনো কোনো অন্যায় দেখিনাই। অত্যন্ত ন্যায় নীতি সম্পন্ন মানুষ হয়েও তুই জীবনে অনেক আঘাত পাইছিস। শেষ আঘাতটাও বোধহয় আমিই তোকে দিব। কী করব বাবা। তোর কু”লাঙ্গার ভাই যে আর কোনো পথ রাখে নাই। সুরভি পরের বাড়ির মেয়ে। তার ভালো, মন্দ চিন্তা আমি করি না৷ কিন্তু রিমন সেও তো এই বাড়ির অংশীদার। আমার বংশধরেরা রাস্তায় ভিখারির মতো জীবন পার করবে আমি বেঁচে থাকতে তা তো হয় না বাবা। তোর কাছে আমি স্বার্থপর মা হবো জানি। কিন্তু মায়েরা তো এই স্বভাবরেই। আমরা সবার চিন্তাই করি, আসলে করতে হয়। সব চাইতে খারাপ অবস্থায় যে থাকে তার চিন্তা না চাইলেও এসে যায়। নিরুপায় আমি। দিলুকে আমি এই বাড়িতে কোনোদিন জায়গা দিব না। এতদিন মা হিসেবে যতটুকু করলাম সেটুকু যে অন্যায় তা চোখে আঙুল দিয়ে উপরওয়ালা দেখিয়ে দিছে। তার কুকীর্তি তোরও অজানা নাই নিশ্চয়ই। তোর বাবার এই বাড়ির যে অংশ রাদিফ, সাদমান পাবে তার চারভাগের এক ভাগ রিমনকে দিতে ইচ্ছুক আমি। কিন্তু তোর অসন্তুষ্টির জন্য সব ব্যবস্থা স্থগিত রাখছি। এইদিকে আমার সিদ্ধান্তে সুরভি রাজি হয়নি। সে পথে ভিক্ষা করবে তবুও এই বাড়িতে আসবে না জানিয়েছে। আমি বলে দিছি, শেষকালে রিমন যেন নিজ শেকড়ে একটু জায়গা পায় সেই বন্দোবস্ত করে দিব। আজ থেকে বিশ বছর পর হলেও যেন সে তার অধিকার পায়। সেই ব্যবস্থা। সুরভি এ জীবনে তোর মুখোমুখি হবে না। পাপে ধরেছে ওকে। সেজন্যই নির্লজ্জ হয়ে অনুমতি সত্ত্বেও এ বাড়ি আসবে না। ওদের দিনকাল ভালো যায় না। ছেলেটা কলেজ পাশ করে ভালো কোথাও ভর্তিও হতে পারেনি। দিলু আর সুরভির করা অন্যায়ের শাস্তি সবাই পেলরে রিদু৷ রাদিফ, সাদমান, রুদ্র, সূচনার জন্য আমরা সবাই ছিলাম। কিন্তু ঐ ছোটো ছেলেটার জন্য পাপী মা ছাড়া আর কেউ নাই। শুনেছি ছেলেটা নাকি নিজের জীবন আর মাকে নিয়ে দিনকে দিন যুদ্ধ করতেছে। অতীতে নিজের বাবা, মায়ের করা কাণ্ড নিয়েও আজকাল মাথা ঘামায়। গত সপ্তাহে, খবর পেলাম মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিছে। আমার বিশ্বাস, সুরভি তার আসল শাস্তি এই ছেলের দ্বারাই পাবে। শেষ সম্বলটুকুর চোখে নিজের জন্য অসহ্য ঘৃণা দেখা কি শাস্তি না? যাক গে সেইসব কথা। আমি তোদের কারো মনেই দুঃখ দিতে চাই না। সার্বিক দিক বিবেচনা করে যদি ঐ বিপদগ্রস্থ ঊনিশ বছর বয়সের বাচ্চা ছেলেটার প্রতি তোদের কৃপা হয় আমাকে জানাবি। তাহলে নির্ভারে সব কাজ সম্পন্ন করে দিব। কতকাল আর বাঁচব বল বাপ? যাওয়ার আগে সবার দিকেই এক নজর তাকানো আমার দায়িত্ব। ওপারে তোর বাবা যদি আমাকে প্রশ্ন করে সবার জীবন আমি গুছিয়ে দিছি কিনা কী জবাব দিব?
হে রে রিদু, তুই কি আর বিয়েসাদী করবি না? ছেলেমেয়েরা তো গোছগাছ করে নিল। তোর শেষ বয়সের দেখভালের জন্যও তো মানুষ দরকার। বাড়ি আসবি কবে? একটু সময় করে আসিস বাবা। মায়ের ওপর খুব রাগ হইছে না? একবারটি দেখা করিস। দূরে থাকলে রাগের বস্তা আরো ভর্তি হয় বুঝলি। কাছে আয়, অভিমান ভেঙে যাব। আসিস কিন্তু আমি পথ চেয়ে এই বসে রইলাম। রুদ্র তো কাল চলে যাব। তোর বউমার কাছে চিঠি পাঠাই দিব। শিগগিরই আসবি কিন্তু… মা যতই খারাপ হোক, মায়ের ডাকে মুখ ফেরাতে নেই। রুদ্র না হয় আমার নাতি। সে মুখ ফিরিয়ে থাকে বলে তুইও থাকবি? আমি না তোর মা।
। তোর আম্মা।
চিঠি লেখা শেষ করে চোখের পানি মুছল দাদিন৷ বালিশের নিচে চিঠিটা রেখে শুয়ে পড়ল নিঃশব্দে। শরীরটা খারাপ লাগছে। তাই জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। সময় গড়ালে এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল৷ আজো বোধহয় তার স্বপ্নে হাতছানি দেবে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মুহুর্ত। প্রতি রাতের মতো আজো ঘুম ভাঙলে হয়তো হাসফাস করবে। শেষ বয়সের একাকীত্বের ভার বহন করা কতটা কঠিন আমরা জানি না। হয়তো সেদিন যেদিন আমাদেরও শেষ সময় আসবে। জীবন তো এটাই। এটাই তো জীবন। মানব জীবন।
______________
হামিদা দু’দিনের জন্য বোনের মেয়ের বাসায় গেছে। টিশার বাবুটা নাকি খুব অসুস্থ। এমন অবস্থায় না গিয়ে থাকতে পারলেন না হামিদা। এদিকে চার মাসের মেয়ে নিয়ে সূচনারও বড্ড মুশকিল হচ্ছে। হঠাৎ করেই ঠাণ্ডা লেগেছে তার৷ ছোটো বাচ্চা নিয়ে সকাল সকাল রান্নাবান্না করা কষ্টই বটে। বউ, বাচ্চার অবস্থা বুঝে ফেলল বোঝদার মাহের৷ সূচনা বাসন মাজতে যাচ্ছিল। এমন সময় মেয়ে মিশকাতকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে এলো মাহের। সূচনা বলল,
-” ওকে নিয়ে এখানে এসেছ কেন? যাও ঘরে যাও। সর্দি লেগেছে তো ওর। ”
-” তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও এদিকটা আমি সামলাচ্ছি। ”
আশ্চর্যান্বিত হয়ে সূচনা বলল,
-” মজা করো না তো। ঘরে যাও। আমার অনেক কাজ। মা বলল, টিশার বাসা থেকেই ও বাড়ি যাবে সে। ভাইয়া তিনটার দিকেই বের হবে। আমাদের অন্তত বারোটা মধ্যে ওখানে উপস্থিত থাকা উচিৎ। ”
-” তুমি ওকে নাও আমি দ্রুত সব করে দিচ্ছি। ”
-” পাগল হয়ে গেছ তুমি। হাজব্যন্ড দিয়ে বাসন মাজানোর মেয়ে আমি নই মাহের প্লিজ। ”
দৃষ্টি দৃঢ় করল মাহের। দৃঢ় স্বরেই বলল,
-” বাসন মাজাটা জরুরি। স্বামী মাজলো না বউ মাজলো সেটা জরুরি নয়। আমাদের সংসারের সব কাজই আমাদের দুজনার। আর এই মুহুর্ত বাবুকে সুস্থ রাখতে হলে তোমার সুস্থতা জরুরি। সাতসকালে বাসন মেজে, ঠান্ডা পানি ধরে ধরে জ্বর, ঠান্ডা বাঁধাবে। এরপর মা, মেয়ে দু’জন মিলে ভুগবে। এরচেয়ে ভালো আমি এটা করে ফেলি। তোমরা দু’জন সেফ মানে আমিও সেফ কেন বুঝোনা? ”
সূচনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পরোক্ষণেই ধাতস্থ হলো৷ নাহ আর অবাক হবে না সে। অবাক কেন হবে? সে কতটা সৌভাগ্যবতী সে বিষয়ে এখন আর সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহে মাহের নামক পুরুষটা যে ওভারল গুড পার্সন। উহুম উহুম বেস্ট হাজব্যন্ড, বেস্ট বাবা।
মিশকাতকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাহেরের কাজ দেখল সূচনা। বাসন মেজে ফ্রিজ থেকে তরকারি গরম করল সে। ভাত আগেই বসিয়ে দিয়েছিল। ভাতটা হলেই দু’জনে খেতে বসল। মিশকাত তখন জেগে। মেয়েটা জেগে থাকা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে চায় না। কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়। নয়তো কাঁদতে থাকে খুব। মাহের মেয়ের কান্না একেবারেই সহ্য করতে পারে না। একসঙ্গে দু’জন খাবে কিন্তু মিশকাতকে রাখতে গিয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। সূচনা বলল,
-” তুমি খেয়ে ওকে রাখো। তারপর আমি খাব। ”
এক মুহুর্ত ভেবে মাহের বলল,
-” আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আমাদের হাতে সময় কম। ঝটপট খেয়ে ও বাড়ি যেতে হবে। ”
সূচনা না করতে গিয়েও থেমে গেল। তার ঘরের দরজায় সুখেদের ভীড়। এত সুখ ফিরিয়ে না দিয়ে দরজা উন্মুক্ত করে রাখা ভালো। যত পারে আসুক না বুকে জমুক না এক সমুদ্র সুখ।
মিশকাতকে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াতে লাগল সূচনা। আর মাহের নিজে খাওয়ার পাশাপাশি সূচনাকেও খাইয়ে দিতে লাগল। খাবারের প্লেট হাতে কখনো বউ বাচ্চার পিছু হাঁটল, কখনো বা পাশাপাশি। এভাবে পেট ভরে এক সঙ্গে খেয়ে নিল দু’জনই। এই দম্পতির কানায় কানায় মিষ্টি সুখে পরিপূর্ণ। হৃদয়ে হৃদয়ে তীব্র ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে, ছিটিয়ে। একেবারে মেইড ফর ইচ আদার কাপল।
চলবে…