#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৬ (১ম অংশ)
“আমার ফোন নম্বর নেই তোর কাছে?” ফোনের ওপাশ থেকে রিশাদ বলল কথাটা। ময়ূখ কম্পিউটারে ব্যস্ত দৃষ্টি রেখে ফোন কানে তুলেছিল। রিশাদের কণ্ঠ শুনে প্রথমে চমকালেও পরে মনে পড়ল সে রিশাদের হোটেল ম্যানেজমেন্টে নম্বর চেয়েছিল।
” না ভাই তোমারটা নেই রাইমারটা ছিল সেটাও বোধহয়…”
ময়ূখকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রিশাদ আবার বলল,
“ইরিন ফুপির কাছে ছিল তো! ইরশাদের বিয়ের সময় ফুপি, ফুপার সাথে কথা হলো।”
“মনে ছিল না ভাই আসলে ভাই এত তাড়া দিচ্ছিলো তোমার নম্বরের জন্য তাই হোটেলে কল করে নেওয়াটাই সহজ মনে হলো তখন।”
“কেমন আছিস তোরা?”
“ভালো। তোমরা কেমন আছো? রাইমার নাকি ঢাকাতেই বিয়ে হয়েছে?”
“হু আবরার চাচু এসেছিল তোরা তো কেউ তখন আসিসনি।”
“ইয়ে আসলে ব্যস্ততা ছিল।”
“আচ্ছা বল, কোন প্রয়োজন ছিল ইরশাদের তাড়া কেন দিচ্ছিলো?”
“আমি ঠিক জানি না। ভাই চট্টগ্রাম যাবে বলে শুনেছি সম্ভবত সেজন্যই তোমার সাথে কথা বলবে।”
“ঘুরতে গেলে বল কক্সবাজার চলে আসতে আমার হোটেলেই উঠবে না হয়৷ আমি ঢাকায় আছি তোর ভাবীকে নিয়ে আর রাইমার মেয়ে হয়েছে ফুপিকে বলিস।”
ময়ূখ আর রিশাদের আরও কিছু সময় কথা হলো৷ রিশাদের বাবা সম্পর্কে ইরিনের ফুপাতো ভাই৷ তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্কে আন্তরিকতার গভীরতা বেশ। রিশাদ কিংবা ইরশাদরা প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় একে অপরের পাশে থাকে ঠিক সেকারণেই ইরশাদ নিশ্চিন্তে চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রোগ্রাম করেছে। সে জানে রিশাদ দ্বিতীয় বিয়ের পর অনেকটা সময় চট্টগ্রামেই ছিল তার স্ত্রী মেবিশকে নিয়ে। ইরশাদ মৈত্রীকে নিয়ে ঠিক কোথায় উঠলে তাদের পাহাড় ভ্রমণ চমৎকার হবে সে বিষয়েই হেল্প চাইবে রিশাদের কাছে।
ইরশাদ আজ অফিস ছুটির পর মৈত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। চা বাগানের শীত কেমন মৈত্রীর তা বোঝা হয়ে গেছে এখানে আসার পরই৷ কিন্তু রাতের শীত সে ঘরে বসে উপভোগ করেছে বাইরের হিম শীতল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে বেড়ানো আর টঙের পাশে ভাড়ে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা মৈত্রীর কখনোই হয়নি৷ ইরশাদ জানে তার স্ত্রী ছোট থেকে একাকীত্বের জীবন কা-টি-য়ে-ছে। তাই নিজ সাধ্য আর সামর্থ্যনুযায়ী সে মৈত্রীকে পৃথিবীটাকে উপভোগ করাতে চায়। মনে মনে সে ভেবেই রেখেছে এবার পাহাড় দেখাবে পরে সিলেটের চমৎকার জায়গাগুলোরও দর্শন করাবে৷ দু জনে একটু আগেই বের হয়েছে। আজ প্রথমবার দুজনে কোথাও ঘুরতে যাবে শুনতেই মৈত্রীর চোখে মুখে যে উচ্ছাসের দ্যুতি ইরশাদ দেখেছে তা যে ছিল বড্ড মনোলোভা।
“এই পোশাকে আমাকে আজব লাগছে না!”
ইরশাদের ডান হাতটা জড়িয়ে উঁচুনিচু পাহাড়ি মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আনমনেই প্রশ্ন করলো মৈত্রী। ইরশাদ দু দিন আগেই এখানকার স্থানীয় এক মার্কেট থেকে দু জনের জন্য একইরকম দুটো হুডি কিনে এনেছে। মৈত্রীর জন্য দুটো গলা বন্ধ ফুল স্লিভ টপও এনেছে কিছুটা মোটা কাপড়ের। সে প্রায় খেয়াল করেছে মৈত্রী এটা সেটা করার সময় শাল জড়িয়ে থাকতে পারে না। তাই নিজেই এগুলো কিনে এনেছে তার কাজের সুবিধার জন্য। আজ ঘুরতে বের হবে বলে শাড়ি পরবে, জামা পরবে, গাউন পরবে কি পরবে এত দ্বিধা করছিল তা দেখে ইরশাদ নিজেই বুদ্ধি দিল এসব না বাইরে প্রচুর শীত ভালো লেগিংস থাকলে পরো সাথে তার আনা সেই টপ দুটো থেকে একটা তার উপর হুডি। কি আজব কথা সে বউ মানুষ এসব পরে বের হলে লোকে কি বলবে! এমনিতেও সে লেগিংস, জিন্স যাই পরে কূর্তি, কাফতান এর ওপর এভাবে থোড়াই! ইরশাদ সে কথায় পাত্তা দেয়নি উল্টো বুঝিয়েছে তার পোশাকের মাধ্যমে দৈহিক গঠন অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ না হয়। মৈত্রী সে কথা শুনেই পরেছিল কাপড়গুলো এখন নিজের দিকে তাকিয়ে তার এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তাই প্রশ্ন করছে। দুজনে কুয়াশার দেয়াল সরিয়ে হেঁটে অনেকটা পথ গিয়ে ছোট্ট এক ঘুপচি দোকান পেল। মাচার ওপর পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় বসে স্টোভে চা করছে, দু চার রকম বিস্কিট ছাড়া আর কিছুই নেই৷ মৈত্রীকে নিয়ে সেখানেই দাঁড়ালো সে।
“চাচা চা দিন দু কাপ”
“সেকি! এখন চা খেলে ভাত খেতে চাইবেন না আপনি।” বাধ সাধলো মৈত্রী।
“লোকটাকে দেখো কেমন হাঁড় কাঁপানো শীতে এই পাহাড়ের গায়ে মাত্র একটা চাদর আর টুপি পরে অপেক্ষা করছে কাস্টমারের৷ অথচ শীতের এ সময় এই বাগানের আশপাশের মানুষগুলো সন্ধ্যার পরই ঘরবন্দী হয়ে গা বাঁচায়। তাই লোকটার চায়ের ক্রেতা হাতে দু চারজন পথিক তারমধ্যে আজ আমরাও আছি। আমাদের দু কাপ চায়ে নিশ্চয়ই উনার থলিতে কিছু পয়সা ঢুকবে!” মৈত্রীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলেই ইরশাদ লোকটাকে বলল কিছু বিস্কিট যেন কাগজে মুড়ে দেয়৷ মৈত্রী জানে তার এই প্রিয় মানুষটি বড়ই উদার মনের কিন্তু তার উদার মনটা ঠিক কতখানি বড় তা যেন আজই উপলব্ধি করতে পারল সে। দোকানটায় হারিকেন জ্বলছিল হারিকেনের সেই হলদে আলোয় মৈত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মানুষটির দিকে। কখনো কখনো মন অজান্তেই কিছু ভালো মানুষকে বেছে নিতে পারে নিজের জন্য এমনটাই মনে হলো মৈত্রীর। পাশাপাশি বাঁশের চিকন মাচায় বসে মাটির ভাড়ে চা খেলো দুজনে৷ ইরশাদ কাঁচের বৈয়ামে থাকা গোল গোল দুই টাকা দামের এক প্রকার বিস্কিট কাগজে মুড়ে নিলো। বসা থেকে উঠে দাম মিটিয়ে এক হাতে মৈত্রীর হাত অন্য হাতে বিস্কিট নিয়ে এবার রওনা দিল বাড়ির দিকে৷ চলতে চলতে বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ আর থেকে থেকে পেঁচার ডাক উপভোগ করলো দুজনাতে। ভালো বাসাবাসি শুধু মানুষে মানুষে নয় কখনও কখনও মানুষে প্রকৃতিতেও হয় মৈত্রী আজ তাই জানলো। ঘরে ফিরে ইরশাদ বিস্কুটগুলো মৈত্রীকে দিলো রেখে দেওয়ার জন্য পরে কখনো খাওয়া যাবে৷ ইরশাদ জুতো খুলে, হুডি বদলে বেডরুমে ঢুকতেই তার ফোন বাজে৷ আম্মু ভিডিও কল দিচ্ছে দেখে রিসিভ করে সালাম দিল। ক্যামেরার সামনেই আব্বু, আম্মু তাদের মধ্যিখানে ময়ূখ বসে আছে।
“আরেব্বাহ্ আমি নেই তাই সুযোগ পেয়ে একদম আব্বু-আম্মুর কোলে উঠে বসে আছিস।” ইরশাদ টিপ্পনী কেটে বলল।
“থাকবোই তো এখন এই দুই দুনিয়া আমার একার ভাই৷ থাকো তুমি জঙ্গলে পড়ে সব আদর আমি নিয়ে নেবো।” কথাটা বলার মাঝেই ময়ূখ দু হাতে আম্মা আর বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে নিজের সাথে। দু ভাইয়ে মিলে মা-বাবাকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। মৈত্রী রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজ করে এসে দেখলো শ্বশুর শ্বাশুড়ি ক্যামেরায়। ইরশাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেও তাদের সালাম জানায়। ময়ূখ হঠাৎ মৈত্রীর মুখটা দেখে কথার মাঝেই থেমে গেছে৷ মৈত্রী নিজেই প্রশ্ন করলো, “কেমন আছেন ময়ূখ ভাইয়া, নোরা কেমন আছে?”
“ভাল” কথাটা বলার পরই বলল, “ভাই আমি লন্ডনে যাচ্ছি শিগ্রই।”
ময়ূখের মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল কথাটা বলার সময়। ইরশাদ সেদিকে লক্ষ্য করতেই জানতে চাইলো হঠাৎ কেন! ইরিন রে-গে গেল, “হঠাৎ মানে কি বউ থাকবে এক জায়গায় সে থাকবে আরেক জায়গায়!”
“আম্মু ময়ূখের তো বিসিএসের রেজাল্ট…”
“চুপ কর কিসের রেজাল্ট বউ, সংসারই এখন ওর রেজাল্ট বিয়ে করার সময় মনে ছিল না সেসব?”
ইরিনের ধ-ম-কে আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না ইরশাদ। সে ফোন ধরিয়ে দিলো মৈত্রীকে আপাতত বউ শ্বাশুড়ি গল্প করুক। মৈত্রী কথা শুরু করতেই ইরিন ময়ূখ আর ফখরুল সাহেবকে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন৷ ইরশাদ তা খেয়াল করতেই আবার এগিয়ে এলো, “এই আম্মু তুমি কি সিক্রেট কথা বলবে?”
“যাই বলি না কেন চোখের সামনে থেকে দূর হ তুই।”
ইরশাদ বুঝলো কথাটা বউ শ্বাশুড়ির তাই সে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
“মৈত্রী তোমাদের যাওয়াটা কি ক্যান্সেল করা যায় না! দেখো এখন তো সময় দেখার কি হয় না হয় অন্তত এ ডেটটা যেতে দাও।”
মৈত্রী মাথা নাড়লো তাতে কি বোঝালো কে জানে! ইরশাদ বাথরুম থেকে বেরিয়েছিল তোয়ালে নিতে। মায়ের কথা শুনে কিছু না বুঝলেও বেশ অবাক হলো সে।
“কিসের কথা বলছে আম্মু?”
চলবে