১.
ভর সন্ধ্যায় খান পরিবারের সকল সদস্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, শিউলির হাত থেকে কাঁচের শো পিসের শব্দে সবাই জড়ো হয়েছে।কেননা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার এরকম কান্ডে, শিউলি যেন জীবন্ত মুর্তি হয়ে গেছে, চোখ দুটো যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে।
এরমধ্যেই শিউলির শাশুড়ি রাহেলা বেগম বলে উঠলো – হা রে খোকা, তোর পাশে এরকম বউয়ের সং সেজে দিনা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে কেন?
শিউলি মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে, সে তা ভাবছে তা যেন না হয়। কিন্তু শিউলিকে ভুল প্রমাণিত করে শিশির বলে উঠলো – মা , দিনা কোনো সং সাজে নাই, আজ দিনা আর আমি কাজি অফিসে বিয়ে করেছি। শিউলির মতো দিনা ও আমার কাগজ কলমে বিয়ে করা বউ।
শিশির কথাটা যত সহজে বলে ফেলল অপর পাশে শিউলির মেনে নেওয়াটা আরো বেশি কষ্টকর। শিউলির কলিজা টা যেন দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে।
শিশির কথাটা শেষ করতেই রাহেলা বেগম শিশিরকে কষে একটা চড় দিলো। শিশির চোখ বুজে সহ্য করে নিল। শিশির জানতো পরিস্থিতি এরকমই হবে। শিশির চোখ মেলে শিউলির দিকে তাকালো, শিউলি এতোক্ষণ এ অশ্রু মাখা চোখে তাকিয়ে ছিল শিশিরের দিকে, দুজনের চোখে চোখ পড়তেই শিউলি কাঁচ এর উপর দিয়ে দৌড়ে উপরে চলে গেল।
শিশির এর বোন শায়মা চিল্লিয়ে বলল-এমা, রক্ত,কত রক্ত। মা ভাবি মনে হয় কাঁচের উপর দিয়ে দৌড়ে গেছে, দেখো রক্তমাখা পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শায়মার কথা শেষ হতেই শিশির দিনাকে দরজার সামনে রেখে ই ঘরের ভেতর দৌড় দিল।শায়মার পিছন পিছন শিশির দৌড়াচ্ছে। শায়মা সোজা ছাদে গিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিলো। শিশির দরজা ধাক্কাচ্ছে।
দিনাকে এভাবে শিশির দরজার সামনে ই ফেলে চলে যাবে দিনা কল্পনা ও করতে পারে নাই। দিনা মনে মনে ফুঁসে ওঠে শিউলির উপর , শিউলিকে এর উপযুক্ত শাস্তি সে দিবেই।
দিনার ভাবনার মাঝেই শায়মা ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলো দিনাকে, বলল- তোমার লজ্জা করলো না দিনা আপু, আমার ভাই আর ভাবির সংসার টা ভাঙতে। কতবার বলেছি, আমাদের সংসার থেকে দূরে থাকো। মায়ের মতই শকুনী হয়েছো, যেদিক যাও সেদিক ই ধ্বংস লীলা শুরু করে দেও। বেহায়া নির্লজ্জ মেয়ে।
শায়মার কথায় দিনা ক্ষেপে গেল। চোখ গরম করে যেই কিছু বলতে যাবে তখনই রাহেলা বেগম আরেক গালে ঠাস করে একটা চর লাগালো। রাহেলা বেগম গর্জে উঠে বলল – এই পরিবারে আমি এখনো বেঁচে আছি, তোর লজ্জা করে না, লজ্জা তো দূর তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই আমার সামনে আমার মেয়েকে চোখ রাঙাস। সাহস তো কম নয়, বের হ আমার ঘর থেকে, এই বিয়ে আমি মানি না।
রাহেলা বেগম এর কথা দিনার রাগে ঘি ঢেলে দিল। দিনা বলল – তোমরা মানো আর না মানো আমার বিয়ে শিশিরের সাথে হয়ে গেছে, আর রইলো মানা মানির কথা, তোমাদের মানা মানিতে আমি দিনা রায় ওপস দিনা শিশির খান পরোয়া করি না। আপনারা যদি আমার গায়ে পরে ঝগড়া করতে চান তাহলে আমি আপনাদের ও ছাড়বো না, নারী নির্যাতন এর মামলায় জেলের ভাত খাওয়াবো। মাইন্ড ইট।
বলেই দুজনের মধ্যে দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ড্রইংটেবিলের সোফায় বসল।
মিনিট দুয়েক পর শিশির দৌড়ে নিচে নামল, শায়মাকে বলল – শায়মা , ছাদের এক্সট্রা চাবি টা দে। সাথে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে আয়। শিউলির কিছু হবে না, আমি হতে দিব না।
দিনা- আমাকে এভাবেই বাসায় এনে অপমান করবে জানলে আমি না হয় আসতাম না, আর এই অবস্থায় (পেটে হাত রেখে) এভাবে জার্নি করে, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে ( বলেই দিনা সোফায় ঢলে পড়ে)
সায়মা – ভাই , এই নে ফাস্ট এইড বক্স।আর ডুপ্লিকেট চাবি।
শিশির দ্বিধায় পড়ে যায়। এই মুহূর্তে তার শিউলির কাছে যাওয়া উচিত তবে এই মুহূর্তে দিনার ও তার প্রয়োজন। শতহোক দিনা তার অনাগত সন্তানের মা। এই সন্তানের জন্য ই তো সে আর শিউলি কত কিছু করছে। আল্লাহ মুখ তুলে চায় নি। তবে দিনাকে আল্লাহ তার জীবনের ফেরেস্তা হিসেবে পাঠিয়েছে, হোক না দিনা তার ২য় বউ, সন্তান দিনার মাধ্যমে না হয় আসুক। শিউলি ও মা হওয়ার অনুভূতি টা পাবে। কি হবে তার দুটো বউ থাকলে। দুজনকে ই না হয় সমান ভালোবাসা দিবে।(writer -NE El Noor)
সায়মার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে পকেটে রেখে,শিশির দৌড়ে দিনার কাছে গেল, দিনাকে কোলে নিয়ে দ্রুত তার রুমে নিয়ে গেল। ডা. কে কল দিল। এতক্ষণ সে দিনার হাত পা ঘসছিল। রাহেলা বেগম আর সায়মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে শিশির এর কর্মকান্ড। মিনিট দশেক পর ডা. এলো । ডা. চেকাপ করছে।
শিশির দৌড়ে ছাদের দিকে যায়। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখল, দেওয়ালের একপাশে ঠেস দিয়ে শিউলি বসে আছে। শিশির দৌড়ে কাছে গেল। শিউলিকে ধরতেই শিউলি শিশিরের উপর ঢলে পড়লো। শিশির শিউলির মুখে হাত রেখে চমকে গেল, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, পায়ের থেকে রক্ত বের হয়ে জমাট বেঁধে গেছে। শিশির ভয় পেয়ে যায়, যা কিছু হয়ে যাক না কেন, শিশির শিউলিকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। শিশির যা ই করুক না কেন, শিউলি কে তা মেনে শিশির এর সাথেই থাকতে হবে।
শিশির শিউলিকে পাজা কোলে রুমে নিয়ে আসে ।দিনার পাশে শুইয়ে দেয়। ডা. তারাতাড়ি ক্ষতস্থান পরিস্কার করে, ঔষধ দিয়ে দিলো।
ডা. বললো – দুজনের অবস্থা একটু নমনীয়। খুব করে খেয়াল রাখতে হবে। এসময় যত্নই সব কিছুর সমাধান। আমি ঔষধ দিয়েছি সকালের মধ্যেই দুজন ঠিক হয়ে যাবে।
চলি।
ডা. কে বিদায় দিয়ে, শিশির ঘরে ঢুকে।রাত ১০ টার বেশি বাজে।
রাহেলা – শিশির, শিউলি কে আমার রুমে দিয়ে আয়।
শিশির – না মা, আমার বউদের আমি ই খেয়াল রাখতে পারব।
শিশির এর কথায় শায়মা শিশির কে ভেঙছি দিয়ে চলে যায়।রাহেলা বেগম দুটো চোখ বন্ধ করে শান্ত হলো তারপর বললো – শিশির তোকে একটা কথা বলবো ? তুই দুই দুই নৌকায় পা দিয়ে চলসিস। কখনো এ যাত্রায় সফল হবি না। আমি তোকে মানুষ করতে পারিনি।
শিশির মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল – মা আমি সব ঠিক করে দিব। বিশ্বাস কর। মা তুমি খুব শীঘ্রই দাদি হতে যাচ্ছো। তুমি জানো মা, দিনা প্রেগনেন্ট।
রাহেলা বেগম চমকে উঠল, কিন্তু ছেলের সামনে প্রকাশ করলো না।
শিশির – আমার সন্তান আসবে, আমাদের বংশের প্রদিপ আসবে, তুমি খুশি হও নি?
রাহেলা বেগম – খুশি? (মুখটা মলিন করে)তুই খুব মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলছিস।মা হয়ে সন্তানের এই পতন দেখবো। হয়তো জীবনে কোন এক সময় পাপ করেছিলাম। যেই রত্ন তুই অন্যতে খুঁজসিস, সেটা হালাল ভাবে তুই পেয়ে ও হারিয়ে ফেললি। তবে একটা কথা মাথায় রাখিস, শিশির হয়তো প্রতি রাতে হাজারো কলি শিউলি ফুল কে ফুটায়, তবে প্রতিটি শিউলি ফুল একবার ই শিশিরে ভিজে।
রাহেলা বেগম চলে গেল। শিশির মায়ের কথাগুলো বুঝলো না। সে বুঝতে পারলো না, মা কেন কথাগুলো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল। শিশির রুমের সোফায় বসল। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল।
ফজরের আযানের ধ্বনি শুনে শিউলির ঘুম ভেঙ্গে।পাশে তাকাতেই….
চলবে…
#ফোটা_শিউলি_ফুল_একবারই_শিশিরে_ভেজে
#Writer_NE_EL(Noor)
#Neel
(