শাহজাহান তন্ময়
৩.
তন্ময়ের মুখশ্রী করুণ। দৃষ্টি এলোমেলো বড্ড। তার অশান্তির কারণ ল্যাপটপে চলতে থাকা দৃশ্যটি। একটি ভিডিয়ো চলছে। ভিডিয়োটি বেশ পুরনো এবং করেছিলেন ওহী সাহেব। যখন অরু পৃথিবীতে আসে। হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রাখা বাচ্চাটিকে ভিডিয়ো করার একপর্যায়ে ক্যামেরা চলে যায় দশ বছরের হাফপ্যান্ট-হুডি পরে থাকা তন্ময়ের দিক। তন্ময় হাসছে। তার ছোটো ছোটো পবিত্র চোখ সদ্যোজাত জন্মানো অরুর দিক। মোস্তফা সাহেব এগিয়ে কোলে তুলে নিলেন অরুকে। হেসে-হেসে বললেন, ‘ধুমধাম করে বিয়ে দিব আমার আম্মার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজপুত্র আনব আম্মার জন্য।’
তন্ময়ের হাসি-হাসি বাচ্চাটে মুখশ্রীর রঙ বদলায়। আতঙ্ক ছেপে ওঠে মুখশ্রীর সর্বত্র জুড়ে। সে ছটফট গলায় বলে, ‘অরুর রাজপুত্র তো আমি। চাচ্চু বলেছেন আমি হব অরুর রাজপুত্র। তাই না চাচ্চু?’
আনোয়ার সাহেব স-শব্দে হাসে। হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে জানায়, ‘হ্যাঁ ত। আমার তন্ময়ের থেকে শ্রেষ্ঠ রাজপুত্র আর কে হতে পারে?’
তন্ময়ের মুখমণ্ডল জুড়ে বসন্তের ছোঁয়া। দু’গাল ভরে হাসে। চোখ ভর্তি স্বপ্ন বাচ্চা ছেলেটার। সে আশাবাদী নয়নে তাকায় বাবার পানে। মোস্তফা সাহেব অসহায় ভঙ্গিতে দু’ধারে মাথা দোলায়।
তন্ময় তখনই ভিডিয়োটা বন্ধ করে দিল। কাচুমাচু ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়াল। সেই বাচ্চা অরু এখন এগারো বছরের। সারাদিন ফ্রোক পরে ঘুরে-বেড়ায় বাড়ি জুড়ে। তন্ময়ের আশেপাশে তাকে ঘুরঘুর করতে দেখা যায় রাতের বেলা। পড়তে না বসার হাজারো অজুহাত দাঁড় করায়। তবে সেই অজুহাত তন্ময় মানে না। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি বাদে, এমন কোনো আবদার নেই যে সে মেয়েটার পূরণ করে না। তন্ময়ের মনে আছে একটি ঘটনার কথা।
সেদিন আসমান জুড়ে মেঘ। চারিপাশ আঁধার।
একঝাঁক বর্ষণ নামে। ঝোড়ো হাওয়া প্রকৃতি-তে। অরু তখন ন-বছরের। ডিজনি চ্যানেলের প্রিন্সেস পুতুলটা তার পছন্দ হয়। মুগ্ধতায় ডুবে থাকা বাচ্চা অরু আবদার ধরে পুতুলটা তার চাই। এবং এক্ষুনি চাই। বাড়ির সকলে বোঝায় সকালে এনে দেবে। আর নাহলে অপেক্ষা করতে বৃষ্টি থামুক। কিন্তু অরু মানতে নারাজ। স্বাস্থ্যসম্মত সে কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে। তন্ময় পড়াশোনা রেখে নিচে নামে। ড্রাইভার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে খেলনার স্টোর গুলোতে। ধানমন্ডির বেশ কিছু স্টোর ঘুরেও সেই প্রিন্সেস পুতুলটা পায় না। উত্তরায় রওনা হয়। সেখানকার বিশেষ স্টোরে গিয়ে ঢোকে। এবং বেশ খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও যায়। আট-হাজার দিয়ে সেই লেটেস্ট মডেলের প্রিন্সেস পুতুলটা কিনে আনে। অরু পুতুল পেয়ে ভীষণ খুশিই। খুশিতে সে তন্ময়ের কোলে চড়ে গলা জড়িয়ে বারংবার চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘থ্যাংকিউ তন্ময় ভাইয়া।’
অরুর খুশিতে চিকচিক করা নয়ন জোড়া দেখে তন্ময় তৃপ্তি পায়। অদ্ভুত তৃপ্তি। এই তৃপ্তি পেতে যেমন পৃথিবীর যা চাইবে বাচ্চাটি তাই এনে দেবে সে।
_____
শুক্রবার ছুটির দিন। শাহজাহান বাড়ির কর্তা-রা আজ বাড়িতেই। সাতটায় রান্নাঘরে তোরজোর শুরু হয়েছে গৃহিণীদের। কর্তা-রা বসে লিভিংরুমে। তন্ময় স্বভাবসুলভ সাতটায় ঘুম থেকে ওঠেছে। ট্রাউজার শার্ট পরে নিচে নামছে সিঁড়ি বেয়ে। লিভিংরুমে বসা আনোয়ার সাহেবের পাশে অরু বসে। হাত-পা টানটান সোজা। সে তার বাবাকে নতুন শেখা ব্যায়াম দেখিয়ে যাচ্ছে। তন্ময় তার অপজিটে বসে গিয়ে। তাকে বসতে দেখেই অরু থেমে যায়। চঞ্চল ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। চুলগুলো দুটো বেণি-তে বাঁধা। লম্বা পাপড়ি ঝাপটে-ঝাপটে সে শুধায়, ‘তন্ময় ভাই আজকে আপনি ফুটবল খেলতে যাবেন না?’
তন্ময় মিথ্যে বলে সর্বদার মতো, ‘না।’
অরু ভাবান্তর ভঙ্গিতে বলে, ‘এইযে আপনি না বলছেন। কিন্তু পড়ে কেম্নে যেন না -হ্যাঁ হয়ে যায়। আপনি তো চলে যান খেলতে। যদি এবারো আপনার না-টা হ্যাঁ হয়ে যায়, আমাকে সঙ্গে নেবেন? আমি খেলা দেখতে চাই।’
আনোয়ার সাহেব শব্দ করে হাসছেন। মোস্তফা সাহেব ভাতিজিকে আরও বিগড়ে দেবার ভঙ্গিতে ছেলেকে বলেন, ‘নিয়ে যাও অরুকে। ড্রাইভার যাবে সঙ্গে। দেখে রাখবে।’
‘আমি যাচ্ছি না।’
তন্ময়ের কাঠকাঠ জবাব। অরুর কমবেশি সব আবদার মেনে নিলেও, অনেক গুলো সে মানতে নারাজ। এবং তাকে দিয়ে মানানো বড়ো কঠিন। তারমধ্যে খেলা দেখতে নিতে না যাওয়াটা। এর কারণ আছে তন্ময়ের মনে। কিন্তু মুখে সে আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি। আজকাল রাস্তাঘাটে দশ বছরের বাচ্চা মেয়েদের ও দেখা যায় প্রেমিক নিয়ে ঘুরছে। একটু একটু ছেলেমেয়ে প্রেমপত্র আদান-প্রদান করছে। তন্ময় যেই মাঠে খেলে সেটি বিশাল বড়ো। সেখানে ছোটো বোড়ো সবধরনের ছেলে-মেয়ে থাকে। অরুর বয়সী মেয়েরা দামড়া বয়ফ্রেন্ড নিয়ে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময় একদমই চায় না অরু সেগুলো দেখুক বা সে ওদের মধ্যে একজন হয় দাঁড়াক বা তার এসবের প্রতি বিন্দুমাত্র ধারণা জন্মাক।
___
এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে তন্ময়। সদ্যোজাত পুরুষ হয়ে ওঠার রাস্তায় কেবল। মুখ জুড়ে ক্লিন-শেভ। এখনো পুরোপুরি দাঁড়ি না ওঠায় শেভ করে রাখতে হয়। আর্মি কাট বেশ মানায় বাড়ন্ত বয়সী ছেলেদের। তন্মের ক্ষেত্রেও তাই। মুখশ্রী-তে লেপ্টানো গাম্ভীর্যের ছোঁয়া সুদর্শনের তালিকায় ফেলে তাকে। জার্সি পরে কোলে ফুটবল নিয়ে আলগোছে বেড়িয়ে পড়ে সে। রাস্তার মোড়ে তার এলাকার ছোটোবড়ো ভাই-ব্রাদার-রা দাঁড়িয়ে। প্রত্যেক শুক্রবার তাদের সঙ্গে ফুটবল খেলাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। সদরদরজা সামনাসামনি আসতেই ছোটো অরুকে দেখতে পায়। দরজা দিয়ে ক্ষনে ক্ষনে মাথা বের করে উঁকিঝুঁকি দিয়ে রাস্তা দেখছে। তন্ময়কে দেখতেই দারোয়ান চাচাকে বলে, ‘খুলুন দরজা চাচা। ওইযে ভাইয়া! এবার ত খুলুন।’
তন্ময় খুলতে ইশারা করে। দরজা খুলে দিতেই দৌড়ে বেরোয় অরু। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে তন্ময়কে করুণ গলায় বলে, ‘আমায় কেন নেননি?’
‘তুই গিয়ে কী করতি?’
‘খেলা দেখতাম।’
‘খেলা দেখে কী হতো?’
‘মারজি প্রত্যেক শুক্রবার ওর ভাইয়ার সাথে যায়। প্রত্যেক শুক্রবার খেলা দেখে। আমিও দেখতে চাই।’
তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। হাতের বল-টা রাস্তায় ফেলে। তন্ময় ভেবে বলে, ‘খেলা দেখবি?’
‘হু।’
‘আচ্ছা।’
তন্ময় সেলফোন বের করে। চাচাতো ভাই আকাশকে ফোন করে। আকাশ ভেতরে ছিল। শুনে দৌড়ে বেরোয়। দারোয়ান সহ তারা চারজন সেখানেই খেলার মাঠ বানায়। হৈচৈ শুনে বেরিয়ে আসে। মোস্তফা সাহেব। অরু হৈহৈ করে তার চাচ্চুকেও খেলতে ডাকে। ভাতিজির আবদার রাখতে তিনিও বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় যোগ হোন। একেক করে নেমে আসে আনোয়ার সাহেব এবং ওহী সাহেব ও। বাড়ির গৃহিনীরা সদরদরজায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। স্ট্রিট লাইটের নিচে তাদের ফ্যামিলি প্লে জমে ওঠেছে।
________
চলবে ~