#মেঘফুল_ফুটলো_মনে
#অন্তিম_পর্ব [সিজন -১]
#লেখনীতেঃ- আবরার আহমেদ শুভ্র
মেঝেতে পড়ে আছে অথৈ। দুদিন কিছু আহার না করাতে দূর্বল হয়ে গেছে অথৈয়ের শরীর। তাই তো সেন্সলেস হয়ে গেছে সে। তানিম হতদন্ত হয়ে ছুটে গেলো তার কাছে। মনে মনে নানারকমের বাজে চিন্তাভাবনা ঘুরাফেরা করছে তার সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে। মনটা তার বারংবার কু’ডাক গায়ছে। ফোন হাতরে কোনোরকমে সে ডায়লে ফুয়াদের নম্বরে ডায়াল করা মাত্রই রিসিভ করলো ফুয়াদ। এদিক থেকে তানিম কোনোরকমে বলে উঠলো,
–ফুয়াদ অথৈ, অথৈয়ের অবস্থা ভালো না একটু রুমে আয় ভাই।
কিন্তু ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না৷ কয়েক মুহুর্ত পর দ্রুত শায়লা বেগমকে সাথে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো ফুয়াদ। সামান্য চেক-আপ করার পর ফুয়াদ তানিমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
–ভাইয়া, ওর শরীর প্রচন্ড দূর্বল তাই সে সেন্সলেস হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রচুর পরিমানে পেনিক ছিলো সে তাই তার এমন অবস্থা। সে মেন্টালি খুবই উইক। সো প্রপারলি যত্ন নিলে ইনশা’আল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে না। তাছাড়া ওর খাবারের প্রতি খেয়াল রেখো সবসময়। জানোই তো, তোমারই বউ! হারিয়ে গেলো পরে কাঁদবে আবার ছোট বাচ্চার মতোন। দেখিও সাবধান!
বলে মুচকি হাসি দিয়ে তানিমের দিকে তাকালো ফুয়াদ। তানিম বেচারা লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে আছে শায়লা বেগম আছে বলে। তানিমের ছোট চাচি অর্থাৎ তানজিমের মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুখটিপে হেসে তানিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–থাক ফুয়াদ, এমন করে কেউ লজ্জা দেয়। ওর বউয়ের যত্ন ও নিবে, সেটা কি আর তোরে বলতে হবে রে ফাজিল ছেলে। তা বল, তোর বউয়ের যত্ন তুই নিতে পারবি তো? আমার মেয়েকে সুখে রাখতে পারবি তো?
শায়লা বেগমের কথায় চমকালো ফুয়াদ। আর অবাক হলো তানিম। কিন্তু এক্ষেত্রে সে ভুল বুঝলো ফুয়াদকে। ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
–তানভিন এখনও ছোট তার উপর ওর স্টাডি লেভেল তুই চিন্তা করছিস ফুয়াদ? একটাবার ওর বয়স আর তোর বয়সের দিকটা চিন্তা কর ভাই। সে এখনো খুব…
তানিমের কথার মাঝে বাধা দিলেন শায়লা বেগম। খানিকটা রেগে তিনি বলে উঠলেন,
–আহ্ তানিম, তুই খামোখা ফুয়াদকে ভুল বুঝছিস! আমার মেয়ে মানেই কি শুধু তানভিন? তানজিম কি আমার মেয়ে নয়? হা আমার গর্ভে সে আসে নি! তাই বলে কি? যায়হোক, আমার বড় মেয়ের কথাই বলছি। তিনি আর ফুয়াদ সাহেব খুব শীঘ্রই একত্র হতে চলেছেন। বুঝলি?
এবারও চমকালো ফুয়াদ। আর তানিম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে মনে মনে বেশ খুশি হলো সে। কারণ, তানজিম তার জীবনে একজন কেয়ারিং পার্সনকে পাবে। তার ভাবনার মাঝে ফুয়াদ শায়লা বেগমকে অবাকের সুরে বলে উঠলো,
–ছোটাম্মি তুমি জানো কেমনে এসব? আমি তো কখনো কেউকে এগুলো বলি নি? যা শুধুই আমার আর তানজিমের জানা। কিন্তু তুমি?
হালকা হাসলেন শায়লা বেগম। তারপরে বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
–আমি একজন মা, আর মা হয়ে মেয়ের কথা জানবো না এটা কি কখনো হয়? তুইই বল? আর তানজিমের সাথে আমার সম্পর্ক মা মেয়ে নয়, ফ্রেন্ডের মতোন। সে সব কথায় আমাকে শেয়ার করে সবসময়। তাছাড়া যখন তুই ওর কেয়ার করতি তখনো সে বলতো আমাকে, যে তোর মতোন একজন কেয়ারিং পার্সন যদি তার জীবনে আসতো তাহলে হয়তো সে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতে পারতো। কিন্তু তুই আমার মেয়েকে কষ্ট দিবি না….
শায়লা বেগমের কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটলো ফুয়াদ,
–ছোটাম্মি জানি না তুমি ব্যপারটি কেমন নিবে তবুও বলছি যাকে আমি ছোট্টবেলা থেকেই পছন্দ করতাম, সবসময় যেকোনো মুহুর্তে যার যত্ন নিতে ভুল করতাম না তাকে কেমনে আমি কষ্ট দিবো? সে আমার অস্তিত্বে মিশে আছে ছোটাম্মি। ভালোবাসি আমি তাকে!
দরজার বাইরে থেকে ফুয়াদের বলা সবটা কথা শুনে ফেললো তানজিম। খুশিতে তার চোখে জল এসে গেলো। মনে মনে ভাবছে সে,
–এমন সুখ আমার কপালে সইবে তো? নাকি ক্ষনিকের জন্যে এমন সুখে দেখা মিলেছে আমার জীবনে? তবে আল্লাহ যা করেন ভালোই করেন।
বলে সে নিজের কামরায় চলে গেলো।
____________
শিকলবদ্ধ অবস্থায় কাতরাতে কাতরাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মৃন্ময়। পিঠের চামড়াটা একেবারেই বিছানায় লেগে গিয়েছে গ্লুু’র মতোন। একটুখানি পিঠ উঠালেই ব্যথায় চিৎকার করে কাতরে উঠছে পুরো শরীর। খাটের চারকোণে চারটি শিকল দিয়ে বাঁধা তার হাত পা জোড়া। আজ একমাস একুশদিন টানা এমন অবস্থায় রাখা হয়েছে তাকে। শুধু একজন গার্ড এসে তিনবেলা ডাল আর ভাত দিয়ে যায় খাওয়ার জন্য। কোনোমতে সেগুলো খেয়ে সে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করে। সে জানে না তাকে এমন করে কে এই অন্ধকার রুমে আটকে রেখেছে। একবার মাত্র সে দেখেছিলো প্রথমদিন এর পর আর দেখেনি সেই মানুষটাকে। সে বুঝতে পারছে এখানে হয়তো তার জীবনের ইতি ঘটতে চলেছে। তা হয়তো খুব শীঘ্রই!
নিঃশ্বাস খুব দ্রুত গতিতে চলছে তার। বারংবার কু’ডাক গায়ছে তার মন। তার মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে তার সাথে। খুব খারাপ কিছু! হয়তো মৃত্যু তার সন্নিকটে বলে মন তার এমন করছে। তার ভাবনার মাঝে রুমে প্রবেশ করলো সেই ব্যক্তিটি। দড়জার দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল মৃন্ময়। বার বার মন বলছে সে তার চেনাজানা কেউ। কিন্তু কোনো মতেই চিনতে পারছে না সে লোকটিকে। লোকটি রুমে ঢোকা মাত্রই মৃন্ময় তার দিকে চেয়ে আর্তনাদের স্বরে বলে উঠলো,
–আমাকে মুক্তি দিন ভাই। কি অন্যায় করেছি আমি আপনার সাথে? কেন আমাকে এভাবে এই অন্ধকার ঘরটিতে আজ এতোটা দিন আটকে রাখছেন?
মৃন্ময়ের কথা শোনে খানিকটা বিরক্ত হলো সে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না কোনো ভঙ্গিমাতে। কিন্তু সে এসে সময় নিলো না বেশিক্ষণ। ঠিক কপাল বরাবর তাক করলো তার ৯এমএম এর বন্দুকটি। ক্ষনিকের মধ্যেই কপাল এফোড় ওফোড় করে চলে গেলো দু দু’টো গুলি। ক্ষনিকের মধ্যেই নিথর হয়ে গেলো শরীরটা। স্ব শব্দে হেসে উঠলো লোকটি! হাসতে হাসতে একপর্যায়ে বলে উঠলো,
–মুক্তি দিলাম তোকে একেবারে চিরজীবনের জন্য। যেখানে আছে শুধু অপার শান্তি। ওপারে ভালো থাকিস।
আমার প্রেয়সীকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি তুই পেয়ে গেছিস। ফুয়াদ কখনোই কোনো কাজ অপূর্ণ রাখে না। গট ইট!
বলে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো রুমটি থেকে। আর যাওয়ার আগে তার গার্ডকে ইশারা করলো সে যেন দ্রুত বডিটা সরিয়ে ফেলে সেখান থেকে।
_____________
রওশন প্যালেস সেজে আজ বাহারি রঙে। মেহমান গমগম করছে পুরো বাড়ী জুড়ে। সাজের আঙ্গিকে বাড়ীটাকে ছোটখাটো রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম লাগছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ীটার পরিবেশ অবলোকন করছে তানজিম। আজ তার আর ফুয়াদের বিয়ে। বিয়েটা ঘরোয়াভাবেই হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু হুটহাট তানভিনের জিদের কারণেই এমন ঝাঁক ঝমক করে করতে হচ্ছে সেটা। একদিকে খুব খুশি তানজিম। কিন্তু মনে তার ভীষণ রকম ভয় কাজ করছে কেন সেটা সে নিজেই জানে না। সারাদিন ব্যস্ততার কারণে কিছু খেতে পারেনি তানজিম। তাইতো তানভিনকে বলেছিলো কিছুক্ষন পর তার জন্যে খাবার নিয়ে আসতে।
কিন্তু তানভিনের আসার কোনো নামগন্ধই নেই। একদিকে খিদে তার পেট চোঁচোঁ করছে আর অন্যদিকে তানভিনের লেট অসহনীয় করে তুললো তানজিমকে। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে যখন রুমে গিয়ে তানভিনকে আবারও কল করতে যাবে তখন রুমের মধ্যে ফুয়াদকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো তানজিম। খাবার হাতে নিয়ে বসে আছে সে। মনে মনে আওড়াতে লাগলো সে,
–এখন তো এখানে ফুয়াদ ভাইয়ের থাকার কথা না। তাহলে কি আমি উল্টা পাল্টা চিন্তার ফল এই!
বলে আবারও ফুয়াদের দিকে তাকালো সে। কিন্তু এবারও ফুয়াদকে তার দিকে কেমন করে চেয়ে দেখতে দেখে ওর ভয় যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। চিৎকার করে উঠলো সে। কিন্তু পাল্টা চিৎকার করতে যাবে এমন সময় ফুয়াদ এসে চেপে ধরল তার মুখখানা। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
–স্টুপিড গার্ল, কেউ এমন ভরা বিয়েবাড়ীতে চিৎকার করে? তাও আবার সেটা যদি কনের রুম থেকে আসে তাহলে বিষয়টা সকলে কেমন করে নিবে ভাবতে পারছিস তুই? ওহ স্যরি বউ, ভাবতে পারছো তুমি?
ফুয়াদের কথায় অবাক হলেও সেটা মোটেও প্রকাশ করলো না সে। উল্টো বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকালো তার দিকে। ফুয়াদ তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। রাগ হলো তার ফুয়াদের এমন হাসি দেখে৷ কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
–লজ্জা করছে না আপনার একটা মেয়ের রুমে এভাবে চলে আসতে? পারমিশন নিয়েছেন?
তানজিমের কথায় ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফুয়াদ বলে উঠলো,
–বউয়ের রুমে আসতে পারমিশন নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি তাই নিও নি? আর পারমিশন না নিলে কি করবে শুনি?
তানজিম বুঝতে পারলো ফুয়াদ তার সাথে ঝগড়া করতে চাইছে, তাই সেও ফুয়াদকে জ্বালানোর জন্যই বলে উঠলো,
–তাহলে বিয়ের পর আমাদের বেডরুমের ডোরে লাগিয়ে দিবো উইথ আউট পারমিশনে সকলে যেকোনো মুহুর্তে যেকোনো সময়েই আমার বেডরুমে প্রবেশকে করতে পারবেন৷ এমনকি আমাদের একান্ত মূহুর্তেও।
বলে জিব কাটিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো সে৷ কি বলবে কি বললো সেটাই ভাবছে সে। লজ্জায় আর ফুয়াদের দিকে তাকাতেই পারছে না সে। ফুয়াদ বুঝতে পারলো তানজিম কথাগুলো মুঝ ফসকে বলে ফেলছে। তার লজ্জামিশ্রিত মুখশ্রী দেখে আবারও প্রেমে পড়ে গেলো ফুয়াদ।
তানজিমকে নিজের দিকে টেনে নিলো ফুয়াদ। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠলো,
–আর মাত্রই কয়েকঘন্টা, তারপর থেকে তানজিম শুধুই ফুয়াদের হবে ইনশাআল্লাহ। যে আমার মেঘ মিশ্রিত মনে প্রেমের ফুল ফুটিয়েছে তাকে নিজের করতে আমি দুনিয়ার সক শক্তির সাথে লড়তে প্রস্তুত ছিলাম। মহান আল্লাহও চেয়েছেন তোমায় আমার করে নিতে। তুমিই আমার #মেঘফুল যা ক্লান্ত মিশ্রিত মনেটাতে মেঘের ন্যায় শান্তির বাতাস বহিয়েছে আর ফুলের ন্যায় কোমল করেছে আমার এই পাথর মনটাকে। সেই #মেঘফুল_ফুটলো_ মনে যে আমার! জানো আমার মেঘফুল যে তুমিই! যা বহিয়ে দিছে আমার মনে প্রেমের বাতাস!
ফুয়াদের কারণে এতোক্ষণ রাগ করে থাকলেও সেটা নিমিষেই মিলিয়ে গেছে তার মনে। কেমন যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। ফুয়াদ বুঝতে পেরে আগলে নিলো তার প্রেয়সীকে৷ শক্ত করে চেপে ধরল নিজের বক্ষপিঞ্জরে। সাথে সাথেই তানজিম কান্না থামিয়ে দিলো ফুয়াদের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দে। হয়তো সেই শব্দগুলো বারংবার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করছে তানজিমের মনে। সারা মস্তিষ্কজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো তানজিমের। অবাক কান্ড করে বসলো সে, ফুয়াদের দু’পায়ের উপর ভার দিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
-ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। আপনি আমার শুরু না হলেও আপনিই আমার শেষ। আপনাতেই আমি সারাটাজীবন মগ্ন থাকতে চাই ডাক্তার সাহেব। আমার দঃখে যেমনটা করে ঠিক আপনায় পেয়েছি আমি আমার সুখের প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকেই চাই আমার। আপনার মেঘফুল হয়েই থাকতে চাই সারাজীবন। রাখবেন কি আমায় আপনার মেঘফুল করে?
ফুয়াদ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না, মুচকি হেসে তানজিমের কানে কানে বলে উঠলো,
–আগে শাস্তি দিয়ে নিবো, তারপরে নাহয় মেঘফুল করে মনের অন্দরমহলের ঠিক মধ্যিখানে রাখবো তোমায়। বুঝেছেন? আর হে, ভালোবাসি কেশবতী! প্রিয় মেঘফুল! তোমায় সারাজীবন আমার মেঘফুল করে রাখতে আমার কোনো আপত্তিই নেই বউ।
#সমাপ্ত ~
[