#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী
অসময়ে সাদিফের সাথে সাইরাকে দেখে শায়লা চৌধুরী তাজ্জব বনে যান। ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন কোন গোলমাল হয়েছে। তিনি ওদেরকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নাতিকে কোলে নিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সাদিফরা ভিতরে প্রবেশ করলে তানিশা এসে নোয়েলকে( সাইরার মেয়ে) কোলে নিয়ে সাইরাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। সাইরাও আন্তরিকভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। তূর্ণা দাদুর পাশে বসে খেলছিল। ড্রয়িংরুমে আওয়াজ শুনে সেও দৌড়ে আসে। সাইরা ওকে দেখা মাত্রই কোলে তুলে নেয়।
” মম, ক্ষুধা লেগেছে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, সবাই একসাথে খাব। ” সাইরার কোলে থাকা তূর্ণাকে আদর করতে করতে বলে সাদিফ।
তানিশা নোয়েলকে রহিমা খালার কাছে দিয়ে রান্নাঘরে আসে।
ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর নিচে আসে সাদাফ। নিরো, নোয়েল, তূর্ণা মিলে সোফায় বসে খেলছিল। সাদিফ এসে ওদের পাশে বসে। সাইরাও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। তানিশা শ্বশুরকে খাইয়ে এসে ওদের টেবিলে ডাকে।
চেয়ারে বসতে বসতে সাদিফ তানিশাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা খেয়েছে কি না। তানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। সাদিফ মেয়েকে আগে খাইয়ে দিয়ে পরে নিজে খায়। সাইরাও আগে ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে দেয় পরে নিজে খায়। ওদের খাওয়া শেষ হলে তানিশা, শায়লা চৌধুরী ও রহিমা খালা একসাথে খেয়ে নেয়।
সাদিফ ডিভানে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। বিছানায় নিরো , নোয়েল , তূর্ণা খেলনা নিয়ে খেলছে। তানিশা নিচের সব কাজ সেরে শ্বশুরের কাছে কিছুক্ষণ বসে। সাইরাও সেখানে আছে। ওরা কিছুটা সময় গল্প করে কাটায়। এরপর তানিশা রুমে বাচ্চাদের কাছে এসে দেখে তারা খেলায় ব্যস্ত।
” তানিশা, মাথা ধরেছে। ব্ল্যাক কফি খেলে ভালো লাগত। ” ল্যাপটপে মুখ গুঁজেই বলে সাদিফ।
” এক্ষুনি দিচ্ছি। ”
কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে আসে। সাদিফ মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানায়।
তানিশা বারান্দায় এসে বসে চাঁদনী রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। সাদিফ একনজর সেদিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দেয়। কিন্তু মনযোগে বারবার বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বেয়ারা মন। সে চাচ্ছে তানিশার কাছে যেয়ে ওকে বুকে জরিয়ে ধরতে। কিন্তু সাদিফ নিজেও সময় নিচ্ছে আর তানিশাকেও সময় দিচ্ছে।
” ভাইয়া আসব? ” সাইরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
” আয়। ভেতরে আসবি, জিজ্ঞেস করতে হবে! তোর যখন মন চাইবে, তখনই আসবি। ”
” কি যে বলো ভাইয়া। তোমার বোন কি সেই আগের মত আছে। অনেককিছু বদলে গেছে ভাইয়া। ভাবি কোথায়? ”
” বারান্দায় আছে দেখ। ”
সাইরা বাচ্চাদের কাছে যেয়ে আদর করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
” এত মনযোগ দিয়ে কি দেখছ ভাবি? কিছুই তো দেখা যায়না। ”
” আকাশ দেখি, চাঁদনী রাত দেখি, রাতের সৌন্দর্য দেখি। এ সৌন্দর্যর যেন শেষ নেই। ” স্নিগ্ধ হেসে বলে তানিশা।
” যার মন সুন্দর, তার চোখে দুনিয়ার সব কিছুই সুন্দর লাগে। ”
তানিশা কোন জবাব না দিয়ে শুধু হাসে।
সাইরা আচমকা তানিশার দুহাত ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে, ” তোমার কাছে এখনো ক্ষমা চাওয়া হয়নি ভাবি। জানি, তোমার সাথে যা যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও মন মানছেনা। তোমার সাথে অন্যায়ের শাস্তি আজ আমি পাচ্ছি। তোমার সাথে যা করেছি আজ সবটাই ফিরে এসেছে আমার কাছে। আজ বুঝতে পারি তুমি তখন কত কষ্ট পেতে। যেমনটা আজ আমি পাই। আসলেই প্রকৃতি কোন ঋণ রাখেনা, সব সুদেআসলে ফিরিয়ে দেয়। নারীজীবন কতযে কঠিন তা এখন আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাবি। তুমি ক্ষমা না করলে আজীবন এই শাস্তি পেতেই থাকব। ”
সাইরার গলায় এমন কিছু ছিল যা তানিশার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। সত্যিই নারীজীবন খুব সহজ কিছু নয়। পদে পদে কত বাঁধা, কত অন্যায়-অবিচার, কত অবহেলার সমন্বয়ে যে একজন নারী পরিপূর্ণ হয় তা কেবলমাত্র সেই জানে।
” এসব তুমি কি বলছ! আমি কোন কিছু মনে রাখিনি। এইযে তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এতেই তোমার যত অন্যায় সব ধুয়ে গেছে। এভাবে কেঁদোনা প্লিজ। আর কখনোই মনে এসব চিন্তা এনে এই সুন্দর মুখটাকে মলিন করবেনা। ”
” আমি কিছুদিন এই বাড়িতে থাকলে কোন সমস্যা হবে ভাবি? ”
” সাইরা এসব কি প্রশ্ন করছো তুমি! তোমার বাড়িতে তুমি থাকবে এতে সমস্যা হবে কেন! শোন তুমি এই বাড়ির মেয়ে তোমার ভাইয়াদের যে অধিকার এ বাড়িতে আছে ঠিক ততটাই অধিকার তোমারও আছে। তুমি যতদিন খুশি ততদিন থাকবে। নিজের অধিকার নিয়ে থাকবে। ”
সাইরা তানিশার কথা শুনে আনন্দে জড়িয়ে ধরে।
সাদিফের কানে ওদের কথপোকথন পোঁছে গেছে। তানিশার এই পজিটিভ মনোভাব ওর বেশ ভালো লেগেছে। অবশ্য ও জানত সাইরার এ বাড়িতে আসায় তানিশার কোন সমস্যা হবেনা।
সাইরা অনেকক্ষন ধরে তানিশার সাথে গল্প করে। রুমে আসলেই সাদিফ ওকে ডেকে পাশে বসায়। তানিশাও বাচ্চাদের কাছে বসেছে।
” সাইরা, তুই আমাদের একটামাত্র বোন। ছোট থেকেই তুই আমাদের চোখের মনি ছিলি। এখনো ঠিক তেমনিই আছিস। আগেও যেমন তোর কষ্টে উতলা হতাম, এখনো হই। বড় হয়েছিস, সংসার হয়েছে বলে মনে করিসনা আমরা সব দূরে সরে গেছি। আমি মনে করি বড়ভাই হিসেবে তোর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে। আজ বাবা সুস্থ থাকলে তার সাথে আলোচনা করে সব সিদ্ধান্ত নিতাম। কিন্তু সে উপায় এখন নেই। আজকে আমার সিদ্ধান্তে তুই কি একমত? যদি একমত না হোস বলতে পারিস। তোর সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাবো। কিন্তু আমি চাইব তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি ভেবেচিন্তে নিবি।
আমি চাইনা তুই আজীবন ঐ সংসারে ছোট হয়ে বেঁচে থাক। আমি চাই তুই তোর অধিকারে মাথা উঁচু করে বাঁচ। কারো কটু কথা, অসম্মান, অপমান নিয়ে ভেতরে ভেতরে গুমরে ম*র। আমি জানি এর পরবর্তী ফলাফল কতটা ভ*য়া*ব*হ।
আমি আরেকটা তানিশার জীবনের ছবি তোর মাঝে দেখতে চাইনা। তুই এ বাড়িতে ততদিন থাকবি যতদিন রাতুল নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে তোকে নিতে না আসে। আমার বোন ফেলনা নয়। সে আগেও এ বাড়িতে রাজকন্যার ন্যায় ছিল এখনো সে আমাদের চোখে রাজকন্যাই আছে। আর আমি না বললে তুই রাতুলের সামনে যাবিনা, কোন কথা বলবিনা। আমি শুধু একটা কথাই বলব। একটাবার ভাইয়ার উপর ভরসা করে দেখ। ”
সাইরা ভাইয়ের কথা শুনে কাঁদতে থাকে। ও ভেবেছিল বাবা অসুস্থ, বাবার অফিস থেকে পাওয়া টাকা কবেই ওর জন্য আর বাবার চিকিৎসার জন্য শেষ হয়ে গেছে। ভাইয়ের রোজগারে এখন সংসার চলছে। বাবার চিকিৎসা চলছে। যদিও ভাইয়া নেহাৎ কম আয় করেনা। একসাথে কয়েকটা পরিবার চালানোর ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু বাবার সক্ষমতা যে কোন সন্তানকে স্বস্তি দেয়। আর এই স্বস্তি তখনই শান্তির পরশ আনে যখন সেই মানুষটার রোজগার থাকে। সাইরা জানতো ওর বাবা এখন একজন জড়বস্তুর ন্যায়। যে অন্য কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারেনা আর না আছে তার রোজগার। তাই সে নিজেও আর এই সংসারে বোঝা হতে চায়নি। তাই শত অপমানেও মুখ বুজে ঐ বাড়িতে পরে ছিল।
” কাঁদছিস কেন হুম? আর তোর চোখে পানি দেখতে চাইনা, বুঝেছিস। চোখ মোছ। অনেক রাত হয়েছে, এখন রুমে যা। বাচ্চাদের ঘুমিয়ে দে। কাল উইকেন্ডে আমরা লং ট্রিপে যাব। আজ একটা জম্পেশ ঘুম দে। তানিশা ওদের রুমে দিয়ে আসো। ” তানিশা ভাইবোনের কথা যতই শুনছিল
ততই মুগ্ধ হচ্ছিল। কত মিল এদের!
তূর্ণা মাঝ বিছানায় ঘুমে বিভোর। তানিশা একপাশে শুয়েছে সেই কখন কিন্তু সাদিফের দেখা নেই। বারান্দায়ও সেই সে! তানিশা এপাশ-ওপাশ করে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু তবুও সাদিফ আসেনা। বাধ্য হয়ে উঠে বসে। বিছানা থেকে নেমে দেখে রুমের দরজা খোলা! রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিচে নামে। কিন্তু এখানে কেউই নেই! গেল কোথায় লোকটা! তারপর হঠাৎ মনে হল ছাদে নেই তো। কিন্তু তার আর ছাদে যাওয়ার সাহস হয়না। দৌড়ে রুমে এসে শুয়ে পরে। সাদিফ রুমে আসে আরও আধাঘন্টা পর। বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেই তানিশা কেমন একটা গন্ধ পায়। একটু চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছে। তবে কি লোকটা আজকাল সিগারেট ধরেছে!
” দুর্গন্ধ আসছে আপনার শরীর থেকে। মেয়ের সমস্যা হতে পারে। ”
সাদিফ কিছু না বলে নিঃশব্দে উঠে ওয়াশরুমে যায়। ব্রাশ করে, মাউথ ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে গার্গেলিং করে, পোশাক পাল্টিয়ে এসে শুয়ে পরে। তানিশা অবাক হয়ে লোকটার কান্ড দেখে।
” এত কষ্ট না করে এসব ছেড়ে দিলেই তো হয়। এতে নিজেরও ক্ষতি আবার আশেপাশের মানুষজনেরও সমস্যা। ”
” ঠিক আছে আজ থেকে ছেড়ে দিলাম। তবুও চাইনা আমার জন্য তোমাদের কোন ক্ষতি হোক। আমার জীবনের প্রায়োরিটিই এখন তোমরা। ”
তানিশা চুপচাপ থাকে। সাদিফ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
বাচ্চারা সেই কখন ঘুমিয়েছে কিন্তু সাইরার চোখে ঘুম নেই। ও এখানে আসার পর রাতুল ফোন করেনি। না জানি ঐ বাড়িতে কি হচ্ছে! রাতুল কি আদৌ ভাইয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে! ও রাতুলকে একটু বেশিই ভালোবাসে। কিন্তু ভাইয়াও তো কম ভালোবাসেনা আমাকে। চিন্তায় চিন্তায় পাগল হওয়ার দশা সাইরার। কি করবে ও। রাতুল এখন পর্যন্ত ফোন করেনি। তবে সে কি আর আসবেনা!
তার সন্তানেরা বাবাকে ছাড়াই বড় হবে! বুক দুরুদুরু করছে সাইরার। এ কোন বাঁধনে বাঁধা পরেছে সে। একতরফা ভালোবাসায় আটকে আছে সম্পর্কটা। অবশ্য রাতুল সন্তানদের জন্য একজন দ্বায়িত্ববান পিতা একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই সাইরার। কিন্তু স্বামী হিসেবে সে কখনোই আদর্শ হয়ে উঠতে পারেনি। তবুও তাকে ভালোবেসে সাইরা তার সব কিছু মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজ সাইরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। না পারছে ভাইয়ের কথা অমান্য করতে আর না পারবে রাতুলকে ছাড়তে। এ কেমন টানাপোড়েন! এর শেষ কোথায়?
সকালে সাদিফ ওর মাকে জানায় সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। এমনকি বাবাও যাবে তাদের সাথে। কিন্তু শায়লা চৌধুরী যেতে রাজি হয়না। তিনি বলেন, তোরা সবাই ঘুরে আয়। আমি তোর বাবাকে নিয়ে থাকব। তাছাড়া অসুস্থ মানুষ এত ধকল নিতে পারবেনা।
সকাল দশটার দিকে ওরা বেরিয়ে পরে। সাদিফ ড্রাইভ করছে। ওর পাশে তানিশা মেয়েকে নিয়ে বসেছে। আর পেছনে সাইরা ওর বাচ্চাদের নিয়ে। তানিশা সামনে থেকেই টুকটাক সাইরার সাথে গল্প করছে। সাদিফ ওদের নিয়ে শহরের বাইরে কোলাহলমুক্ত স্থানে আসে হাইওয়ে থেকে কিছুটা দূরে একটা পার্ক। সেখানে বিনোদনের সকল ব্যবস্থা আছে। পার্কের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু একখানা নদী। নদীর টলটলে পানিতে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে। নদীর ওপর একটা কাঠের সাঁকো। সাঁকো পার হলেই ওপারে দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত। ফাল্গুনী হাওয়ায় মাঠের ফসল দুলছে। বাচ্চারা আনন্দে ছুটোছুটি করছে। তানিশা চোখ বন্ধ করে বাতাসে ভেসে আসা ফসলের ঘ্রান নেয়। নিমেষেই ওর মন ছুটে যায় কদম তলী গাঁয়ে। কত বছর যায়না গ্রামে। কত বছর দেখেনা বাবা-মা’ র মুখ। ভাই-বোনেরাও বড় হয়েছে। ঢাকা আসার পর বাবা-মা কতবার যেতে বলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত যাওয়া হলোনা। শ্বাশুড়ি ও বলছে গ্রাম থেকে ঘুরে আসতে কিন্তু তানিশা নিজেই বলেছে পরে যাবে। আসলে তানিশা চাচ্ছে সাদিফ আরো কিছুদিন মেয়ের সাথে কাটাক। তারপর গ্রামে যাওয়ার কথা বলবে। তানিশা ভালো করেই জানে ও মেয়েকে নিয়ে কদম তলী গেলে সাদিফ পাগল হয়ে যাবে। মেয়েকে ছাড়া সে একদণ্ড থাকতে পারেনা। তাই বাবা-মেয়ের মাঝের বন্ধন আরেকটু দৃঢ় করতেই তার এই সিদ্ধান্ত। এদিকে শায়লা চৌধুরী চাচ্ছেন তানিশার বাবা-মা’কে দাওয়াত করতে কিন্তু তানিশার দাদি অসুস্থ থাকায় তাদেরও এই মুহূর্তে আসা সম্ভব নয়। তানিশার নানান ভাবনার মাঝেই সাদিফ ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। সাইরা বাচ্চাদের নিয়ে ফসলের মাঠে ছুটোছুটিতে ব্যস্ত।
ফাগুনের মৃদুমন্দ বাতাসে তানিশার খোলা চুলের দল হুটোপুটি করছে। সাদিফ সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে কপালে পরে থাকা চুলগুলোকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তানিশা চমকে তাকায়। সাদিফকে দেখেও চুপ থাকে। যা সাদিফের বুকে লাগে।
তানিশার হাত ধরে ওকে নিয়ে আসে নদীর পাড়ের সরষে ক্ষেতের আইলে। হলুদ ফুলগুলো বাতাসে দুলছে আর সুগন্ধ এসে নাকে লাগছে। আইলে জন্মানো ঘাসের উপর বসতে বলে তানিশাকে। আজ ওর তানিশাকে কিছু বলার আছে।
নিজের দু’হাতের মুঠোয় তানিশার ডান হাত শক্ত করে ধরে সাদিফ। তানিশা অবাক চোখে চায়।
” ভালোবাসা অথবা মায়া কিংবা মরিচীকা এবং আবেগ কি জানো বউ? আমি এগুলোর সংজ্ঞা জেনেছি এই চার বছরে। ভালোবাসা হলো জীবনের আরেক নাম। একটা মানুষ যতই নিকৃষ্ট হোক না কেন তার জীবনকে সে খুব ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। দিনশেষে যারা নিঃস্ব, দুঃখী তারা কিন্তু কখনোই জীবনের শেষ কোথায় এই চিন্তা করেনা। তারা পরের সূর্যদয় দেখার আশায় বাঁচে। তাই আমি ভালোবাসা বলতে জীবনকেই সংজ্ঞায়িত করেছি করেছি। যেমনভাবে আমার জীবন তুমি।
আর মায়া সেতো বড়ই ভয়ানক এক টান। তুমি যতই দূরে যাওনা কেন এই টান তোমার পিছু ছাড়বেনা। চোখের আড়ালে গেলেই এই টান আরো বাড়ে, শক্ত হয়। যেমনটা এই চার বছরে আমার কয়েকগুন বেড়েছে।
মরিচীকা, তুমি তাকে দেখছো, অনেকটা সময় কাটিয়েছো তার সাথে কিন্তু বেলা শেষে তাকে পাওয়া আর হয়না। এই মরিচীকা খুবই বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এরা না কারো হয়, না কাউকে হতে দেয়। সোহা আমার জীবনে এরুপ মরিচীকা। যার অ*ঙ্গা*রে ছা*ড়*খা*ড় হয়েছে আমার জীবন।
আর বাকি রইল আবেগ। যার দ্বারা আ*ক্রা*ন্ত হয় প্রত্যেকটা মানুষই। আবেগের কাজই হলো মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। হোকনা সেই স্বপ্ন মিথ্যে কিংবা অসম্পূর্ণ। একটা ছেলে যখন শৈশব থেকেই শুনে বড় হয় তার সাথে খালাতো বোনের বিয়ে হবে। সবাই যখন দু’জনকে ক্ষনে ক্ষনে মনে করিয়ে দেয় ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে কিংবা দু’জনের মেলামেশাকে প্রশয় দেয়। তখন সেই কিশোর-কিশোরীর মনে আবেগ, চোখে প্রেম খেলা করবে এটাই স্বাভাবিক। ঠিক তেমনটাই আমার সাথে ঘটেছিল। যখন জানলাম সোহা আমার বাগদত্তা, ওর সাথে মিশতে আর বাঁধা রইলনা। দু’জনে ভাসতে লাগলাম আবেগের মহাসমুদ্রে। কতশত স্বপ্ন দেখতাম দুজন। কত কথা হতো দু’জনার মাঝে। অথচ বাবা এই বিষয়ে অমত করেছিলেন। কিন্তু আমার সেই অবস্থাই ছিলনা যে বাবার কথা মানব। তখন থেকেই বাবাকে বিরক্ত লাগার শুরু। এইচএসসি র পর চলে গেলাম পোল্যান্ড। সেখানের ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নিলাম। তখনও সোহার সাথে সম্পর্ক ছিল পুরদমে। ইচ্ছে ছিল সেখানেই সেটেল হব। ভালো একটা জবও পেয়েছিলাম। একদিন মম জানালো, সোহার সাথে বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলেছে। পরে অবশ্য জেনেছি সেটা বাবার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় হয়েছে। তার কিছুদিন পর বাবা আমাকে দেশে আসতে বলে। জিজ্ঞেস করলে বলে বিষয়টি খুবই জরুরী। এমনভাবে বাবা কখনোই বলেনি। তাই দেরি না করে ছুটি নিয়ে দেশে আসি। ” সাদিফ একনাগাড়ে বলার পর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তানিশাকে বুঝে ওঠার সময় দেয়। তানিশাও নিশ্চুপ থাকে। কিছু সময় পর সাদিফ আবার বলতে শুরু করে।
” আমাকে দেখে মম অবাক হয়ে যায়। কিন্তু বাবাকে খুব খুশি মনে হয়। দুই দিন পর বাবা আমাকে বলে, আমার বিয়ের কথা। কোন এক গ্রামের এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এমন একটা মেয়ের কথা। তাকে নাকি বাবার খুবই পছন্দ হয়েছে। এমনকি মেয়েটির বাবাকেও কথা দিয়েছে। কথাটা শুনেই আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। সেই শৈশব, কৈশোর আর যৌবনে যাকে ভালোবাসলাম সে নয়! অন্য কাউকে মেনে নিতে হবে ভেবেই বুকের ভিতর তোলপাড় হচ্ছিল। বাবার বিরোধিতা করলাম সেই প্রথম। কিন্তু শেষমেশ বাবার জেদের কাছে হার মানতে হল। একদিন সন্ধ্যায় বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিল আগামীকাল শুক্রবার আমার বিয়ে। স্তব্ধ হয়ে ছিলাম সারাটা সময়। সেই থেকে মনের ভেতর রা*গ জন্ম নিল না দেখা মেয়েটির প্রতি। যেই রা*গে ছি*ন্ন*ভি*ন্ন হয়েছে গ্রামের এক চপল কিশোরীর মন। সেই কিশোরী নানান ঘাত-প্রতিঘাতে নারীতে পরিনত হয়।
কিন্তু একটা সময় পরে যখন মনের কোনে সেই চপল কিশোরী একটু একটু করে বাসা বাঁধতে শুরু করে, তখনই সব থমকে যায়। শুরু হয় আমার একলা পথ চলা। কত খুঁজেছি তাকে। কিন্তু পাইনি। ভালোবাসা, মায়া, মরিচীকা, আবেগকে আমি সে সময়ই জেনেছি। ক্ষনে ক্ষনে সেই কিশোরীর খিলখিলানো হাসি, আবার কিশোরী থেকে রমনীতে পরিনত হওয়া লাজুক হাসি কিংবা বধূরুপে কাছে পাওয়ার সেই রাতগুলো আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। নিঃসঙ্গ রাতগুলো আমার কষ্টের সাক্ষী ছিল। কিন্তু আজ আবার যখন তাকে ফিরে পেলাম, সে এক অন্য দুনিয়ার মানুষ।
তবুও স্বীকার করছি আমি ভুল করেছি। আবেগে ভেসে ভুল করেছিলাম, আমার সেই চপলা কিশোরী বধূকে কষ্ট দিয়ে ভুল করেছিলাম, সেই রমনীকে অবহেলা করে ভুল করেছিলাম যে একান্তই আমার ছিল সব সময়ই।
আর একটাবার আমাকে সুযোগ দেয়া যায়না? আমি আর কোন অভিযোগের সুযোগ দিবনা প্রমিজ করছি। ” সাদিফের চোখে পানি।
তানিশাও কাঁদছে, কিন্তু কেন কাঁদছে তা জানেনা। শুধু সাদিফের প্রশ্নে মাথা নাড়ির সায় দেয়।
তানিশার মাথা নাড়াতে দেরি হয়েছে কিন্তু সাদিফের ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে সময় লাগেনি।
চলবে….