#যেখানে_পথচলা_শুরু |০৮|
#সাদিয়া_মেহরুজ
ভুল! ভুল! ভুল! ভুল করেছে তীরু। বিশাল বড় ভুল। সেই ভুলের কারণে তীরু এখন অনুশোচনার অনলে দ গ্ধ। বক্ষপিঞ্জরে ঝড় উঠেছে তার! হৃদয়স্থল বড্ড অশান্ত। অন্তরালের হাল বেহাল। নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে বারংবার। অনুতপ্ততায় কাহিল মন। কিন্তু ভুল করে এমন রূপ প্রদর্শন করার কোনো মানে আছে? নেই! কথায় আছে ‘ ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ‘ তীরু ভেবে কাজ করেনি তাই তার ভুল হয়েছে। এখন ভুলটা করার পর অনুতপ্ত হয়ে কোনো লাভ আছে কি? এলোমেলো যা করার তা তো পূর্বেই করে বসেছে।
লাইব্রেরি বিরান। শিক্ষার্থীরা সবাই অডিটোরিয়ামে। পরিক্ষার পর মূলত এখানকার শিক্ষার্থীরা মন ফ্রেশ করতে খেলাধুলা করে। সে যে বয়সেরই শিক্ষার্থী হোক না কেন। অডিটোরিয়ামে বিভিন্ন ধরনের খেলা করার পাশাপাশি বিনোদমূলক পরিবেশ করা তৈরি করা হয়েছে সেখানে। ক্লাসের চাপ শেষই দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা অডিটোরিয়াম নয়ত মাঠে ছুটে যায়। তীরুও যেত! ও বাস্কেটবল খুব ভালো খেলে। কিন্তু আজ সে ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাহিরে না গিয়ে এসেছে লাইব্রেরীতে। আসা মাত্রই হেড ডাউন করে বসে আছে আধাঘন্টা হলো। ঐ যে ও সময় অরোন এর কলার চেপে ধরল? তৎক্ষনাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে সরি বলে ছুটে বেড়িয়ে এসেছিল এক্সাম হলে। মনে তখন চরম অপরাধবোধ। সেভাবেই কোনো রকম পরিক্ষাটা দিল। মস্তিষ্ক হালকা হতেই তাকে ঝাপটে ধরল দুশ্চিন্তা, অনুতপ্ততা, একরাশ লজ্জা আর ভয়! অরোন নিশ্চয়ই তাকে খুব খারাপ মেয়ে মনে করছে। কিন্তু ও করবেটা কি? রাগ যে সামলাতে পারে না। তখনকার রাগ অবশ্য ভিত্তিহীন। তীরু সচরাচর ভিত্তিহীন কারণে রাগেনা। কিন্তু তখন কি যে হলো তার, ধুর!
অনুশোচনা যখন তীরুকে আষ্টেপৃষ্টে ঝাপটে ধরে ভারী যন্ত্রণা দিচ্ছিল তখনি তীরুকে উদ্ধার করতে কল এলো ফোনে। ইলি ফোন দিয়েছে।
-” হ্যা ইলি বলো? ”
ইলি অপাশ থেকে প্রতিত্তোর করল বিরক্তিমাখা গলায়,
-” কোথায় তুমি টীরু? আমরা কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমাকে। এর আগে যে কল দিলাম। রিসিভ করলে না কেন? ”
তীরু আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
-” লাইব্রেরিতে আমি। হেড ডাউন করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই আর কি। কেন খুঁজছিলে? ”
-” অ্যারোন তোমাকে খুঁজছে তীরু। ও তোমার সাথে দেখা করতে চায়। ”
‘ অ্যারোন ‘ ইলি অরোনের নামটা অব্দি ঠিক মতোন উচ্চারণ করতে পারেনা। শুধু মাত্র ইলিই নয় আরো অনেকে রয়েছেন এই ভীন দেশে যারা অরোনের নামটা ‘ অ্যারোন ‘ হিসেবেই উচ্চারণ করেন।
অরোন অপেক্ষা করছে। বাক্যদ্বয় তীরুকে অবাক করে ছাড়ল! ছেলেটা এখনো যায় নি?কেন অপেক্ষা করছে? সে তো ভেবেছিল অরোন তাকে দিয়েই নিজ গন্তব্যে ছুটেছে। টেবিল থেকে ব্যাগ ছোঁ মে রে ঘাড়ে তুলে ছোটা শুরু করে তীরু। করিডর পেরিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে অদূরে অরোন ইলি একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দুই জনকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ছোটার গতি বাড়ল তার।
ইলি বুঁজে আসা গলায় বলে উঠলো,
-” কেয়ারলেস মেয়েটা এসেছে! ”
অরোন ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে তাকাল। ছোট্ট এক ছাউনির নিচে বসেছিল দু’জন। তীরুকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে এগোল। সর্বপ্রথম কথা বলল ছুটে আসা তীরু!
-” কি ব্যাপার? আমাকে কেন খোঁজা হচ্ছে? আপনি যাননি? ”
অরোনের মুখোশ্রীর রূপরেখা চট করে পাল্টাল। কন্ঠে একদম ভিন্ন রকম সুর টেনে বলল,
-” যাইনি। কেনো আমার থাকাতে আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে? ”
তীরু ব্যাতিব্যাস্ত হলো। ‘ না, না। তা কেন? ”
ওদের দু’জনের মাঝে ফোড়ন কাটে ইলি।
-” শোনো, তোমরা কথা বলো বরং। আমি গেলাম। একটু কাজ আছে আমার। ”
স্মিথ হাসল অরোন। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। ইলি প্রস্থান করতেই মুখোবয়বে টেনে আনল গাঢ় কালো মেঘ। মুখোশ্রীতে গাম্ভীর্যতা বহাল। তীরু গভীর নয়নে দেখতে ব্যাস্ত নতুন অরোনকে। নতুন অরোন? হ্যা নতুন অরোনই তো! লোকটাকে আগে কখনো সে গম্ভীর দেখেনি। দেখেছে শীতল মুখোবয়ব। শান্ত চোখের চাহনি। কিন্তু এবার যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে ভিন্ন অরোন!
-” আসুন আমার সাথে। ” অরোন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।
তীরু বিনা বাক্য ব্যায়ে হাটাঁ ধরে। অরোনকে নিয়ে বিশ্লেষণে ব্যাস্ত তীরু খেয়ালই করল না হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পড়েছে রাস্তার মাঝে। অরোনের পিছুপিছু চলতে গিয়ে ও দূরত্ব সৃষ্টি করে নিয়েছে। অরোনটার ধ্যানও তার প্রতি নাই। সিগন্যাল তখন গ্রিণ লাইট প্রদর্শন করছে। অন্যমনষ্ক তীরু বেমালুম আশেপাশের জগত ভুলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হাঁটা ধরল। পেছন থেকে চেঁচাল পুলিশ। ছুটে আসছিল গাড়ি নিয়ে। ফোনে মগ্ন অরোনের ধ্যান ছুটে গেল। তীরুর অবস্থান দেখে বড়সড় হলো চোখজোড়া। কি অদ্ভুত! মেয়েটা অমন রোবটের মতো হেঁটে যাচ্ছে কেন? আশপাশ থেকে যে চেঁচাচ্ছে। শুনছে না তা?
অরোন ছুটল! টান দিয়ে তীরুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো লহমায়। তীরু ফিরে এলো হুঁশে। সাথে কেঁপে উঠল অরোনের হুংকারে।
-” অদ্ভুত মেয়ে! মন কোথায় থাকে? আশপাশ থেকে যে চেঁচাচ্ছে কানে শুনেন না আপনি। এখনি তো হতো একটা এ ক্সি ডে ন্ট। ”
তীরু সিঁটিয়ে রয়েছে। অরোনের শক্তপোক্ত হাত তার কো ম ড়ে। সড়কে গাড়ি চালানো কয়েকজন সাদা চামড়ার লোক তীরু কে ইংরেজিতে বকাঝকা করে গাড়ি টেনে চলে গেল। দৌড়ে এলো ট্রাফিক পুলিশ। চারপাশে এক নজর বুলিয়ে অরোন শক্ত চোখে পুনরায় তীরুর পানে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-” দিলেন তো ঝামেলা লাগিয়ে। এখন পুলিশের চক্করে কতক্ষণ টাইম ওয়েস্ট হয় কে জানে! ”
অরোনের কণ্ঠে স্পষ্টত বিরক্তির রেশ! তীরু গায়ে মাখাল না। ও মিশে আছে ছেলেটার সাথে। মুঠোয় বন্দী করেছে অরোনের একগাছি শার্টের কাপড়। ও ভাবছে কিছু! ভাবনা – কালীন হুঁশ থাকেনা তার। আরো কতো কি অদ্ভুত স্বভাব তার মাঝে যে রয়েছে হিসেব নেই। তীরু অদ্ভুতুরে! ভীষণ অদ্ভুতুরে! এখন এটা অরোনকে বোঝায় সে কি করে? লোকটা তো রেগে আ গুন! অবশ্য রাগাটা স্বাভাবিক নয় কি? তবে তীরু জানে। এইযে তার সন্নিকটের সৌম্য পুরুষ, এই লোকটা জীবনে আসার পর হতে সে আরো অদ্ভুত হয়েছে। নয়ত এমনটা তো কখনো ঘটে নি। আজই কেন? অরোনকে নিয়ে চিন্তা করতে করতেই তো সে হুঁশ হারাল। দিক – বেদিক শূন্য হলো তাই না?
তীরুর ডান পা টা একটু ছুলেঁ গিয়েছে। খানিকটা র ক্ত ও পড়ছে সেখান হতে। অরোন দেখেছে আঘাত প্রাপ্ত স্থান। তবুও চুপ ছিল। কিছু বলেনি। তবে এ মূর্হতে পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে ফেরার সময় তীরুর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে তার টনক নড়লো। চিন্তা হলো একটুখানি। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” পায়ে দেখি ব্যা থা পেয়েছেন। কখন পেলেন? ”
তীরু প্রতিত্তোর করে, ” যখন আপনি ছাগলের মতো টান দিলেন। ”
অরোন চোয়াল বাঁকায়। বলে,
-” আপনি কি আমায় ছাগল বললেন? ”
তীরুর বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ হ্যা! আপনাকে বলবো না তো কাকে বলব? আপনি তো ছাগলই। আস্ত একটা মানুষ ছাগল। ছাগল অরোন! ছাগল যেমন নিজের পেট ভরতে খাবার খাওয়াটা বোঝে আর দিন দুনিয়ার কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞান নেই আপনিও তেমনি নিজের স্বার্থটাই বুঝেন। আশপাশের মানুষের কষ্ট দেখার বা বোঝার তো জ্ঞান নেই আপনার। ”
তবে ও আসলে বলল, ” না। আপনাকে কেন ছাগল বলতে যাব? আমি বোঝাতে চেয়েছি মানুষ যেমন ছাগলের গলার রশি ধরে উল্টাপাল্টা টান মা রে তেমনি তো আপনিও করলেন। ”
তীরুর কথায় যুক্তি খুঁজে পেল না অরোন। যুক্তিহীন কথা তার কাছে ভিত্তিহীন। ও ব্যাপারে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তাই অরোন নিঃশব্দে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে অপর পাশে নিজে গিয়ে বসল। গাড়িটা এনেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। তীরুকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, হেঁটে। কিন্তু মেয়েটা তো দিল ঝামেলা পাকিয়ে। এখন মাথা ধরেছে তার। সন্ধ্যা নেমেছে প্যারিসের বুকে। বাড়ি ফিরে ঘুমানো দরকার।
তীরু উঠে বসার পর কি ভেবে যেন অরোন নেমে গেল গাড়ি থেকে। তীরু তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। সিটে মাথা এলিয়ে দিল। স্বগতোক্তি করল,
-” তীরু! তীরু! তীরু! ছন্নছাড়া, উন্মাদ তীরু। সীমা লঙ্ঘন করছিস তুই। পা গ ল হচ্ছিস। যে তোকে দুই পয়সার দাম দেয় না তাকে নিয়ে ছ্যাচড়ার মতো ভাবনা আর কতো? ফিরে আয়, ফিরে আয় নিজের রূপে। খোঁজ তোর আসল সত্তাকে যাকে তুই হারিয়ে ফেলেছিস ঐ ছাগল অরোন তোর জীবনে আসার পর। ”
গাড়ি চলছে। কাচঁ তোলা। এসি চলছে। শীতল হাওয়া গায়ে দিচ্ছে প্রশান্তির দোলা। রেডিওতে স্টিফেন সানচেজের ‘ until I found you ‘ সফট মিউজিকটা বাজছে। প্রশান্তিদায়ক পরিবেশে ঘুম ঘুম লাগছিল তীরুর। ঘুমিয়েও পড়েছিল। আচানক গাড়ি ব্রেক কষলো। চোখ দু’টো জোরপূর্বক খুলে বুঝল হোস্টেলে এসে পড়েছে। হাই তুলে কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরুতে নিবে তৎক্ষনাৎ অরোন জলদগম্ভীর কন্ঠ তাকে থামিয়ে দিল।
-” দাঁড়ান। পায়ে ড্রেসিং দরকার। ”
কোনো কিছু ভাবার সুযোগ দেয়া হলো না তীরুকে। অরোন নিজে এসে তীরুর পাশের দরজা খুলে হাঁটু গেড়ে বসল। ছো মে রে পা টেনে ধরে নিজের কাজ করা শুরু করে ফেলল! হতবিহ্বল তীরু বোকার মতো তাকিয়ে। হতভম্বতা কাটছেই না তার। ও তখন অব্দি বোকার মতো তাকিয়ে আছে অরোনের পানে। দেখছে নিজের কাজে ভীষণ ব্যাস্ত থাকা অরোনকে।
চলবে~
|