হারিয়েছি নামপরিচয় পর্ব -২৭ ও শেষ

#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ২৭ ও শেষ পর্ব।
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মেঘলা আজ অনেকদিন পরে ঢাকা শহরে ফিরল। এখানে আসার কারণ মুন্নির বিয়েতে উপস্থিত থাকা। মুন্নির সাথে তার বন্ধু রাসেলের বিয়ে হতে চলেছে আজ।

বাড়ি ফিরে সবার সাথে দেখা হলেও রিফাতের সাথে মেঘলার দেখা হয়না। রিফাত নাকি কোন একটা জরুরি কাজে অফিসে রয়েছে। যার দরুন মেঘলার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ সে ভেবেছিল আজ অনেকদিন পর রিফাতের সাথে দেখা হবে। কত আনন্দ করবে দুজনে। আর এখন শুনছে রিফাতই বাড়িতে নেই। মন খারাপ করে ঘরে বসেছিল মেঘলা। আচমকা রোদেলা পেছন থেকে এসে মেঘলাকে চমকে দেয়। মেঘলা অভিমান করে বলে,
‘এভাবে ভয় না দেখালেও পারতি রোদ। এমনি আমার মন ভালো নেই।’

রোদেলা হালকা হেসে বলে,
‘তোর মন কেন ভালো নেই সেটা আমি জানি। আমার সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানের ওখানে চল। আর একটু পর বর চলে আসবে। মুন্নি তৈরি হচ্ছে। রিফাত বিয়ের আগেই চলে আসবে।’

‘তোকে কে বলল রিফাতের জন্য আমার মন খারাপ?’

‘আমাকে কি তোর গা’ধা মনে হয়? এখন বেশি কথা না বলে চল তো। ‘

অগত্যা রোদেলার সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানের ওখানে চলে যায় মেঘলা। এসেই দেখা হয়ে যায় রিফাতের সাথে। রিফাত সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরল৷ খুব ক্লান্ত লাগছিল রিফাতকে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব তাড়াহুড়ো করে এসেছে। রোদেলা মেঘলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
‘দেখ তোর জামাই এসে গেছে। আর মন খারাপ করে থাকিস না মেঘ। যা গিয়ে সব মান অভিমানের পালা মিটিয়ে নে। আমি দেখি আমার উনি কি করছেন। তোর বরতো তবু তোর কত খেয়াল রাখে আর মুবিন সে তো সারাদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।’

রোদেলা চলে যায়। মেঘলাকে দেখে রিফাত তার দিকেই আসছিল। মেঘলা অভিমান করে নিজের রুমের দিকে যায়। রিফাতও মেঘলার পিছুপিছু তার রুমে যায়।

মেঘলা নিজের রুমে রিফাতকে দেখে অভিমানী সুরে বলে,
‘এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো। আমাকে চট্টগ্রামে নিতে যাবেন বলেও তো নিয়ে গেলেন না। এখন কেন এসেছেন?’

‘খুব রাগ হয়েছে আমার উপর?’

‘রাগ হবে কেন? আমি কি আপনার উপর রাগ করতে পারি।’

রিফাত বুঝতে পারে বেশ ভালোই রাগ হয়েছে মেঘলার। তাই সে মেঘলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘আসলে কাজের এত চাপ ছিল যে,,,’

মেঘলা আর অভিমান করে থাকতে পারে না। সামনে ঘুরে রিফাতকে আলিঙ্গন করে বলে,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন নিচে চলুন। বিয়ের সময় তো হয়ে এলো।’

৫৩.
মুন্নি ও রাসেলকে সামনাসামনি বসানো হয়েছে। তাদের বিয়ে পড়ানো শুরু হয়েছে। কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

বিয়ের পর বিদায়ের আয়োজন চলছিল। মুন্নির ফোনে আচমকা একটি ম্যাসেজ আসে। মুন্নি ম্যাসেজটি দেখে। সেখানে লেখা,
‘নতুন জিবনের জন্য শুভকামনা। তোমার জিবন সুখের হোক। এই বন্ধুকে ভুলে যেওনা—আরিয়ান।’

ম্যাসেজটি দেখে মুন্নি হালকা হাসে। আরিয়ান মুন্নিকে কখনো ভালো বাসার কথা বলতে পারে নি। হ্যা বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে চেয়েও পায়নি। বরং সেদিন আরিয়ানের সাথে দেখা করে ফেরার পথে রাসেল মুন্নিকে প্রপোজ করে। পরপর দুইবার ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে বিদেশে চলে যায় আরিয়ান। সেখানে গিয়ে কাউকেই আর মন থেকে ভালোবাসতে পারে নি। তবুও চেষ্টা করেছে ভালোবাসার। কিন্তু কোন মেয়ের উপরেই আর ইন্টারেস্ট খুজে পায়নি সে। তাই বারবার ভিন্ন মেয়ের পিছনে ঘুরতে থাকে।

রাসেল ও মুন্নির বিদায় হয়ে যায়। মুন্নি নিজের পরিবারকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় শ্বশুর বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। মেহের নিজের মেয়েকে বিদায় দিয়ে কান্না করতে থাকে। রোজিয়া মেহেরকে সামলানোর চেষ্টা করে। এখন আর আগের মতো দা-কুমড়া সম্পর্ক নাই তাদের। দুজন এখন দুই বোনের মতো থাকে। রোজিয়া বুঝতে পেরেছে যা হয়েছে তাতে মেহের কোন দোষ নেই৷ তার স্বামীই আসল দোষী।

আজ অনেকদিন পর রিফাত ও মেঘলা একসাথে চন্দ্রবিলাস করছে। মেঘলা রিফাতের কাধে মাথা দিয়ে ছিল। রিফাত মেঘলাকে বলে,
‘তোমার মনে আছে মেঘলা আমাদের প্রথম বাসর রাতও আমরা এভাবে চন্দ্রবিলাস করে উপভোগ করেছিলাম।’

‘হুম মনে আছে।’

‘সেই সময় আমার কাছে তুমি ছিলে রোদেলা। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে তুমি হিসেবেই ভালোবেসেছি। ‘

মেঘলার মনটা খারাপ হয়ে যায় রিফাতের কথা শুনে।
‘আমার এখন আর অতীতের কথা ভাবতে ইচ্ছা করে না। সেইসময় আমার জন্য অনেক কষ্টকর ছিল। আমার নাম পরিচয় সবকিছু হারিয়ে ছিলাম তখন।’

‘আমি তো সেই নামপরিচয় বিহীন মেঘলাকেই ভালোবেসেছিল। একটা সত্য কথা জানো তো মেঘলা? তোমার মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি বৃষ্টির দিনে প্রথম একটা মেয়েকে দেখে ভালোবেসেছিলাম। সেই মেয়েটা রোদেলা ছিল না ছিলে তুমি। কিন্তু পরে আমি মুবিনের সাথে রোদেলাকে দেখে ভুল বুঝেছিলাম যে সে ঐ মেয়েটি।’

রিফাতের কথা শুনে রাজ্যের খুশি এসে ধরা দেয় মেঘলার বুকে। মেঘলা আহ্লাদী স্বরে বলে,
‘সত্যি আপনি আমাকে পছন্দ করেছিলেন? রোদ নয় আমি ছিলাম সেই মেয়ে?’

‘হুম।’

মেঘলার আজ খুব আনন্দ হচ্ছিল। মেঘলাকে খুশি দেখে রিফাত নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে ছুইয়ে দেয় তাকে। ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে তাদের ভালোবাসা৷ একসময় ভালোবাসায় মত্ত হয়ে যায় দুজনে।

৫৪.
৮ বছর পর,
সময় অনেক এগিয়ে গেছে। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে অনেককিছু। মেঘলা এখন একজন ডাক্তার হয়ে উঠেছে। যে একসময় নিজের নামপরিচয় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল সে আজ ফিরে পেয়েছে সবকিছু। পেয়েছে নতুন পরিচয়। আজ ডাক্তার মেঘলা ইসলামকে সবাই একনামে চেনে। কত সংকটাপন্ন রোগীকে সারিয়ে তুলেছে সে।

তবে এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। মেঘলার মাথায় সেই আঘাতের কারণে কোমা থেকে সেরে ওঠার দুইবছর পর একবার তার অনেক বড় সমস্যা হয়ে যায়। সেইসময় জিবন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে যায় মেঘলা। তবে আল্লাহর রহমতে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।

এখন মেঘলার জিবন পরিপূর্ণ। রিফাতের সাথে তার সুখের সংসার। তাদের দুজন সন্তানও আছে। মেঘলা ও রিফাতের ছেলে মেয়ে। যাদের বয়স যথাক্রমে ৬ এবং ৩। তাদের ছেলে মাহিম ও মেয়ে রিমি।

অপরদিকে রোদেলা ও মুবিনেরও সুখের সংসার। রোদেলা এখন একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। তাদেরও একটি ছেলে আছে যার নাম রোদ্দুর। মুন্নি ও রাসেলের একটি মেয়ে হয়েছে সবেমাত্র এক মাস হলো। অনেক অপেক্ষায় পর বাচ্চার মুখ দেখল মুন্নি। একসময় তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তবে শেষ অব্দি মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল সে।


মেঘলা আজ বেশ রাত করে বাড়ি ফিরল। চেম্বারে অনেক রোগী ছিল তাই ফিরতে দেরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরেই হতবাক হয়ে যায় সে। বাড়িতে এমনিতে তো কেউ তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। কিন্তু আজ বাড়িময় অন্ধকার। ভেতরে ঢুকেও কারো সারাশব্দ পায়না মেঘলা।

আচমকা মেঘলাকে অবাক করে দিয়ে লাইট অন করে দেয় সবাই মিলে। বাড়ির সবাই মেঘলার পাশে রিফাতকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়। দুজনকে একসাথে দাড় করিয়ে বলে,
‘হ্যাপি ম্যারেজ এনিভার্সারি।’

মেঘলার তো মনেই ছিলনা আজকের দিনটার কথা। পাশেই মুখ গোমড়া করে দাড়িয়েছিল রিফাত। মেঘলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিফাত বলে,
‘ডাক্তার ম্যাডাম তোমার তো আজকাল কিছুই মনে থাকে না। আজকে সকাল থেকে আমি তোমাকে কত হিন্টস দিলাম। কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তুমি তো আমার কথা বুঝতেই পারলা না। আজকের দিনটা কিভাবে ভুলে গেলে তুমি?’

মেঘলা মৃদু হেসে বলে,
‘আসলে সারাদিন এত ব্যস্ত থাকি যে দিন তারিখই মনে থাকে না। তুমি রাগ করোনা প্লিজ।’

এখন মেঘলা রিফাতকে তুমি করেই বলে। রিফাতই তাকে অভ্যাস করিয়েছে তুমি করে বলতে। রিফাত বলে,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলো একসাথে কেক কা’টি। আম্মু, ছোট আম্মু সবাই তোমার অপেক্ষায় রাত জেগে বসে আছে। ওনাদের তো বয়স হয়েছে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে।’

আচমকা মাহিম এসে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে। মেঘলা মাহিমকে কোলে তুলে নেয়। রিমি রোজিয়ার কোলে ছিল। মাহিমকে মেঘলা কোলে নিতেই সে কান্না জুড়ে দেয়। মাহিম বলে,
‘দেখেছ আম্মু তোমার মেয়ে কত্ত হিংসা করে আমায়। সারাদিন আমায় জ্বালায়। তুমি তো বলো ও আমার ছোট বোন। তাই তো আদর করে ওকে কিছু বলিনা। আর ও কেমন আমায় হিংসা করে।’

রিমি আলতো গলায় বলে,
‘আম্মু ভাইয়া মিত্তা বলতে। আমি মোতেই ভাইয়াকে দালাই না।’

মেহের এদের ভাইবোনের ঝগড়া দেখে বলে,
‘আরে হয়েছে হয়েছে। তোরা দুই ভাইবোন মিলে সারাদিন শুধু ঝগড়া। এই আমার রোদ্দুর দাদাভাইকে দেখ তো। কিরকম শান্তশিষ্ট, নরম ছেলে।’

রোদেলা বলে ওঠে,
‘ওকে বাইরে থেকেই শুধু এমন মনে হয় মা। আসলে সে ও কেমন দুষ্টু সেটা আমিই জানি।’

মুবিন এবার সবাইকে থামিয়ে বলে,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আর এসব কথা নয়। ভাইয়া ভাবি তোমরা এগিয়ে আসো। এই নাও ছু’রি। কেকটা কে’টে এবার নিজেদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করো।’

মেঘলা ও রোদেলা কেক কা’টে। একে অপরকে কেক খাইয়ে দেয়। তারপর বাড়ির সকল সদস্যদেরও কেক খাইয়ে দেয়। এরমধ্যে মুন্নি উপস্থিত হয়ে বলে,
‘আমাকে কি সবাই ভুলে গেছ নাকি?’

মুন্নির সাথে রাসেলও এসেছে। রাসেল তাদের মেয়েকে কোলে নিয়ে রেখেছে। রোদেলা মুন্নির কাছে এসে বলে,
‘তোমাকে কি আমরা ভুলতে পারি? আমাদের একমাত্র ননদিনী বলে কথা।’

মুন্নি ও রাসেলও এই আনন্দে যোগ দেয়। আজ বাড়ির সকল সদস্য এই আনন্দে অংশ নিয়েছে। শুধু একজন ছাড়া। তিনি হলেন আমিনুল হক। দীর্ঘ আট বছর ধরে প্যারালাইজড হয়ে আছেন তিনি। না হাটতে পারেন, না কথা বলতে পারেন আর না ভালোভাবে খেতে পারেন। তাকে দেখাশোনার জন্য কাজের লোক রাখা হয়েছে। এই আট বছরে নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করে গেছেন তিনি। কিন্তু কোন লাভ নেই। এখন আর বাড়ির কেউ তার দিকে মুখ তুলে তাকায় না। একেই বলে কর্মফল।

মেঘলা তার এই পরিবার নিয়ে খুব সুখী। আজ তার জিবনে কোন কষ্ট নেই অথচ আজ থেকে আট বছর আগে এই দিনেই নিজের নামপরিচয় সব হারাতে হয়েছিল মেঘলাকে। মিথ্যা পরিচয়ে কা’টাতে হয়েছিল জিবন। আর আজ পরিপূর্ণ এক জিবন নিয়ে সুখে জিবনযাপন করছে সে। এই সুখের মুহুর্তে আল্লাহকে স্মরণ করে মেঘলা। আল্লাহর কাছে তার প্রার্থনা সবাইকে নিয়ে যেন আজিবন এভাবেই সুখে থাকতে পারে।

সমাপ্ত ✨

>>অবশেষে আপনাদের সকলের প্রিয় গল্পটা শেষ হয়ে গেল। এই গল্পটাতে যে আপনাদের এতটা ভালোবাসা পাবো সেটা কল্পনাও করিনি। মেঘলা-রিফাতকে আপনাদের পাশাপাশি আমিও অনেক মিস করব। খুব তাড়াতাড়ি নতুন গল্প নিয়ে ফিরে আসবো ইনশাআল্লাহ ✨✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here