#বেদনার_রঙ_নীল
উনিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
” আমি নামবো। গাড়ি থামান।”
প্রণয় হু-হা করে হাসল। যেন তুলি কোনো মজার কথা বলেছে। তার এই হাসির মাত্রা তুলির ভয়ের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। তুলি প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” আপনি হাসছেন কেন? ”
প্রণয় জবাব দিল না। হাসি বজায় রাখল। তুলি বলল,” যদি গাড়ি না থামান তাহলে আমি চিৎকার করবো।”
প্রণয়ের হাসির বেগ বাড়ল। আরও জোরে হাসতে লাগল সে। তুলি এই অবস্থা দেখে বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে পেছনে মাথা ঠেঁকালো। স্বগতোক্তি করল,” হে আল্লাহ, এসব কি হচ্ছে?”
প্রণয় হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করল। খুব জোরে ধাক্কা লাগায় তুলি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল অনেকটা। প্রণয় তার সামনে ব্যারিকেডের মতো হাত বাড়িয়ে দিল যাতে সে আঘাত না পায়। তুলি ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকাল। প্রণয়ের হাত ঝটিতে সরিয়ে বলল,” আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই না। এর চেয়ে একা যাওয়া অনেক ভালো। ”
তারপর সে অস্থির হয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু অবাক কান্ড, দরজা কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। তুলি কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” কি করেছেন আপনি? দরজা কেন খুলছে না? প্লিজ এসব বন্ধ করুন। আমার অসহ্য লাগছে।”
প্রণয় তুলির কান্ড-কারখানা দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। সপ্রতিভ হেসে বলল, ” আপনি কি শুরু করেছেন সেটাও আমি বুঝতে পারছি না মিস তুলি। আপনার কি হয়েছে? আগে আমাকে আপনার ব্যাপারটা বুঝতে দিন।”
” মানে? আমি কিছুই শুরু করিনি।”
” তাই? তাহলে হঠাৎ আপনার এই রূপ বদলের কারণ কি?”
” আপনি আমাকে অন্য সব মেয়েদের মতো ভাববেন না। আমি কারো টাইম পাসের অংশ হতে চাই না। দামী ফোন গিফট করলে, মিষ্টি করে দু’টো কথা বললেই আমি পটে যাবো এসব আপনি ভাবলেন কি করে? প্লিজ, স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি। আমি আপনার চেহারাও দেখতে ইচ্ছুক না।”
প্রণয় ভ্রু নাচিয়ে বলল,” আচ্ছা তাই? তাহলে সেদিন আজমীরদের সামনে ওই কথা কেন বললেন যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
” আমি বাঁচার জন্য বলেছিলাম। সেটা আপনি জানেন।”
প্রণয় এবার গম্ভীর হয়ে বলল,” আমাকে আপনার কি মনে হয়? যখন প্রয়োজন হবে ইউজ করবেন আর যখন দরকার নেই তখন ছুঁড়ে ফেলে দিবেন? মানে আমি কি কোনো টিস্যু পেপার? ”
তুলি উত্তর দিল না৷ চোয়াল শক্ত করে সামনে তাকাল। আরেকবার গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টায় মত্ত হলো। প্রণয় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল। সামান্য রেগে বলল,” এইযে লুক এট মি। আপনাকে তো আজকে জবাব দিতেই হবে। আপনি কি করতে চান আমার সাথে?”
তুলি ফুঁসে উঠে বলল,” সেইম কুয়েশ্চন আমারও। কি করতে চান আপনি আমার সাথে?”
” আমি কিছুই করিনি। আপনি জানেন, আমাদের একটা নরমাল রিলেশন ছিল। যেটা আপনার কারণে এবনরমাল হয়ে যাচ্ছে।”
” আমাদের রিলেশন শুরু থেকেই এবনরমাল ছিল। বরং আমারই ভুল হয়েছে। প্রথম ভুল আপনার ফোন নাম্বার মুখস্ত করা। দ্বিতীয় ভুল আপনার দেওয়া মোবাইল এক্সেপ্ট করা। আর তৃতীয় ভুল আপনাকে ফোন করা। আমি প্রত্যেকটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি। এক্সট্রিমলি স্যরি।”
প্রণয় হাত তালি বাজালো। ঠোঁট উল্টে বলল,” ওয়ান্ডারফুল। স্যরি বলে দিলেই সব সোলভ হয়ে গেল? তাহলে আপনি এসব কেন করলেন তুলি? প্রথম দিনই যদি আপনি বলে দিতেন যে আপনার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাহলে আমি আপনাকে বিরক্ত করতামও না। কিন্তু আপনি প্রথমে আমাকে রেসপন্স করেছেন। আর এখন এমন ভাণ করছেন যেন কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে। স্ট্রেইঞ্জ!”
প্রণয় বিরক্তিতে গাড়ির স্টেয়ারিং-এ আঘাত করল। তুলি আক্ষেপ ঝরা কণ্ঠে বলল, ” কারণ প্রথমে আমি আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি।”
প্রণয় দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করল,” কোন উদ্দেশ্যের কথা বলছেন আপনি?”
” এতো কথা বলে কি হবে? আমাকে যেতে দিন। এটা আমাদের দু’জনের জন্যই ভালো। ”
প্রণয় গাড়ির লক খুলে দিল। কিন্তু তুলি যখন গাড়ি থেকে নামতে যাবে তখনি সে দেখল নীল রঙের একটি মাঁকড়সা ঝুপ করে পড়ল উপর থেকে। তুলি বিকট শব্দে চেঁচিয়ে প্রণয়ের টি-শার্ট খামচে ধরল। প্রণয় হেসে ফেলল। এবার সে শানের কৌশল অবলম্বন করেছে তুলিকে আটকানোর জন্য। তুলি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” এইটা এইখানে কি করছে? প্লিজ এইটাকে সরান৷ আমার ভীষণ ভয় হয়। আপনি এতো জঘন্য!”
প্রণয় জবাবে বলল,” আমি কিছুই করিনি৷ শান প্রতিদিন এই গাড়ি দিয়ে স্কুলে যায়। হয়তো সে-ই রেখেছে।”
” আমি বিশ্বাস করি না। এই সবকিছু আপনার প্ল্যান। মিথ্যা বলবেন না। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য করছেন তাই না? আমার মাঁকড়সা নিয়ে অ্যালার্জি আছে। আপনি জানেন আমি কত ভয় পাই? প্লিজ এটা সরান। নয়তো খুব খারাপ হবে।”
তুলি রীতিমতো আতঙ্কে কাঁপছে। প্রণয়ের টি-শার্ট খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিরবচ্ছিন্ন বকবক করেই যাচ্ছে। ঠিক এই অবস্থায় প্রণয় একদমে বলে ফেলল,” আই লভ ইউ।”
তুলির কণ্ঠ থেমে গেল সাথে সাথে। কাঁপাকাঁপিও থেমে গেল এক নিমেষে। সে ঝটিতে চোখ মেলে চাইল প্রণয়ের দিকে। অবাক বিস্ময়ে উচ্চারণ করল,” মানে?”
প্রণয় নির্লিপ্তে বলল,” এর মানে একটাই।ভালোবাসি৷ এর তো দ্বিতীয় কোনো মানে নেই!”
তুলি চমক সামলাতে না পেরে স্রেফ তাকিয়েই রইল। প্রণয়ও নিশ্চুপ। নীরবতায় কাটল কিছু সময়। একটু পর তুলি বিষাক্ত কণ্ঠে বলল,” এটাও কি আপনার টাইম পাসের অংশ?”
প্রণয় ধৈর্য্যহারা হয়ে কপালে হাত রাখল। বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলল,” তুলি আমি সেটা মজা করে বলেছিলাম সেদিন।”
তুলি চিৎকার করে বলল,” কিন্তু আমি আপনার মজা করার বস্তু না। রাইফার সাথে সম্পর্ক থাকার পরেও আপনি কোন সাহসে আমাকে এসব বলছেন? আপনার কি লজ্জা নেই?”
এইটুকু শুনেই থমকে গেল প্রণয়। তুলি ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করতে লাগল। প্রণয় কঠিন দৃষ্টিতে বলল,” রাইফার সাথে সম্পর্ক মানে? এইখানে আমাদের মাঝে রাইফা কোথ-থেকে এলো?”
তুলি সংশোধন করার মতো বলল,” স্যরি, ভুল হয়েছে। রাইফা আসেনি। বরং আমিই আপনার আর রাইফার মাঝে চলে এসেছিলাম।”
” রাইফার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই তুলি। শী ইজ জাস্ট মাই ফ্রেন্ড!”
তুলি এমনভাবে হাসল যেন কথাটা বিশ্বাসই করল না। সে শুধু বলল,” আমাকে যেতে দিন। আমি নেমে যেতে চাই।”
প্রণয় নির্ণিমেষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,” আমার উত্তর এখনও আমি পাইনি।”
” আপনি কোনো উত্তর ডিজার্ভই করেন না।”
তুলির কটমট দৃষ্টির সামনে হার মানতে হলো প্রণয়কে। সে এক পর্যায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ওকে। আপনার যেমন ইচ্ছা।”
তারপর সে মাঁকড়সাটা দরজা থেকে সরিয়ে নিজের পকেটে রাখল। তুলি নিশ্বাস বন্ধ করে দৃশ্যটা দেখল। তারপরেই ফটাফট ব্যাগ নিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। প্রণয় একবারও বাঁধা দিল না। ফাঁকা রাস্তায় রিকশা খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তুলির। সে রিকশায় চড়ে বসল। প্রণয় গাড়ি নিয়ে সম্পূর্ণ রাস্তা তুলির রিকশাকে অনুসরণ করল। তুলি সেটা বুঝেও কিছু বলল না।
বাড়ি ফিরে দেখা গেল রাইফা আর তন্বি তুলির অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। তন্বি বলল,” ফ্রেশ হয়ে আয়। আমার খুব জোরে ক্ষিদে পেয়েছে৷ তিনজন একসাথে খেতে বসবো।”
তুলি হাসল। তন্বি রান্নাঘরে চলে গেল। রাইফা বারান্দা থেকে প্রণয়ের গাড়িটা দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” তোকে প্রণয় পৌঁছে দিয়েছে তাই না?”
তুলি মৃদু হেসে বলল,” না। আমি ওর সঙ্গে আসিনি। রিকশায় করে এসেছি।”
” তাহলে প্রণয়ের গাড়ি এইখানে কেন?”
” কি জানি? সে হয়তো তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে!” তুলি ফোঁড়ন কাটার উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।
” আমার সঙ্গে?” রাইফা বিভ্রান্ত হলো। তারপর গায়ে একটা ওরনা জড়িয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়ল। তুলি সতর্কবাণী দেওয়ার জন্যে বলল,” এই ছেলেটা ভালো না রাইফা। তোর ভালোর জন্যই বলছি।”
রাইফা রাগ নিয়ে বলল,” কচু জানিস তুই।”
সে লিফটে উঠে গেল। প্রণয় কি কাজে এইখানে এসেছে সেটা জানা দরকার। তন্বি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে সাজালো। তুলি এসে বসতেই তন্বি প্রশ্ন করল,” রাইফা কোথায়?”
তুলি প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল,” বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে।”
” কি? রাইফার বয়ফ্রেন্ডও আছে? আমি তো জানতাম না!”
” আমিও জানতাম না। এইতো কিছুদিন হলো জেনেছি।”
” তাহলে তুই আমাকে জানালি না কেন? কে ওর বয়ফ্রেন্ড?”
” আমি যে ছেলেটাকে পড়াই, তার বড়ভাই।”
তন্বি ফিচেল হেসে বলল,” ও। এইবার বুঝতে পেরেছি। এজন্যই ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাইফার এতো আগ্রহ!”
তুলি বিষাক্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” হুম। ঠিক।”
প্রণয় গাড়ির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে খুব এলোমেলো আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। রাইফাকে নামতে দেখেই সে হাসল। সোজা হয়ে বলল,” হায়।”
রাইফা কৌতুহলী দৃষ্টিতে জানতে চাইল,” তুমি হঠাৎ এখানে কেন প্রণয়?”
” মিষ্টি আপু বলেছিল তুলিকে পৌঁছে দিতে। তাই এসেছিলাম।”
” কিন্তু তুলি যে বলল সে তোমার সঙ্গে আসেনি? আর তুমি নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?”
প্রণয় হেসে অন্যদিকে তাকাল। রাইফা অবাক হয়ে বলল,” কি হচ্ছে?”
” তুলি ভাবছে আমাদের মধ্যে রিলেশন আছে।”
” বাহ, এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু ও এতো ইজিলি বিশ্বাস করে নিল?”
” জানি না। ও বলেছে আমি যাতে ওর থেকে দূরে থাকি।”
রাইফা হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল। প্রণয়কে আশ্বস্ত করতে বলল,” ডন্ট ওরি। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।”
” দরকার নেই।”
” কেন?”
প্রণয় উপরে তাকালো। জানালা থেকে তুলি তাদের উপর নজর রাখছে। রাইফা সরাসরি তাকাতেই তুলি দ্রুত পর্দা টেনে সরে গেল। রাইফা সন্দিহান গলায় বলল,” সে কি জেলাস?”
প্রণয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” জানি না। কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করছে না।”
ভার্সিটির ভর্তি কোচিং-এ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তন্বির ভর্তির জন্য হেলাল সাহেব টাকা পাঠিয়েছেন। তুলি ভেবেছিল তার জন্যেও টাকা পাঠানো হবে। কিন্তু হলো না৷ তুলি অবশ্য এই নিয়ে একদম মনখারাপ করেনি। সে জানতো এটাই হবে৷ রাইফা আর তন্বিকে বলে দিল,” তোরা ভর্তি হয়ে যা। আমি এমনিই পড়বো। কোচিং-এ ভর্তি হলেই যে চান্স হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমি কোচিং ছাড়াই ভর্তি পরীক্ষা দিবো।”
রাইফা এই কথা শুনে রেগে গেল। সে বলল,” অসম্ভব। আমরা তিনজন একসঙ্গে ভর্তি হবো। তুলি, তুই টাকার জন্য এই কথা বলছিস তাই না? প্রয়োজনে তুই আমার থেকে ধার নে। তবুও ভর্তি হয়ে যা প্লিজ!”
তুলি হেসে বলল,” লাগবে না। কোচিং ছাড়াই দেখবি আমি ভালো রেজাল্ট করেছি। আর তুই তো ভর্তি হচ্ছিসই। আমি না হয় তোর থেকেই নোটস নিয়ে নিবো।”
” নোটস নেওয়া আর স্ব-শরীরে ক্লাস করার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে তুলি। তুই ভর্তি না হলে আমিও হবো না, যা।”
রাইফার জেদের কাছে হার মানতে হলো৷ তুলি বলল,” আচ্ছা যা, আমি ভর্তি হবো। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন পেতেই তোর ধার শোধ করে দিবো কিন্তু।”
” আচ্ছা দিস।”
তিনজন একসঙ্গে হাসল। তন্বির বিভাগ আলাদা ছিল। সে মানবিক শাখা থেকে আলাদা কোচিং-এ ভর্তি হয়ে গেল৷ তার ক্লাসও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এদিকে তুলি আর রাইফা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তাই তাদের প্রায় নিয়মিত ক্লাস থাকে। প্রতিদিন পরীক্ষা হয়৷ আজ-কাল শানকে পড়ানোর সময় কমিয়ে এনেছে তুলি। আগে সে দুইঘণ্টার বেশি সময় ধরে পড়াতো। এখন ঘড়ি ধরে দেড়ঘণ্টা পড়ায়। এর মাঝে প্রণয়ের সঙ্গে একবারও দেখা হয় না। প্রণয়কে ইদানিং বাড়িতেই পাওয়া যায় না। তুলির সময় ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে।
কোচিং-এ এই কয়দিনে তাদের অনেক ভালো ভালো বন্ধু জুটে গেছে। টিনা, অবনী, মীরা, রাইফা আর তুলি পাঁচ জনের সুন্দর একটা গ্রুপ তৈরী হয়েছে। তারা প্রতিদিন একসঙ্গে বসে ক্লাস করে। সবারই কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। তুলি খুব পড়াশুনা করে। তার অন্যকোনো দিকে মনোযোগ নেই। টিনা শুধু সবার ভুল ধরে। কে কি বলল, কিভাবে তাকাল, কি পোশাক পরল এসব নিয়ে মাথা ঘামানোই তার মূল কাজ। অবনীর কাজ শুধু কোচিং-এর হ্যান্ডসাম ভাইয়াদের উপর ক্রাশ খাওয়া। সে তো পারলে ফুচকাওয়ালার উপরেও ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে। মীরা তাকে এসবে শাসন করে। সে কিছুটা মুরব্বি ধরণের। রাইফা খুবই হেল্পফুল। কারো কলম প্রয়োজন হলে কিংবা খাতা, ক্যালকুলেটর, পানি প্রয়োজন হলে সব তার কাছে পাওয়া যায়। এমনকি কারো ক্ষিদে পেলে খাবারও পাওয়া যায় রাইফার কাছে।
একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। সেদিন ছিল পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস। এর পরে রসায়ন পরীক্ষা। তুলি পড়াশুনা করছিল মন দিয়ে। বাকিরা আড্ডায় মত্ত। হঠাৎ সময়মতো ক্লাসে লেকচারার ঢুকে পড়ল। সবাই তড়িঘড়ি করে জায়গামতো দাঁড়ালো লেকচারারকে স্বাগতম জানাতে। তুলিও দাঁড়িয়েছে কিন্তু তার দৃষ্টি বইয়ের দিকে। লেকচারার বলল,” বসো সবাই। কেমন আছো?
সবাই একসঙ্গে উত্তর দিল৷ কিন্তু তুলি তখনও পড়ছে৷ এটাই তার কাজ। নতুন কোনো লেকচারার ক্লাসে এলে প্রথম দশমিনিট কথা বলে সময় নষ্ট করে। ওইটুকু সময় তুলি পড়ার মধ্যেই থাকে। তারপর মূল লেকচার শুরু হলে সে ক্লাসে মনোযোগী হয়। তবে আজকের ব্যাপার ভিন্ন। রাইফা চাপা স্বরে বলল,” তুলি, দ্যাখ কে এসেছে!”
তুলি ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,” পরে দেখবো।”
তখনি পেছন থেকে অবনী বলল,” শেষ! আমি শেষ! এতো সুন্দর টিচার কেন দেয় বলতো?আমরা কি হার্ট অ্যাটাক করবো নাকি পড়াশুনা করবো? নাকি পড়াশুনা করতে করতে হার্ট অ্যাটাক করবো?”
তুলি কথাটা শুনতে পেয়ে মজা করে বলল,” হার্ট এতো দূর্বল হলে চলে?”
” বাট হি ইজ ড্যাম হট।”
মীরা বলল,” চান্স পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে পড়াশুনা কর। তাহলে এমন কত ড্যাম হট পেছনে ঘুরবে!”
তুলি তাদের কথা শুনে হাসছিল। রাইফা তুলির কানে কানে বলল,” তুই কি একবার দেখবি না ভাইয়াকে?”
” যত সুন্দরই হোক, আমার কাছে ভালো লাগবে না। তাহলে দেখে কি লাভ? শুধু শুনলে আর পড়া বুঝলেই হলো।”
তখন টিনা বলল,” নারে, আজকের ভাইয়াটা আসলেই জোস। দেখার মতোই জোস। হয়তো তুইও ক্রাশ খাবি।”
টিনা মোবাইল বের করে লুকিয়ে ছবি তুলতে লাগল। তার এই আচরণে বোকা হয়ে গেল তুলি। তারা একদম পেছনে বসে আছে। ক্লাসরুম অনেক বড়। পেছন থেকে লেকচারারের কথা স্পষ্ট শোনা যায়। কারণ স্পিকার ব্যবহার করা হয়। আর তুলি যেখানে বসেছে সেখান থেকে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। তবে টিনার কান্ডে তুলির দেখতে খুব ইচ্ছে হলো। টিনা খুব নাক উঁচু মেয়ে। তার সহজে কাউকে পছন্দ হয় না। অথচ এইবার সে একদম ফোন বের করে ছবি তুলতে শুরু করেছে। এর মানে কিছু তো আছেই। তুলি সামনের মানুষটিকে দেখার কৌতুহল দমাতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনি তার আত্মা ছলাৎ করে উঠল। রাইফা মৃদু হেসে বলল,” চিনতে পেরেছিস?”
তুলি হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি কি ভুল দেখছি নাকি আসলেই ভুল দেখছি?”
” তুই একদম ঠিক দেখছিস।”
প্রণয় মুচকি হেসে তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,” যদি কোনো প্রবলেম না থাকে তাহলে কি আমরা সবাই বসতে পারি?”
সবার মাঝে একমাত্র তুলিই দাঁড়িয়ে আছে। তাই কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না যে কথাটা তুলির উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। প্রত্যেকের দৃষ্টি এবার তুলির দিকে স্থির হলো। তুলি তখনও হাঁ করে প্রণয়কে দেখছিল। তার বিস্ময় কাটছিলই না। প্রণয় বলল,” বসো।”
তুলি বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” কি?”
সবাই হেসে উঠল৷ সামনে থেকে একটি মেয়ে বলল,” ভাইয়া তোমাকে বসতে বলেছে। বসো।”
এই কথার পর সবাই আরও এক দফা হাসল। চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। একজন তো বিড়বিড় করে বলেই উঠল,” ভাইয়াকে দেখে হ্যাং মেরে গেলে যে? ক্রাশ খেয়েছো নাকি?”
তুলি লজ্জায় বসে পড়তে নিচ্ছিল তখন প্রণয়ই আবার বলল,” তোমার পেছন থেকে দেখতে অসুবিধা হলে সামনে এসে বসতে পারো।”
তুলি মনে মনে প্রণয়কে খুব গালি দিয়ে বলল,” নো থ্যাংকস। আমি এখানেই ঠিকাছি।”
তারপর সে বসে পড়ল নিজের জায়গায়। রাইফা হাসতে লাগল। তুলি ফিসফিস করে বলল,” আর কোনো জায়গা ছিল না? এখানেই কেন মরতে আসতে হবে তাকে?”
প্রণয় সবার উদ্দেশ্যে বলল,” ওয়েল, আমি এখন আমার পরিচয়টা দেই। আমি প্রণয় আহসান ফ্রম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং(সিএসই) ফোর্থ ইয়ার।”
তুলি মুখ ভেংচিয়ে বলল,” ম্যা, ম্যা, ম্যা! আমি এই ছাগলের ক্লাস করবো না।”
চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
বিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
এতো দূর থেকে তুলির ফিসফিস কণ্ঠে বলা শব্দ প্রণয়ের কানে পৌঁছানোর কথা না৷ কিন্তু প্রণয় এদিকেই এগিয়ে আসছে। তুলি কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসল৷ ঘটনা আঁচ করা যাচ্ছে না। প্রণয় যদি সবার সামনে তাকে কিছু বলে তাহলে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে!
প্রণয় একদম পেছনে তুলিদের বেঞ্চের সামনেই এসে দাঁড়াল। তুলি আতঙ্কবোধ করছে। প্রণয় কণ্ঠে গম্ভীরতা ঢেলে বলল,” তুমি দাঁড়াও।”
তুলি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,” আমি?”
প্রণয় জবাব দিল না। তুলি খেয়াল করল তার দৃষ্টি টিনার উপর। টিনা ঠিক তুলির পাশেই বসে আছে। সে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রণয় ভারিক্কি মেজাজে বলল,” তোমার ফোনটা দেখি।”
টিনা অস্বচ্ছন্দে ফোন দিল। প্রণয় এবার মুখে হাসি টেনে বলল,” আমার সাথে ছবি তুলতে চাও? তাহলে বাইরে এসো। একসাথে অনেকগুলো তুলে নেই। নয়তো পুরো ক্লাস লুকিয়ে ছবি তুলতে তুলতে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে৷ এতোদূর থেকে একটা ছবিও ভালো আসবে না।”
সবাই হেসে উঠল। টিনার মুখ লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল। নিম্ন স্বরে বলল,” স্যরি ভাইয়া।”
প্রণয় ফোনটা ফেরত দিয়ে চলে গেল। তুলি রাগে কটমট করে বলল,” খুব ভালো হয়েছে। তোকে কে বলেছিল লুকিয়ে ছবি তুলতে? এখন দিল না একটা আচ্ছামতো বাঁশ? ভালো লাগছে?”
টিনা জবাব দিল না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। তার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। রাইফা হাসির চোটে কথাই বলতে পারছিল না। ক্লাস শেষ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার সময় তুলি তার মনের কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করল,” যার বাপের এতো টাকা সে কেন কোচিং সেন্টারে চাকরি করতে এলো? আমি বুঝতে পারছি না।”
রাইফা হাসি মুখে বলল,” প্রণয়ের কথা বলছিস?”
” অফকোর্স। আর কার কথা বলবো?”
রাইফা শ্রুতিমধুর কণ্ঠে বলল,” হয়তো ও তোর জন্য এসেছে।”
” হোয়াট?” তুলির চেহারায় অবিশ্বাস। রাইফা নিরাশ কণ্ঠে বলল,” জানি বিশ্বাস করবি না। কিন্তু এটা সত্যি হতেও পারে।”
” ও আমার জন্য কেন আসবে?”
” সেটা ও জানে।”
” অদ্ভুত!”
তুলি এই নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করল না। রাইফাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইল না। প্রণয় নিষেধ করেছিল। ঠিক পরের সপ্তাহে আবার একটি পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে দেখা হলো প্রণয়ের সঙ্গে।এই রকম খুবই কম হয়। ভর্তি কোচিং-এর নিয়ম হলো একবার যেই স্যার ক্লাস নিয়ে চলে যাবেন তিনি আর দ্বিতীয়বার কখনও আসবেন না। তার জায়গায় নতুন কেউ আসবেন। একই স্যার দ্বিতীয়বার আসা খুবই বিরল একটি ঘটনা। ছাত্রীরা প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে লাগল৷ সামনের বেঞ্চিতে বসা কয়েকজন মেয়ে জিজ্ঞেস করল,” ভাইয়া এটা কিভাবে হলো? আপনি আবার কিভাবে আমাদের ক্লাসে এলেন?”
” আসলেই। এটা কি কো-ইন্সিডেন্ট ছিল?”
প্রণয় আন্তরিক ভঙ্গিতে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল,” এটা কোনো কো-ইন্সিডেন্ট না। আমিই ইনটেনশনালি আবার তোমাদের ক্লাসে এসেছি। আর এখন থেকে তোমাদের সব ফিজিক্স ক্লাস আমিই নিবো। হেড অফিসের সাথে ডিল করা আছে।”
প্রণয়ের এমন কথায় সবাই অবাক বনে গেল। অবনী বলল,” ভাইয়া মনে হয় আমাদের মায়ায় পড়ে গেছেন, তাই না? এজন্য আমাদের ছাড়তেই চাইছেন না।”
সামনে থেকে একটি মেয়ে বলল,” এর একটা রিজন অবশ্যই আছে ভাইয়া। আপনি নিশ্চয়ই আপনার সুবিধার জন্য এইটা করেছেন ঠিক না?”
প্রণয় সরাসরি বলল,” ইন্টেলিজেন্ট। তোমাদের ব্যাচে কেউ আছে যে আমার কাছে অনেক স্পেশাল। তার জন্যই আমি এইটা করেছি। সুতরাং বলতে পারো আমার সুবিধার জন্যই।”
সবাই খুব জোরে চেঁচালো। মেয়েটির নাম জানার জন্য কৌতুহল উপচে পড়তে লাগল প্রত্যেকের চেহারায়। প্রণয় প্রসঙ্গ পাল্টে পড়াশুনার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করল৷ সবাই আশাহত হলো। মেয়েটির নাম জানার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছিল না কেউই। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহসও হচ্ছিল না কারো। রাইফা আঁড়চোখে তুলির দিকে তাকাল। তুলি রেগে বলল,” আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? ওই স্পেশাল গার্ল তো তুই।”
রাইফা ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” গাঁধী। আমি কেন হবো? ওই স্পেশাল গার্ল তুই।”
তুলির বিশ্বাস হলো না। ক্লাসের মাঝে প্রণয় একটা গাণিতিক সমস্যা দিয়েছিল। যারা সবার আগে সমাধান করবে তাদের মধ্য থেকে প্রথম তিনজন পাবে খাতায় সিগনেচার। রাইফা, তুলি আর অচেনা একটি মেয়ে খুব দ্রুত সমস্যাটা সমাধান করে ফেলল। প্রণয় বাকি দুইজনের খাতায় সিগনেচার করল। শুধু তুলির খাতায় লিখল,” ম্যাথের এন্সার ঠিকাছে। কিন্তু আমার এন্সার এখনও পাইনি।”
লিখাটা পড়ে তুলি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের খাতা বন্ধ করে ফেলল; যাতে কেউ দেখতে না পারে। ক্লাস শেষেই শুরু হলো অবনী আর টিনার হা-হুতাশ। সেই স্পেশাল গার্লের নাম তারা জানতে পারল না। কিভাবে মেয়েটিকে শনাক্ত করা যায় তা নিয়ে চলতে লাগল পরিকল্পনা। মীরারও যে আগ্রহ কম হচ্ছে তা না। তবে সে টিনা আর অবনীর মতো অস্থিরতা দেখাচ্ছে না। রাইফা বলল,” আমাকে একটা জায়গায় আর্জেন্ট যেতে হবে তুলি। আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি। তুই রিকশা দিয়ে চলে যাস।”
তুলি একটু চমকে বলল,” কোথায় যাবি তুই এইসময়? চল আমিও তোর সঙ্গে যাই?”
” লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।”
রাইফা বের হয়ে গেল। তুলি বিস্মিত। এর আগে কখনও রাইফা তাকে একা ফেলে চলে যায়নি। আজকে মেয়েটার কি হলো?
ভরা রাস্তায় ওই পারে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালো তুলি। এই পার থেকে রিকশা যাবে না। ওই পারে গিয়েই উঠতে হবে। কিন্তু রাস্তা খুবই ব্যস্ত। ব্রীজেও ওঠা সম্ভব নয়। কারণ ব্রীজ খুব নিরিবিলি। আর অনেকটা দূরে। এতো হাঁটার শক্তি তুলির নেই। হঠাৎ প্রণয় গাড়ি নিয়ে সামনে এসে থামলো। জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,” হেল্প লাগবে?”
তুলি ভদ্রভাবে হেসে জবাব দিল,” নো থ্যাংকস। ”
প্রণয় গাড়ির দরজা খুলে দিল। তুলি হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি বলেছি লাগবে না।”
প্রণয় অবিচল কণ্ঠে বলল ” উঠে এসো। নাহলে যদি জোর করে তোমাকে গাড়িতে তুলি তাহলে মানুষ আমাকে কিডন্যাপার ভাববে।”
তুলি আশেপাশে একবার দেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল৷ তারপর বাধ্য হয়েই গাড়িতে উঠল। প্রণয় আর কোনো কথা না বলে গাড়ি চালু করল। দু’জনই নিশ্চুপ ছিল। একসময় তুলিই বলল,” আপনি কোচিং-এ এসব কি শুরু করেছেন? ”
” মানে?”
” আমার খাতায় ওগুলো লেখার মানে কি? যদি কেউ দেখতো?”
” কিন্তু দেখেনি তো!”
তুলি বিরক্ত গলায় বলল,” উফ, আপনার সেই স্পেশাল গার্লটা কে? তার খাতায় গিয়ে লিখুন যা ইচ্ছা। আমার খাতায় না।”
প্রণয় হাসল। তুলি গরম দৃষ্টিতে বলল,” ডন্ট ফ্লার্ট। এখন আবার বলবেন না যে আমিই সেই স্পেশাল গার্ল!”
” আমি বললেও তো তুমি বিশ্বাস করবে না। তাহলে বলেও লাভ কি?”
” আচ্ছা আপনি আমাকে তুমি করে বলতে লাগলেন কবে থেকে?”
” এখন স্টুডেন্টকে আপনি করে ডাকতে হবে?”
” স্টুডেন্টকে প্রপোজ করাও কোনো ভালো টিচারের কাজ না।”
তুলি এই কথাটা বলল অন্যদিকে চেয়ে। প্রণয় মুচকি হাসল। কৈফিয়ৎ দেওয়ার জন্যে বলল,” ওইসময় তো তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে না।”
তুলি বাঁকা হেসে বলল,” এখন তো স্টুডেন্ট হয়েছি!”
” কি আসে-যায়?”
তুলি তার ব্যাগ থেকে একটা রঙিন ওরনা বের করল। প্রণয়ের দিকে ওরনাটা বাড়িয়ে বলল,” এটা শান আমাকে দিয়েছিল। সে নাকি আপনার আলমারিতে পেয়েছে।”
প্রণয় ভ্রু কুচকে কিছুটা রেগে বলল,” হোয়াট রাবিশ! আমার আলমারিতে মেয়েদের ওরনা থাকবে কেন?”
” নাটক করবেন না। এটা রাইফার ওরনা। আপনার আলমারিতে ছিল। আপনি এই ওরনার অনেক যত্ন নেন। শান আমাকে সবই বলেছে। তখন থেকে ওরনাটা আমি নিজের কাছে রেখেছি। এজ আ প্রুফ। এখনও কি অস্বীকার করবেন যে আপনি রাইফাকে ভালোবাসেন না?”
প্রণয় চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আমি এই ওরনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। স্ট্রাস্ট মি।”
তুলি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হেসে উঠল। প্রণয়ের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। শান কি উল্টা-পাল্টা লাগিয়েছে কে জানে? সে বাড়ি ফিরেই শানের খোঁজ করল। কিন্তু শান নিরুদ্দেশ। আজকে তার স্কুল বন্ধ থাকার কথা। তাহলে সে কোথায় যেতে পারে? প্রণয় মিষ্টিকে বলল,” শান বাড়িতে এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।”
মিষ্টি আর অজান্তা দু’জনেই ঘাবড়ে গেল।
শান প্রণয়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। প্রণয় মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। চোখ-মুখ গম্ভীর,লাল। দেখে বোঝাই যায় যথেষ্ট রেগে আছে। প্রণয়ের এমন চেহারা দেখলে শানের বুকে ধুকধুক শব্দ শুরু হয়। যা এখনও হচ্ছে। শান কিছুতেই এই ধুকপুকানি থামাতে পারছে না। মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। গলাও শুকাচ্ছে। ঢোক গিলতে কসরত হচ্ছে। শান এক পা ভিতরে নিয়েও আবার বের করে ফেলছে। ঘরে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছে না। প্রণয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝারতে ঝারতে বলল,” আয়।”
শান রীতিমতো কেঁপে উঠল। ঘন পল্লবযুক্ত অপূর্ব অক্ষিযুগল প্রণয়ের দিকে তাঁক করে ভেতরে ঢুকল। ভয়ে শানের বৃহৎ চোখ আরও বৃহতাকৃতি ধারণ করেছে। প্রণয় আয়নায় শানের মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল,
” কোথায় গিয়েছিলি সকাল সকাল?”
শান নির্বিঘ্নে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল,” তাইতিদের বাড়ি। নোট আনতে।”
প্রণয় আবার তাকাল শানের দিকে। শান মাথা নুইয়ে ফেলল। প্রণয় ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে শানের দিকে ঘুরে তাকাল। পূর্ণ মনোযোগের সাথে জিজ্ঞেস করল, ” তাইতি কে?”
শান মাথা নিচু রেখেই বলল,” ফ্রেন্ড।”
” তোকে গার্লস স্কুলে পড়াই?”
শান আশ্চর্য হয়ে তাকাল,” না তো।”
প্রণয় কঠিন গলায় বলল,” তাহলে এতো মেয়ে ফ্রেন্ড আসে কোথ থেকে? তোর সব ফ্রেন্ড মেয়ে হয় কি করে? তোর ক্লাসে ছেলে নেই?”
শান অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,” আছে। তবে আমাদের ক্লাসে মেয়ের সংখ্যা বেশি। এটা কি আমার দোষ? আর সব ফ্রেন্ড মেয়ে না তো। মাত্র ছয়জন মেয়ে।”
” কাল স্কুলে গিয়ে তোর প্রধান কাজ কি জানিস?সব মেয়ে ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করা। এতো মেয়ে ফেন্ড থাকা যাবে না। ছেলেদের সাথে মিশবি। ফ্রেন্ড হিসেবে মেয়েদের থেকে ছেলেরা বেশি হেল্পফুল হয়। মেয়েদের থেকে পাঁচ ফুট দূরে থাকবি। মনে থাকবে?”
শান মাথা নুইয়ে মাথা নাড়ল। প্রণয় বিরবির করল,
” মেয়েদের সাথে মিশতে মিশতে তোর স্বভাব-চরিত্রও দিন দিন মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছে।”
” মানে?”
” মেয়েদের মতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিস। রিসবের আলমারি থেকে ওরনা চুরি করেছিস কেন? তুই কি ওরনা গায়ে দিবি? নাকি তোর কোনো মেয়ে বান্ধবীকে উপহার দিবি?”
শান ভ্রু কুচকে লজ্জিত গলায় বলল,” আমি মেয়েদের সাথে মিশি না। মেয়েরাই যদি আমার সাথে নিজ থেকে কথা বলতে আসে, টিফিন শেয়ার করে,নোট শেয়ার করে, এটা কি আমার দোষ? আমি কি করবো? আই ফাইন্ড দেম হেল্পফুল ফোর মি। সো আই কিপ দেম।”
” দে আর নট হেল্পফুল ফোর ইউ। দে আর জাস্ট হার্মফুল ফোর ইউ।”
” বাট তাইতি ইজ নট হার্মফুল। শী ইজ বিউটিফুল।”
” বিউটিফুল? এখন সবই বিউটিফুল লাগবে। পরে বুঝবি প্যারা কি জিনিস। তোর মতো বয়সে আমারও এমন মনে হতো।”
” মিস কিউটিপাই কি হার্মফুল?”
প্রণয় চোখ ছোট করে তাকাল। শান জড়োসড়ো হয়ে বলল,” ওকে। আমি এখন যাই। শিনচ্যান শুরু হবে।”
শানের পড়ার টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে তুলি। কিন্তু শান এখনও আসছে না। বসে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম এসে গেছে। ক্রমাগত হাই তুলতে হচ্ছে। আজ সকাল আটটা নাগাদ শানকে পড়াতে চলে এসেছে সে। শানকে পড়িয়ে রাইফার সাথে যাবে কোচিং-এ।
শান ভিতরে ঢুকেই একটা কাশি দিল। কাশির শব্দ শুনে পেছনে তাকাল তুলি। এই কাশিটাকে বলা হয় মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কাশি দেওয়া। শান তার পেছনে কি একটা লুকিয়ে রেখেছে। তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুলিকে খুব জরুরি কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। তুলি শানকে ভেতরে আসতে বলল। শান নির্বিকার ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। পেছনের জিনিসটা এখনও আড়াল করে রেখেছে।
তুলি বলল,” তুমি কি কিছু বলবে?”
শান মাথা নাড়ল।
তুলি ঠান্ডা কণ্ঠে অনুমতি দিল,” হ্যাঁ বলো?”
শান এবার পেছনে লুকিয়ে রাখা খাতা আর কলমটা টেবিলের উপর রাখল। তুলি দেখল খাতাটার প্রথম পেইজে লেখা– “I am donkey. Please forgive me.”
এই একটা লাইন পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বারবার লেখা। তুলি ভ্রু কুচকে শানের দিকে তাকাল।
” এগুলো কি?”
“পানিশমেন্ট।”
“কিসের পানিশমেন্ট? কে দিয়েছে এমন পানিশমেন্ট? ”
” রেডলাইট!”
” কেনো? আবার কি কুরুক্ষেত্র ঘটিয়েছো শুনি!”
” তেমন কিছুই করিনি। শুধু ছোট্ট একটা মিসটেক হয়ে গেছে। তিন হাজার বার এই লাইনটা আমাকে লিখে রেডলাইটকে জমা দিতে হবে।”
তুলি চোখ বড় করে বলল,” তিন হাজার বার? কিন্তু এতোবার কেনো?”
” ভাইয়ার পারমিশন ছাড়া তার আলমারি ঘেঁটেছি। সেইজন্য এক হাজার। আলমারি থেকে ওরনা চুরি করেছি। সেইজন্য আরো এক হাজার । চুরি করা ওরনাটা আপনার হাতে দিয়েছি। সেইজন্য আরো এক্সট্রা এক হাজার । মোট তিন হাজারবার।”
তুলি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এইটা কি ধরনের পানিশমেন্ট? তিন হাজার বার এতোবড় একটা লাইন লিখতে হবে? ব্যাপারটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?
তুলি বলল,” কিন্তু শান, তুমি যদি সারাদিন এসব লেখো তাহলে পড়াশোনা করবে কখন?আর এতো লিখতে গিয়ে হাত ব্যথা হয়ে যাবে না?”
শান মুচকি হাসল,” হুম সেইজন্যই তো আপনাকে দিচ্ছি। আপনি লিখে দেবেন আমাকে। আর আমি পড়ব।”
কথাটা শুনে তুলির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।
” মানে? আমি কেনো লিখতে যাবো? পানিশমেন্টটা তো তোমার।”
” কিন্তু অর্ধেক দোষ আপনারও। আপনি যদি কাল রেডলাইটকে ওরনাটা না দেখাতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না। আমি চুপি চুপি গিয়ে ঠিক জায়গা মতো ওরনাটা রেখে আসতাম। কিন্তু আপনিই ঝামেলা বাঁধিয়েছেন। তাই এখন আপনাকেই পানিশমেন্ট পেতে হবে। আমি সারারাত ধরে বারোশো বার লিখেছি। এখন বাকিটা আপনি লিখবেন।”
” ইম্পসিবল! আমি এসব লিখতে পারবো না। আর তাছাড়া তোমার হ্যান্ড রাইটিং আর আমার হ্যান্ড রাইটিং এ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তোমার ভাইয়া বুঝে ফেলবে।”
” সেইটা আপনার প্রবলেম। আপনাকে এমন ভাবেই লিখতে হবে যেন রেডলাইট না বুঝতে পারে। আদারওয়াইজ…..”
” আদার ওয়াইজ কি?”
” আমি আপনার ভিডিও ভাইরাল করে দিব।”
তুলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। হত বিস্মিত গলায় উচ্চারণ করল,” হোয়াট?আমার আবার কিসের ভিডিও?”
” আছে। ”
শান রহস্যের ভঙ্গিতে হাসল। তারপর পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে একটা ভিডিও চালু করল। ভিডিওটায় তুলি খুবই এলোমেলো অবস্থায় চেয়ারের উপর পা তুলে বসে আছে। চোখমুখ বন্ধ করে মনে মনে কি যেন বিরবির করছে। তার হাত-পা কাঁপছে আর শরীর থেকে ঘাম ছুটছে। খুবই বাজে একটা অবস্থা। তুলি কিছুক্ষণ ভিডিওটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,” এটা কি শান? তুমি এমন জঘন্য কাজ করতে পারলে?”
” এটা আপনি মিস। মাঁকড়সা দেখে একটা মানুষ এতো ভয় পায়, ব্যাপারটা অনেক ফানি! আপনি যদি আমাকে হেল্প না করেন তাহলে এই ভিডিও আমি ভাইরাল করব। আমার ইউটিউব চ্যানেলে আপ্লোড করে দিবো। ভালোই ভিউজ হবে। কিছু ইনকামও হবে।”
শানের কথা শুনে তুলির চোখ রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেল। এই মিলিমিটার সাইজের ছেলে বলে কি? তার আবার ইউটিউব চ্যানেলও আছে? আবার বলছে সেখানে ভিডিও ভাইরাল করবে? তুলি ভাবতেই পারছে না শান এই ধরণের ভিডিও কখন করল? না জানি আর কি কি আছে এই ছেলের কাছে! ভয়ে বুক ধুকধুক করতে লাগল তুলির। সে খাতা আর কলম হাতে নিয়ে বলল,” ঠিকাছে, বাকি লেখা আমি লিখে দিবো। ”
” থ্যাংকস। ” শান মিষ্টি করে হেসে পড়তে বসল।
তুলি বিরবির করে বলতে লাগল,” কি ডেঞ্জারাস ছেলে! এখনো দুধের দাত পড়েছে কি-না সন্দেহ। অথচ এমনভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে যেন কোনো বড়সড় মাফিয়া। এই ছেলে ফিউচারে কি হবে আল্লাহ মালুম। বড়সড় কোনো গ্যাংস্টার কিংবা কোনো রাজনীতিবিদ। মাথাভর্তি যতসব কূটনৈতিক বুদ্ধি!”
শান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,” আপনি চাইলে খাতাটা বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন। রেডলাইট আমাকে কাল সকাল বারোটার পর্যন্ত টাইম দিয়েছে। এর মধ্যেই আপনাকে শেষ করে আমার কাছে জমা দিতে হবে। যদি এক সেকেন্ডও লেইট হয়, ভিডিও উইল বি আপ্লোডেড দেন।”
তুলি কটমট দৃষ্টিতে তাকাল। না পারল কিছু বলতে আর না পারল সহ্য করতে।
চলবে