#বেদনার_রঙ_নীল
একুশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
সন্ধ্যায় চায়ের আসরে অনেক দিন পর বন্ধুরা একত্রিত হয়েছে। সেমিস্টার ফাইনালের চাপ শেষ করে মাত্র হাঁফ ছাড়ল সকলে। অনেকদিন পর একটি মজার বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রণয়। সামনে তার জন্মদিন। আজমীর আর প্রিয়ন্তী প্রণয়ের সবচেয়ে কাছের। তবে বেশ কিছুদিন হলো আজমীরের সাথে প্রণয়ের ঝামেলা চলছে। বন্ধুত্বে সচরাচর এতোদিন ধরে ঝামেলা থাকে না। তবে আজমীর আর প্রণয় একে-অন্যের মুখ দেখতেও অনিচ্ছুক। বন্ধুরা বুঝতে পারছে এটা যে কোনো মেয়েঘটিত ব্যাপার। প্রণয়ের অনুপস্থিতিতে এই নিয়ে আলোচনাও হয় ব্যাপক। আজমীরের হবু ভাবীকে বিয়ে থেকে ভাগিয়ে আনতে গিয়ে এখন প্রণয় নিজেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে। খুবই মুখরোচক আলোচনা। প্রণয়ের সামনে অবশ্য কেউ এই বিষয়ে কথা বলার সাহস পায় না। তবে আগে-পিছে এসব নিয়ে হাসি-তামাশা নিশ্চয়ই হয়। আজকে প্রণয় আড্ডামহলে উপস্থিত হতেই আজমীর ঠুনকো একটি বাহানা দেখিয়ে উঠে যেতে চাইল। জুবায়ের তাকে থামিয়ে বলল,” আরে বোস, আর কতদিন চলবে তোদের মধ্যে এসব? এবার একটু সমঝোতা কর। সামনে প্রণয়ের বার্থডে।”
আজমীর আঁড়চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাল। প্রিয়ন্তী বলল,” তুইও কিন্তু কম না প্রণয়। এখানে আসার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি আজমীর আছে কি-না! অর্থাৎ আজমীর থাকলে তুই আসবি না? এটা কোনো কথা? একটা মেয়ের জন্য তোরা টিন এইজের মতো ঝগড়া করছিস।”
প্রণয় শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,” আমি কারো সাথে ঝগড়া করিনি। কথা বলাও বন্ধ করিনি। আমার দিক থেকে সব নরমাল।”
সবাই এবার আজমীরের দিকে চাইল৷ আজমীর অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” তাহলে কি সব দোষ আমার? যে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল সে স্যরি না। অথচ আমাকে স্যরি হতে হবে?”
প্রণয় চোয়াল শক্ত করে তাকাল। ভারী আওয়াজে বলল,” আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।”
” তুই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।” আজমীর প্রণয়ের কাছে এগিয়ে এলো। প্রণয়ও চায়ের কাপ রেখে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে লাগল। পরিস্থিতি অনুকূলের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কায় বন্ধুরা তাদের সামলানোর চেষ্টা করল। প্রিয়ন্তী প্রণয়ের হাত টেনে বলল,” এদিকে আয় দোস্ত।”
রাফি আর অয়ন আজমীরকে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। প্রিয়ন্তী ফিসফিসিয়ে বলল,” এখানে কোনো হাঙ্গামা করিস না প্লিজ। আজমীর তোর কত ভালো ফ্রেন্ড ছিল৷ একটা সামান্য মেয়ের জন্য ওর সাথে তুই এমন করতে পারছিস?”
প্রণয় ইস্পাতের মতো কঠিন মুখ করে বলল,” সে কোনো সামান্য মেয়ে না। কথা বলার আগে বুঝে শুনে বলবি।”
প্রিয়ন্তী একটু হকচকিয়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল,” আচ্ছা স্যরি।”
প্রণয় প্রিয়ন্তীর হাত ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তার মেজাজ হয়ে উঠেছে তিরিক্ষ। প্রিয়ন্তী একটু কাছে এসে ফোঁড়ন কেটে বলল,” আমি তো ভুলেই গেছিলাম। ও এখন তোর গার্লফ্রেন্ড!”
প্রণয় অকপটে বলল,” গার্লফ্রেন্ড হয়নি এখনও। ”
প্রিয়ন্তী চমকালো। কৌতুহল নিয়ে বলল,” কি? তাহলে আমি যে শুনেছিলাম তোদের রিলেশন হয়ে গেছে? আজমীর তাহলে তোর উপর কেন রেগে আছে?”
প্রণয় সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করল। প্রিয়ন্তী শ্রান্ত কণ্ঠে বলল,” ওহ মাই গড! আমার তো মনে হয় মেয়েটা তোদের দু’জনের সঙ্গেই খেলছে..”
” কি বললি তুই?” প্রণয় ধারালো দৃষ্টিতে চাইল। প্রিয়ন্তী সংশোধন করার জন্য ত্বরিতে বলল,” মানে সে হঠাৎ এমন কেন করবে? আজমীরের থেকে বাঁচার জন্য তোর হেল্প নিয়েছিল। আর এখন তুই ওর পেছনে পড়ে গেছিস তাই তোর থেকে বাঁচার জন্য উল্টা-পাল্টা রিজন দেখাচ্ছে। টিন এইজ মেয়েরা এমনই হয়। ওরা ফিলিংসের কি বুঝে? রিলেশনশীপ নিয়ে কখনও সিরিয়াস থাকে না।”
” তুলি ওই ধরণের মেয়ে না।”
” কি জানি সে কেমন মেয়ে! আমি তো ওকে সামনা-সামনি দেখিওনি।”
হঠাৎ দূর থেকে আজমীর ছুটে এলো। তার ভাব-গতিক দেখে মনে হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য প্রণয়কে আক্রমণ করা। সেজন্য প্রণয়ও প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়ন্তী এই অবস্থা দেখে দ্রুত তাদের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজমীর খিটমিট করে বলল,” সামনে থেকে সর প্রিয়ু।”
প্রিয়ন্তী রেগে আজমীরকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল,” তোর সাহস তো কম না! কি করতে চাইছিস? প্রণয়ের গায়ে যেন একটা আঁচও না লাগে।”
আজমীর হিংস্রভাবে প্রিয়ন্তীকে ধাক্কা দিল। প্রিয়ন্তি উল্টো হয়ে ব্যস্ত সড়কের মাঝে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। প্রণয় তাকে দুইহাতে আগলে ধরল। সবাই এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে উঠল। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো আজমীরের দিকে। ফায়েজ হৈ হৈ করে বলল,” ওই, এটা কি করলি তুই? যদি ওর কিছু হয়ে যেতো?”
আজমীরের ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি তখনও প্রণয়ের দিকে স্থির। প্রণয় আচমকা এসে আজমীরকে প্রচন্ড বেগে একটা ঘুষি মারল। আজমীর উল্টে পড়ল মেঝেতে। বন্ধুরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। মীম ভয় পেয়ে বলল,” প্লিজ তোরা থাম। ফোর গড সেইক!”
কয়েকজন প্রণয়কে দূরে নিয়ে যেতে লাগল। আর বাকিরা আজমীরকে তুলতে ব্যস্ত হলো।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু রাতে আজমীর প্রণয়কে ম্যাসেজ করল,” যদি সাহস থাকে তাহলে আজকে এগারোটার পর আমার এলাকায় আসবি গাড়ি নিয়ে। আধাঘণ্টার একটা রেইস হবে। তোকে চ্যালেঞ্জ করছি।”
প্রিয়ন্তী এবং বাকি বন্ধুরা তখন প্রণয়ের সাথেই ছিল। তার জন্মদিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তখন এই ম্যাসেজটি দেখে প্রিয়ন্তী অস্থির হয়ে বলল,” খবরদার প্রণয়, তুই কিন্তু যাবি না। ও তোকে ট্র্যাপে ফেলতে পারে।”
প্রণয় ত্যাড়া গলায় বলল,” আমি অবশ্যই যাবো। ও কি মনে করেছে?”
প্রিয়ন্তী শক্ত করে প্রণয়ের হাত চেপে ধরল। দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমি তোকে জীবনেও যেতে দিবো না।”
” তুই আমাকে যেতে না দেওয়ার কে?” ঝারি মেরে হাত ছাড়াল প্রণয়। প্রিয়ন্তী কোমল দৃষ্টিতে বলল,” আমার দোহাই, তুই যাবি না।”
প্রণয় সবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়ন্তীও তার পিছু এলো। অনুরোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” তুই প্রমিস করে বল যে যাবি না! আর গেলেও আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”
প্রণয় এবার অধৈর্য্য হলো। ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,” তুই এসব কি শুরু করেছিস? সবাই তোকে আর আমাকে নিয়ে উল্টা-পাল্টা ভাবে তোর এমন আচরণের জন্য।”
প্রিয়ন্তী থতমত খেয়ে বলল,” মানে? আমি কি এমন করলাম? ফ্রেন্ড হিসেবে কি আমি তোর টেইক কেয়ার করতে পারি না?”
প্রিয়ন্তী আলতো স্পর্শে তার গালে হাত রাখল। প্রণয় হাতটা সরিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” এটাকে টেইক কেয়ার বলে না।”
” তাহলে কি বলে?”
” বাড়াবাড়ি করা বলে।”
প্রিয়ন্তী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। প্রণয় তার কথাটা বলেই চলে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গ প্রিয়ন্তী চিন্তা করতে লাগল, আসলেই কি বাড়াবাড়ি করছে? অল্প-স্বল্প বাড়াবাড়িতে ক্ষতি নেই তবে!
এগারোটার মধ্যে আজমীরের বলা জায়গায় পৌঁছে গেল প্রণয়। আজমীরও সেখানেই অপেক্ষারত ছিল। ঠিক এগারোটা দশমিনিটে তাদের মধ্যে শুরু হলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। গাড়ি নিয়ে কে কার আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। যথারীতি আজমীর মাঝপথে থেমে গেল। আর প্রণয়ের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়ে গেল।
তুলিরা একত্রে কার্ড খেলছিল। তাদের সঙ্গে টিনা, অবনী আর মীরাও আছে। পরিকল্পনা ছিল সারারাত গ্রুপ স্টাডি করবে। সামনে পরীক্ষা। কিন্তু পড়াশুনা বাদ দিয়ে কার্ড খেলা চলছে। তুলি সবার আগে জিতে গেল। এবার সে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” তোরা খেল। আমি যাই।”
রাইফা প্রশ্ন করল ঝটিতে,” কই যাস?”
তুলি হাই তুলে বলল,” ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আমি এখন কফি খেয়ে পড়তে বসবো।”
তন্বি পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” রাতে কফি খেয়ে ঘুম তাড়ানো ঠিক না। এখন ঘুমিয়ে নে। সকালে পড়িস।”
রাইফার মোবাইলটা তখনি বাজল। সে মোবাইল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেল। তুলি বিছানা বালিশ গুছিয়ে শোয়ার জন্য প্রস্তুত। ঠিক সেই সময় রাইফা বারান্দা থেকে বের হলো একটি দুঃসংবাদ নিয়ে। প্রণয় এক্সিডেন্ট করেছে।
টিনা আৎকে উঠে বলল,” প্রণয় মানে? কোন প্রণয়? আমাদের কোচিং-এর ভাইয়া?”
রাইফা ইচ্ছাকৃতই মিথ্যা বলল,” না। তুই চিনবি না। আমাদের প্রতিবেশী। তুলির সাথে ভালো সম্পর্ক। তুলি, যাবি নাকি তুই?”
তুলির হাত থেকে মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাটটা অনায়াসে পড়ে গেল। স্থবির হয়ে যাওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে,” কোথায়?”
” হসপিটালে।”
তুলি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। তার হাত-পা কাঁপছে ভীষণভাবে। রাইফা নিচু হয়ে তুলিকে ধরে বলল,” মিষ্টি আপু ফোন করেছিল। তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
#বেদনার_রঙ_নীল
বাইশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
ঘড়িতে এখন আড়াইটা বাজে। নিঝুম রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন নীরব শহর। নাইট গার্ড ছাড়া সড়কে মানুষ নেই। তুলি দাঁড়িয়ে আছে তৃতীয় তলার করিডোরের কার্নিশ ঘেঁষে। শীতল বাতাস তার গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার ভালো লাগছে।
রাইফার কাছে যখন ফোন এসেছিল তখন রাত বারোটা বাজে। তারা দেরি না করে বেরিয়ে পড়েছিল। তুলি উন্মত্ত ছিল। তন্বিও আসতে চাইছিল কিন্তু সূচির ঘুম ভেঙে গেলে যাতে সে পরিস্থিতি সামলাতে পারে এই অযূহাতে তাকে আনা হয়নি!
হসপিটালে আসার পর দেখা গেল অনেক ভীড়। প্রণয়ের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এসে হুলুস্থুল অবস্থা এখানে। পুলিশ পর্যন্ত হাজির। আজমীরকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। প্রণয়ের বয়স্ক ফুপু কপাল চাপড়ে এমনভাবে কাঁদছিলেন যেন বেচারা ম-রে গেছে৷ তুলি এই অবস্থা দেখে আতঙ্কে আরও অস্থির হয়ে পড়ল। তারপর মিষ্টি এসে জানাল প্রণয় ভালো আছে তবে ঘুমাচ্ছে। অজান্তা দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন,” তোমরা এতোরাতে কেন আসতে গেলে?”
তুলি মিষ্টির দিকে তাকাল,” আপু, আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।”
মিষ্টি অবাক হয়ে গেল। সে বলল,” আমি? কই নাতো! আমি শুধু রাইফাকে জানানোর জন্যে ফোন করেছিলাম। তখন রাইফাই বলল সে আসছে। তোমাকে নিয়েও যে আসবে বুঝিনি। তবে থ্যাংকস আসার জন্য।”
তুলি আঁড়চোখে রাইফাকে দেখল। রাইফা জীভ বের করে হাসল। অর্থাৎ সে মিথ্যা বলে তুলিকে এইখানে এনেছে। তুলি অবশ্য এই নিয়ে রাগ দেখাল না। সে নিজেই আসার জন্য অস্থির ছিল। রাইফা না বললেও এসে পড়তো।
যেখানে পুলিশ জেরা করছে সেখানে গিয়ে জানা গেল প্রিয়ন্তী নামের একটি মেয়ে প্রণয়ের জান বাঁচিয়েছে। সে পেছনেই ট্যাক্সিতে ছিল। যদি ওইসময় দ্রুত পদক্ষেপে সে প্রণয়কে হসপিটালে না আনতো তাহলে ঝামেলা হয়ে যেতো। আজমীর তার বিভিন্ন কথার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইছে এটা এক্সিডেন্ট। তবে প্রণয়ের বন্ধুরা সাক্ষী হিসেবে তার সাথে প্রণয়ের ঝামেলার কথা জানালো। এখানে যেহেতু ঝামেলার মূল উদ্যোক্তা তুলি, তাই তাকেও ডাকা হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তুলি যা সত্যি তাই বলে দিল। পুলিশ পুরো ঘটনা এমনভাবে শুনছিলেন যেন খুব উপভোগ করছেন। তুলির অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। ইন্সপেক্টর একবার জিজ্ঞেস করলেন,” আপনার সাথে এখন প্রণয় আহসানের কি সম্পর্ক? ”
তুলি উত্তর দেওয়ার আগেই রাইফা আগ বাড়িয়ে বলল,” গার্লফ্রেন্ড।”
তখন ইন্সপেক্টর বিভ্রান্ত হলেন।
” এটা কিভাবে হয়? তাহলে ইনি কে? ইনিও প্রণয় আহসানের গার্লফ্রেন্ড।”
প্রিয়ন্তীর সাথে তুলির তখনি প্রথমবার দেখা। প্রিয়ন্তী মনে মনে তুলিকে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল। তারপর চুলের মুঠি ধরে বলল,” তামাশা দেখতে এসেছো এখানে? তোমার জন্যই প্রণয়ের এই অবস্থা। ফালতু মেয়ে!”
ইন্সপেক্টর ডাকলেন,” মিস প্রিয়ন্তী, আপনার সাথে প্রণয় আহসানের সম্পর্ক কি?”
প্রিয়ন্তীর সম্বিৎ ফিরল তখন। তুলিকে দেখে উল্টা-পাল্টা ভাবনা মাথায় এসে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা অস্বস্তিজনক। প্রিয়ন্তী নিজেকে সামলে বলল,” জাস্ট ফ্রেন্ড।”
” ওহ আচ্ছা স্যরি। তাহলে আমারই ভুল হয়েছিল। আমি তখন শুনেছিলাম গার্লফ্রেন্ড।” ইন্সপেক্টর খানিক লজ্জিত হলেন। তুলি তখন প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আর প্রিয়ন্তী তুলির দিকে। তারা কি ভাবছিল নিজেরাও জানে না হয়তো।
আজমীরকে থানায় নেওয়া হলো। সে যাওয়ার আগে তুলি সবার সামনেই তার কলার ধরে বলল,” আপনাকে আমি ছাড়বো না আজমীর ভাই। আপনি মারাত্মক ভুল করেছেন। এতোটা জঘন্য হবেন আশা করিনি।”
আজমীর নরম সুরে বলল,” তুলি তুমিও সবার মতো আমাকে ব্লেইম করছো।”
তুলি চেঁচিয়ে বলল,” শাট আপ৷ একটা শব্দও শুনতে চাই না আপনার মুখ থেকে। ”
আজমীরকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তার বিরুদ্ধে ‘এটেন্ড টু মার্ডার’ এর অভিযোগ করেছে সবাই। তবে বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিল আজমীর প্রণয়কে মে-রে ফেলতে চায়নি। সে ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে।
ধীরে ধীরে সবাই চলে যেতে লাগল। হসপিটাল ফাঁকা হয়ে গেল। তুলিকে একাকি করিডোরের কোণায় দাঁড়ানো দেখে মিষ্টি বলল,” চলে যাও তুলি। আর থেকে কি করবে?”
মিষ্টির এমন প্রশ্নে তুলি হতবাক। একবার প্রণয়ের সঙ্গে দেখাও হলো না। সে কিভাবে চলে যাবে? অবশ্য তুলির মনের অবস্থা মিষ্টির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে শান্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,” রাইফা কোথায় মিষ্টি আপু?”
” রাইফাকে দিয়ে ছোটমাকে বাড়ি পাঠাবো। শান বাড়িতে একা। তুমিও চলে যাও।”
” হসপিটালে কে থাকবে তাহলে?”
মিষ্টি মিষ্টি হেসে বলল,” এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না৷ আমি আছি, প্রণয়ের বন্ধুরা আছে। ওরাই দেখবে।”
বন্ধু বলতেই তুলির সর্বপ্রথম মাথায় এলো প্রিয়ন্তীর কথা। মেয়েটির প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধ হওয়া উচিৎ। কারণ সে ছিল বলেই প্রণয় ভালো আছে, বেঁচে আছে। সে না থাকলে কি হতো? তবে অদ্ভুতভাবে, তুলির মন থেকে কৃতজ্ঞতাটা আসছে না। সে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে। তুলি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি এখানে থাকতে চাই আপু। প্লিজ?”
” আচ্ছা। সমস্যা নেই থাকো।”
রাইফা তুলিকে বিদায় জানিয়ে অজান্তাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে বলল,” আমি দ্রুত ফিরে আসবো। তুই থাক।”
কিন্তু রাইফা আর ফিরে এলো না। সকাল হয়ে গেল। মাঝরাতে মিষ্টি জোর করে তুলিকে গাড়িতে এনে ঘুম পাড়িয়েছিল। ভোরে ঘুম ভাঙার পর সবার আগে তুলি প্রণয়কে দেখতে ছুটে এলো। কিন্তু সে দেরি করে ফেলেছিল। প্রিয়ন্তী ইতোমধ্যে প্রণয়ের কেবিনে উপস্থিত। সে প্রণয়কে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। প্রণয়কে দেখে বোঝাই গেল না তার এক্সিডেন্ট হয়েছে। শুধু বামহাতের মাসলে আর কপালে ব্যান্ডেজ। গালের কাছে একটু কেটে গেছে। এই অবস্থাতেই প্রণয় হাসছে। তাকে অত্যন্ত খুশি দেখাচ্ছে। প্রিয়ন্তী বলল,” নড়বি না খবরদার। তোর পায়ে মালিশ লাগাচ্ছি।”
প্রণয় রসিকতা করে বলল,” আপনার আদেশ শিরধার্য।”
প্রিয়ন্তী হাসল। প্রণয় আবার বলল,” সকাল থেকে একটার পর একটা আদেশ করেই যাচ্ছিস। এখন থেকে কি আমাকে তোর আদেশ মতোই চলতে হবে?”
” অবশ্যই। তোর জীবন আমি বাঁচিয়েছি। তাই এখন তোর জীবন আমার হয়ে গেছে।”
” তাই নাকি? এইটা আবার কেমন রুল?”
“এটা এমনি রুল। এবার হাঁ কর।”
” তোর হাত থেকে ঔষধের গন্ধ আসছে। আমি আর তোর হাতে খাবো না। স্টে অ্যাওয়ে।”
” আচ্ছা বাবা। তাহলে নিজের হাতে খা।”
” আর খাবোই না। গালের এই সাইডে এখনও জ্বলছে। চাবানোর সময় ব্যথা লাগে।”
” ওহহো! আগে বলবি না এটা? বরফ নিয়ে আসছি দাঁড়া।”
” লাগবে না।”
” অবশ্যই লাগবে। ”
প্রিয়ন্তী ছুটে বের হলো বরফ আনতে। তুলি দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ইচ্ছে করল প্রিয়ন্তী বের হতেই পাটা বাড়িয়ে দিতে। তুলির পায়ের সাথে উষ্টা খেয়ে ধপ করে মেঝেতে উল্টে পড়ুক প্রিয়ন্তী। কিন্তু ইচ্ছে হলেই সব করা যায় না।
প্রিয়ন্তী চলে যাওয়ার পর তুলি ভেতরে প্রবেশ করল। প্রণয় তুলিকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল,” আরে, আপনি কখন এলেন?”
তুলি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলল,” আমাকে না ‘তুমি’ করে বলতেন? আমি তো আপনার স্টুডেন্ট!”
” স্টুডেন্ট তো ক্লাসরুমে। এটা ক্লাসরুম না।”
” ও। ভুলে গেছিলাম। আপনি কেমন আছেন এখন?”
” ভালো ছিলাম না। কিন্তু এখন অনেকটা ভালো বোধ করছি।”
তুলি মুচকি হেসে জানতে চাইল,” এখন ভালো বোধ করার কারণটা কি?”
প্রণয় মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,” কারণ রাতে অনেক ভালো ঘুম হয়েছে।”
তুলির হাসি নিভে গেল। সে প্রণয়ের কাছে অন্য রকম উত্তর আশা করেছিল। মিষ্টি এসে তুলিকে দেখেই হাসল।
” তুমি এখানে? আমি আরও তোমাকে ক্যান্টিনে খুঁজে এলাম৷ চলো তুলি, কিছু খেয়ে নিবে।”
তুলি বিরস মুখে বলল,” আমার ক্ষিদে নেই।”
মিষ্টি চোখ বড় করে বলল,” এখন কিন্তু আমার হাতে মার খাবে। রাত থেকে পাগলামি করছো। একটুও ঘুমাতে চাওনি। আর এখন বলছো ক্ষিদেও পায়নি?”
প্রণয় ভ্রু কুচকে বলল,” রাত থেকে মানে? আপনি কখন এসেছেন তুলি?”
তুলি জবাব দেওয়ার আগেই মিষ্টি বলল,” কালরাত বারোটায় এসেছিল রাইফার সাথে। রাইফা তো ছোটমাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। আমি ওকেও যেতে বললাম, কিন্তু গেল না কিছুতেই। তোর সঙ্গে দেখা করেই নাকি যাবে।”
প্রণয় তুলির দিকে তাকিয়ে রইল। তুলি লজ্জায় অস্থির হয়ে বলল,” চলো আপু নিচে যাই৷ আমার ক্ষিদে পেয়েছে এখন।”
মিষ্টি হেসে বলল,” আসো।”
তুলি চলে যাওয়ার সময় প্রণয় ডেকে বলল,” একটু দাঁড়ান।”
তুলি দরজার কাছে গিয়ে থামল। মিষ্টি ততক্ষণে বের হয়ে গেছে। তুলি না তাকিয়েই প্রশ্ন করল,” কিছু বলতে চান?”
” আপনি সারারাত এখানে কেন ছিলেন? মানে কি করেছেন?”
তুলি ইতস্তত করে বলল,” রাইফার আমাকে নিতে আসার কথ ছিল। সে আসেনি। তাই আমি যেতেও পারিনি। ”
প্রণয় মৃদু হাসল। সেই হাসি দেখতে পেল না তুলি। তবে সে আন্দাজ করতে পারল যে প্রণয় হাসছে। প্রণয়ের পরবর্তী প্রশ্ন শুনেই তা বোঝা গেল। সে বলল,” শুধু রাইফা আসেনি বলেই আপনি যাননি? অদ্ভুত! ”
তুলি বিব্রত কণ্ঠে বলল,” রাইফা না এলে আমি কার সঙ্গে যাবো? এতোরাতে একা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”
” ওকে। বুঝলাম। আপনি তাহলে রাইফার জন্যই যাননি।”
” আপনি আর কিছু না বললে আমি কি যাবো? মিষ্টি আপু চলে গেছে।”
” যান।”
তুলি বের হতে নিলেই প্রিয়ন্তীর সঙ্গে দেখা হলো। হাতে করে দু’টো আইসক্রিম নিয়ে এসেছে সে। তুলির উদ্দেশ্যে বলল,” আরে তুলি, তুমি কখন এলে?”
” এইতো। একটু আগে।”
” চলে যাচ্ছো? তোমার সাথে তো ভালোমতো আলাপও হয়নি। আইসক্রিম খাবে?”
” না। থ্যাংকস।”
” ওয়েলকাম।”
তুলি বেরিয়ে এলো। প্রিয়ন্তী প্রণয়ের কাছে যাচ্ছে। তুলি কৌতুহল সামলাতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। প্রিয়ন্তী প্রণয়ের গালে আইসক্রিম ঘঁষছে। প্রণয় জিজ্ঞেস করল,” দুইটা আইসক্রিম কেন?”
” একটা তোর আরেকটা আমার।”
” আমি কি তোকে বলেছি যে আইসক্রিম খাবো?”
” খাবি না?”
” না।”
” ঠিকাছে তাহলে দুইটাই আমার। আমি বসে খাবো আর তুই আমাকে দেখবি।”
তুলি বিষণ্ণমনে স্বগতোক্তি করল,” কেন তোকে দেখতে হবে? তুই কি বিশ্ব সুন্দরী? ছাগী কোথাকার!”
চলবে
চলবে
গ্রুপ- Sidrat’s story land❤গল্পের সিড়ি❤