কি ছিলে আমার পর্ব – ২৫

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২৫

“আই নিড মানি”

“হাও মাচ?”

“হাজার পঞ্চাশ।”

“আর ইউ শিওর!” বিষ্মিত স্বরে জানতে চাইলেন আবরার খন্দকার। শেষ কবে ময়ূখ তাঁর কাছে কিছু চেয়েছে ঠিক মনে পড়ছে না উনার। পড়াশোনা, থাকা খাওয়া সব তো তার ফুপা নিজেই চালিয়েছেন। আবরার সাহেব প্রায়ই যেসব টাকা পাঠিয়েছেন তা যে ব্যাংক একাউন্ট করে ফখরুল সাহেব ময়ূখের জন্যই জমিয়ে রেখেছেন তা অজানা নয় কারো। কিন্তু হুট করে এতগুলো টাকা চাইছে ছেলেটা তাই তার প্রয়োজনটা একটু জানার আগ্রহ হলো আবরার খন্দকারের। ময়ূখ সোজা কথায় জবাব দিলো, “শিওর হয়েই তো চাইছি৷ থাকলে দিন আর না হয়… ”

“না হয় কি?”

“আই ওয়ান্ট সেল মাই কার।”

অবাকের শেষ পর্যায়ে এবার আবরার খন্দকার৷ ময়ূখের গাড়ি মানে তার মায়ের গাড়িটা। নব্বই দশকের সেই প্রাইভেট কার প্রায় বাইশ বছর হলো গ্যারেজে পরে আছে। জং ধরা, ভেতরের যন্ত্রপাতি সবই প্রায়ই নষ্ট- হয়ে এসেছে। সেটার ইঞ্জিন এখন আর চালু হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই ময়ূখ সেটাকে বলছে বিক্রি করবে! অথচ গত সাত আট বছরে তিনি ছেলেকে কতবার বলেছেনে গাড়ি নাও একটা। যেমন চাও ঠিক তেমন দেব নিয়ে যাও, ড্রাইভিং শিখো আর কত কি বলেছেন অথচ মুখের ওপর বলে দিয়েছে তার লাগবে না৷ ইরশাদদের পারিবারিক গাড়িতে কত ক-ষ্ট হয়েছে চলতে তবুও নেয়নি। আর আজ টাকার জন্য তার মায়ের পড়ে থাকা একটা স্মৃতি সেটা বিক্রি করতে চাইছে!

“ওই গাড়িটা বিক্রি করলে কত পাবে?”

“আমি সকালেই চেক করে এসেছি, ওটার এখন যা অবস্থা তাতে হয়তো বেশি আসবে না তবে বিভিন্ন পার্টস এখনো মোটামুটি চালিয়ে নেওয়ার মত। ভাঙারির দোকানে দিলেও অনায়েসে বিশ নেওয়া যাবে।”

দুপুরে আজ খাবার খেতে বাড়ি এসেছিলেন আবরার৷ মূলত স্ত্রী অ-সু-স্থ, মেয়েটাও মানসিকভাবে বিপ-র্যস্ত টের পেয়েছেন সেকারণেই বাড়িতে আসা। ময়ূখও রাতে তাদের ঘন্টা দুই পরই এসে উপস্থিত হয়েছিল বাড়িতে৷ কিন্তু এ বেলায় বাড়িতে এসে ছেলেকে সজাগ পাবেন ধারণায় ছিলো না। খেতে বসেই টেবিলে ছেলের আগমন হয়েছে তাও কিনা টাকা চাইতে। কিন্তু কথার ছ-লে এত কথা উঠবে বুঝতে পারেননি৷ খাওয়া থেমে গেছে আগেই এবার তিনি ময়ূখকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন। কোথাও কিছু পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে কিন্তু পরিবর্তনটা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছেন না। ময়ূখের মুখটা কি খুব শুকনো লাগছে? ইরিন কেন কাল অত রাতে ফোন করে কান্না করছিলো! ইরিন বলল ময়ূখ কিছু লুকাচ্ছে তার কাছে কিন্তু কি? প্রায় তেইশ বছর পর আজ তিনি পঁচিশ বছরের ছেলের মাঝে দুি বছরের মুখটিকে খুঁজছেন যেন। বড় ভুল সময়ে এই মুখে তিনি নজর দিয়েছেন। বা – হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে অফিসে কল দিলেন। ততক্ষণে আরেকবার প্রশ্ন করলেন ময়ূখকে, ” কি হয়েছে তা কি জানতে পারি?”

“গিটার কিনব। আমি মেবি, এ সপ্তাহে ইন্ডিয়া যাব ট্যুর প্লাস কনসার্ট। কলেজ ফ্রেন্ডসরা অরগানাইজ করছে। চট্টগ্রামেও যাব নেক্সট মান্থ ডোনেশন কালেক্ট করবে বলে একটা শিশু সংস্থার হয়ে।”

এত ডিটেইলে ময়ূখ তার বাবাকে কখনো কিছু বলে না। তারওপর এত লং প্ল্যান যা ইরিন জানে না! আবরার খন্দকার এবার যেন সন্দেহি হলেন ছেলের প্রতি। তারমানে ইরিন ঠিকই বুঝেছে তবে ময়ূখ ভালো কিছু করছে এতেও খুশি হলেন। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ময়ূখকে বিকেলে অফিসে যেতে বললেন। আজ শনিবার ব্যাংক খোলা পাবে না তাই অফিসে যা আছে তাই দিবেন বলে জানালেন। মনে মনে ঠিক করলেন কাল, পরশুর মধ্যে তিনিও ডোনেশন দিবেন লাখ খানেক৷ ময়ূখ আর না দাঁড়িয়ে চলে গেছে মেহেরকে আনতে। আজ অনেকদিন পর মেহের স্কুলে গিয়েছিল কিন্তু ময়ূখ তো জানে মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতোটা অসু-স্থ আর বি-ক্ষি-প্ত। তাই বোনকে নিয়ে কোথাও একটু বেরুবে বলেই ঠিক করল।

বৌ ভাতের জমজমাট অনুষ্ঠানটা বড্ড ফিকে লাগছে ইরিনের। এমনটা লাগছে ইরশাদ, নোরা আর ফখরুল সাহেবেরও। ইরশাদের বিয়ে অথচ আনন্দ করার জন্য ময়ূখটা নেই, সব কিছুতে ছটফ-ট করে সবাইকে জ্বা-লা-নোর জন্য মেহেরটা নেই এদিকে বোনকে প্রতি মুহূর্তে চিন্তামু-ক্ত থাকার আশ্বাস দেওয়ার জন্য বড় ভাইটা পাশে নেই৷ আছে শুধু ছোট ভাই আর ভাতিজি৷ ইরিনের বারবার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়েছে তার, কিছু একটা তার নজর এড়িয়ে গেছে যা তার বড় ভাইয়ের পরিবারকে সুক্ষ্মভাবে বি-চ্ছি-ন্ন করে দিয়েছে। সকালের নাশতার পরপরই মৈত্রী আর ইরশাদকে পার্লারে পাঠানো হয়েছে। নোরাও আজ লেহেঙ্গা পরে সাজবে ভেবেছে তাই মৈত্রীর সাথেই সাজতে চলে গেছে। ইরশাদ অবশ্য আজ হেয়ার কাট আর ফেসিয়ালের জন্যই গিয়েছে। কাল তার সাজে ছিল শেরোয়ানি, খোঁচা দাঁড়ি পায়ে নাগরা জুতো। আজ আবার গেটআপ সম্পূর্ণই ভিন্ন সেজন্যই আজ ক্লিন শেভ এর প্রয়োজন মনে হলো ইরশাদের৷ সে হয়তো মন থেকে ভা-ঙা-চো-রা। বিয়ে নিয়ে তার অত বিশেষ কোন ভাবনা ছিলো না কিন্তু মৈত্রী! সে নিশ্চয়ই দারুণ চায় সবটা অন্তত তার খুশির কথা ভেবেই ইরশাদ সবটা স্বপ্নময় করে দিতে চায় তাতে নিজের পরিচ্ছদ তো সাধারণ কিছু। ইরশাদ এমন ভেবেই সব ভেবে ভেবে গুছিয়ে করছে কিন্তু ময়ূখটার জন্য মন খারাপ লাগছে খুব। সকাল থেকে প্রায় দশ -বারো বার কল দিয়েছে সে কল রিসিভ করেনি। দুপুরে ইরশাদ যখন একদম তৈরি হয়ে মৈত্রীকে পার্লার থেকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলো তখন কলটা এলো৷ বড় চাচুর গাড়িটাই কাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে ইরশাদের আজও তাতে। ড্রাইভ নিজেই করছিলো তাই মৈত্রীকে বলল, “রিসিভ করে লাউডে দাও।”

মৈত্রী তাই করলো। ময়ূখ কিছু বলার আগেই ইরশাদ বলে উঠলো, “খুব বড় হয়ে গেছিস তাইনা! এখন আর আম্মা, ভাই কারো দরকার নেই কাউকে কিছু বলা, জানানোর এমনকি কারো কিছুতে অনুমতির দরকার নেই!”

“ভাই, আমি নিজে কনফার্ম ছিলাম না তাই…”

“কি কনফার্ম ছিলি না বন্ধুর বাপ মা-রা যাবে সেটা নাকি তুই কোলকাতা যাচ্ছিস সেটা!”

ইরশাদের কথায় রা-গ স্পষ্ট কিন্তু সে যে ময়ূখের জন্য কতোটা চি-ন্তি-ত তা যে এমন কথাতে অস্পষ্ট। ময়ূখ রাগ টের পেয়ে বলল, “ভাই আসলে আম্মাকে শুধু কনসার্টের কথা বললে কিছুতেই রাজী হতো না তারওপর তোমার বৌভাত! ”

“আসলেই তো আমার সামান্য বৌভাতের কনসার্ট মিস করা খুবই হাস্যকর।”

“ভাই তুমি অন্তত বোঝো, এই কনসার্টটা আউট অফ কান্ট্রি তার ওপর হিউজ ডোনেশন… ”

“ডোনেশন!” ইরশাদ এবার কৌতূহলী হলো।

“হ্যাঁ ভাই আমার ফ্রেন্ড জয়ের কথা মনে আছে ওই যে এমপির ভাতিজা! তাদের শিশু সংস্থা আছে মানে এতিম আর প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সেটা। তারা নিজেদের অর্থেই চালায় সেটা কিন্তু প্রতিবছর কোন একটা কালচারাল ফাংশন কিংবা বিভিন্ন ফেয়ার ফাংশনের মাধ্যমে এক্সট্রা আয় করে। সেচ্ছাসেবকরা করে এসব তো এবার আমাদের যে ভার্সিটির ব্যান্ড গ্রুপ আছে তারা নিজ উদ্যোগে কিছু দিতে চায়। আমাকেও জানিয়েছিলো আর হাতের মুঠোয় এমন একটা সুযোগ ন-ষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না।”

“বুঝলাম, কিন্তু তাই বলে আমাদের জানালে অন্তত আমাকে বললে কি আমি করতাম না ব্যবস্থা? চো-রের মত চোখের আড়াল হয়ে কেন করছিস তুই এসব!”

“ভাই…”

“ময়ূখ ভাইয়া!” দু ভাইয়ের কথার মাঝে এবার মৈত্রী ডেকে উঠলো ময়ূখকে। এই ডাকটাই তার নিঃশ্বাস আটকে দিলো। এটাই কি প্রথমবার মৈত্রী তাকে ডাকলো! আসলেই তার সাথে নিজ থেকে এই প্রথম কথা বলল মৈত্রী। কিন্তু এ ডাক তাকে তো অসু-স্থ করে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। ময়ূখের কোন জবাব না পেয়ে মৈত্রী আবার ডাকলো, ময়ূখ ভাইয়া, এটা একদমই ঠিক করেননি আপনি। আজ রাতে চলে যেতেন আন্টিকে আমরা বলে বোঝাতাম।”

আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলল মৈত্তী কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব আসার আগেই কল কে-টে গেছে। ইরশাদ বলল ব্যালেন্স চেক করো তো! মৈত্রী দেখলো টাকা আছে তবুও কল কাটলো কেন! পুনরায় কল দিতেই দেখলো ফোন বন্ধ। বাড়ি পৌঁছে ইরশাদ মাকে বলল, ময়ূখ একটা এতিমখানার জন্য সাহায্য করতেই বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছে। এ কথা শুনে ইরিনের স্বস্তির জায়গায় সন্দেহ আরও বাড়লো। কিন্তু এই মুহুর্তে মেহমান ভর্তি বাড়িতে এ নিয়ে কথা বললেন না আর। দুপুরের প্রায় শেষে মৈত্রীদের আত্মীয়রা এলো৷ বড় জাঁকজমকপূর্ণ হলো বৌভাত কিন্তু তাতে সব লোকজন ছিল ইরশাদদেরই আত্মীয় মৈত্রীদের আত্মীয় বলতে খুব বেশি মানুষ আসেনি৷ ফটোগ্রাফি চলল বর কনেকে নিয়ে অনেকটা সময়। কম কথা বলা, মুখচোরা মৈত্রী আজ কিছুতেই চুপচাপ থাকতে পারেনি শতশত মেহমানের ভীড়ে। জা, ননদ কত শত নতুন আত্মীয় এসে একের পর এক কথা বলেই চলেছে। মৈত্রীর খারাপ লাগেনি। কিন্তু সে কাল এ বাড়ি আসার পর থেকেই একটি মানুষের নাম শুনেছে বহুবার কিন্তু মানুষটির সাথে কিছুতেই দেখা হয়নি। যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে মানুষটি সম্পর্কে তার জা ইরশাদের ভাবী হবে কিন্তু সে চোখের সামনে একটিবার কেন এলো না! তবে ভাসুর মহাশয় এবং তার ছেলেকেও দেখেছে শুধু সেই জা’টিই আসেনি সামনে। এই নিয়ে এক অবাধ কৌতূহল কুয়াশার মত জমতে থাকলো মনের ভেতর।

শীতের বিকেল দ্রুতই সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায় বলে মৈত্রী, ইরশাদকে নিয়ে ফিরতে রাতই হলো মুজিব সাহেবদের। ইরিনও তাদের যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন যেন। তারা বেরিয়ে যেতেই তিনি বর্তমান বড় ভাবীকে কল দিলেন মানে মেহেরের মাকে৷ যতটুকু কথা হল তাতে স্বস্তি পাওয়ার মত কোন সংবাদ নেই বাধ্য হয়ে এবার আবরার খন্দকারকে কল দিলেন। কিন্তু তিনি ফোন তোলেননি। ইরিনের মনে হলো এবার তাকে যে করেই হোক ঢাকায় গিয়ে ময়ূখের সাথে আলাদা কথা বলতেই হবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here